শারদ সংখ্যা
![]() |
অলঙ্করণ: গুগল |
-আমার জন্মের তারিখ। কেমন নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হল। রবি ঠাকুরের জন্মদিনের কথা মনে এল। ২৫শে বৈশাখ। আমারটা -না না, দূর! কেমন উৎসাহ নিয়ে বাড়ির দিকে জোরে হাঁটা শুরু করলাম। বাড়িটাও কেমন রহস্যময় হয়ে উঠল। কত তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে যাব, সেই চিন্তাই করছিলাম।
প্রথম ঠাকুমাকে উঠোনে পেলাম।
-ঠাকুমা আমার জন্মের তারিখ বলোতো। ঠাকুমার মুখ দেখে মনে হল, আমি অবৈধ কোন প্রশ্ন করেছি।
-আমি মুখ্যু মানুষ, লিকেও তো রাখতে পারিনা। মার কাছে বলগে যা। কেন জানি মনে হল, ঠাকুমা মুখ্য, তাই আমার জন্ম দিন মনে নেই; কিন্তু একাদশী, পুজো পার্বণ কত কি মনে থাকে! মা তখনকার কালের ইউ.পি. পাশ। যাই, মায়ের কাছে।
-মাকে জিগ্যেস করতে মা বলল- ঠিক মনে নেই; আমি মেয়ে মানুষ, সংসারের নানা কাজে জেরবার; তবে তোর দিদা বলতে পারবে। নাতি নাতনির জন্মদিন লিখে রাখতে পারে।
-মা, বাবা নিশ্চয় জানে?
-দূর! পুরুষ মানুষ ওসব খবর রাখেনা। মেয়ে মানুষ, তার সংসারের অনেক কাজ, পুরুষ মানুষ - শব্দগুলো আমাকে অজান্তে আহত করল। মা তার অক্ষমতা জানাল। বাবার কীর্তিময় বিষয়-সম্ভারে এমন দিন কোন দাগ কাটার ক্ষমতা রাখেনা। নিজেকে কেমন গুরুত্বহীন লাগছিল; আমি তো বড় আদরের কেউ। তাহলে? আমি এসেছিলাম -অভ্যাসের সন্তান! শাঁক বেজেছিল-আচার!
ঠাকুর্দা এলাকার প্রতিষ্ঠিত বনেদী বিচক্ষণ মানুষ। তার বিচক্ষণতায় ভরসার বীজ বুনলাম।
-ঠাকুর্দা ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে বলল- কত লোকে কত বাচ্চা বিয়োচ্চে, আমি ওসব খবর রাখব? আমার কি কোন কাজ নেই। হ্যাঁ রে, তোর মাস্টার তো লেখাপড়া-জানা লোক, এটার জন্য লোক পাঠাবার কি আছ? আমি তো বুঝি না। ভালমন্দ একটা কিছু বসিয়ে নিতে বোল গে যা; বলবি, ঠাকুর্দা বলেছে।
বাড়ির বারোমেসে (২৪ ঘন্টা) হাঁসাদা বলল- তুই তো আর মহাপুরুষ হচ্ছি না, যে জম্মের তারিখ লাগবে।
