এবং খোঁজ। শারদ সংখ্যা। বর্ষ : ২, সংখ্যা ১৪। নির্বাচিত 'ধারাবাহিক' পড়তে ক্লিক করুন। উচ্চারিত হোক অক্ষর, স্পর্ধিত হোক ভাষা।

শা র দ সং খ্যা

লাইন স্কেচ : দেবাশিস সাহা



অ-সাধারণের আত্মজীবনী

শ ত দ ল  মি ত্র



 ১৬ 

সারাদিন ঘরের বাইরেই বসে থাকে সে চুপচাপ,

একা

মলিন জীর্ণ

আমিও ঘরে ঢোকাই না তাকে

তবে বাইরে গেলে বিশ্বস্ত সঙ্গী সে আমার

সঙ্গ দেয় দোকানে বাজারে

পথ চলার আনন্দে সে আমার আগে আগেই হাঁটতে চায় যেন

কোনো রকমে বশে আনি তাকে

তবে তাতে কিছু মনে করে না সে

বরং খানাখন্দ থেকে আমার ছেঁড়াফাটা পা জোড়াকে

আগলে রাখে পরম বিশ্বস্ততায়।


 

তার একটাই স্বপ্ন-- আমার সঙ্গে একদিন দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে

ভাবছি, আমার পুরোনো চটিজোড়াকে একদিন মলে নিয়ে যাব

সঙ্গে করে

সেদিন সাবান ঘষে একটু ধোপদুরস্ত করতে হবে এই যা।

মলে গিয়ে প্রিয় চটিটার সঙ্গে সেলফি তুলতেই পারি

এটুকু করতেই হবে,

নইলে ফিচলে চটি যে কোনো মুহূর্তে পিছলে গিয়ে

আমাকে রাস্তায় পেড়ে ফেলে যদি!



 ১৭ 

একলা তলিয়ে যাচ্ছি আমি

নেমে যাচ্ছি অতল আঁধারে

তলিয়ে যেতে যেতে

ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি রুক্ষ পাথরে

              মাথা ফেটে চৌচির

              লোপ পাচ্ছে স্মৃতি

তবুও কষ্ট হচ্ছে না কোনো

কেননা এ গর্তে

সাড়ে সাতচল্লিশ ডিগ্রী কোণে

হাত খেলানোর মতো জায়গা যথেষ্টই!

ফলে বিভিন্ন ভঙ্গিমায়

              সেলফি তুলছি দেদার, আর

পোস্ট করছি তা  তৎক্ষণাৎ সোস্যাল মিডিয়ায়,

সঙ্গে সঙ্গে লাইকও হাজার-হাজার, স্বচ্ছন্দ স্বীকৃতি!

শুধু আফসোস একটাই—

প্রস্তুত না থাকার কারণে

পতন শুরুর মুহূর্তটিকেই 

ছায়াবন্দি করতে পারিনি আমি আদৌ!


 

এ অসফলতাটুকু অতিক্রম করে যাব

               আগামী মরণে নিশ্চয়ই—

পতনবিলাসী সমূহের কাছে এ আমার নিঃস্বার্থ অঙ্গীকার!      



 

 ১৮ 

আমার বাবা আমাকে আদর করে

বাবরি নামে ডাকত, আমিও

আমার মেয়েকে বাবরি নামেই ডাকি,

জানি না আমার ঠাকুরদা বাবাকে

বাবরি বলে ডাকত কিনা—

বোধহয় না, কেননা সাত সন্তানের মধ্যে

বড়জন স্বপ্নের হলেও বাকিরা  নিত্যনৈমিকতায়

এলেবেলেই থেকে যায় পরিবারের ডালপালায়।


 

যা হোক পুরনো কথা বাদ দেওয়াই ভাল—

বর্তমানে ফিরে বলি যে আমার মেয়ে

বাপ নেওটা খুব। সেই জোরে সবসময়

শাসনে রাখে আমাকে। আমিও

ভালবেসে উপভোগও করি তা।


 

আজ সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছে খুব,

অমনি দূর থেকে বেজে ওঠে বাবরি—

বাবা, জানলা খুলে কাব্য করো না বেশি

বৃষ্টির ছাটে ঠান্ডা লেগে যাবে যে...

কথা শোনো লক্ষ্মীটি!

খেয়ে নিও সময়ে ঠিকঠাক।  


 

মনে মনে হাসি আমি, আর

নাছোড় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে

স্বপ্নে ছবি বুনি, মুছে ফেলি বারবার...


 

আত্মজা-সম্ভব এ কাব্যে

রাতের সকল তারাই

                পিতৃজন্ম পায়!




 ১৯ 

বাবা আমাকে মানুষ হতে বলেছিল

আমিও আমার সন্তানকে মানুষ হবার আশীর্বাদ দিই।

কিন্তু, একটা কিন্তু থেকেই যায়।

মানুষ হওয়া কাকে বলে?

উত্তরটা আজও অজানা।

আমার জ্ঞানের আগেই বাবা হারিয়ে যায়—

তাই জানা হয় নি বাবা মানুষ ছিল কিনা!

পুরনো লোকে বলে বাবা না কি ভালোমানুষ ছিল।

তাহলে সারসত্য এটাই যে শুধু মানুষ হলেই হবে না

ভালোমানুষ হতে হবে।

আমি ভালোমানুষ হবার বাসনায়

টিনের পুরনো তোরঙ্গ খুলে জংধরা

                বাবার শার্টটা বার করলাম

আর গায়ে চড়ালাম।

একটু ঢলঢলে হল বটে, তবুও

কেমন যেন বাবা-বাবা গন্ধ পেলাম—

পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি

সেখানে কিছু খুচরো পয়সা আজও মজুত।

সেই পয়সা নিয়ে দোকান গেলাম চাল কিনতে।

দোকানদার বলল—পুরনো এক-দু পয়সা বর্তমানে অচল।

চাল না কিনেই ঘরে ফিরে এলাম অগত্যা।

চালচুলোহীন আমি অভুক্ত সন্তানকে

                      কী করে মানুষ হবার কথা বলি!

আমার তাই মানুষ হওয়া তো দূর

বাবা হওয়াই হল না আজও!



 ২০ 

সকালটা অন্য রকম লাগছে যেন আজ

মনে মনে আদর করি নিজেকে নিজেই—

বেঁচে আছি...

সকল বিস্ময় হারিয়ে ফেলার পরও

বেঁচে আছি তবে,

       মানুষের মতো!


 

কত—

কত দিন পর

স্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে!