শারদ সংখ্যা
![]() |
অলংকরণ : গুগল |
শেষ শলাকা
The Last Match
মূল কাহিনী : এডওয়ার্ড ফিতজ-জেরাল্ড ফ্রিপ
- এবার বাড়ির পথে রওয়ানা হওয়া যাক তবে। এই হাওয়ার গন্ধটা আমার সুবিধের ঠেকছে না। আমার আন্দাজ ভুল না হলে তুষার ঝড় এই এলো বলে।
- এই রে, তবে ভুল বোধহয় বলছো না। রওয়ানা হয়ে পড়ো তাহলে। নমস্কার মিস্টার মসন, বিদায় মিসেস মিলস।
পশুখাদ্য কোম্পানির মালিক গুঁড়ো করা শুকনো ভুট্টার বস্তাটা বসার আসনের পিছনে তুলে নিলে মসন জিভে একটা শব্দ করে ঘোড়াটাকে ডেকে নেয়। তারপর সানসেট নামক এই শহরতলির একমাত্র রাস্তা ধরে ঘোড়ায় টানা ছোট্ট স্লেজটা রওয়ানা দেয়। স্লেজের গায়ে লাগানো ঘুন্টিগুলো থেকে রিনঠিন আওয়াজ ওঠে।
ঘাস আর ঝোপে ঢাকা প্রেয়ারিসের এই শহরতলি বরফের চাদরের তলায় যেন অর্ধনিদ্রিত, কর্মব্যস্ততার কোন চিহ্ন নেই। গমের দামে ধ্বস নেমেছে তিন বছর হয়ে গেল। তিন বছর ধরে উইনিপেগ শস্য বিপণি কেন্দ্রে সেরা এক নম্বর নর্দার্ন গমের দামও ষাট সেন্টের বেশি এক পয়সা বাড়েনি। এমন খারাপ সময় এদিকে বোধহয় আর আসেনি। বাজারের অবস্থা সত্যি বড় খারাপ। বেচতে না পারা ডিমগুলো নাকি শূকরদের ভোজে লাগানো হচ্ছে, ভাবা যায়!
আগে প্রতি শনিবার সানসেট শহরতলিতে প্রতিবেশী খামারগুলো থেকে গাড়ি চড়ে আসা চাষীদের ভিড় লেগেই থাকতো। আজকাল তারা আর আসেনা। দুটো গ্যারাজের একটা তো বন্ধ, আর একটায় চারজনের জায়গায় মাত্র একজন কাজ করছে। সিনেমা হলে সপ্তাহে একটা মাত্র শো হয় আজকাল, রেক্স ক্যাফে আর গুড ইটস ক্যাফেতে কদাচিৎ একটা দুটো খরিদ্দার আসে কি আসেনা। দোকান পাটের চেহারায় হতশ্রী ভাব, নাপিত এড উইলসন মাছি তাড়ায় বসে বসে। এমনকী ঘোড় দৌড়ের বাজী ধরতেও কেউ আসেনা। খারাপ সময়ের এর থেকে বড় প্রমাণ আর কীই বা হতে পারে। উইনিপেগ শস্য বিপণি কেন্দ্রের কোনো খবরে চাষীরা পর্যন্ত বিশেষ উৎসাহ দেখায় না আর, কী হবে উৎসাহ দেখিয়ে? ষাট পাউন্ড এক নম্বর নর্দার্ন গমের দাম যদি ষাট সেন্টে গিয়ে ঠেকে তাহলে বলার যে আর কিছুই থাকেনা।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে সানসেট শহরতলি পেছনে ফেলে স্লেজটা লম্বা সোজা একটা রাস্তায় গিয়ে পড়ল। ন্যাড়া প্রেয়ারিসের মধ্যে দিয়ে যেন অন্তহীন ভাবে সোজা চলেছে সেই রাস্তা। পেছনে গোলাঘরের ওই কপিকলের সাদা উঁচু মাথাটা তখনও দৃশ্যমান, ঠিক যেন ওটা মাথা উঁচু করে সানসেটের উপর কড়া নজর রাখছে। যেমন প্রাচীন কোনো গ্রামের চার্চের তেকোণা মাথাটা উঁচু হয়ে গ্রামের মঙ্গল অমঙ্গলের উপর নজর রাখে, ঠিক তেমন।
স্লেজের পুরুষ ও মহিলা আরোহী বেশ খানিকক্ষণ ধরেই চুপচাপ। দুজনেরই গায়ে কনকনে হাওয়া আটকানোর জন্য মোষের চামড়ার পোশাক। তুষারের উপর ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা যায়না, কানে আসে কেবল স্লেজের ঘুন্টির শব্দ। কথা বলার ইচ্ছাও দুজনের কারুরই হয়না, উইনিপেগে এক নম্বর নর্দার্ন গমের দাম ষাট সেন্ট হয়ে গেলে কথা বলার মত কিছু খুঁজে না পাওয়াই স্বাভাবিক।
অবশেষে মসন বলে – স্লেজে চড়ে অদ্ভুত লাগছে, যেন যুদ্ধের আগের সময়ে পৌঁছে গেছি আমরা। চার চাকার গাড়ি একেবারেই না থাকলে বলার কিছু ছিলনা, কিন্তু একবার গাড়িতে অভ্যেস হয়ে গেলে গাড়ি ছাড়া কেমন অসহায় লাগে। এ বড় আস্তে চলে।
- তা চলে- মহিলার উত্তর। আবার নীরবতা।
এবারের শীত বেশ মোলায়েম, এখনও পর্যন্ত তাপমাত্রা একবারও শূন্যের নীচে নামেনি। কিন্তু গত দুই দিন ধরে তুষারপাত হয়ে চলেছে, সঙ্গে দক্ষিণ দিক থেকে আসা হালকা একটা হাওয়া। এই অঞ্চলে এমন তুষারপাতকে আর্দ্র তুষার বলা হয়, যদিও ইংল্যান্ডের যে কোন তুষারপাতের থেকে এই তুষার অনেক অনেক বেশি শুষ্ক। এখনও তুষারকণায় পরিমন্ডল সাদা হয়ে আছে, এমনিতে নিঃশব্দ অথচ তাদের টুপি, তাদের মোষের চামড়ার পোশাকে ঝরে পড়ার সময় ভারী শান্ত ক্ষীণ একটা শব্দও হচ্ছে যেন। যদিও কানে স্পষ্টভাবে তা ধরা পড়েনা। তাদের টুপি আর পোশাক অবশ্য ইতিমধ্যে সাদা হয়ে গেছে।
সানসেটে পৌঁছানোর সময়ে তুষারে স্লেজের যে দাগ পড়েছিল তা এতক্ষণে অদৃশ্য হয়েছে। ঘোড়াকে আবার নতুন করে পথ কাটতে হচ্ছে তুষারের মধ্যে, ফলে যাত্রার গতি আরো ধীর হয়ে পড়ছে। তুষারকণার আকার এখন ক্ষুদ্র, কিন্তু পড়ছে দ্রুততর। যাওয়ার সময়ে সরাসরি মুখে ঝাপটা লাগছিল, আর এখন লাগছে পাশ থেকে, কোণাকুণি ভাবে।
- এ গন্ধ আমার ভালো লাগছেনা – মসন বিড়বিড় করে – হাওয়া এবার আসছে উত্তর দিক থেকে, কিছু একটা হবে তো নিশ্চয়ই। এবার গলা তোলে মসন – জলদি নে রে, পিট।
পিট কান ঝাড়া দিয়ে কাঁধ সোজা করে নেয় একবার। ওকে অবশ্য তাড়া দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলনা। হাওয়ার পরিবর্তনটা সে ভালোই টের পেয়েছে। তাড়াতাড়ি আস্তাবলে ফিরতে পারলে সেও বাঁচে।