অগত্যা মামাবাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলাম। মনি নদীর ধারে হালদার পাড়ায় হাজির। ঝি-মা বারান্দায় (দাদুর মা); এক্সট্রা টাইম ব্যাট করছে তখন। তিনি ৯৩ প্লাস। বয়স জিগ্যেস করলাম। খানিক ভেবে বলল- তা ৪ কুড়ি কবে পেইরে গেছি। কথা না বাড়িয়ে সোজা দিদিমার কাছে হাজির হলাম। শম্ভুদার মা উঠোনেই ছিল। সব শুনে শম্ভুদার মা প্রথমেই বলল- ও দিদি সে বছর খেপির বাচ্চা হয়েছিল। তোমার মনে নেই? কে খেপি? আমি তাকাচ্ছি চারিদিকে।
-তুই যেমন, ওই তো খেপি, ও কি বলতে পারবে? চোখ দিদিমার আঙুলের পথে গোয়ালের বারান্দায় এক গরুকে আবিষ্কার করল। সোর্স অব ইনফরমেশন এভাবে গরুতে গিয়ে শেষ হবে ভাবতেই পারিনি।
মামাবাড়ি থেকে ফেরার পথে সিরিষ ঠাকুরদার সাথে দেখা। সব শুনে বলল- শামোল একটা জলজ্যান্ত মানুষ জন্মাল, আর তার জন্মদিনটা কেউ জানেনা। এটা হতেই পারেনা। তুই টেনশন নিবিনা, তোর ন-ঠাম্মার কাছে যা তো; সুবলকাও আছে। হয়ে যাবে। কেমন যেন জন্মদিন পাওয়ার ঠিকানা পেয়ে গেলাম।
ন-ঠাম্মা গয়া-ফেরত বিধবা। অনন্ত সেক্সের বাজারে ঠাম্মার ক্রেডেনসিয়াল আলাদা। ঠাম্মা ঠিকমত দেখতে পায়না। স্মৃতি সরণি ধরলেন; মনের চোখ দিয়ে জন্মের ফেলে-আসা ক্ষণ খুঁজতে বের হলেন। -তুই খুব কেঁদেছিলি।
(আমি তো গীতার সন্তান! কাঁহা, কাঁহা তো করবই। বাই দ্য বাই আমার মায়ের নাম ও গীতা।)
জানিস, নন্দবউ প্রথম দেখে চিৎকার করে বলল- এ গীতা! তোর ছেলে খোঁড়া। শুনে তোর মা কি বলেছিল জানিস! চোখ বন্ধ করে বলল- অন্ধ তো নয়। বলে তোর খোঁড়া হাতটায় হাত বুলাচ্ছিল।
-ঠাম্মা আমার জন্মদিন?
-চুপ করনা; কি মিস্টি দেখতে ছিলিস তুই! কে যেন ফোড়ন কাটল-ভগবানের হিসেব বোঝা ভার। এত রূপ সহ্য হবে না।
কিন্তু বুড়ো আঙুল নেই, এটা নন্দবউ প্রথম দেখতে পায়নি। আচ্ছা সুবল, একটা জাবদা খাতায় এ সব লেখা থাকত, তুই দেখত; বলেই পুবের মাঠে শাক তুলতে গেল।
সুবলকা অনেক ভেবে মাথার উকুনদের কিঞ্চিত বিরক্ত করে বলল- দ্যাখ শ্যামোল জন্ম একটা ঘটনা। যে ঘটনার দিনটির জন্য মা কতদিন অপেক্ষায় ছিল! আবার ঘটনার দিন কত পরিজন! কায়দাটা বলি শোন, এই ঘটনার লেজ ধরে ধরে সে প্রথম ঘটনায় যেতে। এটাই নিয়ম বুঝলি। ক্ষণ খোঁজার পথে ক্ষণিক আলো পড়ল মনে হল। কাকার জন্য শ্রদ্ধা জমল মনে।
-আচ্ছা তোর এখন বয়স কত?
