শারদ সংখ্যা
![]() |
একটি মিলন দাবি
কবি : অমিত সাহা
প্রকাশক : কবিতা আশ্রম, ১৭৫/-
আলোচক : সূর্যকান্ত জানা
‘একটি মিলন দাবি’ তার একটি অন্যতম কাব্যগ্রন্থ। কবিতাগুলি অনুভব করলাম। আর সেই অনুভূতি প্রকাশ করবো।
আমরা যারা রোমান্টিক ভাবাপন্ন, তারা একা থাকলেও, নিজের দ্বিতীয় সত্তার সাথে কথা বলি। আর অচেনা ও দুঃসাহসিক স্থানে সেই সত্তাকে এগিয়ে দিই।
কাব্যের পৃষ্ঠা উল্টোতে উল্টোতে পৌঁছে যাই "রোদ-ভর্তি কৃতজ্ঞতা"-য়।
আর সেখানেই একটি লাইন "একটি মিলন দাবি"।
বাঁশিকে একা রেখে মিলতে চেয়েছেন কবি, কিন্তু কার সাথে! তাহলে কবিতা গুলির ভেতরে যাওয়া যাক-
"অনন্ত স্লেটের মাঝে যত সব অন্ধকার
কিছু অংশ মুছেছে পেন্সিল..."
অনন্ত স্লেট, শিক্ষাক্ষেত্র হতে পারে অথবা কর্মক্ষেত্র হতে পারে, ভবিষ্যৎ এ কী হবে সেটা অন্ধকার। পেন্সিল মুখ বসায়নি বলেই ফাঁকা অথবা মোছা।
"প্রতিটি সাঁকোর পেটে
থাকে কিছু নদীর উজান..."
আমরা মোহনা থেকে জীবন শুরু করি, তারপর উজানে বাওয়া জীবন। এই জীবনে কতই সাঁকো সম্পর্ক জুড়ে দিই। লক্ষ্য আমাদের উৎস।
আর একটি কবিতা "দুঃখী প্রেম"। প্রেম আসলে দুঃখের উপর প্রলেপ দেওয়া অজ্ঞান সময়। সে আকাশে তাকিয়ে শস্য মনে হতে পারে, আবার কোনো এক পাখীকে দেখে ফুরফুরে হয়ে যায়। আবার রাত হলে পেঁচার দৃষ্টিতেও বিস্ময়। তবুও
"নদীটি তারার জন্য জাগে!"
মিছে জাগা। জাগতে জাগতে ভোর, এইবার আসল জাগার পালা।
আর জাগলেই বিদ্যুৎ এর আলো, কবি তাতেও ক্ষতবিক্ষত হন। তা "সৌদামিনী-ক্ষত" কবিতাটিতে প্রকাশ করেছেন। মেঘের সাঁকো ভাঙলে বৃষ্টি নামে, বৃষ্টির মরণ নেই। সেই বৃষ্টি জলে নৌকোটি ভেসে গেলে, নৌকো আর প্রাণের মানুষের যে দূরত্ব তা বিদ্যুৎ এর ধাক্কা দিয়ে ছাপ রাখে জীবনভর।
তারপর "সব ওড়াউড়ি শেষে"-
যে পাতায় ঠোঁট মুছে
ফিরে গেছে শুঁয়োপোকা...
সন্দেশ রঙের প্রজাপতি
ক্লিপখোলা প্রজাপতি
কখনও দেখেনি শুঁয়োপোকা...
শুধু টের পেয়েছে মগজে!
প্রেমিক প্রেমিকার সমস্ত কিছু স্পর্শ ও ইন্দ্রিয় সুখের পর কেউ যখন চলে যায় ছেড়ে। তখন ঘুমোতে চায় মগজ। গাঢ় ঘুম, যা পূর্ব জনম থেকে ক্রমশ...
এ জীবনে এভাবেই সূর্যাস্ত আসে।
এরপর সরল জীবন তাই "সরল কবিতা"
যদিও সব কিছু জটীল-
একটা সরলরেখা
কতখানি কষ্টে বৃত্ত হয়,
তুমি কেন্দ্র-বিন্দু.....
ভগ্যবলে হয়ে গেছ
প্রেমিকার টিপ!