আস্তে আস্তে হাওয়ার জোর বাড়তে থাকে। যাওয়ার সময়ে দক্ষিণ থেকে আসা হাল্কা হাওয়ায় নরম তুষারকণাগুলো আলতোভাবে মুখে এসে লাগছিল তাদের। ভারী ভালো লাগছিল সেটা, ঠান্ডা একেবারেই লাগছিলনা। কিন্তু এখন এই হাওয়ায় কামড় আছে রীতিমতো। তুষারকণাগুলো আকারে অনেক ছোট এখন, মুহুর্মুহু আরো ছোট হতে হতে প্রায় বিন্দুর আকার নিয়ে মাটির সাথে সমান্তরাল রেখায় বয়ে এসে ঝাপটা মারছে তাদের। এই হাওয়া আসছে সুমেরু থেকে সরাসরি,মাইলের পর মাইল নিষ্ফলা তুন্দ্রা অঞ্চলের উপর দিয়ে বাধাহীন ভাবে বইতে বইতে। রাস্তায় এমন কিছু বাধা নেই যা এর জোর কিছুমাত্র কমাতে পারে, ঠান্ডায় এবার কাঁপুনি আসছে তাদের। আন্তর্জাতিক রেখা বরাবর অঞ্চলগুলোতে তাপমাত্রা হু হু করে নামতে শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যে, মাঝরাত নাগাদ এই ঠান্ডা গিয়ে হানা দেবে আমেরিকার মধ্যাঞ্চলের শহরগুলোতে আর চব্বিশ ঘণ্টা বাদে ২০০০ মাইল দক্ষিণে মিসিসিপি উপত্যকার তুলোর খামারের কর্মীদের কাঁপিয়ে দিয়ে শান্ত হবে এই তুষার ঝড়। ততক্ষণে অবশ্য প্রেয়ারিসের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর দিয়ে বইতে বইতে এর ধার অনেক কমে যাবে।
ধীরে ধীরে তুষারকণাগুলো মুখে চোখে বিঁধতে শুরু করলো। ঝাপটা বাড়ার সাথে সাথে ঘূর্ণায়মান মেঘের মতো তুষার ধেয়ে আসতে লাগলো, কেউ যেন বিশাল এক শ্বেত কার্পেট ঝাড়তে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশার মধ্যে যেমন দিকভুল হয়, তেমনই সামনে কয়েক গজের বেশি দৃষ্টি চলেনা আর। কুয়াশা যেমন তার আঙ্গুল চালিয়ে দেয় পোশাকের ফাঁকে, এই শুকনো তুষার ঠিক তেমনভাবে ঢুকে আসতে লাগলো গ্লাভসের ফাঁক দিয়ে, মাফলারের আর কোটের মাঝখানের ফাঁক বেয়ে, এমনকী কোটের হাতার ভিতর দিয়েও ঢুকে পড়তে ছাড়লোনা। সামান্যতম আর্দ্রতাও নেই এই হাওয়ায়। পড়ে থাকা তুষারকণাগুলোকে পাউডারের মতো উড়িয়ে নিয়ে ফেলতে লাগল চারিদিকে। কোথাও বাধা পেলেই সেখানে ছোট ছোট ঘূর্ণি তৈরী করে কণাগুলো জমা হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের সমস্ত বেড়ার বায়ুমুখী দিকগুলোতে বেশ কয়েক ইঞ্চি করে তুষার তাই ইতিমধ্যেই জমে গেছে। সকাল হওয়ার আগেই নির্ঘাত তুষারের নীচে চাপা পড়বে একদম।
স্লেজের একমাত্র আসনে দুই আরোহী সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দুজনে দুজনের গা ঘেঁষে বসে আছে। ঝুঁকে বসলে ঘাড় বেয়ে তুষার হয়তো কম ঢুকবে পোশাকের ভিতর। পুরুষ আরোহী হাত তুলে কান-ঢাকাটা আরো নামিয়ে দেয়, তার দস্তানা থেকে ঝুরঝুর করে নুনের মতো তুষার ঝরে পড়ে। এতো শুকনো, যে একটি কণাও আটকে থাকেনা দস্তানায়। - বলেছিলাম না, তুষারঝড়ের গন্ধ পাচ্ছি – ভবিষ্যৎদৃষ্টার বিমর্ষ সন্তুষ্টি নিয়ে মসন বলে – আমাদের যে ঘণ্টা দুয়েক দেরী হয়ে যায়নি এই অনেক ভাগ্যি, তোমার স্বামী নিশ্চয়ই এতক্ষণে পৌঁছে গেছে।
মহিলা মাথা ঘোরায়। হাওয়ার দাপট তার টুপি থেকে সমস্ত তুষার উড়িয়ে নিয়ে যায়। - হ্যাঁ, তিনটের ভিতর পৌঁছানোর কথা ওর, নিশ্চয়ই ঠিকই আছে ও। মহিলা মাথা নামিয়ে নেয়, আবার চুপচাপ সব। তার স্বামী ভোর চারটেতে বেরিয়েছে। উইনিপেগে এক নম্বর নর্দার্ন গমের দাম ষাট সেন্ট হয়ে গেলে চাষীদের পক্ষে কয়লা কেনা সম্ভব হয়না, তাই তার স্বামী এক প্রতিবেশীর সাথে আরো উত্তরে গেছে জ্বালানীর সন্ধানে। ওদিকে মাটির আর্দ্রতা সামান্য বেশি, পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে থাকা বেঁটে পপলার গাছ কেটে আনলে সারা বছরের জ্বালানীর সংস্থানটা হয়ে যায়। যদিও স্লেজে সেই বোঝা নিয়ে তিরিশ মাইল তুষার ঠেঙ্গিয়ে ফিরতে হবে শরীর মন অবশ করা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া সহ্য করে।
এতক্ষণে রাস্তা থেকে সামান্য দূরে একটা বাড়ি দেখা যায়। জরাজীর্ণ রংহীন কাঠের একটা বাড়ি, কুঁড়ে বলাই ভালো। বাড়িটা সাজানো গোছানোর কোনো চেষ্টাই বোধহয় কেউ করেনি কখনও। সামনে পেছনে দুটি দরজা, চারটি ঘর, আলো আসার মতো কয়েকটি জানালা, ব্যাস ওই পর্যন্ত। বাড়ি না বলে কেবল বাসস্থান বলাই ভালো, খাওয়া ঘুমানো মাথা গোঁজা কোনরকমে চলতে পারে আর কী। অবশ্য এই অঞ্চলের খামারবাড়ি এমনই হয়। সমতল জমি থেকে সটান উঠে গেছে বাড়িটা। গমের ক্ষেত আর বাড়ির মাঝে না আছে কোন বেড়া, না কোন বাগান বা ঘাসজমি। বাড়ির পাশে বিশাল এক শস্যাগার, ঠিক যেন বামনের পাশে দৈত্য।
খিড়কি দরজা পর্যন্ত স্লেজটা নিয়ে যায় মসন। মিসেস মিলস কাঠের অগভীর খোলা একটা বাক্স হাতে নেমে আসে। যাওয়ার সময়ে এই বাক্সে ছিল তার নিজের হাতে বানানো মাখন, এখন আছে সেই মাখনের বদলে পাওয়া নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, একেবারে নীচে চিঠিপত্র। অবশ্য সবকিছুর উপর এখন তুষারের ঘন আচ্ছাদন।
- পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ – গলা তুলে জানায় মিসেস মিলস।
- ধুর, ও কিছুনা। কিন্তু একা ঠিক থাকতে পারবে তো?
- হ্যাঁ, জিম যাওয়ার আগে সব ঠিকঠাক করে গেছে।
- সব হাতের কাছে আছে তাহলে?
