নিবন্ধ
জীবন ও মৃত্যুর দ্বন্দ্ব : 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো'
গৌ ত ম জা না
"মৃত্যু চেতনা তার কবিতার বিশেষত্ব হতে পারে, মৃত্যু বাসনা তার কখনও ছিল না... আসলে সে মৃত্যুকে কবিতায় চ্যালেঞ্জ করেছে। মৃত্যুর সঙ্গে দ্বন্দ্ব আবার তার রহস্যময়তার প্রতি অপার কৌতুহল। কোনও কোনও সময় আবার সে মৃত্যুকে অতিক্রম করেছে। জীবনকে ভালোবেসে তার কবিতা।" (১)
শ্রদ্ধেয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই মন্তব্য করেছেন বিশ শতকের পাঁচের দশকের কবি বন্ধুবর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা সম্পর্কে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক পরিবর্তিত মানসিকতার অধিকারী। প্রেম বিষয়ক কবিতা দিয়ে কাব্য রচনার সূত্রপাত ঘটলেও প্রকৃতি, জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কিত চেতনা তাঁর রচনায় অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। জীবন এবং মৃত্যুর দ্বন্দ্ব তাঁর কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক।আর এই ভাবনার অনন্য প্রকাশ ঘটেছে তাঁর "যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো"(মার্চ ১৯৮২) কাব্য গ্রন্থের নাম কবিতায়।
'যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো' কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'দেশ' পত্রিকায় (১.৯.১৯৭৯)। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত 'আমি চলে যেতে পারি' কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা রূপেও এটি মূদ্রিত হয়। নিবন্ধের সূচনায় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতির কথাগুলি আলোচ্য কবিতাটি সম্পর্কে কীভাবে সাজুয্য রক্ষা করেছে তা এই নিবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয়।
'জীবনের মধ্য দিয়ে মৃত্যু মোহানার দিকে যায়'। জীবন ও মৃত্যু দুই-ই চরমতম সত্য। জীবনের সূচনা থেকেই আমরা মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হই এক পা এক পা করে। জীবনে মৃত্যুর অনিবার্য উপস্থিতি থাকলেও হৃদয়ের আকাঙ্খা মানুষকে টানতে থাকে জীবনস্রোতে নতুন করে ঢেউ তুলবার জন্য। মৃত্যু আছে বলেই জীবন এত সুখময়, দুঃখ আছে বলেই সুখ এত অমৃতময়। জীবনের এই পরম সত্য কবি উপলব্ধি করেছেন বলেই মৃত্যুকে সাদরে বরণ করে নিতে তিনি প্রস্তুত।
মৃত্যু জীবনের পরিসমাপ্তি নয়,তার আর এক জীবনের পূর্বাভাসও বটে। কবির কাছে তাই জীবন অনিঃশেষ। বিশ শতকের জটিল আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে কবির পথচলা,তাই কবির উপলব্ধি এত নিবিড়। গভীর নিঃসঙ্গতা এবং অসহায়তা থেকে তাঁর জেগেছে মৃত্যুপ্রীতি। অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি কবির চেতনায় ব্যর্থতার জ্বালা হয়েছে তীব্রতর। হৃদয়ে বাসা বেঁধেছে ঘুনপোকা। এইরকম পরিস্থিতিতে কবি হয়েছেন ক্লান্ত। ভেবেছেন মৃত্যুতেই ঘটতে পারে এই যন্ত্রনার অবসান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর প্রান্তে দাঁড়িয়ে কবি ঘোষণা করলেন জীবনের উষ্ণতা-
' ভাবছি ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো'
কবিতাটি শুরুও তাই নাটকীয় ভাবে সিদ্ধান্ত বাক্য দিয়ে। 'ভাবছি' এই ঘটমান বর্তমান কালের ক্রিয়াপদটির ব্যবহারের পটভূমিকায় কবি যা ভেবেছেন তা হল জীবনের কাছে প্রত্যাবর্তন। জীবনের ক্লান্তি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আশা-নিরাশা, বেদনা-ভালোবাসা, স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের ব্যর্থতায় জীবন ভরে উঠলেও আশাবাদী কবি ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চান।যাকে এতদিন উপেক্ষা করেছেন-
' কখনো তোমার করে তোমাকে ভাবিনি'
