গল্প 

অলংকরণ : চন্দন কুন্ডু 


অ লো ক  প টু য়া 

বাজিকরের মেয়ে 


ইয়ের পাতায় সেদিন মন ছিল না একদমই। শুধু একলা কোথাও দূরে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা বাসা বাঁধছিল। ডমরুর ক্ষীণ আওয়াজ শুনে বিপ্লব বইয়ের পাতা বন্ধ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মালিনী দিঘির পাড়ে গিয়ে যা দেখল তাতে তার প্রাণ দু'হাত হয়ে গেল। 


দিঘির উত্তর পাড়ে চার-পাঁচ ঘর মতো যাযাবর বাজিকরের পরিবার এসে তাঁবু খাটিয়েছে বাজিকরেরা এভাবেই ডমরুর আওয়াজে পাড়ায় পাড়ায় জানান দেয়। এ হলো মানুষকে আকর্ষণ করার এক মাধ্যম। 


পরের দিন দেখে সেখানে প্রচুর মানুষের সমাগম। ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখে একটি মেয়ে প্রায় নয় ফুট উঁচুতে রশির উপরে নানান কসরত প্রদর্শন করছে। একবার রশি বরাবর দ্রুত এপার থেকে ওপার যায় , আবার আসে। আবার রশির উপর থালা রেখে তার উপর এক পা দিয়ে যে কেমন করে সেটার উপর কসরত করছে !  আরো কত কি ! এসব বিপ্লবের কাছে বড্ড আশ্চর্যের বিষয় ! প্রায় আধঘন্টা ধরে এভাবে মনোরঞ্জন করার পর অবশেষে মেয়েটির পা মাটি ছুঁল। এতক্ষণ ধরে বিপ্লব অবাকচক্ষে দেখছিল ও নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে কিসব ভাবছিল! 


একটা গামছা পেতে মেয়েটি সুর করে বলতে লাগল- ‘ বাবুরা যে যা পারিস এট্টু সাহায্যি কর। ’ ভিড় কমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তা সে ঠাহর করতে পারেনি। হঠাৎই মেয়েটি এসে হাত ধরে বলল – ‘ কী রে বাবু তুই কিছু দিবি না ? ' 


এমনভাবে বিপ্লবকে আগে কেউ হাত ধরেনি। বিপ্লব দ্বিধান্বিত হয়ে তড়িতাবেগে হাত সরিয়ে নিল। বিপ্লব বড্ড লাজুকে স্বভাবের। দু'হাত তুলে শুধু বলল – ‘ আমার কিচ্ছু নেই গো। ’


মেয়েটি বলল- ‘ কিচ্ছু নাই ? লক্ষ্মীদেবী গোঁসা করবে খন।  ' 


বিপ্লব কোনো কথা না বলে মেয়েটির দিকে অবাকচক্ষে তাকিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল। কিছু দূর এগিয়ে কৌতূহলবশত  পিছন ফিরে দেখল মেয়েটি তখনো তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভারি অবাক লাগল বিপ্লবের। বিপ্লব কিন্তু এমন সাধারণ অথচ প্রাঞ্জল মেয়ে আগে কখনো দেখেনি। সে পথে যাওয়ার সময় ভাবছিল – মেয়েটা কিরকম যেন মায়াবী  , সরলা বালিকাসুলভ।  


মেয়েটির বয়স প্রায় বছর ষোল এর কাছাকাছি হবে। শ্যামবর্ণা , পরনে সাবটা দেওয়া জীর্ণ শাড়ি , মুখখানি গোলগাল , নাকে নথ , মুখে হাসি যেন লেগেই আছে , দু'হাতে গাছগাছালি  দিয়ে তৈরি অনেকটা চুড়ির মতো গোল গোল কি একটা।  প্রাঞ্জল চিত্তাধিকারী । তোমরা যাকে বলো ঐ গেঁয়ো মেয়ে। তবে আমার কাছে এই মেয়ে মাটির মেয়ে। 


বিপ্লব আজকাল দিঘির পাড়ে প্রায়ই যায়। বিপ্লব দেখে -  মেয়েটি হাতে তৈরি মাটির  উনুনে রান্না করে। ধোঁয়ায় তার চোখ লাল হয়ে যায়। কি অপরূপ মায়ার মতো মুখখানি! আর অন্যান্যেরা সক্কলে কাজে ব্যস্ত। পরিবারের বড়োরা বেতের ঝুড়ি, আবার কেউ বিশেষ ধরণের বসার কেদারা, কেউ আবার প্রাণীর চামড়া দিয়ে নাম না জানা একধরণের বিশেষ বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি তৈরি করতে ব্যস্ত।  বিপ্লবের এসব দেখতে খুব ভালো লাগে কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগে ঐ মেয়েটির আদুরে মুখখানি। 



এরকমভাবে বেশ কয়েকদিন যায়। 


বিপ্লব সেদিন বিকেলবেলা  দিঘির দক্ষিণ পাড়ে দাঁড়িয়ে আদিগন্ত খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল – দূরে এলোমেলো আলপথ ধরে যদি সে কোনো অজানা দেশে যেতে পারত , এমন মনফড়িংয়ের দেশ যেখানে হাত বাড়ালেই বন্ধুর দেখা পাওয়া যায়। এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে দুই হাতে করে কে তার চোখ ধরল। অনেক চেষ্টাতেও বিপ্লব বুঝে উঠতে পারল না। বিপ্লব বলল- ‘ কে  ? ’ মেয়েটি চোখ ছেড়ে দিল। বিপ্লব পিছন ফিরে দেখে সেই মেয়েটি। সে অবাক ! তার অবাক করা দৃষ্টি দেখে মেয়েটির সে কি হাসি। খলখল হাসিতে চারদিক ভরে উঠল। বাতাসের প্রতি তরঙ্গে ভেসে যাচ্ছিল সেই হাসির ঢেউ। 


গালভরা হাসি হেসে মেয়েটি বলল- ‘ কী রে বাবুয়া দেখিস ক্যান ? তুর এট্টোও বন্ধু নাই বুঝি। ’


বিপ্লব আলগা স্বরে বলল – ‘ কেন ? ’


—‘ আমি শুধু ভেলকি দেখাই না রে মুখ পড়তেও পারি। হৃদয় জ্বালাটো চুপ থাকলে কী আর কমে রে ? দেখসন - জীবনযুদ্ধে পাষাণ হইছি। দুখের ওজনটুকুনি কমাতে হাসির ছোঁয়াটুকুনি রাখেছি। শোন , তু আমার বন্ধু হবি ? আমরা ত্যাভুবন পাড়ি দিব।’


বিপ্লব ভাবল এ কোন মেয়ে! এ মেয়েকে হেয় করা পাপ। বিপ্লব এতক্ষণে দ্বিধা ঝেড়ে বলল – “শোনো বাজিকরের মেয়ে , এই মালিনীর জলকে শপথ রেখে বলছি আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। ”


মেয়েটি শুধু খিলখিল স্বরে হেসে উঠল। 


পরের দিন ছেঁড়াখোড়া  নীল আসমানী শাড়িটা সাবটা করে পরে এসেছিল। চোখে পুরু কাজল। কবরীর খোঁপাতে জবার ফুল। কি সুন্দর মানিয়েছিল বাজিকরের মেয়েটিকে ! ধরিত্রী তারে নিজ হাতে নিজ রঙে রাঙিয়েছে যেন ।


সেদিনই বিকেলবেলা তারা দুজনে মেঠো আলপথ ধরে এক পা , দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছিল সুকন্যা নদীর দিকে। নদীর তীরে উঠে  বিপ্লবের মন জুড়িয়ে গেল। তীরের লম্বা ঝুঁটিওয়ালা ঘাসগুলোর প্রতিচ্ছবি নদীর জলের তরঙ্গে কেমন যেন একবার করে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল – বিপ্লব দেখল তার প্রতিচ্ছবির দশাও এক – সে নিজের অজান্তেই একবার হাতটাকে পিছনে দিয়ে নিজ মেরুদণ্ড  ছুঁয়ে দেখল।  বিপ্লবের হাত শক্ত করে ধরে বাজিকরের মেয়ে সুদূরে নদী যেখানে বাঁক খেয়ে অদৃশ্য হয়েছে তার প্রতি অঙ্গুলিসংকেত করে শূন্যে মুখ তুলে বলে উঠল – ‘তুমরা বাবুরা নকলটোকে বেশি ভালোবাসো খন , আসল তো হলো লড়াইটো। দেখসন সাধারণের কপালেই যত বেপদ , দেখ গো দেখ  চনমনা সুকইন্যার দশা , সেও বাঁকতে বাধ্য হইছে । ’


