গল্প  


অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল 


অ নি মে ষ  গু প্ত

চিঠি


মানিনী,

তোমার সঙ্গে কয়েকদিনের মেলামেশার মধ্যেই সুফি-বাউলদের জীবন আর ধর্ম সম্বন্ধে সম্বন্ধে তোমার আগ্রহের কথা বুঝতে পেরেছিলাম। তোমাকে আগেই বলেছিলাম প্রেমই তাদের একমাত্র পথ। বাস্তবের প্রেমিক বা প্রেমিকার জন্য যে আকুলতা, চরম কাম ও প্রেমের অভিজ্ঞতাকে তারা ঈশ্বরপ্রেমের সঙ্গে মিশিয়ে চায়। এটাই তাদের স্বাভাবিকতা, তাদের সাধনা। এসব বিষয়ে তোমার আকর্ষণ যে শেষে তোমাকে এত ভাবালুতার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে এমনটা ভাবিনি আমি। গতরাতে তোমার আবেগ, তোমার ইচ্ছে সব তুমি যেভাবে প্রকাশ করেছ তা এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাকে।

 

তুমি সরল এবং সুন্দর। যে কেউই তার স্বাভাবিক অবস্থায় তোমার ওপর টান বা আকর্ষণ অনুভব করতে পারে কিন্তু আমার দিক থেকে কিছু কথা তবুও থেকে যায়, যা মুখে বলে বোঝানো কঠিন। তাই এই চিঠি…  

 

শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভাল। হয়ত ইতিমধ্যে তুমি আমার আচার, ব্যবহারে নিজেই কিছুটা আভাসও পেয়ে থাকতে পারো যে আমার ভাব-ভাবনা অন্যদের চেয়ে কিছুটা হলেও আলাদা। বাস্তব জীবনের প্রেমে পড়া মানুষ যা চায় তা হয়ত আমার মধ্যে নেই। স্বাভাবিক অর্থে সফল মানুষদের মধ্যে আমাকে গোণা যাবে না। বস্তু-সর্বস্ব কংক্রিট জীবনধারায় আমি বেমানান। আউল-বাউলদের সঙ্গে মিশি, নেশা-ভাঙ করি, মাঠে ঘাটে গান গেয়ে বেড়াই অচেনা অধর মানুষের খোঁজে, কাম ছেঁচা প্রেমের খোঁজে। এছাড়া একটু আধটু লেখালিখি করি। এর মানে এই নয় যে মানুষের তৈরি করা সম্পর্কগুলোর ওপর আমার আস্থা ভরসা নেই বা কোন বাসনা, ইচ্ছে-অনিচ্ছে নেই। মানুষ হয়ে জন্মেছি যখন, কাম বাসনা এসব সময়ে অসময়ে ভালোমতই আস্তানা খুঁজে নেয় আমার মধ্যে। তফাৎ  শুধু এইখানে যে দৈহিক হোক বা স্বয়ং-সম্ভুত, আমি এক শেষ না হওয়া প্রেমের কথায় বিশ্বাস করি যা বয়েই যায়। বাধাহীন, নিরন্তর।   

 

তুমি বয়সে আর অভিজ্ঞতায় আমার চেয়ে অনেক ছোট তবু সরল মনে আমাকে ঘিরে গড়ে ওঠা তোমার ভালোবাসার যে কথা আমায় জানিয়েছ, আমি সেই সরলতাকে সন্মান জানাই, ‘জয়গুরু বলি’। আমার লেখা একটি কবিতা এই চিঠিতে তোমার কাছে পাঠালাম আমার কথা পরিস্কার করে তোমায় জানাতে। আশা করি এর মধ্যে তুমি আমার কথাগুলো ঠিকমত বুঝতে পারবে।

 

আমি জানি পৃথিবীর ভালবাসা

নদীর মত— মিশে যায়, পূর্ণ হয়

বৃষ্টি হয়ে ঝরে…

এক অলৌকিক আশীর্বাদের হাত

 

