শা র দ সং খ্যা
শেনু
বু মা ব্যা না র্জী দা স
(কানাডা)
ইজিপ্ট
খৃষ্টপূর্ব ১৩২৫
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘিরে এসেছে। প্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে মশাল জ্বলে উঠছে ধীরে ধীরে। তরুণ সম্রাট ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নিজের কক্ষের দিকে। তাঁর একটি পা জন্ম থেকে বিকৃত। সে পায়ের পাতা তিনি ফেলতে পারেননা। হাঁটার সময় পা টেনে হাঁটতে হয়। তবে তার জন্য তাঁর মনে কোনও খেদ নেই। এমন কোন কাজ নেই, যা তাঁর আয়ত্বের বাইরে। রথ চালানো থেকে শিকার, সবেতেই তিনি পারদর্শী। কিন্তু ইদানীং শরীরটা সম্পূর্ণ সুস্থ নেই। কী যে এক জ্বর আসছে কিছুদিন ধরে। রথ থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে পায়ে চোটও পেয়েছেন খুব। সামরিক অধিকর্তা আই যদিও ভরসা দিয়ে বলেছেন চিন্তার কিছু নেই, রাজবৈদ্য দেখেও গেছেন। তবু খুব সুস্থ লাগছেনা তাঁর। অনেকখানি রোগাও হয়ে গেছেন। আংটিগুলো যেন ঢিলে লাগছে আঙ্গুলে। বাম হাত ঈষৎ তুলে নিজের তর্জনীর দিকে তাকান সম্রাট। অতি প্রিয় রাজকীয় শেনু। সুবর্ণনির্মিত আংটিটি প্রধানত ডিম্বাকৃতি। কিন্তু ডিমটি দাঁড় করানো আছে একটি সমান সোজা পাতের উপর।
ফলে আংটিটি দাঁড় করিয়ে রাখা যায়, গড়িয়ে যায়না। প্রত্যেক সম্রাট সিংহাসন আরোহণের পর তাঁর নিজস্ব শেনু নিজের পছন্দমত বানিয়ে নেন। ক্লান্ত সম্রাটের মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটে ওঠে। আঙ্খেসেনামুন- মনে মনে নামটি উচ্চারণ করলেই যেন মন প্রফুল্ল হয়ে আসে সম্রাটের। কিশোর সম্রাটের কিশোরী সম্রাজ্ঞী। নীলনদে ফুটে থাকা পদ্মের মতই যেন তিনি। তবে তাঁর বুদ্ধির ঔজ্বল্য রূপকেও হার মানায়। তাঁর সহমর্মিতা, তাঁর সাহচর্য এই মুহূর্তে বড়ো প্রয়োজন অসুস্থ সম্রাটের।
কক্ষের দরজার সামনে ঘন নীল পর্দা ঝোলানো, নীচু গলায় ডাকতে যাবেন, হেনার সুগন্ধ নাকে এলো তাঁর। সম্রাজ্ঞী তাঁর উপস্থিতি বুঝতে পেরে নিজেই বেরিয়ে এলেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন সম্রাটের দিকে। দামী রত্ন গুঁড়ো করে ঘন নীল রং তৈরী করা হয়। সেই উজ্জ্বল রঙে রঞ্জিত তাঁর ভ্রূ, চোখের পাতা। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ চুল থেকে নীলচে আভা বেরোচ্ছে যেন। তাঁর পরনে সাদা সুতির পোশাক। স্বর্ণ ও লাপিজ লাজুলি খচিত দীর্ঘ হার তাঁর গলায়। হাত ধরে সম্রাটকে কক্ষে নিয়ে গেলেন সম্রাজ্ঞী। তাঁর দীঘল বুদ্ধিদীপ্ত চোখে চিন্তার ছায়া। সম্রাট বেশ অসুস্থ তিনি বুঝতে পারছেন। কিন্তু তাঁর চিকিৎসা যথাযথ হচ্ছে কিনা সেটা তিনি বুঝতে পারছেননা। সেনানায়ক আই সম্রাটের প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু কেন তিনি নিজেও বুঝতে পারেননা, আইকে ঠিক বিশ্বাসযোগ্য লাগেনা তাঁর। কিন্তু বর্তমান সম্রাটের পিতা আখেনাতেনের সময় থেকে আই প্রাসাদের সবার বিশ্বাসভাজন। হঠাৎ মনের ভিতরটা কেঁপে ওঠে সম্রাজ্ঞী আঙ্খেসেনামুনের। দেবরোষে পড়তে হয়নি তো? সূর্যদেবতা আতেন ছিলেন প্রধান উপাস্য। সেই উপাসনা ছেড়ে তাঁর সম্রাট আদি দেবতা আমুনের পূজা শুরু করেছেন আবার। নিজের নামও তুতানখাতেন থেকে তুতানখামুনে বদলে নিয়েছেন তিনি। দু দুটো কন্যা জন্মের পরই মারা গেল। মনটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তাঁর।