সুকন্যাকে অতিক্রম করে তারা পৌঁছেছে নিবিড় মায়াবী জঙ্গলে। সেই কখন তারা বেরিয়েছে অচেনার উদ্দেশ্যে। সূয্যি চলে গেছে তার দেশে। বিপ্লব এই প্রথম কোথাও দূরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। বিপ্লব শক্ত করে মেয়েটির হাত ধরে আছে  , পাছে হারিয়ে ফেলে। চারদিকে জোছনার আলো পড়েছে। এ পথ মেয়ের চেনা। ধরিত্রী যে নিজ হাতে তৈরি করেছে বাজিকরের মেয়েকে। চারদিক নিঃঝুম। মাঝেমধ্যে রাতচোরা পাখির কড়্কড়্ ধ্বনি  , দূরপাল্লার কোনো এক জায়গা থেকে শোনা গেল ‘হুক্কা হুয়া , হুক্কা হুয়া ’ আওয়াজ। এ আওয়াজ কানে যেন ভয়ংকর অথচ মায়াবী ঠেকল। বিপ্লব তার বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল – জোছনার লেপনে আলোআঁধারি মুখখানি কি সুন্দর মায়াভরা ! 


কিছুক্ষণ পর রাস্তা সরু হয়ে আসে। এবার আগে চলে বাজিকরের মেয়ে , পিছে অনুসরণপূর্বক আসে বিপ্লব। তারা এগিয়ে যাবে সেই মনফড়িংয়ের দেশে যেখানে থাকবে বিপ্লবের হাতে অজানা অথচ চিরকালের চেনা সেই বাজিকরের মেয়ের শক্ত হাত। জোছনার আলোকে ভরসা করে এগিয়ে চলেছে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। বিপ্লব বলল- ‘ আর না। আর পারিনা। ’


মেয়ে বলে উঠল – ‘ মনফড়িং এর দ্যাশ এখনো শ'ক্রোশ। লড়াই চাই , সংগ্রাম চাই …। ’ 


কিছুকাল পরে দুজনে ঘুম যায় বিশাল শাল গাছের তলায়। “ হুপ! হুপ!! ” – আওয়াজে বাজিকরের মেয়ে জেগে উঠে দেখে একটি লক্ষ্মীপেঁচা তাদের মাথার উপরের ডালে বসে। তাকে না তাড়িয়েই পিপাসার্ত মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনের রাস্তা দিয়ে অল্পদূরের ডোবার উদ্দেশ্যে চলে গেল। হালকা সাদার উপর হলুদের আবছা আবরণে ঢাকা শাল ফুল টুপ করে বিপ্লবের গায়ে পড়ায় তার নিদ্রাভঙ্গ যায়। জোছনার হালকা আলোয় মনে হচ্ছিল ফুলের উপর কাজলের ছোঁয়া লেগে আছে যেন। পাশ ফিরেই বিপ্লব হতচকিত ! ভেতরটা আঁচড় দিয়ে উঠল বিপ্লবের। তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে কিছুদূর যেতেই সে দেখে দুই হাঁটুর উপর ভর দিয়ে মেরুদন্ডটি সোজা করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে চোখ মুদে বসে আছে বাজিকরের মেয়ে ,  হয়তো কোন এক অজানা দেবতার উদ্দেশ্যে।  নথপরা নাকের ওপাশে গুটিকতক কেশ মৃদুমন্দ সমীরণে ফুরফুর করে উড়ছিল। জ্যোৎস্নার মায়াবী আলোয় মায়াবিনী জঙ্গলে দুজনকে মুক্ত হরিণ-হরিণী লাগছিল। মুগ্ধনেত্রে অপলক দৃষ্টিতে বিপ্লব বাজিকরের মেয়েকে দেখছিল , লড়াইয়ের আসল অর্থ সেদিন টের পেয়েছিল কিনা জানি না তবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি সে কৃতজ্ঞ ছিল। 



ভেলকিবাজির  কানের  কাছে  মুখ  নিয়ে  গিয়ে  বিপ্লব মৃদুস্বরে  বলল – ‘ বন্ধু , তোমার  হাতের  ভেলকিবাজিতে আজ  আমি  মুক্ত।  দেখো  কেমন  ফড়িংয়ের  মতো ফুরফুরে মেজাজে উড়ছি। আমায় শক্ত করে ধরো বন্ধু। তোমার দেশের শরিক আমি আজ ।’



অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল 


ঋ ভু  চ ট্টো পা ধ্যা য়

আয়না অথবা প্রতিবিম্ব

              

বাই ঠিকই ধরেছেন, এখন সকালবেলা, অন্তত আকাশ দেখে তাই মনে হচ্ছে।অবশ্য মনে হওয়াটা সেরকম কোন ব্যাপার না।অনেকের অনেক কিছুই মনে হয়।যেমন তমালের।ক্লাবের ছেলেরা এক কথায় তমলা বলে ডাকে, কেউ আবার তবলা।ব্যাটার এখন সামনে ভুঁড়ি হচ্ছে।সেদিন অশোক অনেক ক্ষণ ধরে দেখে বলে উঠল, ‘ভালোই মাল টানছিস, কি বল? দাঁত ক্যালা।’

ওরকম ভাবেই উত্তর দিল, ‘না, কোথায় আর মাল…’

–তাহলে মাল দেখছিস, মাগি বাজি করছিস?

শালা ভাগ্য একেই বলে।‘গ’ অক্ষর মেষ মাংস(‘গ’ বললাম কারণ মাধ্যমিকটা পাশ করেছে।তারপর ওর থেকে বয়সে বড় এক মহিলার প্রেমে যেই পড়ল ব্যাস অমনি জীবন এক্কেবারে কেলিয়ে কুকুর হয়ে পড়ে থাকল।তখন আমাদের কথা শুনতই না।কিছু বললেই রেগে উঠত, ‘তোরা কিছু বুজিস না।এটা ঠিক প্রেম নয়, ঐ একটা ভালো লাগা বলতে পারিস।’ আর গো মাংস বললাম না পরিস্থিতির জন্যে) ঐ মহিলার যত ছিদ্র ছিল তমাল সবগুলোর খুব সুন্দর ব্যবহার করে গেছে।

আমাদের শঙ্কর আবার কলেজে ভর্তি হয়েছিল, তাও আবার ইংরেজিতে অনার্স।আমাদের তো সেটা শুনে তিন দিন হাসি থামেনি।কিছু বলতে গেলেই পেটটা ককিয়ে ওঠে,‘শালা পাশ করেও ভালো করে শেক্সপিয়রের বানানটা লিখতে পারবি না।শেক্সেই সব কিছু আটকে যাবে।জোর করে সিস্টেমের বদান্যতায় কখনো বড় কিছু হয় না।’

তবে শঙ্কর আমাদের একটা ছোট্ট ধারণা দিয়ে দিয়েছিল।ঐ সেক্সপিয়র না কি যেন নাম, ও ব্যাটাও ওর থেকে কয়েক বছরের বড় এক মেয়েকে লাইন মারত।তারপর তাকে খুশি করতেই লুকিয়ে শিকার করা, হাতে গরম লোহার শিকের আঘাত খাওয়া সেখান থেকে ভিড়ে মিশে লণ্ডন।এলো এনডি লন্ডন, ছোট বেলায় খেলতাম।

শঙ্কর কথাগুলো কলেজের কোন স্যারের কাছ থেকে শুনেছিল আমাদের বলে দিল।শুনে আমিই প্রথম উত্তর দিলাম, ‘তা বলে তুই ঐ সেক্সপিয়র হতে যাস না।তোর যা সেক্স, মনে আছে তো খোকন কাকা কেমন তাড়া করেছিল…’ 

শঙ্কর কোন উত্তর না দিলেও বাকি সবাই হেসে উঠল।বদ ছেলে।তখন সবে ক্লাস টেনে উঠেছে।একদিন ক্লাবে এসে বলল, ‘খোকন কাকাদের বাথরুমের দরজাটা ভাঙা।’

আমরা সবাই হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাতে তোর বাবার কি? কাকিমাকে পটাতে যাবি নাকি?’

