শা র দ সং খ্যা
ম ল য় রা য় চৌ ধু রী
গহ্বরতীর্থের কুশীলব
খাজুরাহো মন্দিরের দেয়াল থেকে মাটিতে লাফাবার সময়, ঘুরঘুরে পোকার মুখে পাঠানো আদেশ তামিল করার জন্যে, বাতাসের মাঝপথে, নিজেকে পাষাণ মূর্তি থেকে রক্তমাংসের মানুষে পালটে নিয়েছিল কুশাশ্ব দেবনাথ নামে স্বাস্হ্যবান যুবকটি, যে কিনা হাজার বছরেরও বেশি চাণ্ডেলাবাড়ির একজন গতরি, ভারি-পাছা, ঢাউসবুক উলঙ্গ দাসীর ঠোঁটে ঠোঁট, যোনিতে লিঙ্গ, আর স্তনে মুঠো দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল ।
এতকাল কত রোদ রোদিয়েছে, কত মেঘ মেঘিয়েছে, কত শীত শীতিয়েছে, কত বৃষ্টি বৃষ্টিয়েছে, কত ঝড় ঝড়িয়েছে, কত ধুলো ধুলিয়েছে, তার গোনাগুনতি নেই।
—-অ্যাই, তোকে তফতরে ডেকে পাঠিয়েছে। অমাবস্যার রাতে কানের ওপর এসে, হুকুম শোনাবার মতন হেঁড়ে গলায়, বলেছিল কেঁদো কালো ঘুরঘুরে পোকাটা।
হাজার বছরেরও বেশি অমন পোজ দিয়ে থাকার দরুণ শরীর আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও, গায়ে কিন্তু একদম ব্যাথা নেই কুশাশ্ব দেবনাথের। আড়ষ্টতা কাটাবার জন্যে একটু ওঠবোস লাফালাফি ছুটোছুটি করে নিল। পাথর হয়ে সঙ্গমরত থাকলেও, ‘দফতর’ শুনে ছাঁৎ করে উঠেছিল নিরেট বুক। মাটিতে দাঁড়িয়ে, রক্তমাংসের দেহে, যদিও উলঠ্গ, ছাঁৎ-ছাঁতানিটা কাটতে সময় লাগল।
—-এভাবে যাওয়া অ্যালাউড? জিগ্যেস করল কুশাশ্ব।
—-নিজেকে নগন্য করে নে, তিন-চার সেন্টিমিটারের মতন, তাহলে প্রবলেম হবে না। মাপ না বাড়লে লোক-লজ্জার ভয় নেই। কন্ঠস্বরে আদেশ মিশিয়ে বলল ঘুরঘুরে পোকাটা, যার ঠাকুমা আদর করে ওর নাম রেখেছিলেন পচা; আর এখন তো পচাঞ্জন সরদার নামে পুরো গোভারতে বিখ্যাত। এক দুর্গন্ধে সবাই চেনে।
—-যাব কী করে? শরীরের পেশিগুলো ম্যাসাজ করতে-করতে, যাতে একটু ঢিলে-ঢালা হয়, জানতে চাইল কুশাশ্ব।
—-তোর সেই জলফড়িং বন্ধুটা কোথায়? তার তো বেশ হাওয়াইজাহাজের মতন বডি, চার ডানার ইনজিন, চাদ্দিকে দেখার মত ডুমো-ডুমো চোখ। ওটার ওপর বসে চলে যা।
মনে পড়ল কুশাশ্বর। পতঙ্গিনী ধরিত্রীকন্যা নামে এক জলফড়িং এসে প্রতিদিন নাকের ডগার ওপর বসে ডানা ঝাপটানির আদর দিচ্ছে মাসখানেক যাবত। পতঙ্গিনীও বলছিল, মন্দিরের গা থেকে নেমে, জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে দেশঅদেশ দেখতে, ভালমন্দ খেতে, রক্তমাংসের মেয়ের আহ্লাদ নিতে। পতঙ্গিনীর পরিবার নাকি কয়লাযুগের সময় থেকে রয়েছে। তখন ওরা অনেক অবস্হাপন্ন ছিল। এত অবস্হাপন্ন যে ওর পূর্বপুরুষদের বলা হত দৈত্যফড়িং, আর সময়টাকে লোকে বলত রেনেসঁস।
রেনেসঁসের সময়ে ছিলেন ফোরোরাকোস, টিরানোসরাস, ডিপলোডোকাস, ইগুয়ানাডন, ট্রাইসেরাটপাস, মাস্টোডোনসরাস, স্টেগোসরাস, রয়ামোফোরিনকাস, টেরানোডন, ব্লনটোসরাস, আরকিওপটেরিক্স, ট্রাকোডোন, মোসোসৌর প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্ব; একদিন বিকেলবেলায় বলেছিল পতঙ্গিনী, যখন বিকেলেরচ সোনারঙআ হাওয়া ওর স্বচ্ছ চারটে ডানাকে ফরফরিয়ে হাওয়াতে চাইছিল। কয়লা-উৎপাদী বনজঙ্গল যখন ফেলে-ছড়িয়ে চারপাশ জংলাচ্ছে, তখন জলে অভিভূত জলায়-জলায় ডানাবাজনার প্রবচন শুনিয়ে সংস্কারের কাজ করতেন ওর তিন ফিট লম্বা পূর্বপুরুষরা।
আর এখন? পতঙ্গিনী ধরিত্রীকন্যা বলে, এখন সবই খুদে-খুদে। ছয়ফুটকি কাঁচপোকা, গোবরঠেলা গুবরে, ডোরাকাটা তেলাপোকা, কালীঝিঁঝি, গন্ধকীট, কেঁচো, কির্মি, মঃকুন, বল্মীক, কিটিভ, জালিক, উচ্চিঙ্গে, ডেঁয়ো, পুতিকা, লুমবিষ, শলভ, শুঙ্গা, কেঁদরাই, জলৌকা, ঘুণ আর চুলচেরারা সমাজ চালায়।
অচেনাসুলভ অচেনাদের একটা জমঘত আছে যাকে খুদেরা বলে দফতর। যারা ইনজিরি ভাষা জানে তারা বলে পার্টি- ঘর। ওই দফতরে হাজির হতে বলেছে ঘুরঘুরে। আদেশ দিয়ে, গায়ের ঢাকনা তুলে, গোপন ডানা বের করে, মুখের সামনে কালাশনিকভ উঁচিয়ে চলে গেল স্পেশাল রিজার্ভ ফোর্সের ঘুরঘুরে কমান্ডার।
পতঙ্গিনী বলেছিল, কাঁচপাখনার খুনসুটিমার্কা কাঁপন তুলে, দফতরের অছিসিংহাসনের মালকিনির সামনের দিকটা সুয়োরানি আর পেছনদিকটা দুয়োরানি; কিন্তু তুমি টেরটি পাবে না কোনটি সুয়ো আর কোনটি দুয়ো।
—-সে কি? আমাদের মন্দিরের গায়ে যে উলঙ্গ যুবতীরা অমর হয়ে রয়েছে তাদের তো সামনে দিক আর পেছনদিক একেবারে আলাদা, অথচ সুয়ো-দুয়োর ব্যাপার নেই।
—-তোমার মন্দিরে যা আছে তা হল স্হপতি আর ভাস্করের কল্পনা। আমি রূঢ় বাস্তবের কথা বলছি ভায়া। কখনও যদি দফতর শহরে যাও, নিজের চোখে দেখতে পাবে।
—-শুধু চোখ কেন আমি তো সব অঙ্গ দিয়েই দেখব। চোখ দিয়ে সবকটা ডাইমেনশান ধরা যায় না। তাছাড়া তোমার মতন চোখ তো আমার নেই।
দফতরের ডাকে সে-কারণেই সাড়া দিল কুশাশ্ব দেবনাথ।
এদিকে অমাবস্যার অমিয় অন্ধকার, তারায় তেরিয়ে আকাশ, শীতে শীতোচ্ছে ঝোপঝাড়, বাঁশিয়ে রয়েছে বাঁশবন, হিমে হিমোচ্ছে হালকা হাওয়া; কখন দুজোড়া ডানার কপাট খুলে পতঙ্গিনীর ঘুম ভাঙবে কে জানে।
নগণ্য হবার আগে একবার জঘন্য হয়ে দেখা যাক, ভাবল কুশাশ্ব। বলা তো আর যায় না। যদি দফতর শহরের কাজে লাগে। যদি অছি-সিংহাসনের কাজে লাগে। যদি মালকিনির সুয়ো দ৮ইকের কাজে লাগে। যদি মালকিনির দুয়ো দিকের কাজে লাগে।
যামন ভাবা তেমনি কাজ।
সারা গায়ে চুল আর শুঁড়োলো মুখ দিয়ে দাঁত বেরোনো শাকাহারী ম্যমথ হয়ে গেল কুশাশ্ব। গাছে-গাছে গেছো পাখিদের চেঁচামেচিতে লজ্জা পেয়ে আবার ফিরে এলো নিজের চেহারায়। ট্রায়ালটা দিয়ে অবশ্য ফুরফুরে প্রাণে ফুরসত এলো।
সকালে, পতঙ্গিনী এসে যখন রক্তমাংসের কুশাশ্বকে দেখল, ওর তো হেসে-হেসে ডানা ব্যথা হবার যোগাড়। সব শুনে বলল, নগণ্য-জঘন্য বা ধন্যধন্য যা-ই হও, অত দূরে ফ্লাই করার প্রযুক্তি আমার নেই ভায়া। অত এভিয়েশান ফুয়েলও ক্যারি করতে পারি না।
—-তাহলে কী হবে? কেমন করে যাব?
তুমি নগণ্য হয়ে আমার পিঠে দুপাশে পা ঝুলিয়ে বসো, আমো কোনো শঙ্খচিলের পিঠে বসিয়ে দেবো তোমায়। ওরা কেউ-কেউ দফতর-শহরের দিকে যায়।
নগণ্য হয়ে, উঠে বসার সময়ে পিছলে যাচ্ছিল কুশাশ্ব। ভোর-ভোর পরাগ মাখাবার ডিউটিতে বেরিয়েছিল পতঙ্গিনী, যাতে বেশি-বেশি হাইব্রিড জন্মায়।
—-হাইব্রিড? জানতে চাইল কুশাশ্ব। অচেনাসুলভ অচেনা?
হ্যাঁ, হাল আমলে আমরা ফড়িংরা অনেক ধরনের হাইব্রিড তৈরিতে সফল হয়েছি।
—-তাই বুঝি?
—-হ্যাঁ তো! গান্ধির পরাগের সঙ্গে মার্কসের পরাগ, গান্ধির পারাগের সঙ্গে রজনিশের, মাও-এর সঙ্গে মোরারজির, মার্কিনের সঙ্গে চিনা, জেহাদের সঙ্গে সাম্যবাদ, লাউ-এর সঙ্গে লঙ্কার, রবারের টুপির সঙ্গে চামড়ার টুপি; সে-সব হাইব্রিড তুমি দফতর শহরে গেলেই দেখতে পাবে।
—-হাফ-চেনার সঙ্গে উড়ুক্কু হাফ-চেনা মিশিয়ে পুরো একখানা অচেনাসুলভ অচেনা? পিঠের ওপর যুৎ করে বসে বলল কুশাশ্ব। এভাবেই ঘোড়ায় চাপত হাজার বছর আগে।
ঝিলের ঝিলমিলে কিনারায় যে শঙ্খচিলটা বসেছিল তাকে, জলে পোঁতা কঞ্চিতে বসে জিগ্যেস করল পতঙ্গিনী, একজনকে দফতর-শহরে নিয়ে যাবেন? ওর ডাক পড়েছে, খুব জরুরি।
ঠোঁটে শুকনো ঘাসের নুটি নিয়ে পেতলের একটা ছোট মূর্তি ঘষেমেজে ফর্সা করছিল শঙ্খচিল, এক মনে, মাথা নিচু করে। বলল, গোপালের এই তো সবে ঘুম ভাঙল। দাঁত মাজিয়ে, চান করিয়ে, ব্রেকফাস্ট করিয়ে, তারপর ওকে নিয়ে একটু বেরোব।
—-আপনি যতটা যাবেন অন্তত ততদূর পৌঁছে দেবেন নাহয়। তারপর কোনো যানবাহনে চাপিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। প্রস্তাব দিল পতঙ্গিনী।
—-ঠিকি আছে, আগে গোপালের সেবাটা করে নিই। এক হাতে গোপালকে, অন্য হাতে তোমার অতিথিকে ধরে নিয়ে যাবো।
শঙ্খচিলের পায়ের কাছে কুশাশ্বকে নামিয়ে, টা-টা করে চলে গেল পতঙ্গিনী। কুশাশ্ব দেখল গোপাল একটা পুতুল, হাতে নাড়ু নিয়ে বসে আছে। ও নিজে ছিল পাথরের আর নাড়ুগোপাল নিরেট পেতলের।
শঙ্খচিলের পরামর্শ মেনে, যে-হাতে গোপালকে আঁকড়ে ধরল পাখিটা, সেই হাতটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল কুশাশ্ব। একটা হাত আমার খালি থাকা দরকার, নয়তো নামার সময়ে অসুবিধা হবে, বলেছিল শঙ্খচিল।
দু-তিনবার পাক খেয়েই আকাশের চেয়ে উঁচু আকাশে উঠে পড়ে শঙ্খচিল যখন ফুল স্পিড নিয়েছে, ধাতব হাসি হেসে পেতলের মূর্তিটা ফিসফিস করে কুশাশ্বকে বলল, এত নিচু স্বরে যাতে শঙ্খচিল শুনতে না পায়, এই নিন, নাড়ু খান, আপনার তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি।
সত্যিই বেশ জোরে খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বাঁ-হাতে নাড়ুটা নিয়ে খেয়ে নিল কুশাশ্ব। এমন খিদে পেয়েছিল যে প্রশ্ন করার মানে হয় না, গোপাল ছোকরাটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় না হওয়া সত্বেও।
খেয়ে নিলে, গোপাল বলল, আরো নিচু স্বরে, দফতর থেকে আমারও ডাক পড়েছে, কিন্তু আমার সেবাইত তো ছাড়তেই চায় না, সব সময়ে সঙ্গে থাকে, এমনকি রাত্তিরে ঘন্টা বাজিয়ে মশারি টাঙিয়ে, আমাকে ঘুম পাড়ায় আর নিজে আমার সামনে মাটিতে শুয়ে মশার কামড় খায়।
এরকম উজাড় করে সেবা করছে লোকটা, অথচ আপনি দফতরের ডাকে সাড়া দিতে চাইছেন? কুশাশ্ব বিস্মিত। গলায় নাড়ুর চুরো আটকে আরেকটু হলেই জোরে কেশে ফেলত। সূর্য উঠে গিয়ে থাকলে কী হবে, আকাশ ব্যাপারটাই একেবারে ঠান্ডা, পাথরিনী চান্ডেলা দাসীর চেয়েও। তার ওপর খুচরো মেয়েলি মেঘগুলো মাঝে-মধ্যে সুড়সুড়ি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
বন্দী জীবন কাটাচ্ছি, বুঝলেন, চব্বিশ ঘন্টা নজরে-নজরে, একেবারে একপাখিতন্ত্রী যাপন। বলল গোপাল। তারপর যোগ করল, একটু পরেই আমার সেবাইত ছোঁ মেরে নাড়ু তোলার জন্যে একজায়গায় নামবে, তখন কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে যাবে। বাঁ হাতটা তাই ফাঁকা রেখেছে। মাটির কাছাকাছি যেই নামবে, আপনি ওর হাতের বগলে কাতুকুতু দিয়ে মাটিতে ঝাঁপ দেবেন, আমিও দেবো সেই সঙ্গে।
কিন্তু পতঙ্গিনী তো বলেছিল ও-ই দফতরে যাবার গাড়িতে তুলে দেবে।
প্রশ্ন করবেন না। সেবাইতদের বলা যায় না। কিছু না পেলে আপনাকেই টুক করে খেয়ে ফেলতে পারে। আমি তো পেতলের, আমায় খেতে পারে না। হয়ত আমি ধাতুর বলেই আমার সেবাইত হয়ে রয়েছে।
দোটানায় পড়ল কুশাশ্ব।শঙ্কচিল গোঁতা মেরে নামা আরম্ভ করেছিল নিচে। ভাবার আর সময় ছিল না। হালুইকরের বাড়ির ছাদে নাড়ুর থালার কাছাকাছি হতেই কাতুকুতু দিয়ে লাফ মারল কুশাশ্ব। গোপাল নাড়ু মাখার পাত্রের মধ্যে পড়ল। তুলে নেবার জন্যে শঙ্খচিল পেছনে বাঁক নিয়ে নেমে এসেছিল বটে, হালুইকরের মা একটা লাঠি নিয়ে ‘এই পালা এই পালা’ চেঁচিয়ে তাড়াল পাখিটাকে। না পালিয়ে ওপরে চক্কোর মারছে দেখে হালুইকরের মা লোকজন ডেকে নাড়ুর থাল, যার ফাঁকে কুশাশ্ব লুকিয়ে, আর নাড়ু মাখার বিরাট পাত্রটা, যার মধ্যে গোপাল লুকিয়ে, মাথায় তুলে নিচের তলার ভাঁড়ার ঘরে গিয়ে রাখল।
কর্মীরা বাইরে বেরিয়ে গেলে, কুশাশ্ব স্তম্ভিত হয়ে দেখল, গোপাল প্রমাণমাপের মানুষের চেহারা নিয়ে ফেলেছে।
—-করছ কী? করছ কী? ধরা পড়ে গেলে ভীষণ কেলেংকারি হবে। আমার মতন খুদে হয়ে যাও না। পরে সুযোগ পেলে কেটে পড়ব। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল কুশাশ্ব।
গোপাল বলল, আমি নগণ্য হতে পারি না। সে-ক্ষমতা আমার নেই। আমি যে ঈশ্বর। আমি কেবল বড়, আরও বড়, তার থেকেও বড় হতে পারি। বা ধাতু, কাঠ, মাটি, পাথরের।
মনে হল এ-ঘরে কেউ আসছে। পায়ের শব্দ শোনা গেল। দ্রুত শুয়ে থাকা পেতলে রূপান্তরিত হল গোপাল। উত্তেজনায় কুশাশ্ব নিজের ছয়ফিট দীর্ঘ প্রকৃত চেহারা নিয়ে ফেলল। হাতে, বাহুতে, পায়ে, গলায় স্বর্ণালঙ্কার সুদ্ধ। কিন্তু দেহে যে পোষাক নেই। খাজুরাহো মন্দিরের দেয়ালে ওভাবে পোশাকহীনই ছিল হাজার বছর।
যে যুবতী-বধু ঘরে ঢুকেছিল, সে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে, আর ঝাঁপিয়ে পড়ল কুশাশ্বর ওপর। টাল সামলাতে না পেরে, ডািঁ-করা মিষ্টির পাহাড়ের ওপর পড়ল দুজনে। তাই আওয়াজ গেল না বাইরে।
সকাল থেকে আমার বিশেষ কিছু খাওয়া হয়নি । সম্বিত ফিরে না পেলেও বলল কুশাশ্ব।
বাঁ হাত দিয়ে কুশাশ্বর মুখে চোখে নাকে মিষ্টি গুঁজে দিতে লাগল যুবতী, আর দান হাতে খুলতে লাগল নিজের পোশাক। মিষ্টির নানা রকম ঢিবির ওপর চলল ওদের দুজনের স্বয়ংক্রিয় সৃজন-কম্মের হুটোপাটি । মিষ্টির বিছানায় ওদের খেলা স্তিমিত হয়ে এলে, কুশাশ্ব বলল, দফতর শহরে যাবার জন্যে ওকে সাহাজ্য করতে। গোপালের কথাটা চেপে গেল, কেননা এরাও যদি গোপালকে বন্দী করে ফ্যালে তাহলে মুশকিল। বলা যায় না; হয়ত ক্যাশ-বাক্সের ওপর রেখে এরাও গোপালের সেবাইত হতে চাইবে।
মেয়েটি কুশাশ্বর জন্যে একটা থলে, ফুলপ্যান্ট, শার্ট, জুতো আর সোনার এক হাজার সরকারি মুদ্রা এনে দিতে, কুশাশ্ব নিজের সবকটা অলঙ্কার দিয়ে দিল খুলে, স্মৃতিচিহ্ণ হিসাবে। যুবতী যখন দেখতে গেল খিড়কি দরজার দিক ফাঁকা আছে কিনা, গোপালকে তুলে ঝোলায় পুরে নিল কুশাশ্ব।
পেছনের খিড়কি দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওপরে তাকিয়ে দেখল, তখনও আকাশে চক্কোর দিচ্ছে শঙ্খচিল। ঝোলা থেকে গোপালকে বের করলে ও-ও প্রমাণ মাপের মানুষের চেহারা নিল , আর মাথা থেকে ময়ূরের পালকটা খুলে ফেলে দিল ছুঁড়ে।
ঈশ্বর হয়েও আপনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি? আমার নগণতার সুযোগ নিতে হল? গাড়ি-ঘোড়ার খোঁজে হাঁটতে-হাঁটতে গোপালের দিকে প্রশ্ন দুটো ছুঁড়ে দিল কুশাশ্ব।
ঈশ্বরদের অনেক হ্যাপা, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল গোপাল। ঈশ্বররা পাওয়ার শেয়ারিঙে বিশ্বাস করে না, আকাশে উড়ন্ত শঙ্খচিলের দিকে তাকিয়ে বলল গোপাল। তারপর যোগ করল, ঈশ্বররা ভক্তদের দিয়ে অপরাধ করাতে বাধ্য হয়, কেননা তারা নিজেরা নিজেদের হাতে অপরাধ তুলে নিলে ঈশ্বরগিরি হারাবে। গোপিকাদের নিয়ে লীলে খেলায় আমি তো অনেক বেশি অভিঞ্জ। এমন কি যতই যাই করি কৌমার্য অটুট থাকে। তবু ওই যুবতীকে সন্মোহনে ডেকে পাঠালুম যাতে ওর বাঁজা বরের বদনাম ঘোচাবার অপরাধটা আপনি করেন, আর সেই সঙ্গে যুবতীটি আমাদের পালাবার সুযোগ করে দ্যান।
—-ঈশ্বর হওয়া দেখছি বেশ ঝকমারি!
হ্যাঁ, যে ঈশ্বরই হোন না কেন, যে সম্প্রদায়ের বা যে দেশেরই হোন না কেন, এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি নেই। নিরাকার হয়েও পার পাওয়া যায় না।
—-তার চেয়ে তো না হওয়াই ভাল।
—-সেই জন্যেই তো পচাঞ্জন সরদারের কথামতন দফতর শহরে যাচ্ছি।
—-পচাঞ্জন কি আপনার সঙ্গেও তুইতোকারি করেছে?
—-হ্যাঁ, কেন বলুন তো? গায়ের রঙ কালো, উস্কোখুস্কো চুল আর হাটুরে ধুতি দেখে ওনারা তো এমনিতেই তুইতোকারি করেন। কেনই বা আমায় বিশেষ ছাড় দেয়া হবে?