সম্রাটকে কক্ষের ভিতরে এনে তাঁর প্রিয় শয্যায় ধীরে ধীরে বসিয়ে দিলেন তিনি। এটি রাজকীয় শয্যা নয়, সদ্য বানানো একটু নীচু খুবই সাধারণ দেখতে একটি খাট, কিন্তু সম্রাটের খুব প্রিয়। আরামে চোখ বুজে আসে তাঁর। পানীয় আনতে কক্ষের অন্য দিকে যান সম্রাজ্ঞী। ঘুমিয়ে পড়েন সম্রাট তুতানখামুন। তাঁর হাত এলিয়ে পড়ে শয্যার বাইরে। আলগা হয়ে আসা শেনু খসে পড়ে যায় আঙুল থেকে। শেনুর ডিম্বাকৃতি অংশের ভিতর বসানো চৌকো স্লেটের একদিকে সম্রাট আর অন্যদিকে সম্রাজ্ঞীর ছবি খোদাই করা। মাঝখানে অমূল্য কিন্তু অনুজ্জ্বল একটি পাথর। কেউ খেয়াল করেননা ব্যাপারটা। সম্রাট স্বপ্নের মাঝে তলিয়ে যান, দেখেন তাঁর নিজের জন্য যে সমাধিমন্দির তৈরী করা শুরু করেছিলেন, তা আর শেষ করা হলনা। সিংহাসনে আরোহণের পর থেকেই ফারাওরা নিজেদের পিরামিড বানানোর কাজ শুরু করে দেন। তিনিও তাই করেছিলেন। সত্যি সে কাজ শেষ হয়ওনি। ঘুম আর ভাঙেনি ফারাও তুতানখামুনের।
তখনও ভোর হয়নি। আবছা অন্ধকারে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে সেনাপতি আই। এতো কাছে এসেও কী তার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে? ওই একফোঁটা ফারাও, ভারী তো রাজত্বকাল - মাত্র দশ বছর। নিজের সমাধিটা পর্যন্ত শেষ করে যেতে পারলোনা। অবশ্য লোক লাগালে, দাসের তো অভাব নেই - হাজার হাজার দাসদের দিয়ে কয়েক দিনেই বাকী কাজ শেষ করা যাবে। ফারাওয়ের দেহ সমাধিস্থ করার জন্য তৈরী হতেও তো কম সময় লাগবে না। কিন্তু না, আইএর সেরকম কোন ইচ্ছাই নেই। ওখানে যদি কেউ সমাধিস্থ হয়, তবে সে নিজে। হ্যাঁ সে নিজে হবে পরবর্তী ফারাও। ওই ছোকরা রাজাটিকে অন্য কোন সমাধিতে পাচার করবে সে। রাজবংশের অনেকেরই সমাধিক্ষেত্র তৈরী হয়ে পড়ে আছে। সেরকম কোন একটিতে থাক শুয়ে চিরনিদ্রায়। বললেই হবে যে অসম্পূর্ণ ক্ষেত্রে তো ফারাওকে সমাধিস্থ করা যায়না। তবে ধুমধাম যথোচিত করতে হবে, নাহলে কথা উঠবে। ধীরে ধীরে ওই তুতানখামুনকে ইজিপ্টের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলবে আই। কিন্তু ফারাও হতে গেলে সামনে একটাই উপায়। সেটা কী সম্ভব হবে? তার গায়ে রাজবংশের রক্ত নেই, ফারাও হতে গেলে তাকে বর্তমান রানী মানে আঙ্খেসেনামুনকে বিবাহ করতে হবে। আই নিশ্চিত, এই কাজটা করা খুব কঠিন হবে।
- মহামান্য ফারাও- ভীষন চমকে ওঠে আই - কে? - বেশ কর্কশ ভাবে বেরিয়ে আসে কথাটা। একটি দাস এসে দাঁড়িয়েছে, মাথা নীচু। হাতের পানীয় সসম্মানে বাড়িয়ে ধরে আইয়ের দিকে।
- কী চাই, কে তুই?
- দাসের স্পর্ধা ক্ষমা করবেন ফারাও। আপনি ছাড়া কে আর ফারাও হতে পারে এবার।
ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আই। কী মতলব এই দাসের? প্রাসাদের কাউকে বিশ্বাস নেই।
এবার হাঁটু পেতে বসে পড়ে দাসটি। -আপনার দাসানুদাস একটি মহামূল্য বস্তু কুড়িয়ে পেয়েছে। আপনাকে দিয়ে ধন্য হতে চায়।
আই বোঝে দাসটি ধুরন্ধর। কিন্তু কী কুড়িয়ে পেল সে? কিছু জিজ্ঞেস না করে অপেক্ষা করতে থাকে সেনাপতি আই।
- মৃত ফারাওএর আঙুল থেকে তাঁর শেনু আলগা হয়ে খসে পড়েছিল। দাস সেটি কুড়িয়ে নিয়ে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে মহানুভব।
মুহূর্তে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় আইয়ের। তুতানখামুনের শেনু! তাতে আছে অমূল্য একটি পাথর, আর আর-
মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলে আই বলে- বদলে কী চাই তোর?
- মুক্তি প্রভু।
- আর তৃতীয় ব্যক্তি জানলে?
- আপনার শক্তি সম্বন্ধে আমার ধারণা আছে প্রভু।
একটি স্বর্ণপাত্র বাড়িয়ে ধরে আই। দাসটির পরিধানের সামান্য কাপড় কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই দড়ির ভিতর থেকে বের করে আনে মৃত ফারাওএর শেনু। রেখে দেয় পাত্রে।
- যা এখন। তোর মুক্তির ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
- বেরিয়ে যায় দাস। চোখের ইশারা করে আই। আড়াল থেকে রক্ষী বেরিয়ে আসে। আইয়ের ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয়না তার। দাসটির চিরমুক্তির ব্যবস্থা করা হয়ে যায়।
এই শেনু লুকিয়ে ফেলতে হবে আপাতত। খুব নিরাপদ একটি জায়গার কথা মনে পড়েছে তার। এখন কিছুদিন এটা লুকানোই থাক।
মৃত ফারাওকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অনেকক্ষণ। আমুনের মন্দিরের পুরোহিতরা তাঁর দেহ পরিষ্কার করে মমি তৈরীর প্রস্তুতি নেবে। সম্রাজ্ঞী আঙ্খেসেনামুন দুটি হাত কোলের উপর জড়ো করে বসে আছেন বহুক্ষণ। বড়ো আতঙ্ক তাঁর মনে। যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই ঘটতে চলেছে। সেনাপতি আইকেই পরবর্তী ফারাও বলে প্রায় সকলেই মেনে নিতে প্রস্তুত। এখনও পর্যন্ত সরাসরি আই তাঁর কাছে বিবাহের প্রস্তাব না আনলেও যে কোনও মুহূর্তে যে সেটা ঘটবে তাতে আঙ্খেসেনামুনের কোনও সন্দেহ নেই। কী করবেন তিনি? মাকে মনে পড়ে তাঁর। নেফারতিতি- ইজিপ্টের অন্যতম ক্ষমতাশালী মানুষ। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের হাতেই হাল ধরেছিলেন, সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। কিন্তু সিংহাসন, ক্ষমতা, রাজত্ব, ষড়যন্ত্র কোনদিন আঙ্খেসেনামুনকে টানেনি। তাঁর ফারাও আর নেই। এরা তাঁকেও ছেড়ে দিকনা, তিনি চলে যাবেন কোথাও। এই রাজপ্রাসাদ তাঁকে যেন খাঁচার মত ঘিরে ধরছে।
সেনাপতি হোরেমহেব বিরক্ত মুখে বসেছিল। তার ক্ষমতা আইয়ের থেকে খুব কম কিছু নয়। বয়সও তার আইয়ের থেকে অনেক কম। সম্পর্কে আই তার শ্বশুরমশাই। আই ফারাও হলে তার নানারকম সুবিধা হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু ফারাও হওয়ার ইচ্ছা তার নিজেরও যথেষ্ট। সেটা আইকে
টের পেতে অবশ্য সে দেয়নি। আই তাকে ডেকে পাঠিয়েছে কেন সেটা জানা দরকার। বিরক্ত মুখেই উঠে দাঁড়ায় হোরেমহেব।
- মহামান্য ফারাও- তুতানখামুনের মৃত্যুর পর কেটে গেছে চল্লিশ দিন। মৃত সম্রাটের দেহকে মমিতে পরিণত করার কাজ চলছে পুরোদমে। ইতিমধ্যে আই মাথায় ফারাওদের পরিধেয় নীল মুকুট খেপ্রিশ পরে নিয়েছে। সে যে পরবর্তী ফারাও তাতে কোনও সন্দেহ কারুরই নেই। পছন্দ হোক না হোক, তাকে মেনে নিতে বাধ্য হোরেমহেব।
- ফারাওয়ের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা প্রমাণ করতে পারছনা কিন্তু হোরেমহেব। হিটাইট সুপ্পিলুলিউমার কাছে প্রাসাদ থেকে চিঠি পৌঁছয় কী করে?