ও ব্যাটা কোন উত্তর না দিলেও পরে শুনলাম কে নাকি খোকন কাকাদের বাথরুমে উঁকি মারছিল।অন্ধকারে বুঝতে না পারলেও খোকন কাকা তাড়া করেছিল।খোকন কাকাই দেখেছে একটা কম বয়সি ছেলে ছিল।

আমাদের আর কিছু শুনতে হয় নি, বুঝে গেছিলাম।এটা শঙ্কর ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।তমাল পুলিশে চাকরি পেয়ে গেল।‘একেই বলে কপাল, না কোন ফর্ম ফিলাপ, না মাঠ, না ঘাট।’ কথাগুলো এক সন্ধ্যায় শঙ্কর নিজের মত করে বলতে আরম্ভ করল।আমরা কেউ উত্তর না দিলেও তার পরের দিন থেকে ও নিজেই আমাদের ক্লাবে আসা বন্ধ করে দিল।

অবশ্য কথাগুলো সব সত্যিই বলেছে।তমাল শালার বাপটা মন্ত্রীর কনভয়ে কাজ করত, অ্যাক্সিডেন্টে একটা হাত গেল, অমনি মন্ত্রীর কথায় তমালের সোজা চাকরি।আমাদের ভালো গিলিয়ে ছিল।নেশার ঘোরে অবশ্য সবাই বলেছিলাম, ‘এবার কিন্তু তোর হাতেই এই রাজ্যের নিরাপত্তার দায়িত্ব, সাবধানে থাকবি।’

-সময় সময় হাত দুটো একটু ধুবি।দিন রাত তো হাত মেরে মেরে তো শরীরটাই শুকনো আম করে দিয়েছিস, চাকরি পেলি, এবার বিয়েও হবে।এখন থেকে একটু সংযত না হলে শুধু ধোঁয়া বেরুবে।কথাগুলো তুষার বলল, তমাল শুনল কি?

কয়েক মাস পরে ছুটিতে ক্লাবে এসে বলে,‘আমাদের মেসটা খুব সুন্দর।আমার ঘরের জানলার ওপাশেই পুকুর।সকালে কতজন স্নান করে….’

–কত জনের মেয়েছেলে কটা..? কথাগুলো কেষ্ট কাকা জিজ্ঞেস করে।

-তুমি কাকা কিন্তু বড্ড পাকা, ও পুলিশ হয়ে গেছে বলে কি ওর দাঁড়াবে না?

আমাদের ক্লাবের ফিস্টে কাকাই রান্না করে।টাকা নেয় না, তবে একটু খাওয়াতে হয় একটু গেলাতে হয়।কেষ্ট কাকার খুব কষ্ট।এই দিন গুলোতে বাড়ি যেতে পারে না।বউ মুখে মালের গন্ধ পেলেই ক্যালায়।কেষ্ট কাকা তাই কথায় কথায় বলে,‘বিয়ে করবি না, বরং মাগী পুষবি।’

আমি কিছু উত্তর না দিলেও তমালের সাথে আমার ভাগ্যের প্লাস মাইনাস দেখি।তমাল সকালে মাগী দেখে, আর আমি নটা পর্যন্ত পেপার নিয়ে ঘুরে বেড়াই।চোখের সামনে প্রতিদিন খুন ডাকাতি, ধর্ষণ শব্দগুলো এক এক করে লোকের ঘরে ঘরে দিয়ে আসি।অথচ নিজে কাউকে খুন করতে পারিনা, বকতে পারিনা।সবার সামনে একটা আয়না নিয়ে দাঁড়ালেও আমিই সবাইকে আয়নাতে দেখতে পাই, তাদের মত পোশাক পরে নি।লোকে এই সব পড়ে, দেখে, আনন্দ নেয়।আর আমি মাস গেলে কিছু ক্যাশ পাই।

ক্লাবের সবাই মোটামুটি আমারই মত, কেউ টোটো, কেউ অটো, কেউ সব্জি, কেউ মুদির দোকানে কাজ করে, শুধু তমাল ঐ যে মেয়েটা, সরি কাকিমাটা যার সাথে ব্যাটা লাইন মারে, তার ভাগ্যেই চাকরি জুটে গেল।না হলে যেদিন থেকে প্রেম আরম্ভ করল তারপরেই ওর বাবার ঐ রকম হল, আর চাকরি।জয় মা, জয় কাকিমা।

 

সন্ধেবেলা

 

প্রতিদিন দুপুর থেকেই শরীরটা কেমন যেন হয়ে যায়, ভাত খাই, আর সঙ্গে নিজের অজান্তেই কিছু একটা খেয়ে ফেলি।দেখি মুখ দিয়ে ভালো কথা ছাড়া আর কিছু বের হতেই চায় না।মনে শুধু অঙ্কের ফর্মুলা ছাড়া আর কিছু আসে না।আমি এই সময় ফুল শার্ট পরে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে টিউসন করি।আমি কিন্তু ঠিক যাকে মুর্খ বলে সেটা নই, ম্যাথে অনার্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েসন করেছি।টপাটপ অঙ্ক করি,ছাত্র ছাত্রীদের বাবু বাছা বলে কথা বলি।সবাই বলে আমার মত টিউটর নাকি এই শহরে বিরল।অর্থাৎ আমি একটি বিরল প্রজাতির প্রাণী।অন্তত এই সময়।দুপুর তিনটে থেকে রাত্রি দশটা।

ক্লাবের বন্ধুরা অবশ্য গাল দিয়ে বলে, ‘শালা, তুই হলি শঙ্করের বেস্ট ফ্রেন্ড, তুই কারোর খাঁজ ভাঁজের দিকে না তাকিয়ে শুধু পড়াবি!সে গুড় বা চিনি সবেই বালি।’  

এই এক মহা জ্বালা, তিনটে থেকে আমার এই পাল্টে যাওয়া চরিত্রটা কেউ মানতে পারে না। আমিও না, কেমন করে যে বলে উঠি, ‘হ্যাঁ বৌদি/ কাকু/ দাদা/ কাকিমা… বা ইত্যাদি প্রভৃতিও পড়ছে, তবে আপনাকে একটু দেখতে হবে।’ 

আসলে কয়েক বছর আগে পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে গলিতে বন্ধুর বাইক ঢুকিয়ে দিচ্ছিলাম।সেটাই ক্লাবের সবাই যে এমনি ভাবে খেয়ে নেবে কে জানত?

