নিবন্ধ  

আবদুল মান্নান সৈয়দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ,
অলংকরণ : গুগল
 



স্বতঃস্ফূর্ত কাব্য ও বানানো কবিতা
শং ক র  ব্র হ্ম


হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো। চমৎকার হয়েছে। ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।  একটু বসুন স্যার, চা খান, কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের, পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।


রুণ কবিদের জেনে বুঝে নিতে হবে, অণুপ্রাণিত স্বতঃস্ফূর্ত কবিতা আর বানানো কবিতার মধ্যে পার্থক্য। এই সত্য বুঝে না নিলে, তা'রা সাফল্য অর্জন করতে পারবে কিনা সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।

অণুপ্রণিত স্বতঃস্ফূর্ত কবিতার পক্ষে যে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব, সাজানো গোছানো বানানো কবিতার পক্ষে তা হয়তো কখনোই সম্ভব হতে পারে না।

বানানো কবিতা অনেক সময়, আচরণে ও নির্মাণে আকর্ষণীয় মনে হতেই পারে। কিন্তু দীর্ঘকালের প্রচেষ্টায় যে কাব্য সম্পদ আমাদের অধিকারে এসেছে, তার মধ্যে শব্দসম্ভার এক উল্লেখ যোগ্য প্রাপ্তি। ফলে এই শব্দাবলী সাজিয়ে কবিতা লিখতে দেখা যায় অক্ষম কবিরাও আগ্রহ বোধ করছেন, তা'তে আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু বিপদ আসে তখন, যখন সাজানো কবিতা কখনও কখনও অণুপ্রাণিত কবিতার ভেক ধরে, জন সমক্ষে হাজির হয়।


(যা আজকাল প্রায়শই ফেসবুক জুড়ে চোখে পড়ে।)
শুধু তাই নয়, যখন তারা নানা আজগুবী অধিকারও দাবী করে বসেন। তখন এই অবস্থা মারত্মক রূপ নেয়।

কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ -এর সূক্ষ্ম শ্লেষাত্মক এই কবিতাটি পড়লেই তার মর্ম উপলব্ধি করা যায় সহজেই।

“এখানে কবিতা বানানো হয়।  
সব ধরণের কবিতা।  
রাজনীতিক কবিতা, সামাজিক কবিতা।  
নাগরিক কবিতা, গ্রামীণ কবিতা।  
প্রেমের কবিতা, শরীরের কবিতা।  
স্বপ্নের কবিতা, বাস্তবের কবিতা।  
চল্লিশের কবিতা, পঞ্চাশের কবিতা।  
ষাটের কবিতা, সত্তরের কবিতা।  
আশির কবিতাও আমরা বাজারে ছাড়ছি শিগগিরই।  
কবিতার হাত, পা, মাথা, ধড়,  
শিশ্ন, যোনি, চুল, নখ,  
চোখ, মুখ, নাক, কান,  
হাতের আঙুল, পায়ের আঙুল–  
সব-কিছু মওজুদ আছে আমাদের এখানে।  
স্বদেশি ও বিদেশি উপমা ও চিত্রকল্প,  
শব্দ ও ছন্দ,  
অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল  
লক্ষ লক্ষ জমা আছে আমাদের স্টকে।  
ব্যাঙের ছাতার মতো আরো অনেক কবিতার কোম্পানি  
গজিয়েছে বটে আজকাল। কিন্তু,  
আপনি তো জানেনই,  
আমাদের কোম্পানি ইতোমধ্যেই বেশ নাম করেছে।  
আর ফাঁকি দিয়ে কি খ্যাতি অর্জন করা সম্ভব,  
বলুন?  
হ্যাঁ, আপনার অর্ডার-দেওয়া কবিতাটি এই-তো তৈরি হয়ে এলো।  
চমৎকার হয়েছে।  
ফিনিশিং টাচ শুধু বাকি।  
একটু বসুন স্যার, চা খান,  
কবিতার কয়েকটা ইস্ক্রুপ কম পড়ে গেছে আমাদের,  
পাশের কারখানা থেকে একছুটে নিয়ে আসবার জন্যে  
এখখুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি লতিফকে।”
  

বানানো কবিতার কবিরা শব্দের মোহে আকৃষ্ট হয়ে, শব্দ বিন্যাসকেই কবিতা বলে দাবী করে বসেন। 
শব্দ অবশ্যই কবিতার মূখ্য অবলম্বন ও উপাদান, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শব্দই শেষ কথা নয়। এ'ছাড়া বহু বিষয় আছে যা কবিতা নির্মাণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য সত্য।

জীবনান্দ দাশ যখন লিখলেন,
‘ফিরে এসো সুরঞ্জনা;
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;’

এখানে আমরা লক্ষ্য করলেই দেখব, ‘নক্ষত্র, রূপালি, আগুন, ভরা, রাত’-এ সবই আমাদের কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কবি তাকে সাজিয়ে তুললেন। এবং শব্দ হয়ে উঠল ব্রহ্মময়ী! শক্তিময়! কী অপরূপ শব্দ দ্যুতি-দীপ্ত!

