শারদ সংখ্যা
সেই বৃক্ষের কাছে
শৌ ভি ক রা য়
যে গ্রামের নাম টিরনা, সে সুন্দর হবেই। চেরাপুঞ্জির বাজার থেকে একুশ কিমির যাত্রায় ভাবছিলাম সেটাই। ভাবনাটা মিলে গেল। ছবির মতো এরকম সুন্দর জনপদ দেখিনি আগে।
এখান থেকেই গভীর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নামতে হবে ৩৫০০ সিঁড়ি। পথে পড়বে দু-দু'টো ঝুলন্ত ফুটব্রিজ আর তার নীচে ভীমবেগে বয়ে চলা পাহাড়ী নদী! যাচ্ছি লিভিঙ রুটব্রিজ দেখতে। নির্দিষ্ট করে বললে ডাবল ডেকার লিভিঙ রুটব্রিজ দেখতে। এটা দেখতেই আসা চেরাপুঞ্জিতে।
বয়স্ক রাবার গাছের শেকড়গুলিকে খাসি প্রজাতির লোকেরা এমনভাবে লালন করেন যে, সেগুলি ব্রিজের আকার নেয়। নদীর ওপরে যেখানে চলাচল অসম্ভব, সেখানে এই রুটব্রিজই ভরসা। টিরনা থেকে ৩৫০০ সিঁড়ি ভেঙে উমশিয়াং যাবার পথে এই রুটব্রিজ। প্রায় বছর পনের লাগে একটি রুটব্রিজ তৈরী করতে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি জানাচ্ছে, পৃথিবীতে এরকম ব্রিজ এই একটিই।
![]() |
ডাবল ডেকার লিভিঙ রুটব্রিজ |
মেঘালয়ের এই অংশে অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের ও ট্রপিক্যাল ফরেস্টের জন্য প্রকৃতি দুর্গম। খাসি প্রজাতির লোকেরা তাই অভিনব পদ্ধতিতে ব্রিজ বানিয়ে থাকেন। বয়স্ক রাবার গাছের শেকড়গুলিকে তারা এমনভাবে লালন করেন যে, সেগুলি ব্রিজের আকার নেয়। নদীর ওপরে যেখানে চলাচল অসম্ভব, সেখানে এই রুটব্রিজই ভরসা। প্রায় বছর পনের লাগে একটি রুটব্রিজ তৈরী করতে। কেননা শেকড়কে হতে হয় ততটাই শক্ত যাতে সে মানুষের ওজন নিতে পারে। একবার তৈরী হলে রুটব্রিজ টিকে যেতে পারে পাঁচশো বছর।
টিরনা থেকে ৩৫০০ সিঁড়ি ভেঙে উমশিয়াং যাবার কারন এই রুটব্রিজ। এই ব্রিজটি ডাবলডেকার, অর্থাৎ দু'টো তল এর। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি জানাচ্ছে, পৃথিবীতে এরকম ব্রিজ এই একটিই। আরও কান্ড হ'ল, ব্রিজ নির্মিত নয়, গড়ে উঠেছে নিজেই!
ট্রেক আগেও করেছি। সিঁড়িও ভেঙেছি পালিতানা, পক্ষীতীর্থম বা শ্রাবণবেলগোলায়। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা আলাদা। এই সিঁড়িগুলো অনেকটা বেশী খাড়াই। চাপাও। তাই পায়ের ওপর চাপ পড়ছে তুলনায় বেশী। নজর রাখতে হচ্ছে তীক্ষ্ণ, যাতে পা ঠিক জায়গায় পড়ে। কোথাও কোথাও টানা আটশো সিঁড়ি নেমে গেছে। চারদিকে পাহাড় আর গভীর জঙ্গল। কোনও কোনও জায়গায় অরণ্য এত দুর্ভেদ্য, আলোও ঢোকে না ঠিকঠাক। রাস্তা জনশূন্য।
একবার থামতে হ'ল। রাস্তা নেই। সামনে পাহাড়ী নদী। ঝুলছে ফুটব্রিজ। তাতে খানিক এগোতেই শুরু হ'ল দুলুনি। নীচে বিরাট বিরাট পাথর আর তার ফাঁকফোকড় দিয়ে বইছে প্রবল বেগে নদী। দাঁতে দাঁত চেপে পৌঁছে গেলাম ওপারে। আবার শুরু ওঠা। খানিকটা এগোতেই আবার একটি ব্রিজ। এটি অনেকটা লম্বা। তবে ভয় কেটে গেছে। সামান্য যেতেই দেখা হয়ে গেল একটি রুটব্রিজ সঙ্গে। বসে পড়ি আনন্দে। পুত্র তাগাদা দেয়। থামা চলবে না। এখনও গন্তব্য আসে নি। তাই এগিয়ে যাই। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে আর বোধহয় পারবো না। তবু এক অদম্য জেদ নিয়ে চলতে থাকি।
অবশেষে চোখের সামনে ডাবল ডেকার লিভিং রুটব্রিজ। বিশ্বাসই করতে পারছি না। একটি গাছ থেকে শেকড় বেরিয়ে দু'টো ব্রিজ হয়ে ওপরে নীচে দাঁড়িয়ে আছে ! বেশ লম্বা। নীচে বইছে নদী। শোনা যাচ্ছে পাথরের বুকে আছড়ে পড়া জলের শব্দ। ঝুলছে সরু সরু ঝুরি। নদীতে সামান্য দূরে দু'একজন কাপড় ধুচ্ছে। বড় বড় পাথরের অনেকগুলিতেই শ্যাওলা জমে পেছল পেছল ভাব। নদীর স্বচ্ছ জলে মাছের দল। চোখের সামনে বিশ্বের একবোদ্বিতীয়ম ডাবল ডেকার রুটব্রিজ। নিমেষেই মিলিয়ে যায় সব ক্লান্তি। প্রণাম করি সেই বৃক্ষকে। তার সহনশীলতা মুহূর্তেই পড়িয়ে দেয় জীবনের পাঠ।
ফিরতি পথে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা কেবল। বুকে হাঁপ ধরে ভীষণ। থেমে থেমে চলি। বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় আর বোধহয় পারবো না। কিন্তু যে সহনশীলতার শিক্ষা মাত্র নিয়ে এলাম বৃক্ষের থেকে, উজ্জীবিত করে সে-ই। এগোই। থামি। আবার এগোই। আমাকে পেরিয়ে যান স্থানীয় এক বৃদ্ধ ও এক প্রৌঢ়া। মৃদু হাসেন। প্রৌঢ়া বলেন, "ওয়াক স্লোলি।" হাসি। সত্যিই বলেছেন। ধীরে ধীরে এগোতে এগোতে এক সময় শেষ হয় সিঁড়ি। উঠে আসি টিরনা গ্রামে। কোমরে, পায়ে তখন অসম্ভব ব্যথা শুরু হয়েছে। দরদর করে ঘামছি। বুকে চাপ চাপ ব্যথা। গাইড টাকা নেয়। হ্যান্ডসেক করে। বলে, "কাম এগেন।" মাথা নেড়ে বলি, "ইয়েস আই মাস্ট।"
© ছবি : লেখক