অলংকরণ : প্রণবশ্রী হাজরা 



ব ন বী থি  পা ত্র

চৈত্রদিনের শেষে



(এক)

জ বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে ভেবেছিল তৃণা। কিন্তু ভালো করে সকাল হওয়ার আগেই ঘুমটা ভেঙে গেল। কম্বলটাকে আরও কিছুটা জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বোজে, কিন্তু ঘুম আসে না। ঘর জুড়ে হালকা অস্পষ্ট সবুজ আলো, বালিশের আশপাশটা হাতড়িয়ে মোবাইলটা খুঁজে পায় না তৃণা। কাল রাতে শোয়ার সময় মোবাইলটা বিছানায় এনেছিল কি না মনেও করতে পারে না। কাচের জানলাতে ঘন নীল রঙের ভারী পর্দা ঝুলছে। পর্দার এপাড় থেকে বাইরে সকালের আলো ফুটেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় অকারণে শুয়ে থাকতে ভালো লাগে না। সময়টা না দেখেই উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। ফেব্রুয়ারী মাস শেষ হতে চললেও শীতের আমেজটা থেকে গেছে এখনও। বিশেষ করে এই সকাল আর সন্ধের দিকটা হালকা চাদরের ওমটুকু মন্দ লাগে না। রিঠি কুঁকড়ে শুয়ে আছে সেই ছোট্টবেলার মত। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শীত করছে। অথচ কম্বলটা এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে পায়ের তলায়। কম্বলটাকে টেনে দেয় তৃণা। পাশবালিশটাকে জড়িয়ে আরাম করে শোয় রিঠি। ট্রলিব্যাগ থেকে স্টোলটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নেয় তৃণা। দরজা খুলে বাইরে ব্যালকনিতে বেরিয়ে দেখে দিনের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ আগেই। তবে সূর্যোদয় হয়নি মনে হয় এখনও। সূর্যোদয়টা দেখার জন্যই বোধহয় এত সকালেই সমুদ্রতটে অত মানুষের মেলা। ব্যালকনি থেকে সমুদ্রটা দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সূর্যোদয়টা পরিষ্কার দেখা যাবে না। বেলা করে ঘুম থেকে ওঠাই রিঠির বরাবরের অভ্যাস। তৃণা জানে এখন ও ঘুম থেকে উঠবে না। তবু দরজাটা বন্ধ করে একবার সমুদ্রে যাওয়ার কথা ভেবেই মনটাকে পরিবর্তন করে নেয় তৃণা। কোনদিন ভোরবেলা জাগে না, কিন্তু আজ যদি কোন কারণে জেগে যায়! রিঠি তো আর পাঁচজনের মত স্বাভাবিক নয়। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে রাখা বেতের চেয়ারটায় এসে বসে। ভোরের শিরশিরে সমুদ্রের হাওয়ায় অদ্ভুত একটা আয়েশে চোখ দুটো যেন বুজে আসে তৃণার।

ছোটবেলায় ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর এমন চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে থাকতে ভীষণ ইচ্ছা করত তৃণার। কিন্তু ওই বাড়িতে বেলা অবধি কারও বিছানায় শুয়ে থাকার নিয়ম ছিল না। সূর্য ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেগে উঠত গোটা বাড়িটা।

দোতলা বাড়িটা ছিল এল প্যাটানের। পুরনো আমলের বাড়ি। শরিকী সম্পত্তি, কেউ দেখভাল করতো না বাড়িটার। মাথা গুঁজে দিনগুলো কাটিয়ে দেওয়াটাই যেন জীবনের লক্ষ্য। কোনদিনও বাড়িটায় রঙ হয়েছিল কিনা বোঝাই যেত না। পলেস্তারা খসে খসে ইঁট বেরিয়ে যেখানে সেখানে। বাইরের দিকে কোথাও কোথাও বট-অশ্বত্থের চারা দিব্যি নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করতো। নীচে উঠোনের একপাশে টিউবয়েল কল। তারপাশে একটা কুয়ো। কুয়ো থেকে জল তোলা কখনও দেখেনি তৃণা। টিউবয়েল কলটা হওয়ার আগে হয়তো ওখান থেকে জল তোলা হত। কুয়োতলায় ছোটদের যাওয়া বারণ ছিল। তবু বড়োদের এড়িয়ে কুয়োর দেওয়াল ধরে নীচের দিকে তাকানোটা কেমন নেশার মত ছিল। কুয়োর মধ্যেটা ছিল নিজেদের কল্পনার রাজত্ব। জলের কোন অস্তিত্ব ছিলনা। দিনের বেলাতেও কেমন নিকষ অন্ধকার। কেমন অজানা একটা গা ছমছমে ভয় যেন লুকানো ছিল ওই অন্ধকারে। কুয়োতলার পাশেই পরপর দুটো টয়লেট। যার ডাকনাম ছিল কলঘর। পাঁচ পাঁচটা শরিকী পরিবারের ওই দুটো কলঘর। সারাদিনে সবসময়েই দরজার বাইরে দু-একজন অপেক্ষায় থাকত। কলঘর দুটো মনে পড়তেই গা পাক দিয়ে ওঠে তৃণার। ঐরকম অপরিচ্ছন্ন টয়লেটের কথা আজ আর ভাবতেই পারেনা তৃণা। উঠোনটা ছিল সিমেন্টে বাঁধানো। অবশ্য মাঝে মাঝে চটকা উঠে তারও দৈন্য দশা। সারসার লম্বা দড়িতে সারাদিনই জামাকাপড় শুকত। ছাদে কেউ জামাকাপড় মেলত বলে মনে পড়ছে না তৃণার।

মা ছিল ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষ। ওই বাড়ি ছেড়ে কোন ভাড়াবাড়িতে উঠে যাওয়ার জন্য অনেক রাতে বাবা-মায়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি হতে শুনেছে তৃণা। বাবা রেগে যেত মায়ের কথাতে। সামান্য প্রাইমারী স্কুলে মাষ্টারী করে চার-চারটে পেট টানার পর বাড়ি ভাড়ার টাকা কোথা থেকে আসবে জানতে চাইত বাবা। এরপর আবার দু-দুটো মেয়েকে পার করতে হবে, তার খরচও তো কম নয়। মেয়ের বদলে দুটো ছেলের জন্ম দিলেও না হয় জানতাম সংসারকে কিছু দিয়েছ। অন্ধকারে দেখতে না পেলেও তৃণা বুঝতে পারত বাবার কথা শুনে মা কাঁদছে। ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়ে জন্মানোর জন্য কেমন একটা অপরাধ বোধ যেন কুরে কুরে খেত তৃণাকে। বাবা-মা শুতো মেঝেতে বিছানা পেতে, আর ওরা দুই বোনে চৌকিতে। চৌকির বিছানায় দিদির পাশে চুপটি করে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকত। বাবা রেগে গেলে কেমন যেন হয়ে যেত, ভীষণ ভয় করত তখন তৃণার। দিদিকে আঁকড়ে ধরতে গেলে বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিত। দিদির নাকি গায়ে হাত দিলেই সুড়সুড়ি লাগে। দিদির থেকে সাড়ে সাত বছরের ছোট ছিল তৃণা। দিদি তখন শাড়ি পরে স্কুলে যায়, পড়ার বইএর মধ্যে লুকিয়ে মেজবৌদির কাছ থেকে আনা সিনেমা নায়ক নায়িকার ছবি দেওয়া বই পড়ে, মাকে লুকিয়ে ছোড়দার বন্ধুদের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করে। আর তৃণাকে ভয় দেখায় মাকে এসব কথা বলে দিলে আর একটাও গান শিখিয়ে দেবে না। সুরের প্রতি ছোট থেকেই ভীষণ টান অনুভব করত তৃণা। মা একটা পুরনো হারমোনিয়াম নিয়ে এসেছিল মামার বাড়ি থেকে। দিদি গান শিখত পাড়ার শ্যামল মাষ্টারের কাছে। দুজনকে মাষ্টারের মাইনে দিয়ে গান শেখানোটা বাবার হিসাবে বাজে খরচ। মা বলেছিল, দিদির বিয়ে হয়ে গেলে তৃণাকে গান শিখতে ভর্তি করে দেবে। তখন কে জানত দিদি ঐ গানের মাষ্টারমশায়ের সঙ্গেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে! দিদির গান শেখা শুরু হয়েছিল মায়ের ইচ্ছায়। দিদির পালিয়ে বিয়ে করার সব দায় যেন এসে পড়ল মায়ের ওপর। বাবা, বাড়ির লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী কেউ মাকে ছেড়ে কথা বলেনি। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হতো তৃণার। রাগ হয় দিদির ওপর। এতটা স্বার্থপরের মতো কাজ দিদি কি করে করতে পারল আজও ভেবে পায় না তৃণা। বাবার রাগটা সম্পূর্ণ এসে পড়ল তৃণার ওপর। স্কুলে যাওয়া ছাড়া তৃণার বাইরে বেরনো বন্ধ করে দেয় বাবা। তখন সবেমাত্র ক্লাস সেভেনে পড়ে তৃণা। মাধ্যমিকটা পাশ করলেই বিয়ে দিয়ে দেবে বলে হুমকি দিত বাবা। বাড়ি ছেড়ে, মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে শুনলেই কেমন যেন ভয় করতো তৃণার। কয়েক বছর পর সেই বাড়ি ছেড়ে ভাড়াবাড়িতেই উঠে যেতে হয়েছিল তৃণাদের। তৃণার সামনে তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা। সেজ্জ্যেঠুর ছেলে বান্টুদার বিয়ে হয়েছে মাস পাঁচেক আগে। বৌদি সবসময় কেমন যেন মনমরা। বৌদি মফস্বলের মেয়ে। সবাই ভাবতো শহরের এই বদ্ধ পরিবেশে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে হয়তো। কিন্তু সব ভুল ভাঙলো বৌদি যেদিন ঐ পুরনো কুয়োটার মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো। প্রথমে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না বৌদিকে। শেষে বৌদির সবুজ শাড়িটাকে আটকে থাকতে দেখা গিয়েছিল কুয়োর ভিতরের গাছপালার মধ্যে। বডিটা তুলতে অনেক খুঁজে তবে লোক পাওয়া গিয়েছিল। কুয়োর প্রচলন কমেছে অনেক আগেই। কুয়োতে নামায় পারদর্শী মানুষগুলো সব অন্য পেশায় ঢুকেছে। বৌদির লাশ কুয়ো থেকে উঠেছিল প্রায় দেড়দিন পর। সবাই বলাবলি করছিল, বৌদির অত সুন্দর মুখটা নাকি দেখে ভয় লাগছিল। মা অবশ্য তৃণাকে সে মুখ দেখতে দেয়নি। বৌদিকে খুঁজে পাওয়ার আগেই অবশ্য বৌদির লিখে যাওয়া চিঠি থেকে সবাই জেনে গিয়েছিল আত্মহত্যার কারণটা।

