ধারাবাহিক    উপন্যাস  


অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল 




নরকের অন্তরে

কৌ শি ক  দে

।। শেষ পর্ব ।।


বিগত তিন মাসে অঞ্জন প্রায় চার বার ডেকে পাঠিয়েছে হিয়া'কে। সঞ্জীব'দার অফিসে বহুরকম অঙ্গভঙ্গিমার মাধ্যমে সে হিয়া'কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে তার চরিত্র'টি কেমন ভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে হবে। তবে আজ পর্যন্ত বলেনি যে হিয়া'কে তারা নায়িকা হিসেবে নিচ্ছে কিনা। 

এদিকে সেই জাহাজ কোম্পানি জাপানের অর্ডার পায়নি। একের পর এক ক্লাইন্ট তাদের চলে যায় এই তিন মাসের ভিতর। মুখার্জি ম্যানেজার হিয়া'কে ডেকে বলেন, তুমি পারলে কোনো অন্য কাজের জন্য চেষ্টা করো। এখানে মনে হয় আমাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে । হিয়া উত্তর দেয়নি। হাতের জমানো পয়সা'ই এখন ভরসা। তার পক্ষে বৌবাজারের লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব না। তার আগে মৃত্যু অনেক ভালো। এদিকে হিয়া'র বাবা জয়ন্ত'বাবু প্রতি মাসে একটা করে ফিরিস্তি নিয়ে আসে তার কাছে। সেদিন যেমন বললেন, মা, ইচ্ছে করে এই পুজোতে একটা ভালো ধুতি পাঞ্জাবি বানাই। কত দিন হলো ভালো পোশাক কেনা হয়নি। 

হিয়া কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে তার আলমারির তৃতীয় তাকে রাখা একটা ছোট্ট শিশি হাতে নিয়ে দেখে। আবার সেটিকে পুরোনো জায়গায় ঢুকিয়ে রাখে। সে ভাবে, এখনই সময় আসেনি। আর কিছু দিন দেখি। জানালার পাশে একান্তে বসে সে আকাশ দেখতে চায়। তবুও তা দেখা দেয় না। শহরের বাড়িগুলো আড়াল করে রাখে । 

অঞ্জন আজ ডেকেছে হিয়া'কে। তারা বসে আছে কফি হাউসের দোতলায়। চারিদিকে মানুষ। অঞ্জন বলল, তুমি কিছু খাবে ? হিয়া না বলতে পারলো না। সকালে দুটো রুটি পেটে পড়েছে। চাল যা ছিল বাবা'কে রান্না করে দিয়ে এসেছে। হিয়া'র উত্তরের অপেক্ষা না করে অঞ্জন দুটো স্যান্ডউইচ অর্ডার দিলো। মুহূর্তে তা শেষ করে দিলো হিয়া। অঞ্জন বলল, তোমায় দেখলে অসিতের কথা খুব মনে পরে।

হিয়া বলল, ওর কোনো খবর পেলেন ?

নাহ। মনে হয় আর পাবো না। যাইহোক, তোমায় কিছু বিশেষ কথা বলতে আমি ডেকেছি। 

বলুন।

এখানে না। একটু নিরিবিলি চাই। গড়ের মাঠে যাবে ?

হিয়া একটু হিসাত্মক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। সে জানে কেন পুরুষেরা নিরিবিলি চায়। মুখের অভিব্যাক্তি লোকাবার চেষ্টা করে বলল, আমার আপত্তি নেই। চলুন।

ভেবেছিলাম আপত্তি করবে। থাক , আজ আর যাবো না। এখানেই বলি। হিয়া , আমি ভাবছি এই মুভি'টা করবো না।

চমকে উঠে হিয়া বলল, বলেন কি ! 