আমি সেই নদীর মতই ভালবাসি 

যে তার দুটি ধারে

বৃক্ষরাজি, ফুল-শস্য পালে।

জানে কখন মন্থরতা, কখন বা গতি প্রয়োজন

 

যেন এক আদিম প্রপাতের

জলধারা, যে জানে… সে কোন স্রোতে বয়

স্তরে স্তরে কী শৈলীতে   

মাটির গর্ভে ফল্গু বয়ে যায়   

 

বাৎসল্য মোহ কিংবা

তীব্র কোন আকর্ষণ নয়

ঐশ্বরিকও কেউ বলেনি তাকে  

 

সে নিজে জানেনা কোন অনাদিকাল

থেকে সে কেমন নিশব্দে বয়

 

মানিনী, ভালো থেকো, আনন্দে থেকো…

ইতি

‘আমার খেপা ’

(যে নামে আমায় তুমি ডাকতে ভালোবাসো)




অলংকরণ : চন্দন কুন্ডু 


 আ ই জা ক  সা হা

 ফায়ার


নি নিয়ে তিনজন ডাক্তার দেখানো হল।

- কতদিন ধরে এসব ?  

- আজ্ঞে প্রায় আট ন'মাস। 

এই ডাক্তারবাবুর কথা শুনেছে মেজবৌদির পিসতুতো দাদার কাছে। খুবই নাকি ভাল ডাক্তার। গত চারমাসে জনা দুয়েক ডাক্তার দেখিয়েছে পিকলুকে। কত ওষুধ, কত নিদান। কোনো লাভ হয় নি। এবারও যে কিছু হবে সে আশা সে করে না। তবু একটা চেষ্টা করতে দোষ কি !  

প্রথম চোখে পড়েছিল পিকলুর মায়ের। দশ টাকার লাইটারটা রান্নাঘরে রাখা থাকে। সেটা খুঁজে পাচ্ছিলো না। অনেক খুঁজে পেতে মিলল পিকলুর কাছে। ছাদে বসে একগাদা কাগজ, ফেলে রাখা হাবিজাবিতে আগুন লাগিয়ে সে দিকে একমনে তাকিয়ে ছিল।

- আগুন জ্বালানোই ওর নেশা ডাক্তার বাবু। কিছু পেলেই ছাতে নিয়ে জড়ো করে। আগুন জ্বালায়। কী মজা পায় কে জানে।

-কি অর্ণববাবু ! এসব সত্যি ? 

পিকলু উত্তর করে না।

 একুশ বছরের ছেলে। কলেজে যায়। বন্ধুবান্ধব, পড়াশোনা করে। ফেসবুক,হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব,ফুটবল,ক্রিকেট,আড্ডা সবই ছিল। যেমনটা হয় আর কি। আর দশজনের মত। আট ন মাস ধরে এইরকম। প্রথম প্রথম গুম ধরে নিজের ঘরে বসে থাকত। টিভি দেখা নেই। মোবাইল ঘাঁটছে না। চুপচাপ। বসে থেকে থেকে অবশেষে ঘুম। মাধবী ব্যাপারটা লক্ষ্য ক'রে রমেনকে বলে। রমেনের সাথে পিকলুর মেলামেশা কম। যা কিছু মাধবীর সাথেই। তবে মাঝেমধ্যে রাজনীতি নিয়ে কথা বলে রমেনের সাথে। এ বিষয়ে সে রমেনের মত একটু বাঁদিকে হেলে। কলেজেও বাঁমঘেষা ছাত্র সংগঠন করে।

-আচ্ছা, আমি আপনাদের তিনজনের সাথেই একটু আলাদা করে কথা বলব। প্রথমে ম্যাডামের সাথে,তারপর আপনি আর সবশেষে অর্ণবের সাথে।