-সেটা তো জানিনা কাকা।
-স্বাভাবিক। এখন ক্লাশ ফোরের ফাইনাল দিবি। তার মানে প্রাইমারীর ৪ বছর, পাততাড়ি ২ বছর( অ আ ক খ, ধারাপাত তালপাতায় করতাম, এটাকে পাততাড়ি বলতাম), তার আগে মায়ের কোলে, বাড়ির বারান্দায় ২ বছর; মোট ৮ বছর।
মনে মনে কাকাকে তারিফ করছি। আর জন্ম-ক্ষণের দিকে এগিয়ে চলেছি।
নন্দকাকি হাজির। নন্দকাকি প্রথম দেখেছিল আমি খোঁড়া, তাই কাকির ক্রেডেন্সিয়াল শিকারী ফেমিলিতে আলাদা।
-আচ্ছা সুবল, সে বছর আমাদের বড় পুকুর খোলা হয়েছিল; (পাড়ের পেয়ারা গাছ থেকে ঐ পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার কথা মনে পড়ল) সামনের তেতুঁল গাছটায় কি তেতুঁল হয়েছিল! নন্দকাকি’র এ কথা শোনার পর ছোটঠাম্মা চিৎকার করে উঠল- সুষুমার মাথায় তাল পড়েছিল; মেয়েটা মাটিতে পড়ে গেল! কাকা বলল- দাড়াও, দাঁড়াও মা, আমাদের মদনটাক পাখিটা খাঁচা থেকে উড়ে পালাল;
(মনটা পাখিটার সাথে উড়ল। মনে হল, ক্ষণ আর কত দূর! ঠিক উড়ে পৌঁছে যাব।)
-দূর! মদনটাক উড়ে গেল বর্ষার দিনে। মা গো ঐ খিরিস গাছটার ডালে বসেছিল, একদম ভিজে গিয়েছিল।
(আমি পৌঁছে গেলাম এক বৃষ্টির দিনে। মান কচু পাতা মাথায় দিয়ে কাদায় পা টিপে টিপে চলেছি স্কুলে। যাদের ফেলে আসিনি তারা ও ভীড় করল।)
স্মৃতির টান আর স্বপ্নের টান
মাঝখানে ঘানি টানে বর্তমান।
মুখপোড়া জীবনের ঐকতান।
হেরে যায় জিতে যায়
কারা সব জানিনা।
আমি শুধু বেঁচে থাকি বিমিশ্র চেতনায়।
সুবলকার চিন্তিত মুখ আমাকে ভরসা দিচ্ছে। হয়ত পেয়ে যাব সেই ক্ষণ-সুন্দরীকে। আসলে মানুষের এক ব্যর্থতা সে দুঃশ্চিন্তা ছাড়া থাকতে পারেনা, আবার সাফল্য বেশিক্ষন দুঃশ্চিন্তায় সে থাকতে পারেনা। পাওয়া গেল না জন্মদিন।
ঠাকুরদার মতামত স্যরকে জানিয়ে দিলাম। পরে আমার অ্যাডমিট কার্ডে দেখলাম Date Of Birth : September 21, 1964
দৌড়ে স্যরের কাছে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্যেস করলাম, স্যর আমার জন্মতারিখ আপনি কোথায় পেলেন? কে দিয়েছে? বাবা?
-না, ঐ দিনটা পাঁজিতে দাগ মেরে রেখেছিলাম বছরের নতুন ধান কাটব বলে। ভালই হল বল।
-হ্যাঁ, স্যর।
-ঘরে ফিরে দেখি মা তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সন্ধ্যা দিচ্ছে। ঠাকুর না কি সব জানে? হাসাদাকে জিগ্যেস করলাম।
- না; যা মানুষ জানেনা তা ঠাকুর জানে না।
–হাঁসাদার সহজ উত্তর।
শুনেছিলাম এ পৃথিবীর কোন ঘটনা হারিয়ে যায় না। তারা আলোর বুকে রয়ে যায়। পথে তারই বেগে ছড়িয়ে যায়। ৪৮ বছর আগের ছবি এখন বৃহস্পতি থেকে দেখা যাবে। পৃথিবীর আলো ওখানে যেতে না কি ঐ সময় নেয়। আমার প্রথম কান্না এই তো ৯ বছর আগে বৃহস্পতি ক্রশ করল। চলে গেছে আর ও দূরে। মাঝে মাঝে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ওখানেই আছে পুতিগন্ধময় সেই ঘর যেখানে মিটমিট করে প্রদীপ জ্বলছে; মা আমার পঙ্গু হাতটায় তার দুর্বল হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। তারপর বোকার মত অভিমান করে মহাকাশকে বলি- তুমি আজও আমার জন্ম কথা বয়ে বেড়াচ্চো! মহাকাশ কেমন আপন হয়ে যায়।