এবং খোঁজ। শারদ সংখ্যা। বর্ষ : ২, সংখ্যা ১৪। নির্বাচিত 'রম্যরচনা' পড়তে ক্লিক করুন। উচ্চারিত হোক অক্ষর, স্পর্ধিত হোক ভাষা।

শা র দ সং খ্যা

স্কেচ : গুগল


মো হ ম্ম দ  শা হ বু দ্দি ন  ফি রো জ

কবিকথা



বি সেই ব্যক্তি বা সাহিত্যিক, যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। ... একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণত বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। কার্যত যিনি কবিতা লিখেন, তিনিই কবি।" এটি আভিধানিক স্পষ্ট অর্থ। এবার যদি প্রশ্ন আসে কবিতা কী? তবে নানা কবির নানা মত। তা হোক। আমি কবিতা নিয়ে কিছু বলছি না, বরং কবি নিয়ে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভাগ করি। প্রথমেই জানিয়ে রাখি কাউকে অপমান বা অপদস্ত করার উদ্দেশ্যে আমার এ লেখা নয়। ঘটনাগুলোর সব চরিত্র বাস্তবের হলেও নামগুলো আমার মনগড়া। বাস্তবে এই নামের কোনো কবি থেকে থাকলে আমার অজানা। দয়া করে ভুল বুঝবেন না। আমাকে বাংলাদেশের কয়েকজন কবিবন্ধু ফোনে বা সাক্ষাতে কবি সম্বোধন করেন। আসলে শুনেছি বাংলাদেশে নাকি কবি সম্বোধনের একটা ওজন আছে। কবি বলে কেউ সম্বোধন করলে অপর ব্যক্তি নিজেকে সম্মানিত বোধ করেন। যাঁরা ওদেশে গেছেন তাঁরা বিষয়টি ভালো করে জানবেন। আমি সেই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত। কিন্তু আমাকে কেউ কবি সম্বোধন করলেই মনে হয় ব্যঙ্গ করছেন। কারণ, ছোটো থেকেই শ্লেষাত্মক এই প্রবাদটি শুনে আসছি “কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব।" আর এখন দেখি দু'টি বাক্য লিখেই অনেকে নিজের নামের সাথে নিজেই ‘কবি' শব্দটি জুড়ে দিচ্ছেন। আর ফেসবুক প্রোফাইলে কাজটি করতে পারলেই “বিশ্ববিখ্যাত কবি" হয়ে গেলেন, তাকে আর পায় কে? সারা পৃথিবীর লোক তাঁকে কবি বলেই চিনবেন। ভাবুন কারোর নাম অবনীকুমার কর্মকার আগে কবি শব্দটি বসিয়ে তিনি ফেসবুক প্রোফাইলে নাম লিখলেন “কবি অবনী কুমার কর্মকার" সুমেরু, কুমেরু, জাপান, হনুলুলু যেখান থেকে যেই দেখুন না কেন অবনীবাবুকে সবাই কবি হিসেবেই চিনবেন। অথচ অবনীকুমার নামটি যে একসাথে লেখা উচিৎ সেটাই জানেন না কবি অবনী কুমার কর্মকার। এখন তো আবার ‘আন্তর্জাতিক পত্রিকা'র ছড়াছড়ি। তাতে যদি একবার লেখা ছাপা হয়, তবে আর পায় কে? সেটা তো নোবেল পুরস্কারের সমতুল্য।  


যে কথা বলছিলাম। ওই শ্লেষাত্মক প্রবাদ  “কবি কবি ভাব, ছন্দের অভাব।" সারাজীবনই ছন্দের অভাববোধ আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। এখনও ছন্দের ‘ছ'টুকুই শিখতে পারিনি। বাস্তবে কোনো কবি পেলেই, তাঁর কাছে ছন্দ শেখার হ্যাংলামি আজও করি। আমার প্রিয় কবিরা সেটা ভালো ভাবেই জানেন। ইতিমধ্যে এক বয়োজ্যেষ্ঠ কবি ফেসবুকে লিখলেন কবিতা লিখতে গেলে ছন্দের কী দরকার? কথাটা আমার মনে বেশ লাগল... এই তো পেয়ে গেছি আমার দলের লোক। বিষয়টা আমি এক বিখ্যাত কবিকে বলেই বসলাম। উনি খুব ছোট্ট কথায় বললেন “সন্তানের জন্ম দিতে কি বাবা বা মায়ের চোখ থাকার দরকার হয়? হয় না তো। তবে মানুষের চোখের দরকার নেই।" কথাটা শোনামাত্র নিমেষেই তাঁর মুখ থেকে পায়ের পাতায় আমার চোখ নেমে এল। প্রসঙ্গটা কত তাড়াতাড়ি পালটানো যায় তখন তাই ভাবছি। 


