শারদ  সংখ্যা 

অলংকরণ : গুগল




পিছিয়ে দেওয়াল 

ঋ ভু  চ ট্টো পা ধ্যা য়




পু দরজাটা বন্ধ কর’ কথাটা কানে গেলেও তপু তখন জানলা দিয়ে পাশের পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছে।পুকুরটা বড় নয়, তবে চারদিক অসংখ্য বড় বড় তাল আর খেজুর গাছ।ওখানেই সকাল দিকে ক্যাওট পাড়ার অবনী দুটো ট্রাকের টিউবে একটা পাটা বেঁধে মাছ ধরে। তারপর বড় বড় বাঁশের কাঁটা সারা পুকুরে ফেলে দেয়। তপুর বাবা পুকুরটার নাম বলেছে, ‘নিমাই দিঘী।’


‘দিঘী তো অনেক বড় হয়, এটা তো ছোট।’ ক্লাসে দিদিমণি পড়া বোঝানোর সময় এই কথাগুলোই তার মনে আসে।বুঝতে পারে না, কাউকে জিজ্ঞেস করলেও সঠিক জানতে পারে না, খুব মুশকিল তবে বাবাকি মজা করল, এটা দিঘী তো নয়, ডোবা, না গোঁরে। সে যাইহোক, সকালে স্কুল যাবার আগে তপু জানলাতে পা ঝুলিয়ে মাছ ধরা দেখে।মা তখন  অন্য পুকুরে স্নান করতে যায়।কিছুটা রান্না করে নেয়, বাকিটা এসে করে। বাবা সকাল আটটাতে খেতে বসে, সাড়ে আটটাই অফিসে বের হয়।তপুর পৃথিবী মানে এই জানলা আর তার সাথে লাগানো বিছানা।এখানেই শুয়ে শুয়ে দুপুরে আকাশও দেখে। সকালে উল্টোদিকের নাপিত পাড়ার বৌ’গুলো পুকুরে আসে।পায়খানা করে, স্নান করে, এই সময় তপু জানলা থেকে সরে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে।ভয় লাগে, ‘কেউ যদি দেখে ফেলে!’


একতলাতে বড়জ্যাঠা থাকে, বড়জেঠিমাকে তপু ‘বৌমা’ বলে। বৌমা সকাল থেকে সারাটা দিন রান্নাঘরে থাকে।তপু একবার জানলা থেকে নিচে পেচ্ছাপ করে দিয়েছিল। বৌমা সব্জি ধুচ্ছিল।গায়ে না পড়লেও চিৎকার করছিল।তপু কি করবে, মা না থাকলে দুপুর বেলাতেও যে তার ভয় করে। মা কোথায় গেছিল যেন, ও গুইনের দোকানে, শাড়ি কিনতে, নিজের না, একটা বিয়েবাড়িতে দেবার জন্যে।


বাবা বলেছে, ‘দুপুরে কোন দিন নিমাই দিঘীর দিকে যাবি না, বিজয় মামাদের বাহাদুরটা দুপুর বেলাতেই ওখানে ডুবে মরে গেল, তাও গ্রীষ্মকালে, সেরকম জল ছিল না।’


দুপুরে তপুর ঘুম আসে না, পাশে মা ঘুমায়, তপু পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে, তালগাছ দ্যাখে, খেজুর গাছ দ্যাখে, আর নাপিত পাড়ার ছেলেগুলোকে দ্যাখে।ওরা কি সুন্দর দুপুরে পুকুর পাড়ে ঘুরে বেড়ায়।ঝোপে হাত দিয়ে হাঁসের ডিম খোঁজে, পেলে কুড়ো জ্বালিয়ে ডিম সেদ্ধ করে। তপুর খুব তাদের মত ঘুরতে ইচ্ছে করে, ডিম সেদ্ধ খেতে ইচ্ছে করে, মা বকে, দরজা বন্ধ করে, চাবি নিজের বালিশের নিচে রেখে ঘুমায়।তপু দুপুরেই ছাদে ঘুরতে চলে যায়। একদিন হনুমান তাড়া করেছিল। তপু ছুটে ঘরে চলে এলেও দরজা লাগায় না, একটা হনুমান ঘরে ঢুকে যায়। তপু চিৎকার করে। মায়ের ঘুম ভেঙে যায়, বিছানায় উঠে বসে, বিছানার নিচে হনুমান। মা চিৎকার করে ওঠে। হনুমান মায়ের চিৎকারে ভয় পেয়ে খোলা বারান্দা দিয়ে পালায়। মা আবার তপুকে বকে, ‘কতবার বলেছি দরজা বন্ধ করবি, দেখলি তো কেমন হনুমান ঢুকে গেল।’ 


মায়ের এই কথাগুলোই তপুর দু’কানে ঘোরাফেরা করে।এমন অবস্থা দুপুরে বন্ধ জানলার পাশে বসে থাকে, ভয় লাগে হনুমান যদি জানলাতেও এসে যায়। একদিন তো এসেছিল, তপু সেদিন জানলাতে দুটো পা ঝুলিয়ে সকালে টিফিন খাচ্ছিল, সামনে বিজয়দাদুদের রান্নাঘরের চালে হনুমান আসছে, নামছে, লাফাচ্ছে, উঠছে, পড়ছে। কোথাও কিছু নেই হঠাৎ তপুর টিফিন খাওয়া দেখে একটা হনুমান এক লাফে জানলার দুটো লোহার রড ধরে ঝুলে পড়ল। তপু টিফিনের বাটি ফেলে বিছানার উপর বসে থরথর করে কাঁপতে আরম্ভ করল।মা সেই সময় নিচে কি একটা দরকারে বৌমার রান্নাঘরে গেছিল। তারপর পুজোর ছুটিতে পিসির ছেলে পিন্টু এল, তপুরই বয়সী, কিন্তু বেশ চাবুক ছেলে।এসেই সারাটা দিন পুকুরের পাড়ে বসে থাকত।তপুকেও থাকতে হত, পিন্টু একক্লাস উঁচুতে পড়ত, তপু সিক্স, পিন্টু সেভেন।তপু তাও দাদা বলত না, পুকুর পাড় থেকে তার পাশের রমাদিদের বন্ধ থাকা একতলা বাড়ির ছাদে উঠে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। সেই সময় পিন্টু ঐ বয়সে বিড়ি ধরিয়ে তপুর মুখে গুজে বলে ওঠে, ‘নে এবার সুখটান দিয়ে পুকুরে মাগীদের স্নান দ্যাখ, এই সব আমাদের ওখানে পাওয়া যায় না।’


পিন্টুদা ঐ বয়সেই বাসে চেপে তিরিশ কিলোমিটার দূরে একটা ভিডিওহলে অসভ্য সিনেমা দেখতে যেত।একবার পুলিশে রেড করেছিল। হলের পিছনের দরজা দিয়ে দৌড়। অনেকটা গিয়ে তারপর বাসস্ট্যাণ্ড পেয়েছিল।তপুর এই সব ঘটনা মাথার উপর দিয়ে যায়।তখনই নিজেকে খুব ছোট লাগে।এমন একটা জায়গায় থাকে এতটা বড় হল কিছু জানে না।পিন্টু’দা ছেলেদের স্কুলে পড়ে, তাও সময় অসময়ে মেয়েদের স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।একটা গার্লফ্রেণ্ডও বাগিয়ে নিয়েছে।আর তপু নিজে….।


‘তুই চিরটা কাল মায়ের ভয়েই মরবি, ফুলশয্যার রাতেও বৌয়ের পাশে শোওয়ার আগে মায়ের ভয়ে প্যাণ্টে মুতে ফেলবি।’ কথাগুলো সত্যিই। তপু ভাবে, আর চোখের সামনে পিন্টুদার বিড়ির ধোয়া মেঘের মত আকাশের বুকে ছড়িয়ে যায়। তপু পিন্টুদার হাত থেকে বিড়িটা নিয়ে টানতে যায়, এমন সময় ছাদের দরজা খুলে যায়। রমাদির তপুর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘তাই তো ভাবি, ছাদে এখন কে থাকবে, তোরা এই বয়সে এখানে বিড়ি ফুঁকছিস?’ তপু ভয়ে কাঁপতে থাকে, কিছু কথা বলতে পারে না। রমাদি তপুর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমি আজই কাকিমাকে বলছি।’


পিছন ফিরে দ্যাখে পিন্টু ততক্ষণে ছাদ থেকে প্রাচীর ডিঙিয়ে নিচে নেমে গেছে। তপুর সামনে রুমাদি নাকি যমের স্ত্রী’লিঙ্গের কেউ?


