অলংকরণ : প্রণবশ্রী হাজরা |
জ গৎ জ্যো তী চ ট্টো পা ধ্যা য়
নেকড়ে মানব
"ইয়েতির সন্ধান জানা নেই, তবে অন্য একজন আশ্চর্য মানবের খোঁজ দিতে পারি। যদি আপনাদের দেখার ইচ্ছে থাকে।", বলল লিটন।
চিকেন স্টু'টা মুখে পুরে ঋষি জিজ্ঞেস করল,"কে তিনি?"
"আপনারা নেকড়ে-মানব বা ওয়্যার উলফের ব্যাপারে জানেন তো?"
লিটনের প্রশ্নে ঋষি বলল,"হ্যাঁ, ওয়্যার উলফকে নিয়ে বেশকিছু মুভি দেখেছি। যেমন, 'এ আমেরিকান ওয়্যার উলফ ইন লন্ডন', 'টোয়াইলাইট' সিরিজ, 'সিলভার বুলেট', 'ব্যাড মুন'। আরও রয়েছে। সবকটাই লোমহর্ষক।"
নীলিমা কৌতূহলী,"এই সিমলাতে আবার ওয়্যার উলফ রয়েছে নাকি?"
"একদম জলজ্যান্ত নেকড়ে-মানব। কেবল...", বক্তব্য সম্পূর্ণ না করেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল লিটন,"তা ব্রেকফাস্ট তো প্রায় শেষ। এবার ওঠা যাক। ঘুরতে বেরিয়ে সারাদিন রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিয়ে সময় কাটানোর মতলব করেছেন নাকি?"
"উঠছি। কিন্তু, মাঝপথে 'কেবল' বলে থেমে গেলেন কেন? পুরো কথাটা শেষ করুন।", বলল নীলিমা।
লিটনের উত্তর,"খানিকটা সাসপেন্স থাক। সন্ধ্যার সময়ে বেরিয়ে আপনাদের সঙ্গে নেকড়ে-মানবের সাক্ষাৎ করিয়ে দেব। যদি সে তাঁর বাড়িতে থাকে। এখানকার লক্কর বাজার এলাকায় ওনার বাড়ি। আপাতত...",
লিটনেরর শেষ কথাগুলো শুনে দম্পতি চমকিত। তাদের চোখেমুখে যুগপৎ বিষ্ময় ও অবিশ্বাস ফুটে উঠল।
লম্বা গ্ৰীষ্মাবকাশ। নীলিমাই সিমলায় যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ঋষি বলেছিল,"আমার পিসতুতো দাদা প্রবালের বন্ধু লিটন সমাদ্দারের নিজস্ব হোটেল আছে সিমলাতে। মনে আছে নীলিমা, বিয়ের সময়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলাম।
উচ্ছ্বসিত নীলিমা বলেছিল,"ভালো মতো মনে আছে। এবারে কিন্তু জমিয়ে হিমাচল প্রদেশটা ঘুরব। পাহাড় বরাবর আমাকে চুম্বকের মতো টানে। সূর্যালোকে উদ্ভাসিত বরফাচ্ছাদিত শুভ্র শৃঙ্গরাজি, তাদের কোলে বিছানো সবুজ বনানীর গালিচা, সেসব চিরে এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া সরু পথ, রিনরিনে সুরে বয়ে চলা নদী, সুললিত ছন্দে ঝরে পড়া ঝর্ণা, হাত বাড়ালেই মেঘের পরশ। রাতের নক্ষত্রখচিত ঝলমলে আকাশ। ভাবলেই মনটা বাচ্চাদের মতো অনাবিল আনন্দে নেচে ওঠে।"
স্ত্রীয়ের প্রকৃতিবর্ণনা শুনে অভিভূত ঋষির প্রতিক্রিয়া ছিল,"তুমি এবার কবিতা লেখাটা শুরু করে দাও। বাংলা সাহিত্যজগতে অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলতে পারবে। আমিও গর্বভরে সবাইকে বলতে পারব যে আমার বউ কত বড় কবি!"