তার থেকেও অদ্ভুত ব্যাপার হল যাকে দেখছিলাম সেটিও আমার এক স্টুডেন্টই ছিল।ব্যাস, সব সিস্টেমের হরেকৃষ্ণ হয়ে গেল।তবে আমি নিজে জানি আজ পর্যন্ত ভুল করেও কোন অছিলায় কোন স্টুডেন্টের গায়ে হাত ছোঁয়াই নি।এটা ক্লাবের কেউ বিশ্বাস করে না।

মাঝে মাঝে নিজের উপরেই রাগ হয়, ক্লাবের উপরেও।ভাবি ‘কাল থেকে আর ক্লাবের দিকে যাবো না।পড়িয়ে সোজা বড়ি চলে আসবো।এমনিতেই প্রতিদিন রাতে ঘুমিয়ে ভোরে উঠতে অসুবিধা হয়, নেহাৎ বাবার আমল থেকে পেপারটা দেওয়া নেওয়া হচ্ছে তাই হয়ত সুবলদা দেরি হলেও পেপার গুলো যত্ন করে রেখে দেয়।আমি প্রতিদিনই একবার করে বাবাকে শুনিয়ে বলি, ‘পেপার দেওয়াটা এবার বন্ধ করব।’

বাবা শুনতে পেলেও প্যারালাইসিসের পর আর কথা বলতে পারে না, ইশারাতে আকাশ বাতাস দেখায়।হয়ত আমার কথাগুলো শুনতেও পায়, আমার উপর রেগে যায়।মাকে ঘঁ ঘঁ করে কি সব বলে।মা আমার উপর চিৎকার করে।বাবার আড়ালে বলে,‘মানুষটা আর কদিনই বা বাঁচবে, কি দরকার এই শেষ সময়ে কষ্ট দিয়ে। মানুষটাতো লোকের বাড়ি বাড়ি এই পেপার দিয়েই তোকে বড় করেছে, যা হোক পড়াশোনা শিখিয়েছে।কেউ তো…’  

কথাগুলো ঠিক, সকালে পেপার, আর বিকালে একটা মুদির দোকানে কাজ এই করেই তো এতগুলো বছর কাটল।

আমার চোখের সামনে একটা সকাল জোর করে জেগে ওঠে।আমি কোন রকমে দুই’চোখে আধ ঘুম নিয়েই বিছানা ছাড়ি, সাইকেল বের করি।শীতকাল হলে সঙ্গে একটা টর্চ রাখি।যারা পেপার নেয় তাদের সাথে দাঁত কেলিয়ে কথা বলি, আবার টাকার তাগাদা করি।পত্রিকা সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে সে সবের উত্তর দি অথবা পরের দিনের জন্যে সময় নি।চাকরি খোঁজার পেপারগুলোর কথা বলি।সবটাই কিন্তু মার্জিত ভাবে, পড়ে থাকে ক্লাব বা অন্য কিছু।

 

রাত্রিবেলা

 

শালা প্রতিদিনই পড়ানো শেষ করার পর সাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে যাবার কথা ভাবলেও সাইকেলের চাকা ক্লাবের দিকে ঘুরে যায়।আমিও টুক টুক করে চলে যাই।প্রতিদিনই গিয়ে দেখি তপন সুবলরা বসে বসে তাস খেলে, কানাইদা এককোণে বাংলার একটা বোতল আর ছোলা ভাজা নিয়ে বিশ্ব দর্শন করে।আমি পুজোর চারদিন ছাড়া আর খাইনা।ও ভুলে গেছি, তমাল ইংলিশ কিনে আনলে একটু চলে।ওর নাকি মাইনের টাকাতে কোন হাত পড়ে না।পবিত্র বা তুষাররা একটু দেরিতে আসে।একজন মুদি আর একজন কাপড়ের দোকানে কাজ করে।ফিরতে তো দেরি হবেই। ক্লাবে ঢোকার সময়েই একপাশে জুতো জোড়া খুলে রেখে দেওয়ার মত সকাল আর সন্ধেটাকেও রেখে দিতে হয়।এখানে কোন হাইট অ্যান্ড ডিস্টেন্স হয় না।এখানে শুধু এত পরিমাণ জলে এত পরিমাণ সিরাপ.. অথবা ওয়ান বাই কস সির অঙ্ক কষতে হয়।না পারলে একপাশে বসে থাকো, একটা দুটো বিড়ি টানো, আর শঙ্করের ভাগ্যে ঈর্ষা কর। আমার ভাগ্যে ওরকম একটা জুটলে ভালো হত, না হয় ভাইবোনের মত থাকতাম।

 ক্লাবে থাকো মজা কর, মাল খাও, কিন্তু ভুলেও এই সময়কার পড়াশোনা বা রাজনীতির কথা বলতে গেলে গাল শুনতে হয়।একপাশে বসে থাকতে হয়, শুনতে হয়, ‘তুই বাল বেশি বকিস না তো, করিস তো টিউসনি,  আর নিজেকে ভাবিস মাস্টার।টিউটর আর মাস্টার এক নয়।’ 

আগে কথাগুলো কাঁটার মত শরীরে লাগত, এখন আর কিচ্ছু মনে হয় না।পাল্টে ফেলে এখন পটল হয়ে গেছি।সত্যিই তো সবার সাথে ঝগড়া করতে করতে আমাকে তো বনে গিয়ে থাকতে হবে।তার থেকে এই ভালো ওদের সাথে খিস্তি খাস্তা করেই দিব্যি চলে যায়।ওরাও এটা ভালোবাসে।তারপর রাত হয়, আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে পা বাড়াই।মা প্রতিদিন খাবার নিয়ে বসে বসে ঢোলে।ঘরে ঢুকলেই খুব শান্ত ভাবেই বলে, ‘তোর এই রাতের ব্যাচটা ছাড়।এদের সকালে পড়িয়ে দে।প্রতিদিন এত রাত করে ঢুকলে কত অসুবিধা বল তো।খেতে শুতেই বারোটা বেজে  যায়।তোর আবার ভোরে ওঠা আছে, দুপুরেও তো একটু শুতে পাস না।’

কিছু উত্তর দিতে পারি না, বুঝতে পারি মা নিজের কথাও বলে, বলতে হয়, কষ্টে মুখ দিয়ে এই সব কথা বেরিয়ে আসে।প্রতিদিনই খাবার পর বাবার কাছে গিয়ে কিছু সময় বসি।মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দি।জেগে থাকলে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে দেখে, আর দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।মুছিয়ে দিতে গেলে আমার নিজের হাত কাঁপে।মুখ চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি।কান্না আসে, কাঁদি, বালিশ ভেজাই, জানলার ওপারে নেমে আসা রাত্রি আমাকে ঘুম পারানোর চেষ্টা করে।শুধু আমি ভুলে যায় কে কাঁদে, সকাল, সন্ধে না এই অন্ধকার রাত্রিটা, কার জন্যেই বা কাঁদে?

দুর শালা কি সব বাঁজা ভাবছি, আমাকে তো ভোরে উঠতে হবে।



অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল 


বা ণী ব্র ত  গো স্বা মী

এক ব্যাগ খুশি

                  ‌‌                                          

নন্দপালিত আর পদ্মপুকুর স্টপেজের মাঝামাঝি ভদ্রমহিলার কাঁধ থেকে ব্যাগটা ছিঁড়ে নিয়ে ছেলেটা চলন্ত বাস থেকে লাফ দিল। আমি কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে ব্যাগটা খেয়াল করছিলাম। ভারী সুন্দর। গাঢ় গঙ্গাজল রঙের চামড়া। প্রকৃত গোরুর চামড়া,কৃত্রিম নয়। আমরা যারা চর্মশিল্পের সাথে যুক্ত তাদের এটা একটা বদ অভ্যাস। কোন মহিলার কাঁধে প্রকৃত চামড়ার ভালো ব্যাগ দেখলে, নিরীক্ষণ করা। ব্যাগে কী কী গয়নাগাটি, ক্লিপ, চুম্বক, লাগানো আছে? এটা কিসের চামড়া? কাঁচা চামড়া থেকে ব্যবহার  যোগ্য করে তোলার জন্য কী প্রযুক্তি এবং রাসায়নকিকরণ করা হয়েছে? সেসব বোঝার চেষ্টা  করা। এসবের জন্য একবার তো ট্রেনে এক ভদ্রমহিলার ব্যাগে দুবার হাতও বুলিয়ে ফেলেছিলাম। ওনার স্বামী ইশারায় ওনাকে সাবধান হতে বলেছিলেন। এক্ষেত্রেও ভদ্রমহিলা চিৎকার করতে থাকলেন, এবং বারবার বলছেন, এক ভদ্রলোক নাকি অনেকক্ষণ তার ব্যাগের ওপর নজর রাখছে। ইতিমধ্যে পিছনে খুব চিৎকার। আমাদের বাসটাও দাঁড়িয়ে পড়ল। করোনার দৌলতে মুখের মাস্কটা আরেকটু টেনে নিয়ে বাস থেকে নেমে এযাত্রায় বেঁচে গেলাম। পিছনে দেখলাম ভিড়। আমি-ও এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি, একটা ছেলে সবুজ জামা, জিনসের প্যান্ট, রক্তে ভেসে যাচ্ছে পা দুটো। বাসের পিছনের চাকায় পিষ্ঠ দুটো পা। ডান হাতে ঐ ব্যাগটা ধরা। বোধহয় জ্ঞান নেই। ভদ্রমহিলা দৌড়ে এসে ব্যাগটা ফেরৎ পেয়ে ‌খুব খুশি। একটা প্রণামও করলেন। বোধহয় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেন। ছেলেটাকে যখন ট্যাক্সিতে তোলা হচ্ছে, তখন চমকে গেলাম, আরে! একে তো আমি চিনি। এতো সাকলিন। আমার পাশের কারখানায় ব্যাগের কারিগর। অনেক ছোটবেলা থেকে চিনি। আগে টেনিয়া ছিল। এখন পাকা কারিগর। কিন্তু ওদের কারখানা তো তিনমাস বন্ধ। আমাদের মত ওদেরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যাগ যায়। বিদেশের কোন অর্ডার নেই। তাছাড়া জাহাজ, বিমান সব বন্ধ। মানুষ আগে খাবে, ওষুধ কিনবে, না ব্যাগ কিনবে। ট্যাক্সিটা চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের দিকে চলে গেল। আমি পাশের গলিতে ঢুকলাম আনোয়ারের বাড়ি যাব, একটা ছোট ব্যক্তিগত কাজ আছে। সে কথায় পরে আসছি। 