অসহায় গোপালের দিকে তাকাল কুশাশ্ব। পথে, রেডিমেড জামাকাপড়ের প্রথম দোকানটা থেকে দুজনের জন্যে এক সেট করে ট্রাউজার, টি শার্ট আর ট্যাংক জাঙিয়া কিনল। গাময় মিষ্টির রস লেগে চটচটে, স্নান করে পোশাক পালটাতে হবে। নাড়ুঅলার খিড়কি দরজা ছাড়ার সময় থেকে একদল কীর্টনীয়া মাছি ডানার খঞ্জনি বাজিয়ে একঘেয়ে গেয়ে যাচ্ছিল, ‘জামাটা খোল না রে রসিক নাগর, দেহসুধা পান করি…’।
এসব মিষ্টিখোর মাছিদের জানা আছে কুশাশ্বর। এরা ঘোড়া মাছি, এদের ড্যাবডেবে নেশা-করা চোখ দুটো এমন যে মাথা খুঁজে পাওয়া যায় না। মাদিগুলো রক্ত খায়। যখন পাথর হয়ে মন্দিরের গায়ে স্হায়ি সঙ্গমকারীর চাকরিতে ছিল, মরদগুলো লিঙ্গের ওপর বসে মধুরস খাবার তালে থাকত; মাদিগুলো এসে বসত পোঁদের ওপর। কিছু না পেয়ে, ভুল বুঝতে পেরে, কাঁচা খিস্তি দিতে-দিতে উড়ে যেত।
তিতকুটে-সবুজ বনবাদাড়ে ঘেরা একটা ঝলমলে-টলমলে সোমথ্থ ঝিলের কাছে পৌঁছলে, গোপাল বলল, আমি নিজেকে একটু লাঘব করে আসছি, আপনি ততক্ষণ স্নানটা সেরে ফেলুন।
হ্যাঁ, হয়ে আসুন, বলল কুশাশ্ব। তারপর খটকা লাগল, ঈশ্বররা কি হাগেন-মোতেন! কে জানে, হয়ত অমন অবিনশ্বর সমস্যার কারণেই ওনারা হয় নিরাকার হয়ে যান, বা পাথর-মাটি-ধাতু-বরফ কোনো আধারকে আশ্রয় করেন। এও কম ঝকমারি নয়। ও নিজেও যখন পাথর ছিল, তখন হাগা-মোতার সমস্যা ছিল না। পান-ভোজনের দরকার হত না তো মলের প্রশ্নই উঠত না।
জামা-প্যান্ট খুলে ঝিলকিনারায় রাখার পর, ওর পোশাক নিয়ে যখন কীর্তনীয়া মাছিরা ‘মিছা মায়া মধুরসে, বন্দী হয়্যা মায়াপাশে, হরিপদে না রহে ভকতি’ গাইতে-গাইতে কাড়াকাড়ি করছে নিজেদের মধ্যে, ওদিকে খেয়াল দিতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিল, ব্যাস, সেই ফাঁকে একটা চিকনচাম ঠান্ডাবদন ময়ালসাপ ওকে জড়িয়ে বলে উঠল, এইবার বাগে পেয়েছি তোমায়, আর কোথাও যেতে দেব না, তুমি আমায় শেখাবে কী ভাবে বহুক্ষণ নিজের ল্যাজের ডগায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
—-আঃ ছাড়ুন ছাড়ুন, কাতরে উঠল কুশাশ্ব, আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আপনার অশ্লীল আলিঙ্গনের চাপে।
—-ছাড়বই যদি তো এই সাড়ে তিন পাকে ধরেছি কেন? জিভ দিয়ে কুশাশ্বর গাল চাটনির মতন চেটে নিয়ে বলল দাগড়া পোশাকের রয়াল বেঙ্গল ময়াল, মুখ দিয়ে বোটকা গন্ধ বেরোচ্ছে পালকসুদ্ধ দেশি মুর্গি খাবার।
—-আরে, অদ্ভুত মশাই, চিনি না জানি না, গলা টিপে ধরে এ কেমন প্রস্তাব! টু-পিস জিমনাস্টদের কাছে যান না শেখার জন্যে। গোপালের এসে পড়ার প্রত্যাশায় এদিক-ওদিক তাকেয়ে, গলার জাপট ছাড়ারাবার চেষ্টা করতে-করতে বলল কুশাশ্ব। দাঁড়াতে শিখে করবেনটাই বা কী? এই তো বেশ আছেন, সারা জীবন কেবল শুয়ে থেকেই চালিয়ে দ্যান।
—-জানিস না মানে? আমার পেটে যাবার আগে শ্বেতকেষ্ট সিংহ নামের শঙ্কচিলটা বলছিল যে তুই হাজার বছর ধরে অশ্লীল ঢঙে দাঁড়িয়েছিলিস, তুইই ওকে ঠকিয়ে ওর সোনার গোপাল হাতিয়ে পালিয়েছিলিস; সেইটে খোঁজার জন্যে ও মাঠে এসে নেমেছিল, আর আমি ওকে খপ করে ধরে গপ করে খেয়ে টপ করে হজম করলুম, যাতে ইয়ে করার আগে গায়ে একটু গত্তি লাগে।
—-তার মানে তো আমি আপনার উপকার করেছি।
—-আমাকে ভড়কি দিসনি। আমার নাম স্বপ্ননীল বাজারি, বুঝলি। সব বাজারের সব্বাই আমাকে এক হাঁকে চেনে। এখন ঘন্টার পর ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে প্রেম করার তরকিবটা বল।
গায়ে মিষ্টি রস লেগে থাকের দরুণ স্বপ্ননীল বাজারির জাপটটা যে পিছলে যাচ্ছে তা টের পাচ্ছিল কুশাশ্ব। এ-ব্যাটার সাড়ে তিন পাক থেকে ছাড়ান পাবার একটাই উপায়। সেটাই করল ও। আচমকা নগণ্যা হয়ে গেল। ফলে আলিঙ্গনের প্যাঁচ ফসকে টুপুস করে পড়ল গিয়ে ঝিলের জলে।
আশেপাশে কিলবিলে চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল যে নীলচেসবুজ ব্যাঙাচিদের জলহুল্লোড়ে গিয়ে ও, কুশাশ্ব, পড়েছে। আমাদের উত্তমকুমার, আমাদের সৌমিত্তির, আমাদের বুম্বাদা, আমাদের জিৎ, আমাদের শারুখ, আমাদের সালমান, আমাদের আমির, আমাদের অভিষেক, আমাদের ইমরান, আমাদের শাহিদ, আমাদের রণবীর বলে-বলে লুকুচিগান করতে লাগল মারমেইড ব্যাঙাচিবৃন্দ।
শিতকালে ব্যাঙাচি! বিস্মিত হল কুশাশ্ব। স্বপ্ননীল বাজারীরও তো শীতে কম্বল চাপা দিয়ে গর্তের পালঙ্কে বা ঝাড়ের দোলনায় ঘুমোবার কথা। ঋতুগুলো হয়ত সবাইকে বোকা বানিয়ে ক্যালেন্ডারে জায়গা বদল করে নিয়েছে।
ভাগ্যিস ময়ালের স্টকে ছোবল নেই। নইলে আর দেখতে হত না। জলেতে এক কোপ ছলাৎ মেরে কপাৎ দিলেই তো এক ঝাঁক ভারজিন মারমেইড ব্যাঙাচিদের সঙ্গে স্বপ্ননীল বাজারির এসি মার্কেটে, যেখানে মাথায় রেডইন্ডিয়ানদের মতন পালকের মুকুট পরে রাঙাচোখো শঙ্খচিলটা, শ্বেতকেষ্ট সিংহ, রেগে হালুয়া হয়ে বসে আছে।
ব্যাঙাচি মারমেইডগুলো হাত-ধরাধরি করে নগণ্য কুশাশ্বকে বৃত্তাকারে ঘিরে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’ গাইতে থাকে পানা-বীথিকার সবুজ টলটলে ছায়ায়। গানটার এমনই অলস নিশিডাক যে ব্যাঙাচি মারমেইডদের বৃত্তের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাসমান কুশাশ্বর হাতদুটো একবার বাঁদিকে উঁচু হয়ে ঢেউ খেলায় তো একবার ডানদিকে উঁচু হয়ে ঢেউ খেলায়। ভালই চলছিল ওর জলনাট্য। একটা দশ কিলো কাৎলা ওকে বিনা বঁড়শির টোপ মনে করে মুখে ঢুকিয়েই ফেলে দিল, থু-থু করে; বলল, শালা তেতো মনুষের বাচ্চা কোথাকার! এদিকে বিনা নোটিসে অমন ঝপাং তোলায় মারমেইডরা যে যার ল্যাজ-লজ্জা বাঁচিয়ে ছত্রভঙ্গ।
থু-থু করে দূরে ছোঁড়ার ফলে কুশাশ্ব পড়বি তো পড় একটা গর্তের একেবারে ভেতরে। ভয়ে কাঁটা। ভাবল, নিশ্চই কোনো ছোবলধারী সাপের বা দাঁতবের-করা শেয়ালের আড্ডায় গিয়ে পড়েছে, আর সে-ব্যাটা দাঁত বের করে জব্বর ঘুম দিচ্ছে। যে-দিক থেকে আলো আসছিল, সেদিক দিয়েই বেরোবার পথ আঁচ করে ল্যাংটো পোঁদে পড়িমরি দেদ্দৌড় লাগাল। ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই; শুনতে পেল লোকজনের কথা বলার ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে, ওই দিকেই গমগম করছে আলো।
গর্তটা হয়ত কোনো বদলি-হওয়া সরকারি বা বেসরকসরি প্রাণির। কিংবা ভুতুড়ে ছমছমিয়া টানেল মনে করে একমাংসবর্তী জীবরা ছেড়ে চলে গেছে নতুন নিকোনো গর্তে। কিংবা সুন্দরী লুমলুমে শেয়ালনির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া যুবরাজ শেয়ালের। কিংবা পুলিশ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত গিরগিটির, যে সন্ন্যাসী হয়ে খাইবার পাসের পাথুরে ডেরায় ছররা-মালা জপতে গেছে। যাই হোক, গর্ত থেকে মাথা বের করে কুশাশ্ব দেখল যে ওপরে জায়গাটায় মেলা বসেছে, আর গর্তের হাঁ-মুখের এপাশে-ওপাশে-চারিপাশে নানা রকমের নানা রঙের নানা মাপের খেলনা সাজানো, বেশির ভাগই একটা পেল্লাই-ভুঁড়ি টাকমাথা লোকের ছোট-ছোট চেহারা।
সবকটা মূর্তিতেই চিকনা-টেকোটা গাল ফুলিয়ে হাসছে। দু-হাত ওপরে তুলে নিতাই-গৌর হয়ে, পাশবালিশে হাঁটু রেখে বসে, বাবু হয়ে ভুঁড়ি ঝুলিয়ে বসে, তা সে যত রকমের পোজ হতে পারে তেমন করে, কায়দা করে গাল ফুলিয়ে হাসছে ভুঁড়িদাস থলথলে টাকলুটা। হাসছে তো হাসছেই।
কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে কি না জানার জন্যে বুক পর্যন্ত গর্ত থেকে বেরিয়ে ইতিউতি দেখছিল কুশাশ্ব। ভেবেছিল কারোর নজর না পড়লে বেরিয়েই পৌ২পা ছুট মেরে গিয়ে লুকোবে সামনের টিপ নখপালিশ লিপস্টিক শ্যাম্পু ডেওডোরেন্ট ময়েশ্চারাইজার বিক্রির মেয়েভুলোনো দোকানটায়। তারপর এক ফাঁকে কোনো দোকানে লুঙ্গি বা পাজামা বা নিদেন একটা হাফপ্যান্ট যোগাড় করে প্রমাণ-মাপের মানুষ হয়ে মেলার ভিড়ে মিশে যাবে।
তা আর হল না। কাছাকাছি যে টেকো গালফোলা ভুঁড়িদাস খেলনাটা ছিল সেটা খপ করে ধরে ফেলল কুশাশ্বকে। আর ও, কুশাশ্ব, ভয়ে কেলিয়ে গিয়ে, ভৎ করে নিজেকে আবার গর্তের মধ্যে লুকিয়ে ফেলল। তার ফলে যা হল তা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
গালফোলা হাসিমুখ টেকোটা, যে কুশাশ্বর চুলের মুঠি ধরেছিল, ডিগবাজি খেয়ে সরুসুড়ঙ্গে পড়ল গিয়ে কুশাশ্বর ঘাড়ের ওপর। দুজনে গড়াতে-গড়াতে বেশ খানিকটা ঢুকে গেল টানেলেরভেতর। গড়ানো থামলে, কুশাশ্ব শুনতে পেল টেকোটা অট্টহাসি হাসছে। সে কী জোরে-জোরে হাসি। গমগম করতে লাগল গর্তপথ। হাসছে তো হাসছেই। হাসছে তো হাসছেই।
কুশাশ্ব প্রথমে ভেবেছিল যে ও উদোম ল্যাংটো বলে ভুঁড়িদাসটা বসে-বসে হাসছে। কিন্তু আবছা আলোয় লক্ষ করল যে টেকোটার গায়েও এক চিলতে কাপড় নেই। কেবল ঝোলা ভুঁড়িতে ওর লেংটুটা ঢাকা পড়ে গেছে।
—-আপনি কে? আমাকে বেরোতে দিলেন না কেন? কোনো মানে হয় এ রকম আচরণের? বিরক্ত কুশাশ্ব জবাবদিহি চাইল।
জবাব দেবার বদলে লোকটা নিজের অট্টহাসি বজায় রাখল।
—-আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি। আমি কথা বলছি আর আপনি শুধু বোকার মতন এনামেল হাসি হাসছেন।
—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-আরে। কী মুশকিল। এরকম হাসাহাসির আবার কী ব্যাপার হল?
—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-দেখুন, আপনার মাওসেতুঙি হাসিটা এবার থামান। আপনি কে মশাই? আমাকে বিপদে ফেলে হাসছেন। আপনার তো দাঁতও নেই দেখছি যে বলব দাঁত বের করে হাসছেন।
—-হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
কুশাশ্ব ভাবল হাসছে হাসুকগে। এক সময় তো চোয়াল ব্যাথা হয়ে থামবে। মাটির দেয়ালে ঠেসান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। ফোকলাটার হাসি থামার নাম নেই। দশ মিনিট, পনেরো মিনিট, কুড়ি মিনিট, তিরিশ মিনিট, চল্লিশ মিনিট, পঞ্চাশ মিনিট, কতক্ষণ ধরে টেকোটা টানা হেসে গেল কে জানে।
—-চুপ করুন, ফুলকো হাসি থামান। ধৈর্য রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল কুশাশ্ব।
জোরে-জোরে হাসি থামাল বটে লোকটা, কিন্তু ফিকফিকে মেটেল হাসি বজায় রাখল গাল ফুলিয়ে।
—-আপনি কে? কী চান? সরাসরি জানতে চাইল কুশাশ্ব।
—-লাঃ ফিং বু ঢ ঢো ঢা। লোকটা এমনভাবে দমফাটা হাসি মিশিয়ে কথাগুলো বলল যে কী বলছে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারল না কুশাশ্ব।
—-বুঢঢা বুঢঢো, কী বলছেন বুঝতে পারছি না।
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-বুঢঢো? বুদ্ধ? না বুঢঢা?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-গৌতম বুদ্ধ?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-বামিয়ান বুদ্ধ?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-হীনযানের বুদ্ধ?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-মহাযানের বুদ্ধ?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-শাক্যমুনি বুদ্ধ?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-এই যে বললেন লাফিং বুঢঢা?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-লাফিং বুঢঢাই শিওর তো?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-একশো ভাগ নিশ্চিত?
—-ইয়েস ইয়েস, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-আমাকে আটকে দিলেন কেন?
—-গোপাল এই পথ দিয়ে যাবার সময় বললেন আপনি এই গর্ত দিয়ে বেরোবেন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-তাতে কী? আমি বেরোতে চাইছিলুম। আপনি অযথা বাগড়া দিলেন।
—-আমাকেও দফতরে ডেকে পাঠিয়েছে। পচাঞ্জন সরদার হুকুম জানিয়ে গেছে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ….
—-আপনাকেও? স্তম্ভিত কুশাশ্ব চেঁচিয়ে জিগ্যেস করে ফ্যালে। এখন বের হব কেমন করে? পোশাকই বা যোগাড় হবে কী ভাবে? আপনি তো এমন থপথপে যে আপনার দ্বারা কিছু হবে বলে মনে হয় না।
পাকা সন্ধ্যার থকথকে অন্ধকার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। হাসি বজায় রেখে বলল লাফিং বুঢঢা। তারপর মেঝেয় শুয়ে, বাহুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। নাক ডাকতে লাগল। নাক ডাকা শুনে ভয় হল কুশাশ্বর। ব্যাঙাচিগুলোর মা-মাসি-পিসিরা আবার মেটিং-কল মনে করে না হপহপ ফপফপ করতে-করতে চলে আসে।
এক সময়ে কুশাশ্বও ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল যখন, তখন একটা মেঠো মাদি ইঁদুর পায়ে চিমটি কেটে বলল, এই আপনারা এভাবে যাতায়াতের রাস্তা ব্লক করে রেখেছেন কেন? আর এটা তো দেখছি অকম্মের ঢেঁকি লাফিং বুঢ়ুয়া, ও আবার এখানে কী করতে এসেছে? তারপর কুটিপাটি ইঁদুরদেঁতো হাসি হাসল। হাসতে হাসতেই বলল, আজকে তো যতদুর জানি দফতর থেকে অবরোধের হুকুম জারি হয়নি, রাস্তায়-রাস্তায় তাহলে তো ক্লাবের ছেলেরা ঝান্ডার ডান্ডা নিয়ে জনমনিষ প্যাঁদাতে বেরোত!
ইঁদুরের পেছন-পেছন ওরা দুজন গর্তের মুখ পর্যন্ত গিয়ে দেখল মেলাচত্বর ভোঁভাঁ, বাইরে শীত-রাতের শীতে কাহিল আঁধিয়ারি অন্ধকার ঘুটুরঘুটুর করছে। ঝিঁঝিরা বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঝিঁঝিট-রাগে খেয়াল গাইছে। বাইরে বেরিয়ে দুজনেই একসঙ্গে প্রমাণ মাপের মানুষ হয়ে উঠতে, ‘তাজ্জব ব্যাপার’ বলে চলে গেল মাদি ইঁদুরটা, কেননা মানুষের শরীর থেকে ইঁদুরলিঙ্গহীন ইঁদুর ঝুলতে ও-ও নিজের এত বছরের ধান চুরির অভিজ্ঞতায় দেখেনি।
দূরে দপদপে অথচ টিকিসটিকিস আলো জ্বলতে দেখে, ভৌতিক অন্ধকারের মেঠো সুযোগ নিয়ে, দুজনে সন্তর্পণে সেই দিকে এগোল। আলো জ্বলতে-থাকা প্রথম ঘরের জানলা দিয়ে ডেখল, একটা লোক খাটের ওপর দলীয় পতাকা বিছিয়ে আঙুলে মুচকি-হাসি মাখিয়ে নোটের থাক সাজাচ্ছে। এবাড়িতে খাওয়া-পরা-থাকার যোগাড়-যন্তর করা মুশকিল। পোশাক হাতানোটাও কঠিন।
পরের বাড়িটায় পৌঁছে জানলা দিয়ে দেখল, এক প্রৌঢ় দম্পতি সান্ধ্য-সঙ্গমে মশগুল। সঙ্গমকালীন পরিবেশ গড়ার জন্যে আলোও টিমটিমে লিকলিকে। জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে, দম্পতির খুলে-রাখা পোশাক টেনে নিল ওরা। প্রৌঢ় দম্পতির লীলেখেলা দেখে লাফিং বুঢঢা মুখে না হেসে কেবল ভুঁড়ি নাচিয়ে হাসছিল। শার্ট-প্যান্ট-সোয়েটার পরে নিল কুশাশ্ব। মহিলার শাড়ি লুঙ্গির মতন করে পরে গায়ে আলোয়ান চাপা দিয়ে নিল লাফিং বুঢঢা। তারপর যেদিক থেকে ভারি ট্রাক চলাচলের শব্দ আসছিল সেদিকে রওনা দিল দুজনে।
পৌঁছল জাতীয় সড়কে, কে জানে কত নম্বর, যাচ্ছে আসছে যানবাহন। সরকারি গাড়ি প্রায়ভেট গাড়ি। টেম্পো ট্রেকার জিপ। ডিজেল পেট্রল সিএনজি। কিন্তু কোন দিকে দফতর শহর? হাত দেখানো সত্বেও থামছে না কোনো গাড়ি। হেড লাইটের আলোয় ওদের দেখতে পেয়ে গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাতের বেলায় গণতন্ত্র আরও বেশি গণতন্ত্র হয়ে যায়। রাস্তার অন্য পারে গিয়ে হাত দেখিয়েও কোনো কাজ হল না।
—-দাঁড়ান, কোন দিকে হাঁটতে হবে আমি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্ণয় দিচ্ছি, হাসতে-হাসতে কথা কটা বলে আবার হাসতে-হাসতেই এই ফরমুলাটা বলল লাফিং বুঢঢ: ‘আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি, যদুর মাস্টার শ্বশুরবাড়ি, রেল কম ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম’। তারপর নির্ণয় নিল, এই দিকে গেলে পা পিছলে আলুর দম হবে, তাই আমাদের হাঁটতে হবে উল্টো দিকে।
যেমন বলা তেমনি কাজ। বজ্রবাঁটুল বিজ্ঞের বৈজ্ঞানিক বাতেলা বলে বাক্যি। ঢং-ঢাঙাতিদের থেকে বাঁচতে হলে বিজ্ঞানের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় নেই। কম্ম কেয়াল করতে হবে তো! অতএব বাগড়া-বাগড়ি না করাই ভাল। দুজনেই তো এখন সোঁতের শ্যাওলা । আরম্ভ হল হাঁটা দেয়া।
হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। হাঁটছে তো হাঁটছেই। কোনদিকে দফতর শহর তার নির্দেশবোর্ড নেই কোথ্থাও। খানিক পরে-পরে কেবল মাইলপাথর।তার ওপর যৌনরোগ সারাবার পোস্টার, যার দরুন কী লেখা পড়া কঠিন। যেটুকু বা পড়া গেল কয়েকটায় তাতে অচেনাসুলভ অচেনা জায়গার নাম। আরও হন্টন। লাফিং বুঢঢা রাস্তার পাশে বসে পড়ে বলল, আর পারছি না গো, আপনি বরং এগোন, আমার ভুঁড়ি আর ওজন বইতে পারছে না। মুখে গালফোলা অটুট, কিন্তু হাসি উধাও। ইচ্ছে তো কুশাশ্বরও হচ্ছিল বসে পড়তে। লাফিং বুঢঢার দেখাদেখি ও-ও বসে পড়ল। একটু পরে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ল দুজনে।
লাফিং বুঢঢা সতর্ক করল কুশাশ্বকে, ঘুমিয়ে পড়বেন না যেন, শেষে জন্তু-জানোয়ার টেনে নিয়ে যাবে। বরং গল্প করা যাক, কী বলেন। আমি একটা গল্প বলছি। হয়ত গল্প শুনতে-শুনতে জেগে থাকবেন। রসিয়ে-রসিয়ে গল্প বলা আরম্ভ করল লাফিং বুঢঢা।
অনেক অনেক অনেকদিন আগেকার কথা। আমাদের দেশে এক নেতার চারটে ছেলে ছিল। তারা ছিল পরস্পরের জিগরি দোস্ত। সবসময় মিলে-মিশে থাকে। মলে যায়, মাল্টিপ্লেক্সে যায়, ডিসকোথেকে যায়, নাইট ক্লাবে যায়, বেশ্যালয়ে যায়, ভোট দিতে যায়, পিকনিকে যায়, বাজি পোড়াতে যায়, চিনা রেস্তোরাঁয় যায়, লং ড্রাইভে যায়, সালসা নাচতে যায়, সর্বত্র এক সঙ্গে যায়।
ওদেরও নেতা বানাবার আগে ওদের বাপ ট্রেনিঙে পাঠাল। নেতা বাপ দেশের টাকাকড়ি-সোনাদানা মেরে লুকিয়ে রেখেছিল; আর সব নেতারা যা করে এই নেতাও সেই সব কুকম্ম করে জীবনে উন্নতি করেছিল। তাই ভাবল ছেলেদের এবার পথ দেখানো দরকার। তাহলেই তো দপতর শহরে গদির আলো পাবে; নয়তো থাকতে হবে অন্ধকারে। ছেলেদের পাঠিয়ে দিল নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী।
যেতে যেতে, যেতে যেতে, যেতে যেতে, এক জায়গায় ছেলেগুলো দেখতে পেল জটায় শ্যাম্পু, গলায় মুক্তা-পান্না-চুনীর হার, গায়ে সিল্কের আলখাল্লা, মেট্রোসেক্সুয়াল পারফিউম মেখে, একজন লোক মাইক বাজিয়ে শিষ্য যোগাড় করছে। উপস্হিত শিষ্যরা জানাল যে উনি সিদ্ধযোগী।
চারজন প্রণামী দিয়ে বলল, মহারাজ, আপনি তো গুরু লোক, অনেককে পার পাইয়ে দিয়েছেন। আমারাও আমাদের বাপের মতন নেতা হয়ে নেম-ফেম-ব্লেম-শেম কামাতে চাই । আপনি একটু ট্রিকগুলো বাতলে দিন। গডম্যান সন্তুষ্ট হয়ে ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে টর্চ দিবে বলল, তোরা এক কাজ কর। চারজনে দফতর শহরের দিকে এগিয়ে যা। যেখানে যার টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবে, সেখানে সে খোঁজ করলেই অঢেল লুকোনো টাকাকড়ি-সোনাদানা পাবে। ব্ল্যাক থেকে হোয়াইট করার টাকার পাহাড়।
গডম্যানের কথামতন চারজন মিলে যাত্রা আরম্ভ করল। তিন যায় রাত যায়, হাঁটে। দিন যায় রাত যায় , হাঁটে। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। দিন যায় রাত যায়, হাঁটে। এক জায়গায় একজনের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সেখানে মাটি খুঁড়ে নতুন-পুরানো অঢেল তামার কয়েন পাওয়া গেল। সে অন্য ভাইদের বলল, চল, তামার কয়েনের এই স্টক নিয়েই দেশে ফেরা যাক। নতুন-পুরানো তামা বেচে প্রচুর মাল কামানো যাবে।
অন্য ভাইরা বলল, তুই এসব ফালতু তামার কয়েন নিয়েই থাক। আমরা দেখি আরও দামি জিনিস পাওয়া যায় কিনা। যে তামার কয়েন পেয়েছিল, সে সেগুলো ট্রাক বোঝাই করে বাড়ি ফিরে গেল।
বাদবাকি তিন ভাই এগিয়ে চলল। বেশ কিছুটা হাঁটার পর আরেকজনের টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সে সেখানে পেল রূপোর গয়না আর কয়েনের অঢেল স্টক। সে বলল, ভালই হল রে, চল রূপোর কয়েন গয়না আর বাসনকোসন ট্রাকে লোড করে দেশে ফিরি। অন্য দুই ভাই বলল, দূর বোকা, তোর যাবার হয় যা, আমরা আরও বেশি মালকড়ির জন্য এগোচ্ছি। দ্বিতীয় ভাই একাই ফিরে গেল গোটাকতক ট্রাকে লোড করে।
আরও কিছুটা যাবার পর তৃতীয় ভাইয়ের টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে গেল। সে জায় গাটা খুঁড়াখুঁড়ি করে পেল সোনার অজস্র কয়েন আর অলংকার। চতুর্থ ভাইকে সে বলল, চল, আর কি, এ-জিনিস তো মালামাল করে দেবে আমাদের, নেতাগিরিতে ফেল মারলেও ক্ষতি নেই। চার নম্বর ভাই বলল, তুই ফিরে যা, এরকম এক-এক করে পাচ্ছি যখন তার মানে আরও দামি-দামি হীরে-জহরত ঘয়নাগাটি পাবো। তৃতীয় ভাই ফিরে গেল ট্রাক লোড করে।
চার নম্বর ভাই একলা এগিয়ে চলল টর্চ হাতে। অনেক দূর চলে গেল। টর্চ নেভার নাম নেই। শেষে টর্চ যখন নিভু-নিভু, দেখতে পেল বিটকেল চেহারার একজন লোক তার সামনে পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে। লোকটার মাথার ওপর একটা নীল রঙের চাকা, যাতে স্পোক রয়েছে, আর তা লোকটার মাথার ওপর বাঁই-বাঁই করে আপনা থেকে ঘুরছে । চতুর্থ ভাই অবাক। জিগ্যেস করল, মশাই আপনি কে? আপনার মাথার ওপর আপনা থেকে ঘুরছে ওটা কী? চার নম্বর ভাইয়ের প্রশ্ন শেষ হবার আগেই লোকটার মাথা থেকে চাকাটা ছুটে এসে ওর মাথার ওপর বনবন করে ঘুরতে লাগল।
মাথার ওপর অসহ্য চাপ বরদাস্ত করতে না পেরে আর্তনাদ করে উঠল চার নম্বর ভাই, ওরেব্বাপ, এতো ভিষণ ভারি,মাথা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়, গা গুলোচ্ছে, সইতে পারছি না।
লোকটা বলল, আমার কিছু করার নেই, তোমার আদর্শবাদী সর্বনাশ তুমি নিজেই ডেকে এনেছ। আমিও এককালে তোমার মতন টর্চ হাতে আদর্শের নেশায় এখান অব্দি এসেছিলুম। এবার বাঁচা গেল। আমার জায়গাটা তুমি পেলে। এখন মাথার ওপর ওই চক্র নিয়ে মজা করো। যদ্দিন না কোনো রাজনৈতিক আদর্শবাদী এসে তোমার কাছ থেকে চক্রটা নিজের মাথায় তুলে নিচ্ছে, তদ্দিন ওখানে দাঁড়িয়ে দুঃখকষ্ট জ্বালাযন্ত্রণা আত্মগ্লানি ভোগ করো। আমি চললুম, টা-টা, বাই-বাই।
গল্প শেষ হতে চারিদিক থেকে ঝিঁঝিপোকাদের সুরেলা গান ভেসে আসতে লাগল, ‘ঘুমঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা এই মায়ায়ায়াবি রাত….’। ঘুমিয়ে পড়ল কুশাশ্ব। পরের দিন রোদ যখন রোদাতে-রোদাতে ওর গায়ে এসে ছিস করে ঠেকল, তখন ওর ঘুম ভাঙল। উঠে বসল। এদিক-ওদিক চেয়ে দেখল। লাফিং বুঢঢা আবার কোথায় গেল। ও-ও কি হাগতে বেরোল গোপালের মতন? ধাতু বা চিনামাটির স্হায়ীত্বের মল বলে কথা, এঁটে এঁটেল হয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু রাস্তার দুপাশ তো ফাঁকা। খেতগুলোয় কোথাও আড়াল করার মতন ঝোপজঙ্গল নেই। হঠাৎ নজর গেল পায়ের কাছে পড়ে থাকা চারটে পেনসিল টর্চ ব্যাটারির দিকে। তুলে দেখে চারটে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাটারি, এক্সপায়ার করে গেছে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার আগেই, তলার দিকটা সবকটার গলে গেছে।
জুতো-চটি কিছু নেই পায়ে। শীতকাল হলে কী হবে, চলার পথ তেতে গেছে এর মধ্যে। কয়েক-পা হাঁটল কুশাশ্ব। বেশ গরম। হাঁটা মুশকিল। কী করা যায়! খিদেও পাচ্ছে। সড়কের পাশ দিয়ে ধুলোর ওপর হেঁটে এগোল যতটা পারা যায় । বহুদূর থেকে কিছু আসছে দেখে দাঁড়িয়ে থাকল। কাছাকাছি হলে টের পেল, দশ-বারোটা উট নিয়ে এদিকেই আসছে একটা লোক, পরনে নোংরাটে মেটরঙা ধুতি আত কোঁচদেয়া হাফ-পাঞ্জাবি, মাথায় হলদে রঙের পাকানো কাপড়ের পাগড়ি।
উটগুলোকে আর লোকটাকে হাত দেখিয়ে থামাল কুশাশ্ব। জিগ্যেস করল, আচ্ছা আপনি কি একজন টাকমাথা গালফোলা ভুঁড়িদাস বেঁটেমতন ফর্সা লোককে দেখেছেন?
উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যে বোঝা গেল না হ্যাঁ বলছে, না, না বলছে।
বছর কুড়ির একটা অতিবৃদ্ধা উট যার পিঠে দুটো কুঁজ, বলল, বাবু, আমাদের এখানে সবাই পাগড়ি পরে, কারোর টাক দেখার উপায় নেই, পাগড়ি হল টাকের অন্তর্বাস।
উদ্বিগ্ন কুশাশ্ব জিগ্যেস করল, দফতর শহরটা কোন দিকে বলতে পারেন? ওই দিকে যাবো, না, এদিকটায়?
উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে জানে না হতে পারে, আবার জানেও হতে পারে।
দুকুঁজো উট বলল, বাবু আমি দফতর শহরটা জানি না, কিন্তু দফতর শহরের দেশটা জানি। একবার আমায় চুরি করে ওই দেশে তাড়িপার করাতে নিয়ে গিয়েছিল।
—-তাড়িপার?
—-হ্যাঁ বাবু, আমাদের তাড়িয়ে-তাড়িয়ে ওই পারে পাঠাচ্ছিল, ওই পারের লোকেরা পরবের দিন খাবে বলে। কিন্তু গোপনে খবর পেয়ে পুলিসে আমাদের আর সেই সঙ্গে আরও সাতজন উটকুমারীকে বর্ডারের ব্রথেল থেকে উদ্ধার করেছিল।
—-উটের মাংস খাওয়া যায় নাকি? ও তো ছিবড়ে হবে।
—-না বাবু, উটের মাংস সুস্বাদু আর নরম। উটের দুধও কনডেন্সড মিল্কের মতন।
—-উটের দুধ খাওয়া যায়?