"সেই!", নীলিমা আফসোসের সুরে বলল,"সারাদিন অফিসের চাপ, তারপর সংসার সামলে যতটুকু অবকাশ পাই, তাতে আর যাই হোক, কাব্যরচনা করা সম্ভব নয়। অন্তত আমার পক্ষে। তার চেয়ে বরং সুনীল-শক্তি-সৃজাতর কবিতায় অবগাহন করে নিজের অগোছালো অনুভূতিগুলোকে খুঁজে ফিরেই সন্তুষ্ট আছি।"
নির্দিষ্ট দিনে হাওড়া থেকে কালকা মেল ধরে গতকাল ভোরে কালকা পৌঁছনো। সেখানে একদিন থেকে টয়-ট্রেনে চেপে, ছবির মতো নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতে আজ সকালে দম্পতির সিমলা আগমণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী লিটন সমাদ্দারের হোটেলে ওঠা।
সেখানে প্রাতরাশের সময়ে হিমালয়ের সৌন্দর্য ও গিরিরাজের দুর্গম অঞ্চলে লুক্কায়িত রহস্য নিয়ে আলোচনাকালীন ইয়েতির কথা ওঠে। তাই নিয়ে বলতে গিয়ে লিটন নেকড়ে-মানবের কথা বলে।
"রোগটার নাম হাইপারট্রিকোসিস। সহজ নাম 'ওয়্যার উলফ সিনড্রোম'। বলতে পারেন, এই রোগটাই আমাকে কিছুটা খ্যাতির আলোয় নিয়ে এসেছে। না-হলে, কেনই বা নগণ্য একজনকে দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন ছুটে আসবে?", ফুরফুরে মেজাজে বললেন বিলাস গুরুং।
"তা আপনি যে এমন একটা বিরল রোগের শিকার, সেটা জানার পর কেমন লেগেছিল? বিষয়টাকে সহজে মেনে নিতে পেরেছিলেন?", জিজ্ঞেস করল নীলিমা।
প্রশ্নটা শুনে ক্ষণিক নীরব রইলেন বিলাস। তাঁর মুখে উদাস ভাব। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে উত্তর দিলেন,"এই সমস্যাটাকে শুরুতে রোগ বলে ভাবতেই পারিনি। তাই অবাক হতাম খুব। যখন দেখতাম শৈশবেই আমার মুখ-সহ সারা শরীর ঘন চুলে ভরে গিয়েছে। যত কাটা হয়, তত বেশি করে গজায়। স্কুলে বন্ধুরা এই নিয়ে হাসাহাসি করত। সবাই বলত, আমি জংলী। বনমানুষের মতো দেখতে। ওদের মতো স্বাভাবিক মানুষ নই। তখন খুব খারাপ লাগত। তবে, আস্তে আস্তে ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়ে যায়।
"তখন তের কি চৌদ্দো বছর হবে। মায়ের হাত ধরে একজন বড় চিকিৎসকের কাছে যাই। তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন। অবশেষে জানান, আমি একটি অত্যন্ত বিরল রোগে আক্রান্ত। বিশ্বের হাতেগোনা কিছু সংখ্যক মানুষের এই রোগটি রয়েছে। রোগটার নাম হাইপারট্রিকোসিস। এই রোগে মুখমণ্ডল ঘন চুলে ছেয়ে যায় এবং তা দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। মুখটা তখন দেখতে অনেকটা নেকড়ের মুখের মতো লাগে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এর থেকে স্থায়ী প্রতিকার পাওয়া সম্ভব নয়।
"কিন্তু, এখন আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। এই রোগ আমাকে বিশেষ পরিচিতি এনে দিয়েছে। কয়েক মাস আগেই 'টাইমস অফ ইন্ডিয়া' দৈনিকে আমার একটা সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে আমাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টরি বানানো হয়। সবমিলিয়ে, এই রোগ আমাকে পুরোপুরি নিরাশ করেনি। বরং এমন একটা কিম্ভুত রোগ না থাকলে আমার এতখানি পরিচিতি হত কিনা সন্দেহ!"