                                                  ২ 


–তোমার যত সব বেশিবেশি, আরো তো সবাই আছে, কে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।


–কেউ যাচ্ছে না বলে আমরাও যাবো না, সেটা তো হতে পারে না।তাছাড়া তপু বড় হচ্ছে, এখানে থাকলে ওর পড়াশোনা কিছুই হবে না। এই তো বিড়ি ফোঁকা শুরু করেছে, কদিন পরে আরো কিছু আরম্ভ করবে। তোমাদের পাড়ার কেউ তো পড়াশোনা করে না, সারদিন খালি ঘুরে বেড়ায়, আর একটু বড় হলেই প্রেম করতে আরম্ভ করে।এখানে থাকলে তপুর কোন দিন ভালো রেজাল্ট করতে হবে না।


তপু কিছু বলতে পারে না, মায়ের উপর বাবাও কথা বলতে পারে না, তপুও তো নয়ই। মা স্কুল আর টিউসন ছাড়া তপুকে বাইরে বেরোতে দেয় না।তপু তাও টিউসনে থেকে মাঝেমাঝেই একটু দেরি করে ফেরে। মাঠে তার বয়সী ছেলেরা খেলে, গাছে চড়ে, সাঁতার কাটে। কিন্তু তপু তাদের কাছে গেলেই তারা মজা করে বলে ওঠে, ‘কিরে, তুই এখানে কেন, যা শুয়ে শুয়ে মায়ের দুধ খা, বাইরে বেরোলে তোর মা এক্ষুণি আমাদেরও বকতে আরম্ভ করবে।’


তপু বাড়ি ফিরে মায়ের উপর রেগে যায়, কিন্তু বলতে পারে না, ‘আমি গাছে চড়ব, সাঁতার কাটব, খেলব।’


প্রাইমারী স্কুলে পড়বার সময় হেডস্যারের এক নাতি স্যারের বাড়িতে থাকত। কি সুন্দর মোষের পিঠে চেপে স্কুলের মাঠে ঘুরে বেড়াত, তপু তার দিকে একঠায়ে তাকিয়ে থাকত, পড়াতে মন বসত না। কথাগুলো বাড়ি ফিরে মাকে বলতেই মা পরের দিন হেডস্যারের সাথে দেখা করে টিঙ্কার নামে কি সব বলে আসে।হেডস্যারের নাতি তার নিজের বাড়ি চলে যায়।


                                               ৩ 


নতুন জায়গায় এসেও মায়ের কিছু পরিবর্তন হয় না, বরং এখানে এসে বাবা আরো ব্যস্ত হয়ে যায়। অফিস যেহেতু কোয়ার্টার দিয়েছে তাই বাবার তিন শিফ্টে কাজ আরম্ভ হয়। মা সব কিছু সামলে তপুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। স্কুলে নিয়ে যায়, টিউসনে নিয়ে যায়, এমন কি বিকালে একটা জায়গায় বাবা ফুটবল খেলা শেখার জন্যে ভর্তি করেছে, সেখানেও মা নিয়ে যায়।যতক্ষণ খেলা শেখে মা বসে থাকে। সবাই হাসে, এমনকি টিউসনের মেয়েগুলো পর্যন্ত বলে, ‘হ্যাঁরে, তোর মা কি এখনও তোকে ছুঁচুও করে দেয়।’ অথবা ‘তোর তো বেশ ভালো, বাড়ি যাবি মায়ের দুধ খাবি, ঘুমিয়ে পড়বি।’ 


তপু শুনে যায়, কষ্ট হয়, চোখ দিয়ে জল পড়ে, কিন্তু গালে আসার আগেই তপু চোখের জল মুছে দেয়। মায়ের চোখে পড়লে এক্ষুণি চিৎকার আরম্ভ করবে। মেয়েগুলোকে বকবে, তাদের মায়েদের সাথে ঝগড়া আরম্ভ করবে। তপুর খুব খারাপ লাগে, প্রতিদিন বাবাকে বলে, বাবা মাকে বললেও কাজের কাজ কিছু হয় না। উল্টে মা বাবাকে বোঝাতে আরম্ভ করে, ‘এক্ষুণি কিছু হয়ে গেলে কে দায়িত্ব নেবে? তুমি!’


-তা বলে ছেলেটাকে ভ্যাঁদাকান্তের মত করে মানুষ করবে? ওকে একা ছাড়ো, পৃথিবীটাকে দেখুক, চিনুক, খারাপ লোক ভালো লোকের পার্থক্য বুঝুক।


-বাড়িতে থাকতে তো একা ছেড়ে দিয়েছিলাম, কি হল, তোমারই বোনের ছেলে তপুকে বিড়ি খাওয়া শেখাচ্ছিল।


–আরে ও যদি শেখে তুমি বারণ করলে কিছু করতে পারবে? এখন ক্লাস নাইন, মাধ্যমিক, হায়ারসেকেণ্ডারি, তারপর তো কিছু প্রফেসেনাল কোর্স করাতে হবে। তুমি কি সেখানেও যাবে?


মা এরপর আর কিছু উত্তর দিতে পারে না। তপু একবার বাবা আরেকবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়। মায়ের মুখে মেঘ জমে ওঠে। সেই মেঘের অন্ধকারে দেশের বাড়ির বন্ধুরা ঘুরে বেড়ায়, গাছে চড়ে, সাঁতার কাটে, খেলে, মজা করে। ওখান থেকে বাবার কাজের শহরে এসে পৌঁছায়। এখানেও বন্ধুরা সাইকেল চালায়, খেলে, আর তপু মায়ের সাথে একপা একপা করে হাঁটে। 


                                                       


এই বছর থেকে একা একা পড়তে যাচ্ছে। বাবা বহুকষ্টে একটা সাইকেল কিনে তপুকে শেখাল। তাও প্রথম দিকে বাবা রেগে যেত, তপুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠত, ‘লোকে কি বলবে, এই বুড়ো ভাম, টেনে পড়ে, মাধ্যমিক দেবে, এখন সাইকেল শিখছে। চারদিকে দ্যাখ, তোর বয়সি আর কে সাইকেল শিখছে। সবাই এই সময় বাইক চালাচ্ছে, একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছে।’


তপু বলতে পারে না,‘এতে আমার কি দোষ, আমি তো সব কিছু করতে চাইছিলাম, মা বারণ করে এক্কেবারে শেষ করে দিল।’


সাইকেল চালায়, রাস্তায় ধাক্কা লাগে তারপর কাঁপা হাতে সাইকেল চালিয়ে পড়তে যায়। পাশের পাড়া থেকে সুমনা নামে একটা মেয়ে যায়। তপুর মা তার সাথে তপুকে পড়তে পাঠায়।সারাটা রাস্তা সুমনা তপুর উপর চিৎকার করতে করতে যায়। টিউসনে বাকি ছেলে মেয়েরা তপুকে প্যাঁক মারে, ‘তুই কি বসে বাথরুম করিস?’ ‘তোরটা কাটা না গোটা?’ ‘গোটা থাকলে দাঁড়ায়?’