—-হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি ওই সোমথ্থ উটনির থনে মুখ লাগিয়ে দেখুন না।
মুখ টিপে হেসে সোমথ্থ উটনি বলল, ধ্যাৎ, আমার লজ্জা করে। বাবু আপনি চোখ বুজে খাবেন, আমার মুখের দিকে তাকাবেন না। লোকখিটি।
ছুটে গিয়ে ঠোঁটব্যাকুল বাঁট মুখে পুরে চুষতে-চুষতে পাথরজীবনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায়, যেন ঠোঁট চুষছে, পেট ভরে দুধ খেল কুশাশ্ব। কখন কোথায় খাবার-দাবার পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই।
ঢেঁকুর তুলে উটমালিককে কুশাশ্ব বলল, আমার পায়ে জুতো নেই, আমি কি কোনো উটের পিঠে বসতে পারি? পথে যে গঞ্জ হাট শহর গ্রাম স্টেশান খেয়াঘাট বা বাস ডিপো পড়বে সেখানে নামিয়ে দেবেন।
উটমালিক এমনভাবে মাথা নাড়ল যার মানে হ্যাঁ-ও হয়, আবার না-ও হয়।
দু-কুঁজো উট মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে বলল, বাবু আসুন, আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে জুতোর দোকান আছে। আপনি সেখান থেকে নানা জায়গায় যাবার গাড়ি পাবেন।
দুটো কুঁজের মাঝখানে বসে, সামনের কুঁজ আঁকড়ে ধরে, ধন্যবাদ জানাতে, দু-কুঁজো জিগ্যেস করল, বানুর কী করা হয়?
কুশাশ্ব: প্রেম করি।
দু-কুঁজো: প্রেম…
কুশাশ্ব: হ্যাঁ, অষ্টপ্রহর প্রেম।
দু-কুঁজো: এখন কী প্রেম করতেই যাচ্ছেন?
কুশাশ্ব: না, অমন প্ল্যান করে প্রেম হয় না, হঠাৎ-হঠাৎ হয়ে যায়..
দু-কুঁজো: আমরা তো দিনকতকের জন্যে হিটে আসি, তখনই প্রেম করি। প্রেমের ঋতু হয়।
কুশাশ্ব: আমার প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তে প্রেমের ঋতু।
উটের কাফিলা পৌঁছোল এক গঞ্জ-শহরে। জুতোর দোকান দেখতে পেয়ে নেমে পড়ল কুশাশ্ব। একজোড়া নাগরা জুতো কিনল, শুঁড়তোলা। তারপর, নানা লোককে জিগ্যেস করেও যখন দফতর শহরের হদিশ পেল না, তখন দাঁড়াল গিয়ে ডিপোর ছাউনিতে। লাফিং বুঢঢার ফরমুলা অনুযায়ী যে-দিকটা পা পিছলে আলুর দম হল তার উল্টো দিকে যাবার গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
ট্রাক আসে , যায়। বাস আসে, যায়। অটো আসে যায়।ট্যাক্সি আসে, যায়।টেম্পো আসে, যায়। রিকশা আসে, যায়। টাঙ্গা আসে, যায়। সবই পা পিছলে আলুর দমের দিকে। একবার কুশাশ্বর মনে হল, চলে যাই শালা আলুর দমের দিকেই। পরক্ষণেই মনে হল, বিজ্ঞানের নির্দেশিকা অমান্য করা অমানুষের কাজ।
একজন রোগা ডিগডিগে লোক এসে দাঁড়াল কুশাশ্বর পাশে। সাড়ে-পাঁচ ফিট লম্বা হবে।শাদা ফুল শার্ট কালো প্যান্ট। এত রোগা যে মনে হচ্ছিল লোকটার চেহারার শুধু দুটো ডাইমেনশান। সামনে আর পেছন। ঠিক যেন তালপাতার সেপাই। পুতুলনাচের পুতুলের মত অঙ্গভঙ্গী। মাইকেল জয়াকসন বা প্রভু দেবা নাচের সময় যে-ভাবে হাত-পা নাড়ায়। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। এর কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে ভেবে আলাপ শুরু করতে চাইল কুশাশ্ব।
—-আপনি কোথায় যাবেন?
—-আপনার তাতে দরকার?
—-না, মানে, আমি দফতর শহরে যাবো তো, তাই।
—-তা যান না, কে বারণ করেছে?
—-আসলে কেউ বলতে পারছে না।
—-আমি তাতে কী করব?
—-আপনি যদি একটু বলেন।
—-জানলে তো বলব।
—-এরকম রুষ্ট হচ্ছেন কেন?
—-আপনি বিরক্ত করছেন বলে।
—-আমি কিন্তু একজন প্রেমিক। আমার নাম কুশাশ্ব দেবনাথ। গুপ্তহাসি হেসে ও বলল।
—-আমার নাম গিলগামেশ। আমি দুই-তৃতীয়াংশ দৈব আর এক তৃতীয়াংশ নশ্বর। ইচ্ছেমতন ছোট-বড় হই।
কথাটা শুনে কুশাশ্ব স্তম্ভিত। লোকটা তো ওর চেয়েও দেড় হাজার বছর আগের। কিন্তু এই কি গিলগামেশের চেহারা, যে কিনা খালি হাতে সিংহ মেরে বগলদাবা করে নিয়ে যেত। সারাজীবন বেঁচে থাকার জন্যে কত কত কত অ্যাডভেঞ্চার করেছে গিলগামেশ; ম্যাজিক-ছোঁয়ানো লতাপাতা খুঁজে বের করেছিল, অমর হয়েছিল, অনেক টাকাকড়ি করেছিল। অথচ গিলগামেশ আসলে কাগুজে ল্যাংপ্যাঙে টিংটিঙে, দু-অবিনশ্বর ফুরিয়ে এর অবিনশ্বরে ঠেকেছে।
—-আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল। আপনার অ্যাডভেঞ্চারের কথা অনেক শুনেছি। গিলগামেশকে প্রীত করার জন্যে ঠৌঁট টিপে হেসে বলল কুশাশ্ব।
মনে হল তেল লাগানোটা কাজে দিয়েছে। দাঁতখিঁচুনির বদলে দেঁতো হাসি হেসে গিলগামেশ বলল, দফতর শহরে আমারও কাজ আছে, সেখানেই যাব, কিন্তু কিসে চেপে কী ভাবে যাব জানি না।
আপনাকে কি পচাঞ্জন সরদার যেতে বলেছে? নৈকত্য বাড়াবার চেষ্টা করল কুশাশ্ব।
হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন? সিংহ-মারা তেজ বাদ দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল গিলগামেশ।
আমাকেও হুকুম করেছে। আপনার সঙ্গেও কি তুই-তোকারি করেছে?
হ্যাঁ, ওনারা দলতন্ত্রের অধিকার প্রয়োগ করছেন। অপহসিত হাসি হেসে বলল গিলগামেশ।
অবাক হল কুশাশ্ব। গিলগামেশ বলে কথা। যে কিনা খালি হাতে সিংহ মারে। তার সঙ্গেও তুইতোকারি। কত ক্ষমতা অছিসিংহাসনের, বাপরে বাপ, ওই ক্ষমতার জোরে কালো-কেল্টে ঘুরঘুরে পোকাও রোয়াব ঝাড়ছে।
কুশাশ্ব নিজের ফরমুলা শুনিয়ে কোনদিকে যেতে হবে সে-বিষয়ে মতামত জানাল। গিলগামেশ বলল, ও-ও ওই দিকটাই নিজের বৈজ্ঞানিক ফরমুলা প্রয়োগ করে বাছাই করেছে, যেটা ও সিংহ শিকারের আগে পরীক্ষা করে নিত। ফরমুলাটা হল, ‘গোদা নাটাটা পা ফাটাটা অড়ল বনের ধারে কুচুৎ করে কানটি কেটে নুনের ভাঁড়ে পোরে।’ আলুর দম আর ভাঁড়ে পোরা একটিই দিক নির্দেশ করছিল। সেদিকে যাবার একটা জিপ-ট্যাক্সি এসে থামল, প্যাসেঞ্জারে এমন গাদাগাদি যে কার মুখ কোথায় আর ঠ্যাঙ কোথায় টের পাবার উপায় নেই।
ওরা দুজনে পেছন থেকে ডাইভ দেবার ঢঙে গোঁতা মেরে জোরজবরদস্তি ঢুকল জিপ-ট্যাক্সির ভেতরের ঠাসাঠাসি ভিড়ে। হাফশয়নম-হাফপতিতম অবস্হা । ধাতস্হ হতে টের পেল, এটা মহিলাদের স্পেশাল ট্যাক্সি। ততক্ষণে কিল-চড়-থাপ্পড়-ঘুষি-লাথি আরম্ভ হয়ে গেছে। গিলগামেশ কানেকানে কুশাশ্বকে বলল, দেবনাথবাবু, যেতে তো হবেই, দফতরের হুকুমের টালাবাহানা করার যে কি বিপদ তা তো জানেন। তাই বলে মহিলাদের হাতে প্যাঁদানি খেলে ইতিহাস আমায় আস্ত রাখবেনা; আমার খালি হাতে সিংহ মারার খ্যাতি সব জলে যাবে। এমনিতেই ইতিহাসকাররা আমাকে কুরে-কুরে গবেষণা করে এরকম রোগাপাৎলা করে দিয়েছেন।
জুতো খুলে, গিলগামেশের কব্জি শক্ত করে ধরে কুশাশ্ব পরামর্শ দিল, আমি এক দুই তিন গুনছি। তিনের মাথায় একসঙ্গে ছোট্ট হয়ে যাবো দুজনে। ওকে? রেডি, এক…দুই…তিন ।
নিমেষে ছোট্ট হয়েই, খোলা স্প্রিঙের মতন বিঘত খানেক লাফিয়ে এক যুবতীর দুই স্তনের মাঝখানে দুজনে হাত ধরাধরি করে পিছলে পড়ল। কাতুকুতু হেসে যুবতীটি পাশের মেয়েটিকে বলল, অ্যাই, ভালো হবে না বলছি। পাশের মেয়েটা বলল, ওমা, আমি আবার কী করেছি!
স্প্যাঘেটি-স্ট্র্যাপ টপের ভেতরে পড়ে দুজনে পিছলে নেমে আটকে গিয়েছিল পুশ-আপ ব্রাতে। টপের কাপড় ধরে ঝুলতে-ঝুলতে ওরা উঠে বাঁধুনি আঁকড়ে শুনতে লাগল যুবতীদের কথাবার্তা। দেখতেও পাচ্ছিল যুবতীদের, উঁকি দেয়ে। বোধহয় স্নাতকোত্তর ছাত্রী। কিংবা মডেল-মেয়ের দল চলেছে কোনো হোটেলে র্যাম্পের ওপর বিল্লিহাঁটন দিতে।
—-জলজ্যান্ত দু-দুটো মরদ, বেমালুম উবে গেল যে রে। বলল, হল্টারনেক।
—-এরা দুজনে মিলে কিলোচ্ছিল-লাথাচ্ছিল। অভিযুগ তুলল সি-থ্রু আকাশি ব্লাউজ।
—-কিলোব না তো কি! লেডিজ স্পেশালে ঢুকবে আর পার পেয়ে যাবে! আবদার নাকি? বলল বাদামি ডাংগারি।
—-কারেক্ট। পিটিয়েছি, ঠিক করেছি। বিকটহাসি হেসে বলল জরিরকাজ শিফনশাড়ি।
—-দ্যাখ, তোরা দুজনে লেসবিয়ান-সতীত্ব ফলাসনি। বলল স্প্যাঘেটি-স্ট্র্যাপ। বুক দোল খাওয়ায় কুশাশ্বর হাত আরেকটু হলেই ফস্কে যাচ্ছিল।
—-ভালো বলেছিস, লেসবিয়ান-সতীত্ব! বাঁকা হাসি হেসে বলল প্লেনটপ সোয়ারস্কি জিনস।
—-সঁতীত্বেঁর শ্বেঁতপদ্ম। সামীচন্দ্র লীলাবতী। বলল ব্যাকলেস-চোলি।
—-সত্যি! দু-দুজন জোয়ান, দুরকম টাইপের জোয়ান, হাতছাড়া হয়ে গেল। একটু ফস্টামি-নষ্টামি তো করা যেত রাস্তার বোরডাম কাটাতে। একগাল হেসে বলল ডিপ-নেক অরগ্যান্ডি।
খুব জোর বেঁচেছি, বলল গিলগামেশ। তারপর যোগ করল, আমি যতরকম অ্যাডভেঞ্চার সম্ভব করেছি কিন্তু কখনও নারীগর্ভে ঢুকে অ্যাডভেঞ্চার করিনি। দেবনাথবাবু, এক কাজ করুন। দুজনে এক-একজন লেসবিয়ান সতীর গর্ভে ঢুকি। কী বলেন?
মনের মতন প্রস্তাব পেল কুশাশ্ব। বলল, আপনি ওই জরিরকাজ শিফনশাড়িতে আশ্রয় নিন। আমি যাচ্ছি বাদামি ডাংগারির ভেতরে। দুজনের একজন অন্তত তো যাবে দফতর শহরের দিকে।
চিলতে কাগজের মতন নিজেকে গুটিয়ে গিলগামেশ চলে গেল নিজের বাছাই করা সলোমান মাইন্সে অ্যাডভেঞ্চার করতে। পায়ের ধুলো ঝেড়ে, গুটিপোকার কায়দায় তিড়িকিনাচন দিয়ে কয়েক লাফে কুশাশ্ব পোঁছোল তীর্থক্ষেত্রের দরজায়।
সৌ মী আ চা র্য্য
আলোর বেণু
(১)
এমন বৃষ্টিদিনে কাঁপন আসে।পৃথিবীর গভীরে জাগে আদুরে গন্ধ। মাটিতে খড় মিশিয়ে মাখতে থাকে ব্যাস। বনেদী বাড়ির দুর্গামণ্ডপে আলো জ্বললেও বাইরে অন্ধকার ঝেঁপে এসেছে।
-মাটি ছানতে আমার ভালো লাগে।
মুখ তুলে তাকিয়ে এ বাড়ির মেয়ে ঐন্দ্রীকে দেখে হতচকিত হয় ব্যাস। বৃষ্টি রাতে চুল খুলে একা ভিজে গায়ে এসে দাঁড়িয়েছে বড়!ভয় নেই! ব্যাস কপট রাগে বলে,"নাহ্ ঋতুমতী মেয়েদের মূর্তি তৈরীর মাটি ধরতে নেই।"আহত চোখে বিষন্নতা গভীর হয়।
-মা কেবল তোমাদের তাইনা!বেশ তালে তোমার মাকে আমি দেখতেও আসবো না আর।
ছপছপিয়ে ছুট্টে পালায়। কত বয়স হবে? সতেরো আঠারো!এ বয়েসেও এমন বাচ্চাদের মতো অভিমান থাকে নাকি? ব্যাস মন দিয়ে বিচুলিতে সুতলি বাঁধে।মাটি চাপিয়ে তবে জলে ঘষে তোলে হাতের এঁটেল মাটি।মণ্ডপের সাথেই ছোট্ট ঘর।একটা চৌকি দু একটা বাসন স্টোভ।রাত কত হবে কে জানে!বাবার সাথে ছোটবেলায় প্যালা দিতে আসতো।এখন রাতটুকু একাই কাজ করে।দিনে শম্ভু থাকে সাথে।ফ্যানাভাত লঙ্কা দিয়ে মেখে খাওয়া শুরু করতেই আওয়াজ পায় ফিসফিস করে কথা বলছে যেন কেউ।গায়ে কাঁটা দেয়।উঁকি মেরে দেখে মেয়েটা একমনে মাটিতে জল মিশিয়ে ছানছে।
-আমি জানি তুমিও ঋতুমতী।তুমি আমার মতোই।আচ্ছা তোমায় শিবঠাকুর আসতে দিতে চায়না বলে কাঁদছো তাইনা!তাই এতো বৃষ্টি হচ্ছে!বর গুলো এমন বাজে কেন হয়?মেজদির বর ওকে পুজোতে বাড়ি আসতে দেয়না।বলেছে বিয়ে হলে শ্বশুর বাড়িতেই থাকতে হয়।ইস্ নিজের বাড়ির পুজো ছেড়ে অন্যের বাড়ি থাকা যায় বলো!আমি বিয়েই করবো না।
ব্যাসের সারা হাতে ভাত।মেয়েটার মাটি।কারো অস্তিত্ব অনুভব করে তাকাতেই লালচে বাল্বের আলোয় দীর্ঘদেহী যুবককে দেখে হঠাৎ ছুট্টে পালায় মেয়েটা।কি এক টানে মণ্ডপ থেকে দালান বাড়ির অন্ধকার পথটুকতে তাকিয়ে থাকে ব্যাস।বৃষ্টি থেমে গেছে বহুক্ষণ।আকাশে গুটিগুটি পায়ে ভীড় জমিয়েছে তারার ঝাঁক।চৌকিতে শুয়ে এফ এমটা চালায়।গান ভেসে এসে চিনচিনে আবেশে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ওকে।দালানবাড়ির দোতলার ঘরে বুড়ি ঠাকমার গা ঘেঁষে শুয়ে আকাশ পাতাল ভাবে ঐন্দ্রী।লোকটার নির্মেদ খালি গা,সকড়ি হাত আর বিস্মিত চোখদুটো মনে পড়ছে কেবল।কি যেন দেখে নেয় ঐ চোখ দিয়ে।যা কাউকে কখনো দেখানোর কথা ভাবেনি তাই হয়তো!তার একলা মন।ঠাকুমাকে সাপটে ধরে।
-ও পালদা দরজা খোলো কি ঘুম রে বাবা!পালদা,ও পালদা।
শম্ভুর ডাকাডাকিতে দরজা খুলে বাইরে আসে ব্যাস।বৃষ্টির দানার উপর আলো পড়ে ঝকঝক করেছে গাছের পাতা।মন ভালো করা সকাল।আজ মায়ের মুখের ছাঁচে মাটি দিতে হবে।রাতে যে মাটি মেখেছিল মেয়েটা সেই মাটিতে হাত দিল।আশ্চর্য নরম,পেলব।ঢেলার কণা মাত্র নেই।ঐ মাটি দিয়েই ছাঁচ ভরলো।বারবার পেছন ফিরে খুঁজতে লাগলো মেয়েটাকে।
-কি পালদা!কি দেখছো বারবার পিছনে?
-কিছুনা,তুই নিজের কাজ কর তো।
মেয়েটা সন্ধ্যের সময় থেকে রাত অবধি ঘুরঘুর করে কিন্তু দিনে এমুখো হয়না।কেন কে জানে? আর মাত্র কুড়িটা দিন এর মধ্যেই সব কাজ সারতে হবে।মনের ভেতর এক অজানা চঞ্চলতা কাজ করছে।সূর্য ডোবার এত অপেক্ষা আগে কখনো হয়নি।পুরোহিত মশাই দুপুরে পুজো করতে এসে রোজই ব্যাসের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করেন।
-তুমি তখন পেটে,তোমার বাবা বললো 'ঠাকুর মশাই বাচ্চার নাম বলেন।'আমি বলেছিলাম ভূমিষ্ট হলেই নাম রাখবো।তুমি এলে নাম দিলাম ব্যাস।তোমার শিল্পী আঙুল দেখে মনে হয়েছিল তুমি নতুন কিছু রচনা করবেই।
-নাহ্,সে আর পারলাম কই ঠাকুর মশাই!সব তো শেষ হয়ে গেল।
-নারে বাবা যতক্ষণ আছো কিছুই শেষ হয়না।আমি শুনেছি আর্ট কলেজে পড়ার ইচ্ছা ছিল,সে তোমার হলো না।কি করবে বলো ভগবান টাকা পয়সা সকলকে দেননা।আবার সব দিয়েও নিঃস্ব করে রাখেন।এই যে দুগ্গ্যি মানে ঐন্দ্রী,ওর নামটাও আমারই রাখা।মেয়েটা জন্মেই জানলো ও অপয়া।কারণ ওকে জন্ম দিয়েই ওর মা মরলো,সেদিনই ওর বাপটা তাড়াহুড়ো করে হাসপাতালে যেতে গিয়ে লরি চাপা পড়লো ফলে জোড়া অপয়ার দায় পড়লো মেয়েটার।
-হ্যাঁ শুনেছিলাম কিন্তু অপয়া ব্যাপারটা জানতাম না।
-ওরে বাবা!বাড়ির কর্তারা সব কাজে বেরলে তবে ও ঘরের বাইরে আসার অনুমতি পায়।সকালে ওর মুখ দেখতে কেউ রাজি নয়।
-কি বলছেন ঠাকুরমশাই?
-হ্যাঁ ঐ জন্য মেয়েটা রাত বিরেতে এদিক ওদিক ঘোরে আর বেলা অবধি ঘুমায়।ঐ কর্তামা যতদিন আছেন ততদিন ওর এই বাড়ির ভাত আছে তারপর কি হয় কে জানে?অথচ সম্পত্তি ওর বাবাই সবচেয়ে বেশি বাড়িয়েছিলো।
-আর পুজোর সময় মেয়েটা কি করে তবে?
-সারা রাত টোটো করে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়।ভোররাতে ঘুমাতে যায় আর দুপুরের ভোগারতির সময় এই মন্ডপের কোণায় বসে কাঁসর বাজায়।এবার বলো বাবা কে বেশি অভাগা তুমি না দুগ্গ্যি!কার সব কিছু শেষ হয়ে গেছে!ওর চোখের দিকে তাকালে বুঝবে কি ভীষণ যন্ত্রণা গোপন করে আছে মেয়েটা।
-আচ্ছা ঠাকুরমশাই সত্যি ও অপয়া!
-জানিনা বাবা!একবার লক্ষ্মীপুজোর রাতে মাথা ঘুরে নিত্যানন্দের ধানকলের সামনে পড়ে গিয়েছিলাম।সারাদিন উপোস।বড্ড ধকল যাচ্ছিল।চোখ খুলতেই দেখি আমার মাথা কোলের উপর নিয়ে ভেজা ওড়না দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা।আমি উঠে বসতেই বললো,'তুমি মরলে বামুনদিদা বিধবা হবে।পাড়ায় অন্য কোনো নতুন পুরোহিত আসবে।তুমি গিয়ে চিতায় উঠবে।তাই বলছি একটু নিজের কথা ভাবো।তোমার শরীরের ভেতর ঠাকুর নেই!তাকে কষ্ট দাও কেন?'এই বলে ক্ষেতের আলে নেমে গেল।আকাশে কোজাগরীর চাঁদ জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে।যে হেঁটে যাচ্ছে তাকে আমার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ব্যতীত আর কিছু মনে হয়নি!
ব্যাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই দৃশ্য কল্পনায় মগ্ন হল।লক্ষ্মীর শরীরে মাটি চাপাতে গিয়ে কেঁপে উঠলো।ছিঃছিঃ এটা সে কি করলো!প্রতিমা থেকে হাত সরিয়ে ছুটে গিয়ে বসলো চাঁপা গাছটার নীচে।থরথর করে কাঁপছে ওর শরীর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ঘৃণায় যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে ফেললো।বাবা বলতেন,"মেয়ে শরীর নয় ব্যাস এ হল দেবী মূর্তি।বুক,পেট আসলে আশ্রয়,সৃষ্টি। যতদিন মনে কু আসবে না মায়ের শরীর বানাতে পারবি।"তবে কি আর কখনো প্রতিমা আসবে না ব্যাসের হাতে!সন্ধ্যা নেমে আসে অজ্ঞাতসারে।শম্ভু যাবার আগে বহুবার ডাকলেও মন্ডপে ফেরেনা ব্যাস গাছের নীচে বসে থাকে পাথরের মতো।
-জানিনা বাপু তোমার কি হয়েছে?লক্ষ্মীর গায়ে আদদেক মাটি দিয়ে এসে সেই যে বসেছো তো বসেছো।আমি কোনরকম লেপেছি নইলে শুকিয়ে কাঠ হতো।চললাম আমি।
টপটপ করে চোখ দিয়ে জল গড়ায় ব্যাসের।সারা বছর কোলকাতার এক শাড়ি কারখানায় ডিজাইন করলেও এই পুজোর একমাস যখন কাজের সবচেয়ে বেশি চাপ ব্যাস চলে আসে এখানে।ভালো কারিগর বলে মালিক তাড়াতে পারেনা।মুখার্জি বাড়ির ঠাকুর তৈরী হয় ব্যাসদের হাতেই এটাই পরম্পরা।মাঝে কয়েক বছর বাবা একাই ঠাকুর তৈরী করেছে।নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে জীবনের পাঁচটা বছর দান করেছে সময়কে।চেষ্টা করেছে আর্ট নিয়ে পড়ার।পারেনি সফল হতে।তবে কোনদিন পাপের চিন্তা মনে আসেনি ওর।সাদামাটা জীবন,ঈশ্বরে অবিচল ভক্তি,আঁকা,মূর্তি তৈরী এই তার সম্বল।আজ প্রথমবার এমন বিপত্তি।নিজের সাথে কপটতা করবে কি ভাবে ব্যাস?নিজের মন থেকে কোথায় পালাবে?
-আজ কাজ করবে না?তোমার কি শরীর খারাপ?
সহসা ভীষণ রেগে হয়ে যায়।একটু চিৎকার করে বলে,"চলে যাও এখান থেকে।যাও বলছি।অপয়া মেয়েছেলে,আমার মনে পাপ এনে দিল,যাও বলছি।"
এত কঠিন বাক্যে ঐন্দ্রী থমকে যায়।কাল সারারাত যাকে মনে করতে ভালো লেগেছে আজ তার কাছ থেকে এমন কথা শুনবে কল্পনাই করতে পারেনি।ঠোঁটটা কামড়ে ধরে বলে,"আমার বাবা বেঁচে থাকলে তোমায় সাত ঘা মেরে আজই তাড়িয়ে দিত।আমি অপয়া হলে আমার ঠাকমা এতদিনে মরে যেত বুঝলে!রোজ সকালে আমার মুখ দেখে কপালে চুমু খেয়ে খাট থেকে নামে ঠাকমা।তোমার মন তোমার পাপকে জন্ম দিয়েছে আমি নই।"একথা বলেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল।ব্যাস অবাক হয়ে ভাবলো এই মেয়ের এত গভীর অনুভব!সত্যিই তো!পাপের দায় এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে সে কেন দিল?কেন?হাতজোড় করে মুণ্ডহীন মাতৃমূর্তির সামনে বসলো ব্যাস।
-আমার মনে যে ভাবনা এসেছে,সেও তো তোমার দান মা,তুমিই তো সর্ব শক্তিমান।আমায় তবে মন শান্ত করার উপায় বলে দাও।
-এসো আমার সঙ্গে।
চমকে ওঠে ব্যাস।মন্দিরের লালচে বাল্বের আলোয় খোলা চুলে দাঁড়িয়ে আছে কে?ঐন্দ্রী নাকি কোন দেবী?চোখ নামিয়ে নেয় ব্যাস।ভীষণ কুন্ঠা হচ্ছে তার।মেয়ের চোখে কোনো দুঃখ নেই।
-আমার সাথে এসো অত ভেবো না।
আগে আগে হেঁটে চলা ছায়ার পরনে সাধারণ স্কার্ট আর টপ।ঢালু পিচরাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে দুজন।একটু তফাৎ রেখে।পুকুরঘাটে অন্ধকারের মধ্যে অসংখ্য আলো আলপনা দিয়ে চলেছে।পোকাদের উল্লাস তীব্র।মেয়েটা গিয়ে বসলো মাচার উপর।ঘোলাটে সরের ভেতর দিয়ে তাকিয়ে আছে ব্যাস।
-তোমার যা দুঃখ এই জলের কাছে,অন্ধকারের কাছে বন্ধক রেখে দাও।দেখবে মন হালকা হবে।বলো বলে ফেলো।
-আমার পাপের কথা জোরে উচ্চারণ করা যায়না।
-জোরে বলতে সাহস লাগে।হয় তুমি সত্যি বলবে নয় মিথ্যে।তাই জোরেই বলো নাহলে পাপ কমবে না।
ব্যাস ইতস্তত করতে থাকে।ঐন্দ্রী বুঝতে পারে লোকটা বলতে পারবে না।আসলে তো ভালো লোক।এখনো মনে আছে ওর ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরা লোকটাকে পাল জ্যেঠুর সাথে কাজ করতে দেখেছিল।সবাই খেলতো,হৈ চৈ করতো আর ছেলেটা একমনে ঠাকুর বানানো দেখত।কে জানে এবার মায়ের মুখ লোকটা কেমন বানাবে?পালজ্যেঠুর কি যে হল ঝুপ করে মরে গেল।ঠাকমা বলেছিল,'এই হল কপাল বুঝলি দুগ্গ্যি!মায়ের সেবা করে যে তার কখনো খারাপ হতে পারেনা বুঝলি।আমিই হলাম পাপী তাই ছেলে,ছেলের বৌ খেয়েও বেঁচে আছি।'ঐন্দ্রী জানে ঠাকমা কেন বেঁচে আছে।তারজন্য,তাকে কার কাছে রেখে মরবে ঠাকমা?