ছোটকাকে সবাই ডাকতো হাফ লেডিস বলে। চালচলন-কথাবার্তা সবেতেই নারীসুলভ ভাব। পাড়াতে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে যাত্রা হতো। পাড়ার ছেলেরাই অভিনয় করত। ছোটকা যাত্রায় মেয়ে সাজত। একজন পুরুষ পাড়ার যাত্রাতে নারী চরিত্রে অভিনয় করাটা পরিবারের লোকজনদের কাছে ছিল চরম অপমানের। পাড়ার সবাই গেলেও তৃণাদের বাড়ি থেকে কেউ যেত না। বাবা-জ্যাঠাদের কড়া নিষেধ ছিল। একতলার দক্ষিণের কোণের ঘরটাই ছিল ছোটকার জগৎ। বাড়ির কেউই সেভাবে কথা বলত না ছোটকার সাথে; সবাই কেমন বিচ্ছিরি ভাবে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ-তাচ্ছিল্য করত ছোটকাকে। খারাপ লাগত তৃণার। কিন্তু সাংসারিক ব্যাপারে বাড়ির ছোটদের কোন কথা বলার চল ছিল না বাড়িতে। ছোটকার খাওয়ার পালা পড়ত বড়োজ্যেঠু আর মেজ্জ্যেঠুর ঘরে। তৃণা একবার মাকে জানতে চেয়েছিল, ছোটকা ওদের ঘরে বা সেজ্জ্যেঠুদের ঘরে খায়না কেন? মা বুঝিয়ে দিয়েছিল, সেজ্জ্যেঠু আর বাবা হলো দাদুর ছেলে। আর বড়োজ্যেঠু-মেজ্জ্যেঠু-ছোটকা হলো বড়দাদুর ছেলে। তাতে কি হয়েছে, সবাই তো ভাই ভাই! শিশু মাথায় ভায়াদি ভাগাভাগিটা ঠিকমতো ঢোকেনি তৃণার। তবে মাকে আর বেশি কিছু জানতে চাওয়ার সাহস হয়নি। ছোটকার সাথে বাড়ির মধ্যে একমাত্র ভাব ছিল বান্টুদার সাথেই। কিন্তু তাই বলে! বৌদির মৃত্যুর থেকেও সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল বান্টু আর ছোটকাকে নিয়ে। শেষে কিনা ঘরের মধ্যে এমন নোংরামি! ছোটকাকে মারধোর করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল বাবা-জ্যাঠারা। আপন মানুষগুলোর প্রতি কেমন একটা অবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল বাবার। তৃণার নিরাপত্তার জন্যই উঠে এসেছিল ভাড়াবাড়িতে।

একটা দোতলা বাড়ির একতলাটা ভাড়া নিয়েছিল বাবা। দুটো ঘর, একটা রান্নাঘর আর এক চিলতে বারান্দা। সব থেকে বড় পাওনা একটা বাথরুম, শুধু তৃণাদের তিনজনের জন্য। চেনা জীবনের ছকটাতে একটু একটু করে পরিবর্তন আসছিল। মনে পড়ে, ভূগোল বইতে পড়ে দিদি একবার দার্জিলিং বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার আবদার করেছিল বাবার কাছে। আর সেই আবদারের জন্য দিদির সঙ্গে সঙ্গে মাকেও সেদিন বকুনি খেতে হয়েছিল বাবার কাছে।

"মামাদের মত সব বড়লোকি হালচাল শিখেছে!"

মামাদের কাউকে কখনও দেখেনি তৃণা। এমনকি মায়ের কাছেও কোনদিন মামাবাড়ির কোন গল্প শোনেনি। বন্ধুরা সবাই ছুটিতে মামাবাড়ি বেড়াতে যেত, তৃণারা কোনদিন মামাবাড়ি যায়নি। তবু যে কোন কথাতে বাবা কেন যে মামাবাড়ির প্রসঙ্গ তুলত, বুঝতে পারত না তৃণা। মামাবাড়ির কথা মায়ের মুখে শুনেছিল মায়ের মৃত্যুশয্যায়। মায়ের যে যমজ ভাই ছিল, সেই মামাকে একবার দেখতে চেয়েছিল মা। মায়ের সেই ইচ্ছাটুকুও পূরণ করতে পারেনি তৃণা। মামা যখন এসে পৌঁছেছিল, শ্মশানে তখন মায়ের দাহকার্য চলছে। পরিণত বয়সে এসে এখন তৃণা বুঝতে পারে, কতটা কষ্টে মা আপনজনদের সব স্মৃতিতে সারাজীবন নিজের মনের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। কিন্তু মামাবাড়ির সঙ্গে কেন সম্পর্কটা স্বাভাবিক ছিল না জানা হয়নি তৃণার। শ্মশান থেকেই ফিরে গিয়েছিল মামা, মায়ের শেষ কাজেও আসেনি। তৃণারও আর নতুন করে যোগাযোগ করা হয়নি মামাদের সঙ্গে।

চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে আসা জলটুকু মুছে নেয় আলগোছে।

নতুন বাড়িতে এসে বাবাও যেন একটু একটু করে পাল্টাচ্ছিল। মায়ের সঙ্গেও আর যেন অতটা খারাপ ব্যবহার করত না সবসময়। তৃণার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাবা-মা আর তৃণা পুরী এসেছিল। মা আর বাবাকে প্রথমবার জীবনে একসঙ্গে খুশি হতে দেখেছিল তৃণা। সবসময় সংসারের কর্মভার আর একটা অজানা অপরাধ বোধে কুঁকড়ে থাকা মাকে প্রথমবার উচ্ছল হতে দেখেছিল সমুদ্রে এসে। ভালোলাগার অনুভূতিটুকু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পুরী থেকে ফেরার সপ্তাহ খানেকের মাথাতেই বাবার হার্ট-অ্যাটাক হয়। বাবা তখন স্কুলে ক্লাস নিচ্ছিল। স্কুলের সহকর্মীরাই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বাবা চলে গিয়েছিল অন্য জগতে। প্রতিদিনের মত খেয়েদেয়ে স্কুলে গিয়েছিল বাবা  আর বাড়ি ফিরেছিল সাদা চাদর ঢাকা মৃহদেহটা। সুস্থ-সবল বাবা, হঠাৎ করেই নেই হয়ে গেল তৃণা আর ওর মায়ের জীবনে। বাবার এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় মা যেন আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। কারও সঙ্গে কথা বলত না। নিজের ঘরেই বসে থাকত সারাদিন। সবকিছুতেই কেমন যেন একটা অনীহা। প্রথম প্রথম তৃণা ভেবেছিল, অধিক শোকে হয়ত এমনটা হয়েছে। কিন্তু  কিছুদিনের মধ্যেই তৃণা বুঝতে পেরেছিল, মা মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে।

ততদিনে বাবার চাকরিটা পেয়ে গেছে তৃণা। মাকে নিয়ে এতখানি ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে ইচ্ছা থাকলেও চাকরি-সংসার দুদিক সামলিয়ে বিএ পাশটা আর করা হয় না তৃণার।

-সাহস করে আলাপ করতে চলে এলাম। এখন তো বেশির ভাগ জনই লেট রাইজার। আপনি তো বেশ সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠেন।

ভাবনার মাঝখানে অজানা পুরুষ কণ্ঠস্বরে একটু যেন চমকে ওঠে তৃণা। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকায়।



(দুই)

-তৃণা, তৃণা....

পাহাড়ের কোলের সেই ছোট্ট শহরটাতে অপটু হাতে গোছানো নতুন সংসার তখন তৃণার। অমিত খাদ্যরসিক মানুষ। তৃণা তখন প্রতিদিনই কিছু না কিছু নতুন রেসিপি ট্রাই করছে রোজ। খবরের কাগজ, পত্রিকা, টিভির কুকিং শো সব জায়গার রেসিপি লিখে রাখছে নিজের ডায়েরীতে। অনেকটা যেন বড়বেলায় রান্নাবাটি খেলা। সেদিনও নতুন কিছুই বোধহয় বানাচ্ছিল রান্নাঘরে। অসময়ে অমিতের ডাক। ওর তো অফিস থেকে ফিরতে দেরি আছে কিছুক্ষণ। হাত না ধুয়েই দরজা খুলতে গিয়েছিল তৃণা। দরজা খুলে তো অবাক তৃণা!

-তোমার জন্য সারপ্রাইজ।

একমুখ হেসে ঘরে ঢোকে অমিত। হাতে নতুন গিটার।

চা খেতে খেতে অমিত বলেছিল,

-তুমি বলেছিলে তোমার সুর ভালো লাগে। তাই নিয়ে এলাম গিটারটা। সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিয়ে দুজনে বারান্দায় গিয়ে বসব। তুমি একটার পর একটা সুর বাজাবে, আর আমি মুগ্ধ হয়ে শুনব।

অমিত যখন এইভাবে কথাগুলো বলত, নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ মনে হত তৃণার। মায়ের সেই পুরনো হারমোনিয়ামটা ছাড়া আর কোন বাদ্যযন্ত্র কোনদিন হাতে নেড়েও দেখেনি তৃণা। অমিতের অতখানি উৎসাহের মাঝে একটু যেন কুণ্ঠিত স্বরেই বলেছিল,

-আমি তো গিটার বাজাতেই জানি না।

-জানো না তো কি হয়েছে! শিখে নেবে। দাঁড়াও একজন ভালো টিচারের খোঁজ করছি।

গিটারের টিচার এসেছিল প্রায় বছর চারেক পর। ততদিনে অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে ওদের জীবনে। সেই গিটার আনার পরপরই নতুন অতিথি আসার খবরটা পেয়েছিল ওরা। গিটার তখন সযত্নে উঠে গেছে আলমারির ওপর তাকে। নতুন খুশিতে মগ্ন তখন ওরা দুজনে। খুশিটা দ্বিগুণ হয়েছিল, যেদিন জেনেছিল একজন নয় দুজন আসছে ওদের ঘরে।

দুজন এসেছিল তৃণার কোলে। কিন্তু একজনকে অনেক চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারেননি ডাক্তারবাবুরা। একা রিঠিকে কোলে নিয়েই হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরেছিল তৃণা। জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন সমস্যা ছিল রিঠির। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যাগুলো অনেকটা কেটে গেলেও তৃণা বুঝতে পারত রিঠি আর পাঁচটা বাচ্চার মত স্বাভাবিক নয়। চাকরির সময়টুকু ছাড়া সবটুকু সময় মেয়েকে নিয়ে কাটাতে কাটাতে হাঁফিয়ে উঠছিল তৃণা।

প্রাঞ্জলকে অমিতই নিয়ে এসেছিল। খুব ভালো গিটার বাজায়। গিটার শেখাবে তৃণাকে। রিঠিকে সবসময় দেখাশুনো করার একজন আয়া রাখা হল। কিন্তু রিঠির সবসময় ওর মাকেই প্রয়োজন। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, রিঠিকে যত বেশি সময় দেওয়া যাবে ওর জন্য সেটা তত উপকারী হবে। ইচ্ছা থাকলেও গিটার শেখাটা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেনি তৃণা। গিটারের আওয়াজ পেলেই অসম্ভব কান্নাকাটি শুরু করত রিঠি। বাধ্য হয় গিটারটা ছাড়তে হয়েছিল তৃণাকে। অমিতের সেটা পছন্দ নয়। মেয়েকে নিয়ে ছোটখাটো সব ব্যাপারেই কেমন একটা মনোমালিন্য যেন লেগেই থাকত অমিতের সঙ্গে। অলক্ষ্যে সম্পর্কটা যে ভিতর ভিতর ক্ষয়ে আসছে, কখনও ভাবেইনি তৃণা।

তাই তো অমিত যেদিন প্রথম আলাদা থাকার কথাটা বলেছিল, প্রথমটায় নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারেনি তৃণা। পরে বুঝেছিল অমিত আরর সুচেতার সম্পর্কটা অনেকদিনের। সাড়ে পাঁচ বছর ধরে অমিতের অভিনয়টা একটা বারের জন্যও বুঝতে পারেনি তৃণা। আর তাই তো অমিতের ওপর রাগ অভিমানের থেকেও নিজের প্রতি ধিক্কারবোধটা বেশি হয়েছিল। রিঠি যে স্বাভাবিক আর পাঁচজন বাচ্চার মত নয়, সে দোষটা তো ওর নয়। অথচ অমিত যেন একটা দিনের জন্যও মেয়েটার অসহয়তাটাকে মেনে নিতে পারে নি। নতুন করে জীবন শুরু করলেও মেয়ের চিকিৎসা বা অন্যান্য সমস্ত খরচাপাতির আর্থিক দায়িত্ব নিতে চেয়েছিল অমিত। ভালোবাসাহীন কর্তব্যের দানটুকু নিয়ে নিজেকে আর মেয়েকে ছোট করতে পারেনি তৃণা। নিজের চাকরীটাকে ভরসা করেই নতুন ভাবে জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তার।



(তিন)

"তখনো কুহেলীজালে,

সখা, তরুণী উষার ভালে

শিশিরে শিশিরে অরুণমালিকা

উঠিতেছে ছলোছলি ।।

এখন বনের গান,

বন্ধু হয় নি তো অবসান...."