হোরেমহেব বিশেষ কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে।ফারাওকে প্রশ্ন করলে মর্যাদা লঙ্ঘন করা হয়।
- আঙ্খেসেনামুন হিটাইটদের কাছে খবর পাঠিয়েছে। তাদের কোনো রাজপুত্রকে সে বিবাহ করতে ইচ্ছুক। আমাকে নয়। আইয়ের ওষ্ঠ দৃঢ়বদ্ধ হয়ে ওঠে।
- আমার কাজ ফারাওয়ের ইচ্ছা পালন করা।
- সে হিটাইট যেন ইজিপ্টে পৌঁছাতে না পারে। সেটা দেখা তোমার কাজ।তুতানখামুনের সমাধিকার্য্য শেষ হতে আরও তিরিশ দিন। তারপর আমি আঙ্খেসেনামুনকে বিবাহ করে সর্বসমক্ষে সিংহাসনে বসব।
- ফারাওয়ের ইচ্ছাই আদেশ।
- আর হ্যাঁ, তোমার এই আনুগত্য প্রসংশনীয়। তুমি আমার জামাতাও। তোমাকে একটি অমূল্য সম্পদ আমি দিতে চাই। আর তা থাকবে তুতানখামুনের সমাধির মধ্যে। শেষ দিন প্রধান পুরোহিতের কাজ আমি করব, রীতি অনুযায়ী উত্তরাধিকারী ফারাওয়েরই সেটা করার কথা। সেই সম্পদ কোথায় রাখছি সেটা লিখে রেখে সবার অলক্ষ্যে মমির বাইরের স্বর্ণ আবরণের তলায় রেখে আসবো। কিছুদিন বাদে তুমি সেটি সংগ্রহ করে এনো।
- এক হাঁটু পেতে সম্মান জানিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় হোরেমহেব। তার মনেও লোভ, প্রচণ্ড লোভ।
তার বেরিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আই। হোরেমহেবের মনের তীব্র ইচ্ছা তার চোখে ফুটে উঠেছে। সে ফারাও হতে চায়। এই অমূল্য সম্পদ অর্থাৎ তুতানখামুনের সেই শেনু এখনই তার হাতে তুলে দেওয়া যেত। কিন্তু তাতে হয়তো ফারাও হওয়ার আগে তাকেই হত্যা করতে পারে হোরেমহেব। এভাবে লোভ দেখিয়ে রাখলে তুতানখামুনের সমাধি অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরে থাকতে বাধ্য হবে হোরেমহেব। আর একবার সর্বসমক্ষে ফারাও বলে স্বীকৃতি পেলে তাকে সরানো বা হত্যা করা একপ্রকার অসম্ভব। আর তিরিশটা মাত্র দিন। তারপর ইজিপ্ট তার। আঙ্খেসেনামুন তার। তুতানখামুনের মমি একটি অত্যন্ত সাধারণ স্থানে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে আঙ্খেসেনামুনের কোনও চিহ্ন আই রাখবেনা। কিছু ছবি অবশ্য এর মধ্যে আঁকা হয়ে গেছে, সে ব্যাপারে এখনই কিছু করার নেই। পরে সেগুলো নষ্ট করে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ওই বালককে ফারাও না করে প্রথমেই তাকে ফারাও করা উচিত ছিল সেটা ইজিপ্ট নিশ্চয়ই একদিন স্বীকার করবে। বালক রাজার সমস্ত স্মৃতি মুছে যাবে একদিন। একা ঘরে হাসতে থাকে বৃদ্ধ আই।
৫ ই নভেম্বর, ১৯২২
- মিস্টার কার্টার, আপনি কী এখনো কিছু পাওয়ার আশা রাখেন এখানে?
- লর্ড কার্নার্ভন আমি আপনার হতাশাটা বুঝতে পারছি, কিন্তু এই মাসটা অন্তত। এই শেষ, কথা দিচ্ছি।
- ঠিক আছে, কিন্তু কোনরকম সূত্র কি পেয়েছেন আপনি? এভাবে বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে বেড়ানো-
- তাঁর নাম লেখা সুবর্ণ পাত পেয়েছি সেটা তো আপনি জানেন লর্ড কর্নার্ভন। তিনি এখানেই কোথাও আছেন।
লর্ড কর্নার্ভনের মুখে চাপা় উদ্বেগ ফুটে ওঠে। হাওয়ার্ড কার্টারকে তিনি অনেকদিন ধরে চেনেন। মানুষটি বড়ো ভালো, কিন্তু একটু ছিটগ্রস্থ। এই এক সমাধি খুঁজে বেড়াচ্ছেন আজ কতকাল ধরে। ভ্যালি অফ কিংস চষে ফেলেছেন প্রায়।না খুঁজে পেলে মনে হয় মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বেন তিনি। পেছনে হঠাৎ একটা গোলমাল মতো কানে আসে। ওয়াল্টারের গলা না? যে ছোকরা তাঁদের জল চা এসব দিতে আসে। এই ভর দুপুরে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে দেখো। দৌড়ালেন দুজনে সেদিকে।
ওকি। হোঁচট খেয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে ব্যাটা। চা ছড়িয়ে পড়েছে, কিছু পাঁউরুটিও। কিন্তু সবাই তাকে ছেড়ে কিসে হোঁচট খেয়ে পড়লো তাই দেখতে হামলে পড়েছে কেন। কার্টার তাঁর আগেই পৌঁছে গেলেন সেখানে। হাঁটু গেড়ে বসে পাগলের মত বালি সরাচ্ছেন না? লর্ড কার্নার্ভন পৌঁছাতে পৌঁছাতে খাবলা খাবলা বালি সরিয়ে একটা সিঁড়ির ধাপ বের করে ফেলেছেন কার্টার। তাঁর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বললেন - লর্ড, পৌঁছে গেছি আমরা তাঁর কাছে, আমার মন বলছে।