- হ্যাঁ - হাওয়ার দাপটে এবার প্রায় চিৎকার করে বলতে হয় মিসেস মিলসকে। হাওয়ার তীব্রতা কি আরো বাড়লো? চারিদিক সাদা একেবারে, দৃষ্টি চলেনা মোটে। কানে চোখে ঘাড়ে তুষারকণা ছিটকে এসে পড়ে। মিসেস মিলসের হাতে ধরা বাক্সের উপর থেকে তুষারের স্তরও খানিকটা উড়ে যায় সেই হাওয়ার ঝাপটায়। সেই সাথে বাক্সে রাখা একটা প্যাকেটও উড়ে গেল কি? সামলে নিয়ে বাক্সের দিকে তাকিয়ে অবশ্য কিছু বুঝতে পারলোনা মিসেস মিলস। বাক্সের উপরকার তুষার যেমন ছিল তেমনই তো আছে। আশপাশে তাকিয়েও কিছু পড়ে আছে মনে হলোনা।
এদিকে জমে যাওয়ার যোগাড়, ঘরের ভিতরের গরমে যেতে পারলে বাঁচা যায়। পিট বেচারাও খুর ঠুকছে, মসনের পক্ষেও আর বাইরে থাকা উচিত নয়। ঝড় যেমন বাড়ছে, হাত পায়ের সাড় থাকবেনা আর। মিসেস মিলস আবার হাতে ধরা বাক্সটার দিকে তাকায়। সত্যি উড়ে বেরিয়ে গেল কিছু, না মনের ভুল? যাকগে, ভেবে লাভ নেই, পড়ে গেলেও সেটা বসন্তে বরফ গলার আগে খুঁজে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাছাড়া কীই বা পড়ে যাবে? বাড়িতে তার খাবারের অভাব তো নেই।
মসন ব্যস্তভাবে আবার বলে – ঠিক আছে, চলি তাহলে।
হাত নেড়ে রওয়ানা দেয় মসন, পিট তড়বড় করে এগিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে তুষারপাতের মধ্যে অদৃশ্য হয় স্লেজটা, মিসেস মিলসও দরজার দিকে দৌড়ায়।
খোলা বারান্দার কড়িকাঠ থেকে মাংসখণ্ড ঝুলছে, জিম এই ক’দিন আগেই একটা বাছুর আর শূকর মেরেছে খাওয়ার জন্য। এখানের শীতের এই একটা বড় সুবিধা, মাংস কেটে ঝুলিয়ে রাখো, জমে গিয়ে একদম ঠিক থাকবে। খাও যতদিন ধরে খুশি। এই কঠিন সময়ে পর্যাপ্ত খাওয়ার জিনিস যে আছে তাদের, এটাই বড় কথা। খিড়কির দরজার সামনে তুষার ঢিবি হয়ে আছে, দেওয়ালের গা ঘেঁষে রাখা জামাকাপড় ধোয়ার যন্ত্র আর ঝাড়ুগুলোও প্রায় চাপা পড়ে গেছে। বারান্দার বাকী অংশে একফোঁটা ধুলোও পড়ে নেই, ঝোড়ো হাওয়া সব উড়িয়ে নিয়ে চলে গেছে। পরিষ্কার তকতক করছে বারান্দা। এই অঞ্চলে দরজায় তালা লাগায়না কেউ। দরজার সামনের জমে থাকা তুষার পা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করতেই সেটা হাওয়ার ঝাপটায় মিসেস মিলসের মুখ পর্যন্ত ঢেউয়ের মতো উঠে এলো। আর এক ঝাপটায় সেটা সরে যেতেই এক টানে দরজা খুলে লাফ দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ল মিসেস মিলস। উফফ শান্তি! বাইরের তাণ্ডবের পর রান্নাঘরের উষ্ণতা আর নিস্তব্ধতা বড় অদ্ভুত লাগছে এখন। জিম নেই, এক মুহূর্তের জন্য একলা এই তুষারঝড়ে গা টা কেমন ছমছম করে উঠলো হঠাৎ। কেমন অসহ্য লাগলো, তবে তা ওই এক মুহূর্তেরই জন্য। প্রেয়ারি অঞ্চলের চাষীবউ সে, এত সহজে কাহিল হলে চলবে কেন। দরজার তলা আর চাবি ঢোকানোর ফুটো দিয়ে হাড় কাঁপানো হাওয়া ঢুকছে, এটা ভয় পেয়ে বসে থাকার সময় নয়। এখনও দুধ দোয়া বাকী। এরপর অন্ধকার হয়ে গেলে শস্যাগারের দিকে যাওয়াই যাবেনা। আবার একটা ঝাপটা ঢোকে, এবার লাফিয়ে উঠে পড়ে মিসেস মিলস। স্টোভের ডালা তুলে দেখে ভিতরের জ্বালানী প্রায় শেষ, তলায় কুটো ধিকিধিকি জ্বলছে শুধু। আরো দুটো কাঠের খণ্ড তাতে চাপিয়ে দেয় সে। ধরুক আস্তে আস্তে আগুনটা। শোবার ঘর আর বসার ঘর গরম রাখার আলাদা হিটার আছে ঠিকই, কিন্তু গত দুই দিন তেমন ঠান্ডা না পড়ায় খরচ বাঁচাতে সেটা আর জ্বালানো হয়নি। একটু দ্বিধায় পড়ে এবার মিসেস মিলস। কনকনে ঠান্ডা শস্যাগার থেকে ঘরের উষ্ণ আরামে ফিরতে ভালো লাগবে ঠিকই, কিন্তু তার অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে। বাইরে ঝড়ের যা তাণ্ডব, অন্ধকার হওয়ার আগে ফিরতে না পারলে চূড়ান্ত বিপদ হবে। নাহ্, হিটারের ব্যবস্থা পরেই হবে। বাইরে পরার কোট আর টুপি খুলে ফেলে মিসেস মিলস। বরফ ঝেড়ে, ছুঁড়ে চেয়ারে রেখে দেয়। এই একা ঘরে বড় অস্বস্তি লাগছে তার। বাইরের ওই ঝড়ের শোঁশোঁ আওয়াজে যেন আরো একা লাগে। এই অবস্থায় একা বাইরে যাবেই বা কীভাবে। উৎকণ্ঠা আর আতঙ্ক মেশানো এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে থাকে মিসেস মিলসের। তাড়াতাড়ি করতে হবে, খুব তাড়াতাড়ি। দুধ দোয়া শেষ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরতে হবে, ঘর গরম রাখতে হবে, সেই সঙ্গে গরম রাখতে হবে ভাঁড়ারের সবজিগুলোকেও। সবজি অকুলান, সেগুলো জমে নষ্ট হতে দেওয়া চলবেনা। ঘাড় পর্যন্ত টানা তুষার ঝড়ের উপযুক্ত টুপি পরে নেয় সে, শুধু চোখ আর নাকের ফাঁকটুকু থাকে। পুরানো একটা ওভারকোট গায়ে চাপায় তারপর, কলারটা টেনে দেয় টুপির নীচের অংশ পর্যন্ত। অন্তত ঘাড় জমে যাওয়ার ভয়টা আর নেই। হাতে পরে নেয় দুই জোড়া দস্তানা, প্রথমে উলের, তার উপর হরিণের চামড়ার।