ডাক্তারবাবুই বলেছিলেন, রিঠিকে কখনও অক্ষম না ভেবে বরঞ্চ বিশেষভাবে সক্ষম ভাবতে। ওর ভালোলাগাটাকে খুঁজে বের করতে। ডাক্তারবাবুর কথা মত চেষ্টা করেছিল তৃণা। সেই সাত বছর বয়স থেকে নাচ শিখছে রিঠি। প্রথম স্টেজ পারফরমেন্স করে ন'বছর বয়সে। সেই প্রথম পারফরমেন্সের দিন থেকেই রিঠি যখন স্টেজে ওঠে, সীট ছেড়ে স্টেজের সামনে উঠে এসে দাঁড়িয়ে থাকে তৃণা। রিঠি তো আর ছোটটি নেই, তবু কেন যেন ওর নাচের সময়টুকু সুস্থির ভাবে চেয়ারে বসে থাকতে পারে না তৃণা। আজও চেয়ার থেকে উঠে এসে স্টেজের সামনে বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল তৃণা। রিঠি নাচছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গে মণিপুরী নাচ। একক নৃত্য। দুচোখ ভরে দেখছিল তৃণা। রিঠি যখন নাচে, তখন ওর এতটুকু অস্বাভাবিকতা বোঝার ক্ষমতা নেই কারও। তবু কেন যেন তৃণার বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

-রিঠিয়া তো ভারী সুন্দর নাচে! অথচ এই মেয়েই ছোটবেলায় সুর শুনে কাঁদতে শুরু করত!

কথার শব্দে পিছন ফেরে তৃণা। আজ ভোরবেলা ব্যালকনিতে প্রথম দর্শনে চিনতে না পারলেই, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রাঞ্জলকে চিনতে পেরেছিল। তবে সামান্য সৌজন্য বিনিময়টুকু ছাড়া বিশেষ কোন কথা হয়নি। তার আগেই প্রাঞ্জলের মোবাইলটা বেজে উঠেছিল মিষ্টি সুরে। কোন গান নয়, গিটারে বাজানো একটা বিরহী সুর। শিল্পীর মোবাইলের উপযুক্ত রিংটোন। কথা বলতে সরে গিয়েছিল প্রাঞ্জল। তৃণাও উঠে এসেছিল নিজের ঘরে। একই হোটেলে থাকলেও সারাদিনে আর দেখা হয়নি। সারাদিনে হোটেলে ছিলই বা কতক্ষণ! ব্রেকফার্স্ট করেই তো বেরিয়ে এসেছিল হোটেল থেকে। স্টেজ রিহার্সাল সেরে শেষ দুপুরে হোটেলে ফিরে খাওয়া আর সামান্য একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার অডিটরিয়ামে। রিঠির আজ সারাদিন ভীষণ ধকল যাচ্ছে। রিঠিদের নাচের স্কুলের এই অনুষ্ঠানটার জন্যই এবারে পুরী আসা। এখানে আবার যে প্রাঞ্জলের সঙ্গে দেখা হবে আশা করেনি। মাস ছয়েক হয়ত গিটারটা শিখেছিল তৃণা। তখনই প্রাঞ্জলের সঙ্গে বেশ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। গিটার শেখা ছেড়ে দেওয়ার পরেও প্রাঞ্জল দু-একবার বাড়িতে এসেছিল। তারপর জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটার পর একটা ঝড়ে তৃণা নিজেই এমন বিপর্যস্ত ছিল, প্রাঞ্জল মানুষটার কথা ভুলেই গিয়েছিল। এতগুলো বছরে কখনও মনে পড়েছে বলেও মনে পড়ে না তৃণার। তবে প্রাঞ্জল মনে হয় ভোলেনি! গিটারের আওয়াজ পেলেই যে রিঠি কান্না শুরু করত, সেটা মনে থাকত না এতদিন পর। রিঠি কি আদৌও সুর শুনে কাঁদত! মনে হয় মাকে ছেড়ে থাকতে হবে সেটা বুঝতে পেরে কান্নাকাটি করত। রিঠির সেই ছোটবেলার দিনগুলো মুহূর্তে যেন চলচ্চিত্রের মত ভেসে ওঠে দুচোখের সামনে।

রিঠির নাচ শেষ। হাততালিতে ভরে যাচ্ছে সারা অডিটরিয়াম। প্রাঞ্জলও হাততালি দিচ্ছে। এক মুঠো আনন্দ যেন গোপনে তৃণার বুকের মধ্যে প্রজাপতির মত উড়ে বেড়াচ্ছে।

-রিঠিয়ার আর নাচ বাকি আছে?

জানতে চায় প্রাঞ্জল।

-আর একটা নাচ আছে, অনুষ্ঠানের শেষের দিকে।

-রিঠিয়া তো তাহলে এখন ওখানেই থাকবে। বাইরেই একটা কফিশপ আছে, চলুন একটু গিয়ে বসা যাক ওখানে। কফিও খাওয়া যাবে, একটু কথাও বলা যাবে।

সন্ধের দিকে একবার চা খাওয়ার অভ্যাস তৃণার। আজ আর সেটুকু খাওয়াও সময় অথবা সুযোগ কোনটাই হয়নি। মাথাটা কিছুক্ষণ আগে থেকেই ভার ভার লাগছিল। এখন একটু চা বা কফি হলে মন্দ হয় না! কিন্তু রিঠি যদি কোন কারণে বেরিয়ে এসে মা কে খোঁজে! প্রাঞ্জলের প্রস্তাবটা না করে দিতে গিয়েও থেমে যায় তৃণা। ডাক্তারবাবু বলছিলেন, রিঠির এই সম্পূর্ণ মা নির্ভরতা ব্যাপারটাকে এবার একটু একটু করে কাটাতে হবে। বড় তো হচ্ছে রিঠি। এই নভেম্বরে উনিশ পেরিয়েছে রিঠি।

প্রাঞ্জলও এই অনুষ্ঠানটার জন্যই তার স্কুলের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে এসেছে। তাদের নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল সারাদিন যে দুপুরের খাওয়াটুকুও হয়নি। কফির সঙ্গে চিকেন প্যাটিস নিয়েছে প্রাঞ্জল। তৃণা শুধু কফি।

প্রাঞ্জল একমনে চিকেন প্যাটিস চিবোচ্ছিল। তৃণা চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না, শেষ কবে এত মন দিয়ে কোন খাবার খেয়েছে! কফিতে চুমুক দিতে দিতে তৃণা আড়চোখে জরিপ করছিল চারপাশ। খোলা আকাশের নিচে আলো-আঁধারির খেলা। সমুদ্রটাকে দেখা না গেলেও ইংরাজী গানের মৃদু সুরকে ছাপিয়ে তার গর্জন শোনা যাচ্ছে। একটা নোনা শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়াও যেন অনুভব করছে তৃণা। বেশিরভাগ জনই জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে। তবে একটু দূরে একদল ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলোকে দেখেই রিঠির মুখটা মনে পড়ে। ওরা রিঠির বয়সীই হবে হয়ত। কলেজে পড়ে। রিঠি এখন সবে ক্লাস সিক্স। তবে শেষ দুবছরে লেখাপড়াটায় বেশ মনোযোগী হয়েছে মেয়েটা। তৃণাকে ছাড়াও পড়তে বসে এখন।

চিকেন প্যাটিসটা শেষ করে কফিতে প্রথম চুমুকটা দিয়ে কিছু যেন কৈফিয়তের সুরেই প্রাঞ্জল বলল,

-সারাদিন সেভাবে কিছু খাওয়াই হয়নি। পেটের মধ্যে ছুঁচো লাফালাফি করতে শুরু করেছিল।

তৃণা কোনদিনই ঠিক পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বলতে পারে না। শব্দরা সময় মত কথা হয়ে যেন ধরা দেয় না তৃণার কাছে। আজও প্রাঞ্জলের কথায় কী উত্তর দেবে বুঝতে না পেরে শুধুই মৃদু হাসল তৃণা।

-এখনও সেই পাহাড়ি শহরেই থাকেন? আমি তো জীবনের টানে ভাসতে ভাসতে কত জায়গা ঘুরে, গত সাত বছর ধরে কলকাতাতেই আছি। ইচ্ছা থাকলেও যোগাযোগ রাখতে পারিনি।

-আমরাও অনেক বছর হল কলকাতাতেই আছি।

প্রাঞ্জলের এর পরের প্রশ্নটা আন্দাজ করে, সেটা আর বলতে না দিয়ে ওর কথার মাঝেই নিজের কথাটা বলে তৃণা। তবু এড়াতে পারল না প্রশ্নটাকে। প্রাঞ্জল জানতে চাইল,

-দাদাকে তো দেখলাম না। দাদা আসেনি? দাদা বুঝি অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত?

কী জানি এখন কী নিয়ে ব্যস্ত থাকে অমিত? চলে আসার পর কিছুদিন মাঝে মধ্যে ফোনে মেয়ের খবর নিয়ে কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছিল অমিত। তৃণা সেটাকে ইচ্ছা করেই বেশি গুরুত্ব দেয়নি। বরঞ্চ ওকে এড়িয়ে যেতে চাওয়ার ইচ্ছাটাই বেশি করে বুঝিয়ে দিয়েছিল অমিতকে। ফোনের যোগাযোগটুকুও বন্ধ হয়েছে বছর খানেকের মধ্যে। কিন্তু এখনই সব কথা প্রাঞ্জলকে বলার কী আদৌ প্রয়োজন আছে! একসঙ্গে না থাকার কথাটা প্রাঞ্জলকে বলাটা কী বাধ্যতামূলক! হলেই বা পূর্বপরিচিত, এতবছর পর হঠাৎ একজনের কাছে নিজের জীবনকে অতখানি উন্মুক্ত করতে ইচ্ছা হয় না।

ধীরেসুস্থে কফির শেষ চুমুকটুকু দিয়ে কিছুটা নিস্পৃহভাবেই তৃণা বলে,

-আমিই এসছি রিঠিকে নিয়ে।

প্রাঞ্জলের কথা জানতে চাওয়াটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে বুঝেও থেমে যায় তৃণা। অকারণ কথা বাড়াতে ইচ্ছা করে না তৃণার।

-আমাকে এবার উঠতে হবে। রিঠি হয়ত খুঁজবে আমাকে।



(চার)

সামান্য একটা শব্দ। তাতেই ঘুমটা ভেঙে যায় তৃণার। ধড়ফড় করে উঠে বসে বিছানায়। রাত বাতির আলোতে নিজের অবস্থানে ধাতস্থ হতে কিছুটা যেন সময় লাগে। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে ঘরটা লক্ষ্য করে। শব্দের কোন উৎস নজরে আসে না। শব্দটা তবে কি স্বপ্নে হয়েছিল! মনে করতে পারে না তৃণা। রিঠি ঘুমচ্ছে পাশে। ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে সেই ছোটবেলার মত।

ছোটবেলায় আঙুল চোষার অভ্যাস তৃণারও ছিল। তারজন্য ছোটবেলায় কী ওকে কম ক্ষ্যাপাত দাদা-দিদিরা! বলত, তৃণাকে মা নাকি খেতে দেয় না পেট ভরে। তাই তৃণা আঙুল চোষে। তৃণাকে মা একটুও ভালোবাসে না। মা ভালোবাসে না কথাটা শুনেই ভীষণ কান্না পেত তৃণার। ছোট ছিল তো তাই ক্ষণিকের জন্য মনে হত, মা বোধহয় দিদিকেই বেশি ভালোবাসে। তাই দিদি ওর থেকে বেশি খেতে পারে। আর সেইজন্যই দিদি আঙুলও চোষে না। ছোটকা তৃণাকে কোলে নিয়ে বলত,