দু'জোড়া চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে বছর পঁয়ত্রিশের বিলাসের দিকে। সন্ধ্যেতে ম্যালে বেরিয়ে হোটেলে ফিরে আসার পরে লিটনের সঙ্গে এখানে আসা। বিশেষ কাজ পড়ে যাওয়ায় বিলাসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েই লিটন চলে গিয়েছে।
বিলাসকে প্রথম দর্শনেই স্বামী-স্ত্রী বাকরূদ্ধ হয়ে পড়ে। দেহ মানুষের। অথচ শ্মশ্রুচ্ছাদিত লম্বাটে গোছের মুখাবয়বের সাথে নেকড়ের মুখের অকৃত্রিম সাদৃশ্য বিদ্যমান।
"দুনিয়াতে যে কত আজব রকমের রোগ রয়েছে!", আশ্চর্য হয়ে বলল নীলিমা।
ঋষি সহাস্য মুখে বলল,"তাহলে, গল্প আর চলচ্চিত্রে দেখানো ওয়্যার উলফ আদতে একটা মিথ।" তার গলায় ঠাট্টার সুর।
"কে বলেছে আপনাদের যে নেকড়ে মানব শুধুই কল্পনা?", গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন বিলাস।
নীলিমা বলল,"পুরোপুরি যে কল্পনা নয়, সেটার জলজ্যান্ত প্রমান তো আপনি।"
বিলাস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন,"না, না। আমি তো একজন রোগাক্রান্ত। কিন্তু, নেকড়ে মানব বা ওয়্যার উলফ বলতে আপনারা যে ভীষণদর্শন, মানুষরূপী নেকড়ের কথা কল্পনা করে থাকেন, সেই প্রাণীর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে।"
ঋষি হাসি চাপতে পারে না,"ধুস! কী যে বলেন না!"
বিলাস রহস্য করে হাসলেন। পরক্ষণেই মুখভঙ্গিমা পাল্টে চোখ সরু করে বললেন "আপনারা শিক্ষিত, শহুরে মানুষ। কেনই বা আমার মুখের কথায় বিশ্বাস করবেন! যদি চাক্ষুষ প্রমাণ দেখাই তাহলে? আজ তো পূর্ণিমার রাত। এই দেখুন..."
কথাটা শেষ করলেন না। আচমকা বৈঠকখানার সোফা থেকে মেঝেতে লম্বা লাফ দিলেন বিলাস। মুহূর্তে পাল্টে গেল তাঁর চেহারা। চোখের পলকে সমগ্ৰ দেহ পরিণত হল হিংস্র, লোমশ নেকড়তে। ছিঁড়ে খসে পড়ল পরিহিত পোশাক। বিশ্রী কটু গন্ধে ভরে গেল বাড়ির পরিবেশ।
নেকড়ে বাঘটা ক্রর গর্জন করছে। দু'চোখে খাদকের নির্মম দৃষ্টি। জিভ দিয়ে টসটস করে লালা ঝরছে টাইলসের মেঝেতে। চোয়ালের চকচকে দন্তরাশির দুইদিকে ধারালো দু'টি শ্বদন্ত।
ঋষি আর নীলিমার দৃষ্টি বিস্ফারিত। হৃদস্পন্দনের গতিও উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। বিস্ময় ও আতঙ্কে স্তম্ভিত তারা। প্রত্যেকেই নিজ আসনে স্থবির হয়ে গেছে। দম-বন্ধ-করা কয়েক মুহূর্ত।
প্রবল গর্জন করে ঘর কাঁপিয়ে দুই হাতের মধ্যে বসে থাকা নীলিমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নেকড়েটা। সম্বিত ফিরে পেয়ে আর্তনাদ করে চকিতে সোফার পিছনে লাফিয়ে পড়ল সে। অল্পের জন্য নেকড়ে তার নিশানা ফসকালো।
ঘরের দেওয়ালের এককোণে লম্বা একটা বেতের লাঠি হেলানো। ঋষি এক দৌড়ে সেটা হাতে নিয়ে উঁচিয়ে ধরল নেকড়েটার দিকে। কিন্তু বিশালাকৃতি, হিংস্র একটা জন্তুকে কি আর সামান্য লাঠি দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব! এক মোক্ষম কামড়ে ঋষির হাত থেকে লাঠি ছিনিয়ে অন্যত্র ছুঁড়ে ফেলল নেকড়েটা। প্রচন্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। চোখের সামনে সাক্ষাৎ যমদূত দেখল সে। স্বামীকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে চিৎকার করে উঠল নীলিমা। তার মর্মান্তিক হাহাকারে গমগমিয়ে উঠল চারপাশ।
পরমুহূর্তেই দৃশ্যপটের আমূল পরিবর্তন! কোথায় হিংস্র নেকড়ে? তারা তো বিলাসের বৈঠকখানায় নিজের নিজের আসনে বহাল তবিয়তে বসে আছে। সবকিছুই ঠিকঠাক। তাহলে, এতক্ষণ ধরে যা কিছু ঘটল সমস্তটাই নিছক কল্পনা ছিল? তারা কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিল নাকি? তাই বা কী করে হয়!