অন্তত জমে অসাড় হয়ে যাওয়ার ভয় নেই খানিকক্ষণ। কিন্তু সময় নেই একদম। প্রত্যেকটি মুহূর্ত অমূল্য এখন। স্টোভটা কী করবে? ডালাটা খুলেই রাখবে? হয়তো কাঠটা ধরবে ঠিকমতো তাতে, কিন্তু সে ফিরতে ফিরতে জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। কিন্তু কাঠটা ধরার জন্য অপেক্ষা করাও তো সম্ভব নয়। অন্ধকার হওয়ার সময় হয়ে এলো প্রায়। তবে শুকনো কাঠ ধরে যাওয়ারই কথা এতক্ষণে। না দেখেই ডালাটা বন্ধ করে দেয় মিসেস মিলস, তারপর একটা গরম জলের কেটলি হাতে দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। দরজা খোলা আর এক ঝক্কি। হাওয়ার ঝাপটায় আর ঠান্ডায় নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে, মেঘের মতো একরাশ তুষার ঘরের মধ্যে ঢুকে আসে। দরজাটা এবার ধড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়, আর দুধের বালতি হাতে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মিসেস মিলস। এখনও আলো আছে, তাও পঞ্চাশ গজ দূরের শস্যাগারটা ঝাপসা হয়ে গেছে। তুষারকণাগুলো তীব্র গতিতে এসে সূঁচের মতো বিঁধছে নাকে আর চোখে। পায়ের পাশ দিয়ে চাবুকের মতো আছড়ে পড়ছে। ভাগ্যিস সানসেটে যাওয়ার আগে ভেড়ার লোমের লাইনিং দেওয়া বুট পড়ে নিয়েছিল সে। চামড়ার বুট পরা থাকলে পা জমে যেত একেবারে। দুধ দোয়া শেষ হওয়ার আগে অন্ধকার হয়ে গেলে বাড়ি আর খুঁজে পেতে হবেনা।
কুয়োটা বাড়ি আর শস্যাগারের ঠিক মাঝামাঝি, তাই হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলো। চোখ বাঁচানোর জন্য মাথা নামিয়ে কাঁধ সামনে ঝুঁকিয়ে এগোতে এগোতে দুধের বালতিটা হঠাৎ গিয়ে ধাক্কা খেল পাম্পের হাতলে। হাতলটা উপরের দিকে তুলে হাতের কেটলি থেকে সে গরম জল ঢেলে দিল পাইপ বেয়ে। তারপর প্রাণপণে পাম্প করতে থাকলো। আস্তে আস্তে গরম জল পাইপ বেয়ে নেমে ঠান্ডায় জমে যাওয়া পাম্পটাকে জল তোলার উপযোগী করে তুলল। কুয়ো থেকে জল উঠে এলো এবার। দুধের বালতি আর পাম্পের পাশে রাখা বালতিটায় জল ভরে নিল মিসেস মিলস। আবার পাম্পের হাতল উপর দিকে তুলতে হল, এবার পাইপে জমে থাকা বাকী জলটা কুয়োর তলায় নেমে গেল আবার। এর ফলে জলটা জমে পাইপটাকে ফাটিয়ে দিতে পারবেনা। গরুদুটোকে মাত্র এক বালতি করে জল দিতে পারবে আজ, ফিরে গিয়ে আর এক কেটলি গরম জল নিয়ে আসার সময় কোথায়। দুই বালতি জল আর কেটলি হাতে হাঁচোড় পাঁচোড় করে এবার সে চলতে থাকে শস্যাগারের দিকে। গরুগুলো ওর ভিতরেই। শস্যাগারের পাঁচিলে হাওয়াটা অন্তত আটকাবে। কিন্তু বড় সাবধানে এগোতে হচ্ছে। বালতি থেকে জল উপছে পড়ে গেলেই সর্বনাশ। পাঁচিলের আশ্রয়ে এসে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচলো মিসেস মিলস। শস্যাগারের পাশে প্রায় ফুট তিনেক উঁচু হয়ে তুষার জমে আছে। দুই হাতে বালতি উঁচু করে ধরে ভিতরে ঢুকে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। মনে হল যেন উনুনের গরমে ঢুকলো। গরুদুটো মুখ ঘুরিয়ে আস্তে করে ডাক দিল। প্রথম গরুটার সামনে জলের বালতি ধরে রাখলো মিসেস মিলস। তাড়া থাকলেও বালতি ছাড়ার উপায় নেই, যদি উল্টে দেয়। একে তো এইটুকু জল বরাদ্দ। পাম্প থেকে এই পঁচিশ গজ আসতেই জলের উপরে পাতলা একটা বরফের স্তর জমে গেছে।
গরুটা নাক দিয়ে নানারকম শব্দ করছে, জলের দিকে মুখ বাড়াচ্ছেই না। ভিতর থেকে উঠে আসা চিৎকারটা কোনরকমে আটকে ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মিসেস মিলস। ওই খাচ্ছে জল অবশেষে। এবার মাথা না তুলে বালতির জলটা শেষ করে ফেলে গরুটা। বালতি সরিয়ে নিতে আরো জল চায় ও। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে পরের গরুটার কাছে যায় মিসেস মিলস। ধীরে ধীরে এই পর্ব শেষ হয় একসময়। এবার দৌড়ে বিচালির স্তূপের দিকে যায় মিসেস মিলস। খানিকটা এনে ডাবায় রেখে দেয়, কাল সকালে যদি আসতে দেরী হয়ত অন্তত খিদেয় অস্থির হবেনা এরা। এবার গোবর পরিষ্কার করার পালা। কিন্তু গোবর এতক্ষণে জমে পাথর। এ সরানো বেলচার কম্ম নয়। অগত্যা সে চেষ্টা ছেড়ে গরুগুলোর পায়ের চারপাশে খড় বিছাতে থাকে সে। এটা লাগবে আজ। এর মধ্যেই গরুগুলোর নাকের চারপাশে বরফ জমতে শুরু করেছে। মিসেস মিলসের নিজের টুপির যেই অংশে নিঃশ্বাস এর বাষ্প পড়ছে, সেখানটা জমে শক্ত হয়ে গেছে। সেটা ঠোঁটে ঘষা লাগছে, বিরক্তও লাগছে তাতে। এবার পিঁড়িটা টেনে নিয়ে একটানে দস্তানাগুলো খুলে বালতি হাতে দুধ দুইতে বসে মিসেস মিলস আর সাথে সাথেই যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে। বালতির ঠান্ডা ধাতব হাতল তার বাঁ হাতের আঙুলের চামড়া তুলে নিয়েছে। কি ভয়ানক ভুল করল তাড়াহুড়োয়। শূন্যের নীচের এই তাপমাত্রায় যে কোনো ধাতব জিনিসের ছোঁয়া ছাল তো ছাড়িয়ে নেবেই। বালতিটা কনুইয়ের কাছ থেকে ঝুলিয়ে গরুটার পাশে বসে পড়ে সে। গরুর পেটের কাছে মাথাটা রেখে তার গা থেকে আসা উষ্ণতার ছোঁয়া নিতে বড্ড ভালো লাগে। বাঁট ধোয়ার উপায় নেই, জলটা ওখানেই জমে বরফ হয়ে যাবে তাহলে। বাঁ হাতটায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, রক্তও বেরোচ্ছে। গরুর বাঁটে লেগে যাচ্ছে সেই রক্ত। মাথাটা কেমন ঘুরতে থাকে মিসেস মিলসের, তাও মনের জোরে দুধ দুইতে থাকে সে। আস্তে আস্তে দুধ জমতে থাকে বালতিতে, দুধের ধারার পরিচিত শব্দটা মনকে শান্ত করে কতকটা। নিজেকে বোঝাতে থাকে মিসেস মিলস, একা তো হয়েছেটা কী, তার স্বামী বাড়িতে থাকলে সে যা যা করতো তাই তো করছে এখন। তবু অবচেতন মন তাকে যেন মনে করাতে থাকে যে সে একেবারে একা, সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী মসনদের বাড়িও তিন মাইল দূরে।
