শারদ  সংখ্যা 

অলংকরণ : গুগল



শূন্যতাতেই খুঁজেছি আত্মবিনির্মাণের পথ

 তৈ মু র  খা ন️




পার্থিব জীবন শেষ হতে চলল। অপমানে গঞ্জনায় অবহেলায় নিন্দা শুনতে-শুনতেই কেটে গেল জীবন। কাউকে বোঝাতে পারলাম না, আমি কী ও কেমন। কাউকে বোঝাতে পারলাম না আমি, আমার কোনো দোষ ছিল না। 

কত রাত আমার ঘুম হয়নি। কত রাত আমি গোপনে গোপনে কেঁদেছিলাম। কত কত রাত খিদের কারণে আমি ওঠবোস করেছিলাম। কাউকে বলতে পারিনি। 

    রাষ্ট্রও বারবার আতঙ্কিত করেছে। আজও করছে। বাঁচার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। জেনোসাইডের আয়োজন করছে হয়তো তলে তলে। নিজের কাছেই বারবার একটি প্রশ্নের উত্তর পেতে চাই : তা হলে কি আর মানবিক দেশ দেখতে পাবো না? 

  পৃথিবীতে যে কদিন থাকলাম, নিজের মধ্যে এক ছেলেমানুষি যাকে সাধুভাষায় 'বালখিল্য' বলে তা-ই করে গেলাম। কিন্তু কেউ কি দেখতে পেলে না আমার ভেতরের বালকটিকে?  কী নির্মম ভাবে তাকাল আমার দিকে। কী রূঢ় কথা বলল আমাকে। জাতপাত তুলল। ধর্ম তুলল। বংশপরিচয় তুলল। আমি যত ভালোই হই না কেন কোনোদিনই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারব না। আমার চলার কৌশল, আমার কথা বলার ধরন, আমার পোশাক-আশাক খাদ্যাভাস সবকিছুতেই সাম্প্রদায়িকতা অথবা মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য দেখতে পেল অনেকেই। তাই আমার প্রাপ্য ঘৃণা। আমার প্রাপ্য অবহেলা। আমার প্রাপ্য বিতাড়ন।

 বহু রাস্তা চলতে চলতে মেপে মেপে পা ফেলতে হয়। কথা বলতে হয় অনেক ভেবে-চিন্তে। পোশাক পরতে হয় নিজের মতো নয়, অন্যরা যেমনটি বলে। এহ বাহ্য, যতটা পারি আত্মগোপন করে রাখি। এড়িয়ে যাই অনেক কিছুই। যতটা পারি নিজের নাম পর্যন্ত বলি না। অনেকেরই কষ্ট হয় আমার নাম শুনলে। অনেকেই ব্যথিত হন আমার সাফল্যে।

 কোনো সরকারের শাসনামলেই আমি নিরাপত্তাবোধ করিনি। নানা ভাবে তারা আমার অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এখনো সেই অবস্থা বহাল আছে। এখনো আমি পক্ষপাতের শিকার। কার কাছে সাহায্য চাইবো? রাজনৈতিক মানুষেরা তারা দল বদল করে, কিন্তু মন বদল করে না। তাদের নির্মমতা নিষ্ঠুরতা খুন করার প্রবণতা চিরদিন একই থাকে। শুধুমাত্র অভিনয় ক্ষমতার দক্ষতা বাড়ে। মানবিক হৃদয়ের প্রসারতা কখনোই বৃদ্ধি পায় না।


বাহিরের জগতের সঙ্গে যখন সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তখন একান্তে নিজেরই মুখোমুখি বসি। নিজেরই অসহায় মুখ মুছিয়ে দিই। কী বলে সান্ত্বনা দেবো ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতেই ঐশ্বরিক আমন্ত্রণ পেয়ে যাই। 


 বাহিরের জগতের সঙ্গে যখন সম্পর্ক ছিন্ন হয়, তখন একান্তে নিজেরই মুখোমুখি বসি। নিজেরই অসহায় মুখ মুছিয়ে দিই। কী বলে সান্ত্বনা দেবো ভাবতে থাকি। ভাবতে ভাবতেই ঐশ্বরিক আমন্ত্রণ পেয়ে যাই। পার্থিব আসক্তির লেনদেন চুকিয়ে যেতে থাকে। নিজেকে সমর্পণ করি অসীম এক শূন্যতার কাছে। তখন নিজেকে শূন্যের মতো মনে হয়। মিলিয়ে যেতে থাকি অদৃশ্য কোনো শক্তির কাছে। পার্থিব  ইন্দ্রিয়গুলি কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চৈতন্য বৃহৎ আকাশের মতো ভাসতে থাকে। কেউ নেই কিছু নেই আমি ব্রহ্মময় জীবন মহিমার এক তরঙ্গ স্বরূপ। মিলিয়ে যাচ্ছি। কী আমার পরিচয়! কে আমি! নির্দিষ্ট কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে যায়। আমি অস্তিত্বহীন বিমূর্ত সঞ্চারী প্রজ্ঞায় সম্মোহিত হই। তখন কী কবিতা আসে, কী কবিতা লিখতে পারি আমি!

