ব্যক্তিগত  গদ্য 

অলংকরণ : তনুশ্রী সাহা


দয়া করে পড়বেন না

মো হ ম্ম দ  শা হ বু দ্দি ন  ফি রো জ


য়া করে পড়বেন না। বিনীত ভাবে আমার অনুরোধ, অযথা সময় নষ্ট করে পড়বেন না। কত পড়া যায় বলুন তো? সেই নার্সারির আগে থেকে পড়া শুরু করেছেন— স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি পার করেছেন এমনি এমনি তো নয়, পড়তে পড়তেই। যে চাকরিই করেন না কেন, সেখানেও পড়তে হচ্ছে। চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও লাভক্ষতির অঙ্ক করছেন, সেও পড়ারই একটা বিষয়। এরপরও পড়বেন কেন? আর এই লেখাটিই বা পড়ছেন কেন? যেটুকু না জানলে নয়, সেটুকু তো সবাই জেনেই গেছি। পড়া মানেই অযথা সময় নষ্ট। ওই সময় আপনার চারটি কবিতা অথবা একটি দীর্ঘকবিতা লেখা হয়ে যাবে। এটা যদি বাড়াবাড়ি মনে হয়, তাহলে নিদেনপক্ষে দু'টি অণুকবিতা বা একটি কবিতা তো অবশ্যই লেখা হবে। তাই না? 


—আরে মশাই সিলেবাসের পড়াটাকে কি আপনি যা তাই মনে করেন? চর্যাপদ থেকে শঙ্খ ঘোষ সব পড়েছি। কী পড়িনি সেটা বলুন?


—আহা দাদা রাগছেন কেন? আমিও তো আপনার সাথে একদমই একমত।


আমরা অনেক পড়ে ফেলেছি, এবার নিজের লেখাতে মন দিই। অন্যের লেখা তো পড়েই জীবনের অর্ধেক সময় কাটালাম। এখন সময় এসেছে নিজের কবিতা অন্যকে পড়ানোর। আমারও কবিতা লেখার এলেম আছে। আমারও কলমে কালি আছে। থুড়ি, মোবাইলে আর ল্যাপটপে বাংলা কিবোর্ড আছে। আনলিমিটেড ডাটা আছে। আমারও পাড়ায় ঋতু পরিবর্তন হয়, আমিও বছরে দু'একবার ঘুরতে যাই বাইরে। আমিও কবিতা উৎসবে গিয়ে মাচায় দাঁড়িয়ে মাইক হাতে কবিতা পড়ি। হাতে মনুমেন্ট স্যরি মেমেন্টো নিয়ে ফেবুতে ছবি পোস্ট করি। আমার পড়ার সময় কোথায় বলুন তো? আপনার মতো আমিও ব্যস্ত মানুষ। নিজের লেখালিখির পর আর সময় কই? ফেসবুকে তো কিছু সময় দিতেই হয়, নিজের লেখা পোস্ট করা, কমেন্টের রিপ্লাই দেয়া, রিপ্লাই না দিলে উনি যদি পরের পোস্টে লাইক-কমেন্ট না করেন, সেটা তো ভালো দেখায় না। এটাকেই সৌজন্য বলে মশাই। আর কোথায় কবে কী অনুষ্ঠান আছে সেটা জানা, পত্রিকার মেল আইডি জোগাড় করে লেখা পাঠানো, এসব খবর তো ফেসবুকেই পাওয়া যায়, তাই না? গ্রুপের ইভেন্টে কবিতা দেয়া। ফাস্ট, সেকেন্ড হলে সার্ফিটিকিট মানে ওই শংসাপত্র দেয়ালে সাঁটানো কম ঝক্কির কাজ? এরপরেও ছাইপাঁশ পড়ার সময় থাকে? এই যে দেখুন না, আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা তালিবানরা নিয়ে নিল, সেই নিয়ে একটা কবিতা আজই লিখতে হবে, আর আপনি আমাকে পড়তে বলছেন? 


— তালিবানরা কে?


— দূর মশাই ওসব জেনে আমি কী করব? আপনিই বা কী করবেন? আমরা কি ইতিহাস লিখব নাকি? খবরে দেখেছি সবাই কাঁদছে, একটা কান্নাকাটির কবিতা লিখব। অথবা, ‘প্রতিরোধ হোক, প্রতিবাদ হোক আমি আছি তোমার সাথে আফগানিস্তান' এরকমই কিছু লিখে দেব। তালিবান কে, খায় না মাথায় মাখে ওসব জানা আমার কম্ম নয়। আমি কবিতার লোক, আমি ছন্দ জানি এটাই যথেষ্ট নয় কি।


— আপনি তাহলে ছন্দটা ভালোই জানেন...


— হ্যাঁ, জানব না কেন? এই ছন্দ-র সাথে মন্দ মেলে, শাকচুন্নি-র সাথে ডার্লিংমুন্নি, ভুখাপেট-এর সাথে গবেট এটাই তো ছন্দ। বুঝলেন কিনা, একবার দু'টো লাইনের জন্য একটা কবিতা শেষ করতেই পারছিলাম না। সারারাত জেগেছি কবিতাটা শেষ করব বলে। আগের লাইনে লিখেছি 'জিন্দাবাদ' পরের লাইনে আর মেলাতে পারছি না। ভোর হতেই টুপ করে মনে হল এর সাথে ‘পান্তাভাত' মিলছে। সেই কবিতা শেষ দু'লাইন হল, “শ্রমিক তোমার খেটে খাওয়া নোনা ঘাম জিন্দাবাদ....... / কৃষক সুখে রোজ খাচ্ছে সরু চালের পান্তাভাত" কেমন মিলিয়েছি বলুন?


— হেব্বি, হেব্বি। কিন্তু...


— কিন্তুর আবার কী হল?


— বলছিলাম কী অতগুলো ডট, আর কোথাও কোনো যতি চিহ্ন নেই কেন?


— ডট হল গিয়ে পৌনঃপুনিক, বুঝলেন? যত ডট দেবেন ততই বক্তব্য জোরালো হয়। আর যতিচিহ্নের কথা? আরে ও তো সম্পাদকের কাজ, বুঝেশুনে যতিচিহ্ন লাগিয়ে নেবে। সম্পাদক হয়েছে এটুকু কাজ তো ওদের করতেই হবে। 


হ্যাঁ যা বলছিলাম, জীবনের এতগুলো দিন তো পড়লাম, এরপর তো দায়িত্ব বর্তায় আমার কবিতা অন্যকে পড়ানো। তাই না? এই মোটা-মোটা ঢাউস ঢাউস পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয় তা কি আপনি জানেন? জানবেন বা কী করে আপনিও মনে হয় লেখেন, পড়ার সময়ই পান না। কি, ঠিক বলেছি না? 


—একদম...


— সত্যিই তো লেখালেখি করলে আর পড়ার সময় কই! লিখি বলে সৌজন্য সংখ্যা দেয় অনেকে। নিজের লেখাটা দেখি, কোথাও ভুল হলেই সম্পাদকের পিণ্ডি চটকাই। নিজের লেখাই যদি প্রত্যেকে পড়ে, তবে তো পুরো পত্রিকাই পড়া হয়ে যায় তাই কিনা বলুন? অতএব সবাই লিখুন, প্রত্যেকে শুধু নিজের লেখাই পড়ুন। অযথা অন্যের লেখা পড়ে সময় নষ্ট করবেন না। যেমন আমার এই লেখাটা পড়ে জীবনের পাঁচ মিনিট, সাড়ে ছাপান্ন সেকেন্ড সময় নষ্ট করলেন।