-দূর বোকা, মা রা তো ছোটদেরকেই বেশি ভালোবাসে।

ছোটকাও তো বড় ঠাম্মির ছোট ছেলে ছিল। ছোটকার কথা মনে পড়তেই একরাশ মনখারাপ ঘিরে ধরে তৃণাকে। ওদের সেই পুরনো বাড়ি থেকে ছোটকাকে তাড়িয়ে দেওয়ার দিনটা মনে পড়ে যায় তৃণার। বাবা আর জ্যেঠুরা কী বিচ্ছিরি ভাবে মারছিল ছোটকাকে। ঠোঁটের পাশটা ফেটে রক্ত বেরচ্ছিল। তাও মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও করেনি। ধাক্কা মারতে মারতে সদর দরজার বাইরে বের করে দিয়ে, শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল মেজ্জ্যেঠু। ঘরের জানলা থেকে তৃণা দেখছিল, চলে যেতে যেতে বারবার পিছন ফিরে করুণ চোখে বাড়িটার দিকে তাকাচ্ছিল ছোটকা। ছোটকা সেদিন কোন্  অপরাধের জন্য অত বড় শাস্তিটা পেয়েছিল বুঝতে পারেনি তৃণা। তবে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল ছোটকার জন্য। বড় হয়ে ঘটনাগুলোকে পরপর সাজিয়ে নিজের মনেই বিশ্লেষণ করেছে তৃণা। সমকামিতা আদৌ কি কোন অপরাধ বা নোংরামি! এখন তো সমকামিতা আইনি স্বীকৃতও পেয়ে গেছে। তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়ত সেটা অপরাধই ছিল। আর সেই কারণেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল বৌদিকে। ছোটকাকে তার আপনজনেরাই বিতাড়িত করেছিল বাড়ি থেকে। আর বান্টুটা আজও সবার অবজ্ঞা নিয়ে হয়ত থেকে গেছে ওই বাড়িতেই। বাড়িতে অত মানুষজন, কেউ আন্তরিক ভাবে ওদের অসুবিধা আর অস্বাভাবিকতাটা বুঝতে চেষ্টা করেনি। সবাই শুধু নিজেদের মান-সম্মান নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। ছোটকাকে ও বাড়ির কেউ কি ভালোবাসত না!

ভালো যে বাসত না সেটাই বা বলে কী করে! সেই মা-বাবার সঙ্গে যখন পুরী এসেছিল, একদিন হোটেলের বারান্দা থেকে সমুদ্রের ধারে একজনকে ছোটকার মত দেখতে লেগেছিল তৃণার। একা একা সমুদ্রে গেলে বাবা বকবে জেনেও সেদিন হোটেল থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল তৃণা। বাবা তখন খাবার কিনতে দোকান গিয়েছিল। সমুদ্রতীরে এসে তৃণা দেখেছিল, বাবা সেই লোকটার সঙ্গে কথা বলে মাথা হেঁট করে ফিরে আসছে। অসময়ে তৃণাকে দেখে কী জানি কী আন্দাজ করেছিল বাবা। সেদিন তৃণাকে বকাবকি না করে শুধু বলেছিল,

-আমাদের ছোটনের মত দেখতে, ওটা ছোটন নয়।

দিদি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাবাকে শুধু রাগারাগি আরর চেঁচামেচি করতেই দেখেছে তৃণা। কখনও ভুলেও এতটুকু কষ্ট পেতে বা মনখারাপ করতে দেখেনি। সেইদিন বাবাকে প্রথমবার নিজের কাছে নিজেকে কষ্ট পেতে দেখেছিল তৃণা। ছোটকার সঙ্গে ওইরকম ব্যবহার করার জন্য বাবা সত্যি হয়ত অনুতপ্ত ছিল। জেদের খোলসটা ছেড়ে বেরিয়ে এসে কখনও হয়ত মনের কষ্টটা কাউকে বলতে পারেনি। মনের মধ্যের চাপা কষ্টের বোঝাটা একা একা বইতে বইতেই কি বাবার হৃৎপিণ্ডটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল! আর তাই অসময়ে হঠাৎ করেই থমকে গিয়েছিল সেইদিন!

বুকের মধ্যেটা ভীষণ রকম অস্থির অস্থির লাগছে তৃণার। বিছানা থেকে নেমে আসে। ঘরের মধ্যে কেমন যেন দমবন্ধ লাগছে। দরজা খুলে ব্যালকনিতে বেরতে গিয়েও থেমে যায়। এত রাতে একা একা বাইরে বেরনো না ঠিক নয়। রিঠির গায়ে চাদরটা ভালো করে ঢাকা দিয়ে, জানলাটা খুলে দেয় তৃণা। পূর্ণিমার এক টুকরো আলো এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায় না। এই দিকটা একটা বাজার। অনেক দোকানপাট আছে। দিনের বেলা মানুষের কোলাহলে সরগরম থাকে। এখন অবশ্য শুধুই নীরবতা। এই গভীর রাতের নীরবতার মত নিজেকে আজ যেন ভীষণ রকম শূণ্য লাগছে তৃণার। একা চলতে চলতে এই যেন বিয়াল্লিশেই বড্ড বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ছে তৃণা। তখনই মনে পড়ে মায়ের কথা। তৃণা কত রাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে দেখত, মা জানলার শিকে মাথা ঠেকিয়ে শূণ্য দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাকে তখন ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারত না। তৃণার না হয় ভাগ্যের পরিহাসে জীবনের লড়াইটা একাই লড়তে হচ্ছে। কিন্তু মায়ের তো তেমন ছিল না। মা কি তবে সবার মধ্যে থেকেও একা ছিল! রাতের অন্ধকারে একা একা দাঁড়িয়ে মা কি ভাবত কে জানে! মামাবাড়ির কথা, দিদির কথা, অথবা নিজের জীবনের কথা হবে হয়ত।

দিদি এসেছিল বাবা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে। কিন্তু বাবা জীবিত অবস্থায় বলে গিয়েছিল,

-ওই মেয়েকে কখনও আমার বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। এমনকি আমি মরে গেলেও না। আমার মৃতদেহতেও যেন ওর স্পর্শ না লাগে।

বাবার সেই অভিমানে বলা কথাগুলোকে মনে রেখেই জ্যেঠু-জেম্মারা বাবার কাছে অবধি আসতে দেয়নি দিদিকে। দিদি ফিরে গিয়েছিল। বাবার শেষকাজ তৃণাই করেছিল। মায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে দিদি আর আসেনি। দিদির দুটো ছেলে। দিদিরা এখন কোথায় থাকে তাও জানে না তৃণা। কারও কথা না ভেবে, বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করে দিদি সুখে আছে তো!  এই কথাটুকুও কখন জানার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বহুবছর পর দিদির জন্য মনটা কষ্টে ওঠে। কান্না পাচ্ছে। কান্নাটাকে কিছুতেই আটকাতে পারছে না তৃণা। দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে অঝোরধারায়। দিদির কি কোনদিনও মনখাররাপ করে তৃণার জন্য!



(পাঁচ)

সন্ধে নেমেছে। চাঁদের আলো আর সন্ধের অন্ধকার মিলেমিশে চারপাশটা কেমন যেন রহস্যময়। আর সমুদ্র যেন চপলা কিশোরীর মত প্রতি মুহূর্তে রহস্যের নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছে উচ্ছ্বল হাসিতে। ঝুমঝুম নূপুরের মত শব্দে এসে আছড়ে পড়ছে বালুতটে।

মনটা চঞ্চল তৃণার। নিজের মনটা যেন নিজের বশে নেই আজ। সকালের ঘটনাটা এখনও ছোট ছোট ঢেউ তুলছে বুকের গভীরে। অত বছরের বাঁধনটা হঠাৎ এমন শিথিল করল কী করে, নিজেই বুঝতে পারছে না তৃণা। অসহ্য এক অপরাধ বোধ, একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে তৃণাকে।

-দেখো কি সুন্দর বাড়ি বানিয়েছি।

রিঠি যে পাশে বসে ভিজে বালি নিয়ে খেলা করছে খেয়ালই নেই যেন তৃণার। রিঠি আবার বলল,

-ও মা দেখো না, ভালো হয়নি বাড়িটা?

ভাবনার রেশটা কাটিয়ে কিছু বলার আগেই কে যেন বলল,

-আরে দারুণ সুন্দর হয়েছে তো বাড়িটা। তা কে কে থাকবে এই বাড়িটাতে?

রিঠি সহজ ভাবে উত্তর দিল,

-আমি আর মা।

-অত সুন্দর বাড়িটাতে শুধু তোমরা দুজনে থাকবে?

কেমন যেন মনখারাপের সুর প্রাঞ্জলের গলাতে। রিঠি অল্পসময় কী যেন ভাবল, তারপর বলে,

-তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে দীপুদা?

প্রাঞ্জল একবার আড়চোখে তৃণার দিকে তাকায়। তৃণাও বোধহয় সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখাচোখি হতেই মুখটা ঘুরিয়ে নেয় তৃণা।

প্রাঞ্জলের ডাকনাম যে দীপু, সেটা জানত না তৃণা। প্রাঞ্জল নামটা বোধহয় কঠিন লেগেছিল রিঠির, সহজ নাম জানতে চেয়েছিল প্রাঞ্জলের কাছে। ওখনই দীপু নামটা বলেছিল প্রাঞ্জল। তৃণা আঙ্কেল বলতে বলেছিল, কিন্তু রিঠি দাদা ডাকে প্রাঞ্জলকে। আসলে ওদের স্কুলে টিচারদের দাদা-দিদি ডাকার নিয়মটা থেকে ওই ডাকটাই বোধহয় অভ্যস্ত হয়ে গেছে রিঠি।

নাচের স্কুল থেকে আর যারা সব এসেছে, তার আজ কোনারক গিয়েছিল। রিঠিও বায়না জুড়েছিল যাওয়ার। কালকেই আবার ফেরার টিকিট। পরপর দিনে এতটা জার্নির ধকলে রিঠি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, বিদেশ বিভুঁইতে অসুবিধায় পড়তে হবে। সেই ভয়ে আর কোনারক যাওয়ার সাহস পায়নি তৃণা। যাওয়া হয়নি বলে সে কী রাগ মেয়ের। এখন আবার মনোমত কিছু না হলেই খেতে চায় না রিঠি। অনেক ভুলিয়ে ভালিয়ে সমুদ্রে নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে জলখাবারটুকু খাইয়েছিল মেয়েকে। তারপর টিভিটা খুলে দিয়ে স্নান করতে বাথরুমে ঢুকেছিল তৃণা।

সেই ভাড়াবাড়িতে উঠে আসার পর যখন নিজেদের আলাদা একটা বাথরুম পেল, তখন থেকে স্নান ব্যাপারটায় কেমন একটা বিলাসিতা যেন নিজের থেকেই তৈরি হয়ে যায় তৃণার জীবনে। টিউবয়েলের তোলা জল হলেও তখন আর অল্প জলে স্নান করতে পারত না তৃণা। জীবনে অনেক কিছু ভালোলাগাকে ত্যাগ করলেও এই সময় নিয়ে স্নানের অভ্যাসটা থেকেই গেছে। অফিসের তাড়া না থাকলে স্নানটা সারতে এখনও অনেকটাই সময় লাগে তৃণার। আজকেও লেগেছিল।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে তো অবাক তৃণা। ঘরের দরজা খোলা। টিভিটা চলছে। রিঠি ঘরে নেই। অজানা আতঙ্কে বুকটা কেঁপে ওঠে তৃণার। কোথায় গেল রিঠি? হোটেলে কে কার খেয়াল রাখে! হোটেল থেকে বেরলেই সামনে রাস্তা। আর রাস্তাটা পেরলেই তো সমুদ্র। একা একা সমুদ্রে চলে গেল না তো রিঠি! অজানা বিপদের আশঙ্কায় কুর্তির নীচে কোনরকমে ল্যাগিংসটা পরে নেয়। ওড়নাটা নিতেও মনে থাকে না। ভিজে চুলে জড়ানো রয়েছে শুকনো সাদা তোয়ালেটা। ঘরের দরজাটা বন্ধ করার কথাও বোধহয় ভুলে গিয়েছিল তৃণা। তবে বেশিদূর যেতে হল না। ওই তো রিঠি ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে কটরকটর কথা বলছে। প্রাঞ্জলের সঙ্গে। না বলে এইভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য রিঠিকে বকতে গিয়েও বকতে পারে না তৃণা। সকাল থেকে মনমরা হয়েছিল রিঠি, এখন কী সুন্দর হাসছে।

তৃণাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।

-ও মা, আমরা সমুদ্রে স্নান করতে যাব। ওই দেখো সবাই কেমন স্নান করছে, আমরাও করব।

-না বাবা আমার ভয় করে, যা বড় বড় ঢেউ।

ছদ্ম ভয়ের অভিনয় করে তৃণা।

-কোন ভয় নেই, দীপুদা থাকবে তো আমাদের সঙ্গে। জানো দীপুদার সাঁতার কেটে সমুদ্রের ওপাড়েও চলে যেতে পারে।

অপার বিষ্ময় রিঠির কণ্ঠস্বরে।

কিন্তু তার থেকেও অবাক তৃণা। জানতে চায়,

-দীপুদা কে?