আনোয়ার, আমাদের কারখানায় ফুরনে কাজ করে। প্রতি সপ্তাহে আমাদের কারখানা থেকে চামড়া,কাপড়, সুতো, বোতাম, আঠা, সব নিয়ে আসে। আবার মানিব্যাগ তৈরি করে পরের সপ্তাহে দিয়ে আসে। নিজেও তৈরি করে, আবার কয়েকটা কারিগরও রেখেছে। যারা বিদেশে ব্যাগ রপ্তানি করে, তারা বেশীরভাগই ঘরে বড় ব্যাগ বানায়, আর বাইরে ছোট ব্যাগ, মানে পুরুষ মহিলাদের মানিব্যাগ বানিয়ে নেয়। গোবরা কবরস্থানের পাশে আনোয়ারের বাড়ি। একটা ঘর। টিভি, ফ্রিজ, সোফা, খাট সব আছে ঐ ঘরে। সব মাল ঘর থেকে বার করে দিলে কারও সাধ্য নেই আবার ঐঘরে ঢোকায়। রাস্তায় মাটি খোঁড়ার মত, বেশি হবেই। চারটে করে ইঁট দিয়ে খাট উঁচু করা। নীচে চারজন শোয়। ঘরের এক কোণায় ওর বৌ বিজলী রান্না করে। হিন্দু মেয়ে। ওদের প্রেমের গল্প পরে বলছি।‌ বারান্দায় ওর কারখানা। চারটে কারিগর। ছেলেমেয়েরা ঘরে থাকেনা বললে ভুল হবে, আসলে থাকার জায়গাই নেই। যাইহোক যে কাজে আজকে আসা, আনোয়ারের বড় মেয়েকে তিনদিন হল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে, কারও বাড়ি যায়নি। আজকে থানায় রিপোর্ট লেখাতে যাবে। তাই আমাকে সঙ্গে থাকার অনুরোধ। যদি কিছু লেখালেখি করতে হয়। এমনি এদের আয় কম নয়। কিন্তু সঞ্চয় আর লেখাপড়া এই দুটো জিনিস এড়িয়ে চলে। তবে ওর বৌ আমাকে খুব শ্রদ্ধা করে। কারণ ওদের বিয়ের আগে থেকে অনেক কিছুই আমার জানা। বিজলী আবার হাতে পলা পরে। বাইরে বেরোলে মাথায় সিঁদুর দেয়। তিনজনে মিলে থানার উদ্দেশ্যে বেরোলাম। বিজলী বলল, “তিনজনে যাব?”

আনোয়ার হেসে উড়িয়ে দিল, “ছোড়ো তো ওসব বাত।”

বেরোবার সময় আনোয়ারের ছেলের সাথে দেখা হল। ইকবাল। চোদ্দ-পনেরো বছরের ছেলে। পড়াশোনা কতদূর করেছে জানিনা, কিন্তু যে কোন মোবাইল সারাতে পারে। এটা এদের একটা সহজাত গুণ। চাঁদনিতে কাজ করতো। জানাল, তিনমাস হল একটা মোবাইলও কেউ সারাতে আসেনি। থানায় ঢুকতে দেখি, সেই ভদ্রমহিলা সামনের বেঞ্চে বসে আছে। আমি চোরের মত একটু আড়াল করে দূরে বোসলাম। বড়বাবু নেই। টেবিলের ওপর বিরীয়ানির দুটো প্যাকেট রাখা। বোধহয় স্যারের লাঞ্চ। তার পাশে ভদ্রমহিলার ব্যাগটা রয়েছে। প্রায় আধঘন্টা পর স্যার ঢুকলেন। রাজকার্য সেরে। ঢুকতে ঢুকতেই সংস্কৃত ভাষায়, যেটা এখানে লেখা যাবে না, বলতে লাগলেন, “শালা কবে যে এই পার্কসার্কাস থানা থেকে মুক্তি পাব, সাত জন্মের পাপ। এত ভিড় কেন?” কনস্টেবল গোছের লোকটা বলে উঠল, “স্যার, এই মহিলা, একজন বাসে চাপা পড়েছে, তার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিল। পাবলিক ধরে ঝামেলা করে, তারপর থানায় দিয়ে যায়।”

তারমানে মনে মনে বুঝলাম, কনস্টেবলের চা-পানি কিছুই হয়নি, কেস্ পুরো ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ভদ্রমহিলা ঝেঁঝিয়ে উঠলেন, “মানে, বাসে আমার ব্যাগ ছিনতাই করে, ছেলেটা চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে চাপা পড়ল, আমি নেমে আমার ব্যাগ নিয়ে হাঁটা দিয়েছি, কিছু লোক ঝামেলা করল। বলে কিনা, এ’ব্যাগ আমার না। তখন আমি বলি, ঠিক আছে থানায় চলুন ওখানেই ফয়সালা হবে। আমায় কেউ থানায় দিয়ে যায়নি, আমি নিজের ইচ্ছেতে এসেছি। আমার স্বামী দমকলে আছে। আমি কী একটা ফোন করতে পারি?”

এবার বড়বাবু ওনাকে থামিয়ে বলা শুরু করলেন, “দাঁড়ান, দাঁড়াল, ও দমকলে ফোন করে শুধু শুধু লাভ নেই, আগুন লাগলে করবেন। আমরা তো আইনের বাইরে কিছু করতে পারি না। আমি আপনাকে চিনিনা, জানিনা। তাহলে প্রথমে আপনাকে কী করতে হবে? একটা ছিনতাই এর ডায়রি করতে হবে। তারপর আমরা ব্যাগটা উদ্ধার করবো। আপনি উপযুক্ত প্রমান দিয়ে নিয়ে যাবেন। ভেরী সিম্পল। পচা..., একটা প্লেট নিয়ে আয়।”

বলে উনি হাত ধুতে উঠে গেলেন।  লাঠিধারী একজন বলল, “আপনারা বাইরে বসুন, স্যার খেয়ে নিক।”

ভদ্রমহিলা কনস্টেবলটার সাথে বাইরে আড়ালে গিয়ে নীচু গলায় কিছু কথা বললেন। লোকটা স্যারের টেবিলের ওপর ব্যাগটা থেকে মোবাইলটা বার করে মহিলার হাতে দিল। মহিলা কাউকে একটা ফোন করল, তারপর গটগট করে থানা থেকে বেরিয়ে গেল।

স্যারের খাওয়া হল। তারপর আমাদের ডাক পড়ল। ‘নমস্কার’ বলে ঢুকলাম। আস্তে করে আমিই শুরু করলাম। 

--- “আমার পরিচিত এনার মেয়ে তিনদিন নিখোঁজ।”

--- “আ...স্তে, আস্তে, কিরকম পরিচিত আপনার?”