সরলরেখা, কষ্টে বৃত্ত। আর ভাগ্যবলে সে প্রেমিকার ললাট সজ্জা। আবার তা যখন দুটি সরলরেখার, সংসার হলো। প্রেমিকের মনে বসন্ত।
মন উদাস হয়ে চলে যায় "অবচেতনপুর"-এ -
"ঘঙুরের ক্লান্তি আছে নর্তকী বোঝে না
ঘুঙুরও জানে না নর্তকীকে..."
ঘুঙুর তো নর্তকীর পায়ের দাস। আর দাসের মনের খবর কেউ কী রাখে! তাদের বিষাদ বোঝে সানাই সুর।
কবি আবার কখনও হয়েছেন "সুবল মাঝি"। এ জীবন মাঝি প্রথাগত দাঁড়টানা জীবনযাত্রা থেকে অন্য জায়গায় যেতে চায়। যেখানে শুধু রোমান্টিকতা। লম্ফ আসলে কৃত্রিম আলো, সেই আলোতে ক্ষণিক সুখে ভাসতে চায় মাঝি।
তারপর আসে "অনুতাপ" - আদতে আমরা যারা গ্রাম থেকে জীবনধারা শহরমুখী করি, একটা সময় হাঁপিয়ে উঠি। সেই নদীর বাঁক বা পুকুরের জলে দেখি শৈশবের মুখ।
"উল্কা মাখা ভোর" কবিতায় দেখিয়েছেন, আসলে সবাই তো উড়ছি। ফানুস ওড়ে চাঁদের আলোতে। ভোর হলে তাই উল্কা হতে হয়। তখন "চেতনা" ফেরে। ঝড় থেমে গেলে চেতনা আসে। অচেতন থেকে ফিরিয়ে আনতে ঝড়ের প্রয়োজন, যা চেতনার পাখিকে মেঘের ওপরে নিয়ে যায়।
আরো কিছু কবিতা-ছায়া ও স্রোত, তারার কসম, নুন, অপেক্ষা-নিশ্চুপ (ডানাখসা বাদলা পোকা আলো ও অন্ধকারের তফাত করতে জানে...। পথিকের পায়ে পায়ে ঘোরে ঘাসের শিশির)।
কবিতা গুলিতে অপেক্ষা, আক্ষেপ তারপর মুক্তি। আবারও এগিয়ে যাওয়া আগুনের দিকে। ভুল ভেঙে গেলে "নির্বাণ" লাভ করতে চেয়েছেন-
"শরীরে শরীর মিশে চিনিয়েছে মহাশূন্যতাকে"
বিস্ময় আর বিস্ময়, মিলনের পথে বিস্ময় তো থাকবেই। আর থাকবে অন্ধবিশ্বাস। সেই বিশ্বাস ভেঙে আবার অন্ধ হবেন কবি, অন্তরে তবুও মিলনের আকাঙ্খা। সেখানে কোনো লোভ নেই, কদর্যতা নেই।" নির্লোভ অস্বীকারের মতো" -
দেশলাইয়ের গায়ে থাকা বখাটে বারুদ জানে,
ধ্বংসে কতখানি নিঃস্ব হতে হয়!"
"শালিখের নখ" কবিতায় লিখেছেন-
গাছের কোটরে বাড়ে পেঁচাদের আয়ু...
পুকুরের চাঁদে মেঘ কতটা দয়ালু!
"ছবি আর ইশারার গল্প" তে মিলনের আকাঙ্খা অনেকটা পূরণ হয়েছে। যখন অপত্যের সাথে কথা বলেন, নিজেই হয়ে ওঠেন অপত্য। গাছ পাখি ফুল পাতা, রোদ মেঘ বৃষ্টি। হাতছানি থাকবেই।
"একটা মানুষ; কখনও কি, সব মানুষের ভালোবাসা পায়!"
পায়না বলেই ভরা সংসারের মধ্যেও একাকী হয়ে যায়। তখন ওঠে একটি দাবি, "একটি মিলন দাবি"। প্রকৃতির সাথে নিজের, নিজের সাথে নিজের।
তবে প্রায় প্রতিটি কবিতায় চাঁদ, জ্যোৎস্না, অন্ধকার, গাছ, জোনাকি, পেঁচা, ঝিঁঝিঁ পোকা, নদী, স্রোত, রোদ এই সব শব্দের ব্যবহার বহুলতা মিলনের দাবিকে স্থিতিশীল করে রেখেছে। আগামীতে কবি ঐখান থেকে বেরিয়ে নতুনের পথে যাত্রা করবেন, শুভকামনা রইলো।