তপু বাড়িতে এসে এবারেরও কাউকে কিছু বলতে পারে না। মাকে রাগ লাগে কিন্তু মায়ের মুখের উপর কোন কথা বলতে পারে না। পিসির ছেলে পিন্টুর কথা মনে আসে, কয়েকটা দিন পিন্টুর সাথে থাকলে…।পিসির কথা শুনলেই মা রেগে যায়। বাবাকে বলে, ‘না, ওদের এখানে আসতে হবে না। বাড়িতে যেতে বল।’ কিন্তু তপু বাড়ি কিভাবে যাবে? বাবা তো একাই যায়।


                                                     


মাধ্যমিক পরীক্ষা এগিয়ে আসে। তপু রাত জেগে পড়ে, মা বসে থাকতে চায়, এবার তপু রেগে যায়। আলাদা ঘরে পড়তে বসে। ঐ ঘরেই পড়ে, শুয়ে পড়ে, ঘুমায়, আর মায়ের কাছে শুতে চায় না, একটা ঘরে একা শোয় মা চিৎকার করে, বকে মারতে যায়, বাবা চিৎকার করে। বাবাকে আলাদা ঘরে শুতে হয়। মা জোর করে তপুর পাশে বসে থাকে। তপু পড়ে আর মাঝে মায়ের দিকে তাকায়।রাত হলে একটা অন্ধকার জঙ্গল তপুকে ঘিরে ধরে, তপু ভয়ে চোখ বন্ধ করে। তাও জঙ্গলটা এগিয়ে আসে, সব গাছ থেকে হাত বের হয়, তপুকে জাপটে ধরে তপু ঘামে, সারা শরীরে একটা শিরশিরে হাওয়া বয়ে চলে, কেমন যেন অস্বস্তি হয়, তপু চোখদুটো বন্ধ করে দেয়। সেই সময়েই বারমুড়ায় টান লাগে, ভিজে যায়, চাদরেও দাগ লাগে।পরের দিন বিছানা গোছানোর সময় দাগে মায়ের চোখ যায়। তপুর দিকে তাকায়, কিছু বলতে পারে না, তাও কেমন যেন অদ্ভুত লাগে, মাকে জঙ্গল মনে হয়, মায়ের শরীরে পাতা, ডালপালা, তপু আর পিছিয়ে যেতে পারে না।





অলংকরণ : গুগল



রিখিয়াকে যেদিন শেষবার

দেখেছিলাম

সা গ্নি ক  সি ন হা



রিখিয়াকে যেদিন আমি শেষবার দেখেছিলাম, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সে। পাঁচমিশালি ভিড়ের বিশৃঙ্খল মধ্যবিত্ততার মাঝেও বেমানান উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল তাকে। তবে সদ্য ফোটা টিউলিপের মতো না, অনেকটা আগের রাতের স্মৃতির গন্ধ মাখা রজনীগন্ধার মতো লাগছিল আমার রি 'কে। ভীষণ সাদামাটা ধূসর জনতার কোলাহল ছাপিয়ে ওর নিঃশব্দ চোখের অভিযোগ হাজার ডেসিবেলের গর্জন নিয়ে আছড়ে পড়ছিল আমার কানে। ওর মলিন মুখে হাসির আভাস ছিল না। অভিযোগ না বিস্ময়, নাকি আফসোস… বুঝতে পারিনি কি ফুটে উঠেছিল নিটোল ভাস্কর্যের মতো মুখটায়, আমার ভীষণ প্রিয় মুখটায়। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম আমি, সম্ভবত চোখের জল লুকানোর জন্য।

সেই শেষবার।

তারপর বৃষ্টি নেমেছিল অঝোর ধারায়।



(তিন সপ্তাহ আগে)

দুম দুম দুম...

দুম দুম দুম... 


অন্ধকারে ধড়মড় করে লাফিয়ে উঠলাম হঠাৎ। আলো নিভিয়ে টিভি দেখছিলাম একমনে, এমন সময় আচমকা টিভির সাউন্ড ছাপিয়ে এই বিকট শব্দ। দরজা ধাক্কাচ্ছে কেউ, যেন পেটাচ্ছে প্রায়। কে আবার এল এখন! ঘড়িতে দেখাচ্ছে রাত আটটা। রিখিয়া কি চলে এলো নাকি এর মধ্যেই? ও তো এইভাবে ডাকে না কোনোদিন!

উঠে দৌড়ে গেলাম দরজাটা খুলতে।

যাহ! কই, কেই নেই তো? আমি যে স্পষ্ট শুনলাম দরজায় কে যেন ধাক্কা মারছিল। গেটের মাথার আলো জ্বালিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। নাহ্, বিলকুল ফাঁকা। আশেপাশের বাড়ি থেকে কাউকে বেরোতে দেখছি না, সামনের রাস্তাও শুনশান, একটা কুকুরও দেখা যাচ্ছে না, শুধু স্ট্রিটলাইটটা দাঁড়িয়ে একা একা আলো ছড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।


ছোট্ট মফস্বল এলাকা এটা, কলোনির একপাশে একখানা একতলা বাড়ি নিয়ে কয়েকমাস হল থাকছি, বেশ নিরিবিলি এলাকা। কেন থাকছি? এই রে, কেন বলুন তো! আমি এখানেই কোথায় একটা চাকরি করি, ঠিক মনে করতে পারছি না, কিছুতেই মাথায় আসছে না নামটা। 

হ্যাঁ, এইবার মনে পড়ছে। আমি নির্বাণ বোস, বয়স বত্রিশ, এখানের কর্পোরেশন ব্যাংকের ম্যানেজার হয়ে এসেছি গত ফেব্রুয়ারিতে। আমার স্ত্রী রিখিয়া মুখার্জি, পেশায় শিক্ষিকা। আগে স্কুলে চাকরি করত, তারপর ট্রান্সফার হয়ে আসার পর থেকে আপাতত শুধুই টিউশনি। এখনও ও পড়াতে গিয়েছে একটু দূরের এক স্টুডেন্টের বাড়িতে, ফিরে আসবে আরো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে।

হ্যাঁ, এই যে কেমন গড়গড় করে বলে গেলাম সব। এখন মাথা পরিষ্কার। মাঝে মাঝে কি যে হয়, কোথায় আছি কি করছি বেমালুম ভুলে মেরে দিই; আরে, এমনকি নিজের নামধাম পর্যন্ত বলতে পারি না ! বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা যাকে বলে। ডাক্তার দেখিয়েছিলাম কলকাতায়, বলল কি একটা সাইকোলজিক্যাল অসুখ করেছে, সেটারও নাম মনে নেই এই মুহূর্তে। মাঝেমাঝে আমার নার্ভ গুলো ঠিকভাবে কাজ করতে চায়না,  মেমোরি'রা জুড়তে পারেনা পরপর, কোনো কানেকশন তৈরি হয় না। তখনই কিছু সময়ের জন্য ওইরকম ফক্কা হয়ে যাই।

সে যাকগে, এখন ব্যাপারটা কি হল তাহলে? কানে ভুল শুনেছি কিনা বুঝলাম না। ভিতরে ঢুকে এসে চুপচাপ আবার টিভি দেখতে থাকলাম। আর কিছু ঘটেনি। অন্তত আরো তিন চার দিন।



সেদিন বিকেলে রাকেশ আর প্রমথ এল, আমার কলেজের বন্ধু। হঠাৎ করেই ব্যাংকে দেখা হয়েছিল সপ্তাখানেক আগে, সেদিনই বাড়িতে ঘুরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ করে রেখেছিলাম। ওরা দুজনেই এখন কোনো এক অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি করছে, এই কাছাকাছিই একটা বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকে। এককালে একদম গলায় গলায় ভাব ছিল, কলেজ ছাড়ার পর যোগাযোগ কমে এল, ঘনিষ্টতা আলগা হয়ে পড়েছিল সময়ের নিয়মেই, অনেকদিন পর দেখা হতে এতদিনের জমিয়ে রাখা হাজার কথা বাঁধনহারা হয়ে বেরিয়ে এল। 

