প্রবাসী কলম
![]() |
অলংকরণ : চন্দন কুন্ডু |
বু মা ব্যা না র্জী দা স
(কানাডা)
চেতনা
কাঁটাঝোপ সরিয়ে একটা বিশেষ পাতা খুঁজছিল ইকনি। এখানেই দেখেছে মনে হচ্ছিল কদিন আগে। বাচ্চাদের দিয়ে খোঁজালে তাড়াতাড়ি হত, কিন্তু বাচ্ছারা তাকে ভয় পায়। বড়রাও যে খুব স্বস্তি পায় তাকে দেখে তা নয়। আড়ালে তাকে জাদুকরী বলে, সে নাকি কালা জাদু করে। করে তো করে, ওসব পাত্তা দেওয়ার সময় ইকনির অন্তত নেই। তার মাথায় অন্য চিন্তা ঘুরছে। এই নিয়ে গত সাতটা চাঁদের মধ্যে তিনজন কমে গেল দলের।
টোগ জঙ্গলে গেছিল ফল আনতে। ওইটুকু ছেলে , রোগাও খুব। ও আর কী পারে ফল আনা ছাড়া। সূর্য্য মাথার উপর উঠে যাবার পরও ফেরেনা দেখে তার খোঁজে জঙ্গলে গেছিল তারা কজন। লাল লাল ফলওয়ালা একটা ঝোপের নীচে পড়েছিল টোগ। চোখ দুটো খোলা, ঠোঁটের কোণে সাদা ফেনা। শরীর ঠাণ্ডা। বাকিরা তো জঙ্গলের অপদেবতা টোগকে খেয়েছে ভেবে সঙ্গে সঙ্গে ছুট দিল। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল তার কাছে ইকনি। এই ঘুরে ফিরে শিকার করে, ফল কন্দ জোগাড় করে বেড়ায় তারা, তারপর হঠাৎ একদিন এরকম পড়ে থাকে, সবই একরকম, শুধু ভিতরের মানুষটা থাকেনা। কোথায় যায় সেটা? এইসব খুব ভাবে ইকনি। আর এজন্যই সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। সেদিনও ফিরে এসে বলেছিল যে জঙ্গলের অপদেবতা নাও হতে পারে। ওই যে লাল লাল ফলগুলো, ওগুলোর জন্যও হতে পারে। ওই ঝোপের নীচে আগেও দু চারটে জানোয়ারকে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। তাদের আশেপাশে ফল ছড়ানো ছিল। বাকিরা এসব শুনে মুখ বেঁকিয়ে হেসেছিল। পাগলের কাণ্ড যত ইকনির। একটু পরে দলে ভারী হয়ে আবার গিয়ে টোগকে মাটির নীচে চাপা দিয়েছিল তারা। কেউ আর ওই বাচ্চা রোগা ছেলেটাকে নিয়ে কিছু ভাবেনি। এরকম তো হামেশাই হয়, এটাই তো স্বাভাবিক।
নুকের বেলায় অবশ্য এত সহজে ছাড়েনি সে। নুক গেছিল শিকারে। ফিরে এলো যখন একটা হাত, পেটের একটা দিক ফালাফালা। কোনক্রমে ফিরে এসেছে হামাগুড়ি দিয়ে। লাল রঙের স্রোত নেমেছে শরীর বেয়ে তখন। এটা সবাই জানে যে ওই লাল রঙের জিনিসটা শরীরের ভিতরে থাকে। একটু আধটু বেরোলে কিছুক্ষণ বাদে থেমে যায়, কিন্তু নুকের যেমন ভাবে বেরোচ্ছিল, সেভাবে বেরোতে থাকলে আর থামেনা। একটু বাদে এলিয়ে পড়ে মানুষ, আর ওঠেনা। সবাই ঘিরে বসেছিল নুককে, কতক্ষন আর। শুধু ইকনি তীরবেগে ছুটেছিল জঙ্গলের দিকে। একটা অদ্ভুত জিনিস সে আড়াল থেকে খেয়াল করেছিল কিছুদিন আগে। জঙ্গলে এক ধরনের জনোয়ার আছে অনেকটা তাদের মত দেখতে, তবে ঘন কালো লোমে ঢাকা তাদের শরীর। তারাও দল বেঁধে ঘোরে। বাচ্চারা কোলে থাকে মায়েদের। তবে খুব হিংস্র এরা, কাছে গেলে মানুষেরই বিপদ হয়। সেদিন হঠাৎ ওদের দেখতে পেয়ে চট করে লুকিয়ে পড়েছিল ইকনি। অবাক হয়ে দেখেছিল ওদের মধ্যে একজনের কাঁধ থেকে ঝরছিল ওই লাল স্রোত। একটা ঝোপ থেকে কিছু বেশ পাতা ছিঁড়ে খানিক চিবিয়ে সেটা জানোয়ারটা লেপে দিয়েছিল কাঁধের উপর। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই লাল স্রোত একদম বন্ধ হয়ে গেল ইকনির গোল হয়ে যাওয়া চোখের সামনে। দলটা একটু পরে চলে যেতে বেরিয়ে এসে ভালো করে ঝোপটা চিনে নিয়েছিল সে। সেই ঝোপেরই একরাশ পাতা নিয়ে ফিরতে ফিরতে নুক একেবারে এলিয়ে পড়েছিল। পাতাগুলো বেটে লাগানোর আগেই চোখ স্থির হয়ে গেছিল নুকের। বড় দেরী হয়ে গেছিল মনে হয়। তবে কেউই বিশ্বাস করেনি ওই পাতাগুলোর রসে কোন কাজ হত। এত কথা বোঝাবেই বা কীকরে ইকনি।
শেষ ঘটনা এক চাঁদ আগে। রিবি খেলতে খেলতে পড়ে গেছিল উঁচু পাথরের উপর থেকে। দুটো পা কেমন বেঁকে গেল, আর সোজা করতে পারলো না। ছোট্ট মেয়েটা যন্ত্রণায় সারারাত কেঁদে কেঁদে সকালের দিকে স্থির হয়ে গেল। ইকনি বুঝতেই পারছিলনা কী করা উচিত, খালি মনে হচ্ছিল কিছু নিশ্চয়ই করা যায়। সারারাত মশাল জ্বালিয়ে বসে ছিল মেয়েটার পাশে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। রিবির মা খুব অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিল ইকনির দিকে। বোধহয় বুঝতে চাইছিল এত সাধারণ ঘটনায় এরকম করছে কেন ইকনি। আঘাত লাগলে, কমজোরী হয়ে পড়লে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দলকে তো দুর্বল হতে দিলে চলবেনা। ইকনির আবার এইসব অসুস্থ দুর্বল মানুষগুলোর দিকেই বেশি নজর। ভারী আশ্চর্য। এমনি এমনি কী আর সবাই ভয় পায় ইকনিকে। অপদেবতা মানেনা, বলে সব কিছুর নাকি কারণ খুঁজে দেখতে হয়।
কাঁটাঝোপ বাঁচিয়ে পাতা খুঁজছিল ইকনি। একটি বিশেষ গাছের ছালও। এই ছাল শুকিয়ে পাথর দিয়ে গুঁড়ো করে রাখবে সে। এমনিতে খুব বিশ্রী খেতে। ইকনি জানে খাওয়ার জিনিস নয়, অথচ তার জন্য এতো সময় নষ্ট, এত খাটনি পছন্দ করে না দলের কেউ। তাকে ঘিরে দলে যে একটা চাপা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে সেটা সে অনেকবার টের পেয়েছে। আচমকা একটা হইচই চেঁচামেচি কানে আসে তার। খুব ভালো শিকার পেয়েছে নাকি আজ। কিন্তু একটু কান পেতে শুনে বুঝতে পারলো চেঁচামেচির ধরনটা ঠিক আনন্দের নয়। আবার কী হল ভাবতে ভাবতে গুহার দিকে দৌড় দেয় ইকনি। একটু দূর থেকেই দৃশ্যটা চোখে পড়ে। গুহার সামনের চওড়া চাতালটাতে দলের প্রায় সবাই ভিড় করে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। মেয়েরা দুই হাতে মাথা চাপড়াচ্ছে, শূন্যে দুই হাত