এবং খোঁজ। শারদ সংখ্যা। বর্ষ : ২, সংখ্যা ১৪। নির্বাচিত 'ভ্রমণ' পড়তে ক্লিক করুন। উচ্চারিত হোক অক্ষর, স্পর্ধিত হোক ভাষা।

শা র দ সং খ্যা


মল্লরাজাদের বিষ্ণুপুরে 

শৌ ভি ক  রা য় 



      রাসমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে শিহরিত হচ্ছিলাম। কোচবিহারের মানুষ হওয়ার সুবাদে রাস কথাটির সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের। এখানকার প্রখ্যাত রাসমেলা দেখে দেখে বড় হয়েছি। নিজের কর্মক্ষেত্রটিও রাসমেলা ময়দানের একদম লাগোয়া বলে মেলার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে মেলা শেষের নোংরা আবর্জনা পরিষ্কার করা পর্যন্ত খুঁটিনাটি সবকিছুই জানি। কিন্তু এতদিন এই জাতীয় রাসমঞ্চ সম্পর্কে সেরকম কোনও ধারণা ছিল না। তাই আক্ষরিক অর্থেই শিহরণ জাগছিল! বাংলার চালাঘর আর মিশরীয় পিরামিডের সংমিশ্রণে এরকম স্থাপত্য এই রাজ্যে তো বটেই, সারা দেশে দ্বিতীয়টি আর নেই। 


তোরণ

আসলে ব্যক্তিগত কাজে কলকাতায় এসে একঘেয়েমি লাগছিল। তাই একটু ফাঁক পেয়েই দৌড়েছি মল্লরাজাদের দেশে। প্রাচীন বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর এমনিতেই আমার খুব প্রিয়। তার ওপর লাল মাটি, শাল-সেগুনের জঙ্গল, ঋতু বৈচিত্রে কৃষ্ণচূড়া-পলাশের সমারোহ তাকে যেন আলাদা করেছে। প্রকৃতিদত্ত অনিন্দ্য শোভা আর মনুষ্যকীর্তির অসামান্য  নিদর্শনের এরকম মেলবন্ধন খুব কম জায়গাতেই মেলে। তাই রঘুনাথ সিংহ, বীর সিংহ, বীর হাম্বির, শিব সিংহ প্রমুখের বিষ্ণুপুরে যে কোনও সময়েই চলে যাওয়া যায়। অতীতের রাজপ্রাসাদ কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে গেলেও ১৬ শতক থেকে ১৯ শতকের মধ্যে তৈরি হওয়া তিনশোর বেশি মন্দির আজও রয়েছে বিষ্ণুপুরে। পোড়া মাটির দেশে জলকষ্ট মেটানোর জন্য লালবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, যমুনাবাঁধে, কালিন্দীবাঁধ, শ্যামবাঁধ ইত্যাদিও অতীত সম্পদ যা বিদ্যমান আজও। 


রাসমঞ্চ

এসবের জন্যই রাসমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম যে, অতীতে বঙ্গদেশ স্থাপত্যবিদ্যায় সত্যিই পারদর্শী হয়েছিল। তা না হলে ১৫৮৭ সালে ঝামাপাথরের  এই মঞ্চ তৈরির কথা ভাবা যেত না। রাসমঞ্চে মোট তিনটি গ্যালারি আছে। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে এটি ৮০ ফুট, উচ্চতায় ৩৫ ফুট। রয়েছে ৬৪টি প্রকোষ্ঠ। মূল গর্ভগৃহকে তিনটি ধারাবাহিক খিলানাবৃত প্রদক্ষিণ পথ ঘিরে রয়েছে। ফুলকাটা খিলানগুলিতে পোড়ামাটির প্রস্ফুটিত পদ্মের ছবি অনবদ্য।  অতীতে উৎসবের সময় রাধাকৃষ্ণ এই মঞ্চে আসীন হতেন। অন্যান্য মন্দির থেকেও সব দেবমূর্তি সাধারণ মানুষের দেখার জন্য রাখা হত এখানে। রাসমঞ্চের প্রাঙ্গণটিও সুন্দর। যত্নে রাখবার চেষ্টা করা হয় সেটা বোঝা যায়। তবে চারপাশের হাল আমলের বাড়িঘরের মাঝে রাসমঞ্চটি কেমন যেন বেমানান লাগে! কিন্তু এটাই বোধহয় চিরসত্য। একদিন যা ছিল মুখর, আজ তা নীরব। আবার আজকের মুখরতা একদিন  মিলিয়ে যাবে ভবিষ্যতে!