রিখিয়া পড়াতে গিয়েছিল, সামনে এক্সাম সিজন বলে ওর এখন বেজায় চাপ চলছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেই মেসেজ করেছে একটা একস্ট্রা ক্লাস আছে, ফিরতে রাত হবে।

তাতে ক্ষতি নেই। আজকে অন্তত আর ভূতের মত টিভি নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে না। জমাটি আড্ডা হচ্ছিল তিনজনে। প্রমথ এক বোতল ওল্ড মঙ্ক আর কোক এনেছে, মোড়ের স্টল থেকে মুচমুচে চিকেন পকোড়া আনিয়ে নিয়ে জোরদার আসর বসিয়ে দিলাম আমরা।

ঠিকঠাক মনে পড়ছে না, তবু যতদূর সম্ভব সন্ধ্যে সাতটা হবে। কিংবা রাত আটটা নটা'ও হতে পারে অবশ্য, খেয়াল নেই। ততক্ষণে বোতল প্রায় শেষের দিকে, গরম গরম রসালো সব গালগল্পের মাঝে এতটা খেয়ে ফেলেছি কখন কারোরই খেয়াল নেই। এর মধ্যে প্রমথ আবার হালকা মাতলামি শুরু করেছে। প্রথমেই বলে আমাদের ছাড়াও নাকি ড্রয়িং রুমে কাকে যেন দেখতে পাচ্ছে ও। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সোফা ছেড়ে সটান মাটিতে নেমে পড়ল, মেঝেতে নাক লাগিয়ে কুকুরের মতো শুঁকতে শুরু করল। এদিকে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছি আমরা দুজনে।

বেশিক্ষণ গেল না, তার আগেই বেসিনে গিয়ে হড়হড়িয়ে বমি করে একদম ভাসিয়ে দিল সে। ওষুধ আনতে ছুটলাম দোতলায় বেডরুমে। সবে ঘরে পা দিয়েছি কি দিইনি, এমন সময়... আবার! 


দুম দুম... 

দুম দুম...


কে যেন সর্বশক্তি দিয়ে আসুরিক আক্রোশে হাতুড়ি ঠুকছে দরজায়, নাকি ভেঙে ফেলতে চাইছে। ঊর্ধ্বশ্বাসে নিচে এসে দেখি ওরা দুজনেও ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। রাকেশ নাকি দেখতে গেছিল পিপহোল দিয়ে। কেউ নেই!

টানা পাঁচ মিনিট একভাবে হয়ে চলল অলৌকিক শব্দটা, ঠিক দুইবার করে দরজায় ধাক্কা, একটু বিরতি তারপর আবার দুই... । কাঠ হয়ে বসে রইলাম আমরা। মদের নেশায় কি ভুল শুনছি! সেদিনের সেই ঘটনাটাই হয়তো মাথার মধ্যে গেঁথে রয়েছে এখনও। কিন্তু ওরা দুজনে? ওরা তো আর আমার সাথে ছিল না সেদিন, অথচ এখন ওরাও যে শুনতে পাচ্ছে না সবটাই।

যেমন আচমকা শুরু হয়েছিল তেমনই থেমে গেল শব্দটা। উঠে গিয়েই একটানে দরজাটা খুলে ফেললাম তিনজনে। জানতাম ঠিক কি দেখব, তাই বিশেষ অবাক হলাম না। নির্জন রাস্তায় কাকপক্ষির চিহ্ন নেই। আরেকটু পরে চলে গেল ওরা দুজনেই। যাওয়ার আগে বারবার করে মনে করিয়ে দিয়ে গেল যেন কালকেই বাড়ির সামনে সিসি ক্যামেরা লাগানোর ব্যবস্থা করি, আর আশ্বাস দিয়ে গেল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সম্ভবত এটা পাড়ারই কোনো বিচ্ছু ছেলের কাজ। দরজায় নক করে দিয়ে পালিয়ে গিয়ে মজা নিচ্ছে।

হতে পারে, খুব স্বাভাবিক। আবার হওয়াটা ভাবলে অসম্ভবও মনে হতে পারে। মাথাটা ভারী লাগছিল, এমনিতেই শরীর টলছে অনেকক্ষণ ধরে। গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। তারপর সলিড ঘুম, রিখিয়া কখন ফিরেছে সেটাও জানতে পারিনি।



আজকে বাড়িতে একা, সেই প্রথমদিনের মতো। আজ অবশ্য ঠিক বেকার না, দেদার কাজকর্ম রয়েছে সঙ্গে। ব্যাংকে একটা অডিট হবে সামনের সপ্তাহে, তার আগে সব ফাইল ঠিকঠাক আছে কিনা একবার রুটিন চেক করে নিতে হয়, সেটা ম্যানেজারেরই দায়িত্ব।

ফাইল আর ল্যাপটপে ডুবে গিয়েছিলাম অল্পসময়ের মধ্যেই।

একটু আগে পাশের বাড়ির উর্মি বৌদি এসেছিলেন, রি 'এর খোঁজে। কয়েকদিন আগেও একবার এসে কিসব কথা বলবেন বলে ডাকাডাকি করছিলেন বৌদি, সেইবার উল্টোদিকের শম্পা'কাকিমাকেও সঙ্গে করে এনেছিলেন।

দুবারই অবশ্য খালি হাতে ফিরতে হয়েছে, বলে দিয়েছি পরে আসতে। পাড়ার লোকজনের সাথে রিখিয়ার এত দোস্তি কবে হল কে'জানে! 

রিখিয়ার আজকে একটু তাড়াতাড়ি ফেরার কথা। আমার ফেভারিট মোগলাই পরোটা আর স্পেশাল লিভার কারি বানিয়ে খাওয়াবে বলেছে।


ও কোথায় গিয়েছে কে জানে! কি একটা বলল বেশ, এখন আবার মনে পড়ছে না ছাতা। আচ্ছা, রিখিয়া কে! কোনো মহিলা বন্ধু সম্ভবত, আমার সাথে বাড়িটা শেয়ার করে আছে। ও কিছু একটা কাজ করে আজকাল। সন্ধ্যেয় বেরোয়, নটার দিকে ফেরে। কি যে করে কে জানে!

সে যাকগে, এখন অন্য লোককে নিয়ে ভাবার সময় নেই। উপরের বেডরুমে এসি চালিয়ে জাঁকিয়ে বসেছি, ফুরফুরে হিমেল হাওয়া আলতো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে গায়ে মাথায়। এইবার চটপট আমার কাজগুলো... কাজ.. আমার কাজ..  কি যেন কাজ একটা করব ভেবেছিলাম.. কি ছিল যেন?

সামনে একগাদা কাগজ আর একটা ল্যাপটপ রেখে গেল কে? এগুলো তো ব্যাংকের হিসেবের কাগজ মনে হচ্ছে, আমাদের কর্পোরেশন ব্যাংকেরই। কার এসব! হচ্ছে টা কি আমার সঙ্গে! আমার বাড়িতে কি কোনো ব্যাংক ম্যানেজারও থাকে? না কি আমি ব্যাংক থেকে ভুল করে কাগজগুলো চুরি করলাম? আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম সকালে, হ্যাঁ মনে আছে সেটা। কিন্তু কেন? কি একটা খটকা লাগছে খুব। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? আর একটা দরকারি কথা, খুব দরকারী কথা..... একটা জরুরী কাজ, কিছুতেই মনে পড়ছে না।

এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেয়ে এলাম বসার ঘর থেকে। মাথাটা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। আমি আবার ভুলে যাচ্ছি সব, বেশ বুঝতে পারছি সেটা। কিন্তু তার সাথেও কি একটা খটকা লেগে আছে। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে যেন সব।

বিছানায় এসে আলো নিভিয়ে, এসি'টা একটু বাড়িয়ে দিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার মাথা কাজ না করলে সেটাই করি। এখন কিছু করতে গেলেই আরো গোলমাল বাঁধিয়ে বসব, স্রেফ চুপচাপ থাকাই ভালো।

চোখ বন্ধ করেছি, কয়েক মিনিট হয়তো বা কেটেছে। তখনই শুনতে পেলাম নীচের তলা থেকে ভেসে আসছে আওয়াজটা।


দুম.. 