হতচকিত দম্পতি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। বিলাস মৃদু মৃদু হাসছেন। তাদের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখ দেখে অবশেষে তিনি রহস্য ভাঙলেন,"আমার বাবা একজন ম্যাজিশিয়ান ছিলেন। এই অঞ্চলে জাদুকর হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি ছিল তাঁর। আমি অবিশ্যি ওই লাইনে যাইনি। তবে পিতৃসূত্রে আমিও খানিকটা জাদুবিদ্যা রপ্ত করেছি। যার অন্যতম হল সম্মোহনবিদ্যা বা হিপনোসিস।"
রু মি ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
একটি আষাঢ়ে গল্প
টেবিলে রাখা কাচের গ্লাস থেকে খানিকটা জল চুমুক দিয়ে খেয়ে রিনরিনে গলায় বলে উঠল মনোমিতা
-এইতো এখন অনেকটা ভালো আছেন। কি আছেন তো?
ও ক্রিস্টাল মাইন্ডে জয়েন করা নতুন সাইক্রিয়াটিস্ট । মাত্র কয়েক মাস হল এখানে এসেছে কিন্তু এখন থেকেই বেশ নামডাক হয়ে গেছে। বাইরে পেশেন্টের লম্বা লাইন থাকে।
-হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, ইয়ে মানে ম্যাডাম তা আছি। এখন আর আগের মত সারাক্ষণ ভয়টা করে না। শুধু বিছানায় শুলে মনে হয় ঘুম আসবে না। সারারাত ছটফট করা যে কী দুঃসহ ব্যাপার!
-কেন দুঃসহ কেন? ঘুম যদি একান্তই না আসে জেগে কাটাবেন... ভালো লাগে এমন কিছু ভাববেন। ঘুমের ওষুধের ওপর ডিপেন্ডেন্সি তৈরি হওয়া ঠিক কথা নয়।
-পাশে শুয়ে আমার বউ নাক ডেকে ডেকে ঘুমায়। ওতে আরও ঘুম আসেনা।
-আরে বউয়ের নাক ডাকাকে ঘুমপাড়ানী গান ভাবুন। দুপুরবেলায় শীতের রোদ পিঠে ঠেকিয়ে চুল খুলে কিংবা রাতের টানটান বিছানায় মা ঠাকুমারা যে ঘুমপাড়ানী গান শোনাতো তা শুনে আপনার ঘুম আসতো কেন?
-কেন?
-কারণ তার একঘেয়ে সুর। যখন বাচ্চা বোঝে তাকে চেপে ধরে থাবা মেরে সেই একঘেয়ে গান শোনানো হবে তখন পালানোর জন্য ঘুমের মধ্যে বাধ্য হয়েই ঢুকে পড়ে। আপনিও ভাবুন এই বিরাট পৃথিবী আপনাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে, দোল দিচ্ছে।
-আমার বউ যে বিভিন্ন সুরে নাক ডাকে!
-আগে তো তাতেও ঘুমাতেন।যাক্ গে আপাতত একটা পয়েন্ট টু ফাইভের হালকা ওষুধ দিলাম তবে মাসখানেকের মধ্যে এটাও ছাড়তে হবে। মনে রাখবেন।
মনোমিতার মুখে কখনও মধু কখনও নিমরস। কিন্ত দুটোই পেশেন্ট এর পক্ষে বড় উপকারী। শুধু কি পেশেন্ট? যেদিন মনোমিতা প্রথম এল এই ক্রিস্টাল মাইন্ডে সেদিন রাস্তার ধারে ফুল না হওয়া কৃষ্ণচূড়া গাছটাতেও হঠাৎ করে যেন ঝেঁপে ফুল এল। তিনটে ছানার মধ্যে একখানা হারিয়ে যাওয়াতে মাথায় সাদা ছোপওআলা পাড়ার ডাকাবুকো কুকুর পুটিরাণী খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। ভাতের হোটেলের শ্যামলদা বাবা বাছা করেও উচ্ছিষ্ট খাবার মুখে তোলাতে পারছিল না। মনোমিতা আসার পরের দিনই তার হারানো ষাটের বাছা কুতকুতে কালো কুকুর ছানা লেজ নাড়তে নাড়তে ফিরে এল মায়ের কাছে।
অবশ্য মনোমিতাকে পছন্দ করে না এমন লোকজন আছে। তাদের বক্তব্য ওর খাঁজে খাঁজে খাজুরাহো এবং ও খুব সাজুনী। গাঢ় রঙের লিপস্টিক এর সাথে এক একদিন এক এক রঙের লেন্স পরে আসে চোখে । টারকোয়েশ ব্লু, হাজেল ব্রাউন, জেমস্টোন গ্রীন কত যে বাহারি রঙের উচ্ছ্বাসে উজ্জ্বল হয় চোখগুলো!