বইমেলায় নতুন লিখতে আসা এক কবি আমাকে বললেন “দাদা তুমি কবি জয়ন্ত রায়কে চেনো?" আমি বললাম “চিনি।" উনি বললেন “খুব বড়ো কবি?” আমি জানালাম “মেপে তো দেখিনি তবে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চের বেশি হবে বলে মনে হয় না। কেন কী হয়েছে?” নব্য লিখতে আসা কবিটি আমাকে বলল, “দেখা হয়েছিল। আমি পরিচয় দিয়ে বললাম, “দাদা লিখতে নতুন লিখছি, আমাকে লেখার কিছু টিপস দিন"। উনি বললেন আমার কবিতা পড়েছো? না বলতেই উনি তীব্রস্বরে বললেন বাংলা কবিতা লিখতে এসেছ, আমার কবিতা পড়নি?" নতুন লিখতে আসা কবিটি পালিয়ে আমার কাছে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যেন, কবি জয়ন্ত রায় নামক বাঘের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে। এই কবি জয়ন্ত রায় সম্পর্কে অতীতেও আমার আরেকটা অভিজ্ঞতা আছে। সেটাও এক বইমেলা। প্রথম শনিবার দুপুর দু'টো মতো বাজে। জয়ন্তবাবু হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকে বললেন “ফিরোজ, অজয় আসেনি?” আমি না বললাম। অজয় হল আমাদের পাশের টেবিলে যিনি বসেছেন। জয়ন্তবাবু জানালেন ওনার নতুন কবিতার বই অজয়বাবুর প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গতকাল অর্থাৎ শুক্রবারই ছিয়াত্তর কপি বিক্রি হয়ে গেছে, আজও কতজন এসে বই খুঁজছে, অজয়বাবু না আসার কারণে সবাই ফিরে যাচ্ছে। 


অজয়বাবু একটু গাবলুগুবলু টাইপের মানুষ। বিকেল চারটের দিকে হেলেদুলে এলেন। আসতেই আমি জয়ন্তবাবুর কথাট বললাম নিজে থেকেই। অনেক পাঠক আজও ফিরে গেছে জয়ন্তবাবুর বই না পেয়ে। সব শুনে তো অজয়বাবুর চোখ কপালে! বললেন, “বই আজ এখনও ছাপা শুরু হয়নি, তাই প্রেসে ঝগড়া করে আসছি, আর সে কারণেই দেরি হলো। আপনি বলেন কিনা ওনার কবিতার বই কাল ছিয়াত্তর কপি বিক্রি হয়েছে! মণিপুরী গঞ্জিকা সেবন করেননি তো?” 


দু'চারটি পত্রিকায় কবিতা লিখে আমির আলি নিজেকে মস্ত বড়ো কবি মনে করেন। ফেসবুকে তিনি লিখলেন “দশটি ভালো কবিতা পড়লে, একটি ভালো কবিতা লেখা যায়।" কিন্তু এই ভালো কবিতা একটি খুঁজতেই তো এক নব্য কবির অবস্থা খারাপ। ভালো কবিতা কাকে বলে সেটাই জানে না ওই তরুণ কবি। আমির আলিকে কমেন্ট করলেন “দাদা ভালো কবিতা কাকে বলে?" আমির সাহেব সেই কমেন্টের ধারপাশ দিয়ে আর যাননি। 


আরেক কবির গল্প বলে শেষ করি। কবি কুমার দাসের সাথে ফেসবুকে পরিচয় হয়, ঝুমা পাত্র নামের এক নতুন লিখতে আসা মহিলা কবির সঙ্গে। উচ্চাশা সকলেরই থাকে ঝুমাদেবীরও ছিলো। অনেক পত্র-পত্রিকায় কুমারবাবু নিয়মিত লেখালেখি করেন, ফেসবুকে তার ছবিও পোস্ট করেন। ঝুমাদেবী তা লক্ষ্যও করেছেন। একদিন প্রায় গায়ে পড়েই ঝুমাদেবী কুমারবাবুকে বললেন, তিনিও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখা দিতে চান। সেগুলি কীভাবে মনোনীত হয়, এককথায় কীভাবে ছাপা হবে জানতে চাইতেই, কুমারবাবু বলেন লেখা ছাপানো যা-তা কথা নয়। পরিচয় বাড়াতে হবে। আর এই পরিচয় বাড়ানোর জন্য কুমারবাবু প্রস্তাব দিলেন, তাঁর সাথে ছবি তুললে বহুলোকে চিনবে এবং রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবেন। অনিচ্ছা থাকলেও ঝুমাদেবী রাজি হলেন ছাপা অক্ষরে নিজের নাম দেখতে কার না ভালো লাগে? দেখা হবে সেই বইমেলায়। ঝুমাদেবী ফোনে কুমারবাবুকে ডাকলেন ছবি তোলার জন্য। কুমারবাবু এলেন ছবিও তোলা হলো, কিন্তু সেই ছবি প্রকাশ্যে কখনই আসেনি। কারণ ঝুমাদেবী যেমন লম্বাচওড়া ছিলেন, আর কুমারবাবু তেমনই বেঁটেখাটো রোগা-সোগা। যেন বাঘিনি আর বাগ (Bug) পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। হয়তো সে কারণেই ঝুমাদেবী আর কুমারবাবুর ছবি জনসমক্ষে কোনোদিন আসেনি আর ভবিষ্যতে আসবে কিনা সময়ই বলবে।


বুঝলেন তো আমাকে কেউ কবি বললে কেন বিব্রত হই?