শারদ সংখ্যা
![]() |
অলংকরণ : কারিন মাচুসিক |
অ জি তে শ না গ
রেলগেট
শুনেছি আজ বৃষ্টি তোড়ে খুঁজবে পরিত্রাণ,
অস্বীকারে দুর্বিষহ বুকের ভেতর টান।
আদর করে রাত পেতেছে লোভার্ত কার্পেট -
ফুল সরিয়ে কথার পৃষ্ঠে বিষণ্ণ রেলগেট।
রেলরাস্তার পাশে তোমার মুগ্ধ-আদিম ঘর;
এক রাত্রে কী আর হব অশান্ত বর্বর।
বাইরে থাকুক রাতপাহারায় অসভ্য সান্ত্রী,
চাকার মতই গড়িয়ে যাবে অবাধ্য। যান্ত্রিক!
আত্মাছাড়া ছায়ার জগৎ কলঙ্ক একমুঠ -
কলঘরে স্নান, একফালি গান, একান্ত রংরুট।
অ নু প ঘো ষা ল
জেল থেকে লেখা চিঠি
খবরের কাগজেও এসেছে খবরটা।
অল্পবয়সী জেলর আর ওয়ার্ডেন
হাসাহাসি করছিল।
অথচ ওরা জানে,
সব হাসিদের ভোটাধিকার থাকে না।
থাকে না গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার সাহস।
ঘৃণা, তীব্রতম অক্ষম ঘৃণা থাকে শুধু!
রাষ্ট্রের পুলিশ, পুরস্কার, ভাতা
সব নিয়ে এমনই হাসাহাসি হোক,
রিতিমত খিল্লি হোক পাড়ায় পাড়ায়।
শূন্য গুরুত্বে নেমে আসুক
চারগাছা নেতা, মন্ত্রী, হপ্তাখেকো লোক।
একদিন,
দামাল দিনের কাছে খুলে যাবে
যাবতীয় অলক্ষ্মীর ঝাঁপি।
শানবাঁধানো প্রতিটি স্থবির আফসোস
হাহুতাশ ফেলে যাবে লাঙল ফলার মুখে।
আঁচলের খুঁট খুলে দেবে নাহানা বুলুসির মা।
প্রপাত ভাঙবে কেউ।
গাছে গাছে বেমালুম শ্রাবণ উঠবে ফুটে!
তরুণ কবিরা সবকটা ঝুঁকে পড়া
কবিতার লাশ টাঙিয়ে দেবে
চৌরাস্তার মোড়ে।
খুনিয়ার জঙ্গলে,
অসমবয়সী দুটো শাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে
চিৎকার করে জয়দেব বসু পড়ব,
আমি আর সোহিনী।
নিঃশব্দে হেঁটে যাব পরবর্তী গঞ্জের দিকে।
আরও একটা জেল,
আরও একটা অন্ধকার কুঠুরি।
ডালে ডালে কৃষ্ণচূড়া ফুটে ওঠার অপেক্ষা।
আমি আর ওয়ার্ডেন দু'জনেই জানি,
কাকেদের পরিচ্ছন্ন উড়ান সংক্রান্ত
কোনও উদাহরণ থাকে না।
অ ভি স মা দ্দা র
তলান্ন, এই তরঙ্গপ্রাণ- ১৭
কোথাও টুপ শব্দে কেউ একজন
ফিরে আসে, ফিরে আসি
তোমার পাশে, তোমার সারাদিনের শ্রমের খুকু
যা নিয়ে তুমি খুব আদরে ঢালছ -ভুলে যাওয়া
তার কিছু দূরে দেখো নিভু নিভু সন্ধ্যাকাল
সেও এসেছে পাশে
তার আধখানা খালাসি
তার জীবন জীবন মামুলি ছোলাভাজা
আমরা উপুড় করেছি একসাথে
আমরা একসাথে সেসব বোবাধ্বনি
যা এক ভেতর জ্বলন্ত মানুষ থেকে উঠে আসে
সেসব মর্মর থেকে
তারই লঝঝড়ে লরির কেশে কেশে চলে যাওয়া
কী যে তুমুল, শব্দময়
কেন যে ঠক্ শব্দ এত আন্তরিক, ভায়া
তুমি তা জানিলে না কিছু
কখন লুটিয়ে পড়ে, ত্রস্তজোছন
কখন ছড়িয়ে যায়
কবিতা কবিতা নামে কিছু পর্ণ-ডাকাডাকি!