দুম..

দুম..

থেমে থেমে একবার করে গুনে যেন কেউ ধাক্কা মারছে দেওয়ালে। স্রেফ ধাক্কা না। সর্বশক্তি দিয়ে একটা দৈত্যাকার শরীর যেন আছড়ে পড়ছে উন্মত্তের মতো, বারবার বারবার। এবার আর দরজা না, শব্দটা আসছে ঠিক আমার পায়ের তলা থেকে। বসার ঘর থেকে। 

ঘরের খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিচে নামে সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় জমে ওঠা অন্ধকারটায় যেন একটা আকার ফুটে উঠেছে, সরে সরে যাচ্ছে সেটা, ব্যঙ্গ করছে আমায়। হৃদপিন্ড বুকে উঠে এল আমার। আতঙ্কে বিছানার চাদর খামচে ধরলাম অজান্তেই। বিছানায় কাঠ হয়ে পড়ে আছি, ভয়ে নড়াচড়া করার শক্তিও হারিয়ে গিয়েছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ধাক্কা ছাপিয়ে শোনা গেল আরেকটা অন্য শব্দ। ঝনঝন করে পোর্সেলিনের ডিনার সেট ভাঙার আওয়াজটা চোখ বুজেই বলে দিতে পারি আমি, শুধু ভাঙেনি, কেউ প্রবল আক্রোশে ছুঁড়ে মারল জিনিসটা।

আর নিতে পারলাম না।

লাফিয়ে উঠে ঘরের দরজাটা একটানে বন্ধ করে সবগুলো লক লাগিয়ে দিলাম। এই কৃত্রিম ষোলো ডিগ্রীর শীতেও ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে আমার সারা শরীর থেকে, স্নান করে ওঠার মত ভিজে গিয়েছে জামাটা। হাঁফ ছাড়লাম একটা।

তারপর কি যে হল, আবার খুলেও ফেললাম দরজা। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলাম, শব্দটা এখনও নীচ থেকেই আসছে। 


দুম… 

দুম… 

দুম… 

সেটার উপরে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। অন্ধকারের দিকে দেখব না আমি, নিঃশব্দে চোরের মত সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলাম। অন্ধকারটা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরল আমায়।

ততক্ষণে নেমে এসেছি পুরোটাই। স্রেফ সামনের দেওয়ালের আড়ালটুকু এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে আমায়, ওটা পেরোলেই…. ওত পেতে আমার জন্য অপেক্ষায় আছে দুঃস্বপ্ন থেকে উঠে আসা কোনো বিভীষিকা।

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে আমার। কেন কিসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি জানিনা, সময় থেমে গিয়েছে আমার জন্য। ওইপাশ থেকে ভেসে আসছে একঘেঁয়ে শব্দটা…


দুম…দুম…দুম…

আর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম, হয়তো খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছি বলেই বুঝতে পারলাম। আওয়াজটা আদৌ বসার ঘর থেকে আসছে না, ততটা জোরালো শোনা যাচ্ছে কই! তাহলে?

মরিয়া হয়ে কপাল ঠুকে হুড়মুড় করে এসে পড়লাম বসার ঘরে। নাহ্, যা ভেবেছি তাই। মৃদু গোলাপী একটা ল্যাম্প জ্বলছে এই ঘরে, এই অবস্থায় সেই আধো অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম ঘরের প্রত্যেকটা খাঁজ খোঁজ। একেবারেই ফাঁকা, কেউ নেই এখানে।


দুম..

প্রায় লাফিয়ে উঠলাম হঠাৎ একদম কানের পাশে বিকট আওয়াজটা পেয়ে। পাশে তাকাতেই দেখা গেল তাকে। 

জানলার ঠিক বাইরে থেকেই আসছে শব্দটা। দেওয়ালে এত জোরে আঘাত করেছে যে ভিতরের শেলফ থেকে ছিটকে পড়েছে আমার প্রিয় ডিনার সেটটা, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে মেঝেতে, উপর থেকে মনে হচ্ছিল কেউ ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে সেগুলো। আর জানলার কাঁচে মুখ লাগিয়ে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে… এক ঝাপসা নারীমূর্তি, খুব খুব চেনা একটা মুখ। রিখিয়া !!!!

রিখিয়া!ও কি করছে ওখানে, ওর হাতে ওটা কি ? এইভাবে আওয়াজ করছে কেন ও! ভিতরেই বা আসছে না কেন রিখিয়া, বাড়ির চাবি আছে তো ওর ব্যাগে। তাহলে আগের দিনগুলোতেও কি রিখিয়া'ই -


দুম..

হাতের জিনিসটা দিয়ে আবার দেওয়ালে ধাক্কা মারতে গেল রিখিয়া.. আর সেদিকে তাকিয়ে পুরোটার মানে হঠাৎ জলের মত পরিস্কার হয়ে এল আমার কাছে।

একটা ধাক্কা, একটু বিরতির পর আবার একবার, পরপর। আগের সপ্তাহে ছিল দুবার ধাক্কা, তার আগেরদিন তিনবার।


তিন.. দুই…এক

তিন সপ্তাহ… দু সপ্তাহ.. এক সপ্তাহ

ধাক্কা না রিমাইন্ডার? না কি ওয়ার্নিং!

তিন সপ্তাহ আগে ঠিক কি করেছিলাম আমি? 

ছিঁড়ে গেল চিন্তার সূত্রটা। কিছু ভেবে ওঠার আগেই আবার বিকট স্বরে কেঁপে উঠল দেওয়ালটা, সেইসাথে আমিও। এইবার শুধু দেওয়াল না, কেঁপে উঠল দরজাটাও। হঠাৎ বহু লোকের গমগমে গলার আওয়াজে ভরে গেল বাইরেটা, মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন কেটে গিয়ে আচমকা জেগে উঠেছি আমি।

ধাক্কা পড়ছে দরজায়। একঘেঁয়ে সুরে তীক্ষ্ণ সাইরেন বাজছে বাইরে। এলোমেলো কথার আওয়াজ ভেসে আসছে পাঁচমিশালি ভিড়টা থেকে। এবার আর ছন্দে ফেলে নিয়ম মেনে নয়, ক্রমাগত এলোপাথাড়ি ধাক্কা পড়ছে দরজায়, অনেকগুলো ভারী বুটের রাগী লাথির অভিঘাত। কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করল একজন, " দরজা খুলুন, নাহলে ভাঙতে বাধ্য হব..মিস্টার বোস, মিস্টার নির্বাণ বোস…এক্ষুনি দরজা খুলুন, নাহলে ভেঙে ফেলতে বাধ্য হব আমরা"

পুলিশ! কেন! কি করেছি আমি! পুলিশ কেন আমার বাড়িতে! রিখিয়া ঠিক আছে তো, কোনো খারাপ খবর? কি করব বুঝতে পারছি না। দরজা খুলে দেব? পালাব বাগানের দরজা দিয়ে? 