হ্যাঁ , অনেক ভেবেই সিদ্ধান্তে এলাম। তবে তোমায় আরও কিছু বলার আছে। আমি চাই আমরা বিয়ে করি। তুমি হয়ত জানো না , কিছু টাকা দিয়ে আমায় বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয় তুমিও আমার মতোই একা। আমাদের দুঃখ আমরা শেয়ার করে নিতে পারবো।বুঝতে পারবো। আমি লেখা লেখি করি। আমার দুটি উপন্যাস বাজারে খুব চলছে। বেশ ভালোই পয়সা আসা শুরু হয়েছে। আমি চাই তুমি আমার সাথে এসে আমায় একটু শান্তি দাও যাতে আমি লিখতে পারি আরও।

হো হো করে হেসে উঠলো হিয়া। কাপের কফি শেষ করে বলল, আপনাদের মতন মানুষ'গুলো বেশ সুন্দর কথা বলে অঞ্জন'বাবু। আমার আসল পরিচয় জানতে পারলে এতক্ষন বসে এই মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো বলতেন না হয়ত। তাই সত্যি বলতে , এখন আমার মনে হচ্ছে আপনি হয়ত আমাকে নিয়েও কোনো এক উপন্যাসের পটভূমি ভাবছেন।

তাই কি ? , অঞ্জন বলল, সব খবর তুমি জানো এটা ভাবাটা ঠিক নয় হিয়া। কথা যখন উঠলই তাহলে শোনো, প্রতিম বাবুর সাথে আমার দুবছর আগে থেকে পরিচয়। ওই অফিসে কি কি হয় আমার সব জানা। এমন'কি গেস্ট সাটিস্ফেকশন'এর জন্য যে তুমি আছো সেটাও আমি জানতাম। একদিন মুখার্জি ম্যানেজারের অফিসে আমি তোমায় দেখেছিলাম। তারপর তুমি যখন অডিশন দিতে এলে আমি তোমায় প্রথমেই চিনতে পেরেছিলাম। বিগত তিন মাস তোমার সাথে বারে বারে কথা বলে আমি এতটুকু অন্তত বুঝেছি তুমি খারাপ মেয়ে নও। হয়ত পেটের জ্বালায় তোমাকে ওই পথ বেছে নিতে হয়েছিল। ক্ষতি নেই। চলো আমরা আজ থেকে একটা নতুন জীবন শুরু করি।

কফি হাউসের কোলাহল যেন আর কানে আসছে না হিয়া'র। সে কি বলবে ভেবে পেলো না। অঞ্জন নিজের হাত তার হাতের উপর রাখলো। হিয়া তাকালো আকাশের দিকে। অদ্ভুদ ! আজ কফি হাউজের দেওয়াল ভেঙে সে মুক্ত আকাশ দেখতে পেলো।


                                           ( আঠেরো )


উপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী একা !

তার স্ত্রী গত হয়েছেন চার বছর হলো। নিজের একমাত্র ছেলে বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই এক পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর তার বউমা'কে সে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করে। আর সেই স্নেহ আরও দৃঢ় হয় যখন মেয়ের বাড়ির লোক তাকে নিতে আসে। সেদিন তার বউমা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এক পুত্রহারা পিতাকে আমি ছেড়ে যেতে পারবো না। উনি আমার শ্বশুর ছিলেন। এখন আমার পিতা। 

এই ঘটনার পর মুখ নামিয়ে ফিরে গেছিলো মেয়ের বাড়ির লোক। আর উপেন্দ্রনাথ চোখের জল ফেলতে ফেলতে বুকে তুলে নিয়েছিল তার পরম প্রিয় আদরের বৌমাকে নিজের মেয়ে হিসেবে।

উপেন্দ্রনাথ ঠিক করেছিলেন তার মেয়ের আবার বিয়ে দেবেন। কিন্তু কিভাবে ! এই ভেবেই তিনি চিন্তিত ছিলেন। একেই বিধবা তার উপর আজকের দিলে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যথেষ্ট দুস্কর।