 'আমি আজ অনন্তের পথে' এই শিরোনামেই কবিতাটি লেখা হতে থাকে…..


"আজ রোদ ওঠেনি

একাকী হেঁটে যাচ্ছি অনন্তের পথে

গতকাল যারা বলেছিল: দেখা হবে, রাস্তায় দেখা হবে!

তারা কেউ রাস্তায় আসেনি


আমি শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে বাসতে

নিজের সঙ্গেই কথা বলতে বলতে

এগিয়ে চলেছি


রাস্তায় অনেক পাখি আর গাছপালা আর নুড়িপাথর

সবাই দেখছে আমাকে

রক্তাক্ত সভ্যতার কোলাহল কানে আসছে

আর চিৎকার করে মরে যাচ্ছে অন্তিম ইচ্ছাগুলি


এক ঝলক বাতাস অথবা পোয়াতি মেঘের ছায়া

আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে আজ

সূর্য ফিরলে আমার দৈব ভিক্ষার সম্মোহন তীব্র হবে

আমি শুধু শূন্যতা চেয়ে নেব অনন্তের সকালের কাছে।"


 আসলে আমার সব কবিতাই অনন্তের পথের ঠিকানা খুঁজেছে। ভাতের গন্ধ থেকে এক ঝলক জৈবিক চেতনা তার মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছে। বসন্তের বিমূঢ় উচ্ছ্বাস কখনো কখনো আসক্তি বাড়িয়েছে রমণী হিল্লোলের দৈহিক-শস্য। কখনো কখনো রণ-রক্ত-রিরংসার উল্লাস আমাকে ক্লান্ত বিপন্ন করে তুলেছে। তখনও কবিতা এসেছে। কিন্তু সব কবিতাই আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। আধ্যাত্মিক এক প্রশ্রয়ে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যেতে চেয়েছে। পার্থিব সফলতাকে খুব বেশি কাম্য মনে করেনি। জীবনের পূর্ণতা পার্থিব সাফল্যে নির্ভর করে এরকম ধারণা আমার একেবারেই ছিল না। তাই কবিতাতেও খুব বেশি রমণীর ঘ্রাণ যেমন পাওয়া যায় না, তেমনি পার্থিব বিষয় না পাওয়ার হাহাকারও শোনা যায় না। যে হাহাকার আমার কবিতার মর্মমূলে বিরাজ করে তা আত্মদৈন্যের, তা self-identity-এর, তা অস্তিত্ব সংকটের এবং অবশ্যই মানবিক সংকটের। ক্ষুধার কাতরতা, যৌবনের অবদমন, প্রেমের ব্যর্থতা, পীড়িত হওয়া, শোষিত হওয়া, অত্যাচারিত হওয়া এসবকিছুরও ছায়া পড়েছে; কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে আধ্যাত্মিক শূন্যতার এক প্রান্তর। যেখানে আমি একান্তে হাসতে চেয়েছি, কাঁদতে চেয়েছি, রাস্তা হাঁটতে চেয়েছি, নিজেকে ভাঙতে চেয়েছি এবং ভেঙে আবার গড়তে চেয়েছি। আত্মবিনির্মাণের নানান কৌশলে শব্দায়িত হয়েছে অনুভূতির তরঙ্গগুলি। পাঠক কি তা জানতে পেরেছেন?

 'সর্বনাশের দিকে যেতে যেতে' কবিতায় তাই লিখেছি:


"সর্বনাশের দিকে চলে যেতে যেতে

আর কিছু দিন থাকতে চেয়েছি

আর কিছু দিন শুনতে চেয়েছি বাঁশি

আর কিছু দিন বলতে চেয়েছি :

তোমাকেই ভালোবাসি!