রিঠির আগে প্রাঞ্জলই উত্তর দেয়,

-রিঠিয়ার তো আমার প্রাঞ্জল নামটা একদম পছন্দ হয়নি। ওর নাকি নোংরা লাগছিল নামটা। ও মনে হয় জঞ্জালের সঙ্গে আমার নামটার মিল খুঁজে পাচ্ছিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে আমার ডাকনামটাই বলতে হল।

নিজের কথাতে নিজেই হা হা করে হাসছে প্রাঞ্জল। অভিব্যক্তিহীন ভাবে দাঁড়িয়ে তৃণা। সমুদ্রে যাওয়ার জন্য বায়না করেই চলেছে রিঠি।

-রিঠিয়ার যখন এত ইচ্ছা করছে সমুদ্রে স্নান করতে, চলুন না ম্যাডাম।

প্রাঞ্জলও সমুদ্রে যেতে রাজি হওয়ায় ভীষণ খুশি রিঠি। আনন্দে হাততালি দিচ্ছে।

-দীপুদাও রাজি হয়ে গেছে। কী মজা, কী মজা!

-উনি তোমার আঙ্কেল হন রিঠি। ওনাকে দীপুদা না বলে আঙ্কেল বলবে।

-না দীপুদাকে আমি দীপুদাই বলব।

প্রাঞ্জলের পাশে গিয়ে ডান বাহুতে নিজের মাথাটা গুঁজে দেয় রিঠি। কে বলবে, রিঠি উনিশ পেরিয়েছে! মনের বয়সটা ডাক্তারি হিসাবে এগারো পেরিয়েছে সবে।

-না আমার সমুদ্রকে দূর থেকে দেখতেই ভালো লাগে, জলে নামতে ইচ্ছা করে না।

কথাটা বলতে গিয়ে কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তৃণা। সত্যি তো সে সমুদ্রে স্নান করতে ভয় পায় না। তবে কেন এড়িয়ে চলে সমুদ্রস্নান? তবে কি হানিমুনে গোয়ায় অমিতের সঙ্গে স্নানের সুখস্মৃতিটাতে আর সমুদ্রের নোনা জল লাগতে দিতে চায় না! উত্তরটা নিজেরও জানা নেই তৃণার। এতকিছুর পরেও অমিতের কোন স্মৃতিকে কি এইভাবে আগলে রাখা উচিত? প্রশ্নটা নিজের মনের মধ্যে এসেই যেন নিমেষে আবার বুদবুদ হয়ে মিলিয়ে যায়। অমিতের সবথেকে বড় স্মৃতিটাকেই তো সবচেয়ে যত্নে  আগলে রেখেছে তৃণা। রিঠি দেখতে হয়েছে একদম অমিতের মত।

-ও মা চলো না প্লিজ....

সমুদ্রে যাওয়ার জন্য ছটফট করছে রিঠি।

-অত ভাবতে হবে না, এত করে চাইছে যখন চলুন ম্যাডাম।

-আসলে রিঠিকে নিয়ে জলে নামতে ভয় করে। ও এখনও তো সেই বাচ্চাদের মত দুরন্তই থেকে গেছে। যদি সামলাতে....

তৃণাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রাঞ্জল বলে,

-আমি তো আছি।

মনে মনে হিসাব করে নেয় তৃণা। উনিশ বছর তিন মাস পাঁচ দিন। রিঠির জন্মের পর থেকে এতগুলো দিন কেটে গেছে। একা হাতেই সামলে এসেছে মেয়েটাকে। এই প্রথমবার যেন রিঠির ব্যাপারে এমন আগলে রাখা কথা শুনল কারও মুখে। এরপর আর কিছু বলা যায় না। তৃণা অন্তত বলতে পারে না। ওরা ব্যালকনিতেই দাঁড়ায়, ঘরে গিয়ে রেডি হয়ে আসে তৃণা। রেডি হওয়া বলতে তেমন কিছুই না। তেমন ভাবে সাজগোজ কোনদিনই পছন্দ করে না তৃণা। এখনও তো যেন আরও বেশি সাধারণ থাকে। মুখে একটু ক্রিম অথবা পাউডার, একটা কালো টিপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। সিদুঁর পরা ছেড়েছে বহুবছর হল।

কাল রাতের দিকে মেঘ ছিল আকাশে, ছিটেফোঁটা বৃষ্টিও হয়েছে। কিন্তু সকালে সব মেঘ সরে গিয়ে আকাশ একেবারে ঝকঝকে। শিরশিরে একটা বাতাস বইছে, কিন্তু তাতে শীতের কোন পরশ নেই। বরঞ্চ যেন বসন্তের ছোঁয়া।

সমুদ্রতট জুড়ে শুধুই ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ। এই সময়টাতেই বেশি হয় স্নানের ভিড়। রিধি প্রাঞ্জলের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে যাচ্ছে। তৃণা বেশ কিছুটা পিছনে। না লাফিয়ে শান্ত হয়ে হাঁটতে বললেও বারণ শুনছে না রিঠি। আনন্দে যেন সে আজ বাঁধনহারা। চলতে চলতে পায়ের কাছে একটু বড় সাইজের ঝিনুক দেখলেই পুটপুট করে কুড়িয়ে থ্রি কোয়াটার প্যান্টের পকেটে ভরছে। এলোমেলো বালি ছড়াচ্ছে পায়ে করে।

পায়ে পায়ে অনেকটা পথ হেঁটে আসে ওরা। বেলাভূমির এদিকটা অপেক্ষাকৃত নির্জন। কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে জলের মধ্যে হুল্লোড় করছে। ওদের দেখে রিঠির জলে নামার ইচ্ছাটা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এতটুকু তর সইছে না তার। টিশার্টটা খুলে বালির ওপর রাখে প্রাঞ্জল। বারমুড়া আর স্যাণ্ডো গেঞ্জিতে বেশ সুপুরুষ লাগছে দেখতে। আড়চোখে প্রাঞ্জলকে দেখছিল তৃণা। প্রাঞ্জল এদিকে মুখ ফেরাতেই, চোখাচোখি হয়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে।

-বসে পড়লেন যে, জলে নামবেন না?

জলে নামার এতটুকু ইচ্ছা নেই তৃণার। হোটেল থেকে সদ্য স্নান সেরে এসেছে। কিন্তু রিঠিকে একা প্রাঞ্জলের সঙ্গে সমুদ্রে নামতে দিতে সাহস হচ্ছে না। রিঠি মাঝে মধ্যে এমন চঞ্চল হয়ে ওঠে, সামলানো দায় হয়। তেমন হলে প্রাঞ্জল কি পারবে ওকে সামলাতে! বাধ্য হয়ে উঠতেই হল তৃণাকে। গুটি গুটি পায়ে স্পর্শ করে সমুদ্রকে। রিঠির একটা হাত প্রাঞ্জল ধরে আছে, তবু রিঠির অন্য হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে তৃণা। ছোট ছোট ঢেউ আসছে। ওদের কাছ অবধি আসার আগেই ভেঙে যাচ্ছে ঢেউগুলো। ঢেউ ভাঙা ফেনা প্রবল বেগে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। রিঠি আরও ভিতরে যাওয়ার বায়না করছে। না বললেও বোঝা যাচ্ছে প্রাঞ্জলেরও ইচ্ছা আরও গভীরে যাওয়ার। তৃণার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। মেয়েকে নিয়ে এই প্রথম সমুদ্রে নামা। প্রাঞ্জল সঙ্গে না থাকলে জলে নামার সাহসই করত না তৃণা। একটা বড় ঢেউ যে অত কাছে এসে গেছে খেয়ালই করেনি। রিঠিকে আগলে রেখেছে প্রাঞ্জল। শেষ মুহূর্তে ঢেউয়ের মুখে নিজেকে আর সামলাতে পারল না তৃণা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে জলের মধ্যে। নাকে মুখে নোনা জল ঢুকে বিচ্ছিরি অবস্থা। ওড়নাটা ভেসে যেতে গিয়েও আটকে গেছে তৃণার পায়ের সঙ্গে। প্রাঞ্জলের বাড়ানো হাতটা ধরে কোনরকমে উঠে দাঁড়ায়। ওড়নাটা জল থেকে তুলে বেঁধে নেয় কোমরে। আর জলে থাকার এতটুকু ইচ্ছা নেই ওর। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি রিঠি কিছুতেই উঠবে না জল থেকে। রাগ করে একাই জল থেকে উঠে আসতে যাচ্ছিল তৃণা। ঠিক তখনই আবার একটা বড় ঢেউ। ঢেউটা ওদের কাছে এসে আছড়ে পড়ার মুহূর্তে বেসামাল হওয়ার আগেই তৃণার কোমরটা বাঁহাতে জড়িয়ে নেয় প্রাঞ্জল। পায়ের তলার বালি হঠাৎ সরে যাওয়ার মত কী যেন একটা গড়িয়ে গেল তৃণার বুকের মধ্যে। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রাঞ্জলের মুখের দিকে তাকিয়েছে, ঠিক তখনই ক্যামেরার একটা ফ্ল্যাশ ঝিলিক মেরে ওঠে।

-বহুত আচ্ছা তসবির আয়া হ্যায় ম্যাডামজী। আপলোগ এক দুসরেকো দেখরেহ হো অউর বিটিয়া হাসরেহি হ্যায়। ইয়ে তসবির ড্রইংরুম মে ইয়া ফির বেডরুম মে টাং দিজিয়ে। যবভি দেখেঙ্গি মন খুস হোযায়গা।

সমুদ্র স্নানের ছবি তোলার জন্য অসংখ্য ক্যামেরাম্যান গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঘুরছে। পছন্দমত ছবি তুলে একঘন্টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসে। এদিকটা ফাঁকা ফাঁকা বলে কাউকে খেয়াল করেনি এতক্ষণ। এ যে কখন এসে  হাজির হয়েছে খেয়াল করেনি তৃণা।

লোকটাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তৃণা। কিন্তু কী বলবে? বলবে যে ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়! এটা ওদের পরিবার নয়? ওর পরিবারটা ভেঙে গেছে সেই পনের বছর আগে! কিন্তু এসব কথা লোকটাকে বলে কী হবে! রোজদিন তো এরা এমন কত ফটোই তোলে, তেমনি তুলেছে ফটোটা। লোকটার তো কোন দোষ নেই। থেমে যায় তৃণা। আর না, এবার উঠে আসবে ডাঙায়। উঠে আসার জন্য পা বাড়াতেই বুঝতে পারে প্রাঞ্জলের হাতটা তখনও জড়িয়ে আছে ওর কোমরে। তৃণা ঘুরে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা সরিয়ে নেয় প্রাঞ্জল। জলে ভিজে প্রায় শরীরের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছে কুর্তিটা। ল্যাগিংসটাও চেপে বসেছে পায়ের সঙ্গে। সমুদ্রে স্নানের জন্যই আসছে যখন, ওকেও জলে যে নামতে হবে এটা ভেবে একটা সুতির সালোয়ার কামিজ পরে এলে ভালো করত। মনে মনে নিজের ওপরেই রাগ হয় তৃণার। অগত্যা কোমর থেকে ওড়নার বাঁধনটা খুলে চাদরের মত গায়ে জড়িয়ে নেয়।

রিঠির সঙ্গে ছবি তুলছে প্রাঞ্জল। দু-হাতে জল ছেটাচ্ছে দুজনে। রিঠির সঙ্গে বালির ঘর বানাচ্ছে প্রাঞ্জল। দুজনে টুপি পড়ে পিঠোপিঠি দাঁড়িয়ে। প্রাঞ্জলের হাতে পেট রেখে মিছিমিছি সাঁতার কাটছে রিঠি। মেয়েটার খুশি দেখে একটু আগের তিতকুটে ভাবটা মন থেকে কেটে যাচ্ছে তৃণার। তবে অদৃশ্য কাঁটার মত খিচখিচে অস্বস্তিটা থেকেই যাচ্ছে বুকের মধ্যে।



(ছয়)

আজ বহুদিন পর শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে টিপ পরছে তৃণা। টিপটাকে দুই ভ্রুর মাঝে বসাতে বসাতে আয়নাতেই খেয়াল করে, রিঠি অবাক চোখে দেখছে তাকে।

-কি রে, অমন করে কী দেখছিস? পড়া মুখস্থ হয়েছে তোর?