শেষ বিকেল। ১৬ টা সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে নীচে। একটা বন্ধ দরজা, পলেস্তারা ধরানো। কার্টারের মনের মধ্যে কেমন কাঁপুনি ধরে যায়। সত্যি কী তিনি আছেন ওই দরজার ওপারে। এতদিনের খোঁজ কী শেষ হলো তবে? মশালের আলোয় খুঁজতে থাকেন দরজার উপরে কোনও চিহ্ন আছে কিনা। হ্যাঁ, রাজকীয় চিহ্ন আছে ঠিকই, কিন্তু আর কিছু নেই। এমন তো হওয়া উচিত নয়। একে তো এই জায়গা কোন ফারাওয়ের সমাধির উপযুক্ত নয়, তার উপর কার সমাধি সেটার চিহ্নও নেই। কেউ যেন লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছে কিছু। কিন্তু কার্টারের মন বলছে এতদিনের খোঁজ শেষ হলো তাঁর।
২৩শে নভেম্বর, ১৯২২
সম্পূর্ণ ভাবে পরিষ্কার করা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাওয়ার্ড কার্টার। তবে দরজাটি অক্ষত অবস্থায় নেই। কেউ হয়ত কখনো এই দরজা ভেঙে ঢুকেছিল। ভিতরের মানুষটির শান্তির ঘুম বিঘ্নিত হয়েছিল।দরজার নীচের দিকে তাঁর আকাঙ্খিত নাম লেখা সীল বা নামমুদ্রা। হ্যাঁ এবার পৃথিবীকে তিনি জানাবেন - ফারাও তুতানখামুনের সমাধি তিনি অবশেষে খুঁজে পেয়েছেন।
খৃষ্টপূর্ব ১৩১৯
- মহামান্য ফারাও, ক্ষমা করবেন। এর কোনও অর্থ উদ্ধার করতে আমরা অক্ষম। হয়ত ভূতপূর্ব ফারাও আই ছাড়া কারুর পক্ষে এর মর্মার্থ উদ্ধার করা সম্ভবপর নয়।
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যায় ফারাও হোরেমহেবের। একটা সামান্য সূত্রের সমাধান করতে পারছে না এরা। আই গত হয়েছে বেশ কিছু বছর হলো। বর্তমান ফারাও সে নিজে। ফারাও হোরেমহেব। নিজের মনে কথাটা বলতেও আনন্দ লাগে। কিন্তু আই যে অমূল্য সম্পদ তার জন্য তুতানখামুনের সমাধিতে রেখে গেছিল তার কোন হদিশ এখনো পাওয়া গেলনা। একটি প্যাপিরাসের টুকরোতে কথামত সূত্র রেখেও গেছিল আই। ন্যায্য সময় পর্যন্ত অপেক্ষার পর অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক দিয়ে গোপনে সমাধির দরজা ভাঙিয়ে ভিতর থেকে সেই প্যাপিরাস সংগ্রহ করেছে হোরেমহেব। সেও আজ কতদিন হয়ে গেল। আই যে এত তাড়াতাড়ি মরবে সেটা জানলে এতদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করত না সে। তার গর্ধব পণ্ডিতগুলো একটা সামান্য সূত্রের সমাধান করতে জানেনা। হাতের পানীয় মেঝেতে আছড়ে ফেলে হোরেমহেব। বিরক্তিতে প্যাপিরাসের টুকরোটা ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও পারেনা।
- এটা যেখান থেকে এনেছিলে সেখানেই রেখে এসো। অভিশপ্ত মনে হয়।
বেরিয়ে যায় হোরেমহেবের পণ্ডিতের দল। অবিশ্যি এ কথা পাঁচকান করার জন্য তাদের কেউই বেঁচে থাকবে না।
অসহ্য রাগে জ্বলতে থাকে ফারাও হোরেমহেব। তুতানখামুন আর আইয়ের যত স্মৃতিসৌধ আছে এখনো ইজিপ্টে সব ধ্বংস করে ফেলবে সে।
১৯৭২, দ্য স্টেটসম্যান
ফারাও তুতানখামুনের অতুল ধনসম্পদ সারা পৃথিবীর মানুষের মনে অসীম কৌতুহল ও বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। তাই ইজিপশীয় সরকারের পক্ষ থেকে স্থির করা হয়েছে এই সম্পদ ও প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন সারা পৃথিবীজুড়ে প্রদর্শন করা হবে। এই বছর মার্চ মাসে বৃটিশ মিউজিয়ামের প্রদর্শনী দিয়ে তার শুভ সূচনা হবে। এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করবেন স্বয়ং রানী এলিজাবেথ। কোন দেশে কবে এই প্রদর্শনী পৌঁছবে ইজিপশীয় সরকারের পক্ষ থেকে পরে তা জানানো হবে।
কোলকাতা
মে ২০১৫