-জানো আমার বাবা মরেনি বেঁচে আছে।
-মানে?
-হ্যাঁ গো জ্যেঠু বলেছে।আমি হুবহু তার মতো দেখতে।আমার বাবা গোকুলপুরে থাকে।মায়ের পুরোনো নাগর।সেই নাকি আমার বাবা।তাই এবাড়ির কোনকিছু আমার নয়।আমার বাবা মার ঘরটাও আমার না।আমার মার কচুরীপানা রঙের বেনারসিটা ফুলদি পরে ছিঁড়ে এনেছে।ঠাকমা রাগ করলো।বললো,'কি রে যুগল দুগ্গ্যির মায়ের বেনারসিটাও মেয়েটার জন্য রাখলি না তোরা?'ব্যাস্ ওমনি জ্যেঠু বললো,'ঐ অপয়া মেয়ের মায়ের নাগরকে কিনে দিতে বল।মেয়েটা কার সবাই জানে।এবাড়ির কোনো জিনিস এই মেয়ের না।'ঠাকমা কাঁদলো।আমি পুচিকে নিয়ে খেলতে লাগলাম।পুচি আমার বেড়াল।
ব্যাস বুঝলো মেয়েটাকে সম্পত্তি থেকে বেদখল করার চমৎকার ফন্দি আঁটা হয়ে গেছে।একে অপয়া তায় জন্মে দাগ।বুকের মাঝখানটায় কি যেন হচ্ছে।
-চলো ঐন্দ্রী বাড়ি ফিরি।আমায় ঠাকুর বানাতে হবে এখনো অনেক কাজ বাকি।
-তুমি তাহলে পাপের কথা বললে না!
-আমার মনে কোনো পাপ নেই,সব ধুয়ে মুছে গেছে।যেটুকু অস্বস্তি আছে মা দুর্গার কাছে বলে নেব।চলো।
-তুমি আমায় ঠাকুর গড়া শেখাবে?আমি যদি মা দুর্গা গড়তে পারি আর কেউ অপয়া বলতে পারবে না।
-কোন বাড়ির ঠাকুর গড়বে ঐন্দ্রী?
-কেউ দেবেনা না আমায় না?
-এখানে হয়তো দেবে না কিন্তু কোথাও দেবেনা এমনটা বলা ঠিক নয়।
এরপর সারারাস্তা মেয়েটা কথা বলেনা।মন্ডপে এসে ব্যাসের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
-আমায় মাটি ছানতে দেবে?সন্ধ্যার পর তোমার স্যাঙাৎ তো থাকে না।আমায় নাও না সাথে?নেবে?
-তুমি পড়াশোনা করো না?
-আমার মাটি,বিচুলি,রঙ ভালো লাগে।আমি কত বৌ বর মাছয়ালা বদ্দ্যি বুড়ো বানিয়েছি দেখবে?দাঁড়াও আনছি।
ব্যাস অবাক হয়ে অপেক্ষা করে।এত মায়া কেন হচ্ছে তার প্রায় অজানা মেয়েটার জন্য?একটা ছোট্ট ঝুড়ি কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আসে উৎস্যুক দুটি চোখ।মুগ্ধ হয়ে দেখে ব্যাস।কি ভীষণ যত্নে গড়া।
-কেমন হয়েছে?খুব খারাপ?
ব্যাসের মনে পড়ে ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজের প্রফেসার ডি.কে মৈত্রকে।ব্যাসকে বলেছিলেন,"আমার ওয়ার্কশপে জয়েন করো।ডিপোজিট লাগবে পঞ্চাশ হাজার।তোমার যা স্কিল এক বছরের মধ্যে তার ডবল টাকা পেয়ে যাবে গ্যারান্টি।ওসব কলেজে পড়ে যা হবে তারচেয়ে অনেক বেশি উপার্জনের রাস্তা পাবে।"কথাটা বাবাকে জানিয়েছিল।আর তারপর সবটাই থেমে গিয়েছে।বাড়ি বন্ধক দিয়ে টাকা দেবার কথা চিন্তা করতে গিয়েই প্রবল মানসিক চাপে মাথার শিরা ছিঁড়ে ঘুমের মধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে বাবা।পাল থেকে স্কাল্পচার অবধি জার্ণিটা শেষ হয়েছে অচিরেই।আজ একটা সম্ভাবনা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে।এই চেষ্টাটা তাকে করতেই হবে।
(২)
সব শুনে ঠাকুরমশাই চুপ করে থাকলেন।একটা কঠিন কাজ তবু চেষ্টা করতে ইচ্ছে হচ্ছে।ব্যর্থতার দায় নিতে তিনি রাজি।ব্যাসের মাটিমাখা আঙুলে গঙ্গাজল ধোঁয়া হাত রাখলেন।
-তুমি কি ভেবে দেখেছো বাবা তোমার ঝুলিতে শূন্যতা স্হায়ী বসত করতে পারে।
-আমি ফলের আশা করিনা ঠাকুরমশাই।আপনি ঐন্দ্রীর পুতুল গুলো দেখুন কি ভীষণ জীবন্ত।এই প্রতিভার অপমৃত্যু আমি মানতে পারছি না।
-তোমার নিজের কি এমন আয়?তাছাড়া কি পরিচয়ে ওকে রাখবে তোমার ভাড়াবাড়িতে সেটাও তো ভাবা দরকার।
-মাকে এবার সাথে নিয়ে কোলকাতা যাব ভেবেছিলাম।যদি ঐন্দ্রীকে ডি কে মৈত্রর কাছে কাজ শেখাতে ঢোকাতে পারি তাহলে মা আর ও ঘরে থাকবে আমি বারান্দায় থেকে যাবো।সম্পর্ক ঠিক বেরিয়ে যাবে।তাছাড়া দুবেলা দুমুঠো খাবার যোগাড় করতে সবাই ছুটছে যেখানে সেখানে কেউ সম্পর্ক নিয়ে ভাবেনা।
-জানিনা ব্যাস এরা দায় চিরদিনের জন্য ঝেড়ে ফেলতে এতগুলো টাকা দিতে রাজি হবে কি না!তবু চেষ্টা করবো।
-যা দিতে রাজি হবে আপনি সম্মত হবেন ঠাকুরমশাই।আমি দরকারে আমার বাড়ি বন্ধক দেবো।শুধু ওকে কোলকাতায় ভর্তি করার অনুমতিটা আনবেন।মেয়েটার জীবন হয়তো বদলে যাবে।
ঠাকুরমশাই স্মিত হেসে মুখার্জি বাড়ির ভেতরে চলে যায়।আজ মায়ের গায়ে প্রথম রঙ চাপাচ্ছে ব্যাস।মুখ যেন সাদা রঙ পেয়ে হাসছে।ভোরের শিউলি আলো।পুকুর ঘাটে দুপুরের খানিকটা সময় কেটে যাক একান্ত হেলায় এই ভাবনা নিয়ে শম্ভুকে আঙুলের রঙ চাপাতে দিয়ে কাঁধের উপর গামছা ফেলে ব্যাস।বনতুলসীর ঝোপ রঙিন হয়ে রয়েছে।প্রজাপতির দল দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করছে জোর কদমে।নারকেল গাছের সারির মধ্যে দিয়ে টলটলে জল দেখে মন ভালো হয়ে যায়।আকাশ এখানে দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়।পরিপাটি করে দেখে নিজের মুখ।ঘাটের পাড়ে বসে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে ব্যাস।
-আমার উপকার করার জন্য তোমায় কে মাথার দিব্যি দিয়েছে একটু বলবে?
নাকের পাটা ফুলিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে চুল ছেড়ে এ যে স্বয়ং চণ্ডী।রণং দেহি।অভিমান রাগ চোখের আগায়।এই মেয়ের মুখে মায়া খুঁজে পায়না কেন মুখার্জি বাড়ি?এর মুখ দেখলে যে সকাল ধন্য হয়ে যেতে পারে।
-কি হল বলো?আমি কেন যাব কোলকাতায়?আমি তোমার কাছে মূর্তি গড়া শিখতে চেয়েছিলাম অন্য কারো কাছে তো না।
-ঐন্দ্রী!তুমি জানো তোমার নামের মানে?
-নাহ্ জানিনা জানতে চাইও না।কিন্তু তুমি কে আমার থেকে আমার ঠাকমা,আমার পাড়া,আমার মাঠ,ঘাট কেড়ে নেবার?
-তুমি অনেক নাম করতে পারবে কোলকাতায় গিয়ে কাজ শিখলে।ঠাকুরমশাইয়ের কথায় তোমার জ্যেঠুরা সম্মতি দিয়েছেন।ওরা তোমায় এককালিন যত টাকা দেবে তাতে ভালো মতো তোমার শেখার খরচ চলে যাবে।
-আর থাকবো কোথায়?খাবো কি?
-সে দায়িত্ব আমার।
-কেন তোমার কেন?তুমি আমার কে?তাছাড়া আমি শুনেছি আমি আর কোনোদিন এ বাড়িতে পা রাখতে পারবো না।
-কে বললো তোমাকে?
-আমার সেজোজ্যেঠি।কড়াইয়ের পোড়া লাগা তরকারি দিয়ে রুটি দিচ্ছিল বললাম,এত পোড়া দিওনা জ্যেঠি তাতেই বললো,"আর এইবাড়ির পোড়া খাওয়া লাগবে না।রাজভোগ খেও কোলকাতা গিয়ে।এবাড়ি ঢুকলে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেবে সবাই।"
ব্যাস আশ্চর্য হয়ে গেল বড়বাড়ির নিষ্ঠুরতায়।আচ্ছা ভগবান এই বাড়ির ভোগ নেয়?এ যেন বিশ্বাস করতে মন চায় না।মেয়েটা কেন থাকতে চায় এখানে?
-এত কিছুর পরেও এখানে থাকতে চাও?
-হ্যাঁ চাই।আমার এই অপয়া হয়ে বেঁচে থাকাই কপাল।তুমি পাপের চিন্তায় সারাদিন মূর্তি গড়তে পারোনা আর আমায় সবকিছু থেকে উৎখাত করতে একবার ভাবলে না?
-আমি তোমার ভালো চেয়েছি ঐন্দ্রী।মায়া পড়ে গেছে তোমার উপর।তোমার শিল্পী সত্তার সঠিক মূল্যায়ন হোক এটাই চাই।চাই তোমায় যেন কেউ অপয়া না বলে।আমি তোমার ক্ষতি চেয়ে ঠাকুরমশাইকে বলিনি তোমার জ্যেঠুদের সাথে কথা বলতে।বোঝার চেষ্টার কর।
ঐন্দ্রী বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখে ব্যাসকে।যত রাগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল,ততটাই উপচে ওঠে চোখ।সারা শরীর এক অজানা আবেগে থরথর করে কেঁপে ওঠে।
-মায়া!আমার উপর তোমার মায়া হয়েছে?আমায় ঠাকুরের মাটি ছানতে দাওনি তুমি।আমায় অপয়া ভাবো তুমি।
-কে বলেছে?যে মাটি মেখেছিলে সেই মাটি দিয়েই মায়ের মুখ করেছি।বিশ্বাস করো আমি তোমায় অপয়া ভাবিনা।
-মিথ্যে কথা তাহলে আমায় তোমার সাথে রাখতে,তোমার সাথে ঠাকুর গড়তাম।এখান থেকে কোথাও যেতে হতনা আমায়।
ব্যাস এগিয়ে আসে ঐন্দ্রীর দিকে।ওর জলভরা চোখে কিসের গভীর ছায়া ভালো করে বোঝার চেষ্টা করে।সাহস করে ফর্সা রোগা হাতদুটো আলতো করে ধরে।
-আমার ভাঙাবাড়ি,বয়স্ক সাধারণ মা আর অনেকগুলো স্বপ্ন পূরণ না হওয়া হাহাকারের মাঝে জীবন ঐন্দ্রী!আমার সাথে থাকতে পারবে?
-আমার পুচির একটু জায়গা হবে তো তোমার বাড়িতে?ও আমার মতো অপয়া।কালো কুচকুচে রঙ।সবাই দেখলেই তাড়া করে।
-আর কিছু চাওয়া নেই তোমার।বড় হতে চাওনা?নামডাক,টাকা পয়সা চাওনা?
মাথা নাড়ে ঐন্দ্রী।ঠোঁটটা আলতো করে চেপে ধরে।হাতটা ব্যাস ছেড়ে দিতেই জাপটে ধরে হাত।অনুনয় করে বলে,"আমায় মূর্তি গড়া শেখাবে তো?"ব্যাসের খুব ইচ্ছা করে ওকে দুহাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে,পারেনা।
-আমি যতদিন মূর্তি গড়বো তুমিও থাকবে সাথে।কথা দিলাম।এবার হাতটা ছাড়ো বাড়ি যাও।আমি ঠাকুর মশাইকে গিয়ে তোমার মনের কথাটা বলি।
ঐন্দ্রী যেতে গিয়েও ফিরে চায়।ব্যাস দেখে ওর বাচ্চাসুলভ মুখে সহসা যৌবনের দুষ্টুমি খেলা করছে।অপরূপা হয়ে উঠে বলে,"আর তোমার মনের ইচ্ছা কি?"
-আপাতত ঠাকুর মশাইয়ের পরামর্শ নেওয়া।কারণ তুমি বামুন আমি কায়েত।আর তারপর একটা এমন রাস্তা খোঁজা যাতে তুমি সত্যি করে মূর্তি গড়া শিখতে পারো।রামকিঙ্কর বেইজের নাম জানো তো?
-জানিনা আমি কেবল ব্যাসদেব পালের নাম জানি।আর তারমতো জ্যান্ত দুর্গা গড়তে চাই।
আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আলো।একটা পানকৌড়ি ঝুপ করে ডুব দেয় অতলে।দূরের ধানক্ষেত দিয়ে গ্রামের ঢাকিরা বাজনার বোল তুলে এগিয়ে যায় স্টেশনের দিকে।পুজো চলে এলো যে।
ঋ ভু চ ট্টো পা ধ্যা য়
শুধু ছুঁয়ে থাকা
ঘরের ভিতরে ঢুকে বিছানার উপর বড় গোছানো ব্যাগটা দেখে প্রদীপ্ত একটু অবাক হয়েই স্মিতাকে জিজ্ঞেস করল, “কি গো ব্যাগটা এতো বড় করলে কেন?’’ স্মিতা চোখ দুটো একটু মুছেই প্রদীপ্তর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, ‘অনেক কিছু নিতে হল যে।’
একটু বিরক্ত হল প্রদীপ্ত, জিজ্ঞেস করল,‘এত কি নিলে ? ’
–রেনকোর্টই দুটো নিতে হল। তোমারটাও নিয়ে নিয়েছি।
–রেনকোর্ট কি হবে ? আর কিছু দেবে না ?
–নিজেরাই নিয়ে যাচ্ছি।প্রয়োজন হলে একটা ছেড়ে রেখে আরেকটা পরব।
-তোমাদের আলাদা কোন পোশাক দিচ্ছে না ?
–দিচ্ছে। আমি আলাদা নিয়ে যাচ্ছি ।
–ওরকম কেন বলছ ? মরবে কেন ? সব ঠিক হয়ে যাবে।
–এটা তুমি জেনে বলছ ? গ্লোবালি কতজন মেডিক্যাল পারসোনাল এফেক্টটেড হয়েছেন জানো ? কত জন মারা গেছেন ? আমার ছোট ছেলে। কিছু হয়ে গেলে....
স্মিতা কথা বলতে বলতে বিছানায় বসে তার এক বছরের ঘুমন্ত ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল। আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমন সময় ফোনের রিঙ্গটা বেজে উঠতেই দেখল,‘সুলেখা কলিং।’ একটু বিরক্ত হয়েই বলে উঠল,‘এর আবার কি হল ? ’
ফোনটা রিসিভ করে খুব ভালো ভাবেই,‘হ্যাঁ, বল।’ বলে পাশের ঘরে চলে গেল। দরজার কাছ থেকে প্রদীপ্ত তার হাতের দুটো ব্যাগের একটা ব্যাগ স্মিতার ব্যাগের কাছে রেখে বেসিনে হাত ধুয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। বাইরে এসে দেখল স্মিতা, বাবুর মাথার কাছে বসে থাকলেও চোখ মুখটা হঠাৎ করে ছোট হয়ে গেছে।একটু অবাক হল প্রদীপ্ত,‘আবার কি হল?’ জিজ্ঞেস করতেই একটা লম্বা শ্বাস টেনে উত্তর দিল,‘সুলেখা একটা সমস্যায় পড়ে গেছে।’
–ওর আবার কি হল ?
–ও তো কয়েক দিনের ছুটি নিয়েছিল।ওর মা গ্রামের বাড়িতে গেছেন। কি সব ঠাকুর সেবা আছে।এদিকে কাজের মেয়েটিও আর আসতে পারছে না।ওদিকে ডিউটিতে জয়েন করতে বলেছে।সেই ভাবছে ওর ছেলেটা কোথায় থাকবে ? এক আধ দিন তো নয়, এক্কেবারে পনেরো দিন।
–কোন আত্মীয় বাড়ি নেই ? ওখানেই দিয়ে আসুক।
–আত্মীয় বলতে তো শুধু বাপের বাড়ি।অশোকদার মারা যাবার পর শ্বশুর বাড়ির কেউ যোগাযোগ রাখে না। সুলেখা বলছিল যদি এই কটা দিন এখানেই থাকে ? মানে বাবুর সাথে…. ।
–বাবুর সাথে মানে ?
প্রদীপ্তর কথাগুলো শুনে স্মিতা মাথাটা তুলতেই দেখল কিচেনের স্পেশটা থেকে প্রদীপ্ত তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।স্মিতার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না।কিছু সময় পর একটা ঢোঁক গিলে উত্তর দিল, ‘ওর বাপের বাড়িটাও তো কাছে নয়।’
–তোমাকে কত দিন ওখানে থাকতে হবে ?
-পনেরো দিন।
–দু’ সপ্তাহ !
-তুমি শুনেই সেদিন বললে,‘দুসপ্তাহ আবার কি? দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাবে। আগের বছর ট্রেনিংএ গেলে, সেটাও তো দশদিনের ছিল।’ আজ আবার এমনি বলছ।
প্রদীপ্ত চুপ করে গেলেও মাথার ভিতরটা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। বন্ধুরা শুনলে এক্ষুণি বলবে,‘তখন তো কাঠ খেয়েছ এখন তো আমড়া.....’
–তুমি কি এখন আর চা খাবে ? স্মিতাকে জিজ্ঞেস করল।
কথাগুলো শুনেই স্মিতা একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,‘সাড়ে নটা বেজে গেল। দশটায় খেয়ে নেবো। সাড়ে দশটায় এখানে গাড়ি আসবে বলছে।’
-কোথা থেকে তোমাদের তুলবে ?
-এই সামনের থেকেই।
-ভলবো আনবে ?
‘ভলবো! দেখবে ঐ পৌরসভার কুকুর তোলার গাড়িগুলো এনেছে।’ বলেই মুচকি হাসল স্মিতা।
প্রদীপ্ত চা করতে করতে বলল,‘জিনিসের দাম চড় চড় করে বাড়ছে। এই মাসে বেতন পেলেও সামনের মাসে মনে হয় না পুরো বেতন ঢুকবে। তখনই বাঁশরে লক্ষণ।’
স্মিতার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে একাই সোফার উপর বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই চারদিকটা আর একবার দেখে নিল।এক বছরের ছেলেটার জন্যে স্মিতা বিভিন্ন ভাবে ম্যানেজ করে হাসপাতালে ডিউটি করে।এবারেও বহু চেষ্টা করলেও লাভ হয় নি।বেচারার ভাগ্যটাও এমন বিয়ের পর শাশুড়িকে মাথায় করে রাখলেও বেশি দিন যত্ন করবার সুযোগ পেল না।বাবু জন্মাবার আগেই ফুটুস ডুম।একটা ননদ থাকলেও সে এখন অন্য রাজ্যে ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে। ফোন ছাড়া দু তিন বছর অন্তর একবার করে সশরীর সাক্ষাৎ। জীবনটা এখন স্কুল, বাড়ি আর বাজারের মধ্যেই ঘুরছে। নিজের বন্ধু বান্ধবরাও সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবার জন্য সেরকম আর কারোর সাথেই যোগাযোগ নেই।
–তুমি এত খাবার কিনলে কেন? বিস্কুট, কেক, এত কে খাবে, তুমি ?
প্রদীপ্ত একটু চমকে উঠে স্মিতার দিকে তাকিয়ে বলল,‘তুমি রেডি!এই বললে দশটায় খাবে।?’
–রেডি হয়ে গেলাম।
–এগুলো সব তোমার জন্য।
-আমার জন্য! খাবো কখন? ওখানে খেতে গেলে আলাদা ঘরে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে, হাত পা ধুয়ে তবে খাওয়া। তুমি যখন বাজারে গেছিলে রুনুদি ফোন করে বলল। ফোনটাও অন্য রুমে রাখতে হচ্ছে। টয়লেট করতেও যেতে পারছে না।
-সর্বনাশ! তাহলে তো তোমরাই অসুস্থ হয়ে যাবে।
-না ঐ তিনঘন্টা পর পর তিরিশ মিনিটের ব্রেক দিচ্ছে। তখন কি করব কে জানে? খাবো, না ফোন করব, না টয়লেট যাবো ?
-ও, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি, আজ ফাইভ বি ফ্ল্যাটের পোদ্দারদা গেটের মুখটাতে দাঁড় করিয়েছিলেন।
–কোন পোদ্দার ?
–আরে ঐ যে শর্ট হাইট, মাথায় টাক আছে।
-কি বলছিল ?
জিজ্ঞেস করছিল, ‘বৌদি এখনও হসপিটালে কাজ করেন ? ওনাদের কি এই সময় যেতে হচ্ছে ?’
-ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছিল। অর্চনাদির কমপ্লেক্সে তো বাইরেই পরিষ্কার নোটিশ টাঙিয়ে দিয়ে বলেছে,‘একমাস এই কমপ্লেক্সে ঢুকবেন না। ’ওদের কমপ্লেক্সে একটা ফ্যামিলিকে আইসোলেটেড করে রেখেছে। স্মিতা উত্তর দিল।
আমি ‘কেন?’ জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল,‘না মানে আমাদেরও সেফটি নিয়ে একটু তো ভাবনা হচ্ছে।’ প্রদীপ্ত বলল।
-ঠাস করে একটা চড়িয়ে দিতে হয়।খুব শয়তান লোক ওটা।একটা প্রাইভেট স্কুলের মালিক।এখানে একটা ফ্ল্যাট আছে, কোথায় একটা বড় বাড়ি তৈরী হচ্ছে। অথচ স্কুলের টিচারদেরই পেমেন্ট দেয় না। আমাদের এক কলিগের বোন ওর স্কুলে কাজ করে। কিছু বলনি তুমি ?
আমি পাশের কমপ্লেক্সটা দেখিয়ে বললাম,‘ওখানে অনেক ডাক্তারবাবু থাকেন, তারা প্রত্যেকে হাসপাতালে কাজ করেন।’
–আরে ওর নিজের ছেলেটাই বাইরে পড়ে। একুশ কি বাইশ বছর বয়স। এখনই বিয়ে করে নিয়েছে।
একটু চুপ থেকে আবার বলে উঠল, ‘ সবাই এমন করছে যেন আমরা পকেটে করে ওগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। অথচ যে দেশ এইগুলো করল একটু ঠিক হলেই দেখবে ওদের চেলাগুলো একটা কৌটো নিয়ে ত্রাণে বেরিয়ে যাবে।কেউ একবার আমাদের কথা ভাবছে না। এই এক বছরের বাচ্চাকে রেখে পনেরো দিন ধরে ডিউটি করব, মুখের কথা। ’
–আচ্ছা তুমি ক’দিনের রান্না করে দিয়েছ ?
–পাঁচ ছ’দিন হয়ে যাবে।
-আর বাবুর দুধ!
কথাগুলোই শুনেই স্মিতা থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।বিছানার কাছে এসে ঘুমন্ত ছেলেটা মাথায় হাত বুলিয়েই ফুঁপিয়ে উঠল।প্রদীপ্ত তাড়াতাড়ি স্মিতার কাছে গিয়ে তাকে কাছে টানতেই স্মিতা প্রদীপ্তের বুকে মাথা গুজে ডুকরে কেঁদে উঠল।প্রদীপ্ত মাথার পিছনে হাত দিয়ে বলে উঠল,‘কাঁদছ কেন? তুমি একটা নোবেল মিশনে যাচ্ছো সোনা, কাঁদতে নেই।’
-আমি যদি আর না ফিরি ?
–দূর খ্যাপা। ফিরবে না কেন ?
-না গো, অন্য দেশে কত জন ডাক্তার, নার্স, টেকনিসিয়ান....।
–তোমার কিচ্ছু হবে না। আমাদের কারোর কিচ্ছু হবে না, দেখো।
-কিছু হয়ে গেলে তুমি একা বাবুকে বড় করতে পারবে তো ?
-সোনা অমন কথা বলতে নেই। কারোর কিচ্ছু হবে না।
স্মিতা প্রদীপ্তের বুক থেকে সরে সোফাতে বসেই বলে উঠল, ‘আমার কাছে কয়েক দিন আগেই একটা ছবি এসে ছিল। কোন কোন দেশের এক ডাক্তার যখন বুঝতে পারলেন আর বাঁচবে না, তখন নিজের বাড়ির বাইরে থেকে ছেলে বউএর সাথে শেষ দেখা করতে এসেছিলেন। আমার কিছু হলে একবার নিয়ে আসবে তো ?
–উফঃ, তুমি বড্ড বেশি ইমোশেনাল, চাকরি ছেড়ে দাও।আমাদের ভোটের ডিউটিতে যেতে হয় না। সেখানেও তো কত ঝামেলা। যেকোন সময় মারপিট লেগে যায়। আমি কোন দিন ভয় পেয়েছি ? পনেরোটা দিন দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
কথাগুলো বলেই একটা শ্বাস ফেলল প্রদীপ্ত। তারপর ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘নাও,তুমি এবার খেতে বোসো। দশটা বাজছে।’
ফোনটা আবার বেজে উঠতেই স্মিতা দেখল ‘সুলেখা কলিং।’ স্মিতা একটু পাশে সরে ফোনে কথা বলল।প্রদীপ্তের কানে টুকটাক শব্দ এলেও শোনবার চেষ্টা করল না।স্মিতা কিছু সময় পর প্রদীপ্তের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,‘তাহলে সুলেখাকে কি বলব ?’
আবার একটা লম্বা শ্বাস ফেলল প্রদীপ্ত। কিছু ক্ষণ পর বলল,‘কি বলি বল তো ? তুমি আমার রান্না করে দিয়ে যাচ্ছো। ধর আমি একা ছ’দিন চালালাম। কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলে থাকলে তার কি ভাবে হবে ?’
–না গো, বুম্বা এক্কেবারে ওরকম নয়। অশোকদার মারা যাবার পরে ও কেমন যেন বড় হয়ে গেছে। কোন বায়না করে না।এমন কি চকোলেট কিনে দেবার কথাও বলে না। সুলেখা কথাগুলো মাঝে মাঝে বলে আর কাঁদে।
-তাহলেও এখানে থাকলে আমার তো কিছু দায়িত্ব এসে যায়। তুমি থাকলেও কিছু রান্না করে দিতে। আমি তো আর অত কিছু রাঁধতে পারি না। হোটেলও বন্ধ, কাজের মেয়েটাও আসছে না।তার উপর দুটো ছোট বাচ্চা। না হলে থাকুক না।
-তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। ভাত ফোটাবে, বাটার দেবে, খাবে। আর বুম্বা নিজে হাতে সব কিছু করতে পারে।
–এখন যদি আমি পনেরো দিন বাইরে থাকতাম, আর তুমি এখানে থাকতে, খুব সুন্দর করে ম্যানেজ করে ফেলতে। কিন্তু আমার পক্ষে ইটস রাদার টাফ।
-তাহলে না বলে দেব ?