এবার মনোমিতার চেম্বারের দরজা খুলে যে ঢুকলো তার চুলগুলো কোঁকড়া, চোখ দুটো স্বপ্নালু, মাথাটা শরীরের তুলনায় বেশ খানিকটা বড়, হাতগুলো একটু বেশি ছোট। উচ্চতায় সে মেরে কেটে তিন ফুট দুই এক ইঞ্চ। নাম বিষ্ণুপদ গুহ ঠাকুরতা।উল্টোদিকে চেয়ারে বসার পর বিষ্ণুপদর পা গুলো মহাশূন্যে ঝুলে থাকল। মাটি পর্যন্ত পৌঁছাল না।
-বলুন, কি সমস্যা?
-আমার নাম বিষ্ণুপদ।
-এটা নিশ্চয়ই আপনার সমস্যা নয়।
খানিক্ষন চুপ করে রইল বিষ্ণুপদ। যেন ভেতরে ভেতরে কথা খুঁজে চলছে কিন্তু পাচ্ছে না। তারপর মনোমিতাকে চমকে দিয়েই ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। কান্নাকাটি দেখতে অভ্যস্ত মনোমিতা এরকম অভিজ্ঞতা নতুন নয় তাও মানুষকে কাঁদতে দেখলে অস্বস্তি হয় ওর। সেই সময় পেশেন্টের হাত দুটো চেপে ধরলে ও দেখেছে এতে কাজ হয়। এবারও তাই করল। বিষ্ণুপদ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি ম্যাডাম।
-পাগল আমরা কমবেশি সবাই। ওতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। আপনি আপনার সমস্যাটা খুলে বলুন।
-প্রথম থেকেই বলি?
-বলুন।
-আমরা দুই ভাই কিন্তু এক বৃন্তে দুটি কুসুম টাইপ নই। ও একদম স্বাভাবিক। একটা বয়সের পর বুঝলাম আমার হাড়গুলো আর বাড়বেনা। আমার বাবা-মা ডাক্তার বদ্যি করেছিল। কিন্তু জেনেটিক ডিসঅর্ডার। অনেকগুলো প্রজন্ম পেরিয়ে আবার এসেছে কিছু করার ছিল না। তাই মেনে নিল সবাই। বনসাই গাছের মত দুঃখ আমার। গাট্টা গোট্টা। বত্রিস বছর ধরে ঘর করছি এই দুঃখের সাথে। এইসব দুঃখ নিয়ে আমি খেলা করি, জল দিই, আলো দেখাই। তারাও আমার সাথে বন্ধুত্ব করে নিয়েছে। এ হল কনজুগল্ লাইফের মত দীর্ঘকালীন এডজাস্টমেন্ট। আমি আমার মতই থাকি। আমার তিন বছর বয়সে ভাই হয়। যখন ছোট ছিল তখন টুনটুনি পাখির পালকের মত নরম চুল ছিল ওর। আমি কোলে নিতাম, আঁচড়ে সিঁথি করে দিতাম। আমি চুল না আঁচড়ে দিলে ওর পছন্দই হত না। তারপর একদিন লম্বা হতে শুরু করল, আমি আর ওর মাথায় হাত পেতাম না মনেরও নাগাল পেতাম না।
স্কুলেও সেরকম পাত্তা দিত না কেউ আমাকে। আমাদের বাড়ির সামনে একটা বড় মাঠ আছে। আমরা বলি 'চার্চের মাঠ'। সেই মাঠে এগারোটা ছেলের টিম হত, ফুটবল খেলত। তারা রাগ হলে নিজেদের মধ্যে জামা টানাটানি করে ছিড়ে ফেলত, মারামারি করে নাক ফাটিয়ে ফেলত, আবার আনন্দ হলে কাদা মাখামাখি করে একে অপরকে আনন্দে বুকে জাপটে ধরত। আমি দূরে, অনেক দূরে একটা নরম ঘাসের জমি দেখে শুয়ে ওদের দেখতাম। কনুই