সিরিজ  কবিতা 

অলংকরণ : চন্দন কুন্ডু 


শ ত দ ল  মি ত্র

অ-সাধারণের আত্মজীবনী



১.

জল ঝরছে তো ঝরছেই

জল ঝরিয়েই চলেছে

 

আমি বললাম

মা, আর ভিজো না,

বয়স হয়েছে তোমার!

 

কথাটা শুনতে পেল কিনা জানি না

জলের সঙ্গে কিছুটা সময়ও গড়িয়ে গেলে

হঠাত্ দেখি

ঘরের মধ্যে জলের আলপনা, আর

উপুরি-চুবুরি ভিজে যাচ্ছি আমি

ভেসে যাচ্ছি জন্মেরও আগের সে লবণ লাবণ্যে

 

জল ঝরছে তো ঝরছেই

আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে মা,

একাকী আমার ওপর

পরম মমতায়। 


 

২.

দমকা বাতাসে তারে ঝোলানো

বাবার কাপড়টা উড়ে গেলে আচমকাই 

আমি সে শুভ্রতার পেছনে ছুটি

ছুটতে ছুটতে একলা ডাঙার মধ্যে

দাঁড়িয়ে দেখি বাবার আটপৌরে কাপড়টি

মেঘ হয়ে ঝুলছে আকাশের কিনারে।

                                   

সাদা সে মেঘ দেখতে দেখতে

সজল কৃষ্ণ যেন বা, সে মায়ায়

একলা সে ডাঙা বৃষ্টিতে ভেসে যায়, আর

শীতল নরমে ডুবতে ডুবতে শুনতে পাই

বাবার গলা—

জীবনের একমাত্র সফলতাই হল সজলতার গল্প,

যে গল্পে লাল মাটিতে সবুজের আলপনা।

 

শুনেছি আমার জন্মকালে আমার বাবা  

লাল ডাঙায় বৃষ্টি বুনেছিল!



৩.

ভালবেসে ওকে ছোটেলাল বলে ডাকি

সবে ছয়, ক্লাস ওয়ান এবং অবশ্যই ইংলিশ মিডিয়াম

তবে এখনো বাংলাতেই স্বপ্ন দেখে।

ওর একটা খেলার বাক্স আছে

সেখানে গাড়ি, ছুরি, বন্দুক মজুত রাখে সে যত্নে আর 


আর লুকিয়ে রাখে একটা গোটা আকাশ,

একান্তই নিজস্ব গোপন সম্পত্তি তার।

 

আমাকে ভালোবাসে তো খুব, তাই

মাঝে মাঝে লুকিয়ে তার সেই আকাশে উড়তে দেয় আমাকে,

কেবল আমাকেই, কানে কানে বলেছে–

বড় হলে সেই আকাশের একটুকরো ভাগ সে আমাকে দেবে!

 


৪.

শরতের রোদ  ছুটির মতো বিছিয়ে আছে মাঠে

নীল আকাশে সাদা মেঘখানি আলতো ভেসে গেলে

দস্যি সূর্যটা কী এক খেয়ালে তার আঁচলে মুখ লুকোয়

আর অমনি মাঠজোড়া সবুজ নরমে

ফিস-ফিস, ফিস-ফিস—গল্পেরা বয়ে যায়

সে ইশারায়

     সাবিত্রী সত্যবান

     প্রহলাদ হিরণ্যকশিপু

     হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা

     ধ্রুব আর

     মধুসূদনদাদা তার

আকাশ থেকে ঝরে পড়লে

সাদা মেঘখানি জুড়ে তখন আলোর আলপনা

এমন কহনবেলায় মেঘ ছেনে ফুটে ওঠে চিরন্তনী

আকাশবাসী দিদিমার হাসিটি রাঙা

 

আমার দিদিমার তেল-হলুদ মাখা সাদা শাড়িতে

                                ছুটির গল্পেরা বাস করে

                                                   বারোমাস ।

 

 

৫.

আবদুল চাচা যখনই আসে

কিছু না কিছু নিয়ে আসে

ঝোলা থেকে কখনো বার করে আনে

          এক ফালি জমি

কখনো বা

         এক টুকরো আকাশ

আবার কখনো

         এক আঁজলা জল

মেজাজ শরীফ থাকলে কোনো নিঝুম দিনে

ঝোলা থেকে বার করে উড়িয়ে দেয় আকাশে

         একাকী এক স্বপ্নের নীলকন্ঠ পাখি

একদিন আবার দুববো ঘাসের শুকনো শেকড় হাতে দিয়ে বলেছিল –

         বিছানার নিচে রেখে দিও যত্নে

         সবুজ স্বপ্ন দেখলেও দেখতে পার রাতে

         সবুজ ছাড়া মানবজীবন বৃথা যে বাবা!

 

আর এ সবের বিনিময়ে

সে আমার কাছ থেকে কিনে নেয়

পুরনো অক্ষর, বাসি শব্দ যত।

 

যাওয়ার আগে প্রতিবারই বিড়িতে শেষ সুখটান দিয়ে

আবদুল চাচা হাঁক দেয় অপার্থিব এক সুরে-

         পুরনো বই, খাতা, কা-গ –জ... !