–আচ্ছা আমার স্কুল এখন বন্ধ না থাকলে তুমি কি করতে ?
-তখন ভাবতাম, এখন আর বেশি ভাবতে পারছি না।
কিছু সময় চুপ থাকল প্রদীপ্ত। তারপর বলল,‘আমাদের কমপ্লেক্স ওকে অ্যালাও করবে তো ? ’
-এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। সবাই তো আমার ব্যাপারটাও শুনবে, হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর আমাকেও যদি এখানে ঢুকতে না দেয় কিছু তো করবার নেই।এখন কিছু বললে হাত জোড় করব। বলব ‘এই কদিন ফ্ল্যাটের বাইরে বেরবে না।’ আসলে হাত তালি মারা খুব সোজা, কিন্তু হাতে হাত দিয়ে চলা খুব কঠিন।
–বুম্বা আসবে কি ভাবে ?
–তুমি বললে সুলেখার স্কুটি আমাদের স্পেসে রাখবে। দুজন এখান থেকেই চেপে যাবো।
–ঠিক আছে, নিয়ে আসতে বল।
পরবর্তী মিনিট গুলো কেমন যেন চোখের পাতা ফেলার সাথে মিলিয়ে গেল।এর মাঝে স্মিতা বেশ কয়েকবার বাবুকে কোলে নিয়ে আদর করবার আড়ালে চোখের জল ফেললেও প্রদীপ্ত চোখে পড়ল না। স্মিতারও চোখে পড়ল না প্রদীপ্তের চোখের জলের অদৃশ্য ফোঁটা গুলো। বারণ করলেও প্রদীপ্ত বাবুকে কোলে নিয়েই কমপ্লেক্সের গেট পর্যন্ত হেঁটে গেল। এর মাঝে বাবু যতবার কেঁদে উঠেছে ততবারই স্মিতা কোলে নিয়ে ভোলানোর চেষ্টা করতেই প্রদীপ্ত নিজের কোলেই চেপে রেখে বলেছে, ‘না গো, আমার কাছেই থাক, আমিই চেষ্টা করি, এই কদিন কাঁদলে আমাকেই তো ভোলাতে হবে।’ প্রদীপ্ত বুঝতে পারে না, বাবু নয়, তার কোলের মধ্যে আটকে আছে স্মিতার হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস।
সুলেখার স্কুটিটা অবশ্য স্মিতাদের কমপ্লেক্সের ভিতর রাখতে হয় নি।একটা অটো ভাড়া করেই দুজন এসেছে। প্রদীপ্ত কোলে বাবু আর পাশে বুম্বাকে নিয়ে গেটের ভিতর থেকে দেখল স্মিতা, সুলেখা দুজনেই একপা একপা করে সামনের দিকে হাঁটার সময় বার বার পিছনের দিকে তাকাচ্ছে। নিজের কোলে থাকলেও প্রদীপ্তও এই সময় খেয়াল করে নি, বাবুও ঘুম থেকে উঠে সেদিকেই তাকিয়ে আছে।
ম য় না মু খো পা ধ্যা য়
হুশ
কতক্ষণ যে জলের ধারে পড়ে ছিল তানিয়া তা তার নিজেরই হিসেব নেই। তার নাম ধরে রায়ানের ডাক তার প্রায় অচেতন মনের গভীরে বারবার একটা হালকা ধাক্কা মারছিল কিন্তু কিছুতেই তাকে সম্পূর্ণ চেতনায় ফেরাতে পারছিল না। কে বা কি যেন তার মনকে একটা থকথকে কাদামাখা প্রান্তরে আটকে ফেলেছে। সে যতবার উঠে আসতে চেষ্টা করছে ততবারই যেন আরো গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। রায়ানের কন্ঠস্বর সেই তলিয়ে যাওয়ার পথে তার বাঁচার একমাত্র উপায়, একমাত্র বাড়ানো হাত। তানিয়া প্রাণপণ চেষ্টা করছে হাতটা ধরার কিন্তু পারছে না। সে ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে অতলে। তার নাকে মুখে হদহদিয়ে ঢুকছে তরল কাদা। জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে চন্দনের মতো পেলব মাটিতে, নাকের গহ্বরে বিজবিজ করছে পাঁকগন্ধ মাখা থকথকে তরল মাটি। কানে আসছে একটা চাপা গুবগুব শব্দ। কাদামাটির স্তর সরিয়ে ভারী কিছু একটা যেন নেমে যাচ্ছে গভীরে আরো গভীরে, তার হাওয়া কাটার শব্দই কানে আসছে তানিয়ার, গুবগুব গুবগুব। তানিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে চীৎকার করে ডাকতে চাইছে, রায়ান কোথায় তুমি ? আমাকে ধরো, আমি যে হারিয়ে যাচ্ছি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছে তার গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না।
প্রায় অচেতন তানিয়াকে রায়ান তুলে নিয়ে আসার কিছু পরে তানিয়া স্বাভাবিক হয়। কিন্তু এই ঘটনার ব্যাখ্যা রায়ান আর তানিয়া আজো খুঁজে পায়নি।
পাকঘরের দাওয়ায় বসে রাঙাদিদার কুটনো কাটা দেখছিল তানিয়া। রাঙাদিদার এখন বিরাশি বছর বয়স। এখনো সে মস্ত বটি পেতে বসে টুকটুক করে দিনের যাবতীয় কুটনো কেটে দেন। রায়ান তানিয়ার মামাতো ভাইয়ের সাথে মাছ ধরা দেখতে গেছে। আজ পুকুরে জাল দেওয়া হবে। তানিয়া এক আঁটি মেথি শাকের পাতা বাছতে বাছতে লক্ষ্য করল কুর্মি নিঃশব্দে বারদরজা দিয়ে উঠোনে ঢুকে মরাইয়ের পাশে কিছু একটা খুঁজছে। হাত দুটো মুঠো করে পিছনে রাখা। তানিয়ার চোখে চোখ পড়তেই সে একটু হাসল। কুর্মির ফর্সা মুখটা রোদে লাল হয়ে রয়েছে। তার কপাল দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। তানিয়া চোখের ইশারায় তাকে ডাকল। কুর্মি কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
-- মামমাম রন্টুদাদা তুলিদিদিদের দেখেছো ?
তানিয়া ঘাড় নাড়িয়ে না করল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
-- তোর হাতে কি রে কুর্মি ? কি খেলছিস ? লুকোচুরি ?
কুর্মি একটু লাজুক হেসে হাতটা সামনে আনল। মুঠোটা খুলতেই তানিয়া দেখল হাতের তেলোতে লম্বা লম্বা একরাশ পাতা। সেগুলো তানিয়ার সামনে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে কুর্মি বলল,
-- দেখো তো মামমাম সিক্সটি টা আছে তো ?
তানিয়া বলল,
-- কি খেলা ?
চকচকে মুখে কুর্মি উত্তর দিল,
-- নতুন খেলা মামমাম। হুশ। কোনদিন খেলিনি। তুলিদিদি আজ শিখিয়ে দিল। ওরা তো রোজ খেলে।
তানিয়ার হঠাৎ শরীরটা কেমন অস্থির করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি শাকের আঁটিটা মাটিতে রেখে দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। কুর্মি একটু দাঁড়িয়ে থেকে মামমামের ভালো লাগছে না বুঝে পাতাগুলো তুলে নিয়ে চলে গেল সঙ্গীদের খুঁজতে। তানিয়ার কি শরীরটা খারাপ লাগছে, সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। রাঙাদিদার গলার স্বরে সে চোখ খুলল।
-- তোর কি শরীরটা খারাপ লাগছে তানু ? তাহলে ঘরে গিয়ে শো। একে শরীর খারাপ তার ওপরে কাল এখানে আসতে অনেকটা ধকল গেছে এখন একটু শুয়ে থাক।
তানিয়া মাথা নেড়ে না বলল। তারপর উঠে উঠোন পেরিয়ে বারদরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল পাশের আম বাগানের ছায়ায় জোর খেলা জমে উঠেছে কুর্মিদের। কুর্মি বোধহয় কারোকে ধরে ফেলেছে তাই পাতা গোণা হচ্ছে, এক দুই তিন --। সবাই ভিড় করে সেই গোণা দেখছে। পাতা কমবেশি হলে আবার কুর্মিকে চোর হতে হবে। তানিয়ার মুখ দিয়ে আচমকা বেরিয়ে এল
-- হে ভগবান, পাতা যেন ঠিক ষাটটা হয়।
সারা দুপুর কুর্মি এই নতুন খেলা শেখার আনন্দে তানিয়ার কানের কাছে বকবক করে খেলার বিবরণ দিতে লাগল। কেমন করে খেলতে হয়, কেমন করে পাতা গুণে আনতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তানিয়ার উত্তর না পেয়ে সে ভারি অবাক মামমাম এমন খেলা জানে না, কোনদিন খেলেওনি। তানিয়া একটা বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে আধশোয়া হয়ে ছিল। কুর্মির অর্ধেক কথা তার কানেই যাচ্ছে না। তার কানে আসছে একদল ছেলেমেয়ের হৈ হৈ, তাদের ছোট ছোট পায়ে এখানে ওখানে লুকিয়ে পড়ার খসখস শব্দ, পটপট করে পাতা ছেঁড়ার আওয়াজ আর বাচ্চাদের গলায় ধাপ্পা ধাপ্পা চীৎকার। তার বুকটা কেমন ধড়ফড় করতে লাগল। ওই তো, ওই তো তার ছোটবেলা, তার সঙ্গী সাথী। রিয়া, কুসুম, পল্টন, মিঠু, ডলি, শংকর, জিতেন, ছোটন --। কিন্তু সে কিছুই মনে রাখতে চায় না।
তানু এবার খেলায় চোর। তাকে চোখ বন্ধ করে কুড়ি গুনতে বলে তার সব সঙ্গীরা কোথায় কোথায় লুকিয়ে পড়ল কে জানে। তানু কুড়ি গোণা হলে চোখ খুলে ঘুরে দেখল চারিদিক ফাঁকা। সবাই যে যার মত লুকিয়ে পড়েছে। এখন দুপুর তিনটে সাড়ে তিনটে হবে। মামীরা সবে পাকশালের কাজ সেরে সেলাই পত্তর নিয়ে বসেছে। রাঙাদিদাও ঘরের মেঝেতে রামায়ণ খুলে অল্প অল্প ঝিমোচ্ছে। এই ফাঁকে তারা পাড়ায় খেলতে বেরিয়ে পড়েছে। তানুরা হুশ খেলছে আজকে। সবাই চলে গেছে দেখে তানু আম বাগানের ভেতরে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। কত মোটা মোটা গাছ এখানে। সেই গাছের আড়ালে অনায়াসে দুজন মিলে লুকিয়ে থাকা যায়। কিন্তু তানু এখন তাদের খুঁজতে যাবে না। আগে পাতা তুলতে হবে। এই বাগান সবসময় পরিস্কার করে রাখা হয়। এখানে ছোট গাছ পাওয়া যাবে না তার চেয়ে বোসপুকুরের ওপারে মিশিরচাচার বাড়ির ধারে যাবে। সেখানে মেন্দা বনধনে ভাট কেশুত রাঙচিতা আরো অনেক গাছ আছে। ওখান থেকেই ষাটটা পাতা নেবে তারপর ডলি রিয়া কুসুম পল্টুদের খুঁজবে। তানু মিশিরচাচাদের উঠোনের ওপর দিয়ে পুকুর পাড়ে যাওয়ার সময় দেখল রুমনাচাচি এক পাঁজা বাসন কাঁকালে নিয়ে পুকুরের দিক থেকে আসছে। তানুকে দেখে বলল,
-- এই ঠা ঠা রোদে কই যাও মা জান ?
তানু চিরকালই ঠান্ডা ধীর স্থির মেয়ে। সে রুমনার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-- ওদের কারোকে দেখেছো চাচি ? এদিকে লুকিয়েছে ?
রুমনা বাসনগুলো মাটির দাওয়ায় নামিয়ে রেখে বলে,
-- অ তুমরা খ্যালতাসো ? পাতা নিবার আইসো ? তায় লও। দেইখো জলের ধারে য্যান যাওন না লাগে। তুমি শহরের মাইয়া সব তো বুঝো না।
তানুর বুকের মধ্যে শহর কথাটা না মানা দুধের ফেনার মত উথলে ওঠে। সে শূণ্য চোখে খানিক তাকিয়ে থাকে দাওয়ায় রাখা সোনার মত বাসনগুলোর দিকে তারপর মাথা নীচু করে পায়ে চলা পথ মাড়িয়ে পুকুরের দিকে এগোতে থাকে। তানুর ভীষণ রাগ হয়। কার ওপর রাগ, কেন রাগ সে জানে না শুধু তার ভিতরটা অক্ষম আক্রোশে ফুলতে থাকে। পুকুরের উঁচু পাড়ে দাঁড়িয়ে রাগের চোটে দুটো রাঙচিতা টেনে উপড়ে তোলে তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় পুকুরের জলে। কয়েকটা কচ গাছের ডাল ভাঙে পটপট করে। রাগটা একটু পরে কমতে থাকে। সে পাতা তুলে নিয়ে গুনতে বসে। ষাটটা পাতা গুনে খানিক জলের মধ্যে মাছের ঘাই মারা দেখে সঙ্গীদের খুঁজতে যায়। তার মনে পড়ে আজ তিনদিন ধরে সেই চোর হচ্ছে। পাতা গুনে যখন সবাইকে খুঁজছে তখনই কেউ না কেউ পেছন থেকে ধাপ্পা দিয়ে দিয়েছে। আবার তাকে চোর হতে হয়েছে। কাল একবার তো কুসুমকে ধরেই ফেলেছিল কিন্তু পাতা গুনলে দেখা গেল একটা বেশি। তানু স্পষ্ট দেখেছিল ছোটনকে তার নিজের হাতে রাখা একটা পাতা মিশিয়ে দিতে। তানু তবু কিছু বলেনি। কুসুম ছোটনের নিজের দিদি তাই হয়তো ওরকম করেছিল। আবার তানুকেই চোর হতে হল। এমনিতে তানুর এ খেলায় চোর হতে খারাপ লাগে না। বেশ একা একা ঘোরা যায়। লুকানোর ঝামেলা থাকে না। শুধু সবাইকে খোঁজার সময় একটু চোখ খোলা রাখতে হয় পাছে কেউ ধাপ্পা দিয়ে দেয়। তানু আজ কারোকেই খুঁজে পাচ্ছে না। রিয়া কুসুমদের খুঁজতে খুঁজতে সে দত্তবাগান, তালতলা মাঠ, কানাপুকুর ছাড়িয়ে কখন ভূতির চর অবধি চলে এসেছে। এতো দূর তাদের আসা মানা। শীতের দিন বেলা পড়ে আসছে। ভূতির চরে একদিকে যতদূর চোখ যায় ভুট্টার গাছ। প্রায় সব গাছেই ভুট্টা হয়ে আছে। অন্যদিকে ছোলার ক্ষেত। প্রায় মাটির সাথে লেগে থাকা ঝোপড়া ছোলা গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ সবুজ ছোলা হয়ে আছে। তানু উবু হয়ে বসে ছোলার গায়ে হাত বুলায়। কি সুন্দর নরম রোয়া খোলার ওপরে। সে চুপচাপ আলের ধারে বসে থাকে খানিকক্ষণ। লম্বা লম্বা ভুট্টা গাছের কোলে নীচু ছোলার ক্ষেত, ক্ষেতের মাঝখানের নালা দিয়ে সেচের জল বওয়ার ঝিরঝির শব্দ তানুকে আনমনা করে দেয়। একটা সাইকেলে চড়ে আসা লোককে সে দেখতে পায়। লোকটা সাইকেল রেখে তার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সেই হাতে একটা গোটা ছোলা গাছ। সবুজ রঙের কাচা ছোলা প্রতিটা ডালের মাথায়, শিকড়ে তখনও মাটি লেগে আছে। সেই লোকটা একটা একটা ছোলা ছিঁড়ে তানুর মুখে দেয়। ছোলার খোসাটায় টক টক স্বাদ, ভেতরের শাঁসটা কি মিষ্টি। লোকটা তানুর কত জন্মের চেনা, তানুর বাবা। মাথার ওপরের ধূসর নীল আকাশ, ক্ষেতের চারপাশে ক্রমশ এগিয়ে আসা কুয়াশার পর্দা আর শনশন করে বয়ে যাওয়া মাঘের শীতল বাতাস তানুর বুকের ভিতরটা থিরথির করে কাঁপায়। তানু নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। সে কাঁদে তার বাবা মার জন্য, ফেলে আসা শহুরে জীবনের জন্য, এমনকি বাবার খাইয়ে দেওয়া কাঁচা ছোলাটার জন্য অবধি তার কান্না পায়। তার হাতে গুনে রাখা ষাটটা পাতা কখন পড়ে যায় ক্ষেতের কাচা মাটির মধ্যে। সে ভুলে যায় হুশ খেলার কথা, বাড়ি ফেরার কথা। সেই ধূসর আঁধারে অজস্র জোনাকির ফুটকি আলোর বৃত্তে তানু একা বসে থাকে স্বপ্নোত্থিতের মতো। অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর সে বাড়ি না ফেরায় মামাবাড়ির পুরানো কাজের লোক ছিদামদা একটা হারিকেন হাতে তাকে এখান থেকে খুঁজে সেদিন বাড়ি নিয়ে যায়। মামারা সেদিন তাকে খুব বকছিল এই বলে,
-- দিদি তোমাকে একটুও মানুষ করতে পারেনি তানু। তুমি কারো কথা শোন না। যেখানে যেতে বারণ করা হয় সেখানেই যাও। তোমার একটা বিপদ হলে আমাদের সবাই ছি ছি করবে সেটা তুমি জানো ? ভাগ্যিস রুমনা দেখেছিল তুমি ওদিকে যাচ্ছ তাই ছিদাম তোমাকে খুঁজতে পারলো। নইলে কি হত বলতো।
তানুর কানে কিছুই যাচ্ছিল না। রাতে রাঙাদিদা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিল,
-- এমন করে না তানু। এরকম না বলে অতদূরে যেতে নেই। তাছাড়া তুমি নাকি রোজ খেলার মাঝে অন্য কোথাও চলে যাও।
তানু বলে,
-- ছোটনরা আমাকে রোজ রোজ ঠকায় রাঙাদিদা। বার বার ঠকিয়ে চোর করে। তাই আমার খেলতে ভালো লাগে না।
রাঙাদিদা তানুর মাথাটা কোলে চেপে ধরে বলল,
-- আমি বকে দেব। ও ভাবে তুই ওর আদর কেড়ে নিচ্ছিস তাই হয়তো ওরকম করে।
তানু আরো বলতে চায় যে ছোটন ওকে সবার আড়ালে ছড়া কেটে বলে,
যার নেই বাবা
সে একটা হাবা।
যার নেই মা
সে বাঁচে না।
কিন্তু রাঙাদিদাকে বলতে ইচ্ছে করে না। তাহলে ছোটন হয়তো মার খাবে। তার ওপরে আরো রেগে যাবে। আরো খারাপ খারাপ কথা বলবে। তখন কেউ হয়তো তানুকে বিশ্বাসই করতে চাইবে না। বলবে তানু ছোটনকে হিংসা করে।
মধুমতী গ্রামের এই বাড়ি তানিয়ার মামাবাড়ি যতটা তার চেয়ে বাড়ি অনেক বেশি। সাত বছর বয়সে যখন সে একদিনের মধ্যে তার মা আর বাবাকে হারিয়ে অনাথ হয়েছিল তখন বাবার বন্ধু অনাদি কাকু আর তার স্ত্রী তাকে বহরমপুর থেকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই গ্রামে নিয়ে এসেছিল। কাকিমা তাকে বলেছিল এটা তার দাদুর বাড়ি, এখন থেকে সে এখানেই থাকবে। এই বাড়ির বিরাট উঠোনে দাঁড়িয়ে সেদিন আচমকা তানিয়ার বুক ভেঙে কান্না এসেছিল। এখানে থাকবে ? কি করে থাকবে ? এদের কারোকে তো সে চেনে না। কিছু বোঝার আগেই তাকে কোলে টেনে ঘরে নিয়ে গেছিল এই রাঙাদিদা। রাঙাদিদা নিঃসন্তান। তিনি তানিয়ার মায়ের কাকিমা। রাঙাদিদার কাছে পরে শুনেছিল মা বাবা নিজের ইচ্ছেতে বে-জাতে বিয়ে করেছিল বলে দুবাড়ির কেউই এ বিয়ে মেনে নেয়নি। তাদের সাথে যোগাযোগও রাখেনি। তানিয়ারও মামাবাড়ি চেনা হয়নি। মধুমতীর বাড়িতে এসে প্রথম প্রথম সে খুব আড়ষ্ট হয়ে থাকলেও রাঙাদিদার যত্নে আর আদরে তানিয়া ধীরে ধীরে এবাড়ির মেয়ে হয়ে উঠতে লাগল। এবাড়িতে দুই মামার তিন ছেলেমেয়ে পল্টনদা ছোটন আর কুসুম। পল্টন আর কুসুম তানিয়ার থেকে বড় হলেও ছোটন আর তানিয়া নাকি একই বয়সী। ছোটনের সাথেই তার বেশি ভাব হওয়ার কথা থাকলেও সেটা হল না। ছোটন তানুকে তার আদরের ভাগীদার মনে করেছিল। স্কুলের ছুটি থাকলে কুসুম ছোটন পল্টনরা পাড়ার আরো ছেলেপিলে জুটিয়ে সারাদিন এ বাগান ও বাগান খেলে বেড়াতো। তানিয়া দাওয়ায় বসে বসে সেই খেলা দেখতো। ওরা ওকে খেলতে ডাকতো না, তানিয়াও খেলতে চাইতো না। রাঙাদিদার হুকুমে ছোটন ওকে একদিন হাত টেনে নিয়ে গেল তাদের সাথে খেলতে। আস্তে আস্তে তানু স্বাভাবিক হচ্ছিল, সবাইকে বন্ধু করে নিচ্ছিল। ছোটন ছাড়া আর সবাই তাকে একদিন আপন করে নিয়ে ছিল। কিন্তু সেই একটা দিন সবার জীবনটা অন্যরকম করে দিল, খেলাও বন্ধ হয়ে গেল।
সেই দিনটা তানিয়া আজো ভুলতে পারেনি। সেদিন খেলতে গেলে ডলি উবু দশ কুড়ি করে শ গুনে ছোটনকে চোর করল। সবাই যে যার মত লুকালে ছোটন গেছিল পাতা আনতে। সবাই লুকিয়ে থেকে থেকে বিকেল থেকে সন্ধে হয়ে গেল। না ছোটন কারোকে খুঁজল, না অন্যেরা ছোটনকে খুঁজে পেল। বিকেল পড়ে আসতে গেলে সবাই এক জায়গায় হলে ডলি বলল,
-- ছোটন নিশ্চয় বাড়ি চলে গেছে। কাল থেকে ওকে ঠিক খেলায় নেব না।
তানু পল্টন আর কুসুম বাড়ি ফিরে দেখল ছোটন বাড়িতে আসেনি। এদিকে অন্ধকার নেমে গেছে। ছিদামদা হারিকেন হাতে ছোটনকে খুঁজে এল পাশাপাশি দু তিনটে পাড়া। ছোটন কোথাও নেই। সারা গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেল। কেউ কি ভুলিয়ে নিয়ে গেল তাকে। তানুদের বাড়িতে বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। মামারা থানায় খবর দিলে থানার বড়বাবু এলেন। যারা খেলছিল তাদের সবাইকে তিনি ডাকলেন। পুলিশ দেখে ছোটরা উত্তর দেবে কি তারা তো কেঁদেই অস্থির। ছোটন কোনদিকে পাতা তুলতে গেছিল কেউ দেখেনি। সেই রাত কোনও রকমে কাটলো। পরেরদিন আশেপাশের পুকুরে ডূবুরি নামানো আর জাল দেওয়া স্থির হল। সেই মতো সব পুকুরে এক এক করে জাল পড়ল। কিন্তু কিছুই উঠল না। গ্রামের সবচেয়ে ভালো ডুবুরি রশিদ জেলে। সে নামল একের পর এক পুকুরে। শেষে মিশিরচাচার বাড়ির পেছনের বোসপুকুরে ডুব দিয়ে উঠে এল রশিদ। বলল,
-- নিচে লাশ আছে চাচা। কাদায় গেঁথে আছে। আরো লোক লাগবে।
আরো দুজন নামল ছোট জাল নিয়ে রশিদের দেখানো জায়গায়। সমস্ত গ্রাম তখন ভেঙে পড়েছে বোসপুকুরের ধারে। তারপর জালে বেঁধে উঠে এল সেই লাশ, ছোটন। জল খেয়ে ফুলে গেছে তার শরীরটা, হাতের মুঠোয় তখনও শক্ত করে ধরা একটা কেশুত গাছ, গোড়া থেকে উপড়ানো। পুকুরধারে খুঁজে সদ্য তোলা গাছের গর্তটাও চোখে পড়ল সবার। গ্রামের বুড়োরা দেখে বলল, বোধহয় পুকুরের দিকে পিছন ফিরে গাছটা টেনে তুলতে গেছিল ছোটন। গাছ উপড়ে আসার ঝটকা সে সামলাতে না পেরে সোজা পুকুরে পড়েছে। সাঁতার জানতো না তারপর চিৎ হয়ে পড়ার কারণে উঠে আসার সুযোগ পায়নি সে। উপরন্তু সেখানে নরম পাঁকে ক্রমাগত ডুবে যায় তার নাদুসনুদুস ছোট শরীরটা। তারপর বহুদিন বাড়িটা ভরে থাকতো ছোটমামীর কান্নায়। বাড়ির আনাচে কানাচে সর্বত্র একটা ঝুপসি শোকের ছায়া ঘুরে বেড়াতো। কেউ আর জোরে কথা বলত না, জোরে হাসতো না। ছোটদের খেলাও প্রায় বন্ধই হয়ে গেল। যদি বা খেলতো ওই হাডুডু, সাতগুটি, দড়ি লাফ, ইচিং বিচিং এইসব যাতে চোখের আড়ালে আর কেউ না যায়। তানু আর কোনদিন কোন খেলাই খেলতো না। একপাশে বসে সবার খেলা দেখতো। এরপর তানু একদিন পড়তে কলকাতায় বোর্ডিং এ চলে এল। ছুটিছাটাতে বছরে দুবার বাড়ি যাওয়া। মধুমতীর সাথে নাড়ির টান কোনদিনই ছিল না তার। যেটুকু অভ্যেসের টান ছিল রাঙাদিদা ছাড়া সেটুকুও কেটে যেতে লাগল তানুর। বিয়ের পরে এখন তাদের দু বছরে একবার হয়তো যাওয়া হয়। তারও কারণ শুধু ওই রাঙাদিদা।
রায়ানের কাছে ফোনে তানিয়ার এই অদ্ভুত শরীর খারাপের কথা শুনে রাঙাদিদা তাকে বারবার দেখতে চেয়েছিল তাই এবার মধুমতীতে আসা। এরকম অদ্ভুত অনুভূতি তার প্রথম হয় রিয়ালসারে। এমনিতে তানিয়া কোন জলের কাছে বিশেষ যেতে পছন্দ করে না, যায়ও না। এই ঘটনাটা যখন ঘটেছিল তখন তানিয়ারা হিমাচল প্রদেশের রিয়ালসারে বেড়াতে গেছিল। রিয়ালসারে দেখার মত তেমন কিছু নেই। একটা গুম্ফা আর একটা ছোট লেক। কিন্তু সিনিক বিউটি অসাধারণ। রায়ানের চিরকালই অফবিট জায়গা পছন্দ। তানিয়া সেদিন বিকালে একাই লেকটার চারধারে হাঁটছিল। রায়ান আর কুর্মি হোটেলেই ছিল। একজন মহিলা ফাঁকা লেকের ধারে ছোট ছোট প্যাকেটে মুড়ি বিক্রি করছিল। সে তানিয়াকে মাছেদের খাওয়াতে বলে। বলে মাছকে খাওয়ানো খুবই পুণ্যের কাজ কারণ মাছগুলো আজকের নয়। তানিয়া খানিকটা বাধ্য হয়েই একটা প্যাকেট কিনে সিঁড়িতে নামে। দূর থেকে জলে যেই না মুড়ি ছড়িয়েছে ওমনি দলে দলে সেই মাছেরা ভিড় জমায় সিঁড়ির কাছে। তানিয়া দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে কি বিশাল চেহারা তাদের। অসংখ্য দৈত্যাকৃতি মাছেরা একে অন্যের সাথে ঠেলাঠেলি করে সেই মুড়ি খাওয়ার জন্য প্রায় সিঁড়ির ওপরে উঠে আসতে চায়। ওদের বিশাল মাথা থেকে একটা গা গোলানো পাঁক গন্ধ বেরোচ্ছিল। তানিয়া ভয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি একধাপ ওপরে উঠে আসে। ঠিক তখনই ওর ওরকম একটা অনুভব হয়। তানিয়া বসে পড়ে সিঁড়িতে। এদিকে রায়ান ওর দেরি দেখে খুঁজতে গিয়ে দেখে তানিয়া প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে সেখানে। স্থানীয় লোকেরা ওকে ধরাধরি করে হোটেলে পৌছে দিয়ে যায়। রায়ান এই ঘটনার পরে তানিয়াকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিল যে ওর ঠিক কি হয়ে ছিল। তানিয়া সঠিক করে কিছুই বলতে পারেনি। শুধু বলেছিল তার মনে হচ্ছিল সে ওই জলের গভীরে কাদামাটির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। এরপর আরো দুবার তার সাথে এই ঘটনা ঘটেছে। রাঙাদিদা দুপুরবেলায় বন্ধ ঘরে তানিয়ার কাছে সব শুনে বলে,
-- ছোটনের কথা আমরাই ভুলতে বসেছি আর তোর মনে এখনও কেন আছে। এই জলের ভয় তো তোর তখন থেকেই ছিল। কিন্তু এরকম তো কখনো হয়নি।
তানিয়া রাঙাদিদার কোলে মুখ গুজে কাঁদতে থাকে। বলে,
-- জানি না, আমি কিচ্ছু জানি না রাঙাদিদা।
রাঙাদিদা তার কমজোরি চোখ তানিয়ার মুখের কাছে নিয়ে এসে আঁতিপাঁতি করে তার মুখে কি যেন খোঁজে। তারপর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-- রুমনা আমায় বলেছিল তুই প্রায়ই ওর বাড়ির পিছনের পুকুরের ধারে যাস, ঘাটে বসে থাকিস। ছোটন যেদিন ডুবে যায় সেদিনও কি ছিলি ওখানে ?