মুড়ে, হাতের তালু জুড়ে মাথার তলায় রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা স্বপ্নের ফুটবল টিম বানাতাম যেখানে সবাই আমার মত তিন ফুটের। সেই থেকেই আকাশ আমার বন্ধু। আমার বরাবরই একটা কল্পনার জগত আছে যেখানে আমি ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ায়। রাজপুত্র সেজে, ঘোড়া হাঁকিয়ে। কেউ আমাকে নিয়ে বেশি আদিখ্যেতা করতে এলে আমার মনে হয় দয়া করছে। দয়া জিনিসটার ওপর বড় ঘেন্না আমার।
একা মানুষের বই-ই বন্ধু। আমার বাবার বইয়ের ব্যবসা। ছোটবেলা থেকে ওই জিনিসটার অভাব হয়নি। বাবার দোকানটা এখন আমিই দেখি। দেশ-বিদেশের নানা বই পড়ি। বছর দুয়েক হল মহাকাশ নিয়ে পড়াশোনা করি। স্টিফেন হকিংস এর ডার্ক ম্যাটার, থিওরি অফ এভরিথিং, ব্রিফ অ্যানসারস্ টু বিগ কোয়েসটেনস্ এগুলো আমার অনেক বার করে পড়া।
বেশ অনেকগুলো টাকা খরচা করে একটা রিফ্লেক্টর টেলিস্কোপ কিনেছি তাতে মারাত্মক মারাত্মক স্টিলেস্টিয়াল বডি ইয়ে মানে বাংলায় যাকে বলে স্বর্গীয়, অপার্থিব সব জিনিস দেখা যায়। দেখতে শেখাটা একটু কঠিন অনেক ধৈর্য লাগে। তাক করে অ্যাঙ্গেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে হয় কিন্তু একবার শিখে নিলে নেশা হয়ে যায়। বৃহস্পতির চারখানা চাঁদ, শনি চারিদিকে সোনার চুড়ির মত বলয়, দু-একটা খসে পড়া তারা কতকিছু যায় দেখা ! আকাশে যেদিন আধখাওয়া চাঁদ থাকে আর মেঘ থাকে না সেদিন অনেক চেষ্টা চরিত্র করলে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিটাও দেখা যায়। চিলেকোঠার ঘরে একা একাই সময় কাটে দোকান থেকে ফিরে।
সমস্যাটা শুরু হল ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে। মানে যেদিন ওর ফুলশয্যা ছিল সেদিন থেকে। ওদিন বাড়ী ভর্তি অনেক আত্মীয়-স্বজন। আমার ঘরটাতে একটা ঢালাও বিছানা করে আমার মামারবাড়ির গুষ্টির থাকার ব্যবস্থা করেছিল মা। ভাইয়ের ঘরে তখন ফুলশয্যার খাট রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে সাজানো। রাত্তিরে ওই ঘর থেকে ফুলের সাথে সাথে কাঁচা আদরের গন্ধ বেড়োবে। মনটা এমনিতেও ভাল ছিল না। আত্মীয় স্বজন আমি এড়িয়ে চলি। আমার মামাতো বোন টুয়া তো বলেই ফেলল
-ভাগ্যিস ছোড়দা প্রেম করল নইলে বড়দাকে দেখে কে আর এই বাড়িতে মেয়ে দিত?
মাকে জিজ্ঞেস করলাম
-আমার ঘরে তো একগাদা লোক ঢুকিয়েছো আমি কোথায় শোব?
মা বলল
-একটু এডজাষ্ট করে শুয়ে পড় বাবা, তোর আর কতটুকু জায়গা লাগে?