বেশিক্ষণ ভাবতে হল না, তার আগেই ভেঙে পড়ল পুরোনো কাঠের দরজা, বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে এল চারজন সশস্ত্র পুলিশ। একটা কড়া ফ্ল্যাশলাইট এসে পড়ল আমার মুখে। চোখ ধাঁধিয়ে গেলেও বেশ টের পেলাম ওরা চারপাশ থেকে বন্দুক তাক করে ঘিরে ফেলেছে আমায়।



তার পরের এক ঘণ্টায় যা যা হল, তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়ার মত অবস্থায় আমি নেই। ঝড়ের বেগে সারা বাড়ি লন্ডভন্ড করে তল্লাশি চালালো ওরা, আমার কোনো আপত্তি কানে তুলল না। তোলার কোথাও নয়, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পেয়ে গেল যেটা খুঁজছিল।

বসার ঘরের একদম কোনের দিকের শোকেস সরাতেই পিছনের দেওয়ালে বেরিয়ে এল গর্তটা, আর গর্ত থেকে বেরোল রিখিয়া। দুর্গন্ধের দমকে বমি উঠে এল আমার।

ঠিকঠাক বলতে গেলে রিখিয়ার অবশিষ্টাংশ, দুমড়ানো মোচড়ানো তালগোল পাকিয়ে রাখা শরীরটা সোজা করলে বেশিরভাগ হাড়গোড় আর জয়েন্টগুলো ভাঙ্গা অবস্থায় পাওয়া যাবে। ওভাবেই ভাঙলে ছোট্ট জায়গায় লুকিয়ে রাখতে সুবিধা হয় কি না!

ওরা হ্যান্ডকাফে আটকে ফেলল আমায়, আমি চিৎকার করে বললাম, রিখিয়াকে আমি খুন করিনি, করতেই পারিনা, আই লাভ হার । কেউ শুনলো না। একটা নোংরা গালাগাল দিয়ে 

টেনে থাপ্পড় মারলো সামনে থাকা অফিসার, কড়া পড়া হাতের আগ্রাসী ঘা'য়ে চিড়বিড় করে জ্বলে উঠল গাল, ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে আমার…


তিন… দুই… এক

প্রমথের মাটিতে নাক লাগিয়ে গন্ধ শোঁকা … 

রিখিয়ার খোঁজে আশা পড়শি…

কিন্তু হিসেবটা যে মিলছিল না। আশ্চর্য, আমার কান্না পেলো না। খটকাটা এখনও লেগে আছে ভালোমতো, সময়ের সাথে সেটা বেড়ে চলেছে আরো। আমার বাড়ির দেওয়ালে আমার বউকে মেরে আর কে লুকোবে আমি ছাড়া! কিন্তু আমি কিভাবে, কখন! কেন?

হিড়হিড় করে টেনে বার করল ওরা আমায়। পশুর মত ঘাড়ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে গেল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিজন ভ্যানের কাছে। আশেপাশের বাড়িগুলো থেকে সবাই তামাশা দেখতে বেরিয়ে এসেছে, গলা বাড়িয়ে চোখ বড়বড় করে এমনভাবে দেখছে যেন কোনো চিড়িয়াখানায় এসেছে। আমার চিৎকার শুনে অত্যুৎসাহী কেউ কেউ মোবাইল বার করে ফোটো তুলে ফেলল আমার। ওদের নাকেও কাপড় চাপা দেওয়া।

আমাকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলল প্রিজন ভ্যানের পিছনের অন্ধকারে।

জোরালো হাওয়ায় উড়ে এল কয়েকটা হলদটে শুকনো পাতা। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে বাইরে।



প্রিজন ভ্যানের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল মুখের উপর। অন্ধকার নেমে এল সামনে। ভ্যানের পিছনে আমার দুপাশে দুজন পুলিশ, অশ্রাব্য গালিগালাজ করে চলেছে আমায়। আমায় খুনি ভাবছে ওরা! কিভাবে বোঝাবো এইটা একটা মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝি। গাড়িটা স্টার্ট দিচ্ছে এইবার।

ঠিক সেইসময় বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে আসা ভ্যানের অজস্র দাগধরা নোংরা কাঁচ ভেদ করেও দেখতে পেলাম তাকে, আবার। তার হাতে ধরা ভারী লম্বাটে জিনিসটা দিব্যি চিনতে পারলাম এখন। একটা হামানদিস্তা।

আমার কিচেনের সেই হামানদিস্তা যেটা গত তিন সপ্তাহ ধরে গরু খোঁজা খুঁজেও হদিস পাইনি।

আর ওই একটা জিনিস দেখেই সমস্ত খটকা কেটে গেল আমার, বরাবরের মতো। সবকিছু মনে পড়ে গেল এক ঝটকায়। আগাগোড়া মিলে যাচ্ছিল এক সুতোয়। তাতে কি আদৌ ভালো হল?


তিন… দুই… এক…

তিন সপ্তাহ… দু সপ্তাহ… এক সপ্তাহ

ভগবান! তিন সপ্তাহ আগেই যে সবটা জেনে ফেলেছিলাম  আমি। দুইমাসের গর্ভবতী ছিল মেয়েটা। আমি বারন করতাম অনেক, তারপরেও টিউশন পড়ানো ছাড়েনি, এই অবস্থাতেও রোজ বেরোত। না, অবশ্যই রিখিয়া টিউশন পড়াতে যেত না, আমাকে বোকা বানিয়ে পড়ানোর নাম করে সে চলে যেত ঘন্টাখানেক দূরের শহরে, তার প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে। জানিনা কতদিন ধরে, হয়তো শুরুর থেকেই! তাহলে ওর গর্ভের সন্তান? কি তার পরিচয়? সে কি আমার, না কি…ভাবতেও যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার।

সন্দেহ যে একেবারেই হয়নি তা নয়। বিশ্বাস করিনি। আই লাভ হার, শি লাভস্ মি। ব্যাংকের এক সিনিয়র অফিসারকে বাড়িতে ছাড়তে না গেলে কোনোদিন জানতেও পারতাম না কিভাবে আমার নাকের ডগাতেই আমার প্রেমে গদগদ, কেয়ারিং, অলরাউন্ডার স্ত্রী দিব্যি নিজের ফুর্তি নিয়ে  - যাকগে।

আমি যা পছন্দ করি, যখন যেটা চাই সেটা পুরোটাই নিজের করে পেতে পছন্দ করি। তার উপর সেটা আমার ন্যায্য পাওনা হলে তো বলার অপেক্ষা থাকে না। কিন্তু যদি কেউ দিতে না চায়? আমার প্রাপ্য কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অন্যায়ভাবে। অন্যায়ের শাস্তি অনিবার্য, আজ হোক বা কাল।

তাই, শাস্তিটা আর কারোর হাতে পাওয়ার চেয়ে আমি নিজের কাজ নিজেই সেরে ফেললে ভালো হয় না?

ওর ফিরতে দেরি হতো রোজই। একস্ট্রা ক্লাস থাকতো কিনা। সেদিন রাতে একদম প্রস্তুতি নিয়েই অপেক্ষা করেছিলাম আমি। বাড়ি ফিরতে চুমু দিয়েছিলাম, জড়িয়ে ধরে পরিচিত শরীরের ঘ্রাণ টেনে নিয়েছিলাম প্রাণভরে, বহুদিন পর। রীতিমত চমকে উঠেছিল রি, ভাবতেও পারেনি বোধহয়। তারপর একটু বেশিই উচ্ছসিত হয়ে কিচেনে গিয়েছিল লাফাতে লাফাতে, সম্ভবত আমাকে গাধা বানানোর কাজে সাফল্যের আনন্দেই।

রান্না করার খাটুনিটুকু আর করতে হয়নি। পিছন থেকে গিয়ে ওই হামানদিস্তা দিয়েই… স্রেফ দুটো ঘা, একদম মেডালা আর স্পাইনাল কর্ডের জোড়মুখে। কোনো চিৎকার বেরোয়নি, কথাও ছিলনা তেমন। গলা দিয়ে ঘড়ঘড় করে একটা শব্দ, সুন্দর দীঘল শরীরটা কেঁপে উঠল এক মুহূর্তের জন্য, তারপরই কেমন কাটা কলাগাছের মতো এলিয়ে পড়ল মেঝের উপর ধপাস করে। 

রিখিয়ার নিষ্প্রাণ শরীর নিখুঁত একটা ম্যানিকুইনের মত পড়েছিল কিচেনের মেঝেতে। চিৎ হয়ে থাকা দেহে কোথাও রক্ত নেই, ক্ষত নেই… কিছু নেই। মুখটা অভিব্যক্তিহীন, ভারী নিরস নিরাসক্ত। চোখগুলো খোলা, যেন বিশ্বাসই করতে পারেনি যে সে মারা যাচ্ছে। সেই মুখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে রইলে মনে হয় মেডুসার জাদুতে পাথর হয়ে গিয়েছে সে, উচ্ছল প্রাণের চিহ্ন ভরপুর সেখানে। এক্ষুনি যেন  কথা বলে উঠবে মেয়েটা।

বুকে যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে আমার ফুসফুস, আমার হৃদপিন্ড, আমার জীবনীশক্তির সবটুকু।

এ কি করলাম আমি! যা হল, এভাবেই কি হওয়ার কথা ছিল?