পিকলুর সাথে কারো প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল কিনা, বন্ধুবান্ধবদের সাথে কিছু ঘটেছে কিনা এরকম হাজারো প্রশ্ন যাতে নেশা যৌনতা কিছুই বাদ দিলেন না ডাক্তারবাবু। সবশেষে পিকলু তারপর আবার তিনজন। সবশেষে পরের সোমবার আবার শুধু পিকলুর সাথে সেশন করবেন বলে বিদায় দিলেন। 

রমেন জানত এমনটাই হবে। তবে ডাক্তারটা অন্যরকম। ওষুধ দিল না কিছু। খুঁটিয়ে এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছিল যা অন্য ডাক্তাররা করেই নি। সেসব রমেন কিছুটা বুঝলেও মাধবী নাকি কিছু বোঝে নি। পিকলুকে তিনি কী জিগ্যেস করেছিলেন তা রমেন জানেনা। পিকলুর কাছে জানতে চেয়েছিল রমেন। পিকলু উত্তর দেয়নি। তবে ডাক্তারবাবু পিকলুর পছন্দগুলি মানে প্যাশনটা জানতে চেয়েছিল। কথায় কথায় উনি একটা কথাতে এসে বেশিক্ষণ আটকে গেলেন কেন সেকথা রমেন বোঝেনি। গত ফেব্রুয়ারীতে দিল্লীর দাঙ্গার ঘটনার পরে পিকলু যে ছাত্র সংগঠনের  মিছিলে অংশ নিয়েছিল তা নিয়ে এতক্ষণ আটকে রইলেন তা বোঝেনি রমেন। হ্যা, মোটামুটি বলা যায় পিকলুর এমন অবস্থা মোটামুটি ওইরকম ফেব্রুয়ারীর দাঙ্গার ঘটনার পর থেকেই ঘটেছিল কিন্তু তার সঙ্গে পিকলুর এইরকম অবস্থার কি সম্পর্ক থাকতে পারে যে ডাক্তারবাবু অত জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন এসব মাথায় ঢোকেনি রমেনের।

ফের সোমবার আবার ডাক্তারের চেম্বারে তিনজন। পিকলুর সাথে সেসন শেষ।

- হ্যা, আপনার নাম কি যেন ? 

-রমেন। রমেন ভট্টাচার্য।

- হ্যা। রমেনবাবু। দেখুন একটি দুটি সিটিংএ সাধারণত কিছু করা যায় না। তবে অর্ণবের কেসটায় আর দুটো সিটিং এর জন্য ওকে আসতে হবে। আপনাদের আসতে হবে না। আপনারা নির্দ্বিধায় ওকে একা ছাড়তে পারেন। অর্ণব খুব চমৎকার ছেলে। খুবই সেন্সিটিভ। আজ ওর সাথে চল্লিশ মিনিটের সিটিংএ আমি খুশি।

- তাহলে ডাক্তারবাবু এরকম করছে কেন।  

- সেটা বলবার জন্যেই আপনাদের তিনজনকেই একসাথে ডেকেছি। রমেনবাবু, অর্ণব রাজনীতির ধারণাটা পেয়েছিল আপনার কাছ থেকে। নিজে সেই রাজনীতির মধ্যে ঢুকে ওর নিজের ভেতরের মানবিক গুণগুলির একটি সামগ্রিক ভঙ্গিমা গড়ে উঠেছিল। সেটাই ওর ব্যক্তিত্ব। সেই ব্যক্তিত্বটাকে আপনি চিনতে পারেন নি। 

- না ডাক্তারবাবু, সেরকম তো কিছু নয়। হ্যা, ও কলেজে রাজনীতি করত, কিন্তু সে নিয়ে তো..

- করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে দিল্লির দাঙ্গার পর আপনি ওকে প্রতিবাদের মিছিলগুলিতে যাওয়া থেকে আটকেছেন।  

- আমি ? রমেন পিকলুর দিকে তাকায়। পিকলু চোখেমুখে এক তীব্র বিষাদ আর বিরক্তির চাউনি।

- হ্যা। সে তো ওর ভালর জন্যই। ওদের কলেজের মিছিলে পাথর টাথর পড়ে সে কি এক কাণ্ড। যেখানেই প্রতিবাদী মিছিল হচ্ছে সেখানেই গণ্ডগোল,র্সংঘর্ষ, ইটপাটকেল,বোমা। তাই যেতে দিই নি। তাছাড়া দিনকাল খারাপ। আপনি তো জানেনই সব। সেসবে যাওয়ার দরকারই বা কি ! 