আয়নার সামনে থেকে খাটের কাছে তৃণা। রিঠি পড়ছে। সারা বিছানাতে বই ছড়ানো। বিছানাতে বসে পড়া রিঠির একটা বদভ্যাস। ছড়ানো ছিটানো বইগুলোকে গোছাতে গোছাতে জানতে চায় তৃণা।

-তোমাকে দেখতে কী সুন্দর লাগছে!

রিঠির গলায় অদ্ভুত এক ভালোলাগার স্বর।

রিঠির মাথার চুলগুলো হাতে করে এলোমেলো করে দিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় তৃণা। বছর দুয়েক আগে স্কুলের সহকর্মী কাবেরীদির জোরাজুরিতে অহনা'স বুটিক থেকে কিনেছিল শাড়িটা। এতদিনে একবারও পরা হয়নি। আজ পরেছে। ফিকে গোলাপী রঙের ব্যাঙ্গালোর সিল্কের ওপর রয়েল ব্লু রঙের গুজরাটি কাজ। খুব হালকা সূক্ষ্ম কাজ। শাড়িটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও যেন চোখের স্বস্তি হয়। গোলাপী ব্লাউজের সঙ্গে পড়লে কি বেশি ভালো লাগত! রয়েল ব্লু ব্লাউজে যে বড্ড উগ্র লাগছে! কি করবে বুঝে ওঠার আগেই কলিং বেলটা বেজে ওঠে।

বাইরের বসার ঘরের সিঙ্গেল খাটটাতে টানটান করে একটা নতুন চাদর পাতা। গিটারটা সযত্নে রাখা আছে বিছানাতেই। বহুবছর পর ওটা আবার আলমারি থেকে বেরিয়েছে আজ। তৃণা গিটারটা শেখা শুরু করবে নতুন করে। প্রাঞ্জলের কাছে।

পুরী থেকে ফিরেও প্রাঞ্জলের সঙ্গে যোগাযোগটা থেকে গিয়েছে। হয়ত কিছুটা রিঠির জন্যই। প্রাঞ্জলকে খুব অল্প সময়েই আপন করে ফেলেছে মেয়েটা। ফোনে তাই মাঝে মধ্যে কথা বলে রিঠির সঙ্গে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটু কলেজ স্ট্রীট গিয়েছিল তৃণা, রিঠির কয়েকটা বই কেনার ছিল। সেখানেই হঠাৎ দেখা প্রাঞ্জলের সঙ্গে। ওর অনুরোধেই একটা রেঁস্তোরাতে বেশ অনেকটা সময় বসেছিল দুজনে। পুরীতে রিঠির নাচের অনুষ্ঠানের দিন কফি খেতে খেতে একবার যা অমিতের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল প্রাঞ্জল, তারপর আর কখনও ওর কথা তোলেনি। সেদিন বরঞ্চ নিজের জীবনের কথাই বলেছিল। ওর কলেজ লাইফের প্রেমিকা, ওকে ছেড়ে গিয়েছে। মারা গেছে মেয়েটা। সেই ছিল ওর গিটারের অনুপ্রেরণা। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর গিটারটাকেই আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছে প্রাঞ্জল। গিটারের সুরেই ওর ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ভালোবাসার স্মৃতিটুকুকে নিয়ে একি চলতে চলতে এবার যেন ক্লান্তি আসছে জীবনে।

-ভালোবেসে প্রতারিত হয়ে একা পথ চলার যন্ত্রণা আরও অনেক কষ্টকর।

প্রাঞ্জলের কথা শুনে একটু অন্যমনস্ক ভাবে, ঠিক যিন বলতে না চেয়েও কথাটা বলে ফেলেছিল তৃণা।

কফিমগটা দুহাতে ধরে মাথা নিচু করে এতক্ষণ কথাগুলো বলছিল প্রাঞ্জল। তৃণার কথা শুনে মাথাটা তুলতেই তৃণার সঙ্গে চোখাচোখি হয়। মাথাটা নামিয়ে নেয় দুজনেই। সেদিন আর তেমন কোন কথাই হয়নি। বিদায়ী সৌজন্য বিনিময়টুকু সেরে যে যার পথ ধরেছিল।

দরজায় কেউ ডাকলে যেই খুলতে আসুক, তার পিছন পিছন দরজা খুলতে আসা রিঠির সেই ছোটবেলার অভ্যাস। অনেক বলেও অভ্যাসটাকে বদলাতে পারেনি তৃণা। আজ যথারীতি বিছানা থেকে নেমে তৃণার পিছু পিছু এসেছে রিঠি। প্রাঞ্জলের আসার কথাটা আগে জানায়নি তৃণা। দরজা খুলতেই প্রাঞ্জলকে দেখে তো দারুণ খুশি। আরও খুশি প্রাঞ্জলের আনা ক্যাডবেরীটা পেয়ে। প্রাঞ্জলকে বাইরের ঘরে বসতে দিয়ে অকারণেই একবার ভিতরের ঘরে যায় তৃণা। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে তৃণার। সেদিনের দেখা হওয়ার পর বেশ কিছুদিন ফোন করেনি প্রাঞ্জল। অপেক্ষার আগল ভেঙে তৃণাই প্রথম ফোন করে প্রাঞ্জলকে। গিটার শিখতে চাওয়ার কথাটা ফোনেই বলেছিল ওকে। প্রাঞ্জল একটু সময় চুপ ছিল। কিছুক্ষণ কী ভেবেছিল কে জানে! তারপর আজ বিকালে আসার কথাটা বলেছিল। ওকে বাড়িতে আনার জন্যই গিটার শেখার প্রস্তাব, সেটা কি বুঝতে পেরেছে প্রাঞ্জল!

আলমারীর লম্বা আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায় তৃণা। অকারণে যেন বেশি সাজা হয়ে গেছে। আলনা থেকে একটা রুমাল টেনে নিয়ে মুছে ফেলে চোখের কাজলটা। কপাল থেকে টিপটা খুলে আটকে রাখে কাচের ওপর। বাতাসী রুটি করছিল রান্নাঘরে। ওকে দুকাপ চা করতে বলে বাইরের ঘরে ফিরে আসে তৃণা। রিঠি সমানে বকর বকর করে চলেছে প্রাঞ্জলের সঙ্গে। এইটুকু সময়ের মধ্যে ওর পুতুলগুলোকেও নিয়ে এসে হাজির করেছে বিছানা। তৃণা হালকা বকুনি দেয় রিঠিকে।

-যাও এগুলো যেখানে ছিল রেখে এসো। আমি এখন গিটার বাজানো শিখব। তুমি একদম বিরক্ত করবে না। ভিতরের ঘরে বসে টিভি দেখো গিয়ে। খিদে পেলে বাতাসীদিদিকে বলবে।

প্রাঞ্জল কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিল, ইশারায় ওকে থামিয়ে দেয় তৃণা।

একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে, পুতুলদুটোকে কোলে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। চোখ দুটো একটু যেন জলে ছলছল করছিল রিঠির। মায়ের বকুনি খেয়ে রাগ হলে তো এমন নীরবে চলে যাওয়ার মেয়ে নয় রিঠি। তবে কি প্রাঞ্জলের সামনে বকেছে বলে অভিমান হল রিঠির! মনে মনে তবে কি বড় হচ্ছে মেয়েটা!

গিটারটা কোলে তুলে নিয়ে টুংটাং বাজাচ্ছে প্রাঞ্জল। বসে আছে তৃণা। একটু আগেই চা রেখে গেছে বাতাসী। কিভাবে শুরু করবে বুঝতে না পেরে তৃণা বলে,

-ঠাণ্ডা হচ্ছে চা টা।

গিটার নামিয়ে একটা কাপ তুলে নেয় প্রাঞ্জল। তৃণার কাপ তখনও ট্রেতে। চায়ে আলতো একটা চুমুক দিয়ে প্রাঞ্জল বলে,

-টিপটা পরে তো বেশ লাগছিল। খুলে ফেললেন কেন?

চমকে ওঠে তৃণা। ওইটুকু সময়ে কপালের টিপটাও খেয়াল করেছিল প্রাঞ্জল!

হেমন্তের পড়ন্ত বেলায় সবাই কি তবে একটা মনের ঠিকানা খোঁজে তৃণার মতই!



(সাত)

হঠাৎ জ্বরে পড়েছিল রিঠি। সঙ্গে ভীষণ কাশি। কটা দিন তৃণার ভীষণ টানাপোড়েন গেল মেয়েকে নিয়ে। মাঝে দুদিন স্কুলেও যেতে পারেনি। ওষুধপত্র খেয়ে এখন কিছুটা তাও সুস্থ। জ্বরটা আর নেই। তবে খুকখুকে কাশির রেশ এখনও রয়েছে কিছুটা। অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্সটা কমপ্লিট হতে হতে সেরে যাবে হয়ত। তবে কদিনের জ্বরেই রিঠি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটু যেন চুপচাপও। নাচের স্কুলেও যেতে পারেনি এই সপ্তাহে।

সারাটা সপ্তাহ যা গেল, একটি বারও গিটারটা নিয়ে বসার অবসর পায়নি। প্রথমদিন যেটুকূ শিখেছিল, সেটুকুও কিছু মনে আছে বলে তো মনে হয় না। 

আজ প্রাঞ্জলের আসার দিন। একবার ভেবেছিল ওকে আসতে বারণ করে দেবে। কিন্তু বারণ করা আর হয় না প্রাঞ্জলকে। 

গিটারটা বের করতে দেখে কিছু যেন জিজ্ঞাসা করতে যায় রিঠি। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না। তৃণা জিজ্ঞাসা করলেও বলে না। একটু অবাক হয় তৃণা। রিঠি কবে থেকে মায়ের কাছেও অনুভূতি গোপন করতে শিখে গেল!