কী অসামান্য কল্পনা-জাগানিয়া! প্রতিটি শব্দ যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। নতুন অর্থ-বলয় তৈরি করে হয়ে উঠল অসামান্য। এমনতর-কবিতায় আলাদা কোনও ইঙ্গিত না-থাকলেও, জীবনানন্দ দাশের কবিতার ভাবনা অনুযায়ী, 'তা আমাদের কল্পনার ও সৌন্দর্যবোধের পরিতৃপ্তি ঘটাচ্ছে।'

শব্দ মহৎ শক্তিমান, কিন্ত যখন রূপ-তপস্বীর হাতে না-পড়ে, তা কোনো আনাড়ি খোদাইকরের হাতে পড়ছে, তখন তা হয়ে উঠছে শব্দের জঞ্জাল। যেহেতু যে কোনও শব্দের সাথে যে কোনও শব্দ যুক্ত করে দেবার অধিকার তাঁর আছে, এবং আলাদাভাবে কবিতায় গভীর কোনও ইঙ্গিত সঞ্চারের দায় থেকেও তিনি মুক্ত, নতুন এই নৈরাজ্যের চরাচরে তিনি হয়ে উঠছেন একজন শব্দ-দাস কিংবা শব্দ-দানব। এবং শব্দের সাথে শব্দের এতসব বিয়ের আয়োজন অন্তে তাঁকে দেখাচ্ছে আত্মবিশ্বাসী, সদা-স্মিতহাসির সফল ঘটকের মতো। কিন্তু তাতে এ জগতে কার ক্ষতি? এ-প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেহেতু অসফল শব্দ-ঘটকের সংখ্যাই বেশি এবং তাঁদের উৎপাদনই বেশি পরিমাণে দৃশ্যমান, দ্বান্দ্বিকতার সূত্র অনুযায়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসছে বৈকি। এটাই হয়ে উঠছে কবিতার একমাত্র মার্গ-সাধনার পথ। অন্ততঃ নতুন লিখিয়েরা তাই ভেবে নিচ্ছে। এভাবে চলছে এক অচ্ছেদ্য দুষ্টু-চক্র।


তলস্তয় তাঁর ‘What is art?’-এর শুরুতেই যে প্রশ্ন করেছিলেন, সে প্রশ্ন, বিশেষ করে, এখন, এসব কবিতার শব্দ-জঞ্জাল সম্পর্কে করা যায়, ‘যে শিল্পের বেদীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রম, মানুষের জীবন, সর্বোপরি মানুষের পারস্পরিক ভালোবাসা সবই বিসর্জিত হয় সে শিল্পই ক্রমশ অস্পষ্টতর এবং মানুষের বুদ্ধির কাছে বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠছে।’

এবং আরো বিশেষ করে বললে, প্লেটোর ‘Allegorical cave’এর সেই মানুষদের মতো একটা ছায়া-সত্যকে সত্য জেনে কাটিয়ে দিচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্মের লিখিয়েরা। কত মহৎ প্রতিভার সীমাহীন অপচয়! ‘কী ফুল ঝরিল বিপুল অন্ধকারে!’ এবং ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, এই দুষ্টু-চক্র কীভাবে সভ্যতার এই সময় গ্রন্থিতে প্রধান স্থান অধিকার করে নিতে চাইছে।

শব্দে যদি ব্যুৎপত্তি থাকে, তাহলে অকবির পক্ষেও সাজানো কবিতা নির্মাণ করা অসম্ভব নয়। 

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়। কবিতায় কথাই সব। কথায় কি না হয়? কবিতায় কথা মন্ত্রের মতো কাজ করে। কথার নড়চড় হলে কবিতা একদম দাঁড়ায় না। শব্দের মূল তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত আছে কবিতার মূল কথা। কেননা, শব্দই হল কবিতার মূলাধার।”

মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কবিতার কথা বলতে গিয়ে একেই বলেছেন, ' শব্দে শব্দে বিবাহ বন্ধন।' 
বিবাহ বন্ধন সুন্দর হলে যেমন সংসার সুখের হয়ে ওঠে, তেমনি শব্দ ও শব্দের মিলন সুন্দর হলে, কবিতাও সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে।

বস্তুত, শব্দ বাছাইয়ের পার্থক্য থেকেই এক কবিকে অন্য কবির থেকে আলাদা করে চেনা যায়। মরা শব্দকেও ব্যবহারিক পারদর্শিতায় শক্তিশালী কবি জ্যান্ত করে তুলতে পারেন।
যথার্থ কবির কাছে কথার খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, 
যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে। 

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার বলেছিলেন, "কবির ব্যুৎপত্তি বুদ্ধিতে নয়, উপলব্ধিতে।" এ'কথাও বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার। কবিতায় অনুসন্ধিৎসু প্রাণ না থাকলে, শুধু শব্দের জাবর কাটলেই তা কবিতা হয়ে ওঠে না। এ'কথাটা অনেকেই বুঝতে পারেন না, সমস্যাটা সেখানেই।

কবির লেখা যদি পাঠকরা পড়ে কিছুই না বুঝতে পারে, তবে তারা আগ্রহ বোধ করবে কেন কবিতা পাঠে? তবে সে লেখার সার্থকতা কোথায়?

এই প্রসঙ্গে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে  রবীন্দ্রনাথের পত্রালাপের কথা মনে পড়ছে।

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইতেন, পাঠকের অলস মনের জড়তা কাটাবার জন্য কবিতায় অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করতে। তার যুক্তি ছিল, শব্দ-বাধায় ঠোক্কর খেয়ে, অনেকেই হয়তো ঘরে ফিরবে, কিন্তু তার পরেও যারা এগোবে, তারা অন্তত চলবে চোখ খুলে, কান মেলে প্রতি অগ্র পশ্চাৎ উর্ধ্ব অধঃ দেখতে দেখতে। 

এখানে অলঙ্কারের কথাও বলে নিই কেননা অলঙ্কার চিন্তাকে পরিস্ফূট করার বিশেষ সহায়ক।     
উপমানের সঙ্গে উপমার এত নিবিড় সম্পর্ক যে প্রথমটির স্বভাব অন্ততঃ আংশিক ভাবে হলেও এসে পড়ে। কাজেই উপমার ভিতরেও একটা সামঞ্জস্য, একটা ন্যায় সঙ্গতি না থাকলে মুস্কিল। কিন্তু তাই বলে উপমাগুলিকে গতানুগতিক হতে হবে তার কোন মানে নেই, বরং উল্টোটা হলেই ভাল। সত্যকে নতুন ভাবে দেখতে গিয়ে নূতন রূপকের দরকার হওয়া স্বাভাবিক।

তিনি আরও বলেছেন, যারা কবিতাকে ছুটির সাথী বলে ভাবে, কবিতার প্রতি ছত্র পড়ে হৃদকম্পন অনুভব করতে চায়, তাদের কবিতা না পড়াই উচিৎ। কবিতার গঠন যেমন প্রত্যেক লাইন বিশ্লেষণ করে ধরা যায় না, তার ভাবাবেশও তেমনি খন্ডাকারে দেখা যায় না, বিরাজমান থাকে সমগ্রের মধ্যে।

ভাব শুধু মেঘ বাঁশি প্রিয়া বিরহ মিলন ইত্যাদি জরাজীর্ণ শব্দের করতলগত নয়, শুধু প্রেম বেদনা ও প্রকৃতিকে নিয়েই কাব্যের কারবার চলে না, তার লোলুপ হাত দর্শন- বিজ্ঞানের দিকেও আম্তে আম্তে প্রসারিত হচ্ছে।

এই "বিশেষ জ্ঞানে"-র দিনে কাব্যের তরফ থেকে আমি পাঠকের কাছে, সেই নিবিষ্ট ভিক্ষা করি যেটা সাধারণ অর্পিত হয় অন্যান্য আর্টের প্রতি। 
বুদ্ধিমান অধ্যাবসায়ী পাঠকদের জন্য কবিতা লিখতেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।

রবীন্দ্রনাথের এই মতে সায় ছিল না। তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে জানিয়ে ছিলেন,
" মানুষের মধ্যে, যে লোকটা বুদ্ধিমান তার দাবীর দিকে না তাকিয়ে, যে লোকটা রসবিলাসী তাকে খুশি করার চেষ্টা কর।

