সিরিজ কবিতা
![]() |
অলংকরণ : প্রত্যুষ বাগ |
শ ত দ ল মি ত্র
অ-সাধারণের আত্মজীবনী
১১
পশ্চিম আকাশে তখন খুনখারাবি লাল
একটু পরেই রবি অস্ত যাবে
অথচ আমি চলেছি প্রাণের আরাম
মনের শান্তির খোঁজে
আমাকে ঠাকুরের থানে নিয়ে যাবে বলেছে
আমারই গাঁয়ের দিলু রিকশাওয়ালা –
তিন চাকায় গড়িয়ে গেলে পথ
পেরিয়ে যায় স্টেশনের, বাজারের আলোর ঝরণাতলা
সামনে তখন আশ্রমের নির্জনে
আলোছায়ার মধুর খেলায়
পূর্ণচাঁদের মায়া –
সে মায়ায় ফুটে ওঠে থরে থরে
শিকড়ছেঁড়া দুটো মানুষের
হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা, ফেলে আসা গ্রাম
আর...
আর বুকের লবণে বাঁচিয়ে রাখা সে হাহাকার
-মাটি ছাড়া বাঁচে কোন শালা !
মায়াবী সে চাঁদ তখন শালবীথির
কপালে চুমু খেলে দখিনা বাতাস বয়
দিলু সে দৈবে সংকেত হেনে বলে—
যেদিন গোলচাঁদ তালধ্বজের
হুই বৃক্ষটির মগডালে টিপ হয়ে জ্বলে
সিদিন দেবতা ঠাকুর জাগেন
এ ভুবনে, এ ডাঙায় !
দিলু বাগদির তিন চাকায়
পিষে যায় চাঁদের মায়া
এ প্রবল পূর্ণিমায়
গুহাবাসী কোনও, দ্বার খোলে না !
১২
পশ্চিমে বাঁশ, পূবে হাঁস—
এই নিয়ম মেনেই বাড়ি বানিয়েছি আমি
যদিও বাড়ি নয় ঠিক- কুঁড়ে ঘর, মাটির...
আর খনার বচন একটু অদল বদল করে
পশ্চিমে বাঁশের বদলে কৃষ্ণচূড়া গাছ বুনেছি
গ্রীষ্মের ঝলাসে রক্তিম সে গাছ সূর্যাস্তের রঙ মেখে
লালে লাল আরও।
তবে সাজার পুকুরটি ঠিক সাজানো পরিপাটি পূবে
তাতে হাঁসও চরে প্রতিবেশীর, এমনকি
সাঁঝের আঁধারে চাঁদ উঁকি দিলে
ঘাই মারে অবলীল অমোঘ কালবোশ।
পুকুরপাড়ে আমার একলা উঠোন
ঈশান কোণে তার, সাধের স্থলপদ্ম
নবীন সূর্যের রাঙা আলোয়
ঝলমল বেজে বেড়ায় সারাটা সকালভোর।
দখিনদিকটি আদিগন্ত খোলা—
সবুজক্ষেত ছাড়িয়ে আকাশের কোলে
আদর খায় নদীটি, পলিময় অষ্টপ্রহর...
দখিনা সে বাতাসে ভিজতে ভিজতে
সজলতর আমি বীজ বুনি উত্তরবাগে
আম-জাম-কাঁঠালের
উত্তুরে হাওয়াকে উড়িয়ে, মুকুল
ফোটাবে বলে, হয়তো সন্ততির কালে।
আপাতত সাধের ঘর জুড়ে বসত করি
আমি আর আমার ছায়া...
খোয়াবনামায় এ বাস্তুর পাট্টা-দলিল সবই
মজুত হালেহাল আজও!
১৩
তেল-নুন আর আলু-কুমড়োর
দৈনন্দিনতায় নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে
বেঁচে থাকার উদাসীন কায়দা-কানুন শিখে নিয়েছি বেশ...
নিজস্ব ঘেরাটোপে বন্দি থাকার কলাকৌশলগুলোও
অনায়াস যখন, তখনই
সকল প্যাঁচ-পয়জার বানচাল করে দৈববাণী আছড়ে পড়ে হঠাত্
-এতো শাক আজও, আবার!
মানুষ তো নও, গরুই রয়ে গেলে চিরটাকাল!
এ দৈবে সারাটা দিনমান ছায়া গোটাই,
ছায়া গোটাতে গোটাতে দিনশেষে ছায়ার রেশটুকুও
মুছে ফেলে নিজস্ব আঁধারে
বন্দি করে ফেলি যখন নিজেকে আবারও
অভ্যস্ত কৌশলে,
তখনই সহসা গারদ ভেঙে বেজে ওঠে সে দৈব পুনরায়
-বলি, ছাই-পাঁশ ধোয়া না গিললেই নয়?
নাছোড় কাশিটা তোমার সারছে না তো কিছুতেই আর!
অমনি সে ঝাপটায় খুলে যায় জানালা সপাট
কার্ণিশে ঝুলে থাক টুকরো আকাশটা
গড়িয়ে নেমে আসে আমার সে নিজস্ব ঘরে
নক্ষত্রের নরম আলো ঝিকমিক জ্বলে কপালে তার।
হয়তো মৃত সে নক্ষত্র, তবুও
এ আলোকসম্ভবে জেগে উঠি আমি-
জীবনে, ভিক্ষায়।
১৪
গ্রাম শেষ হলে
যেখানে জনহীনতা ছায়
সেখানে একলা সে বকুল
ঠায় দাঁড়িয়ে আজও।
বৃদ্ধ সে বকুল আমার বন্ধু
আবার আমার বাবারও
সারাটাবেলার বান্ধব সে!
বাবাই তার সাথে পরিচয় করিয়ে
দিয়েছিল আমার সে সকালবেলায় !
সাঁঝবেলায় বৃদ্ধ আমি আজও
গ্রামে গেলেই তার কাছে যাই, একাই।
প্রবৃদ্ধ নিঃসঙ্গ সে বৃক্ষ আমাকে দেখলে
খুশিতে মাথা দোলায়। ফুল ঝরে পড়ে।
আমি দুহাতে আশীর্বাদ কুড়িয়ে নিই।
আঁজলা ভরে আদর ধরি।
দেহজুড়ে তখন মিষ্টিবাস—আমার
হারানো বালকবেলার। হয়তো আমার সেই
ছোটোবেলায় হারিয়ে যাওয়া বাবাটার!
আমি সে বকুল-সইকে আমার ভুলে যাওয়া
ডাক নাম ধরে আদর দিই। পরক্ষণেই
বাবা বলে ডেকে ফেলি!
শয়ন একাদশীর এ বারবেলায়
পুন্নাম নরকে বৃষ্টি ঝরেছিল বোধহয়!
১৫
কী ঘরে, কী বাইরে
সবসময় উলঙ্গ হেঁটেছে আর বলেছে
-এই দেখো, এই আমি।
তার নির্লজ্জ এই উলঙ্গতায়
মুগ্ধ মানুষ দেবত্ব আরোপ করল।
কিন্তু শেষমেষ তার মধ্যে
কোনো অলৌকিকত্ব খুঁজে না পেয়ে
ভন্ড ও প্রতারক বলে তাকে
দোষারোপ করল!
অথচ ভানহীন লোকটা
মিথ্যাবাদী ছিল না কখনো!
প্রবল পাগল ছিল হয়তো-
কবিও!