খুব রাগ হল আমার। সারা জীবনতো এডজাস্টই করে গেলাম। বৈশাখ মাস, খুব গরম ছিল। তাও অ্যাসবেস্টাসের চাল দেওয়া চিলেকোঠার ঘরটাতে গিয়ে বসলাম। টেলিস্কোপটাকে টেনে টেনে বার করে ভাবলাম আকাশ দেখে কাটিয়ে দেব এমন সময় ভয়ানক বৃষ্টি এল। তার সাথে দুমদাম বাজ পড়তে লাগল। কেউ যেন লম্বা লম্বা নেলপালিশ পরা নখ দিয়ে বুক চিরে দিচ্ছে কুচকুচে কালো ছেলে আকাশের, তার বুকে সাদা খড়ি উঠে যাচ্ছে। মাউথ অর্গ্যানের সুর সাজাতে পারি আমি। কষ্ট হলে আরো বেশি ইচ্ছে করে বাজাতে। সেদিনও কষ্ট চুইয়ে পড়ছিল আমার বুকের ধার ঘেঁষে। তাই মাউথ অর্গ্যান এ 'আমার ভিনদেশী তারা বাজাচ্ছিলাম'।
হঠাৎ মনে হল কে যেন আমার মাথায় বিলি কেটে দিল। গা শিরশির করে উঠল আমার। চোখ খুলে দেখি খানিকটা আমারই মত মাথামোটা, অদ্ভুত টানা টানা চোখের, ছোট ছোট হাত-পাওয়ালা জীব আমার দিকে প্যাট-প্যাট করে তাকিয়ে আছে। আমি ভয়ে প্রায় ভিমরি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। চোখ বন্ধ করে ফেলি। মনে মনে দশগুণে আবার তাকায় তখন আর কিছু থাকে না। সেদিন থেকে এই ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। ঘরের মধ্যে যখন বাজাই তখন আসেনা। যখন আমি একা বাজাই তখনই আসে।
আমার তো বিশেষ বন্ধু নেই ম্যাডাম আমাদের দোকানের একটা ছেলে বহুদিন ধরে আমাদের ওখানে কাজ করে। ওকেই বলেছি ব্যাপারটা। প্রথম দিকটা তো হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে আর আমার সংসার-টংসার কোনদিন হবে না তাই হয় উল্টোপাল্টা কল্পনা করছি না হয় আজকাল বেশি নেশা করছি। মিথ্যা কথা বলব না। ডাক্তার উকিলের কাছে মিথ্যা বলতে নেই। মাঝে মাঝে চিলেকোঠার ঘরে বসে দু-এক পেগ স্কচ খাই। তখন ভাবি আমারও যদি একটা প্রেমিকা থাকত যে আমার দিকে এমন ভাবে তাকাত যে আমার দুটো কান গরম হয়ে যেত, আমার বড় হতে না পাওয়া শরীরের ভেতরে গুটিয়ে যাওয়া কেন্নোর মত সত্তাটা শীতের কুঠুরি থেকে বের করে ভালবাসার রোদ্দুরে মেলে ধরত ! এরকম স্বপ্নটা যে মনের মরচে পড়া সিন্দুকে নেই তা নয় কিন্তু তা বলে জলজ্যান্ত একটা প্রাণীকে চোখের সামনে দেখতে শুরু করব? শুধু দেখলেও না হয় কথা ছিল কিন্তু সে তো রীতিমতো তার সরু সরু আঙুল আমার চুলে চালিয়ে দেয়। তার স্পর্শ আমি অনুভব করি!
মনোমিতা খুব মন দিয়ে শুনে বলল
-মানুষের মন বড় বিষম বস্তু বিষ্ণুপদ বাবু। এর অনেকগুলো স্তর। মানে ধরুন ওপরের খোলসটা একরকম, ভিতরের শাঁসটা আরেকরকম আবার তার ভেতরে যে ছোট ছোট বীজ সেটাও একদম আলাদা। মানুষ নিজেই তার মনের তল পায় না। 'মনের ভেতর বসত করে কয় জনা মন জানে না'-গান আছে না একটা?