ঠিক একইভাবে এখনও তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে। ওর চোখগুলো ছলছল করছে তাই না? কেঁপে উঠলো কি একবার ঠোঁটদুটো? 


পাঁচমিশালি ভিড়ের বিশৃঙ্খল মধ্যবিত্ততার মাঝেও বেমানান উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল তাকে। তবে সদ্য ফোটা টিউলিপের মতো না, অনেকটা আগের রাতের স্মৃতির গন্ধ মাখা রজনীগন্ধার মতো লাগছিল আমার রি 'কে। ভীষণ সাদামাটা ধূসর জনতার কোলাহল ছাপিয়ে ওর নিঃশব্দ চোখের অভিযোগ হাজার ডেসিবেলের গর্জন নিয়ে আছড়ে পড়ছিল আমার কানে। ওর মলিন মুখে হাসির আভাস ছিল না। অভিযোগ না বিস্ময়, নাকি আফসোস… বুঝতে পারিনি কি ফুটে উঠেছিল নিটোল ভাস্কর্যের মতো মুখটায়, আমার ভীষণ প্রিয় মুখটায়। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম আমি, সম্ভবত চোখের জল লুকানোর জন্য।

সেই শেষবার।

তারপর বৃষ্টি নেমেছিল অঝোর ধারায়।




অলংকরণ : গুগল



ফিরে পাওয়া

সৌ মী  আ চা র্য্য




জকাল কিছু খেতে চায়না বিভা। বড়মেয়ে কলি চাকরী সামলেও প্রতিদিন অন্তত একটা পদ রেঁধে দেয় যদি খায়,যদি। মায়ের মুখের দিকে তাকালে থরথর করে কেঁপে ওঠে ঠোঁট। চোখ ছাপিয়ে জোয়ার আসে। অস্ফুটে কলি বলে, 'মাগো, তুমি তো বেঁচে আছো মা।' আকাশের উঠোনে সাদা মেঘেদের ছুটোছুটি। বাতাস জুড়ে শিউলি গন্ধ ভাসতে শুরু করেছে। বিভা ব্যালকনির রেলিঙে শীর্ণ হাত রেখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে।


সারা রান্নাঘরে জল থৈ থৈ তার মাঝেই একটা কলাই করা থালায়, ভাত ডাল আর লেজের ছোট্ট পিস। এভবেই খাবর জুটতো দুপুরে। বিভা মাছ আর মাছের আলু খেতে বড্ড ভালোবাসত। একদিন চেয়েছিল বলে বিধবা ননদ মোটা গলায় বলেছিল, 'লজ্জা করেনা, আমাকে, মাকে দেখিয়ে দেখিয়ে মাছ খাও তার উপর আবার আলু চাও। বিধবা হলে টের পাবে। বেহায়া।' কেঁপে উঠেছিল বিভা। রাতে অলোককে বলতেই আদর এঁকে বলেছিল, 'আমি তোমার আগে মরবো না নিশ্চিন্তে মাছ খাও। এরপর যেদিন সোদপুরে যাব, তোমার মাকে বড়ো কাতলা কিনে দেবো আলু দিয়ে লাল ঝোল খেও।'


                           


বিভা কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ে মেঝেতে। ফাঁকা ফ্ল্যাটে গলা টিপে ধরে যেন কেও। মাছের একটু ছোঁয়া না পেলে ভাত খেতে পারত না বলে, পেত্নি, শাকচুন্নি নানা নাম জুটেছিল। অলোক অফিস ফেরৎ ফিসফ্রাই, ফিসচপ আনতো। কটূ শব্দে বাড়ি মুখরিত হয়ে উঠত। নিপাট শান্ত অলোক বলেছিল একদিন, 'মা! মাছের কাঁটা, লেজ এসব খেয়েই তো ও থাকে। মাঝেমাঝে এইটুকু খাবার আমি কি ওকে দিতে পারিনা! বোনের দুইছেলকে দিয়ে তবেই তো ওকে দিয়েছি।' এর পর থেকে বিভার পাত থেকে মাছ উধাও হয়েছিল। গম্ভীর হয়েছিল অলোক। ননদের ছেলে বিভার সোনার কানবালা আলমারি থেকে সরানোর পর বাড়ি ছেড়েছিল অলোক। বিভার কোনো কথা শোনেনি অথচ অভিশাপ এসেছিল, 'মাছ খাওয়া গয়না পরা ঘুচুক ঘুচুক।'


বিভা শাশুড়ির হাত ধরে কেঁদেছিল, 'ও তো আপনার ছেলে মা!'


-না, ও শুধু তোর ভাতার, আমার ছেলে হলে তোর মুখে নুড়ো দিত।


অলোক বিভাকে দৃঢ় হাতে ধরে এগিয়েছিল নতুন জীবনে। আর চার পাঁচটা সাধারণ জীবনের মতো শ্যাওলা কথা তাদের। তবু অলোকের স্পর্শে ক্ষত সেরে উঠেছিল। বড়ো মেয়ে কলি হবার পর মাকে অনেক আপ্যায়ন করে বাড়িতে আনলেও ছোটমেয়ে রিমির বেলায় তিনি নিজে এসে শুনিয়ে গিয়েছিলেন।


-আমার নমির পেটের খোল ভালো বলেই পরপর দুটো ছেলে। কী দেখে যে বিয়ে করেছিলি? এমন মেয়ে বিউনি খোল জুটেছে তোর কপালে। বিভার চোখের ফোঁটা ফোঁটা জল কচি হাতে মুছিয়ে কলি বলেছিল, 'কানেনা মা কানেনা।' কান্না শব্দটাও যে উচ্চারণ করতে পারেনা তার স্পর্শ যেন বিভাকে শক্ত করে দিল। রিমির কচি মুখে চুমো  আঁকা রইল।


-শুনছো, মাকে যাবার সময় মিষ্টি দিয়ে দিও বেশি করে। নমির ছেলেদের জন্য।


কলি আর রিমি মা বাবার হাসিগানে মেতে উঠে বড়ো হয়েছে সহজ আনন্দে। বুঝে গিয়েছে মা আদতে বাবার উপর নির্ভর করে বাঁচে। বিষয়টা টাকার নয় নির্ভরতার। বাবাও যেন আগলে রাখে মাকে। পারিবারিক চাপান উতোরের ঝড় থেকে বুক দিয়ে সামলে দিত বাবা। বুকটা সব সামলাতে সামলাতে যে, বন্ধ হয়ে যাবে বোঝেনি কেউই।


                         


