শা র দ সং খ্যা
অলোকরঞ্জন – একটি কবিতার নাম
র ন্তি দে ব স র কা র
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, নামটি উচ্চারিত হলেই এক নান্দনিক কাব্যমঞ্জরী আমাদের চোখের সামনে, মননের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে দিকে-দিগন্তে, সুষমা ছড়িয়ে; দশদিক সুরভিত করে হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। তাঁর সম্পর্কে বন্ধু এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত ইংরেজি অধ্যাপক, রোল্যান্ড হাইন্ডমার্শ (OBE)–র পর্যবেক্ষণ
‘Alokeranjan’s poetry challenges, drawing the reader into zones of discomfort, of sudden unease, at the juxtapositioning of the everyday with intimations of the infinite. In two lines, he can rip away the ground from under your feet, and leave you struggling to find some new revelatory equilibrium.’
গোদা বাঙ্গলায় যা তর্জমা করলে বা এককথায় যা বোঝা যায় যে অলোকরঞ্জনের কবিতা হলো, সেই বহুস্তর-ভেদ-করা এক বায়বীয় স্তর যা পাঠককে মুহূর্মুহূ চমকিত করবে, ছত্রের বাঁকে বাঁকে বিস্ময়-বিহ্বলতার বর্ণে পাঠকের পায়ের তলাকার মাটী সরিয়ে দিয়ে নতুনতর কোনো মাত্রার খোঁজে অন্বিত করবে, বিস্ময়াবিভূত করবে।
তাঁর শব্দের এমনই অনুপম ব্যবহার যে কখনো তাঁর কবিতার শুরুতে বলছেন- (কবিতা- ‘নামখোদাই’)- ‘এই যে ঘুমনিবিড় মাঠ, এই যে মুখরা নদী…’ সেই মুহূর্তেই পাঠকের সামনে এসে যাচ্ছে এক কল্পময় জগতের নৈসর্গিক হাতছানি। টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন একটি শব্দ দিয়ে- ‘ঘুমনিবিড়’; ছোট্ট এক গ্রাম্য নদীকে অভিহিত করছেন ‘মুখরা’ বলে আর পাশেই একটি দেহাতি মাঠকে এমন বর্ণনায় দেখা- এক নতুন অভিজ্ঞতা বৈ কি। একটি প্রশস্ত মাঠ যেন ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে- আর পাহাড়ী খাত বেয়ে বয়ে যাওয়া মুখরা নদীর পাশে অসাধারণ একটি দৃশ্যকল্প তৈরি হলো মুহূর্তেই। আবার আরেকটি কবিতা- ‘যবশীর্ষ জেগে আছে ভোরের আকাশে…’ এই নামকরণই যেন স্বয়ম্ভূ একটি কবিতা হয়ে উঠেছে। তার চলন শুরু হচ্ছে এমন ভাবে-
‘পর্যাপ্ত উপকরণ এনে দিল ওরা
কবিতার মাসে—
পারিজাত, ঐরাবত, মন্দাকিনীকেও
প্রত্যাশার অমোঘ উল্লাসে।
কবিতার আছে নাকি দিনক্ষণ ? আমি
সমস্ত সরিয়ে একপাশে
একটি উপকরণ বেছে নিই; শীর্ণ, পরিমেয়
যবশীর্ষ জেগে আছে ভোরের আকাশে।
এই ছোট্ট পরিসরে একটি অনবদ্য কবিতা। বিষয়বস্তুও নেহাৎ অকিঞ্চিতকর। বিষয় কি, না, কবিতা নির্মাণ। কবি এখানে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় মাত্র আট-লাইনের মধ্যেই আমাদের গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গিকে দিলেন ভীষণ এক অভিঘাত। কবিতার ওয়ার্কশপ বা কর্মশালা বসেছে। কবিতা লেখার আয়োজনে কোনো কার্পণ্য করেননি কবিতা কর্মশালার আয়োজকেরা। আমন্ত্রিত সেরা কবিবর্গের কল্পনা- বৃদ্ধির পরিযোজনায় বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সেরা নান্দনিক দৈব উপাদানগুলি - দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত, নন্দন-কাননের সেরা ঐশ্বর্যসম্ভার-পারিজাত ফুল এবং স্বর্গের নদী মন্দাকিনীকেও সামিল করেছে, যা দেখে কবিগণ সেরা কবিতা নির্মাণ করবেন এমনই তাঁদের প্রত্যাশা। কিন্তু শেষ দুটি ছত্রে তিনি বোঝালেন, কবিতা লিখতে এসবের প্রয়োজন নেই, যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হয়- যেমন এক্ষেত্রে একটি পরিমেয় যবশীর্ষ-ই যথেষ্ট। তাঁর বার্তা তো স্পষ্ট ; এই প্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে আছে অমূল্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, তাকে খুঁজে নিতে হবে। দৈব-সৌন্দর্যের প্রয়োজন নেই। বাহ্যাড়ম্বর দরকার নেই, তা বাতুলতা।
রবীন্দ্রনাথ-স্মৃতি বিজড়িত লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড শহর নিয়ে তিনি পাঁচ লাইনের একটি অনবদ্য কবিতা রচনা করেছেন যা পড়ে চমকে উঠতে হয়। এভাবেও কবিতা লেখা যায় আর এমন বহুস্তরীয় তার ব্যঞ্জনা ! আলোচ্য কবিতাটি রচনা হয়েছিল সেই সময়ের কথা ভেবে যখন রবীন্দ্রনাথ লন্ডন শহরে ভ্রমণ করছিলেন এবং গাছ-ফুলে মোড়া অপরূপ এই হ্যাম্পস্টেড শহরের একটি বাড়িতে তিনি দেড়মাস ভাড়াটে হিসেবে বাস করেছিলেন। সেই সময়কাল ধরে তাঁর এই স্মৃতিমেদুরতার কবিতাটি দেখা যাক –
এই কবিতাটির কোনো শীর্ষক নেই ; প্রথম ছত্রটিই তার শীর্ষক-
হ্যাম্পস্টেড, যেখানে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন…
আজ সেখানে
টিনের কৌটো, কোকা কোলার, কানীন একটি শিশু
সেটা দিয়েই বানিয়ে নিল জুতো,
তাকিয়ে আছে তার দিকে এক নারী-পুলিশ তার
রয়েছে আব্রু তো ?