দলমাদল কামান

বিষ্ণুপুরের সমৃদ্ধ অতীতের আর একটি অপূর্ব নিদর্শন দলমাদল কামান। রাজা গোপাল সিংহের রাজত্বকালে এই কামান হয়ে উঠেছিল বীর নায়ক। কেননা ৩.৮মি লম্বা এই কামান মারাঠা বর্গির আক্রমণ প্রতিহত করে। সম্ভবত বর্গির দল মর্দন করে বলে কামানের নাম হয় দলমাদল। ওজনে ২৯৬ মণ কামানটির নলের ব্যাস ১১.৫ ইঞ্চি। অতীতে ৬৩টি লৌহবলয় ছিল কামানের শোভা। অবশ্য কামানের গায়ের সুক্ষ কারুকাজও কম যায় না। কামানের পাশেই রয়েছে ছিন্নমস্তার মন্দির। এই মন্দিরটি বয়সের দিক থেকে অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় নবীন। তবে লাল পাথরে তৈরি মন্দিরটি দেখতে বড্ড সুন্দর। ভয় ভয় লাগে বর্গাকার গুমঘরটি দেখে। রাজবাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও গুমঘর, লালবাঁধ যেন ইতিহাসের অন্ধকার দিককেই তুলে ধরেছে। যেমন, লালবাঁধে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল  লালবাঈকে। তিনি ছিলেন পাঠান সর্দার রহিম খানের নর্তকী স্ত্রী। রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ তাঁকে বন্দি করে নিয়ে আসেন। শোনা যায় যে, তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কও শুরু হয়। রাজরানি রাজার এই পতন সহ্য করতে না পেরে লালবাঈ ও রাজাকে হত্যা করে স্বামীর চিতায় সহমরণে যান। আজকের লালবাঁধ দেখতে আর পাঁচটি দিঘির মতো হলেও, ইতিহাসের স্মৃতি তাকে আলাদা করেছে।   


জোড়াবাংলো মন্দির

বঙ্গের ইতিহাসের অসামান্য আর একটি নিদর্শন বিষ্ণুপুরের জোড়বাংলো মন্দির। কেষ্টরায় মন্দির নামে পরিচিত এই মন্দিরটি ১৬৫৫ সালে রাজা রঘুনাথ সিংহের আমলে নির্মিত হয়। গঠনের দিক থেকে তো বটেই, কারুকাজেও জোড়বাংলো মন্দির অনন্য। মন্দিরগাত্রের বাইরের  ও ভেতরের বিভিন্ন ছবি মল্লরাজাদের সেই সময়ের ইতিহাস যেমন তুলে ধরেছে, তেমনি বিবৃত হয়েছে পুরান কথা। বাংলার চালার ছাঁদ মন্দিরের উপরিভাগকে স্বতন্ত্র করেছে। দক্ষিণমুখী মন্দিরটি একটি বর্গাকার প্ল্যাটফর্মের ওপর বানানো হয়। এই মন্দিরের স্থাপত্যকে পশ্চিমবঙ্গের টেরাকোটা মন্দিরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। কাছেই রয়েছে ১৭৫৮ সালে নির্মিত হয় রাধেশ্যাম মন্দির। ল্যাটেরাইট পাথরের ভাস্কর্য, চালার ছাঁদ আর একরত্ন মন্দিরের শিরোপা চৈতন্য সিংহের তৈরি রাধেশ্যাম মন্দিরকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আবার পঞ্চরত্ন শৈলীর চারচালা শ্যামরায় মন্দিরটিও বিষ্ণুপুরের গর্ব। রঘুনাথ সিংহ এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন ১৬৪৩ সালে। টেরাকোটা স্থাপত্য,পঞ্চ শিখর আর মন্দিরের গায়ে রামায়ন-মহাভারতের কাহিনী সহ তদানীন্তন সমাজচিত্র এই মন্দিরটিকেও অদ্বিতীয় করে তুলেছে।


মন্দিরের শহর বিষ্ণুপুরে রাধালাল জিউ, মল্লেশ্বর, মদনমোহন মন্দির, শ্রীমন্দির, যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন মিউজিয়াম, সর্বমঙ্গলা মন্দির ইত্যাদিও দর্শনীয়। আসলে সারা বিষ্ণুপুরেই এত প্রাচীন নিদর্শন ও টেরাকোটা মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে সেগুলি সব দেখা স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। শুধু অপূর্ব কারুকাজ বা অনুপম সৌন্দর্যেই নয়, প্রাচীনত্বেও মন্দিরগুলি যথেষ্ট গুরুত্বের দাবী রাখে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিষ্ণুপুরের বালুচরি, তসর শাড়ি, পোড়ামাটি ও ডোকরা শিল্পের বিভিন্ন স্মারক। এখানকার খাবার হোটেলে পোস্তর বিভিন্ন পদ খাদ্যরসিকদের কাছে অবশ্যই প্রলোভনের।  



আসলে বিষ্ণুপুর এক অসামান্য স্মৃতি। যে জনপদকে ঘিরে একসময় বাংলার শিক্ষা-সংস্কৃতি-সংগীত আবর্তিত হত সেই শহর সর্বগ্রাসী আধুনিকতার স্পর্শেও বাঁচিয়ে রেখেছে নিজস্বতা। এখানেই সে অনন্য।

© ছবি : শৌভিক রায়