বাইরে ঝড়ের আওয়াজে বালতিতে দুধ পড়ার আওয়াজ চাপা পড়ে যায় এবার। গরুটার কাছে বসে থাকার ফলে তার শরীরের সামনের দিকটা উষ্ণ, কিন্তু দরজার দিকে থাকা পিঠটা যেন জমে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। হাতে ভীষণ লাগছে তাও প্রাণপণে দুধ দুয়ে চলেছে মিসেস মিলস। বার বার মনে পড়ছে অন্ধকার হওয়ার আগে বাড়িতে ঢুকতে হবে। এটা অযৌক্তিক ভয় হলেও কথা ছিল, কিন্তু তা তো নয়। আর এটা যে অযৌক্তিক নয়, সেটাই যেন আরো বেশি করে ভয় পাওয়াচ্ছে। অবশেষে দুধ দোয়া শেষ। নিঃশ্বাস ফেলে বালতিটা কনুয়ের কাছ থেকে আবার ঝুলিয়ে নেয় মিসেস মিলস। আর একটা গরুর দুধ আর দুয়ে কাজ নেই, এমনিতেও ওটার দুধ শুকিয়ে এসেছে। আজ নাহয় বাদ থাক।
দস্তানা হাতে ঢোকাতে আর এক প্রস্থ ব্যথা লাগে, আহত আঙুলে উলের ছোঁয়া আরামদায়ক নয় একেবারেই। গরুর গলার শিকল খুলে দেয় এবার, খাওয়া শেষ হলে ওরা একে অন্যের গায়ে ঠেস দিয়ে শুতে পারবে। ঠান্ডাটা কম লাগবে তাতে।
এবার নিজের উষ্ণ রান্নাঘরে ফেরা। পেপার পড়বে, ইংল্যান্ড থেকে আসা শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের লেখা চিঠি পড়বে সে আরাম করে। এই আত্মীয়দের সাথে দেখা হবার সম্ভাবনা বিশেষ নেই, এক নম্বর নর্দার্ন গমের দাম ষাট সেন্টের অনেক বেশি না উঠলে একেবারেই নেই।
আর এক মিনিটও অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করেনা মিসেস মিলসের। মুরগিগুলোকে সকাল পর্যন্ত খাওয়ার মতো যথেষ্ট দানা দেওয়া আছে, ওরা অবশ্য গাদাগাদি করে খোপের এক জায়গায় বসে থাকবে এই ঠান্ডায়। আজকের মতো কাজ শেষ তার। এবার স্টোভে আর হিটারে গনগনে একটা আগুনের অপেক্ষা। স্টোভের পাশে বসে সে খাবে, পেপার পড়বে, চিঠি পড়বে, আরামে ভুলে যাবে যে সে একদম একা। সর্বোপরি উষ্ণতা ঘিরে থাকবে তাকে। যদি গা গরম করতে স্টোভের উপর উঠে বসতে হয়, তাই করবে সে। কেটলি আর দুধের বালতি হাতে বাইরে বেরিয়ে আসে মিসেস মিলস। উফফ কি ভয়ানক ঠান্ডা। ভিতরে ঝড়ের আওয়াজ একটু কম লাগছিল, বেরিয়ে এসে চমক লাগে। ঝড়ের দাপট বেড়েছে আরো। তবে এখনো অন্ধকার হয়নি এই রক্ষে। তুষার ঝড়ে বাড়ি অদৃশ্য। আশপাশ অচেনা লাগে যেন। আর মিনিট কুড়ি দেরী হলে বাড়ির রাস্তা বোধহয় আর খুঁজে পেতোনা সে। দরজার সামনে ফিট দুই পরিষ্কার হলেও তার বাইরে আবার উঁচু হয়ে তুষার জমে আছে। আকৃতিটা হয়েছে ঢেউয়ের মতো, উপরের দিকটা ছুরির মতো ধারালো। মিনিট কুড়ি আগে তার যে পায়ের ছাপ পড়েছিল তার বিন্দুমাত্র কোনও চিহ্ন নেই। হাওয়া এবার পিছন দিক থেকে। হাওয়ার ধাক্কায় পা মাটি থেকে উঠে যাওয়ার যোগাড়, হাতের দুধের বালতি যেন ছিটকে পড়বে। দুই পাশ দিয়ে নদীর স্রোতের মতো তুষারের স্রোত বইছে।
অবশেষে বারান্দার সিঁড়ির ধাপে পা ঠেকে মিসেস মিলসের। উফ গনগনে স্টোভের উপর এবার কেটলিতে গরম জল ফুটবে, গরম চা আর ভাজা শূকরের মাংসের টুকরোর সাথে রুটিতে আজ বেশ করে মাখন মাখিয়ে নেবে। চর্বিওয়ালা খাবার তার শরীর গরম রাখবে, গরম ছড়িয়ে পড়বে কাঁধ বেয়ে হাঁটুতে, এখন যেখানে ঠান্ডা হাওয়া কেটে বসছে। হাওয়াটা বারান্দার দুই পাশ থেকে তুষার ঝেঁটিয়ে এনে মাঝখানে জড়ো করেছে। ফলে বারান্দার দুই দিক তকতকে আর মাঝখানে ফুটখানেক উঁচু একটা তুষার-পিরামিড। দেওয়াল আর দরজা ঘেঁষেও তুষারের পাঁচিল। দরজার কাছে পৌঁছিয়ে আড়চোখে একবার দেওয়ালে ঝোলানো থার্মোমিটারের দিকে তাকায় সে। শূন্যের আরো কুড়ি ডিগ্রী নীচে, অর্থাৎ মাইনাস কুড়ি ডিগ্রী। ভোরের দিকে এটা নির্ঘাত দাঁড়াবে মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রীতে। আচ্ছা, ইংল্যান্ডে তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের এই ঠান্ডার রকমটা বোঝানো যাবে কখনও? একেবারেই না। অনেকক্ষণ বাদে মৃদু একটা হাসি খেলে যায় মিসেস মিলসের ঠোঁটে। পা দিয়ে দরজার সামনে জমে থাকা তুষার সরিয়ে দিতে সেগুলো হাওয়ায় ছিটকে উঠে ধাঁ করে মিলিয়ে যায় বাড়ি পেরিয়ে। যেন বণফায়ারের ধোঁয়া।
বাড়ি। উষ্ণতা অবশেষে। আর কয়েক মিনিটে মাত্র, তারপরেই গনগনে স্টোভটা গরমে আগুন-রাঙা হয়ে উঠবে। ভেবেই আরামে শরীরটা তার শিথিল হয়ে যায়। তবে এতক্ষণে স্টোভটা যতটা গরম হওয়ার কথা ততটা হয়নি তো। বালতি নামিয়ে রেখে শিক দিয়ে স্টোভের ডালাটা তুলে ধরে মিসেস মিলস। এ বাবা, তাড়াহুড়োতে এমনভাবে কাঠের খণ্ডদুটো ঢুকিয়েছে সে, যে জ্যাম হয়ে গিয়ে নীচের ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা কুটোগুলো কাঠগুলোকে ধরানোর বদলে নিজেরাই নিভে বসে আছে। নিজের উপরই রাগ ধরে তার। তাড়াহুড়োতে এরকম হতেই পারে, কিন্তু এখন সবকিছু দেরী হয়ে যাবে। আবার ভিতরে ভিতরে উৎকণ্ঠা তৈরী হয় মিসেস মিলসের, মনটা কু ডাকে। এমন তুষারে ঝড়ের সময়ে একা থাকলে সবই যেন অন্যরকম লাগে, রোজকার সাধারণ কাজও যেন সহজে হতে চায়না।
হাওয়ার ধাক্কায় পুরো বাড়িটা যেন কেঁপে ওঠে এবার। মিসেস মিলসের মনে হয় এই ঠান্ডা যেন জীবন্ত, অনন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে দেওয়াল ভেদ করে আসার হুমকি দিচ্ছে। দুধ দুইতে যাওয়ার সময়ে গরম জলের কেটলি থেকে ওঠা বাষ্প জানলায় জমে পাতলা একটা বরফের স্তর তৈরী করেছে। মাছের আঁশের মতো দেখাচ্ছে সেটা। অন্ধকার হয়ে এলো, কিন্তু আলো জ্বালানোর থেকেও প্রয়োজন এখন এই ঠান্ডাটার একটা ব্যবস্থা করা। কাঠের খণ্ডদুটো বের করে নিয়ে খানিকটা খবরের কাগজ আর একটু বেশি করেই কুটো দিয়ে ফের স্টোভের ভিতরটা সাজিয়ে দেয় সে। এবার আগুনটা ধরানোর পালা। দস্তানা খুলে দেশলাই বাক্সটা থেকে একটা কাঠি বের করে জ্বালাতে যায় মিসেস মিলস। দস্তানা খুলতে হাতে ব্যথা লাগে আবার। সে যাক, আগুনটা ধরিয়েই হাতে ওষুধ লাগাতে পারবে। একী, দেশলাই কাঠির মাথাটাই তো নেই। আবার মনটা কু ডেকে ওঠে। একটু ভয়ও লাগে যেন। এই ঠান্ডায়, আধো-অন্ধকারে সব কিছু যেন তার বিরুদ্ধে চলে গেছে, এই পরিচিত ঘর যেন তার একাকীত্বকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছে।