ছুঁড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। ছেলেরা মাথা নীচু করে চাপা গলায় একটানা শোকের সুর তুলছে। সর্বনাশ, একমাত্র দলের সর্দারের কিছু হলে তবে এভাবে শোকপ্রকাশ করার রীতি। তবে কী রিরুগেরই কিছু হল। চমকে ওঠে ইকনি। রিরুগের মত দলপতি সত্যি কমই হয়। যেমন শক্তি তার, তেমন শান্ত বুদ্ধি। দলের শিশু থেকে বুড়ো, সবাই তাকে মেনে চলে। রিরুগ দলপতি হওয়ার পর থেকেই তারা মাটিতে দানা পুঁতে নিজেদের গাছ বড়ো করতে শিখেছে। চাতালটার নীচের জমিতে একরাশ সবুজ চারাগাছ ওই তো হাওয়ায় দুলছে কেমন। কিছুদিন পর ওদের মাথায় হয়ে থাকা গোলগোল দানাগুলো পেকে হলুদ হয়ে যাবে, তখন সেগুলো তুলে ছাড়িয়ে নিয়ে সেদ্ধ করে খেতে খুব ভাল লাগে। বাচ্চাদের আর কিচ্ছু চাইনা ওগুলো ছাড়া। সেই রিরুগের কিছু হলে দলটা তো ভেসে যাবে একেবারে। তার পরে সর্দার হওয়ার মত কেউই তৈরী হয়নি এখনও। এবার আরো স্পষ্ট দেখতে পায় ইকনি। ওই তো সবার মাঝখানে শুয়ে তাদের দলপতি। একটা পা অদ্ভুতভাবে দুমড়ে রয়েছে, ফুলে উঠেছে সাংঘাতিকভাবে। মুখে প্রচণ্ড যন্ত্রণার ছাপ। রিরুগের পায়ের কাছে বসে পড়ে সে। আলতো করে ছুঁয়ে বুঝতে পারে গা আগুনের মত গরম হয়ে উঠেছে। ভীড়ের মধ্যে থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় ক্রেক। সবাই জানে ওর খুব ইচ্ছা দলপতি হওয়ার। অঙ্গভঙ্গী করে বলতে থাকে যে দলের উপর অভিশাপ লেগেছে, দেবতাকে বলি দিয়ে খুশি করতে হবে। যদিও কমবেশি সবারই তাই মত, তাও ক্রেককে কেউ পছন্দ করেনা বলে কেউ সাড়া দেয়না। ছত্রভঙ্গ দেখায় দলটাকে। বড়ো কঠিন নিয়ম তাদের। যে বাঁচবেনা আর, তার জন্য খাদ্য পানীয় বরাদ্দ থাকেনা আর। সে দলপতি হলেও নয়। এখন বসে বসে অপেক্ষা কখন ধীরে ধীরে চোখ স্থির হয়ে আসবে রিরুগের, বন্ধ হয়ে যাবে বুকের ওঠাপড়া। ভিতরে ভিতরে কেমন অস্থির লাগে ইকনির।
- আমাকে চেষ্টা করতে দিতে হবে একটু।
অবাক চোখে তাকায় সবাই। এ ডাইন আবার কী চায়। এর জন্যই হয়ত দেবতারা অভিশাপ দিয়েছে তাদের। হাতের লতা পাতা গাছের ছাল দেখিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করে ইকনি, কী করতে চায় সে আসলে। আস্তে আস্তে চারপাশ থেকে উঠে যায় সবাই। কেউ রাজী নয়। হঠাৎ রিরুগের দিকে চোখ পড়ে ইকনির। স্থির দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে সে। মাথা তুলতে পারছে না, যন্ত্রণায় মুখ নীলচে হয়ে আসছে, তাও খুব ধীরে মাথা নাড়াতে চেষ্টা করে সে। ছিটকে উঠে দাঁড়ায় ইকনি। এখনো বোধবুদ্ধি হারিয়ে যায়নি তাহলে দলপতির। তীরবেগে নদীর দিকে ছোটে সে। আজ প্রয়োজন হলে পুরো দলটার সাথে একা লড়বে ইকনি।