মানুষ যত সভ্য হতে শেখে, লেখাপড়া করে ততই তার অবচেতন সত্তাটা বড় হতে থাকে। চাপা পড়তে থাকে আমাদের অনেক অবদমিত ইচ্ছে। সেই ইচ্ছেগুলো হল মনের অন্ধকারে কবর খুঁড়ে রেখে দেওয়া অনুভূতি।রাগ,হিংসে, যৌনতা এসব আপনিও সেভাবে হয়ত প্রকাশ করেননি। কিন্তু এগুলো খানিক ভূতের মত, চাপা দিতে যত মোটা দেওয়াল গাঁথুন না কেন, ঠিক বেরিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না একদম সুস্থ হয়ে যাবেন।
খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখল মনোমিতা আর কয়েকটা টেস্ট।
-ভয় পাবেন না, এবার থেকে যদি কাউকে দেখেন ভাববেন আপনি স্পেশাল। বাকিদের থেকে আলাদা তাই হয়তো আপনার কল্পনা একটু বেশি জীবন্ত।
যেসব ডাক্তারদের কথায় অর্ধেক রোগ সেরে যায় মনোমিতা তাদেরই একজন। বিষ্ণুপদ চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতেই সিস্টারকে ডেকে পাঠাল ও।
-আমি একটা দশ মিনিটের ব্রেক নিচ্ছি নীলা। নেক্সট পেশেন্ট একটু পরে পাঠিও।
মনোমিতা নিজের চেম্বারটা লক করে ফেলেল। এবার চোখের মনির রঙটা আস্তে আস্তে পাল্টে যেতে লাগল। নীল থেকেই শ্যাওলা পড়া জলাশয়ের মত হয়ে উঠল। তারপর একটা গোপন ড্রয়ার খুলে স্বচ্ছ যন্ত্র বের করল যার গায়ে পোখরাজের মত ছোট ছোট আলোকবিন্দু গাঁথা। একটা বিশেষ ভাষায় কথা বলে উঠল মনোমিতা। ধাতব ঝংকারের মত সেই ভাষা। ধীর কম্পন কিন্তু ভীষণ তীক্ষ্ণ। সে ভাষার বাংলা অনুবাদ করে যা দাঁড়ায়।
-নাম্বার72, আমি নাম্বার 81 বলছি। তুমি কিন্তু এবার বিপদে পড়বে। চিফ অনেকদিন তোমাকে ফিরতে বলছে তুমি ফিরছ না। কোনরকম প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দিচ্ছ না। নিয়মকানুন মানছ না, বিষ্ণুপদ গুহ ঠাকুরতার বাড়িতে ছদ্মবেশ ছাড়াই হাজির হয়ে যাচ্ছ। অন্য গ্রহের জীব আমরা.. আমাদের পুরো মিশনটাই খুব গোপন। তুমি তো দেখছি সে গোপনীয়তার ছিটেফোঁটাও রাখছ না।
আমার না হয় ভীষণ ব্যস্ত সময় চলছে। মানুষের মাথা আর তার বিচিত্র চিন্তাভাবনা নিয়ে গবেষণামূলক কাজটা আমার এই ক্লিনিকে ডাক্তার হিসেবে জয়েন করার পর থেকে দারুন এগোচ্ছে কিন্তু তুমি তো ফিরে যেতেই পার, এখানে কেন পড়ে আছ ?
-বিষ্ণুপদ এসেছিল? ও মাউথ অর্গ্যান বাজিয়ে শুনিয়েছে তোমাকে?
-না সুর গান এসবে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। ওসব মানুষের ভালো লাগে, আমাদের না।
-আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু ভুল ভাবতাম। শব্দ সংগ্রহ করার যে কাজ আমাকে দেওয়া হয়েছিল তা করতে গিয়ে দেখলাম এই পৃথিবীর সবেতেই সুর।আর সবচেয়ে সুন্দর সুর বিষ্ণুপদর কাছে আছে। এতদিন পর্যন্ত যা যা শব্দ কুড়িয়ে পেয়েছি সব পাঠিয়ে দিচ্ছে তোমাকে একটা ফাইলে। দেখো তো সেন্ড করলাম, কিন্তু আমার আর ফেরা হবে বলে মনে হয় না।
এটুকু বলেই ইচ্ছে করে ফোনটা কেটে দেয় নাম্বার 72। তারপর ছোট যন্ত্রটাকে বিষ্ণুপদদের পাড়ার শান বাঁধানো রেলিং ঘেরা টলটলে জলের পুকুরটায় ঝুপ করে ফেলে দেয়। দুবার হাবুডুবু খেয়ে,ভুটভুটি কেটে হারিয়ে যায় অন্য গ্রহের সংযোগ স্থাপনের যন্ত্রটা, ছিঁড়ে যায় যোগসুত্র। তারপর ঝোপের আড়াল থেকে যে বেরিয়ে আসে তার গায়ে ফুলকাটা সালোয়ার আর পাগুলো ছোট ছোট, মাথাটা শরীরের থেকে বড়। ঠিক যেন বিষ্ণুপদর জোড়া ,ওর জন্যই তৈরী। যাকে বলে মেড ফর ইচ আদার।
ওই তো দেখা যাচ্ছে বিষ্ণুপদ হেঁটে হেঁটে ফিরছে। মুখে এখনও খানিকটা বিষন্নতা লেগে আছে। এরপর একটা ছোট্ট ধাক্কা খাবে নাম্বার 72 এর সাথে। বাকিটা সিনেমায় যেমন হয়, ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে একটা সুরেলা সিম্ফোনি।