--- “ইয়ে, মানে, আমরা একই ব্যাগ কারখানায় কাজ করি।”

--- “আবার চামড়া! সকাল থেকে দুটো চামড়া কেস্ হয়ে গেল। একটা চার নম্বর ব্রিজের নীচে ট্যানারিতে একজন লেবার সুইসাইড করেছে। আবার এদিকে চামড়াপট্টীতে একটা বৌ মার্ডার হয়েছে। শালা ট্রেনও বন্ধ। ওরা তবু দুচারটে  সুইসাইড্ ভাগ করে নিত। এখন তো সবই আমাদের। আচ্ছা, এই চামড়া পাড়ায় সুইসাইড্ এত বেড়েছে কেন বলুন তো?”

--- “স্যার চার মাস ধরে তো সব বন্ধ। না আছে ব্যাগের অর্ডার, না চামড়ার। বানতলায় চর্ম শিল্পতালুক শ্মশানের মত খাঁ খাঁ করছে। একগাদা ছেলেমেয়ে নিয়ে কত পরিবার না খেতে পেয়ে মরছে।”

--- “আচ্ছা এসব ব্যাগ কোথায় বিক্রি হয়?”

--- “স্যার, বেশীরভাগই বিদেশে যায়। দামী চামড়ার ব্যাগ এখানে কেনার লোক কোথায়? দু-চারটে হাতে গোনা ভালো দোকান আছে। তাছাড়া বেশীরভাগই তো সস্তার ব্যাগের দোকান।”

এবার কাঠি দিয়ে দাঁতের ফাঁকে মাংস বার করতে করতে বললেন, “চামড়ার আবার কমবেশী দাম কী? চামড়া তো চামড়াই।”

--- “না স্যার, চামড়া পঞ্চাশ টাকা স্কোয়ার ফুটও আছে, আবার দুশো টাকা স্কোয়ার ফুটও আছে।”

এবার টেবিলের ওপর ব্যাগটা দেখিয়ে,

--- “আচ্ছা, এটা কিরকম চামড়া?”

--- “স্যার, এটা ভালো চামড়া। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি।”

--- “কিরকম দাম হবে?”

--- কমকরে হাজার তিনেক টাকা।

এবার আনোয়ার আমাকে পা দিয়ে ঠ্যালা দেয়, আসল কথাটা বলার জন্য।

আমি আবার শুরু করি, “হ্যাঁ স্যার, ঐ মেয়েটার ব্যাপারটা।”

--- “এত কাজের চাপ। তার মধ্যে যদি লোকের ছেলে মেয়ে খুঁজে দিতে হয়, আসল কাজ করবো কখন? ঠিক আছে মেজবাবুকে গিয়ে রিপোর্টটা লেখান।”

মেজবাবুর টেবিলে অনেক ফাইল। উনি একটা কাগজ পাকিয়ে চোখ বুজে কানের মধ্যে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। রোগা, চোখে চশমা, গোঁফ ছাড়া সারা শরীরে পুলিশের কোন চিহ্ন নেই। সামনে গিয়ে বললাম, “নমস্কার, বড়বাবু পাঠালেন, একটা মিসিং ডায়রি লেখাব।”

--- “যে হারিয়ে গেছে, তার ছবি, আধার কার্ড, এ্যড্রেস প্রুফ, সব এনেছেন?”

--- “হ্যাঁ স্যার।”

--- “তাহলে একটা এ্যপলিকেশন করে, সই করে জমা দিন। আগে মুখে মুখে হতো, এখন অনেক লাফড়া। নিজেরাই লোপাট করে আবার থানায় এসে মিসিং ডায়রি করে।”

--- “স্যার নীচে সই কে করবে?”

--- “যে হারিয়ে গেছে, সে নিশ্চয় নয়, যে ডায়রি করছে, সে করবে। মাথাটা খারাপ করবেন না তো।”

একটা সাদা কাগজে ভালো করে লিখে নীচে আনোয়ারকে সই করতে বললাম। আনোয়ার উর্দুতে ডানদিক থেকে বাঁদিকে সই করল। তারপর লেখাটা নিয়ে মেজবাবুর কাছে গেলাম। তখন উনি সুড়সুড়ি দেওয়ার কাগজটা খুলে মন দিয়ে পড়ছেন। বুঝলাম, দুপুরে খাওয়া মুড়ির ঠোঙার তৃতীয় ব্যবহার চলছে। আড়চোখে হেডলাইনটা দেখলাম, ‘এক অভিনেত্রীর সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করেছেন তার স্বামী'।

বিনয়ের সাথে বললাম, “স্যার, এই যে এ্যপলিকেশনটা।”

উনি বাঁহাতে কাগজটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে চিৎকার করলেন, “বাংলায় চিঠি আর উর্দুতে সই? কী করেন বলুনতো আপনারা? কে এই রুকসানা আখতার?”

--- “স্যার এ-ইতো হারিয়ে গেছে।”

এবার নিজের দোষ ঢাকতে আমাকে ধমক দিয়ে, “আপনি চুপ করুন তো, আমি বলছি এনার বাড়ির লোক কে?”

আমি বিজলীকে ইশারা করলাম। বিজলী বলল, “স্যার আমার মেয়ে, তিনদিন হল পাওয়া যাচ্ছে না, ফোনও সুইচড্ অফ্ বলছে।”

--- “আপনি বাংলা লিখতে পারেন?” বিজলী ঘাড় নাড়ল। “তাহলে এখানে একটা সই করুন।” 

বিজলী যখন সই করছে। তখন মেজবাবু্ টেবিলে তবলার একটা ছোট বোল বাজিয়ে জিগেস করল, “মেয়ে প্রেম করতো?”

 বিজলী থতমত খেয়ে বলে উঠল, “স্যার আগে করত, এখন বকাবকি করায় আর করে না।”

--- “এখন আর করবে কী? এখন তো সংসার করছে। ছেলেটার নামধাম বলুন। রোজ এই নিয়ে কত ঘাঁটছি।”

বিজলী এসব বলায়, আনোয়ারের চোখেমুখে একটা অসন্তুষ্টি। এবার আনোয়ার থাকতে না পেরে বলল, “স্যার ঐ সাকলিন বলে একটা লেড়কার সাথে ওর পেয়ার ছিল। লেকিন এখন ওর মা ওকে বেরোতে দেয় না। ওর ঠিকানা জানিনা স্যার। তবে আগে বানতলায় একটা ব্যেগ কারখানায় কাজ কোরতো। এখন তো সব বন্ধ। শুনেছি চার নম্বরের কাছে একটা ‘মাথানি’র ট্যানারিতে কাজে লেগেছে।”

একটা লুঙ্গি পরা লোক গ্লাসে করে চা দিয়ে গেল। টেবিলের ওপর দুফোঁটা পড়ল। উনি সেই কাগজের টুকরোটা দিয়ে টেবিলটা মুছলেন। এতক্ষণে ওটার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার হল। এবার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “এই তো আপনারা ভুল করেন। ঠিক আছে দেখছি কী করা যায়। ফোন নাম্বারগুলো সব লিখে দিন।”

থানা থেকে বেরিয়ে, বিজলীকে বললাম, বাড়ি চলে যেতে। বিজলী হাতজোড় করে কেঁদে বলল, “ দাদা, রুকসানা বলেছিল সাকলিন ওকে খুব ভালোবাসে, রোজগারও ভালো করে, ওরা বিয়ে করতে চেয়েছিল। আর তারপরেই সব কেমন হয়ে গেল? ভগ…. আল্লা জানে আবার কবে সব ঠিক হয়ে যাবে?” বলে ও শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। আমি আর আনোয়ার পার্কসার্কাস স্টেশনের দিকে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বোসলাম।

আনোয়ারের ঘাড়ে হাত দিয়ে সহানুভূতির সাথে বললাম, “সাকলিন মানে কোন ছেলেটা?”