মস্ত মস্ত পাতায় মুড়ে নদীর ধারের কাদামাটি নিয়ে যখন ফিরে আসে ইকনি, সর্দার রিরুগ তখন চোখ বুজে ফেলেছে। অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। পরম যত্নে প্রথমে গাছের ছালের গুঁড়ো জলে মেশায় ইকনি। জোর করে হাঁ করায় রিরুগের মুখ। একটা পাতা পাকিয়ে সেই হাঁয়ের মধ্যে ধরে রেখে সেই জল আস্তে আস্তে ঢেলে দেয়। খানিক গড়িয়ে বাইরে পড়ে। দুমড়ে থাকা পা টা খুব ধীরে একটু একটু করে সোজা করে। যন্ত্রণার ধাক্কায় শিউরে ওঠে রিরুগের শরীর। ইকনি ভিজে কাদা মাটি লেপতে থাকে সেই পায়ের উপর। কেউ একটা মশালও এনে ধরেনা সামনে। অন্ধকার ঘন হয়ে এলে নিজেই এক হাতে মশাল ধরে আর এক হাতে লেপতে থাকে কাদামাটি। দু চোখ দিয়ে কখন যেন জল গড়িয়ে নামে তার। দলের সবাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ খাবারও দিয়ে যায়নি ইকনিকে। চারপাশে রাতচরা পাখির শব্দে, হঠাৎ ডেকে ওঠা কোন জনোয়ারের শব্দে রাতের জঙ্গল জেগে উঠছে ধীরে ধীরে।
সারারাত ঠায় বসে থাকে ইকনি, কান খাড়া করে রিরুগের নিঃশ্বাসের শব্দ শোনে। নাহ, এখনো নিচ্ছে নিঃশ্বাস, এখনো স্থির হয়নি বুকের ওঠাপড়া। সকাল হলে সবাই দেখতে আসে সর্দারকে। যদিও চোখ বন্ধ তখনও, সাড়া শব্দও নেই, তাহলেও সে যে এখনো বেঁচে তাতে কারুর সন্দেহ থাকেনা। হঠাৎ যেন একটা সাড়া পড়ে যায় সবার মধ্যে, খাবার আসে, আসে জল। সবাই অবাক হয়ে রিরুগের পায়ের উপর শক্ত হয়ে এঁটে থাকা কাদামাটির প্রলেপটা দেখতে থাকে।
অনেক অনেকবার সূর্য ওঠে, চাঁদ ওঠে। কতবার সে খেয়াল নেই ইকনির। দলপতি রিরুগ উঠে বসে আছে। আজ কাদামাটির প্রলেপটা ভাঙবে বলেছে ইকনি। সবাই গোল হয়ে বসে অপেক্ষা করছে তার। যন্ত্রণা কমে গেছিল কিছুদিন পরেই, কতরকম পাতা যে বেটে খাইয়েছে ইকনি এর মধ্যে তার হিসেব নেই। একটা গোল পাত্রে শিশুদের মত শুয়ে শুয়েই নিজের শরীরের আবর্জনা ত্যাগ করেছে রিরুগ। সে সমস্ত পরিষ্কার করেছে ইকনি। চ্যাপ্টা একটা পাথর দিয়ে আলতো করে ইকনি ঠুকতে থাকে প্রলেপটা। ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে থাকে সেটা। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ইকনির কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল রিরুগ, তখন গোটা দলের উল্লাসের আওয়াজে সে তল্লাটের সমস্ত জন্তু জানোয়ার বোধহয় পালিয়ে বেঁচেছিল। রিরুগের পাটা সামান্য বেঁকে গেছিল ঠিকই, কিন্তু পা ফেলতে খুব কিছু অসুবিধা হচ্ছিলনা তার।
ফ্লেমিং সাহেবের পেনিসিলিন আবিষ্কার করে নোবেল পুরষ্কার লাভ করতে তখনও পঞ্চাশ হাজার বছর দেরী ছিল। তবে উইলো গাছের ছাল থেকে যে যন্ত্রণা নিবারণ করার ওষুধ বানানো যায়, সেটা মানুষ জেনে গেছিল সেই প্রথম চেতনার দিনগুলো থেকে। প্রথম চেতনার উন্মেষ, নাকি প্রথম মানবিকতার উন্মেষ।