আর একটা মাত্র কাঠি রয়েছে বাক্সটাতে। ঠান্ডায় অসাড় হাত আর ধরে রাখতে পারছেনা সেটা, আহত হাতটাতে যন্ত্রণা হচ্ছে খুব। কাঁপা হাতে কাঠিটা বাক্সের গায়ে ঠোকে মিসেস মিলস। কাঠিটা জ্বলে উঠতেই দমকা হাওয়া দরজার তলা দিয়ে আছড়ে পড়ে। কাগজের এক দিকটা ধরে উঠতেই স্টোভের ডালাটা কনুই দিয়ে দ্রুত বন্ধ করে দেয় সে। ঘর গরম হওয়ার আগে আর কোনো ধাতব বস্তু আঙ্গুল দিয়ে ছুঁচ্ছেনা সে। এবার আর আগুন নিভবেনা। কানাডার স্টোভ বলে কথা, এ তো আর ইংল্যান্ডের জিনিস নয়। ঠিক মতো সাজালে আগুন ধরানোটা কোনো ব্যাপার নয়। এবার আলো জ্বালানোর আগে আঙ্গুলের ব্যথায় কিছু দেওয়া দরকার। ক্রিম লাগিয়ে একটু স্বস্তি হওয়াতে স্টোভের অবস্থাটা আবার দেখতে যায় মিসেস মিলস। কই স্টোভের পাইপ থেকে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না তো, এরকম সময়ে আগুন জ্বাললে যেমন হয়। সব যেমন গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে, ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। যদি জিম থাকতো এখন এখানে, যদি সব কাজে গোলমাল করার জন্য মৃদু ধমকও দিত, তাহলেও যেন কত ভালো লাগতো। এটা ভেবে যেন আরো একা লাগতে থাকে তার। ডান হাতে দস্তানা পরে নিয়ে স্টোভের ভিতরটা দেখে সে। যা আশঙ্কা করেছিল তাই, ধরেনি আগুনটা। এতো সুন্দর করে গোছালো, তাও ধরলোনা! ভূতে পেলো নাকি ওটাকে। কাঠ তো খটখটে শুকনো, তাও ধরলো না! নাহ্, ভাগ্যটাই আজ বাদ সেধেছে তার। এক ঝলক তাকিয়েই অবশ্য সে বুঝতে পারলো অঘটনটা কী ঘটেছে। যে খবরের কাগজটা বিছিয়েছিল, সেটাই ধরেনি ঠিক করে। আবছা অন্ধকারে চোখের কাছে কাগজটা এনে ধরে মিসেস মিলস। ইশ তারই ভুল, এটা সেই ইংল্যান্ড থেকে আসা সানডে টাইমস। না না কাগজ হিসেবে খুবই ভালো, কিন্তু আগুন ধরানোর পক্ষে একেবারে বেকার। আসলে ইংল্যান্ড থেকে আসা কোনো কাগজেই এই আগুন ধরানোর কাজটা করা যায়না। কেন, কেন সে আর একটু সাবধান হয়ে কানাডার কোনো কাগজ বিছালোনা । এই অবস্থায় সে একা বলেই ভুলগুলো হচ্ছে নাকি ভাগ্যটাই আজ বিরূপ? এই যদি সে টেবিলে রাখা উইনিপেগ ফ্রী প্রেস বা ফ্যামিলি হেরাল্ড ব্যবহার করতো, এতক্ষণে ঘর তার গরম হয়ে যেত। সানডে টাইমসটা ছুঁড়ে ফেলে ফ্যামিলি হেরাল্ডটা টেনে স্টোভে ঢোকায় মিসেস মিলস। আর একটা দেশলাই বাক্স খুঁজে পেতে হবে এবার। গেল কোথায় বাক্সগুলো? যে তাকে থাকে সেখানে নেই। তার উপরের তাকে – নাহহ নেই। নীচের তাকেও নেই। অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় সে। এই তো কাপ, প্লেট, এসেন্সের বোতল, ধুর এগুলো তো নুন মরিচের টিন। রান্নাঘরের সাত সতেরো জিনিস হাতে ঠেকে, কিন্তু দেশলাই বাক্স কই? বুক ঢিবঢিব করতে থাকে তার। এই ভূতে পাওয়া জায়গায় আজ মরবে নাকি সে? গলা বেয়ে আতঙ্ক উঠে আসতে গিয়ে হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে যায় তার। আর স্বস্তিতে হেসেই ফেলে মিসেস মিলস। ইশ কি বোকা সে, নিশ্চয়ই একা থাকার ফল এই সব। আরে বাকী তিনটে বাক্স তো জিম নিয়ে গেছে সাথে। সব মনে পড়ে যায় তার। সকালে ব্যাগে বাক্সগুলো ঢোকাতে ঢোকাতে জিমের সেই মজা করে বলা ভাগ্যিস তার স্ত্রী ধূমপান করেনা, তাহলে মাত্র দুটো বাক্স নিতে পারতো সঙ্গে। সে নিজেও তো খুব হাসছিল এটা শুনে। জিম তাকে সানসেট থেকে নতুন প্যাকেট কিনে আনতে বলেছিল মনে করে। আর তা তো সে এনেওছে। ন’মাসে ছ’মাসে একবার করে বাজার দোকান করার সুযোগ পেলে কি আর কিছু ভুললে চলে? আজ হাতে মাখনও ছিল বেশ খানিকটা, তাই দিয়ে সব জিনিসই কেনা গেছে। ওই তো টেবিলের উপর তার নানারকম পসরার বাক্স। দেশলাই বাক্সের প্যাকেট খুলে একটা বাক্স বের করে কাঠি জ্বালালেই ম্যাজিকের মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। তখন গরম ঘরে বসে তুষারঝড়কে আর পাত্তাই দেবেনা মিসেস মিলস।
কোথায় রে বাবা প্যাকেটটা। এই দস্তানা পরে কিছু যদি খুঁজে পাওয়া যায়। খালি হাতেই খোঁজা যাক বরং। ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা বরফে হাতে ঠেকলে কাঁপুনি আসছে, তাও খালি হাতে এক এর পর এক প্যাকেট ছুঁয়ে দেখতে থাকে সে। শেষ প্যাকেটটাও এক সময়ে দেখা হয়ে যায়, তাও দেশলাইয়ের প্যাকেট তো পাওয়া যায়না। কী হচ্ছে এইসব, সত্যিই ভুতুড়ে ব্যাপার নাকি? কষ্টে চোখে জল এসে যায় তার, কাঁদতে কাঁদতে বাক্সটা উল্টে দিয়ে সব প্যাকেট বের করে ছড়িয়ে ফেলে। বেশ অন্ধকার এখন। প্যাকেটগুলো পরিষ্কার দেখাও যাচ্ছেনা। না, ঘাবড়ালে একদম চলবেনা, মন শান্ত করতে হবে। জোর করে নিজেকে স্থির করে মিসেস মিলস, তারপর বাক্সটা তুলে সেটা কোলে নিয়ে চেয়ারে গিয়ে বসে। এবার টেবিল থেকে একটা একটা করে প্যাকেট তুলে বাক্সে রাখতে থাকে। বুক দুরদুর করছে তার, প্যাকেট তো শেষ হয়ে এলো, কোথায় দেশলাই? এই তো শেষ প্যাকেট, এটাও তো দেশলাই নয়। হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপরটা ভালো করে হাতড়ায় সে। ধাক্কা লেগে ওপাশ দিয়ে দুটো প্লেট পড়ে যায় মেঝেতে। তাহলে? সে একা, বাইরে অন্ধকার, তুষারঝড়, আর তার কাছে একটা দেশলাই কাঠিও নেই?