- হ্যা। সেটাই ও মেনে নিতে পারে নি। সেসময়ের দাঙ্গাটা ওর মনে খুব প্রভাব তৈরি করেছিল। কিছু করবার জন্য ফেটে পড়তে চাইছিল। মিছিলে কিংবা ত্রান সংগ্রহে যোগ দিতে চাইছিল। তার এই সামাজিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটাকে আপনি দমন করে রেখেছিলেন। 

রমেন থম মেরে যায়।

 - ও যে আগুন জ্বালাচ্ছে, সেটা দমিত মনের বহিঃপ্রকাশ। মনের এই চাপা কষ্ট,রাগ,অভিমান ক্ষোভ এইভাবে বেরিয়ে আসাকে বলে অ্যাব্রিঅ্যাকশন। যে ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে ও যাচ্ছে তা হল অ্যাজিটেটিভ ডিপ্রেশন।  ও যে কষ্টটা পাচ্ছে তা এই আগুন জ্বালাবার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করছে। এইসব রোগী নিজেও জানে এগুলি কোনো সমাধান নয়। অনেক সময় পরামর্শ ছাড়া বা সামান্য পরামর্শে সুস্থ হয়ে যায়। এই অ্যাব্রিঅ্যাকশনটা করে তার কষ্টের, যন্ত্রণার স্বীকৃতিটুকু পেতে। আপনারা আসুন। আমি কোন ওষুধ লিখছি না। সামনের সোমবার ওকে পাঠান। 

রমেন চুপ করে থাকে। তার বলবার ভাষা নেই। পিকলুর দিকে তাকায়। একটা বিধ্বস্ত আর উদাসীনতার মুখ দেখে সে পিকলুর মুখে । পিকলুর হাত ধরে। এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয় পিকলু। চেম্বারকে ফালাফালা করে চেঁচিয়ে ওঠে, ফায়ার ! ফায়ার ! প্রতিটি বুকে আমায় আগুন জ্বালতে হবে। ফায়ার! ফায়ার!




অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল 


প্র দী প  সে ন গু প্ত

খনন


খুব চেনা মনে হচ্ছিল প্রিয়তোষের, একদম সেই মুখ -- সেই কথা বলার ধরণ। শুধু গলার কাছে লালচে তিলটা দেখতে পেলে নিশ্চিত হতে পারত, কিন্তু হালকা একটা মাফলারে গলাটা ঢাকা - যদি সরাতো! বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।

' এ' বার বেশ গরম লাগছে ' বলে তিনি সরিয়ে নিলেন মাফলারটা আর তখনই প্রিয়তোষ নিশ্চিত হল -- ও মালবিকা। পাশে একটা অল্প বয়সী ছেলে, হয়ত ছেলেই হবে। প্রিয়তোষ এবার সাহস করে উঠে এল,

-- একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?

ওরা দু'জনেই তাকাল,  ভদ্রমহিলা বললেন,

- হ্যাঁ, বলুন না।

-- আপনি কি মালবিকা?

একরাশ বিস্ময়ে ঢেকে গেল মহিলার মুখ,

-- হ্যাঁ, আমি মালবিকা -- কিন্তু --

-- আমি প্রিয়তোষ -- সাউথ সাবার্বান স্কুল, আপনি ত' বেলতলা গার্লস ?

-- সিক্সটি ফোরের ব্যাচ ? তার মানে তুমি প্রিয়তোষ রায় ?

-- যাক, চেনা গেল তা'হলে ! কতদিন পর দেখা হল বল ত' !

-- তুমি পরিচয় না দিলে আমি ত' চিনতেই পারতাম না , কিন্তু তুমি কি করে চিনলে ?