তানিয়া মুখ না তুলে আরো কাঁদতে থাকে। তার পিঠ ফুলে ফুলে ওঠে কান্নার দমকে। রাঙাদিদা সতর্ক গলায় বলে,
-- ছোটনকে পড়ে যেতে দেখেছিলি ?
তানিয়া ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
-- হ্যা।
-- বল, খুলে বল আমায়। হালকা হবি। যে যাবার সে তো চলে গেছে তুই কেন শাস্তি পাচ্ছিস।
রাঙাদিদার কথায় তানিয়া চোখ মুছে বলে,
-- আমি সেদিন ওই পুকুরের ধারে রুমনাচাচিদের গোয়ালে লুকিয়ে ছিলাম। ছোটন এসে এগাছ ওগাছ থেকে কয়েকটা পাতা তুলল। তারপর পুকুরের দিকে পিছন ফিরে একটা কেশুত গাছ ধরে গোড়া থেকে টান দিতেই গাছটা উপড়ে ছোটন জলে পড়ে গেল। আমি দৌড়ে গেলাম। ও আমাকে দেখে হাত বাড়ালো কিন্তু পাড় জলের থেকে অনেক উঁচু তাছাড়া একটু বাদেই ছোটনকে আর দেখতা গেল না। একবার ভাবলাম সবাইকে ডাকি তারপরেই মনে হল ভালো হয়েছে ও ডুবে গেছে। আমাকে সবসময় ছড়া কেটে কষ্ট দেয়। আমার বাবা মা নেই তাই আমি তোমাদের বাড়ির আশ্রিত বলে কথা শোনায়। আর আমাকে কেউ কথা শোনাবে না, ঠকিয়ে চোর করবে না। আজ এতোদিন বাদে ও আমায় শাস্তি দিতে চায় রাঙাদিদা। ও বোঝাতে চায় ওর কত কষ্ট হয়েছে সেদিন। আমারও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। পাকে ডুবে যেতে থাকি আমি। ছোটনের হাত থেকে আমার ছাড় নেই রাঙাদিদা।
তানিয়া কথা কটা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে। রাঙাদিদা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকেন অনেকক্ষণ। সন্ধ্যে হয়ে আসছে ঘরের ভিতরটা আবছা অন্ধকার। রাঙাদিদা উঠে আলোটা জ্বালান তারপর তানিয়াকে বলে,
-- ভুলে যা তানু, ভুলে যা। সেদিন ছোটনের চলে যাওয়া ছিল। তুই দৌড়ে এসে খবর দিলেও ওকে বাঁচানো যেত না হয়তো। যেভাবে নাকে চোখে মুখে কাদা ঢুকেছিল ও বাঁচত না। তুই ওকে মারিসনি। ওর মৃত্যু ছিল তাই মরেছে। তোর একটা মেয়ে আছে। তুই কি চাস তোর মত কুর্মিও মা হারা হয়ে বাঁচুক ? অনাথের অনেক কষ্ট তুই তো জানিস। তোর কোন দোষ নেই। ছোটনও না বুঝে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছিল। তবুও বলব সব ভুলে যা।
ঝি লি ক মু খা র্জী গো স্বা মী
দি আদার ডে
[১]
স্ট্যাফোর্ডশায়ারের ছোট্ট শহর, আটোজাটার সাঁতারু অ্যাডম পিট পোডিয়ামের মাঝখানের অংশে স্বর্ণ নির্মিত মেডেলে অলংকৃত হয়ে সম্ভাষণ জ্ঞাপন করে চলেছেন প্রতিটি দর্শকদের তথা তাঁর সমর্থকদের। মুখের মধ্যে ফুটে উঠেছে, প্রশস্তি মাখা হাসির ঝিলিক। রাংতার রঙিন কাগজের টুকরো গুলো হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। রিও অলিম্পিকে, সাঁতার বিভাগে সেরার সেরা হয়ে স্বর্ণপদক জয়ী,অ্যাডাম পিট বরাবরই আমার খুবই প্রিয় সাঁতারুদের মধ্যে অন্যতম। অলিম্পিক, ফিনা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে শুরু করে কমনওয়েলথ গেমস। সর্বত্র তাঁর সাফল্যের রেখা উর্ধ্বগামী। জলের সাথে, পিটের সম্পর্কে কোথাও একটুও ঘাটতি নেই। মাছ যেমন জল ছাড়া জীবন ধারণে অক্ষম! অ্যাডাম পিটের সঙ্গে জলের সম্পর্ক, কার্যত তাই। জলের প্রতিটা বিন্দু, প্রতিটা স্রোতের সাথে তাঁর গভীর আত্মিকতা গড়ে উঠেছে যেন। জলের মধ্যে থাকার সময়, অবলীলায় সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন বহুবার। পিটের প্রতিটা স্কিল, আমাকে একরাশ মুগ্ধতায় জড়িয়ে দেয় যেন। বিশ্বখ্যাত পিটকে দেখার পর থেকেই, নিজের অজান্তেই মনের কোটোরে বাসা বাঁধে একটা স্বপ্ন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, অলিম্পিকের সবুজ মাঠ। মাঠ জুড়ে রঙিন রিং এর বেলুনের উপস্থিতি। মাঠ জুড়ে, উন্মত্ত সমর্থকদের উপচে পড়া বীভৎস চিৎকার। সবথেকে উঁচু পোডিয়ামে আমি দাঁড়িয়ে আছি, স্বর্ণ পদক গলায় ঝুলিয়ে। ছবিটা প্রতিবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাই। স্বপ্নটা যখন থেকে আমাকে হাতছানি দিতে শুরু করেছিল, সেদিন থেকেই সাঁতারের ক্লাসে ভর্তি হওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু আমার সিদ্ধান্তই যে প্রধান এবং শেষ কথা নয়, এটা ভেবেও চিন্তিত হয়ে পড়ি। বাবাকে রাজি করানো গেলেও মা...
***
[২]
ঘরের মধ্যে নীল আলোর ছটা, সমস্ত ঘরটাকে মায়াবী করে তুলেছে। নীলচে আলোর অস্পষ্ট আলোতেও পরিলক্ষিত হয়, দু'টো মূর্তির অবয়ব। একটা মূর্তি, ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত হয়ে নিজের দেহের সমস্ত অংশ গুলোকে আরাম কেদারার সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। অপর ছায়ামূর্তি, লেদারের তৈরি গদিওয়ালা চেয়ারে বসে আছে, এলিয়ে যাওয়া শরীরের মুখোমুখি হয়ে। বসে থাকা ছায়ামূর্তির হাতের দক্ষিণ হস্তে নীল-সাদা ডোরাকাটা চাকতিটা পেন্ডুলাম ঘড়ির ঘন্টার মতো দুলে চলেছে ক্রমাগত। দোদুল্যমান চাকতির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, একটা সময় নিদ্রা দেবীর কোলে আশ্রয় নিল, আরাম কেদারার সঙ্গে মিশে থাকা ছায়ামূর্তিটা। বসে থাকা ছায়ামূর্তি একের পর এক প্রশ্নবানে জর্জরিত করল, অর্ধচেতনা মাখা ঘুমন্ত ছায়াশরীরকে।
-" কী দেখতে পাচ্ছেন মিসেস মুখার্জী?"
অর্ধচেতনা মাখা শরীর, প্রবল ক্লান্তিতে জড়ানো কন্ঠে উত্তর দিল....
-" জল...জল...জল...."
-" শেষ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। চারিদিকে মহাশূণ্য।"
-" পৃথিবী থেকে প্রাণের উপস্থিতি লুপ্তপ্রায়...."
আরও কিছু বিক্ষিপ্ত কথা বলে, একটা সময়ে মিসেস তমশা মুখার্জী প্রায় ঘুমিয়েই পড়লেন প্রবল ক্লান্তিতে।
***
[৩]
এইভাবে কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছি জানিনা। স্বপ্নটা এতটাই মধুর ছিল যে.... যখন ঘুম ভাঙল, সকালের ঊষা তার লালচে আভা মাখিয়ে দিয়েছে সারা আকাশ জুড়ে। নীল-সাদা মেঘের ভেলা ভেসে চলেছে সারাটা আকাশ জুড়ে। চোখ মেলতেই দেখলাম, কোথায় রিও! কোথায় অলিম্পিক ! কোথায় অ্যাডম পিট! ঘুম যখন একদম ভাঙল, বুঝলাম এক আকাশ স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম আমি। অ্যাডম পিট, আমার অবচেতন মস্তিষ্কের মধ্যে সর্বদা বিরাজমান। তারই ফলস্বরূপ এই 'স্বপ্নদোষ'। সকালের বিছানা ত্যাগ করার পরিবর্তে পুনরায় যখন সেই কুঁকড়ে যাওয়া বিছানার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইলাম। ঠিক তখনই দরজায় কড়া পাড়ার আওয়াজ কানে এল। শ্লথ গতিতে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি, মা চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের পেয়ালা থেকে, সরু সরু ধোঁয়া গুলো উপরের ভেসে বেড়াচ্ছে। সকাল বেলা, মায়ের স্নিগ্ধ রূপ দেখলেই মনটা কেমন ভাল হয়ে যায়। সদ্য স্নানাদি কার্য সম্পন্ন করার ফলে মা'র শরীর থেকে একটা মিষ্টি সুগন্ধ ভেসে আসছে। এটার থেকেও যেটা আমার সবথেকে বেশি প্রিয়! মা'র কাছে গেলেই, 'মা মা' একটা গন্ধ যেন আমার নাসারন্ধ্রে ঝাপটা মারে। ওই গন্ধে, সমস্ত ক্লান্তি ধুয়ে মুছে একদম পরিষ্কার হয়ে যায়।
-" কতক্ষণ দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবি? চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো!"
মা'র কথায়, মৃদু আওয়াজ করে মুচকি হেসে সরে দাঁড়িয়ে থাকি এবং দূর থেকেই দেবী মূর্তির প্রতিরূপ মা'কে পরিলক্ষিত করতে থাকি। পাড় ভাঙা ঘিয়ে রঙা লালচে পাড় ওয়ালা শাড়ির সাথে কপালে মস্ত বড়ো লাল টিপ। মা'র 'মা' রূপী সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য যথেষ্ট। সদ্য পুজোর ঘর থেকে বেরোনোর ফলে, স্যান্ডেলের সুগন্ধি যুক্ত ধূপের গন্ধ মা'র শরীরের সাথে এখনো লেপ্টে আছে। দেবী মূর্তির প্রতিরূপ, মা'র দিক থেকে নজর ফেরাতেই পারি না সেই মুহুর্তে।
***
[৪]
ডক্টর, অনুভব দাশগুপ্তের চেম্বারের ইন্টারকমের মাধ্যমে ভেতরে প্রবশের অনুমতি হ'ল রিসেপশনে বসে থাকা দু'টো শরীরের। একবার রিসেপসনিস্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, দুজনেই প্রবেশ করল ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বারের অন্দরমহলে। তখনও মিসেস তমশা মুখার্জী গভীরভাবে নিদ্রাচ্ছন্ন। মুখমন্ডল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ প্রশস্তি। বোধহয় কতদিনের পর এমন শান্ত চিত্তে, প্রসন্নবদনে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়েছেন তিনি। নিদ্রাচ্ছন্ন মিসেস মুখার্জীকে দেখা মাত্র, ঘরের মধ্যেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মধ্যবয়স্ক মিস্টার মুখার্জী। কাঁচের টেবিল ঘিরে থাকা তিনটে চেয়ারের মধ্যে, দু'টো চেয়ার দখল করে বসলেন মিস্টার অসীম কুমার মুখার্জী এবং তাঁর একমাত্র কন্যা সন্তান তিথি মুখার্জী। দু'জনের দিকেই ডক্টর দাশগুপ্ত একবার অবলোকন করেই বলতে শুরু করলেন:
-" মিস্টার মুখার্জী! আপনাকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি আমি দিতে চাই না। আপনার মিসেস ঠিক কবে সুস্থ হয়ে উঠবেন পুরোপুরি। সে বিষয়ে আমি যথেষ্ট সন্দিহান। ওনার মধ্যে একধরনের ট্রমা কাজ করছে। যার কারণে উনি ডিপ্রেশনের শিকার হচ্ছেন প্রতিবার। সামগ্রিক কারণেই ওনার প্যানিক এ্যাটাক হচ্ছে বারবার।"
ডক্টর দাশগুপ্তের কথা শেষ হতেই, তিথি বলে ওঠে:
-" ডক্টর! তাহলে মা কি কোনোদিনই সেরে উঠবে না? "
ডক্টর দাশগুপ্তের কাছেও এই প্রশ্নের সঠিক জবাব ছিল না। তাও তিনি ভরসা দেওয়ার সুরে বলে উঠলেন:
-" আমরা সবাই চেষ্টা করছি, তিথি। চেষ্টা ছাড়া আমাদের তো আর কিছুই করার নেই। ভরসা রাখ ভগবানের ওপর। সর্বশেষ মিরাক্যাল যদি কেউ করে থাকেন তিনি হলেন সর্বশক্তিমান। তিনি ডাক্তারেরও ওপরে।"
এইটুকু কথা বলেই ডক্টর দাশগুপ্ত, সিলিং এর দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে মিসেস মুখার্জীর ঘুম ভাঙ্গা কন্ঠস্বর ধ্বনিত হ'ল ঘরের মধ্যে।
***
[৫]
টি টেবিলের ওপর চায়ের ট্রে রাখতেই মা'র দিকে এগিয়ে গেলাম আদর খাওয়ার জন্য। মা'কে বিছানার উপর বসিয়ে, মায়ের কোলের মধ্যে মাথা রেখে আদর খেতে লাগলাম। কালো কুচকুচে, স্প্রিং রোলের মতো চুল গুলোর মধ্যে মায়ের আঙ্গুল বিলি কেটে চলেছে নিরন্তর। একসময় আবেগ জড়ানো কন্ঠে মা'কে বলে উঠলাম :
-" মা গো। ও মা। আমি সাঁতারে ভর্তি হতে চাই। "
আমার এহেন মন্তব্যে মা, রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল:
-" জলের মধ্যে তোমাকে যেতে হবে না। কুষ্টিতে লেখা আছে জল এবং আগুনে তোমার বিপদ আছে। তাই..."
রেগে গেলে বা উত্তেজনা গ্রাস করলে, মা আমাকে 'তুমি' সম্বোধন করে ওঠে। আমি তখনকার মতো মৌনব্রত ধারণ করলাম। ওই মুহুর্তে, মৌনব্রত পালন করাই শ্রেয় মনে হয়েছিল। তবে মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে নিয়েছিলাম, বাবাকে বলে মা'কে রাজি করাতেই হবে। মা রাজি না হলে আমার স্বপ্ন, নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাবে।
****
[৬]
মিসেস মুখার্জীর কন্ঠস্বর কানে আসতেই ডক্টর দাশগুপ্ত, মৃদু স্বরে বলে ওঠেন:
-" কেমন বোধ করছেন, মিসেস মুখার্জী?"
প্রশ্নকারী ডক্টর দাশগুপ্তের প্রশ্নের উত্তরে, মিসেস মুখার্জী ঈষৎ মস্তিষ্কের সঞ্চালনা ঘটালেন ওপর-নীচে। যার অর্থ, উনি হয়তো বোঝাতে চাইলেন 'ভাল'। তিনজোড়া চোখ, মিসেস মুখার্জীর দিকে তাকিয়ে নিজেদের মধ্যে ইশারায় কথা বলে নিল যেন।
ডক্টর দাশগুপ্তের থেকে বিদায় নিয়ে, বড়ো রাস্তার ধারে ট্যাক্সির অপেক্ষায় রত মুখার্জী পরিবার। ঠিক এমন সময়, ফুটপাথ লাগোয়া, কর্পোরেশন দ্বারা নির্মিত নলের জলের ধারা দেখে আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, তমশা দেবী।
-" অপচয়....অপচয়....জল অপচয় !"
-" এখুনি জল শেষ হয়ে যাবে। এখুনি বন্ধ করে দাও নলের মুখ। নইলে নইলে...."
কথা শেষ হয়না, তমশা দেবীর। ততক্ষণে তিনি ঢলে পড়েছেন তাঁর স্বামীর, শক্তিশালী কাঁধের ওপর। রাস্তায়ও বেশ কিছু লোকজন উপস্থিত হয়েছে, তমশা দেবীর চিৎকারে। তিথি, দাঁড়িয়ে আছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। বাবার কাছে ঘেঁষে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল:
-" কিছুটা এগোলেই ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বার। ফিরে যাবে একবার?"
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, মিস্টার মুখার্জী মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন:
-" ডক্টর দাশগুপ্ত চেম্বার ছেড়ে চলে গেছেন বোধহয়। তাছাড়া আমরাই শেষ অবধি...."
মেয়ে-বাবার কথপোকথনের মাঝেই একটা হলুদ রঙা ট্যাক্সি ওদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করে ওঠে:
-" যাবেন নাকি বাবু?"
ট্যাক্সি দেখেই, ওরা তৎক্ষণাত ট্যাক্সি তে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। পেছনে ফেলে রেখে আসে কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষের চোখ।
***
[৭]
বাবাকেও যে এতটা পরিমাণ কষ্ট করে রাজি করাতে হবে ভাবতেই পারিনি। এল.এই.সি অফিসার হওয়ার সুবাদে আমার ওপর একটি শর্তের তালিকা আরোপিত হওয়ার পর সাঁতারে ভর্তি হওয়ার আদেশ মঞ্জুর হ'ল। প্রথম শর্তই ছিল পড়াশোনা যেন সাঁতারের কারণে বিসর্জিত না হয়। সেকেন্ডারি চয়েস হিসাবে আমি সাঁতারে ভর্তি হতে পারি। আরও কিছু শর্ত আরোপিত হওয়ার পর আমি সাঁতারের ক্লাসে আজ যেতে পারছি অবশেষে। দমদম থেকে বাঙ্গুর যাওয়ার পথে এইসব কথা যত ভাবছিলাম তত মনের মধ্যে হাসি ফুটে উঠছিল। হাসিটা আরও চওড়া হ'ল যখন মা'র কাষ্ঠ মুখমন্ডলের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। আমার হাসি মাখা মুখ দেখেই, পাশের সিটে বসা ভদ্রমহিলা আমার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে দেখলেন মাত্র। ওনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রশ্রয় না দিয়ে কানের মধ্যে ইয়ার ফোন লাগিয়ে দিয়ে প্রিয় অরিজিৎ সিং এর গানের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করলাম।
জলে নেমে প্রথমটা খুবই ভয় করছিল। বোধ করি এখুনি ডুবে যাব। সাঁতারের স্যার এর বদান্যতায় একটু একটু করে জলের গভীরে নামতে শুরু করি। হাঁটু ডোবা জল ছেড়ে আমি এখন কোমর ডোবানো জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মনের মধ্যে যে একটা ভীতু বাসা বেঁধে বসেছিল! জলে না নামলে জানতেও পারতাম না। যখনই ভয়টা গ্রাস করতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল অ্যাডম পিটের ছবি থেকে শুরু করে অলিম্পিকের পোডিয়াম। সাহসে ভর করে, গলা ভর্তি জলের গভীরতার দিকে এগোতে লাগলাম।
প্রথমদিনের ক্লাসে সেরকম কিছুই করালেন না স্যার। সর্বাগ্রে যেটা প্রয়োজন সেটা হ'ল জলের প্রতি ভীতি কমানো। সেই কাজটাই স্যার, ভীষণ দক্ষতার সঙ্গে করছিলেন কিছু মূল্যবান কথার মাধ্যমে এবং কিছু ব্যক্তিত্ব যেমন - মাসুদুর রহমান থেকে শুরু করে বুলা চৌধুরীর কথা, আমাদের সমুখে তুলে ধরার মাধ্যমে। তাছাড়াও আরও কিছু স্কিল নিয়ে আলোচনা করলেন। কিভাবে জলের মধ্যে নিশ্বাস - প্রশ্বাস কন্ট্রোল করতে পারি সেই ব্যপারেও বড় একটা দীর্ঘ বক্তৃতা মেলে ধরলেন আমাদের সমুখে।
স্যার এর ক্লাস শেষের পর, জলে ভেজা সুইমিং কস্টিউম বদলে নিয়ে শুকনো জামা কাপড়ে আবৃত হয়ে বাইরে বেরোতেই মুঠোফোনটা বেজে উঠল প্রবল চিৎকার করে। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করতেই, স্ক্রিনে ওঠা 'মা' নামটা দেখে ফোনটা ঝটপট রিসিভ করতেই....
-" তখন থেকে ফোন করছি ফোনটা রিসিভ করতে কি হয় তোর? আমার চিন্তা যে হয়,তোরা বাপ-বেটি বুঝবি কি করে! নিজেদের মতে চলবে সবসময়।"
ভীষণভাবে অবহেলিত সামনে থাকা, সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেঞ্চের উপর বসে পড়ি অগত্যা। জানি, মা'র এখন থামতে সময় লাগবে। বেঞ্চের ওপর বসে, গাছের ওপর বসে থাকা অজানা পাখির ডাকে পাখিটার দিকে চোখ মেলে দেখতে গেলাম। নজর পড়া মাত্রই, ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে একটা গাছের ডাল থেকে অন্য গাছের ডালের ওপর গিয়ে বসল এবং সুমিষ্ট কুজন করেই চলল অবিরত। এদিকে মা তখনও বলেই চলেছে!
***
[৮]
সেদিনের কিছু অনুসন্ধিৎসু চোখ এড়িয়ে, মিসেস মুখার্জীকে বাড়িতে আনা গেলেও প্রতিদিন তাঁর ভিন্নধর্মী কার্যকলাপে, মিস্টার মুখার্জী সহ তাঁর কন্যা তিথি কার্যত নাজেহাল হয়ে উঠেছেন। রাস্তায় দেখা, খোলা নল থেকে বহমান জলের ধারা দেখার পর থেকে, তমশা দেবী যারপরনাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন কোনো এক অজানা ভয়ের কারণে। এবং সেই ছাপ, তাঁর চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। তাঁর চোখ মুখের দিকে তাকানো খুবই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। সমগ্র মুখমন্ডল জুড়ে মালিনতা গ্রাস করেছে। চোখের নীচের কালচে বলিরেখার দাগ আরও কালচে রঙ ধারণ করেছে। শরীরের প্রতিটি অংশ, শীর্ণতার কবলে কবলিত প্রায়। হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি। ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বার থেকে ফিরে আসার পর থেকে, মিসেস মুখার্জীর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার পরিবর্তন, স্পষ্টতই পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিছু এলোমেলো নেগেটিভ চিন্তাভাবনা তাঁকে গ্রাস করেছে। কিছুদিন আগের ঘটে যাওয়া বীভৎস ঘটনায় কার্যত মুষড়ে পড়েছেন মিস্টার মুখার্জী।
মিস্টার এবং মিসেস মুখার্জীর একমাত্র আদরের কন্যা, তিথি। মায়ের সেবা চালিয়ে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে। মা'কে ঠিক করে তোলার যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। কৈশর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা তিথির কাছে এই ব্যপার যে কতটা কষ্টকর! তা তার চোখ মুখ দেখলেই পরিদৃষ্ট হয়। তাও সে লড়াই জারি রেখেছে, মা কে ভাল করার। কারণটা যে নেহাতই তুচ্ছ কারণ নয়! কতদিন, মা'র ধমক খেয়ে তার সকালের সূর্য দেখা হয়নি। মা'র কোলের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে, কুচকে যাওয়া কালচে চুল গুলোতে বিলি কাটা হয়নি। মা'র শরীরের সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে, 'মা মা' সুগন্ধটা আঘ্রাণ করা হয়নি। মা'র স্তব্ধতায়, মুখার্জী বাড়ি কার্যত শ্মশান পুরীতে পরিণত হয়েছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে বাবা-মেয়ে মিলে, সারিয়ে তুলতে তৎপর হয়েছে তাদের একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন কে।
****
[৯]
সাঁতার এর ক্লাস থেকে যখন বাড়িতে ফিরে এলাম তখন ঘনান্ধকার আকাশে বোগিথালার মতো চাঁদের উদয় হয়ে কালো আকাশকে আলোকের ঝর্ণাধারায় ধৌত করে দিয়েছে। বুকের মধ্যে একরাশ ভয়ের অনুভূতি নিয়ে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আসামীর মতো চুপিচুপি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করছি। লিভিং রুমে সবে মাত্র পা রেখেছি, হালকা আলোছায়ার খেলার মধ্যেই পরিলক্ষিত করলাম এক নারীমূর্তিকে। আলো আঁধারির মধ্যে মূর্তিটি সোফার উপর স্থানু হয়ে বসে আছে দরজার দিকে মুখে করে। জানালা দিয়ে ভেসে আসা চাঁদের ক্ষীণ আলো, নারীমূর্তির শরীরের ওপর চুঁইয়ে পড়ে নারীমূর্তিকে স্নিক্ত করার বৃথা চেষ্টা করছে। আমার মেরুদন্ড বেয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল, অনুভব করলাম। 'ভূত' বলে বীভৎস চিৎকার করতে যাব ঠিক সেই সময় গম্ভীরভাবে নারী কন্ঠটি বলে উঠল:
-" তোমার আক্কেল কবে হবে শুনি! তুমি ভাল করেই জান তুমি জলের মধ্যে গেলে আমার দুশ্চিন্তা হয়। তাও এবার একলা। এতবার কারণটা বললাম....তারপরেও বাবা-মেয়ে যা ঠিক মনে করবে তাই করবে। এদের চিন্তায় আমি যেদিন পাগল হয়ে যাব সেদিন সেদিন...."