হে ভগবান, তবে কি স্লেজ থেকে নামার পর ঐ দেশলাইয়ের প্যাকেটটাই উড়ে গেছিল? কেন সে ভালো করে খুঁজে দেখলনা তখন? কেন সে সাবধানে স্টোভে আগুন জ্বাললোনা? কেন সে আলো জ্বেলে নিলোনা আগে? কেন? কেন? চিৎকার বেরিয়ে আসে তার গলা থেকে। সে যে কতটা বিপদে পড়েছে সেটা বোঝার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তার আছে। যদি ঘুমিয়ে পড়ে, সকাল হওয়ার আগেই জমে শেষ হয়ে যাবে সে, জেগে থাকলে হয়তো সকাল পর্যন্ত টিকবে। শেষ রাত থেকে কাজে লেগেছে সে, প্রথমে জিমের যাত্রার প্রস্তুতি, তারপর মাখন বানানো, জিনিসপত্র কী আছে না আছে দেখা, তারপর সানসেট যাত্রা। এগারোটার পর থেকে আর কিছু খাওয়াও হয়নি তার, ক্লান্তিতে খিদেতে শরীর ভেঙে পড়ছে এখন। সর্বোপরি এই ঠান্ডা, এই ভিতর পর্যন্ত জমিয়ে দেওয়া ঠান্ডা। সকাল পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে সে? যদি পারেও, তখনও কি থামবে এই ঝড়? প্রতিবেশীদের কথা ভেবে লাভ নেই কোনো। এই তুষারপাতের মধ্যে রাস্তা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। যদি পায়েও, মাইলখানেক যাওয়ার আগেই সে ঠান্ডাতে মারা পড়বে।
আচ্ছা যদি গরুগুলোর কাছে পৌঁছানো যায়? দুটো গরুর মাঝে গিয়ে শুয়ে থাকলে বেঁচে যাবেনা সে? চেয়ার থেকে উঠতে গিয়েও আবার হতাশভাবে বসে পড়ে মিসেস মিলস। আলো ছাড়া পৌঁছবে কী করে সেখানে? সে শুনেছে ভরপেট খেয়ে, আলো হাতে বেরিয়েও তুষারঝড়ে হারিয়ে গিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি কতজন। বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ একশ গজ দূরে চিরকালের চেনা রাস্তাতেও হারিয়ে গেছে মানুষ। পায়চারি করে সকাল পর্যন্ত নিজেকে জাগিয়ে রাখা ছাড়া আর কী করতে পারে সে? অন্ধকারে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খেতে গিয়ে দেওয়ালে গিয়ে পড়ে এবার, মাথায় কিসের সাথে যেন ধাক্কা লাগে। হাত বাড়িয়ে জিনিসটা কী বুঝতে গিয়ে চমকে ওঠে মিসেস মিলস। আরে টেলিফোন। কিন্তু হা ঈশ্বর, খরচ চালাতে না পারার দরুন তার সংযোগ তো কবেই বিচ্ছিন্ন। টেলিফোন কোম্পানি রিসিভারটাকে আর নিয়ে যায়নি। তা যে দেশে এক নম্বর নর্দার্ন গমের দাম ষাট সেন্ট হয়ে যায়, সেখানে টেলিফোন আর কোন বাড়িতে গিয়ে লাগাবে তারা। বোধহয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা টেলিফোনের সংখ্যাই এখন বেশি। ওভারকোটটা চেপে জড়িয়ে নিয়ে আবার পায়চারী শুরু করে মিসেস মিলস। পনের পা গিয়ে দরজা, আবার পনের পা ফিরে টেলিফোন। সামনে আর পেছনে, বার বার। স্টোভের পাশে বাক্সে স্তুপাকৃতি কাঠ, আর ঠান্ডায় সে জমে যাচ্ছে। রুটি মাখন মাংস কিছুর অভাব নেই, তাও পেট জ্বলছে তার। সামনে টেলিফোন, তাও তার নিঃসীম একাকীত্ব। সেই গ্রীক পুরাণের ট্যান্টালাসকে যেমন জলের উপর ফলে ভরা গাছের নীচে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল- সে জল পান করতে গেলেই জল নেমে যাচ্ছিল, ফল খেতে গেলেই ডাল সরে যাচ্ছিল, ঠিক তেমন তার দশা।
টুপিটা নিঃশ্বাসের বাষ্প পড়ে জমে শক্ত, আহত আঙুলগুলো দপদপ করছে ব্যথায়। মনের মধ্যে খালি ভাসছে স্টোভের উত্তাপ, গরম খাবারের স্বাদ, আলোর উজ্জ্বলতা। অসহ্য, অসহ্য লাগছে এবার। কিছু একটা করতে হবে, যা হোক কিছু। নাহলে পাগল হয়ে যাবে সে।
শুধু যদি এতো খিদেটা না পেত। হাতড়ে হাতড়ে সে রুটির টিন বের করে আনে ভাঁড়ার থেকে।কাঁপা হাতে টিন খুলে বের করে আনে খানিকটা রুটি। একটা ছুরিও খুঁজে আনে। কিন্তু কাটবে কী করে, রুটি তো জমে পাথর। ছুরির দাগও পড়েনা রুটির গায়ে। আবার পাগল পাগল লাগে তার। উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাক হাতড়াকে থাকে, কিছু যদি পায়। এটা কী? মাখন। এটা তো জমে পাথর হবেনা। ছুরি দিয়ে এক খাবলা কেটে মুখে ঢোকাতে গিয়ে আঙুলের কথা মনে পড়ে যায়। আবার ভুল করছিল সে। ও ছুরি ঠোঁটে ঠেকলে আর দেখতে হবেনা। ঠিক আঙুলের মতোই চামড়া উঠে যাবে ঠোঁট থেকে। কিন্তু খালি পেটে মাখন খেতে পারে না বিশেষ, পেটটা গুলিয়ে ওঠে। আবার ছটফট করে উঠে তাক হাতড়াতে থাকে মিসেস মিলস। একটা গোলাকার অথচ লম্বাটে জিনিস হাতে ঠেকে। দস্তানার ভিতরেও হাত তার জমে কাঠ, তাই বুঝতে পারেনা বস্তুটা কী। কিন্তু জিনিসটা এদিক ওদিক করতে করতে হঠাৎ এক ঝলক আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায় মিসেস মিলসের। এ যে বৈদ্যুতিক টর্চ!!! রাতে গাড়ি চালাতে গিয়ে যদি বিগড়ে যায়, তখন কাজে আসবে ভেবে এই টর্চ কেনা। সে গাড়ি আজ আর নেই, টর্চটা থেকে গেছে। একটা সঙ্গী পাওয়া গেল অন্তত। রান্নাঘরের দিকে টর্চের আলো ফেলে সে। ঠান্ডায় দেওয়াল আর ছাদের কাঠ সংকুচিত হয়ে অদ্ভুত আওয়াজ বের করছে থেকে থেকে। টুপির ফাঁক দিয়ে গালের যে সামান্য অংশ দেখতে পাচ্ছে আয়নায় তাতে বুঝতে অসুবিধা নেই শীত দংশন বা ফ্রস্ট বাইট শুরু হয়ে গেছে সেখানে। আচ্ছা, এদিক ওদিক যদি কোনো দেশলাই কাঠি পড়ে থাকে? হয়ত বোকার মতো চিন্তা, কিন্তু থাকতেও তো পারে। টর্চের আলো ফেলে খুঁজতে থাকে মিসেস মিলস। টানাগুলো খুলে খুলে দেখে, জিমের পোশাকের পকেটও বাদ দেয়না। জিমের এক সময় পকেটে আলগা দেশলাই কাঠি রাখার অভ্যেস ছিল। ঘরে আগুন লেগে যাওয়ার ভয়ে সে ই বলে বলে সেই অভ্যেস ছাড়িয়েছে। জিম যে শুধু অভ্যেস পাল্টিয়েছে তাই নয়, প্রত্যেকবার পোশাক ছাড়ার সময়ে পকেট উল্টে আজকাল তাকে দেখায় যে কোনো কাঠি নেই তার কাছে। ইশ কেন জিম তার কথা মেনে নিল।
আবার পায়চারী, সামনে পেছনে, বারবার। পা আর চলেনা যে। ক্লান্তিতে ঠান্ডায় মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে এবার, যেন কেউ সম্মোহিত করেছে তাকে। বসা দরকার, বিশ্রাম নেওয়া দরকার। চেয়ারে বসা মাত্রই চোখ বুজে আসে, ঢুল লাগে তার। ঘুমালে কিছুতেই চলবেনা, নিশ্চিত মৃত্যু তাহলে। জেগে থাকার জন্য মিনিট গুনতে চেষ্টা করে মিসেস মিলস, কিন্তু চোখ আবার বুজে আসে। আচ্ছা কোথাও বাদ পড়েনি তো খুঁজতে? মনে মনে জিমের সব কটা পোশাকের কথা চিন্তা করে সে, না তো কিচ্ছু বাদ পড়েনি। চোখ দুটো আস্তে আস্তে বুজে আসে, তন্দ্রায় তলিয়ে যায় মিসেস মিলস।
ঠক। চমকে জেগে ওঠে মিসেস মিলস। টর্চটা আলগা হাত থেকে খসে পড়েছে। ভাগ্যিস। আর একটু হলেই হয়ত- না, বসা ঠিক হবেনা। কিন্তু ওই সামান্য নিদ্রাই হয়তো তার অবচেতন থেকে একটা স্মৃতি তুলে আনে। বারান্দার পেরেক থেকে একটা পুরানো কাজের পোশাক, যাকে ওভারঅল বলে, ঝুলছে না? প্রায় বছখানেক ধরে ঝুলছে। ওটাকে কেটে ন্যাতা বানাবে ভেবেছিল কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ওটার পকেট একবার দেখলে হয়না? হয়তো অসম্ভব নির্বুদ্ধিতা, কিন্তু যদি একটা কাঠি পাওয়া যায়? যদি না পায় তাহলে না হয় গরুদের কাছে গিয়েই বসে থাকবে সে। হয়তো পৌঁছাতে পারবেনা, কিন্তু এখানে হাত পা গুটিয়ে বসে তিলে তিলে মরার থেকে কিছু করতে গিয়ে মরা ভালো নয় কি?