বুদ্ধিমানদের জন্য আছেন আইনস্টাইন, ব্রার্টান্ড রাসেল, প্রশান্ত মহালনবিশ, সুনীতি চাটুজ্জে মস্ত মস্ত সব লোক।
অথচ তিনি সর্বদা পাঠকরুচির কাছে আত্মসমর্পণের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাতে সস্তা সাহিত্যের আমদানী ঘটে এই বোধ তার তীব্র ছিল। তার ভাষায়, “আদর্শ রক্ষা করতে গেলে প্রয়াসের দরকার, সাধনা না হলে চলে না।”

কবি জীবনানন্দ দাশের কথায়, “কাব্যে কল্পনার ভিতর, চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা থাকবে।”
কবির যেমন চিন্তা ও চেতনারএক নিজস্ব জগৎ আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাও তার চিন্তা চেতনাকে আলোড়িত করে, প্রভাবিত করে, এবং কবি তা প্রকাশ করেন, তার নিজস্ব কল্পনার মাধ্যমে। এবং সে কল্পনাকে জাগরুক করতে হলে, তাকে আশ্রয় নিতে হয়, কখনও চিত্রকল্পের, কখনও রূপকের, কখনও উৎপ্রেক্ষণের, কখনও ছন্দ মাধুর্যের, কখনও ইঙ্গিতময় সান্ধ্যভাষার, কখনও যথার্থ শব্দ ব্যবহারের আশ্চর্য দক্ষতার। সব মিলিয়েই কবিতাটা রূপ পরিগ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত।

এসব অনুভবের ব্যাপার, ব্যাখ্যা করে বোঝাতে গেলে, ভুল বোঝার সম্ভবনা থেকেই যাবে, ঠিক মতো বোঝানো সম্ভব হবে না, হয়তো!

সেজন্যই বুঝি কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন,
সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।”

যথার্থ কবির কাছে শব্দের খেলাই কবিতা হয়ে ওঠে, যা ম্যাজিক সৃষ্টি করতে পারে পাঠকের মননে। কথাটা যত সহজে বললাম আমি, কাজটা মোটেই তত সহজে হয়ে ওঠে না, বরং তা খুবই কঠিন ও দুরূহ ব্যাপার। তার জন্য প্রয়োজন হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, " কঠিন সাধনার"।
অনেক সাধনার ফলে, সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব হয়। মহৎ চালাকির সাথে ফাঁকি দিয়ে এই কাজ  কখনই করা সম্ভব নয়, বলে আমার মনে হয়।
Pen, কলম,
অলংকরণ : গুগল



এই প্রসঙ্গে ১৩৮ বছর আগে বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কি নিবেদন করেছিলেন সেটা মনে পড়ে গেল।


১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।

২। টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্য লেখে, এবং টাকাও পায়,  লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সে দিন আসে নাই।  এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লিখিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া ওঠে।

৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন,  অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।

৪। যাহা অসত্য, ধর্ম্মবিরুদ্ধ, পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সে সকর প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না,  সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ।

৫। যাহা লিখিবেন,  তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছু কাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছু কাল পরে উহা সংশোধন করিবেন।  তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তার পর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্রতী, তাহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া ওঠে না।  এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।

৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই,  সে বিষয়ে তাহার অকর্ত্তব্য।  এটি সোজা কথা, কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না।

৭। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থকিলে তাহা আপনিই প্রকাশ পায়,  চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যা প্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্ম্মন্ কোটেশন বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না।

৮। অলঙ্কার প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টা করিবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে, লেখকের ভান্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজন মতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে -- ভান্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভান্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মত কদর্য্য আর কিছুই নাই।

৯। যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাঠিয়া দিবে  এটি প্রাচীন বিধি।  আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভাল না হইয়া থাকে, তবে দুই চারি বার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভাল লাগিবে না  --  বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে। তখন উহা কাটিয়া দিবে।

১০। সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি সোজা কথায় মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন,  তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক । কেন না, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝান।

১১। কাহারও অনুকরণ করিও না।  অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়,  গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বাঙলা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব। - এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।

১২। যে কথার প্রমান দিতে পানিবে না,  তাহা লিখিও না। প্রমানগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময় প্রয়োজন হয় না,  কিন্তু হাতে থাকা চাই।

বাঙলা সাহিত্য,  বাঙলার ভরসা। এই নিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে,  বাঙলা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।

(প্রচার, ১২৯১ মাঘ - বঙ্গদর্শন)