--- “আরে ঐ যে বানতলায় আমাদের পাশের বিল্ডিং এ কারিগর ছিল। হাতের কাজ ভালো ছিল। আর ক’দিন পর ‘স্যাম্পেল ম্যান' ( যারা ছবি দেখে বা মন থেকে ব্যাগ বানাতে পারে, যেটা দেখে বিদেশ থেকে অর্ডার দেয়) হয়ে যেত। কিন্তু সবই নসীব। কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। তুমি চেনো। এখন ‘মাথানি’র কাজ করে। আর যত পাতাখোর( মাদকাসক্ত), পকেটমারদের সাথে আড্ডাবাজি করে। আসলে পার্কসার্কাস চামড়াপট্টীর পরিবেশটা তো ভালো নয়।”

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি, গরু-মোষের শরীরের চামড়া আগে চীনাপাড়ায়, তপসিয়ায়, বড় ট্যানারিগুলোতে যেত, এখণ বানতলায় যায়। আর মাথার ছোট চামড়াগুলোর (মাথানি) কাঁচা থেকে ফিনিশিং এর কাজ হয় এই পার্কসার্কাস স্টেশনের পিছনে। এই চামড়া দিয়ে সস্তার ছোট ছোট মানিব্যাগ হয়, চাবির রিং হয়। আবার একদম বাতিল অংশ দিয়ে আর ডেনড্রাইটের টিন দিয়ে মহরম, রথের মেলার ঢোল তৈরি হয়।

যাইহোক, এবারে আনোয়ারকে আসল কথাটা বললাম, সাকলিনের এ্যক্সিডেন্ট হয়েছে। আর বাকিটা বলতে আমার বিবেকে বাধল।

আনোয়ার বলল, “সে কী?”

--- “চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে আছে। বাসে চাপা পড়েছে।”

--- “চল, একবার যাবে। খবর নিয়ে আসি।”

চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে গিয়ে জরুরি বিভাগে খবর নিয়ে জানলাম, যে সাকলিনের অবস্থা ভালো নয়। রক্ত লাগবে। দুটো পা'ই বাদ দিতে হবে। বাড়ির লোক কেউ আসেনি, ঐভাবেই ব্যান্ডেজ করে পড়ে আছে।

এর মধ্যে আমার বাড়ি থেকে ফোন এল, অতসীর ফোন।

--- “একঘন্টা বলে বেরোলে। কখন ফিরবে?”

--- “তোমরা খেয়ে নাও। আমার দেরি হবে। বাড়ি গিয়ে সব বলব।”

 আনোয়ার জিগেস করল, “কী করব দাদা? ছেলেটাতো মরে যাবে।”

--- “শোন, যদি পুলিশ কেস হয়, তখন আমরা তো ফেঁসে যাব।”

--- “রুকসানা যদি ওর সাথে পালিয়ে থাকে, বা নিকা করে থাকে,‌ তাহলে কী হবে?”

--- “সেটা নিশ্চিত না হয়ে কিছু করলে বিপদ বাড়বে। এখন বাড়ি যাও।”

আমি ফেরার জন্য বাস ধরলাম। জানলার ধারে একটা সিটও পেয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, পার্কসার্কাসের ওখান দিয়ে ট্রেনে বা বাসে গেলে কত লোক নাকে রুমাল দেয়, কিন্তু ‌ ঐ বাজে গন্ধটাই অনেকের ঘরে বিরীয়ানির গন্ধ ছড়ায়। এখন আর ঐ গন্ধটা নেই। তেমনি তার সাথে কত পরিবারও হারিয়ে যাচ্ছে বা অপরাধ জগতের অতলে মিশে যাচ্ছে। যার খবর কেউ রাখে না। যেটা থেকে নাকে রুমাল দিয়ে বাঁচা যাবে না। আর কটা মাস এরকম চললে আনোয়ার বিজলীদের কী হবে? অথচ ক’মাস আগেও ওরা খুব আনন্দেই ছিল। সাকলিনের কোন চিকিৎসা হচ্ছে না। কে ওর দায়িত্ব নেবে? ও বাঁচবে তো? ওর সঙ্গীসাথী, বাড়ির লোক কোথায়? আমরা সব এরকম হয়ে যাচ্ছি কেন? অথচ আগের দিনগুলো তো অন্যরকম ছিল। বেশীদিন আগের কথা নয়।

বিজলী ব্যাগের কারখানায় তখন রঙের কাজ করতো। ব্যাগ হয়ে যাওয়ার পর, ব্যাগের ধারগুলো সাধারণত মহিলারাই রঙ করে। সেখানেই ওর আনোয়ারের সাথে আলাপ। বিজলীর মা লোকের বাড়ি কাজ করতো। বাবা রিক্সা চালাতো। সন্ধ্যেবেলা যখন বানতলায় সব কারখানা ছুটি হতো। আমি অনেকদিন দেখেছি, আনোয়ারের সাইকেলে বিজলীকে যেতে। বিজলীর তখন বাড়ন্ত বয়স। ঐ সময় সব মেয়েদেরই একটা চটক থাকে। আনোয়ারকেও বেশ হিরোদের মত লাগতো। দুজনকে বেশ মানাতো। জাত-পাত ধর্মের উর্দ্ধে একটা নিখাদ প্রেম। মাঝেমধ্যে খুব হাসাহাসি করে ওদের ফুচকা খেতে দেখেছি। ভেবেছি, কত কম দাম দিয়ে কত দামী ভালোবাসা কেনা যায়। আমি একদিন আনোয়ারকে জিগেস করেছিলাম, “তুমি বিজলীকে বিয়ে করবে তো?”

উত্তরে বলেছিল, “আমি ওর জন্য জান দিতে পারি দাদা।”

ও কথা রেখেছিল। ওদের বিয়ের সময় অনেক ঝামেলা হয়েছিল। আসলে মানুষের কাছে সমাধানের থেকে সমস্যা তৈরি করা অনেক সহজ কাজ। আমি শেষ পর্যন্ত ওদের পাশে ছিলাম। বিয়ের দিন বিজলীর হাসিমুখে, একটা ছোট বোন খুঁজে পেয়েছিলাম। আনোয়ারও ওকে কোনদিন কষ্ট দেয়নি। কিন্তু এখন তো জীবাণুর কবলে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের জীবিকা। সভ্য সমাজে সে জীবন মৃত্যুর নামান্তর। সেখানে ধর্মের কোন স্থান নেই। আছে শুধু, একমুঠো ভাতের লড়াই। ওদের সঞ্চয় কম, ওরা দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। আর আমরা যারা অর্ধশিক্ষিত, একটু বুঝে চলেছি, জীবনের বারুদ কিছুটা সঞ্চিত আছে, নিভতে সময় নেবে। ডারউইনের তত্বের লাইনের ওপারে কোনমতেই আমরা যেতে পারব না। প্রকৃতি বোধহয় এভাবেই অতিরিক্ত শুকনো পাতা খসিয়ে দেয়। 

অতসীর মুখটাও মনে পড়ছে। হাতিবাগানের ফুটপাথে ও যখনই ব্যাগ পছন্দ করে, আমার মতামত জানতে চাইতো। আমি অবজ্ঞাভোরে দেখেছি, আর বলেছি, “এ সব কি ব্যাগ নাকি? এগুলা তো চামড়াই নয়, এ তো ‘পি. ইউ.’।” অতসী অভিমানের সুরে বলেছে, “কোনদিন তো একটা এনে দিতে দেখলাম না, শুধু গল্পই শুনে গেলাম। কোন ব্যাগ, জুতো কিনতে গেলেই এটা গোরুর, এটা মোষের, ওটা ছাগলের এই সারাজীবন শুনে আসছি। শুধু জ্ঞানই পেলাম, চোখে কিছু দেখলাম না।”

অতসীকে কী করে বোঝাব, সোনার দোকানের কর্মচারী বা কারিগর খাঁটি সোনা চেনে, কিন্তু তার ঘরে সোনা কোথায়? বাড়ি ফিরে এসে অতসীকে কিছুটা বললাম, সবটা পারলাম না।

রাত্রিবেলা খেয়ে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছি, আর ভাবছি। কত মানুষ কত দামী দামী জুতো, জ্যাকেট, ব্যাগ ব্যবহার করছে। কিন্তু তার নেপথ্যের ইতিহাস কতটা করুণ। একটা চর্মশিল্পীর শিল্পের মর্যাদা, তিনহাজার টাকার ব্যাগে তিনশো টাকাও নয়। সেটা তৈরী করতে কী পরিমান মুন্সিয়ানা লাগে আমি জানি। তবুও সেই শিল্পের পারিশ্রমিককে খাটো করার জন্য বলা হয়, 'লেবার চার্জ'। শিল্পীকে মেরে শিল্পকে বাঁচানো যায় না। হঠাৎ আনোয়ারের ফোন। 

--- “দাদা, থানা থেকে ফোন করেছিল, সাকলিন মারা গেছে। ওর প্যান্টের পকেটে একটা কাগজে রুকসানার মোবাইল নাম্বার পাওয়া গেছে। আমাকে কালকে সকালে থানায় যেতে বলেছে। দাদা একবার আসবে?”