সবাই জানে সব মিথ্যে কথা

এখন সত্যের মতো ব্যবহার হয়

এখন সবাই জানে আলোতেও লুকিয়ে থাকে অন্ধকার

বৃষ্টি হয় তো হবে, ছাতাহীন নেমেছি রাস্তায়


বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে, আরও উজ্জ্বল হচ্ছে শেয়ালের চোখ

পূর্ণিমা আসবে যদিও, ওর জ্যোৎস্নায় মিশে যাবে শোক।"


 অন্ধকারও আলোর, আলোরও অন্ধকার থাকে। তাই একটার সঙ্গে আরেকটার বিপরীতগামী সামঞ্জস্য এসেছে। সত্যের পাশে মিথ্যা যেমন। কিন্তু শিয়ালের চোখ যখন উজ্জ্বল হচ্ছে, তখন তো আদিম প্রবৃত্তির জাগরণও ঘটছে। পূর্ণিমা এলেও শোকের বিহ্বলতা কখনো কেটে যাবে না। একাকিত্ব, শূন্যতা আর শূন্যতার সংকেতে জীবন গড়াতে থাকে। জীবনের মূলে আদিম ইনস্টিনক্ট তাকে অস্বীকার করা যায় না। আগাথা ক্রিস্টি এই কারণেই বলেছেন: 

"Instinct is a marvelous thing. It can neither be explained nor ignored."

(Agatha Christie, The Mysterious Affair at Styles (Hercule Poirot, #1)

 অর্থাৎ প্রবৃত্তি একটি বিস্ময়কর জিনিস। এটা ব্যাখ্যা বা উপেক্ষা করা যাবে না।

 তাই কবিতাতেও বলতে হয়:


'হাতের মুঠো খুলে খুলে দেখি'

 পুরো কবিতাটি এরকম:


"কয়েকদিনের জন্য এখানে এসেছি

তারপর হারিয়ে যাব

তারপর অনিবার্য শূন্যতা


মাটি দিয়ে এ দেহ বানিয়েছ

হৃদয় বানিয়েছ কী দিয়ে?

হাসি-কান্নার স্রোত নিঃশব্দে বয়ে যায়


রোজ নীরব বাঁশির সুর শুনি

কে বাজায় বাঁশি? চিনি না তাকেও

আলো-অন্ধকারে ছায়া নাচে


চলে যাব, অদ্ভুত এই যাওয়া

হাতের মুঠো খুলে খুলে দেখি

ধরে আছি আদিম এক প্রত্ন শূন্যতা"


 প্রত্নশূন্যতার সঙ্গে প্রত্নআদিমতারও সহবাস চলতে থাকে। চিহ্ন যেমন নিশ্চিহ্নের ধারক, তেমনি নিশ্চিহ্নও চিহ্নের জন্ম দেয়।

ফরাসি প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক এবং নাট্যকার হেনরি ডি মনথারলান্ট (১৮৯৫-১৯৭২) বলেছেন :

"I have only the idea I have made of myself to sustain me on oceans of nothingness"

অর্থাৎ আমার কাছে কেবলমাত্র একটি ধারণা আছে যা আমি নিজেকে তৈরি করেছি, আমাকে শূন্যতার সাগরে টিকিয়ে রাখার জন্য।


শূন্যতার সাগরে টিকে থাকতে হলে নিজেকেও শূন্য হতে হয়। এই শূন্যতাই পরম আশ্চর্যের। যেমন মিলিয়ে যায়, তেমনি জাগ্রতও হয়। যেমন অস্তিত্ববিহীন হয়, তেমনি অস্তিত্বের পুনর্জন্মও দেয়। আমরা যে কিছুই জানি না, অথবা যা জানি তা কিছুই নয়, অথবা সবই শূন্য তা বলাই বাহুল্য। লিও টলস্টয় 'যুদ্ধ এবং শান্তি' গ্রন্থে এই কারণেই বলেছেন:

"আমরা শুধু জানতে পারি যে আমরা কিছুই জানি না। আর এটাই মানুষের প্রজ্ঞার সর্বোচ্চ মাত্রা।" এই প্রজ্ঞা সক্রেটিসেরও ছিল। প্লেটো 'দ্য রিপাবলিক' গ্রন্থে বলেছিলেন: "I am the wisest man alive, for I know one thing, and that is that I know nothing." অর্থাৎ আমি জীবিত সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ, কারণ আমি একটি জিনিস জানি, আর তা হল আমি কিছুই জানি না। এই 'জানি' এবং 'না জানা' ক্রিয়া দুটি নাথিংনেসকেই অনুধাবন করে চলেছে। কবিতা তারই ভাষা,তারই প্রকাশ। প্রত্নশূন্যতায় মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যে দিয়েই সেই প্রত্নআবেগের যাত্রা।