লন্ডনের নয়নাভিরাম শহরতলি- হ্যাম্পস্টেড-এ থাকাকালীন বেশ কিছু গান এই বাড়িতে বসে রচনা করেছিলেন। এই সুন্দর আর নান্দনিক শহর কিন্তু দিন বদল হয়েছে। এখন আর সেই শহর শুধুমাত্র এক নান্দনিক শহর নেই। বৃটিশদের সাম্রাজ্যবাদী লালসা আর ঔপনিবেশিক বাণিজ্যে মত্ত বিশ্ব-রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। বহুজাতিক ভোগবাদী সাম্রাজ্যে গরিব-গুর্বোদের কোনো স্থান নেই। তেমনই এক অবাঞ্ছিত সমাজে বৃটেনে বসবাসকারী দরিদ্র কালো মানুষেরা চরম বৈষম্যের শিকার, আর্থ-সামাজিক নিরিখে। তেমনই এক পটভূমি কবির কলমে সামাজিক বিপ্লবের আগাম সতর্কতা নিয়ে এসেছে। যেমন কবিতায় বর্ণিত যে সর্বহারা বেওয়ারিশ পথশিশুটি এই শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, যেতে যেতে সে তার খালি পায়ে একটি কোকা কোলার ক্যান-এ একটি পা-ঢুকিয়ে জুতোর মত ব্যবহার করছে। এই চিত্রটি যেন প্রতীকী। পরিচয়হীন এই শিশুটি্র পক্ষে কোকা কোলা খাওয়া এক অলীক কল্পনা। তাই সে যেন এক অভিনব প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে তার অক্ষম জিহাদ পেশ করছে। তার প্রাপ্য শুধু কোকাকোলার খালি ক্যান, তার সামাজিক অবস্থানে ক্যান ভর্তি পানীয় তার বরাতে লেখা নেই তাই যেন সেই খালি ক্যান-টিকে জুতোর মত ব্যবহার করে তার ঘৃণা উগরে দিচ্ছে। খালি ক্যান তার ছোট্ট পায়ে এসে এক ধাতব নিনাদে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে; তাই দেখে নারী পুলিশটি তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। এখানে নারী-পুলিশটি কিন্তু কবি প্রশাসনের এক প্রতিনিধি হিসেবে দেখছেন। তাই যেদিন ফরাসী বিপ্লবের মতো এক সামাজিক বিপ্লব-বিক্ষোভ গোটা লন্ডন শহর কেঁপে উঠবে তাদের মত বঞ্চিতদের রণহুংকারে, তখন এই নারী-পুলিশ কি তার নিজের আব্রু ওরফে প্রশাসনের আব্রু বজায় থাকবে তো ? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি পাঠকের কাছে রেখে কবি থেমেছেন। অনবদ্য নির্মাণ।
তেমনি আরেকটি ছয় লাইনের অনবদ্য কবিতায় তিনি আরেকটি অকিঞ্চিৎকর কিন্তু এক জ্বলন্ত সামাজিক ব্যাধি পাঠকের সামনে রেখেছেন –
একটি শবযাত্রা
স্পষ্ট আমি বলতে পারি ঐ
অন্তিম শয্যার শাদা আবরণী তুলে ফেলে কেউ
ভিতরে তাকাও যদি, দেখবে কোনো মৃতদেহ নেই।
তবে যে একদল কান্নাকীর্তনিয়া জলজ্যান্ত লোক
ঈশ্বরের ডাকনাম কাদায় লুটিয়ে চলে যায়
আমি বলে দিতে পারি ওরাই ছয়টি মৃতদেহ।
এই অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতা হয়নি, এমন কোনো মানুষ নেই বললেই চলে। যে কারো মৃত্যু হলেই এইসব পাড়ার স্থায়ী শ্মশানযাত্রী, ‘কান্নাকীর্তনিয়ার’ দল, চোখের নিমেষ কোমরে একটা গামছা পড়ে জুটে যায় শোকাচ্ছন্ন বাড়িতে। এরাই অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে ফুল-চন্দন-মালা দিয়ে সাজানো শবদেহ কাঁধে নিয়ে শববাহী গাড়িতে তুলে একটি ভাড়া-করা ট্রাকে উঠে পৈশাচিক উল্লাসে ‘হরি-বোল’ ধ্বনি দিয়ে গোটা শোকাচ্ছন্ন পরিবারে হৃতকম্প তুলে দেয়। পাড়া-পড়শীদের মনেও। এদের কোনো মানুষ নিষেধ করেনা, আর তারাও তারস্বরে এই হরিবোল ধ্বনি দিয়ে যেন এক গৌরবজনক দায়িত্ব পালন করে। এদের এই পৈশাচিক কাণ্ড কবির সয়না। তাই কবি এই সামাজিক অপরাধীদের দিকে আঙুল তুলে চিহ্নিত করেন। কবির মতে যে কয়জন শববাহকের কাজ করে, তারাই আসলে প্রকৃত ‘শব’। আমাদের সমাজের শবদেহ।