****
[১০]
লিভিং রুমে বসে বাবা-মেয়ে মিলে চুপচাপ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিল। এমন সময় তিথির হাতের চায়ের পেয়ালা চলকে গিয়ে অল্প পরিমাণ চা প্লেটের উপর পড়ল। মিস্টার মুখার্জী মেয়ের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন:
-" কি হ'ল তিথি? অন্যমনা কেন?"
তিথি মাথাটা একবার বাম দিক থেকে ডান দিকে চালনা করল নিশ্চুপ ভাবেই। তার মনের মধ্যে বর্তমানে ভিড় করেছে হাজারো প্রশ্ন। বাবাকে কিছু উত্তর না করেই, 'মার কাছে যাচ্ছি ' বলে সেখান থেকে প্রস্থান করল সে। এখন যে তার মায়ের কাছে যাওয়ার খুবই দরকার। মা'র ঘরে যাওয়ার সময় ডান হাতের ব্যান্ডেজের দিকে একবার তাকিয়ে নিল।
ভেজানো দরজা একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। বিছানার সাথে মিশে আছে শীর্ণকায় শরীরটা। পরম তৃপ্তিতে নিদ্রা দেবীর কোলে আশ্রয় নিয়েছেন মিসেস মুখার্জী। বেশিরভাগ সময় তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। কারণ ঘুম ভাঙা অবস্থায় তাঁকে সামলে রাখা কার্যত কঠিন হয়ে ওঠে। তিনি তখন এতটাই বীভৎস রূপ ধারণ করেন! তিথির হাতের ব্যান্ডেজ সেই সাক্ষী বহন করে চলেছে। তিথি একটু একটু করে এগিয়ে গেল মায়ের বিছানার দিকে। ঘরের মধ্যে হালকা নিয়ন আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরময়। সেই আলোর মধ্যে বিশেষ কিছু পরিলক্ষিত হয়না। বিছানার সাথে মিশে থাকা শরীরের অস্পষ্ট ছবিটা ভেসে উঠছে নিয়ন আলো ভেদ করে। ঠিক সেদিনের মতো। সেদিন চাঁদের আলোর পরিবর্তে নিয়ন আলো, নারীমূর্তির ওপর চুঁইয়ে পড়ছে। হালকা আলোর রৈখিক পথ ধরে ধীরগতিতে এগিয়ে চলেছে তিথি। বিছানার সামনে এসে ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ল, ঠিক তার মায়ের মাথার কাছে। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, লড়াকু তিথি। মায়ের শরীর থেকে সবটুকু সৌন্দর্য কেউ যেন পরম আক্রোশে মুছে দিয়েছে। ঘরময় বিরাজ করছে, ওষুধের ভ্যাপসা গন্ধ। তিথির 'মা মা' গন্ধটা হারিয়ে গেছে ওষুধের ভ্যাপসা গন্ধের মাঝে। আলতো করে জড়িয়ে ধরল শীর্ণকায় শরীরটা। ফুঁপিয়ে উঠে বলতে লাগল:
-" আমরাই তোমাকে 'পাগল' করে দিলাম মা। আমাদের চিন্তায় তোমার আজ এই দুরাবস্থা।"
ঘুমন্তাবস্থা মা'কে জড়িয়ে ধরে, তিথি কতক্ষণ যে কেঁদে চলেছিল তার হিসাব নেই। কিন্তু সন্তানের কান্না, মা'র কর্ণগোচর হল কি আদৌ!
****
[১১]
ঘরের হালকা অন্ধকার নিমেষে নিমজ্জিত হ'ল ঘরের মধ্যে বিদ্যমান কৃত্রিম আলোর ছটায়। বাবা কখন যেন এসে লাইটের সুইচগুলো অন করে, ঘরের মধ্যেকার আলো গুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। সোফা থেকে কিছুটা দূরে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমি তখনও দাঁড়িয়ে আছি স্থানুবৎ হয়ে। মা'র কথা বলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কতক্ষণ যে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠিক বলতে পারি না। ঘরের মধ্যে আলোর ঝর্ণা বয়ে যেতেই মা'র দিকে চোখ পড়ল। কাষ্ঠ মুখে স্থির হয়ে বসে আছে সোফার ঠিক মাঝখানে। মা'র দিকে চোখাচোখি হতেই, হাতের ব্যাগ মাটিতে মা'র দিকে দৌড়ে গেলাম। রক্ত রাঙা জবার মতো আঁখি যুগল থেকে, বারি ধারা গড়িয়ে পড়ে মা'র নরম গাল দুটোকে স্নিক্ত করে তুলেছে। মা'র চোখে মুখে আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় স্পষ্ট। মা'কে জাপটে ধরে আমিও ক্রন্দনরত হয়ে উঠলাম। এহেন দৃশ্যপট দেখে বাবা, অবুঝের মতো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেড়ে দিয়ে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল এবং মা'কে উদ্দেশ্য করে আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলে উঠল:
-" কি হয়েছে তমু? এরকম অবস্থা কেন তোমাদের, মা-মেয়ের?"
আদর করে বাবা, মা'কে 'তমু' বলেই ডাকে। আমাদের কান্না ততক্ষণে থেমেছে এবং বিস্তারিত ভাবে সমস্ত ঘটনা বাবার সামনে তুলে ধরা হয়েছে, মা কর্তৃক। আমি তখনও মা'কে জড়িয়ে বসে আছি। সবকিছু শুনে গম্ভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা আবারও বলে উঠল:
-" এত ভয় করলে, আমাদের মেয়ে যে কোনো দিনও কিছু করতে পারবে না! ভয়ের কারণে, ওর স্বপ্ন গুলো যে আকালে ঝরে যাবে। উল্টে ওর না কিছু...."
বাবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মা বলতে শুরু করল:
-" ওর যা ইচ্ছে হয় করুক। শুধুমাত্র জল এবং আগুন থেকে ও দূরে থাকুক। সন্তান কে আগলে রাখার দায়িত্ব, সমস্ত কিছু বিপদ এর আঁচ থেকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের। আর বিপদের কথা জেনে শুনে ওকে তো আমি সেই বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারি না, মা হয়ে!"
একসাথে কথা গুলো বলে মা হাঁফাতে লাগল। মা'র আবেগের উপর বাবা বা আমি কখনও আঘাত হানতে চাইনি। অনেক চিন্তা, আলাপালোচনার পর বাবা একটা মধ্যস্থতা করে মা'কে রাজি করাল। এরপর থেকে প্রতিটা সাঁতারের ক্লাসে মা থাকত আমার সঙ্গী। কিন্তু এটা যে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল মা'র জন্য তখনই আমরা টের পাইনি।
****
[১২]
বিগত ক'দিনের ঝড় ঝাপটা সামলানোর পর, অবশেষে ডক্টর দাশগুপ্তের সঙ্গে দেখা করার ডেট পাওয়া গেল। কিছুদিনের জন্য আজ্ঞাতবাসে ছিলেন তিনি। এরপর যখন তিনি ফিরলেন স্বমহিমায় তখন আবার অ্যাপোয়েন্টমেন্ট পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়ল প্রায়। অনেক সাধ্য সাধনার পর, আজ অ্যাপোয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেছে। মা'কে নিয়ে আমি আর বাবা পৌঁছে গিয়েছিলাম, ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বারে। কারণ, সময় নষ্ট করার মতো বেশি সময় আমাদের হাতে ছিল না। প্রতিদিন মা'র অবস্থার অবনতি, আমাদের চিন্তিত করে তুলেছিল। একটা ঘরে নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিল নিজেকে। পুরোনো সব কাজকর্ম তথা পুরোনো অভ্যাস গুলো থেকে নিজেকে ক্রমশ গুটিয়ে নিয়েছিল। অবাক করার বিষয় হ'ল কোনো কিছু বিষয়ে নিজের উপর আক্ষেপ প্রকাশ করতে থাকল। মনে হ'ল জীবনে খুব বড়ো একটা ভুল করে ফেলেছে। মা'র আচার আচারণেও পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছিল। হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠছিল ক্রমাগত। এইসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে, ব্যান্ডেজ মোড়া হাতটার দিকে নজর পড়তেই সেদিনের বীভৎসতা মাখা ঘটনার কথাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। একগ্লাস জলের জন্য যে মানুষ এরকম উগ্র আচরণ করতে পারে! মা কে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। প্রচন্ড হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতা এবং ক্রুরতার সঙ্গে কুটিল হাসি হেসে আমার হাতের কাঁচের গ্লাসটা নিমেষে চাপ দিয়ে ভেঙ্গে দিল। এবং তার ফলস্বরূপ আমার হাতের উপর ব্যান্ডেজের প্রলেপ পড়ল। মা'ও যে ক্ষতবীক্ষত হয়েছিল, সেটা মনে করতেই বুকের বামদিকে মোচড় দিয়ে উঠল। হোক না সেই ক্ষতচিহ্ন, আকারে স্বল্প। তারপর থেকেই, বাবা আর রিস্ক নেয়নি। ডক্টরের কথা মতো ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হত মা'কে। ঘুম ভাঙলে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে স্নায়ু শান্ত রাখার ওষুধ গুলো খাইয়ে দিয়ে মা'কে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা করা হত। ওষুধের রিএক্ট করা শেষ হলেই, মা'র রিএক্ট করা শুরু হত। অগত্যা, ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করে মা'কে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হত।
ভাবনায় ছেদ পড়ত না। যদি না হলুদ ট্যাক্সিটা ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বারের সামনে এসে অদ্ভুত ভাবে ব্রেক কষে থামত। গাড়ির নিশ্চল অবস্থা দেখে বুঝলাম, আমরা আমাদের গন্তব্য স্থলে এসে পৌঁছেছি। গাড়ি থামতেই, বাবা এবং আমি মিলে মা'কে নিয়ে ধীরেসুস্থে ডক্টরের চেম্বারে প্রবেশ করলাম। বিশেষ ভিড় না থাকায়, দু'জনের পরেই আমাদের নম্বর এল। নম্বর আসা মাত্র মা'কে নিয়ে ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বারের অন্দরমহলে প্রবেশ করলাম। রোগীর জন্য চিহ্নিত করা জায়গায় মা'কে বসিয়ে দিয়ে, দু'টো চেয়ার দখল করে আমি আর বাবা বসলাম ডক্টরের মুখোমুখি হয়ে।
-" তিথি! হাতে কী হল? বেশ বড়ো ব্যান্ডেজের প্রলেপ দেখছি।"
কখন যে টেবিলের উপর ক্ষতচিহ্ন পূর্ণ হাতটা ছড়িয়ে দিয়েছি খেয়াল করিনি। ডক্টরের কথায় সম্বিত ফিরতেই সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি করে বসি সংক্ষেপে। আমার কথা শুনে, ডক্টর দাশগুপ্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মাত্র। কিছু সময় নিয়ে এবং কিছুটা নীরব থেকে পুনরায় শুরু করলেন:
-" তুমি যা বর্ণনা করলে এবং যেভাবে তোমার মা'র পরিবর্তনের কথা বললে, তার থেকে একটা জিনিসই প্রমাণিত হয়! "
এতটুকু বলে, আবারও একটু বিশ্রাম দিলেন কন্ঠকে। ডক্টরের মৌনব্রত আমাদের চিন্তিত করে তুলল। আমি আর বাবা বিস্ফারিত চোখে চাওয়াচায়ি করলাম একবার। মৌনতা ভেঙে ডক্টর তখন বলা শুরু করেছেন:
-" মিস্টার মুখার্জী! আপনার মিসেস পি.টি.এস.ডি অর্থাৎ পোস্ট ট্রমাটিক ডিসঅর্ডার এর শিকার। এই কারণে উনি এরকম অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। নিজেকে সবকিছু থেকেই গুটিয়ে নিয়েছেন। একটা প্যানিক এ্যাটাক ওনাকে গ্রাস করেছে। "
ডক্টর দাশগুপ্তের কথার মাঝেই আমি, গতবারের রাস্তার ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলাম। ডক্টর সবটুকু শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন। এবং বলা শুরু করলেন:
-" রাস্তার খোলা নল থেকে বয়ে যাওয়া জল দেখে উনি এরকম আচরণ করলেন?"
রীতিমতো আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে দিলেন। আমি কিছু বলার আগেই উনি বলতে শুরু করলেন:
-" রাস্তার খোলা নলের জল.... তোমার হাতের গ্লাসের জল.... গতবারের কেস হিস্ট্রিও বলছে জল নিয়েই উনি মন্তব্য করেছিলেন। চারিদিকে জল...."
ডক্টরের দাশগুপ্ত তখনও নিজের মনেই কি সব হিসেব করে চলেছেন। আমাদের কিছু বলার জন্য অপেক্ষা না করে মা'র দিকে এগিয়ে গেলেন এবং যাওয়ার পূর্বে ঘরের উজ্জ্বল আলোগুলো নিভিয়ে দিয়ে নীলচে আলো জ্বালিয়ে দিলেন। মা'র মুখোমুখি বসে, অতীতের ঘটে যাওয়া কার্যের মতো পুনরায় নীল-সাদা চাকতিটা মা'র মুখের সামনে দোলাতে থাকলেন। একটা সময়, মা'কে অর্ধচেতনা গ্রাস করল। তখনই ডক্টর দাশগুপ্ত একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছেন। সেই প্রশ্নের উত্তর গুলো জড়ানো কন্ঠস্বরে ক্লান্তিহীন ভাবে পরপর উত্তর দিয়ে চলেছে, আমার মা। সমগ্র ঘটনা যখন ঘটছে, তখন আমি আর বাবা একে অপরের হাতের ওপর হাত রেখে বসে আছি এবং বিক্ষিপ্ত উত্তর গুলো আমাদের কানে যতবার আসছে ততবার চমকে উঠছি। মনে মনে ভাবছি, এরকমও হয়!
****
[১৩]
আজ জলে নামতেই কিছু স্কিল দক্ষতার সঙ্গে শিখতে না শিখতেই একটা অঘটনের হাত থেকে রেহাই পেলাম। সুইমিং পুলের মধ্যে, মাথা ভর্তি জলের স্তরে পৌঁছে যখন অনুশীলন শুরু করেছি ঠিক তখনই ভুলবশত হোক বা কোনো অজানা কারণেই হোক স্কিল ভুলে জলের মধ্যে ডুবতে বসেছিলাম। ঠিক সামনেই স্যার ছিলেন বলে, নাকে মুখে জল প্রবেশ করা থেকে রেহাই মিলল। ওই দৃশ্য দেখে মা কখন যেন চেয়ার ছেড়ে সুইমিং পুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এবং হাহাকার জুড়ে দিয়েছে। মা'র ওই অবস্থা দেখে জল থেকে বেরিয়ে এসে, কার্যত চিৎকার করেই বলে উঠলাম :
-" মা, আমার কিছু হয়নি। এটা সুইমিং পুল, মা। এখানে কেউ ডুবে যায় না। আমি ঠিক আছি মা। তুমি চুপ কর। লোকজন দেখছে। প্লিজ মা!"
আমার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, ওই অবস্থায় আমার গালের উপর সপাটে একটা চড় মারল মা। সর্বসমক্ষে আমার প্রতি মা'র এই আচরণ আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। কিছু না বলে, নিশ্চুপ হয়ে ওই জায়গা ত্যাগ করে চেঞ্জিং রুমে চলে গেলাম।
বাসে উঠে কেউ কারোর সঙ্গে কথা বললাম না। দু'টো সিট দখল করে চুপচাপ বসে রইলাম মাত্র। বাঙ্গুর থেকে দমদম আসা পর্যন্ত একটাও বাক্যালাপ করিনি কেউ কারোর সাথে। বাস থেকে নেমেই, বাড়িতে এসে সোজা নিজের ঘরে প্রবেশ করলাম। সোফার উপর বসে থাকা, বাবাকে উপেক্ষা করেই ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছি, চোখের কোণ থেকে জলের ধারা নেমে এসে বালিশকে স্নিক্ত করে তুলছে। ঠিক এইসময় নীচ থেকে মা'র কন্ঠস্বর কানে এল। উত্তেজনা এবং রাগ মিশ্রিত এক অন্যরকম অচেনা কন্ঠস্বরে আমি বিছানার ওপর সোজা হয়ে বসলাম। মা'র উত্তেজিত কন্ঠস্বরের নীচে বাবার মৃদুস্বর কখন চাপা পড়ে গেছে। মা'র কন্ঠস্বরই কর্ণগোচর হচ্ছে এবং সেই কন্ঠস্বর শুনে যা প্রতীত হ'ল, আমার সাঁতারে যাওয়া বারণ হল আজ থেকে। সাঁতার নিয়ে আমি এবং বাবা যেন আর দ্বিতীয় বার কথা না বলি। কারণ কোনো অঘটন ঘটলে....
আর শুনতে ইচ্ছে করছিল না মা'র কথা। কানের মধ্যে দু'টো আঙুল দিয়ে আওয়াজ আসার পথে বাধা দিয়ে বিছানার সাথে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলাম। ঠিক এইসময় দরজার খোলার আওয়াজ কানে এলেও চোখ মেলে তাকানোর প্রবৃত্তি হ'ল না বিশেষ।
আমার মাথার চুলে বিলি কেটে চলেছে আঙুলগুলো। এই স্পর্শ আমার চেনা। এরই মাঝে আরও একটা ফোঁপানোর আওয়াজ কানে এল নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে। চোখ মেলে দেখলাম মা'র চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। আমি উঠে বসে মা'র চোখ মুছিয়ে দিলাম। একটা হাত, আমার গালের কাছে এনে লালচে জায়গার ওপর স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিল মা'র হাত। ফুঁপিয়ে বলে উঠল:
-" ছেড়ে দে সোনা। সাঁতার ছেড়ে দে। আজ তোর কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হব সোনা মা? অন্য কিছু কর। শুধুমাত্র জল থেকে দূরে থাক। আমি যে তোকে...আমি যে তোকে...."
মা'র মুখের দিকে তাকিয়ে একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। মা'র চোখে মুখে ফুটে উঠেছে, তার একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আর থাকতে না পেরে মা'কে জড়িয়ে ধরে আবেগপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলাম :
-" তুমি যা বলবে তাই হবে মা। "
-" আমি আর সাঁতারে যাব না, মা।"
কথার স্বরটা নিজের কাছে খুবই অচেনা ঠেকল। মা'কে খুশি করতে গিয়ে নিজের জীবনের সবথেকে মূল্যবান স্বপ্ন ভাসিয়ে দিলাম। বন্দি করে রাখা বুকের খাঁচা থেকে অ্যাডম পিটকে মুক্ত করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিলাম।
খাওয়ার টেবিলে আজ আমার পছন্দের সব রান্না। এর কারণ আমার কাছে অচেনা নয়। আমার মানসিক পরিস্থিতি ঠিকঠাক রাখার জন্য এত আয়োজন। সব মা-বাবাই চায় তাদের সন্তান খুশি থাকুক। বুকের মধ্যে চেপে রাখা কষ্টটাকে, মৃত ঘোষণা করলাম অচিরেই। মুখের মধ্যে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে মা-বাবার সাথে এক টেবিলে খেতে বসলাম।
****
[১৪]
ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বার থেকে বেরিয়ে, রাস্তার ওপর দাঁড়াতেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম আমরা। মা'কে নিয়ে আমরা ধীরেসুস্থে ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম। প্রায় জনমানবশূন্য রাস্তা ধরে ট্যাক্সি এগিয়ে চলেছে জেট প্লেনের গতিতে। প্রায় একবছরের একটু বেশি হ'ল কোলকাতার রাস্তাঘাট প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে আছে। রাস্তার আলোগুলো তাদের কর্মবিরতি পায়নি। দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ, কয়েকটি ওষুধের দোকান ছাড়া। আর কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানও চোখে পড়ল 'ওপেন' লেখা বোর্ডের সাথে। যবে থেকে প্রথম ঢেউ আছড়ে পড়েছে সারা দেশ তথা সমস্ত শহর জুড়ে তবে থেকেই মানুষের জীবনের চলার গতিতে পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ কারণ ছাড়া বাড়ির বাইরে পা ফেলা নিষিদ্ধ।
খাবার টেবিলে বসে খবর দেখা আমাদের তিনজনের পুরোনো অভ্যাস। প্রতিটা চ্যানেল জুড়ে একটাই খবর আছড়ে পড়ছে। খবরটা কানাঘুসো শুনেছিলাম বটে, আজ চাক্ষুষ করলাম নিউজ চ্যানেলর বদান্যতায়। বিদেশি ভাইরাস ঢেউ এর প্রথম ঝড় আছড়ে পড়েছে গোটা দেশ জুড়ে। যা কোলকাতা শহরেও হানা দিয়েছে। বিদেশি ভাইরাস থেকে বাঁচতে, ঘরবন্দি হতে হবে মানুষজনকে। আগামীকাল থেকে কার্যত সব দোকান বাজার বন্ধ। ভীষণ রকম প্রোটেকশন নিয়ে থাকতে হবে। সামাজিক দুরত্ব বিধি মানা থেকে শুরু করে হাত স্যানিটাইজ করা। যার ফল স্বরূপ সামাজিক থেকে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অবনতি। তার উপর হঠাৎ করে একটা না জানা প্যানিকে সবাই আক্রান্ত হয়ে পড়বে। আরও চিন্তার বিষয় যেটা, সেটা হ'ল গোটা দেশ জুড়ে যদি জলের ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ কিছুদিন আগেই নিউজ চ্যানেল জুড়ে এই খবরও পরিবেশিত হয়েছিল, দেশের কিছু জায়গায় জলের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এই অবস্থায় বিদেশি ভাইরাস ঝড়! এক নিমেষে গোটা দেশকে গ্রাস করবে চরম অব্যবস্থা।
ট্যাক্সিতে যেতে যেতেই এলোমেলো চিন্তা গুলো গ্রাস করেছিল আমায়। এলোমেলো চিন্তার মাঝেই মা'র দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম, উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। গভীরভাবে কিছু চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে। আমিও আর বিরক্ত না করে, বাইরের দিকে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। বিগত একবছরের ধাক্কায় আমি যেন কিছুটা বড়ো হয়ে গেছি। এখন আর মা'র আঁচল তলে সময় ব্যয় করি না। মা'র থেকে অজান্তেই একটা অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে। মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেও বহিঃপ্রকাশ করলাম না, মা'কে ছেড়ে আমি আর বাবা কেউ ভাল নেই। সেদিনের একটা খবর সব শেষ করে দিল।
***
[১৫]
খাবার টেবিলে খাওয়া ফেলে রেখে মা, তৎক্ষণাত উঠে গেল রান্নার ঘরে। খাবার কিছু মজুত আছে কিনা দেখে নিতে চাইল বোধহয়। খাওয়ার প্লেট ছেড়ে দিয়ে আমি আর বাবা স্থির দৃষ্টিতে টেলিভিশন সেটের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। তখনও টেলিভিশনের পর্দার ওপর ভেসে উঠছে, বিদেশ ভাইরাসের খবর। বিদেশি ভাইরাসের ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত গোটা দেশ। খবরের মাঝেই,অভিজ্ঞ ডাক্তার বাবুদের অভিজ্ঞ কথার সাথে সাবধান বাণী শোনা যাচ্ছে। যার অর্থ করলে এটাই বোঝায়:
সারাদিন ঘরবন্দি থাকা, সারাক্ষণ জল অপচয় করে হাত ধোয়া এবং সামাজিক বিধি নিষেধ মানা। তাহলেই ভাইরাসের প্রথম ওয়েভ রক্ষা করা যাবে। প্রতিটা চ্যানেলে এক খবর শুনে যখন একরাশ বিরক্তি গ্রাস করল তখন কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েই টেলিভিশন সেট বন্ধ করে দিয়ে ঘুমোতে গেলাম তিনজনে।
গতরাতে হিজিবিজি চিন্তাদের ভিড়ে ঘুমোতে প্রায় ভোররাত হয়ে গিয়েছিল। রাতের শেষ প্রহরে, পাখির কুজন শুনে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। ঘুমটা হঠাৎই ভাঙল একটা তীব্র আওয়াজ শুনে। ঘুম চোখ মেলে দেখলাম, কাকভোর তখনও বিরাজ করছে। ঠিকঠাক ঘুম না হওয়ার কারণে চোখের মধ্যে জ্বালা ধরে গেল। চোখ ঘসতে ঘসতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই, পা জোড়া থমকে গেল। স্টোর রুম থেকে একটার পর একটা পুরোনো বাসন পত্র বেরিয়ে এসে বারান্দায় জায়গা দখল করে বসে আছে। বাসনপত্রের ওপারে মা, সিদ্ধহস্তে আরও কিছু বাসন নামিয়ে চলেছে। বাবার দিকে চোখ যেতেই দেখলাম, নিশ্চুপ এবং নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মা'র দিকে তাকিয়ে। আমি দূর থেকেই মা'র উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম :
-" এত বাসন কেন বের করেছ মা? কি হবে এগুলো দিয়ে?"
মা'র উত্তর শুনে নিজের মধ্যে ঠিক কি প্রতিক্রিয়া হ'ল বুঝে উঠতে পারলাম না। কিছু না বুঝে প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে আমিও বাবার মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। মা'র বক্তব্য অনুযায়ী :
-" গতকাল দেখানো টেলিভিশন খবরের কারণে মা চিন্তিত। নিজেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তার জন্য প্রচুরপরিমাণ জলের প্রয়োজন পড়বে। তাই জল স্টোর করার জন্য মা'র এত আয়োজন। আর যেখানে দেশের কিছু অংশে জলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কে বলতে পারে জলের বেশি পরিমাণ ব্যবহারে কোলকাতা জুড়ে জলের আকাল হবে না!"
কথার মাঝেই, মা তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বাসন গুলো একটু সরিয়ে রাস্তা বের করে মা'র কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করলাম। মা'র কাছে গিয়ে, হাত ধরে মা'কে স্টোর রুম থেকে বারান্দায় বের করে নিয়ে এসে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। মা বুঝল কিনা বোধগম্য হ'ল না। আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল দ্রুত গতিতে। আমি আর বাবা ছড়িয়ে রাখা বাসন গুলো স্টোর রুমে চালান করে দিয়ে, পুনরায় ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ক্লান্তি থাকার কারণে নিমেষে দুই চোখের পাতা এক হয়ে এল।
**
[১৬]
ডক্টর দাশগুপ্তের চেম্বারে, মা'র কথা গুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে কর্ণগোচর হয়েছিল। ডক্টর দাশগুপ্ত মা'কে পরীক্ষা করে যখন জানান দিলেন, 'অ্যাকুয়াফোবিয়া' নামক একরকম ফোবিয়া মা কে গ্রাস করেছে তখন আমি বলে উঠলাম :
-" অ্যাকুয়াফোবিয়া তো জল থেকে যাদের ভয় গ্রাস করে তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন জলের মধ্যে নামা, গভীর জল দেখে ভয় পাওয়া বা বাথটাব, সিঙ্কের ওপর জল দেখে ভয় পাওয়া...."
হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে ডক্টর দাশগুপ্ত যোগ করলেন:
-" তিথি, এইসব তথ্য গুগল বাবুর থেকে তুমি নিয়েছ জানি। এবং সর্বতোভাবে প্রতিটা কথাকে সমর্থন করি আমি। তোমাকে সমর্থন করেও বলছি, তোমার মা'র কেসটা আলাদা। নইলে তোমার সাঁতার শেখা বন্ধ হত না এবং সেদিনের ঘটনায় উনি আতঙ্কিত হয়ে পড়তেন না। এটাও কিন্তু একধরণের ভয়। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে ফেলার ভয়। আর এটাও বলছি, ওনার ভয়টা 'হাউড্রোফোবিক' ও বলতে পার। কারণ ওনার মনের মধ্যে, উনি বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে আছেন যে বেশি জল অপচয় করলে একটা সময় জলের ঘাটতি দেখা যাবে সর্বত্র এবং পৃথিবীতে প্রাণের চিহ্ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আদতে তা হওয়ার চান্স খুবই কম। তাই ওনাকে জল জাতীয় জিনিস থেকে এবং জল থেকে দূরে রাখার পরিবর্তে একটু একটু করে সাবলীল করে তুলতে হবে, তিথি। সর্বাগ্রে ওনাকে হাসি খুশি রাখতে চেষ্টা করতে হবে। ওনাকে এসব বোঝাতে হবে ভীষণ ভালোবেসে এবং যত্নসহকারে। নইলে...."
এইবার ডক্টর দাশগুপ্তের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমি বলে উঠলাম:
-" না হলে আমার মা বদ্ধ উন্মাদগ্রস্ত হয়ে পড়বে! তাইতো ডক্টর?"