আমি বুঝলাম জড়িয়ে পড়ছি, বললাম, “ঠিক আছে যাব।”

পরদিন থানায় গিয়ে মেজবাবুর সাথে দেখা করলাম। মেজবাবু বললেন, “ সাকলিন ছেলেটার পকেটে পাওয়া রুকসানার নাম্বারে আমরা বারবার ফোন করছি, কিন্ত্ত সুইচড অফ বলছে। বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দিয়েছি। ওর বাড়ির লোক কেউ যোগাযোগ করেনি। আপনার মেয়ের সাথে কানেকশান আছে। আপনারা কি বডি নেবেন?”

আমরা বলে উঠলাম, “আমাদের মেয়েরই কোন খোঁজ পাচ্ছি না, এখন এই বডি নিয়ে স্যার আমরা কী করব?”

--- “তাহলে বডি বেওয়ারিশ হয়ে যাবে। তবে রেকর্ডে কিন্তু আপনার মেয়ের নাম থাকবে।”

আমরা নমস্কার জানিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে এলাম। আনোয়ারের চিন্তা বাড়তে লাগলো। আমি যথাসম্ভব সান্ত্বনা দিতে থাকলাম।

এরমধ্যে দুদিন কেটে গেল। আমিও কাজকর্মের চেষ্টায় দৌড়াদৌড়ি করছি। নিজের মানসিক চাপে আনোয়ারের ঘটনা মনের অনেক নীচে চলে যেতে থাকল। একদিন সকালে বন্ধুর সুপারিশে পাঠানো একটা ক্যুরিয়ার কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দেবার জন্য বসে আছি, হঠাৎ আনোয়ারের ফোন বেজে উঠল। আমি আস্তে করে বললাম,

--- “হ্যালো?”

হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠলো আনোয়ার “দাদা সব খতম। রুকসানা সুইসাইড্ করেছে। কুষ্টিয়াতে একটা টালির ঘরে ওর বডি পাওয়া গেছে। আমরা থানায় যাচ্ছি, তোমার পা পাকড়ছি দাদা, তুমি যত জলদি পরো, একবার এস।”

আমি বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে থানায় চলে এলাম। থানায় গিয়ে জানলাম, গলায় ওড়না দিয়ে সুইসাইড করেছে রুকসানা। বডি এন. আর. এসে. আছে। পোস্টমর্টেম হবে। বিজলী বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। আমরা থানা থেকে দরকারি কাগজপত্র নিয়ে মর্গের উদ্দেশ্যে বেরোলাম। ঠিক বেরোবার মুখে বড়বাবুর সাথে দেখা। বড়বাবু বললেন, “ একটা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। দেখবেন?”

বলেই উনি একজনকে ইশারা করলেন। একজন একটা জামাকাপড়ের দোকানের বিল এনে দিল আমার হাতে। দেখলাম, কয়েকদিন আগেই দুটো সালোয়ার-কামিজ কেনার বিল। পিছনে লেখা রয়েছে, ' সাকলিন; আমি তোমায় ছেড়ে বাঁচব না, তোমার বেটাকে নিয়ে তোমার কাছে আসছি।’ 

আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বড়বাবু পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “ ঐ ভদ্রমহিলা আর এলেন না, দুটো তাজা প্রাণ ঐ ব্যাগটার গায়ে লেগে আছে। ওটা আর আমাদের কোন কাজে লাগবে না। ওটা ছেলেটার কাছে পাওয়া গেছে, ওটা আপনাদের। আমি শুধু একটা অনুরোধ করব, ছেলেটার বডিটা আপনারা আইডেন্টিফাই করে সৎকার করে দিন। আমি সব কাগজ রেডি করে দেব। সব যখন শেষই হয়ে গেল। এবার একটু শান্তি পাক।”

--- “ধন্যবাদ।”

--- “আপনাদের কী মনে হয়, পুলিশ কি মানুষ নয়?”

আমার হাতে ব্যাগটা একজন দিয়ে গেল। আমার অতসীর মুখটা মনে পড়ে গেল। মানবচরিত্র বড়ই বিচিত্র। আনোয়ারের এসব দিকে খেয়াল নেই। ও মেয়ের শোকে পাগল। আমরা মর্গে গিয়ে দুটো বডিই সনাক্ত করলাম।  রুকসানা প্রেগনেন্ট্ ছিল। বডি হাতে পেতে পেতে রাত হয়ে গেল। তারপর গোবরা কবরস্থানে ‘মাটি' দিয়ে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হল। সাকলিন আর রুকসানার সব স্বপ্ন একসাথে মাটির নীচে চাপা পড়ে গেল। এই বিরাট পৃথিবীর বুকে মিশে যাবে ওদের ছোট্ট প্রেম। আমার কাঁধে ব্যাগটা ঝুলছে। ব্যাগের ভেতরে ছিল একটা ছাতা, জলের বোতল, কিছু দোকানের বিল, রুমাল,  লিপস্টিক,আর একটা ছোট আয়না। ছাতাটা মর্গের ডোমটাকে দিয়ে, বাকি সব ফেলে দিয়েছি।

অতসীকে আগেই ফোন করে দিয়েছিলাম, আমার অনেক রাত হবে। ঘরে ঢোকার সময়, ও আমার কাঁধে ব্যাগটা দেখেই বলল, “কী সুন্দর ব্যগ! কার গো?”

আমি বললাম, “তোমার।”

--- “সত্যিই! তুমি আমার জন্য আনলে?”

অনেকদিন পর অতসীর চোখে প্রেম দেখলাম। সংসারের চাপে ওর চোখটা অনেকদিন খেয়াল করা হয়নি। আর গত তিনমাস তো শুধু হতাশা আর দুশ্চিন্তাই দেখেছি। আলোয় দেখলাম, ব্যাগের গায়ে যে ‘লোগো’টা লাগানো রয়েছে সেটা সাকলিনের কারখানার। হয়তো সাকলিন-ই ব্যাগটা বানিয়েছিল। রাতে শুয়ে ভাবছি, সাকলিন ব্যাগটা ছিনতাই করল কী টাকা-পয়সা, মোবাইলের জন্য, নাকি রুকসানাও ওকে বলেছিল, একটা সুন্দর ব্যাগ আনার জন্য। দুটো মৃত্যু ঐ ব্যগটার গায়ে জড়িয়ে আছে, অথচ ওর ভেতরেই ভরা রয়েছে আমার এই টানাটানির সংসারের, একটু খুশির হাওয়া। কী অদ্ভুত! আচ্ছা, এই মৃত্যু দুটো তো করোনার মৃত্যু তালিকায় স্থান পাবে না। পৃথিবীতে এরকম কত লক্ষ মৃত্যু হবে, যার পরোক্ষ কারণ এই মহামারী। আমরা সোসিয়াল মিডিয়ায়, ও.এম. জি., আর.আই.পি. আর এইচ.বি.ডি. করে ঘুমিয়ে পড়ি।‌ এসবের খবর রাখি না। অতসী মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ঘুমিয়ে পড়।”

আজকে ও সত্যিই খুব খুশি।