ওর আসার কথা ছিল ছটায়। আজ আর আসবে না ভেবে শাড়ি ছেড়ে রিঠিকে পড়াতে বসেছিল তৃণা। এই কদিন ঠিক মত পড়াশুনোটাও তো হয়নি। 

প্রাঞ্জলের সামনে কাপ্তানটা পরে একটু অস্বস্তি পড়ে যায় তৃণা। ওকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভিতরে আসে। কাপ্তানটা ছেড়ে শাড়ি পরতে গিয়েও থেমে যায়। এখন শাড়ি পরতে যাওয়াটা বোধহয় বেশি দৃষ্টকটু লাগবে। বাতাসী রাতের রান্না সেরে চলে গেছে একটু আগে। নিজেই প্রাঞ্জলের জন্য কফি করে নিয়ে ও ঘরে যায়।

রিঠি যথারীতি পড়া ফেলে উঠে গেছে প্রাঞ্জলের কাছে। কথা বলতে বলতে কাশছে খুকখুক করে। কথা শুরু করার একটা প্রসঙ্গ তো লাগে। রিঠির অসুস্থতার কথা দিয়ে কথা শুরু হয়। গিটার শেখা হয় সামান্যই। তৃণার অনুরোধে একের পর এক গান বাজাতে থাকে প্রাঞ্জল। মুগ্ধ হয়ে শুনছে তৃণা। রিঠিও শুনছে নীরবে। অথচ এই রিঠির জন্যই সেই সময় গিটার ছাড়তে হয়েছিল তৃণাকে। সত্তর-আশির দশকের পাগল করা হিন্দি রোমান্টিক গানের সুর বাজছে গিটারে। তৃণা তখন অনেকটাই ছোট, মাইকে বাজত গানগুলো। কেমন যেন ছিল নিজেদের বাড়িটা আর বাড়ির মানুষগুলোর ধ্যানধারণা। হিন্দি গান শোনাটা ও বাড়িতে ছিল চরম অপরাধ। ছেলেদের ক্ষেত্রে যদি বা নিয়মে এতটুকু শিথীলতা ছিল, মেয়েদের সব কিছুতেই নিয়মের বিধি নিষেধ। তখন মাইক বাজিয়ে আইসক্রিম বিক্রি হত রাস্তায়। আইসক্রিম গাড়িতে বাজা হিন্দি গানের সঙ্গে দিদি একবার গুনগুন করে নাকি গলা মিলিয়েছিল। আর সেটা শুনে ফেলেছিল বড়জ্যেঠু। গরমের দুপুরে একবাড়ি লোকের সামনে দিদিকে সারা দুপুর উঠোনে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। নিজের মেয়ে হলেও বড়দের শাসনের ওপর কথা বলার রেওয়াজ ছিল না তখন। উপরন্তু সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ঘটনাটা শুনে বাবা আবার বেশ কয়েকটা গাট্টা মেরেছিল দিদির মাথায়।

রাতে শুয়ে শুয়ে দিদি সেদিন কান্নার বদলে রাগে গজগজ করতে করতে বলেছিল,

-দেখিস একদিন আমি অনেক বড় গায়িকা হব। আমার হিন্দি গান মাইকে বাজবে। দেখব তখন কে আমাকে শাস্তি দেয়!

দিদি এখনও কী গান করে? গান শিখে অনেক বড় শিল্পী হওয়ার শখ ছিল দিদির। সেই শখ কী পূরণ হয়েছে দিদির! কতদিন দেখেনি দিদিকে। দিদির কী কখনও মনে পড়ে না তৃণাকে! মনখারাপ করে না ছোট বোনটার জন্য! তৃণার বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা কষ্ট গুমরে ওঠে। নিজেকে সংযত করতে পারে না কিছুতেই। হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। 

হিন্দি গানের পর রবীন্দ্রসংগীত বাজাচ্ছিল প্রাঞ্জল। গিটারে তখন বাজাছিল,

কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,

কে মোরে ডাকিবে কাছে,

কাহার প্রেমের বেদনায় আমার মূল্য আছে,

এ নিরন্তর সংশয়ে হায় পারি নে যুঝিতে....

থেমে যায় গিটারের সুর। তৃণার এমন হঠাৎ কান্নার অর্থটা বুঝতে পারে না প্রাঞ্জল। গিটারটা নামিয়ে রেখে সরে আসে তৃণার দিকে। আলতো হাত রাখে তৃণার কাঁধে। একটু যেন কেঁপে ওঠে তৃণা। মুখ তুলে তাকায় প্রাঞ্জলের দিকে। দু চোখে তখনও জলের ধারা, ঠোঁট দুটো কাঁপছে তিরতির করে। প্রাঞ্জল বোধহয় একটু বেশিই বেসামাল হয়ে পড়ে। তৃণাকে আলতো ছোঁয়ায় টেনে নেয় নিজের কাছে। প্রাঞ্জলের বুকে মাথা রেখে অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে তৃণা। হৃদয়ের গভীরে, অনেক গভীরে যেন পাথর ভাঙছে। অসংখ্য নুড়ি পাথরকে সরিয়ে যেন এক ঝর্ণার সৃষ্টি হচ্ছে। নিস্তরঙ্গ খাতে একাকী বইতে থকা জীবনটা আবার যেন প্রাণের ছোঁয়া খুঁজে পাচ্ছে একটু একটু করে।



(আট)

চৈত্রবেলার সূর্য নিভে আসছে ক্রমশ। পশ্চিমের আকাশে মরা হলুদ আলো। পাখিরা বাসায় ফিরছে। আজ ফিরতে দেরি হয়ে গেল তৃণার। 

রাজনৈতিক দলের মিটিং ছিল। বাস তুলে নিয়েছে প্রচুর। অনেকক্ষণ পর যদি বা একটা বাস এল, তাতে এমন ভিড় যে তিল ধারণেরও বুঝি জায়গা নেই। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। বাতাসী বলেছিল, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে। আজ প্রাঞ্জলেরও আসার দিন। দেখতে দেখতে চারমাস হয়ে গেল, গিটার শিখছে তৃণা!

নিজের সুখের জন্য অযথা টাকাপয়সা খরচ করতে চায় না। তবু আজ বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি নিতে হয় তৃণাকে। কিন্তু রাস্তায় এত জ্যাম, ফিরতে সেই সন্ধেই হয়ে গেল। 

বাতাসী সব কাজ গুছিয়ে বেরনোর জন্য তৈরিই ছিল। রান্নাঘরে রাতের খাবার, রিঠির সন্ধেবেলার টিফিন, এমনকি তৃণার জন্য চা টাও করে ফ্লাস্কে ভরে রেখেছে। দরকারি টুকটাক কথাকটা বলেই বেরিয়ে পড়ে বাতাসী। মেয়েটা ছিল বলে অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে চাকরিটুকু করতে যেতে পারে তৃণা। বাতাসী না থাকলে সারাটা দিন কে সামলাত তৃণার সংসার! তৃণা না হয় রিঠিকে সকালবেলা স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসে। কিন্তু তারপর ওকে স্কুল থেকে আনা, খাওয়ানো, ওর হাজার বায়নাক্কা; সব তো বাতাসীই সামলায়! মেয়েটার কাছে ভীষণ কৃতজ্ঞ তৃণা।

এতক্ষণ খেয়ালই করেনি রিঠিকে, হঠাৎ ড্রেসিংটেবিলের সামনে তাকাতেই চমকে ওঠে তৃণা। নিজে নিজে শাড়ি পরে সাজুগুজু করছে আয়নার সামনে।

স্কুল ছুটির পর গত পরশু সিনেমা দেখতে গিয়েছিল তৃণা। প্রাঞ্জলের সঙ্গে। শেষ কবে যে সিনেমা দেখেছিল মনেই পড়ে না। হয়ত সেই পাহাড়ি শহরে, অমিতের সঙ্গে শেষ দেখা। মাল্টিপ্লেক্সে কালকেই প্রথম ঢুকল তৃণা। একটা বাংলা সিনেমা। কদিন থেকে খবরের কাগজে লেখালিখি হচ্ছিল, সিনেমাটা নাকি খুব ভালো হয়েছে। গত সপ্তাহে গিটার শেখাতে এসেছিল যখন অনেক কথার মাঝে সিনেমার কথাটা তৃণাই বলেছিল হয়ত। পরশু সকালে স্কুলে বেরনোর জন্য তৈরি হচ্ছে, তখনই ফোন করে প্রাঞ্জল। সিনেমাটার দুটো টিকিট কেটে রেখেছে। ঠিক সময়ি যেন পৌঁছে যায় তৃণা। ভালো শাড়িগুলো সচরাচর পরাই হয় না তৃণার। ইচ্ছা করেই একটা পিওরসিল্ক পরেছিল। পেস্তা রঙের। তৃণার সাধের সময় অমিতের এক পিসতুতো দিদি দিয়েছিল। অতবছর আগের শাড়ি, এখনও যেন নতুনের মত হয়ে আছে। হালকা সাজটাও স্কুলে সবার চোখে পড়েছিল। একটা অনুষ্ঠান বাড়িতে যাবে বলে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়েছিল তৃণা। কিন্তু বাড়ি ফিরে সেদিন রিঠির চোখকে এড়াতে পারেনি তৃণা। সেজেগুজে যখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, রিঠি তখন স্কুলে ছিল। তাই দেখতে পায়নি মাকে। ফিরে আসার পর কেমন যেন সন্দিগ্ধ চোখে কিছু সময় জরিপ করেছিল তৃণাকে। তারপর কোন প্রশ্ন না করেই বলেছিল,

-আমি জানি তুমি দীপুদার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলে।

তৃণা মুহূর্তকাল একটু যেন ঘাবড়ে গিয়েছিল রিঠির কথায়। তারপর কিছু বোধহয় বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তৃণাকে কিছু বলতে না দিয়ে রিঠি জিজ্ঞাসা করেছিল,

-দীপুদা তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাই না মা?

মেয়েকে কোন উত্তর দিতে পারেনি। সারারাত সেদিন ঘুমতে পারেনি তৃণা। প্রশ্নটা বারবার ঘুরে ফিরে পাক খাচ্ছিল মনের মধ্যে। সত্যিই কী প্রাঞ্জল ভালোবাসে তৃণাকে! না কি তৃণার একাকী জীবনে শুধুই এক বন্ধু প্রাঞ্জল!

ফেরার পথে ঝিমঝিমে বৃষ্টির ছিটেফোঁটা পড়েছিল শাড়িটাতে। বাতাসীকে বলেছিল, রোদে দিয়ে গুছিয়ে রাখতে। বাতাসী গুছিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কাল আর আলসেমি করে শাড়িটা তুলে রাখা হয়নি আলমারিতে। ওই শাড়িটাই টেনে নামিয়ে পরেছে রিঠি। কাঁধ অবধি লম্বা চুলটাকে টেনে টুনে একটা অগোছালো বিনুনিও বেঁধেছে। তৃণার সাজের জিনিসপত্র সব খুলে একমনে সাজতে ব্যস্ত সে এখন।

তৃণাকে দেখেই ছুটে আসে রিঠি। অফিস থেকে ফিরলে মাকে রোজ যেভাবে জড়িয়ে ধরে, ঠিক সেভাবেই জড়িয়ে ধরে রিঠি। আজ যে ওর মনটা দারুণ খুশি, সেটা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। রিঠির কপালে আলতো চুমু খায় তৃণা। তৃণার কপালেও চকাস করে একটা চুমু খেয়েই হিহি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে রিঠি। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়েছিল, সেটা লেগে গেছে তৃণার কপালে। তৃণাও হাসছে। 

-আমাকে দেখতে তোমার মত সুন্দর লাগছে।

হঠাৎ কেন শাড়ি পরেছে জানতেই চায় না তৃণা। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

-আমার থেকে অনেক সুন্দর লাগছে আমার রিঠিকে।

রিঠির এর পরের প্রশ্নটার জন্য বোধহয় প্রস্তুত ছিল না তৃণা। রিঠি বলে,

-দীপুদা এবার তাহলে আমাকে ভালোবাসবে বলো, ঠিক তোমাকে যেমন বাসে!

মুহূর্তে যেন রক্তশূন্য হয়ে ওঠে তৃণার মুখটা। রিঠি এ কী জানতে চাইছে? এমন কথা ওর মনে এল কেন? এখন কী উত্তর দেবে রিঠিকে!

কোন উত্তর দেওয়ার আগেই কলিংবেলটা বেজে ওঠে। তৃণার আগেই ছুটে দরজা খুলতে যায় রিঠি। ও জানে এখন প্রাঞ্জলই আসবে। অন্য কেউও তো হতে পারে! রিঠির পিছন পিছন তৃণাকেও যেতে হয়। প্রাঞ্জল ঘরে ঢুকতেই প্রাঞ্জলকে  জড়িয়ে ধরে রিঠি।

-দেখো আমি মায়ের মত শাড়ি পরেছি। আমাকে কেমন লাগছে?

প্রাঞ্জলের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওর হাতের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলে,

-কী আছে প্যাকেটে?