ফোঁপাতে ফোঁপাতে দরজার দিকে এগোয় মিসেস মিলস। চাবির গর্ত দিয়ে একরাশ তুষার ঢুকেছে। দরজার হাতল ঘোরানোর আগে অন্ধকার ঘরটার দিকে একবার ফিরে তাকায় সে। কত খাটনি, কত আনন্দ সব এই ঘরে। অভাব অনটন সত্ত্বেও সুখের সংসার তার। আর কোনোদিন দেখতে পাবে কি?
দরজা খুলে বাইরে আসতেই তুষারকণা যেন হাজার হাজার ছুরি হাতে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। টর্চের আলোয় ওই যে দেখা যাচ্ছে ছেঁড়া ওভারঅল ঝুলছে। তার শেষ সুযোগ। সামনে গিয়ে দাঁত দিয়ে ডান হাতের দস্তানাটা খুলে ফেলে মিসেস মিলস। এতো দুর্ভাগ্যের পরও কি আশা করা যায় কিছু? যদি জিম এটার পকেটে দেশলাই কাঠি রেখেও থাকে, ফুটো পকেট থেকে কবে পড়ে গেছে হয়তো। প্রথম পকেট- খালি। দ্বিতীয়, তৃতীয়- খালি। চোখ ফেটে জল আসে তার। নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে সে। আর একটা মোটে পকেট বাকী। যদি সেটাও খালি হয়? কিন্তু আর দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছেনা, হাত অবশ হয়ে গেছে। যদি না থাকে, কী আর করবে, জীবনের শেষ হাঁটাটা হাঁটবে শস্যাগারের দিকে।
এটাও তো খালিই মনে হচ্ছে। তাছাড়া আর কীই বা হবে। হাত বের করেই আনছিল সে, হঠাৎ কী যেন একটা হাতে ঠেকে। পকেটের কোণায়, শক্তমতো কী যেন। নখ দিয়ে আলতো করে খুঁটে দেখে সে, মাথাটা যেন গোলমতো মনে হয়। অসাড় হাত আর নড়তে চায়না তার। জিনিসটা বের করবে কী করে? বুদ্ধি খুলে যায় হঠাৎ। টর্চটা পকেটের নীচে ঠেসে ধরে থাকে। এবার বাইরে থেকে ডান হাতের নখ দিয়ে খুব ধীরে ধীরে জিনিসটাকে ঠেলে তুলতে থাকে। হ্যাঁ একটা দেশলাই কাঠিই বটে। আস্তে আস্তে পকেট থেকে বেরিয়ে আসে সেটা। ডান হাতের বাকী আঙুলগুলো দিয়ে সযত্নে সেটা আগলে ধরে মিসেস মিলস। মাথাটা ঘুরে যায়, আনন্দের চাপা একটা চিৎকার বেরিয়ে আসে গলা থেকে। না না এরকম করলে হবেনা, এখনও যুদ্ধ শেষ হয়নি তার, ফিরতে হবে, আগুন জ্বালাতে হবে। অসাড় হাত থেকে কাঠিটা পড়ে না যায় তার আগে। পকেট থেকে হাত সরায়না সে। আস্তে আস্তে মাথাটা রাখে পকেটের কাছে, দাঁত দিয়ে ধরে থাকা দস্তানাটা ছেড়ে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে যায় পকেটের দিকে। বাঁ হাতে ধরে নেয় দস্তানাটা আর দাঁতের ফাঁকে তিল তিল করে ঢুকিয়ে নেয় কাঠিটা। উত্তেজনায় আর একটু হলেই দাঁত দিয়ে দু টুকরো করে দিয়েছিল আরকি কাঠিটা, মনকে অনেক কষ্টে শান্ত করে অবশেষে দাঁতে কাঠিটা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ায় মিসেস মিলস। অবশ ডান হাতটা কোনক্রমে ঢুকিয়ে নেয় দস্তানায়, কাঠিটা ওই ভাবে ধরে রেখে সে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
যুদ্ধ কিন্তু এখনও শেষ হয়নি, তবে মন তার আশ্চর্য শান্ত। কী করতে হবে সে জানে। আর এবারে সে পারবে। পারতে তাকে হবে। মনে মনে ঝালিয়ে নেয় মিসেস মিলস। দেশলাই বাক্সটা খুঁজে পেতে হবে, স্টোভের ডালা খুলে ভাঁড়ার থেকে তেল এনে সামান্য ছিটাতে হবে কাঠের উপর। তার আগে দস্তানা খোলা যাবেনা। তাহলে কাঠিটা বাক্সের গায়ে ঘষার মতো সাড় থাকবেনা হাতে। তার পর বরফ ঘষে দিতে হবে হাতে আর গালে, যাতে ফ্রস্ট বাইট বাড়তে না পারে। তারপর হিটার জ্বেলে অন্য হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে হবে, তারপর জমে যাওয়া দুধ আর জল কাঠ রাখার বাক্সের পাশে রাখা ছোট কুড়ুল দিয়ে কেটে বের করতে হবে, তারপর-
আবার সেই রান্নাঘর। এবার আর ভুতুড়ে লাগেনা, এমনকী একাও লাগেনা। চিন্তা ভাবনা স্বচ্ছ। টর্চের আলো কমে এলেও আলো জ্বালা পর্যন্ত থাকবে মনে হয়। দেশলাই বাক্সের উপর তুষারের আস্তরণ, কিন্তু তা এত শুকনো যে চাপা দাঁতের ফাঁক দিয়ে ফুঁ দিতেই ঝরে গেল সব। কাঠের উপর তেল ছড়ানো পর্যন্ত হাত কাঁপলো না একবারও। এবার ডান হাতের দস্তানা খুলে হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়ল সে স্টোভের পাশে। আঙ্গুলগুলো পিয়ানো বাজিয়েদের মতো নাড়িয়ে কাজ করছে কিনা দেখে নিল। আস্তে আস্তে দাঁত থেকে আঙুলে ধরলো কাঠিটা, টর্চটা স্টোভের পায়াতে ঠেস দিয়ে রেখে স্টোভের উপর থেকে দেশলাই বাক্সটা নামিয়ে আনলো।
এবার? আর একটাই তো কাজ করার আছে। কিছুতেই যেন করতে পারছেনা সেটা মিসেস মিলস। অন্তহীন মুহূর্ত কেটে যায়। এই কাঠিটার উপর তার জীবন নির্ভর করছে। যদি না পারে-
না, সে পারবে। চুলোয় যাক দুর্ভাগ্য। বাঁ হাতটা স্টোভের ভিতরে রাখা কাগজের উপর রাখে। সেই হাতে ধরা দেশলাই বাক্স। ডান হাতটা যেন চলতে চায়না। স্রেফ ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সেটা ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় বাঁ হাতের পাশে। নিঃশ্বাস আটকে কাঠিটা ঠোকে বাক্সের গায়ে।
দাউদাউ করে কাগজটা জ্বলে ওঠে। বাঁ হাতের দস্তানাটা শিখায় খানিক ধরেই যায়। অসাড় ডান হাতটা টনটন করে ওঠে। কিন্তু তাতে আর কিচ্ছু যায় আসেনা মিসেস মিলসের।
আগুনের গর্জন কানে আসছে তার। চিমনির দিকে উঠে যাচ্ছে আগুন। স্টোভের ডালাটা বন্ধ করে দেয় সে। মন উদ্ভাসিত হয়ে যায়। শিগগির,খুব শিগগির উষ্ণতায় ভরে উঠবে মিসেস মিলসের শরীর।
লেখক পরিচিতি : এডওয়ার্ড ফিতজ-জেরাল্ড ফ্রিপ (Edward Fitz-Gerald Fripp) কানাডাবাসী ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। এমনকি তাঁর লেখা বইয়ের কপিও দুষ্প্রাপ্য। The Outcasts of Canada (১৯৩২) নামে একটি বইয়ের কপি এখনও আছে বলে জানা যায়। এই গল্পটি রূপা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দ্য রাস্কিন বন্ড হরর অমনিবাস থেকে নেওয়া।