সেদিক থেকে এই বাড়িতে অসিত নামের ছেলেটি আসার পর থেকেই তার ভাবনা দূর হতে থাকে। ছেলেটা কোথা থেকে এলো তা তিনি জানেন না। আর এই নিয়ে তার স্নেহের মেয়েকে কোনো প্রশ্নও করেননি। তবে লক্ষ্য করেছেন দিনের পর দিন তার মেয়ে কিভাবে যত্ন নিয়েছে অসিতের। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে ছেলেটি পাগল নয়। তার স্মৃতিভ্রন্স হয়েছে। অসিত'কে তাই তিনি বাড়ির লোক হিসেবেই আপন করে নিয়েছেন।


                                        ( উনিশ )


এদিকে তিন বছর কেটে গেল।

অঞ্জন আজ খুব হন্তদন্ত হয়ে চলেছে রবীন্দ্রসদনের দিকে। রাস্তায় তার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। তাই হেঁটেই যাচ্ছে। পিছনে তার স্ত্রী। যার কোলে তাদের একমাত্র কন্যাসন্তান। নাম রুপা।

রবীন্দ্রসদনের গেটের সামনে পৌঁছে হাত ঘড়ি দেখলো অঞ্জন। বলল, যাক ঠিক সময় পৌঁছেছি। খুব চিন্তায় ছিলাম।

পিছনে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রী বলল, কত করে বললাম বাসে ওঠো। কারোর কথা শুনবে না তুমি। 

আরে ঠিক আছে । পৌঁছে তো গেছি। আচ্ছা শোনো আমায় যখন পুরস্কার দেওয়া হবে তুমি রুপা'কে দেখিও।

রুপা সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারের কি বুঝবে শুনি! এক বছরের মেয়ে।

তা হোক। তাও তুমি দেখিও। ও যখন বড় হবে আমি তখন বোঝাবো ওকে এই পুরস্কারের গুরুত্ব কতখানি।

সে দেবো। একটু এদিকে এসো তো - বলেই নিজের আঁচল দিয়ে অঞ্জনের মাথার ঘাম মুছে দিলো তার স্ত্রী। মাথার চুলটা হাত দিয়ে ঠিক করে বলল, এবার চলো। আমি পিছনেই আছি।

অঞ্জন বলল, পিছনে নয় , একসাথেই যাবো। তুমি না থাকলে আমি যে কি করতাম হিয়া !


মুখার্জি ম্যানেজার দেশের বাড়ি ফিরে গেছেন। কারণ জাহাজ কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তিনি নিজের জমানো পয়সা দিয়ে রিয়েল স্টেটের ব্যবসা শুরু করেছেন। 

হাতে সময় পেলেই তিনি সামনের মানুষদের দালালি ব্যাবসার উপকারিতা ও গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। যার ফলে তিনি এখন বেশ কিছু মানুষের কাছে একজন জ্ঞানী পুরুষ। যদিও তার ইংরেজি এখনো আগের পর্যায়েই রয়েছে।

নিজে বিয়ে করেননি। তাই কোনো পিছু টান নেই। হঠাৎ করে একদিন তিনি সিগারেট'টাও ছেড়ে দিয়েছেন। কিভাবে ছাড়লেন সেই নিয়ে একটি বই লিখছেন বর্তমানে।


এসবের মধ্যে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ফটিক চন্দ্র। 

তিনি এখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছেন। পাগলাগারদ থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় সেই সুপার মহিলা তার ফাইলের উপর লিখেন, ডিউলি ফিট। রেডি টু গো আট হোম। লিখেই মনে মনে বিজ বিজ করে বলতে থাকেন, অদ্ভুদ ! এই উন্মাদ'টা ঠিক হলো কিভাবে !