গো লা ম র সু ল
আমার হাত আমার দেশ
পৃথিবীর দুলন্ত রশির খুঁটি
আমার দুহাত নোঙর তোলা বিশাল দূর
আফিম ভরা শীতের মেঘ
মাতালের মতো দুএক ফোঁটা বৃষ্টি
আমরা একসঙ্গে কাঁদছিলাম দুটি অশ্রু
শেকলের মতো হাসি পৃথিবীকে বেঁধে রেখেছে
যেন জীবন ছেড়ে চলে না যায়
চৌরাস্তার মোড়
শব দেহের কথোপকথন
যখন পোকায় রূপান্তরিত হয়
ক্ষতের মুখ দিয়ে প্রবেশ করি একটি গলিতে
যেখানে আকাশ পিষে দেয় যাঁতা
তুমি কি কখনো দেখেছো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া মানুষের আস্তানা গুলো
রাত্রির শহর একটি অরণ্য
আমি তার মধ্যে কাঠুরিয়াদের সংখ্যা গুনছিলাম
স্পর্শ কাতর আমার আঙুল কেটে গিয়ে একাকি বাজছিল একটি সংগীতের মতো
আর আমি দেখছিলাম কিভাবে বড়ো বড়ো মেঘের কুঁড়ি গুলো নষ্ট হচ্ছে
কক্ষ পথ দিয়ে হাঁটছিলাম সেই সব মানুষগুলোর দিকে
যারা ভাগাভাগির সময় হারিয়ে গেছে
কয়েকটা ন্যাড়া পাহাড়
পাথর ফেটে জল পড়ছে
তুমি কি কখনো সেই নিঝুম জলের শব্দ শুনেছো
এই কক্ষ পথে আমার হাত আমার দেশ
মানুষের জন্য প্রার্থনা আমার ধর্ম
ব ন্যা ব্যা না র্জী
নষ্ট
ছাদে এলেই পুরনো আত্মীয়ের ভীড়
ফুলপিসিমার হাতে লাল চুলের ফিতে
তার উদাসী বৈধব্যে
এলোকেশী শসার গন্ধ পায়
মাথার ওপরে কলমকারি আকাশ
গান গেয়ে ওঠে চারুলতা
পৃথিবীটা তখন এক নষ্টনীড়
বৈ জ য় ন্ত রা হা
আক্ষেপ
তরঙ্গ ফুরিয়ে আসে।
পাহাড়ের চূড়া থেকে কামকেলি যোগান দেয় না আর শীতবাহ
শুধু নুড়িগুলো অনতিদূরের হাওয়া গিলে খায়
ব্যাঙের ঝাপান শুনে মজা নদী জেগে ওঠে
বর্ষার রোদটুকু ফেরারী দস্যুর মতো ক্ষমা ছুঁড়ে মারে
ভিক্ষার ঝুলি থেকে শাপ বেরিয়ে এলে শামুকের খোলে পা কেটে যায়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলো? বিগত যৌবনা...
প্রেমিক কী নিয়ে এসে ফেলে গেছে একা বালুচরে
আগুনের কণা থেকে তুলে নিতে জলজ বাসনা,
ক্লিষ্ট-কুসুম, বাসি ঝড়, বিদ্যুৎ-পুরাণ ও বিরহ বেদনা
আঁচলের ভুল কোণে গিঁট বেঁধে বসে থাকো খালি পাটাতনে?
নৌকাও ভেঙে পড়ে?
পাথরে জলের দাগ দেখে না কী কেউ?
সূর্যের শেষ আভাটুকু
ছুঁয়ে যায় না-ফুরোনো প্রেমের ইচ্ছায়...
তারাদের হাত এসে বালি-ঘড়ি ভেঙে দিয়ে যায়।
বৈ দ্য না থ চ ক্র ব র্তী
সন্ধ্যাগান
৫
মানুষটি বঙ্গে ছিল, বর্ণে-বিভঙ্গে
পোড়ামাতলার দেশে, এখানে
এ বঙ্গে
রন্ধ্র পেলে ধুরন্ধর যেত বাঁশবনে
সবুজ জোছনা পেত মেখে নিত মনে
একদিন নারী এল জানালার ধারে
জরুরি কাগজপত্র বোঝাচ্ছিল কারে
সেসব রহস্য আজও বোঝা তো গেল না
কাছে আসবে বলে কই কাছে তো এল না
আর তো সময় নেই দিতে হবে বলি
নইলে ঘাড় ঠেসে ধরবে দুরাত্মা সে কলি
কলি, নাকি কল্কি অবতার, মানছে না সীমা
মানছে না কোনো বাধা ধবল পশ্চিমা
বাধ্য করবে তাকে এই জ্বালাময় ক্ষত
দীনানুদীনের কাছে মাথা হবে নত...
