সিরিজ কবিতা
![]() |
অলংকরণ : চন্দন কুন্ডু |
শ ত দ ল মি ত্র
অ-সাধারণের আত্মজীবনী
৬
আমাকে নিয়ে যদি একটা পদ্য লেখ তুমি—
জানি আমাকে চেনো না তুমি তেমন কখনো
পাড়ার পাঁচ জনের ভিড়ে আলাদা করা যায় না সে রকম
তবুও দেখ, সকাল হতেই চা খেয়ে
থলে হাতে বেরিয়েছি বাজারে—
আড়াইশো পটল, তিনশো ঢেরশ
পাঁচশো কুমড়ো, একটু নটে শাক, পেয়াজ, আলু আর
তেলাপোয়া চারটে—সাড়ে তিনশো মতন...
মেয়েটা আবার মাছ খায় না, ওর জন্য
তাই পোয়াটাক মুরগির মাংসও নিয়েছি, স্কুলের
টিফিনের জন্য একটা কেক, একটা চিপসের প্যাকেটও
নেব পাড়ার দোকান থেকে...
বেসরকারি অফিসে সামান্য কাজ করি, বেতন
কতটুকুই বা, তবুও চেষ্টা করি, যতটা পারি।
মেয়েটা আমার পড়াশুনোয় বেশ ভালোই, জানো!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই গলিটার পরের গলিটার শেষের
আগের বাড়িটায় ভাড়া থাকি আমরা--
আজ তবে আসি! বেলা হল, অফিস যেতে হবে আবার...
আর হ্যাঁ, একটা কথা... আপনি বলেই
সাহস করে বলা—
আমাদের বাড়ির উঠোনে না একটা
শিউলি ফুলের গাছ আছে এখনও, এ পাড়ায়
ওই একটাই গাছ । সারারাত, সারারাত
ফুল ঝরায় গাছটা উঠোনতলায় আর
পুজো আঁকে রাত্রিময়...
৭
শরত্দা, মানে শরত্ ডোম
বীরের বংশ, বীরবংশী সে—
গতজন্মে জমিদারের লেঠেল
কিংবা রণপায়ে হাঁটা ডাকাত
ছিল কিনা জানি না।
এ জন্মে হেলে কৃষক শরত্দা
আমাদের জমি চাষ করতো—
চাষ তো নয় যেন জমিতে
সবুজ আলপনা আঁকতো
নিখুঁত নিপুণতায়,
তখন সে সবুজ মানুষ যেন
তাকে ঘিরে গাছেদের জটলা ...
সে যেখানে যায় গাছগুলোও সঙ্গে সঙ্গে যায়
সবুজ সে ছায়ায় নদী বয়, পাখি আসে
আমি শরত্বৃক্ষের ডালে বসে জল চিনি
পাখিদের সঙ্গে মিতালি করি।
পরে দিনশেষে সূর্য ঢললে, আঁধার নামলে
কথারা গড়ায় যখন আপন খেয়ালে
শরত্দার নিজস্ব জঙ্গলখানি তখন ঝাকুর-ঝুকুর পারা
আর আঁধার সে জঙ্গলে
বাঘ নামে।
বাঘটা নাকি তার পোষা ।
বীরবংশী শরত্ ডোম সে ব্যাঘ্রবাহনে
জঙ্গল টহল দেয় সারা রাত, সারাটা রাত
-একদম একা!
৮
বাড়ি থেকে বেরলেই পথটা টেনে নেই আমাকে
কখনো বাঁয়ে, কখনো বা ডানে
নিয়ে যাই বাজারে, ছেলের ইস্কুলে, বড় রাস্তায়, অফিসে
এবড়ো- খেবড়ো, পিচ ওঠা রাস্তাটা আমার এতই চেনা যে
আমি আনমনে হাঁটলেও ঠিকঠাক জায়গায় পৌছে দেয় সে আমাকে
মাঝে মাঝে সে চেনা রাস্তাও অচেনা হয়ে ওঠে, যখন
নতুন এক লোক, কিংবা ফেরিঅলা কথা বলে তার সঙ্গে
সে আমাকে চিনতেও পারেনা তখন যেন--
তবুও মাটির তো, যতই ওপরে পিচের প্রসাধন থাকুক না কেন
পরক্ষণেই হাসি ছুঁড়ে দেয় চেনা ভঙ্গিতে।
আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি চেনা পথটিকে ফিরে পেয়ে--
এখনও মানুষ তো আমি!
আর মানুষ বলেই অল্প বিদ্যায় এটুকু জানি যে
মৃত্তিকার পুরোনো খেয়ালে আড়মোড়া ভাঙে যদি সে কোনদিন
পাতালপ্রবেশ হতে সময় লাগবে না আমাদের মোটেই।
৯
আমি কোনোদিন বৃষ্টি হতে পারিনি
অথচ প্রতি আশাড়ে সজল গল্পেরা আসে
আর মাটি ফুঁড়ে সবুজ মায়া লতিয়ে ধরে আমাকে
আমার ডানা দুটো নগ্ন ও পবিত্র
আকাশ ফুঁড়ে মেঘের নরম ছোঁয়ার চেষ্টায় রত হলে
আত্মাসহ আমি বৃষ্টিমানুষ হয়ে যাই—
নগ্ন ও পবিত্র সে ডানায় দু-একটা পাতা গজালে
লৌকিক পাখিরা ঘর বাঁধে,
ঘর বাঁধে আমার হাতের মুদ্রায় ।
এমন মায়ায় এক হাঁটু কাদায় জন্ম নিই আমি, জাতিস্মর—
মৃত্তিকাপুত্র আমিই , অতুল বাউড়ি
হেলে কেওট, প্রবল কর্ষক!
এ শষ্পধ্যানে যে সবুজ জেগে ওঠে
তা আমারই ভুলে যাওয়া ডাকনাম...
ফলত প্রতি আশাঢে গল্পই সজল হয়
এবং সমূহ প্রতারক!
১০
তিন প্রহরের রাতে
জানলার পাশের নিমগাছটা
আর একটু ছায়া আঁকে যখন
আর ড্রেনের জলে চাঁদের মায়া ভেসে ওঠে
তখনই নিঃশব্দে আসে সে আমার জানলায়।
লক্ষ্মী আসবে ঘরে এই আশায়
জ্যোত্স্না গুলে ধানের ছড়া বুনি জানলার পাউটিতে--
লক্ষ্মীর বাহন আটন গাড়ে সে আল্পনায়।
তার নিটোল গাম্ভীর্যে রাত আরো একটু গড়ালে
পাখিটির লোকোত্তর চোখে
কায়রোর আঁধির আভাস দেখি আমি...
সম্মোহিত মন্ত্র ফোটে,
-‘ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার!’
আহা! মরি, মরি—
রাত্রির নখরে অলৌকিক বিদ্ধ হই আমি!