ফটিকবাবুকে বাড়িতে ফিরতে দেখেই মালতিদেবী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই ক'টা বছর তার খুব কষ্টের গেছে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে পেট চালিয়েছেন। ফটিকবাবু শপথ নেন, মালতি'র সব কষ্ট দূর করে দেবেন। তাকে কাজ করতে দেবেন না। আর তাই তিনি নিজে পাড়ার এক রেশন দোকানে হিসেব লেখার কাজে যুক্ত হন।

তারমধ্যে একদিন বাড়ির পুরোনো জিনিস ঝারপোচ করতে গিয়ে মালতি দেবীর হাতে আসে একটি দলিল। যাতে লেখা ছিল , অসিতের অবর্তমানে এই বাড়ির সব দায়িত্ব মালতি দেবীর।

ফটিক'বাবু সেই দলিল নিয়ে ছোটেন আদালতে। অনেক ভেবেচিন্তে আদালত নির্দেশ দেয়, যেহেতু অসিত'কে খুঁজে পাওয়া পাচ্ছে না তাই তার বাড়ির রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব মালতি দেবীর। সাথে সাথে অসিত'কে খুঁজে বের করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন।

ফটিকবাবু সেই বাড়ি প্রোমোটার'কে দিয়ে দেন। শর্ত হিসেবে তিনটে ঘর পেয়েছেন। যার দুটি ভাড়া দিয়েছেন। কর্তা গিন্নির এখন টাকা'র টান নেই। ফটিকচন্দ্র মাঝে মাঝেই একটি করে পাঞ্জাবি বানিয়ে আনেন। যদিও সবার অলক্ষে মালতি দেবীর বুক'টা হু হু করে অসিতের জন্য। নির্জনে তিনি মাঝে মাঝে চোখ ঝাপসা করেন এই কারণে।


সবশেষে আজ ১৬ই অগ্রহায়ণ

উপেন্দ্রনাথে'র রাজবাড়ি সেজে উঠেছে আলোর রোশনাই আর ফুলের সুগন্ধে। পুরো গ্রাম আজ নিমন্ত্রিত। উপেন্দ্রনাথের আজ দম ফেলার সময় নেই। নিজে হাতে সব কাজের তদারকি করছেন। আজ তার মেয়ের বিয়ে। পাত্র অসিত চন্দ্র।

বিয়ের প্রথা শেষ হওয়ার পর বর কনে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। উপেন্দ্রনাথ অসিতের হাতে তুলে দিলো একটি কাগজ। অসিত কিছু বুঝে না পেয়ে বলল, এটা কি ? উপেন্দ্রনাথ কিছু বলল না। সামান্য হেসে জড়িয়ে ধরলো তাকে। আর বাসর ঘরের দিকে পথ দেখালো।

রাত প্রায় দুটো। অসিত আর রিনা বসে আছে তাদের বাসর ঘরে। সারা ঘরে আলো বলতে দুটো প্রদীপ। অসিতের হাতে একটা কাগজ ।যেটা পড়া শেষ করে সে বলল, দেখেছ কান্ড, তোমার বাবা আমায় তার স্টেটের অর্ধেকটাই দিয়ে দিয়েছেন।

রিনা বলল, বেশ করেছে। তোমায় দেবে না তো কাকে দেবে ?

আমি তো এসবের কিছুই চাইনি রিনা । যাইহোক, তোমায় একটা কথা বলবো ভেবেছিলাম , সেটাই বলি। আচ্ছা , সবাই তো তোমায় এত কিছু উপহার দিলো। আমি তো কিছুই দিতে পারলাম না। তোমার এতে দুঃখ নেই তো ?

কে বলেছে তুমি কিছু দাওনি। তুমি আমায় চাইলে এখনো দিতে পারো।

কি চাও বলো?

তোমার একটা কবিতা আমায় দাও।তোমার মনে নেই হয়ত তুমি এককালে খুব সুন্দর কবিতা লিখতে।

ও, তাই জন্যই । জানো রিনা, তাই জন্যই আমার মাথায় দুটো লাইন ঘোরে। কিছুতেই শেষ করতে পারিনা । ওই দু'লাইনেই আটকে যায়।

আজ শেষ করো। 

অসিত বলা শুরু করলো ,


এসো , পুরোনো অতীত , বুকেতে যন্ত্রনা লুকিয়ে

আজ ভরাবো জোৎস্না'মাখা শহরের প্রান্তর হতে।

যেখানে যা কিছু হারিয়ে এসো,

নতুন জীবনের নগর গড়তে।


স মা প্ত