কলির চাকরী পাবার আনন্দে বাড়িতে আত্মীয় বন্ধু বান্ধব সমাগম ঘটেছে প্রচুর। অলোকের নিষেধ উপেক্ষা করেই বিভা শাশুড়ি ননদকে নিজে গিয়ে আসতে বলে এসেছে। কলি সারাক্ষণ মাকে আগলে রেখেছিল। বিভার নরম মনটায় আঘাত করে আজীবন খুশি হয়েছে যারা বাবার মতো কলিও তাদের দূরে রাখতেই পছন্দ করে। খাবার আয়োজন আহামরি কিছু নয় তবে কাতলার আলু দিয়ে লাল ঝোল বাবা কিছুতেই বাদ দেবে না। কলি মনে মনে ভেবেই রেখেছে, বাবার মতো কেয়ারিং যদি কাউকে পায় তবেই বিয়ে করবে নয়তো মা, বাবা, বোনের সাথেই জীবন কাটবে। অলোক একটা মাইকের ব্যবস্থা করেছিল। কলিকে নিয়ে যার যা ইচ্ছে বলছিল তাতে। বিভা তো বলতে উঠে মেয়ের প্রশংসা করতে করতে কেঁদেকেটে একসা। শেষে রিমি জল খাইয়ে চেয়ারে বসালো। অলোক বলতে উঠে খানিক স্ত্রীর দিকে চেয়ে রইল। তারপর খুব ধীরে বলল, অনুভূতি প্রবণ এই মানুষটি আমার সংসার সামলেছেন যত্নে, মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই তাকে। মেয়ে হয়েছে বলে অনেক কটূ কথা শুনলেও তিনি দমে যাননি লড়াই করেছেন। এমন মানুষকে আমি জনমে জনমে পেতে চাই এবং গাদা গাদা মাছ খাওয়াতে চাই।


কিন্তু এসব কথার মাঝেই কোমর বেঁকে যাওয়া অলোকের মা কটূ কথায় ভরিয়ে তুলল পরিবেশ। চিৎকার চ্যাঁচামেচি, শাপশাপান্ত।


-লোক ডেকে বউয়ের গুণগান শোনানো। বেহায়া কাকে বলে? এ পাপ আমার পেটে হয়েছে? মায়ের অবদান মনে পড়েনা। মর মর। পোড়ারমুখীর মাছ খাওয়া ঘুচুক।


অলোক স্বভাবে শান্ত হলেও ভয়ংকর রেগে বিভাকে চিৎকার করে বলে, তোমায় বলেছিলাম না, এসব ছোটোলোকদের ডেকো না। এই আনন্দ অনুষ্ঠান ওদের জন্য নয়। ওরা কেবল টাকা চায়, টাকা। দিয়ে আসি তো মাসের প্রথমে। তারপরেও কেনো এতো শাপ! আমি মরলে বিভার মাছ খাওয়া ঘুচবে এই তো তুমি চাও মা! এই এত লোকের সামনে আমি আজ তোকে বলে দিলাম কলি, আমি মরলে তোর মাকে মাছ খাওয়ানোর দায়িত্ব তোর, মনে রাখিস।


কলি জানতো না দায়িত্বটা সেদিন থেকেই নিতে হবে। প্রবল চিৎকার ও উত্তেজনায় অলোকের মাথার শিরা ছিঁড়ে যায়। প্রবল রক্তক্ষরণে হাসপাতালে নিতে নিতেই সব শেষ। মৎস্যমুখীর দিন কলি মায়ের থালায় মাছ দিতেই বুড়ি গলা বিষ ঢেলেছিল, আমার ছেলেটাকে খেয়ে হয়নি, মাছ খাওয়ার সাধ এত? বিভা না খেয়ে চলে গেছে। গত দুইমাসে বিভাকে কেউ মাছ ছোঁয়াতে পারেনি। কলি কোলকাতায় অফিসের কাছেই ফ্ল্যাট নিয়েছে, বোনকে কলেজে ভর্তি করেছে। বাবার পেনশান চালু করেছে মাকে নিয়ে ছুটোছুটি করে। অবশ্য ওর কাজের জায়গার সবাই খুব ভালো। সদ্য বাবাহারা কলিগকে সবাই সাহায্য করেছে সাধ্যমতো, পরামর্শ দিয়ে। শুধু বিভাই কেমন হারিয়ে যাওয়া মানুষ হয়ে গিয়েছে।


                          ৪


ঘুম ভেঙে যায় বিভার। বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটছে যেন কেউ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠ ভেসে আসছে। সেকি আজ তবে মহালয়া! অলোককে ছাড়া মহালয়া! মাথার ভিতরটা কেমন যেন গমগম করতে থাকে। জোরে জোরে হাওয়া ফুঁকছে যেন কেউ। মাছ খাওয়া ঘুচুক! মাছ খাওয়া ঘুচুক! বিভা লতিয়ে ওঠা ফাঁপা নরম এক নারী। কিছুই অসমাণ্য নয় তার। তবু কী করে যেন অলোকের বিস্ময়কর ভালোবাসা পেয়েছিল সে। মেয়েরাও বাবার ধাঁচ পেয়েছে অদ্ভুত ভাবে। শাশুড়ি ননদের অসহযোগিতা অলোককে বিভার আরো কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। মহালয়া আসা মানেই তাদের পুজো শুরু হয়ে যেত। রোজ রোজ পরিকল্পনা, পুজোর কদিন কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখা হবে? কখন কী খাওয়া হবে। অলোক খাতা পেন নিয়ে প্রথমেই বড়ো বড়ো করে লিখতো রোজ সন্ধ্যায় ফিসফ্রাই মাস্ট। কী লজ্জা যে পেত বিভা। আর বুকের ভিতরটা কেমন সুখে গুঢ়গুঢ় করতো। সাধারণ একটু মাছ খেতে ভালোবাসা নিয়ে কম যন্ত্রণা সে পায়নি। তাই যেন অলোকের এত আবেগ। চোখ ঝাপসা হয়ে জল নামে বিভার। কানের লতিতে চুমু খেয়ে ফিসফিস করতো এক আদুরে গলা, মেছুনি, আমার আদুরী।


-আমি পারছি না, তুমি শুনতে পাচ্ছো! এই মহালয়া আমি শুনতে চাইনা। তোমায় ছাড়া থাকতে চাই না। আমায় তোমার কাছে নিয়ে চলো।


কলি মায়ের গোঙানি শুনতে পায়, রিমিও। ছুটে আসে দুজনেই। এক পূর্ণ বয়স্ক মানুষকে কী বোঝাবে বুঝে পায়না। রিমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, যাও তুমিও চলে যাও। বাবাও আমাদের ভালোবাসতো না, তুমিও না। আমাদের ভিতর তো বাবা নেই তাই না মা! আমরা তোমায় ভালোবাসি না একটুও। এমন করে কেঁদে কেঁদে চলেই যাও। কলি বোনকে মৃদু ধমক দেয়। আহ্ রিমি! মায়ের পিঠে হাত রেখে বলে, মাগো তুমি তো চিরকাল বাধ‍্য ছিলে বাবার। তাহলে কেন মাছ খাওয়া ছাড়লে? আর বাবা কী বলতো মনে আছে? বিভার কানে ভেসে এল ভরাট সুর।


-যাকে ভালোবাসো, সে চলে যাবার পর তার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখো, সেও বেঁচে থাকবে।


বিভা শূন্যে হাত বাড়ায়। অলোককে স্পর্শ করতে চায়। সে শূন্য হাতে কলি নিজের গাল চেপে ধরে। কেঁপে ওঠে বিভা। মহালয়ার সুরে নতুন সূর্য আলো ফেলে ছোট্ট ফ্ল্যাটের টবের গাছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বিভা প্রথম কথা বলে।


-তোর বাবা মহালয়ায় ইলিশ আনতো। আজ ইলিশ এনে দিলে আমি ঠাকুরবাড়ির তেলঝোল রান্না করতে পারি।


-তুমি খাবে তো মা!


'মর্ মর্ , মাছ খাওয়া ঘুচুক পোড়ারমুখীর।' কথাগুলোকে দাবড়ানি দিয়ে বিভা বলে, খাবো, তোর বাবা খুব খুশি হবে। দুই বোন মাকে জড়িয়ে ধরে। বিভা যেন স্পর্শ পায়, ছুঁতে পারে নতুন করে। তার প্রিয়জন এই তো রয়েছে কাছে।