-" এই তিথি ওঠ। বাড়ি এসে গেছি। কি বকছিস ঘুমের মধ্যে !"
বাবার কথার সাথে ঝাঁকুনিতে ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখলাম মা তখনও আমার পাশে বসে আছে নির্লিপ্ত ভাবে। আমি ফুঁপিয়ে মা'কে জড়িয়ে ধরলাম। ডক্টর দাশগুপ্তের কথাগুলো আমার মস্তিষ্কের কেন্দ্রে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে গভীর ঘুমের মধ্যেও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে চমকিত হয়ে উঠলাম। মা'র প্রতি চিন্তা, আমাকে দিন দিন কেমন যেন করে তুলছে। নিজেকেই কেমন যেন পাগল প্রতিপন্ন হচ্ছে।
ডক্টর দাশগুপ্তের কথা মতো মা'কে খুশি করার জন্য আমি আর বাবা নিজেদের ডিটারমাইন্ড করেছি, এই কাজ আমরা যেনতেন প্রকারে আমরা করবই। মা'র সুস্থ হয়ে ওঠা আমাদের দু'জনের কাছেই খুবই মূল্যবান। মা ছাড়া এই ঘরটা ঠিক ঘর বলে মনে হচ্ছে না। তাই প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে মা'র পছন্দের কিছু রান্না বানিয়েছি আমি এবং বাবা। আজ কতদিন পর একসঙ্গে এক টেবিলে বসে খাব। মনে মনে পুলকিত হয়ে উঠলাম। স্বগতোক্তি করে উঠলাম :
-" বি পজিটিভ তিথি। মা'র কিচ্ছু হবে না।"
খাবার টেবিলে খাবার গুলো সাজিয়ে পুরোনো অভ্যাস মতো টেলিভিশন চালিয়ে দিলাম। মা এবং বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতেই দেখলাম বাবার হাত ধরে মা এগিয়ে আসছে। চুলগুলো যত্ন পায়নি বলে, উসকোখুসকো হয়ে উঠেছে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম আগামীকাল কি করতে হবে। না খাওয়ার ফলে, শীর্ণকায় শরীর আরও শীর্ণকায় হয়ে উঠেছে। দূর থেকে মা'কে দেখেই চোখের কোণ ভিজে উঠল। এইরূপে মা'কে যে আমি কল্পনাও করতে পারি না।
খাবার টেবিলে তিনজনে খেতে বসেছি। গম্ভীর মুখে নিশ্চুপ হয়ে মা অল্প অল্প খেয়ে চলেছে। আমি আর বাবাও খাওয়াতে মন দিলাম। হঠাৎই টেলিভিশন থেকে ভেসে এল একটা খবর এবং এই প্রথমবার দেখলাম মা মুখ তুলে তাকিয়ে আছে সেই আওয়াজের দিকে। টেলিভিশন সেটের দিকে মুখ ফেরাতেই দেখলাম, নিউজ রিডার একটাই খবর প্রতিবার চিৎকার করে বলে চলেছে:
-" সবাই সাবধান থাকুন। বিদেশি ভাইরাসের দ্বিতীয় ওয়েভ আসতে চলেছে খুব শীঘ্রই। বাড়িতে থাকুন। সুস্থ থাকুন...."
খবরের মাঝেই একটা ক্ষীণ কন্ঠস্বর আমাদের কর্ণকুহরে এসে ধাক্কা মারল। শুধুমাত্র ক্ষীণ বললে, বলা ভুল হতে পারে। সেই কন্ঠে মেশানো ছিল এক অন্যরকম ভয়। ক্ষীণ কন্ঠস্বর, কম্পন মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল:
-" আবার জলের আকাল হবে। এত বাসন পত্র ধোয়া, রান্নার কাজ, খাওয়া-দাওয়া, নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ কর্মে ব্যঘাত ঘটবে। জল শেষ হয়ে গেলে এতকাজ কি করে হবে!"
এতদিন পর মা'র কন্ঠস্বর শুনে আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে ভীত হয়ে পড়লাম পুনরায়। বুঝলাম, ঝড়ের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার খুব একটা কারণ ছিল না, যেহেতু ডক্টর দাশগুপ্ত পূর্বেই আমাদের সবকিছুই অবগত করেছেন, মা'র কন্ডিশন সম্পর্কে।
খাবার গুলো টেবিলের ওপর অর্ধভুক্ত অবস্থায় অবস্থান করছে। মা ইতিপূর্বেই খাবারের টেবিল ছেড়ে উঠে গেছে, স্বগতোক্তি করতে করতে। স্খলিত পায়ে টলতে টলতে নিজের ঘরে চলে গেছে অনেক্ষণ। আমি আর বাবা, ভাত মাখা হাত নিয়ে, ডাইনিং চেয়ারে বসে আছি অনেকক্ষণ। টেলিভিশন পর্দার ওপর তখনও, নিউজ রিডার খবর পড়েই চলেছে:
-" সুস্থ থাকুন। সাবধানে থাকুন। সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখুন। জল এবং স্যানিটাইজার দিয়ে যতবার পারেন হাত ধৌতকরণ করুন।"
****
[১৭]
বিদেশি ভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার আগেই, আমাদের সমস্ত ঘর জুড়ে এক বীভৎস ঝড় আছড়ে পড়ল। যে ঝড়ের নামকরণ করা যায়, আতঙ্কের ঝড় নামে। খবর শোনা ইস্তক, মা'র অস্বাভাবিকতা পুনরায় ফিরে এসেছে। আগের শান্ত স্বভাবে, ছেদ পড়েছে। পুনরায় হিংস্র হয়ে উঠেছে, মা আমার। জল বা জল জাতীয় কোনো জিনিস দেখলেই, উন্মাদ প্রায় হয়ে উঠছে। পানের নিমিত্তে, জলের গ্লাস সামনে নিয়ে গেলেই, ক্রুদ্ধভাব আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সারাদিন আপন মনে কথা বলেই চলেছে নিজের সাথে। স্নায়বীয় উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য যে ওষুধের প্রয়োজন, তাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে কার্যত। সেদিনের পর থেকে একটাও ওষুধ খাওয়াতে পারিনি, মা'কে। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলাম। কেন যে টেলিভিশনে খবর শুনতে গেলাম! মা'র এই অবস্থার জন্য আমি এবং একমাত্র আমিই দায়ী। প্রচন্ড রাগে, কংক্রিটের দেওয়ালের ওপর মাথা ঠুকতে লাগলাম। আহত হওয়ার আগেই, বাবা এসে প্রচণ্ডভাবে ধমক দিয়ে উঠে বলতে শুরু করল:
-" তুই ও কী রকম পাগলামি শুরু করলি, ঠিক তোর মা'র মতো। তোদের দু'জনকে নিয়ে আমি যে এবার উন্মাদ প্রায় হয়ে উঠব। "
বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, বাবা। এই প্রথম বাবার চোখে জল দেখলাম। নিজেকে শান্ত করে বাবার দিকে এগিয়ে গিয়ে, কাঁধের ওপর ভরসার হাতটা ছড়িয়ে দিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, যতই ভেঙ্গে যাই না কেন বাবার সামনে প্রকাশ করব না। মা'কে সুস্থ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেই হবে। অনেকদিন হল, মা'র শরীর থেকে 'মা মা' গন্ধটা নেওয়া হয়নি।
***
[১৮]
প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেও আদতে কিছুই করতে পারলাম না। মা'র অবস্থা দিন দিন আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। আজ কতদিন হ'ল ওষুধ গুলো পড়েনি। প্রায় অভুক্ত হয়ে আছি পুরো পরিবার। জলের প্রতি ভীতি মানুষকে চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে পারে! মা'র এই অবস্থার সাক্ষী না হলে বিশ্বাস করতাম না। যে মানুষটা জল ছাড়া কিছুই ভাবতে পারত না। সারাদিনে যে কতবার ঘর মুছে চকচকে করে তুলত, তার হিসেব নেই। শীত হোক বা গ্রীষ্ম, স্নানের সংখ্যা দেখলে আমি আর বাবা বিরক্ত হয়ে উঠতাম রীতিমতো। অনেকবার বারণ করা সত্বেও, মা ছিল মায়ের মতো করে। সেই মানুষটা আজ, জল দেখলেই আঁতকে উঠছে। জল অপচয়ী হিসাবে নিজেকে অপরাধীর কাঠ গোড়ায় দাঁড় করিয়েছে। সমস্ত রকম পুরোনো অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত করেছে। ক্রমশ, ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
মা'র অবস্থায় বিন্দু মাত্র উন্নতি দূরে থাক, এতটাই অবনতি হয়েছে যে বাধ্য হয়ে ডক্টর দাশগুপ্ত কে বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ জানিয়েছি। ফোন করা সত্বর ডক্টর তৎপর হয়ে আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন। মা বর্তমানে মূর্চ্ছিত হয়ে মেঝের ওপর পড়ে আছে। এই কদিন আমাকে বা বাবাকে কাওকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়নি, মা। যতবার চেষ্টা করেছি কাছে যাওয়ার, ক্রুদ্ধভাবে আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে। অবশেষে ডক্টর দাশগুপ্তকে বাড়িতে ডাকতে বাধ্য হয়েছি আজ।
সংজ্ঞাহীন মা'র শরীরটা পরীক্ষা করে এবং নাড়ী পরীক্ষা করে, ডক্টর দাশগুপ্ত তৎক্ষণাত হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। ডক্টর দাশগুপ্তের নির্দেশ মতো ত্রিশ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে হাজির হ'ল আমাদের দরজার ঠিক সামনে। সময় নষ্ট না করে, সংজ্ঞাহীন মা'র দেহটা নিয়ে লালবাতি জ্বালিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটা যখন আমাদের ঘর ছাড়ল তখন নীলাকাশে, ভাণু তার রক্তিম আভা মাখিয়ে দিয়েছে।
****
[১৯]
বছর দুই পার করে, মা আজ কিছুটা সুস্থ হলেও মেন্টাল অ্যাসাইলেম থেকে বাড়ি ফিরতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে। আমি আর বাবা প্রতিদিন যাই মা'র সাথে দেখা করতে। তিনজনেই নিশ্চুপভাবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে আসি যে যার অবস্থানে। কথা না বলেলেও অনুভবে বুঝতে পারি, অতীতের তুলনায় মা আজ খুবই শান্ত।
প্রতিটা সকাল নতুন দিনের সূচনা করে এবং প্রতিটা সকাল জানান দিয়ে থাকে আজকের সারাটা দিন কেমন ভাবে যাবে। প্রতিটা সকাল আমাদের কাছে নতুন সকালের মতো। প্রতিদিন আমরা বাঁচার চেষ্টা করছি, অন্য আর পাঁচটা দিনের মতো করে। আমরা এটাও বিশ্বাস করি সেই স্বর্ণালী 'আদার ডে' আমাদের তিনজনের জীবনে ফিরে আসবেই। মা, হয়তো একদিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে। আমিও আবার সাঁতারের ক্লাসে ভর্তি হব। হয়তো অ্যাডম পিটকে পুনরায়, নিজের হৃৎপিন্ডের খাঁচায় প্রতিস্থাপন করতে পারব। আমি অপেক্ষায় আছি সেই, 'অন্য দিনটা'র অপেক্ষায়। এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। আমি বা আমরা যতই, খাঁচার ভিতর অচিন পাখির মতো ছটফট করি না কেন! সময়ই কিন্তু শেষ কথাটা বলে।
ব ন বী থি পা ত্র
ম্যাপল পাতায় শিউলি ফুলের গন্ধ
দোতলার এই ব্যালকনিটায় বসলে সূর্যাস্তটা খুব সুন্দর দেখা যায়। ম্যাপল গাছের ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে সূর্যটা যেন হারিয়ে যায় দূরের বাড়িগুলোর ফাঁকে। যেদিন সন্ধেটাতেই একটু সময় পায় কফির কাপটা হাতে করে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় সম্পূর্ণা। নিজের অজান্তেই মনে মনে হিসাব করে প্রতীক্ষার খাতায় আরও একটা দিন যোগ করে নেয় নীরবে। নেপারভিলে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করে সেপ্টেম্বরের শেষ থেকেই। এই পড়ন্ত সন্ধেতে বাইরে বেশ শিরশিরানি ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। অক্টোবর মাসের ষোল তারিখ হয়ে গেল, এখন তো রোজ এক-দু ডিগ্রী করে তাপমাত্রা নামবে। ম্যাপেলের পাতা এর মধ্যেই ঝরতে শুরু করেছে। ঝরে পড়া খয়েরী আর কমলা পাতার আড়ালে ঘাসের সবুজ ঢাকা পড়ে যায়। ছোটবেলায় মোম রং দিয়ে ম্যাপল পাতার ছবি আঁকার কথা মনে পড়ে যায় সম্পূর্ণার। কখনও যে সেই ম্যাপল পাতার দেশে এসেই বসবাস করবে, সেটা বোধহয় স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি। ভাবনার সঙ্গে জীবনটা কী আদৌ মেলে! জীবন চলে তার নিজের গতিতে। মানুষকে শুধু যেন সেই গতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। সম্পূর্ণা কি জীবনে কখনও ভেবেছিল বাড়িতে দুর্গাপুজো হবে, আর সে যেতে পারবে না! এক দু বছর নয়, টানা তেরো বছর পুজোতে বাড়ি যেতে পারেনি।
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে....
ঘরে মোবাইলটা বাজছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অর্জুনের সঙ্গে যখন আলাপ হয়, তখন থেকেই গানটা যেন ভীষণভাবে নাড়া দিত সম্পূর্ণাকে। যখন থেকে মোবাইল ব্যবহার শুরু করেছে, এই গানটাকেই অর্জুনের নম্বরের রিংটোন করে রেখেছে। অতগুলো বছরে অনেকগুলো মোবাইল আর মোবাইল নম্বর বদলালেও গানটা বদলায়নি সম্পূর্ণা। অর্জুন একটু আগেই বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়েছে। উইকএন্ডের দিনটা ওরা চারজনই একসঙ্গে ঘুরতে বেরোয়। দূরে কোথাও না গেলেও কাছের রিভারওয়াক পার্কে সারাদিনের অনেকটা সময় কাটিয়ে আসে। আগামী দিনগুলোর কর্মব্যস্ত জীবনে ছুটে চলার জন্য প্রাণ ভরে কিছুটা অক্সিজেন নিয়ে আসে। সম্পূর্ণার আজ বেরতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু বাচ্চারা সারা সপ্তাহ এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ওদের এই চাওয়াটুকুকে নষ্ট হতে দিতে রাজি নয় সম্পূর্ণা। তাই আজ সূর্য আর ঈশাকে নিয়ে অর্জুন একাই গেছে। গতমাসে সূর্যর স্কুল থেকে মিউজিয়ামে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু টনসিলের প্রবলেমের জন্য সূর্য সেদিন স্কুল যেতে না পারায় ওর মিউজিয়াম যাওয়া হয়নি। ডুপেজ চিলন্ড্রেন মিউজিয়ামে যাবে আজ ওরা। বাচ্চা দুটোর মনটা ভালো লাগবে। কিন্তু আজকের দিনটাতে তো এর থেকে অনেক বেশি আনন্দ, অনেক বেশি ভালোলাগা পাওনা ছিল ওদের।
আজ দুর্গাষষ্ঠী। সূর্য আর ঈশার বয়সে নিজের ফেলে আসা দিনগুলো যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সম্পূর্ণার। তখন ওরা গ্রামের বাড়িতেই থাকত। বড় জ্যাঠারা সদ্য গ্রামেই পাকা বাড়ি করে, উঠে গেছে নতুন বাড়িতে। তখন অবশ্য পাকা বাড়ি বলত না কেউ, বলত দালান বাড়ি। ওদের পুরনো বাড়িটা ছিল মাটির দোতলা, অনেকগুলো ঘর, কারেন্টও এসেছে কয়েক বছর হল। ঘরে ঘরে হলুদ বাল্ব জ্বলে। সব ঘরে তখন অবশ্য ফ্যান ছিল না। বড়পিসি জামাইষষ্ঠীর সময় কলকাতা থেকে একটা সিলিংফ্যান কিনে এনে ঠাকুমার ঘরে লাগিয়ে দিয়েছিল। সে কী বনবন করা হাওয়া! অত জোর হাওয়ায় ঠাকুমার নাকি বুকে ব্যথা করে। সম্পূর্ণারা ভাই বোনরা মিলে মাঝেমধ্যেই বড়দের নজর এড়িয়ে ঠাকুমার ঘরে ফ্যানের হাওয়া খেতে যেত। ধরা পড়লেই দাদা দিদিরা দিব্যি দোষ চাপিয়ে দিত সম্পূর্ণার ঘাড়ে। ও ছিল বাড়ির সবার ছোট, তাই সবার কাছে একটু বেশি আদুরে। দাদা দিদিরা জানত সম্পূর্ণা দোষ করলেও অতটা কড়া শাস্তি জুটবে না ওর কপালে। তবে ওর একার নামে মিথ্যা দোষ দেওয়াটা ধরে ফেলত মেজজ্যাঠা। রাতে পড়তে বসে পাঁচখানা করে অঙ্ক বেশি করার শাস্তি বরাদ্দ হত সবার জন্য।
বড় জ্যাঠাদের নতুন বাড়ির প্রতি ওদের ভাইবোনদের একটা দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল। ওটা যেন তাদেরই নতুন বাড়ি। কী সুন্দর লাল টকটকে শান বাঁধানো মেঝে। গরমের দিনে মেঝেতে গড়িয়ে পড়লে শরীর যেন জুড়িয়ে যায়। বড়দার বিয়ের পর সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল। বড়বৌদি অত হট্টগোল পছন্দ করত না। কী যে হয়েছিল সম্পূর্ণা আজও জানে না। ঠাকুমা একদিন ওদের ভাইবোনদের সবাইকে ডেকে ওবাড়িতে না যাওয়ার দিব্যি দিল। নিজেও আর কখনও পা দেয়নি ওবাড়িতে। বড়দার ছেলের অন্নপ্রাশনে সবাইকে খেতে যাওয়ার অনুমতি দিলেও ঠাকুমা নিজে যায়নি।
ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই সব যেন ঢেউয়ের মত আছড়ে এসে পড়ে সম্পূর্ণার
স্মৃতির বালুতটে। পুজোর দিনগুলো মনে করতে গিয়ে এলোমেলো কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওদের তো বাড়ির পুজো। বাবার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার আমল থেকে পুজো হচ্ছে। পাঁচপুরুষে পা দিয়েছে পুজোটা। বংশ পরম্পরায় শরিক বেড়েছে। সঙ্গে পুজোর জৌলুসও বেড়েছে। সম্পূর্ণা এখনকার কথা তো জানে না, তেরো বছর তো পুজোয় বাড়ি যেতেই পায়নি। তিনবছর অন্তর ওদের পালা পড়ত। সেবার পুজোর খরচ দায়িত্ব সবকিছু ছিল বাবাদের চার ভাইয়ের। বড়দাদুদের বা ছোটদাদুদের পালাতেও আনন্দের কোন রকমফের ছিল বাড়ির ছোটদের। খরচখরচাটা পুরোটাই ছিল বড়দের ব্যাপার। সম্পূর্ণা তো এসব শুনেছে বড় হয়ে। বসতবাড়িটা মাটির হলে কী হবে, নাটমন্দির ছিল বাঁধানো। প্রতি বছর পুজোর আগে সংস্কার হত, চুনের কলি ফেরানো হত। রথের দিন কাঠামোতে মাটি দেওয়ার দিন থেকেই যেন পুজোর আমেজ শুরু হয়ে যেত। সন্ধেবেলা পড়তে বসে অঙ্কখাতার পিছনে ছোড়দা হিসাব করত আর কতদিন দেরি আছে পুজোর। তখন পুজোর আগে হাপিয়ালি পরীক্ষা হত। নিজের ভাবনার মধ্যে হাপিয়ালি শব্দটাতে নিজেই হেসে ফেলে সম্পূর্ণা। হাফইয়ার্লি উচ্চারণটা তখন ওরা কেউই করত না। মেজজ্যাঠা ওদের সব ভাইবোনের পড়াশুনোর খেয়াল রাখত। মেজজ্যাঠার কড়া হুকুম ছিল, পরীক্ষা শেষ না হলে পুজো পুজো করে নেত্য করা চলবে না। নাটমন্দিরে কাঠের কাঠামোর ওপর খড় মাটি দিয়ে একটু একটু করে গড়ে উঠছে দুগ্গা প্রতিমা, জন্ম থেকে প্রতিবছর সে দৃশ্য দেখে এলেও পরীক্ষার জন্য কী তা না দেখে থাকা যায়! পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে একবার নাটমন্দির না ঘুরে কোনদিন বাড়ি আসত না সম্পূর্ণা। ঠাকুর তৈরি করতে করতে বাদলদাদুর কাছে কত গল্প শুনত সম্পূর্ণা! বাদলদাদুর বাবা ছিলেন বিখ্যাত মৃৎশিল্পী দুলাল পাল। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরষ্কার নিতে উনি দিল্লি গিয়েছিলেন। বাদলদাদুর বাবার সেই দিল্লি যাওয়ার গল্প কতবার যে শুনেছিল সম্পূর্ণা তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তবুও যেন পুরনো হত না সেই গল্প। ওসব কিছুই ছিল যেন পুজোর আনন্দেরই অঙ্গ। মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিল সম্পূর্ণা। ওদের গ্রামের ইস্কুলে অত ভালো রেজাল্ট আগে কেউ কোনদিন করেনি। শহরের নামী স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল সহজেই। সেই বছর প্রথমবার দুগ্গা ঠাকুর গড়া দেখতে পায়নি সম্পূর্ণা। পঞ্চমীর দিন যখন বাড়ি গিয়েছিল, মা দুর্গা আটনে উঠে গেছে। মুখটুকু শুধু ঢাকা সাদা কাপড় দিয়ে। ষষ্ঠীর দিন চক্ষুদান হবে। সম্পূর্ণার এখনও মনে পড়ে ঠাকুর তৈরি দেখতে পায়নি বলে বাড়ি ফিরে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিল সেবার। তখনও কি আর জানত যে আর কোনদিনই প্রতিমা গড়া দেখতে পাবে না! এরপরেও পড়াশুনোর চাপে কোনবারই চতুর্থী পঞ্চমীর আগে হোস্টেল থেকে বাড়ি ফিরতে পারেনি। ততদিনে ওদেরও নিজস্ব পাকা বাড়ি হয়েছে। বাবাদের চার ভাইয়ের আলাদা আলাদা বাড়ি। ফুচকা খেয়ে ফেলে দেওয়া শালপাতার মত মাটির পুরনো দোতলা বাড়িটা পড়ে আছে অবহেলায়। ঠাকুমা যতদিন বেঁচেছিল, ওই বাড়িটাতেই ছিল। ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর বাড়িটার আর সংস্কার হয়নি। শেষ যখন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল, বাড়িটা দেখে কষ্ট হয়েছিল সম্পূর্ণার। একসময় গোবর নিকানো ঝকঝকে উঠোনটা আগাছায় ভরে গেছে। খানিকটা পাঁচিল সহ সদর দরজাটা ভেঙে গেছে। বাড়িটারও মাটি খসে খসে পড়েছে। উঠোনের নারকেল গাছটা বাজ পড়ে ঝলসে গিয়ে পোড়া কঙ্কালের মত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোনাকাকা আমাদের গরু দেখাশুনো করত বহুবছর ধরে। সোনাকাকাকে ঠাকুমা নিজের ছেলের মতই ভালোবাসত। একটু সারিয়ে ঠিকঠাক করে নিয়ে ওই মাটির বাড়িটায় থাকতে চেয়েছিল সোনাকাকা। বাবা আর মেজজ্যাঠা রাজি হলেও বড়জ্যাঠা আর কাকা রাজি হয়নি। বাড়িটা ভেঙে ফেলে ওই জায়গাতে বড়জ্যাঠা নাকি তার ছোটছেলের জন্য আলাদা একখানা বাড়ি করবে। সে বাড়ি হয়েছে কি না জানাও হয়নি সম্পূর্ণার।
অর্জুনের সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথাটা তখনও বাড়িতে বলে উঠতে পারেনি সম্পূর্ণা। কিন্তু কিভাবে যেন খবরটা চলে গিয়েছিল বাড়িতে। বাবার জরুরী টেলিগ্রাম পেয়ে কিছু বুঝতে না পেরে ছুটে গিয়েছিল সম্পূর্ণা। দুই জ্যাঠা, বাবা, কাকা, দাদারা সম্পূর্ণাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে রীতিমত সালিস্যি সভা বসিয়ে ফেলেছিল। অর্জুন যত ভালো ছেলেই হোক, পড়াশুনোতে যত ভালোই হোক, নীচু বর্ণের একজন ছেলেকে বাড়ির জামাই হিসাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। দরকার হলে তারা তাদের বাড়ির মেয়েকে ত্যাগ দেবে। শেষ কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল সম্পূর্ণা। সবাই তাকে এতদিন এত ভালোবাসত, এই তার আসল চেহারা! কান্নাও সেদিন থমকে গিয়েছিল সম্পূর্ণার। একটা জেদ চেপে বসেছিল ওর মনেও। বিনা প্রতিবাদে এক কাপড়েই বেরিয়ে এসেছিল বাড়ি থেকে। তারপরেরটুকু তো সিনেমার মত। অর্জুনের বাড়ি থেকেও ওদের বিয়েটা মেনে নেয়নি।সেসব কথা আর মনেও করতে চায় না সম্পূর্ণা। নিজের সংসারে এখন সে ভালো আছে। তবু একটা পিছুটান তো থেকেই যায়!
আমার একলা আকাশ থমকে গেছে
রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার দিনগুলো সব রঙ চিনেছে
তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে....
আবার মোবাইলটা বাজছে। উঠে গিয়ে ফোনটা ধরে সম্পূর্ণা। ওপাড়ে অর্জুনের উত্তেজিত গলা।
-এতক্ষণ ফোনটা ধরছিলে না কেন?
মৃদু হাসে সম্পূর্ণা।
-শোনো না একটু দারুণ খবর আছে। স্টোরি পয়েন্টে যে দুর্গাপুজোটা হয়, ওখানে এবার নাকি পুজো উপলক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছে। তোমার অনুমতি না নিয়েই একদিন খাওয়ানোর দায়িত্বটুকু আমি নিয়ে নিয়েছি। ওইদিন সবাইকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পুরোপুরি আমাদের দুজনের। তুমি তো বলো, তোমাদের বাড়িতেও দুর্গাপুজোতে এমন লোক খাওয়ানোর রেওয়াজ ছিল।
ফোনের ওপাড়ে তখনও এটা সেটা কথা বলে চলেছে অর্জুন। কোন কথা বলতে পারছে না সম্পূর্ণা। অদ্ভুত এক খুশি আর ভালোলাগায় তার দুচোখে জলের ধারা। ছোটপিসির বিয়ে হয়েছিল অনেক দূরে। প্রতিবার পুজোর সময় বাড়ির পুজোতে আসতে পারবে না, ঠাকুর দর্শন করতে পারবে না বলে বিয়ের আগে কান্নাকাটি করত ছোটপিসি। সম্পূর্ণার হঠাৎ ঠাকুমার বলা একটা কথা মনে পড়ে যায়। ঠাকুমা বলত,
"মায়ের রূপ তো সব জায়গাতেই এক। তাঁকে অন্তর থেকে শুধু উপলব্ধি করতে হয়।"
মোবাইলটা নিয়ে একছুটে ব্যালকনিতে চলে আসে। দিনের শেষ আলোটুকুর আভা তখনও লেগে আছে আকাশের কোণে। এক অব্যক্ত খুশিতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে আসে সম্পূর্ণার। চোখ দুটো বন্ধ করে কান্নাটাকে সংযত করে। একটা চেনা গন্ধ যেন নাকে আসে। চোখ বন্ধ করেই নাক টানে সম্পূর্ণা। এতো যেন শিউলি ফুলের গন্ধ! উঠোনের শিউলি ফুলের গাছটার কথা মনে পড়ে যায় সম্পূর্ণার। পুজোর আগের সন্ধেগুলো শিউলির গন্ধে মাতাল হয়ে থাকত সারা বাড়ি। আজ এই বিদেশ বিভুঁইতে বসে ম্যাপল পাতাতেই যেন শিউলি ফুলের গন্ধ খুঁজে পাচ্ছে সম্পূর্ণা।
সমাপ্ত