- মামুউউউ- শেষ টানটা বুঝিয়ে দিচ্ছে বেশ জব্বর কিছু ঘটেছে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ধপাধপ দ্রুত গতিতে উঠে আসা পায়ের শব্দ। দরজার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকান অর্ধেন্দু। ঠিক সাত গোনার মাথায় দরজায় দুটো খুশিতে জ্বলজ্বলে চশমা পড়া চোখ দেখা যায়। গার্গী। তাঁর বড়ো আদরের ভাগ্নী। কলেজে পড়ে বটে, কিন্তু কৈশোরের সহজ বিস্ময় তার চোখ মুখ থেকে যায়নি এখনও। এখন প্রায় নাচছে সে। হাতে একটা মোটা আইভরি রঙের খাম।
- এসে গেছে। খোলো খোলো- খামটা বাড়িয়ে ধরে সে।
অর্ধেন্দুর চোখে মিটিমিটি হাসি। খামের একেবারে উপরে যা লেখা তার মানে দাঁড়ায় ভারতীয় জাদুঘর থেকে আমন্ত্রণ। এ আমন্ত্রণের অপেক্ষা মামা ভাগ্নী দুজনেরই ছিল। খামটা যত্ন করে খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
ডক্টর অর্ধেন্দুশেখর রায়চৌধুরী। নাম আর পাণ্ডিত্য ছাড়া আর সব কিছুই তাঁর বাহুল্যবর্জিত। এরকম ইজিপ্টোলজিস্ট বা প্রাচীন ইজিপ্ট বিষয়ক পণ্ডিত শুধু পশ্চিমবঙ্গে কেন, পুরো ভারতেও বোধ করি দুটি নেই। শান্ত ভদ্র এবং অমায়িক মানুষটিকে দেখলে তাঁর পাণ্ডিত্যের আঁচ পাওয়া মুশকিল। সংসার করেননি, প্রাচীন ইতিহাসই তাঁর সংসারের পটভূমি। তবে এই ভাগ্নীটি তাঁর প্রাণ বলা যায়। খুব ছোট থেকেই সে গরমের ছুটিগুলো তাঁর কাছেই কাটায়। যদিও ইতিহাস নিয়ে সে পড়াশোনা করছে না। তার বিষয় রসায়ন। কিন্তু নারানাং মাতুলক্রম মেনে ইতিহাস তার নেশা বটে। আর সেই নেশায় শান দিতে ছুটি পড়লেই মামুর কাছে উপস্থিত হয় সে। আর এবারে তো যাকে বলে সোনায় সোহাগা। ফারাও তুতানখামুনের সমাধি থেকে উদ্ধার করা সম্পদ ও শিল্পকলার প্রদর্শনী অবশেষে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছেছে এবং মে মাসের মাঝামাঝি দুই সপ্তাহ ধরে কলকাতার জাদুঘরেই তার প্রদর্শনী হবে। শুনে পর্যন্ত উৎসাহে সে লাফাচ্ছে। অর্ধেন্দু যদিও খোদ ইজিপ্ট গিয়ে দেখে এসেছেন অনেক আগেই, তাও অধীর আগ্রহে আমন্ত্রণের অপেক্ষা তিনিও করছিলেন।
- আসুন ডক্টর রায়চৌধুরী। আপনার জন্য আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। শুধু প্রদর্শনীর জন্য নয়, আপনার জন্য খুব ইন্টারেস্টিং একটা জিনিসও অপেক্ষা করছে। এটা বোধহয় আপনিও আগে দেখেননি, কারণ ছয় মাস আগেও এর উপস্থিতি কারুর জানা ছিলনা।- কিউরেটর অপরেশ বাগচীর মুখ ঝলমল করে ওঠে। অসীম যত্নে সদ্যজাত শিশুকে ছোঁয়ার মত করে একটি বায়ুনিরোধী প্যাকেট বের করে আনেন তিনি। অর্ধেন্দুর পিছন থেকে গার্গীও ঝুঁকে পড়ে সেটার দিকে। একটি অত্যন্ত জীর্ণ প্যাপিরাসের টুকরো। তাতে কিঞ্চিৎ ঝাপসা হয়ে আসা কিছু হাইরোগ্লিফিকস অক্ষর। প্রাচীন ইজিপ্টের লেখার অক্ষর হাইরোগ্লিফিকস পড়তে রীতিমত পারদর্শী অর্ধেন্দুশেখর। কিছু ছবির মাধ্যমে কত কথা যে বলা যায় তার অদ্ভুত নিদর্শন এই অক্ষরমালা।
- হয়ত কোনও কিছুর ছিন্ন অংশ এই প্যাপিরাস। দেখুন উপর দিকটা সামান্য ছেঁড়া।- বলে চলেন বাগচী।- শুধু এই অংশটুকুর সেরকম অর্থ কেউ বুঝতে পারেননি এখনো। তবে আপনি চাইলে-
- নিশ্চই, মামু এর মানে ঠিক বের করে ফেলবে - তাঁকে শেষ করতে না দিয়ে বলে ওঠে গার্গী।
- এটা আপনাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে গবেষণা করতে দিতে পারলে খুবই খুশি হতাম আমরা, কিন্তু বুঝতেই পারছেন, সেটা নীতিগতভাবে সেটা আমাদের অধিকারের বাইরে।
- অবশ্যই- অর্ধেন্দুর ইঙ্গিতে গার্গী সেলফোন বের করে ছবি তুলে নেয় বিভিন্ন কোণ থেকে।
- অবিশ্যি আপনার যখন ইচ্ছা এসে এখানে বসে এটাকে স্টাডি করতে পারবেন।
- ধন্যবাদ। চলুন এবার প্রদর্শনীতে যাওয়া যাক।
সন্ধে ঢলে গিয়ে রাত নামছে। মামা ভাগ্নী ছাদে বসে আলোচনায় মগ্ন।
- ফারাওয়ের স্ত্রী ছিলেন আঙ্খেসেনামুন না মামু? কিন্তু তাঁর কোনও চিহ্ন কোথাও পাওয়া যায়নি কেন?