র বি ন ব ণি ক
নিশ্চিত চেয়েছিলাম
নিশ্চিত চেয়েছিলাম কেউ একজন আমার ভেতর ঢুকে বাসা বাঁধুক
কেউ একজন হঠাৎ আলো নিভিয়ে ব’লে উঠুক এই তোমার সারাদেশ
কেউ হঠাৎ ভিড় থেকে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনুক আমার গতকাল,
মুছে দিক মস্তিষ্ক ফেটে বেরিয়ে আসা শতকের ঘন রক্ত, কিন্তু না,
এসব নয়, আমি শুধু দৌড়ে যাচ্ছি দৌড়ে যাচ্ছি বছরের পর বছর একটা
কাটা ঘুড়ির পেছন পেছন, ঘুড়িটা ভাসতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে যেতে
লাগলো স্বাধীনতার দিকে, আমি সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্র, শ্মশান, কবর, মহাসমুদ্র
ডিঙিয়ে সেই কাটা ঘুড়ির পেছন পেছন সারাটা পৃথিবী, সারাটা পৃথিবী
আমি নিশ্চিত চেয়েছিলাম কেউ একজন শীতের সমস্ত নদী কুড়িয়ে
বুকের ভেতর ছয় বছরের শিশুর মতো একটা চিন্তাহীন বাসা বাঁধুক
শ্যা ম শ্রী রা য় ক র্ম কা র
ভিখারি ২
বৃদ্ধ ভিখারি, রোজ পড়ে যান চলন্ত লোকালে
সর্বশরীর কাঁপছে, যেন এই শেষ
আপনি কি ভবিষ্যৎ
আপনিই কি অক্ষম দেশ
শিরার পদ্ম নীল হয়ে উঠছে করতলপিঠে
বৃদ্ধ ভিখারি, ফের উঠে যান অন্য কামরাতে
অথচ কী কাশফুল! অথচ কী মেঘহীন নীল
ঋতুচক্র পরে এলে অমল ধবল মুখবেশ
উৎসবও সেজে ওঠে, আপনার সাজ-আহ্লাদ নেই?
বৃদ্ধ ভিখারি, আপনি মহাকাল, বৃষভবাহন
দারিদ্র্যের শৃঙ্গে রজ্জু পরিয়ে আপনি মনোহর
উথলপ্রবণ দুঃখ, সুখ তার বায়ুভূক সর
আপনাকে ভিক্ষা দিই, এমন আমার সাধ্য নেই
শূন্য না পেলে রুদ্ধ হয়ে যায় আলোকের গতি
আমরাও শূন্য হতে ক্রমশ শূন্যের দিকে যাই
অর্জন করিনি আজও, আজন্ম হৃদয় পেতে আছি
হে বৃদ্ধ , আমাদেরও যে একমুঠো আলো ভিক্ষা চাই
শ ত দ ল মি ত্র
দুটি কবিতা
সমিধের কাল
যখনই আলো নিভে আসে
আর নিজেকে হারাই বার বার
ভাবি—
শেষবারের মতো এবার তবে
ঘুরে দাঁড়ানোই ভাল!
একই রকম ভাবে প্রতিবার
ঘুরতে ঘুরতে উত্তরবেলায় দেখি
ফিরে এসেছি সেই আদিম বিন্দুতে
যখন আলো আর অন্ধকার সহোদর—
সামনে নির্বেদ দাবানল
আর পেছনে বৌদ্ধিক জলহীন খাদ
এখন কি তবে মুখটাকে ছিঁড়ে ফেলে
মুখোশটাকেই কবন্ধে বসাব!
বৃষ্টির আগে, আপাতত
নিরম্বু অগ্নি সমিধ পাক...
অন্যোপনিষদ
এখন নিষ্পত্র বৃক্ষসকল স্থবির
বায়ুও স্তব্ধবাক নিথর
রুদ্ধ নদীর বুকে চুম্বন আঁকে নাই
জ্যোত্স্নার মায়া
ঘননীল অন্ধকারে জাগে নাই চাঁদ
মৃত্তিকাও কর্ষণহীন, গর্ভাধানবিরত
এ বিষম কালে
রথের দশঘোড়া লাগাম ছেঁড়া
দশদিকে ধায়
সারথি অপ্রাকৃত সমাধিগ্রস্ত,
ভগ্নরথে সত্য শুধু স্বয়ং এ আমি
দেখ নিরুপায় খুলেছি বাকল!
উলঙ্গ হতে হতে যদি কোনো সমর্থ কালে
নিজ পদতলে অর্ঘ দিতে পারি
দ্বিশত ষট জীবাশ্ম পদ্ম--
সে ভবিষ্যে হয়তো
মৃত্যু ভেঙে ঝলকাবে বজ্র…
আপাতত নির্বাসন
সব দেবালয় বন্ধ আজ!
শা ন্ত নু পা ত্র
অভিমান
প্রাচীন রাস্তা মোহময় ঢালু, চর্যাপদের মতো।
দুপাশে বিরুৎ, অগুন্তি কত গুল্মলতার ঝাড়।
সড়ক যোজনা, তবুও কেন যে বরাবর থাকে ক্ষত!
একটু এগোলে রহস্য-নদী শুয়ে আছে নিঃসাড়।
দাঁড়িয়ে আছেন ছন্দগন্ধা, উড়ছে আঁচল শ্বেত।
কান পেতে শুনি ঘন্টার ধ্বনি, দূর কোনও মন্দির।
দেবী-মহিমায় উজানের স্রোতে― পর্ব, মাত্রা, দল...
আমি নগণ্য, ক্লান্ত পথিক নদীর প্রান্তে এসে
ধরতে পারি না, জন্মাড়ষ্ট, ভয়ানক দুর্বল।
নির্বোধ আমি বসে থাকি ঠায়, নিছক এখানে আসা...
আঁজলায় জল, বুঝিনি তবুও নদীর সুনীল ভাষা।