-চাউমিন। রিঠিয়ার জন্য।

তৃণার হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দেয় প্রাঞ্জল। তরল চোখে একবার প্রাঞ্জলের দিকে তাকায় তৃণা। সেদিন সিনেমা দেখে বেরিয়ে একটা রেস্তোরাতে ঢুকেছিল ওরা। সেই সকালে দুটো নাকে মুখে গুঁজে স্কুলে যায়। খিদেও পেয়েছিল। তাই প্রাঞ্জল যখন চিকেন চাউমিন অর্ডার করেছিল, বারণ করেনি তৃণা। খেতে খেতে মেয়েটার কথা মনে হচ্ছিল ওর। রিঠি চাউমিন ভালোবাসে। কথাটা অবশ্য মুখ ফুটে বলেনি তৃণা। না বলা কথাটা প্রাঞ্জল কী রে বুঝেছিল কে জানে! ভালোবেসে তৃণার কথা আগে তো কেউ কখনও বোঝেনি! বলা কথাগুলোকেই বোঝার চেষ্টাটুকুই করেনি কেউ।

প্যাকেটটা হাতে দাঁড়িয়েই ছিল তৃণা। 

প্রাঞ্জল জানতে চায়,

-কী হল?

-কিছু না।

খাবারের প্যাকেটটা রাখতে রান্নাঘরে চলে আসে তৃণা। জানতে চাইলেও সব কথা মুখ ফুটে বলা যায় না। ইচ্ছা হলেও বলতে নেই সব কথা।



(নয়)

বৈশাখ মাস পড়ার আগেই এবছর দু-তিনটে কালবৈশাখী হয়ে গেছে। আজকের শেষ বিকালের কালবৈশাখীর জেরেই সারা শহর এখনও অন্ধকার। কখন কারেন্ট আসবে কে জানে! যা প্রচণ্ড গরম পড়েছিল ক'দিন, অসহ্য লাগছিল একবারে। বিকালের পর আজ ঝুপ করে অনেকটা কমে গেছে গরমটা। বেশ একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। মোমবাতিটা হাওয়া লেগে সামান্য কাঁপছে দিপদিপ করে। মোমবাতিটাকে একটু আড়ালে সরিয়ে এসে জানলার পাশটাতে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে তৃণা। অনেক কষ্টে একটু ঘুম পাড়াতে পেরেছে রিঠিকে। আবার জ্বর রিঠির। যে ডাক্তারবাবু রিঠিকে দেখেন, তাঁকেও ফোনে পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে একটা প্যারাসিটামল দিয়েছে। একশ তিন থেকে একটু নেমেছে জ্বরটা। এখনও একশ এক।

সব কেমন যেন এলোমেলো লাগছে তৃণার। রিঠিকে এমনটা করতে আগে তো কখনও দেখেনি। যে মাকে আঁকড়ে ধরে ওর জীবনটা, সেই মাকেই কাছে আসতে দিচ্ছে না। হঠাৎ করে জ্বরটাই বা এল কেন? দুপুর থেকেই কেমন যেন গুমোট হয়েছিল আকাশটা। বোঝাই যাচ্ছিল ঝড় আসছে। আজ রবিবার। বাড়িতেই ছিল তৃণা। তাই দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পরই বাড়ি চলে গেছে বাতাসী। 

ক'দিন ধরেই রিঠির মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখছিল তৃণা। সেগুলোই আলোচনা করবে বলে প্রাঞ্জলকে আসতে বলেছিল। বাতাসীর সামনে সব কথা আলোচনা করা যায় না। তাই বাতাসী চলে যাওয়ায় ভালোই হয়েছিল তৃণার।

প্রাঞ্জল এসেছিল সাড়ে তিনটে নাগাদ। রিঠি তখন ঘুমচ্ছিল। দুটো ঘরের মাঝে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরের ঘরে বসে কথা বলছিল দুজনে। 

একটু সংকোচ লাগলেও প্রাঞ্জলের কাছে কোন কথাই গোপন করে না তৃণা। রিঠির সেদিনের শাড়ি পরা, তৃণার মত সাজতে চাওয়া, এমন কী সেই ভালোবাসার কথাটাও বলে প্রাঞ্জলকে। প্রথমটায় সবটুকুই রিঠির অবুঝ মনের পাগলামি বলে উড়িয়ে দিলেও পরে তৃণার উৎকণ্ঠার কারণটা বুঝতে পেরেছিল প্রাঞ্জল। শরীরের বয়স পেরিয়ে এলেও রিঠির মন তো এখন বয়ঃসন্ধিতে। তাই হয়ত এমনটা করছে। তবু রিঠির ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একবার সমস্যাটা আলোচনা করার পরামর্শ দিয়েছিল তৃণাকে। একটু কাজ ছিল বলে বেশিক্ষণ বসার সময় ছিল না প্রাঞ্জলের। তৃণার মনটা যে ভালো নেই বুঝেছিল প্রাঞ্জল। হয়ত সেইজন্যই যাওয়ার আগে তৃণাকে জড়িয়ে ধরে একটুখানি ভরসা দিতে চেয়েছিল প্রাঞ্জল। ওর বুকে মাথা রাখা অবস্থাতেই তৃণা খেয়াল করে, রিঠি ঘুম থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে। কী জানি কী ছিল রিঠির দৃষ্টিতে! তৃণার বুকটা ধক করে উঠেছিল। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল প্রাঞ্জলের বাহুপাশ থেকে। রিঠি ততক্ষণে ফিরে গেছে ঘরে। প্রাঞ্জল দরজার দিকে পিছন ফিরে ছিল বলে দেখতে পায়নি রিঠিকে। তৃণাও আর কিছু বলেনি। প্রাঞ্জল চলে গেলে দরজা বন্ধ করে ঘরে আসা তৃণা।

রিঠির অতখানি উগ্র হতে কখনও দেখেনি তৃণা। ঘরের সব জিনিস ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে আলনার গোছানো জামাকাপড়। খামচে ধরে তুলে ফেলছে বিছানার চাদর। এমনটা কেন করছে বুঝতেই পারে না তৃণা। কিছুতেই  নিজের কাছে আসতে দিচ্ছে না তৃণাকে। কাঁদছে আর মুখে শুধু একটাই কথা,

-তুমি আসবে না আমার কাছে। ছোঁবে না আমাকে। কেউ তোমরা একটুও ভালোবাসো না আমাকে।

বাইরে শুরু হয়েছে কালবৈশাখীর তাণ্ডব। জানলা দিয়ে ধূলো ঢুকছে। পাল্লাগুলো সশব্দে যেন বিদ্রোহ করছে। কোন্ দিক সামলাবে বুঝতে পারছে না তৃণা।

কাঁদতে কাঁদতে হাঁফিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত দেখতে হচ্ছে তৃণাকে। এতখানি উত্তেজনা ওর জন্য ক্ষতিকর। একটু পরেই বিছানায় নেতিয়ে পড়ে রিঠি। কাঁদার শক্তিটুকুও তখন আর অবশিষ্ট নেই ওর শরীরে।

রিঠির শরীরটা স্পর্শ করে চমকে ওঠে তৃণা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। 

চোখ বন্ধ করে ঘটনাগুলো ভাবছিল তৃণা। হাওয়া এসে ঘরের মোমবাতিটা কখন নিভিয়ে দিয়েছে, বুঝতেও পারেনি। রিঠির গোঙানি চোখ মেলে দেখে চারদিক অন্ধকার। কোনরকমে হাতড়ে হাতড়ে গিয়ে  মোমবাতিটা জ্বালায়। আবার জ্বরটা বেড়েছে। ভয় করছে তৃণার। জলপটি দেওয়ার জন্য রিঠির পাশে বসতেই হাতের ঝটকায় বাটিটা ফেলে দেয়। নিঃশব্দতাকে ভেঙে ঝনঝন করে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে স্টিলের বাটিটা। ঘরের মেঝে মুহূর্তে জল থৈ থৈ। হাতের ঠেলায় বিছানা থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে তৃণাকে। 

-তুমি আসবে না আমার কাছে। দীপুদা ছাড়া কেউ ছোঁবে না আমাকে।

অতখানি জ্বরের মধ্যে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কোনরকমে টেনে টেনে চাপাস্বরে কথাগুলো বলছে রিঠি। 

কেমন যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে রিঠির। তৃণা কাছে থাকলে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। বাধ্য হয়ে উঠে আসে তৃণা। আবারও চেষ্টা করে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ফোনে অন্তত একটু কথা বলার। কিছুতেই লাইন পাচ্ছে না। ভয় করছে তৃণার। এইভাবে জ্বর বাড়তে থাকলে তো বাড়িতে ফেলে রাখা যাবে না রিঠিকে। এই রাতে একা কী ব্যবস্থা করবে! বাধ্য হয়ে প্রাঞ্জলকেই ফোন করে তৃণা।

যদিও তখন অনেকটা রাত, বাইরে দুর্যোগ। তবু ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রাঞ্জল এসে পৌঁছায়। জ্বরটা তখন একটু কমলেও, তৃণাকে দেখে রিঠি তখন চরম উত্তেজিত। কাঁদতে কাঁদতে দমবন্ধ হয়ে আসবে মনে হচ্ছে, তবু কেঁদে চলেছে রিঠি। এতক্ষণ তবু নিজেকে কোনরকমে সংযত করে রেখেছিল তৃণা। মেয়েটাকে এতটা কষ্ট পেতে দেখতে আর যেন সহ্য করতে পারছে না সে। প্রাঞ্জল আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে তৃণাও। তৃণাকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে রিঠির কাছে যায় প্রাঞ্জল।

প্রাঞ্জল বিছানায় বসতেই রিঠি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাঞ্জলের বুকে। প্রাণপণ শক্তিতে দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ওকে।

-তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না দীপুদা। আমাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসবে না তুমি।

তৃণা আর প্রাঞ্জলের দৃষ্টি বিনিময় হলেও, মোমের আবছা আলোয় কেউ কারও চোখের ভাষা পড়তে পারে না।

সময় আজ যেন বড় দীর্ঘ। প্রাঞ্জলের বুকে মাথা দিয়ে রিঠি বেশ কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু জ্বর কতটা আছে দেখার জন্য তৃণা রিঠির কপালে হাত রাখতেই আবার কেমন যেন হয়ে ওঠে। দুহাতে আরও বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চায় প্রাঞ্জলকে। তৃণাকে কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারছে না। দূরে সরে আসে তৃণা।

এমনটাই যেন আশঙ্কা করছিল তৃণা!

রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। প্রাঞ্জলের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমচ্ছে রিঠি। কাছে গেলেও কপালে হাত দিতে সাহস পায়না তৃণা। যদি ওর হাতের ছোঁয়াতে জেগে যায় মেয়েটা। বড় কষ্ট পেয়েছে, একটু ঘুম এখন ভীষণ দরকার রিঠির। আরও অনেক কিছুই দরকার মেয়েটার। রিঠি মনে মনেও কখন যে এতটা বড় হয়ে গেছে, মা হয়েও বুঝতে পারেনি তৃণা।

প্রাঞ্জলের একটা হাত রিঠির পিঠে। অন্য হাতটা নিজের হাতের মুঠোতে চেপে ধরে তৃণা।

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

-আমার মেয়েটার দায়িত্ব নেবে প্রাঞ্জল? মা ছাড়াও আজ ওর কাছের একজন মানুষকে দরকার। রিঠি ভীষণ ভালোবাসে তোমাকে।

কী বলবে বুঝতে পারে না প্রাঞ্জল। রিঠির পিঠ থেকে হাতটা তুলতেই নড়েচড়ে ওঠে রিঠি। হাতটা তুলতে পারে না প্রাঞ্জল। দ্রুত পায়ে সরে আসে তৃণা। ওকে দেখলে আবার হয়ত উত্তেজিত হয়ে পড়বে রিঠি। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দেয়। বাইরের ঘরের পূব দিকের জানলাটা খুলে দেয়। 

অনেকদিন পর গিটারটা তুলে নেয়। আনমনে সুর তোলে গিটারের তারে।

"সব যে হয়ে গেল কালো,   

নিভে গেল দীপের আলো,

আকাশ পানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে!

যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে...."


দুর্যোগের মেঘ কেটে গেছে বাইরে। ভোর হয়ে আসছে। পূব আকাশে হালকা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। তবু যেন নিজের চারপাশটা নিকষ কালো অন্ধকার মনে হচ্ছে তৃণার.....