তাঁকে আলোর বৃত্তে এনে ভালোবাসার আলোকিত আখরে ডাকতে চান।এ যেন কবির ব্যক্তি জীবনের প্রত্যয়। তিনি তাঁর স্ত্রী কে সময় দেননি,সেই আক্ষেপ তিনি প্রকাশ করেছেন-
' এত কালো মেখেছি দু হাতে
এত কাল ধরে।'
এরপর পরের স্তবকে আমরা দেখতে পাই কবি চারটি পংক্তিতে সুন্দর চিত্রকল্প এঁকেছেন-
'এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে; আয় আয় আয়
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে আয় আয় আয়'
'খাদ' কথাটি অতলান্তিকতার পরিচয়বাহী। 'চাঁদ' এর আহ্বান অলৌকিকতার ব্যঞ্জনাবাহী; 'গঙ্গার তীর' জীবনের প্রবাহমানতার কিনারা আর চিতাকাঠ মৃত্যুর পরিচয়বাহী।
কবি জীবন ও মৃত্যুর মাঝে মানসিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত। জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে কবির চৈতন্য ভূমিতে এক আলোছায়ার লুকোচুরি চলে। জীবনমুখী চাঁদ যেন জীবন সৌন্দর্যের মায়াময় রূপ নিয়ে তার নিজের মতো কাটানো জীবনের পরিধি ভেঙে চলে আসার জন্য ডাকে আবার তিনি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে একাকী গঙ্গার তীরে দাঁড়ালে শুনতে পান মৃত্যুরূপী চিতাকাঠের ডাক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্ব থেকে কবি উত্তরণ ঘটিয়েছেন নিজেকে। জীবনের কাছে ফেরাটাই প্রবল আকাঙ্খার রূপ নিয়ে মোড় ফিরেছে কবিমন।তাই কালক্ষেপ না করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন অমূল্য জীবন ছেড়ে, প্রকৃতির মোহময় রূপগন্ধ আলো ছেড়ে তিনি শীতলতম মৃত্যুর অন্ধকারে যাবেন না।চিতাকাঠের ডাকে সাড়া না দিয়ে জীবন প্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দৃঢ়ভাবে মৃত্যু কে প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে-
' যেতে পারি
যে কোন দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু কেন যাবো?'
ইচ্ছা করলেই কবি যে কোন দিকেই চলে যেতে পারেন। কিন্তু আত্ম উন্মোচনের প্রশ্নতার দ্বন্দ্ব কাটিয়ে তিনি পার্থিব মমতায় নিষিক্ত হতে চান।তাই তাঁর বলিষ্ঠ প্রত্যয়-
'সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমু খাবো।'
জীবনের সব ক্ষত চিহ্ন ধুয়ে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মূলধন সন্তানের চুমু খেয়ে জীবন সমুদ্রে নৌকা বাঁধতে চান। সন্তানের মধ্যেই থাকে আত্মবীজ। সন্তানের মধ্যেই কবি তাই খুঁজে পেতে চান জীবনের বাঁচার প্রকৃত সত্যকে। শেষ পর্যন্ত কবির সুদৃঢ় ঘোষণা-
'একাকী যাবো না অসময়ে।'
মোট চারটি স্তবকে ষোলটি চরনে বিধৃত আলোচ্য কবিতাটি কবির আত্মবিস্মৃতি এবং তারপর তা থেকে ক্রমোন্মোচনের কাহিনি। কবিতাটি কবির মরনের কবিতা নয়; 'জীবনের প্রেমের আলোর কবিতা হয়ে উঠেছে। এখানেই সূচনা অংশে উল্লেখিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্ধৃতির কথাগুলি প্রমান করে। শৈলী গত দিক থেকেও দেখা যায় ক্রিয়াপদ দিয়ে শুরু হয়েছে কবিতাটি যা কাব্য রীতিগত দিক থেকেও অভিনব। এছাড়াও চিত্রকল্পের প্রয়োগ, মৃত্যু ও জীবনের দ্বান্দ্বিকতা, কবির মনোজগতের জটিলতা প্রায় সরল বাক্যে যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাতে কবিতাটি শুধুমাত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্য সম্ভারের মধ্যেই নয় সমগ্র বাংলা কবিতার আকাশে একটি স্মরণীয় মাইলস্টোন হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র :
১. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়/বিনোদন বিচিত্রা/১৮ই এপ্রিল, ৯৫ সংখ্যা, পৃষ্ঠা ৫১-৫২।
ঋণস্বীকার :
১. আধুনিক কালের কবিতা পরিচয়ঃ সম্পাদনায়- দেবকুমার ঘোষ।
২. আধুনিক বাংলা কবিতা নিবিড় পাঠঃ শীতল চৌধুরী
৩. যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো কাব্যপাঠ ও আলোচনাঃ সম্পাদনা- অধ্যাপক লক্ষণ কর্মকার।