- একবারে যায়নি তা নয়, সমাধির গায়ে যেসব ছবি আঁকা থাকে, সেখানে তাঁর ছবি আছে একটি। ফুল দিচ্ছেন ফারাওকে। আর দুজনের একটি মূর্তি আছে শহরের মাঝামাঝি। তবে আধভাঙ্গা। কেউ যেন নষ্ট করে দিতে চেয়েছিল সেটা।
- ফারাও মারা যাওয়ার পর কী হয়েছিল তাঁর? - গার্গী যেন ভুলতে পারেনা আঙ্খেসেনামুনকে।
- যতটুকু জানা যায়, পরবর্তী ফারাও আই তাঁকে বিবাহ করেছিল। সেটা না করলে আইয়ের পক্ষে ফারাও হওয়া সম্ভব হতোনা। কারণ সে ছিল সাধারণ মানুষ, রাজবংশের কেউনা। তবে বিয়েটা যে হয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ কারটুশ জানিস তো? চৌকো স্লেটের মত জিনিস, তাতে একদিকে ফারাও আর একদিকে তার রানীর ছবি আঁকা বা খোদাই করা থাকত। অনেক সময় সেটা ছোট আকারের সোনার তৈরী হত, ফারাও আঙ্গুলে পরতেন সেটা। তাকে ওরা বলত শেনু রিং। আই আর আঙ্খেসেনামুনের কারটুশ পাওয়া গেছে, তবে ওইটুকুই। আর কোথাও রানীর চিহ্নটুকু পর্যন্ত নেই।
অন্ধকার ঘন হয়ে আসে। কেন যেন মনটা ভারী লাগে গার্গীর।
- তারপর?
- আর কিছু নেই। আঙ্খেসেনামুন হারিয়ে গেছে তারপর। তার আর কোনও খবর জানা নেই।
খানিকক্ষণ চুপচাপ কেটে যায়।
- আচ্ছা মামু, তাহলে তুতানখামুনেরও তো একটা শেনু থাকা উচিত? তার রানীর ছবি দেওয়া?
- উচিত তো রে মা। কিন্তু পাওয়া তো যায়নি।
- ওই প্যাপিরাস নিয়ে কখন বসবে মামু? আমিও থাকবো তো?
- হ্যাঁ রে পাগলি। চল এখন।
খাওয়ার পর চেয়ারে বসেই কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল গার্গী। বাইরের পোশাক পরিবর্তন পর্যন্ত করা হয়নি। অদ্ভুত একটা স্বপ্নও দেখে ফেলল। তারই বয়সী একটি মেয়ে, নাকি রাজকন্যা বা রানী হবে হয়তো। উজ্জ্বল কালো রঙে ভ্রূ আর চোখের পাতা রং করা। পরনে শ্বেতশুভ্র পোশাক। গলায় উজ্জ্বল নীল পাথরের মালা। কুচকুচে কালো চুল থেকে যেন নীলচে আভা বেরোচ্ছে। কিন্তু মুখ বড় মলিন, যেন খুব দুখী। দুই হাত বাড়িয়ে কিছু যেন বলতে চাইছে। ঘুম ভেঙে যায় গার্গীর। ভোর হচ্ছে। সারারাত চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিল নাকি। আবছা অন্ধকার তখনও।স্বপ্নটা মনে ছাপ ফেলে যায়। কাকে দেখলো কে জানে। কী বলতে চাইল তাকে। ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে মামুর পড়াশোনার ঘরের দিকে চোখ যায় গার্গীর। এখনো আলো জ্বলছে! তার মানে সারারাত কাজ করেছে মামু? ছুটলো গার্গী।
- মামু? পড়ে ফেললে?
- আয়। পড়েছি, তবে বুঝিনি। এদিকে এসে দেখ।
ঝুঁকে পড়ে গার্গী। তার ফোনে তোলা ছবিটা থেকে প্রিন্টআউট বের করেছে মামু।
- প্রথম লেখাটা দেখ।
- কী মনে হচ্ছে?
- দুটো হাত উপর দিকে উঠে আছে?
- ঠিক। এ হলো যাদুবিদ্যার দেবতা হেকা। তবে শুধু জাদু বা ঐন্দ্রজালিক বা জাদু সম্বন্ধীয় যা কিছু বোঝাতেও এটা ব্যবহার করা যায়।
- তারপর?
- এটার নানা মানে হতে পারে। পালকি,বা আসন বা ধর পেতে বসার মাদুর।
- বাব্বা। যাদুবিদ্যার দেবতা মাদুর পেতে বসে আছে?
- দাঁড়া ,শেষটা সবচেয়ে গোলমেলে। এটা দুটো পাশাপাশি, মানে একসাথে হবে।
- কি ওগুলো?
- সিংহ আর পা। পা ও হতে পারে, আবার হাঁটাও বোঝাতে পারে।
- মানে কী দাঁড়াল মামু?
- সেটাই তো ভাবছি রে। যদি এটা কোনও কিছুর অংশ হয়, তাহলে ভেবে লাভ নেই, কারণ বাকিটা না পেলে কোনো মানেই দাঁড়াবে না।
- সিংহ আসনে বসে পা চিবোচ্ছে কারুর।
- গুলিয়ে দিসনা। জাদু আছে আগে।
- তাও বটে। জাদু আসন? জাদু মাদুর? ম্যাজিক কার্পেট মামু?
- থামলি?
- আচ্ছা মামু আসন বলতে মনে হল, অনেকগুলো বসার জায়গা ওই খাট মতো দেখলাম না কাল? একটা ক্যাম্প খাট মত ছিল না?
- আরে সেটা তো দারুন ব্যাপার। তোর সাথে আলোচনা করবো ভেবেছিলাম, ভুলে গেছি। ওটা একটা প্রাচীন বিস্ময় বলতে পারিস। পৃথিবীর প্রথম তিনটে ভাঁজে ভাঁজ করা খাট। সত্যি জিনিয়াসদের ব্যাপার। ওই খাটটা এখন ভাঁজ করা অবস্থাতেই তো আছে দেখলি। ছয়টা পায়া ওটার। ভারী মোটা পায়া খেয়াল করেছিস নিশ্চই। এবার অত ভারী পায়া নিয়ে খাট ভাঁজ হবে কী করে? ওরা পায়ার উপরে হিঞ্জ লাগলো এমনভাবে যে পায়াগুলো ভিতর দিকে ঘুরে ঢুকে যায় ভাঁজ করার সময়। ব্যস, বিনা বাধায় খাট ভাঁজ। বোধহয় পৃথিবীর প্রথম ক্যাম্প খাট ওটা। ফারাও শিকারে গেলে ওটাই ব্যবহার করতেন। শুনেছি তুতানখামুনের খুব প্রিয় ছিল জিনিসটা।
- দারুন তো মামু। সেযুগের মার্ভেল বলো। সাধারণের চোখে হয়তো ম্যাজিকের মত লাগতো।
স্থির হয়ে যান অর্ধেন্দু। -কী বললি? - কী টা উত্তেজনায় খি হয়ে বেরোয়।
মুখটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে ওঠে। চোখে হ্যালোজেন ল্যাম্প।লাফিয়ে ওঠেন চেয়ার ছেড়ে। গার্গীর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান। - চ'-
দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন অর্ধেন্দু। দরজার পাশে গাড়ির চাবি ঝুলছে। মুহূর্তে টেনে নিয়ে দরজা খুলে ফেললেন। পেছনে গার্গী দৌড়ে আসছে। - মামু পা'জামা আর হাওয়াই চটি বদলে যাও।
- বাগচীকে তোর ফোনে ধর। নম্বরটা নিতে বলেছিলাম না কাল?
- জাদুঘর খোলার সময় হয়নি একেবারেই, তাও বাগচী চলেই এসেছিল। ওরকম ফোন পেলে চলে আসতেই হয়। পা'জামা, হাওয়াই চটি আর ফতুয়া সজ্জিত ডক্টর রায়চৌধুরীকে দেখে বিস্মতও হননি বাগচী। এই মানুষটি এমনই।
- ফারাওয়ের ঘরেই যাবেন তো? চা বলি?
- বাগচী বাজে না বকে চলো আগে।- দাবড়ানি এলো।
একরকম দৌড়েই প্রদর্শনী হল পর্যন্ত এলেন তাঁরা। -ভাঁজ করা খাট খোলো গ্লাভস পরে।- হুকুম হলো এবার।
- এইরে, ও তো জ্যাম হয়ে গেছে ডক্টর রায়চৌধুরী। কবেকার জিনিস।- বাগচী প্রায় কাঁদো কাঁদো।
- তোমার মুন্ডু। ও জ্যাম হয়েছে অন্য কারণে। আমাকে দাও।
গ্লাভস পরে, সিংহাকৃতি পায়ার পাশে হাত ঢুকিয়ে দেন ইজিপশীওলজিস্ট। একটা অদ্ভুতদর্শন বাক্স বের করে আনেন। দুই দিক থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গার্গী আর বাগচী। বাক্সের ঢাকা খুলে ডক্টর রায়চৌধুরী বের করে আনেন ফারাও তুতানখামুনের শেনু। একদিকে ফারাও স্বয়ং, আর একদিকে তাঁর প্রিয় সম্রাজ্ঞী আঙ্খেসেনামুন। মাঝখানে একটি পাথর। গার্গী আর কিছু না পেয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে ফ্যালে।
প্রদর্শনী শেষ। এবার গন্তব্য ছিল সিঙ্গাপুর। কিন্তু ইজিপশীয় সরকার স্থির করেছেন যে এখনই আর নয়। ফারাও এখন কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরবেন। এই প্রথম তাঁর সমাধিতে তাঁর শেনু স্থান পাবে। তাঁকে ও তাঁর সম্রাজ্ঞীকে পূর্ণ মর্যাদায় একসাথে সবাই দেখতে পাবে।
গার্গীও বাড়ি ফিরবে, ছুটি শেষ তার। আবার পরের ছুটিতে চলে আসবে মামুর কাছে।
- মামু, মাঝখানে ওটা কী পাথর ছিল গো?
- জানিনা রে, আমি কী আর পাথর চিনি বল। দামী হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। আসল জিনিস তো পাথরের দুইপাশে। কি বল।
মনে মনে হাসে গার্গী। গতকাল রাতেও অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। সেই মেয়েটি আবার। তবে এবারে একা নয়। সঙ্গে এক তরুণ। বলিষ্ঠ দেহ, কিন্তু একটা পা বিকৃত। দুজনেরই হাসিমুখ। দুজনেরই কাজল মাখা চোখ জ্বলজ্বল করছে।
অলংকরণ : বুমা ব্যানার্জী দাস