-- একটু চেনা লাগছিল, পরে তোমার তিলটা আমাকে নিশ্চিত করল। তা' এখানে?  দিল্লী থাকো না কি ?

-- মেয়ের বাড়ি এসেছিলাম, এ' আমার জামাই সুপ্রতিম - সি অফ করতে এসেছে। বুঝলে সুপ্রতিম, এ' হল আমার ব্যাচমেট প্রিয়তোষ -- আমরা এক কোচিং এ টিউশন নিতাম, ইংরাজী।

সুপ্রতিম উঠে প্রণাম করল। বলল,

-- আপনি এখানে বসুন।

মালবিকা অনেক সহজ হয়ে এসেছে, বলল -

-- তুমি এখানে ? 

-- ঋজুকে মনে আছে?

-- ভালো ক্রিকেট খেলত?

-- হ্যাঁ, ও আসছে -- ওকে রিসিভ করতেই এসেছি।

-- ঋজু হঠাৎ আসছে!

-- ও দিল্লীতে একটা বাড়ি কিনতে চাইছে। ব্যবসার কাজে লাগবে।  আমি একটা বাড়ির খোঁজ পেয়েছি - সেটা দেখতেই আসছে। ফ্লাইট দু' ঘন্টা কুয়াশার জন্য লেট, আমি ত' আগেই এসে পরেছি। তোমার ফ্লাইট কটায়?

-- দশটা দশে। একটু পরেই ঢুকে যাব,  ভিতরেও ত' একটু সময় লাগবে।  অনেকক্ষণ এসেছি, বাইরে কফি শপেই সময় কাটাচ্ছিলাম,  না হ'লে ত' দেখাই হত না। তা'ঋজুর ফ্লাইট কটায় পৌঁছাবে?

-- এক্সপেক্টেড টাইম দশটা চল্লিশ।

-- তুমি তা'হলে পুরোণো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রেখেছ দেখছি। ইস্, ঋজুর সাথে একটুর জন্য দেখা হবে না!

-- শুধু ঋজুর সাথেই যোগাযোগটা আছে।

-- তুমি কি এখানেই থাকো ?

-- আমি এখানে সেটেলড -- প্রায় তিরিশ বছর। তুমি?  কলকাতাতেই আছ ?

-- কোথায় যাব আর !  একাই থাকি।

এতক্ষণ পর প্রিয়তোষ খেয়াল করল মালবিকার সিঁথি একদম সাদা। মালবিকা বুঝতে পারল - বলল,

' উনি ত' প্রায় পাঁচ বছর হল চলে গেছেন। মেয়ে জামাই ত' বারবার বলছে ওদের কাছে চলে আসতে।

সুপ্রতিম বলল,

-- ওখানে একা একা থাকার কোন মানে হয়,  বলুন ত' ? কখন কি প্রয়োজন -- শরীরও ত' খারাপ হতে পারে হঠাৎ।

প্রিয়তোষের মনের মধ্যে একটা অকারণ ইচ্ছা পাক দিয়ে গেল,

-- ঠিকই ত' বলছে ওরা। তোমার কিন্তু ওদের কাছেই চলে আসা উচিৎ।

মালবিকার চোখে হালকা একটা হাসি ভেসে উঠল,

বলল,

-- ওদের প্রায় সারাদিনই অফিস, আমি সারাদিন একা একা কি করব বলত ? কোলকাতায় কত পরিচিত লোকজন !  সে' সব কথা পরে হবে, তোমার কথা বল -- তোমার সংসারের গল্প শুনি।

-- সংসার করা হয়ে ওঠে নি আমার।

মালবিকা চমকে ওঠে,

-- ও মা!  সে কি!

প্রিয়তোষ গম্ভীর হয়ে ওঠে,

-- বাবা আর মা - দুজনেই একমাসের মধ্যেই মারা গেছিলেন, দিদি এই ঘটনায় খুব আপসেট হয়ে পরেছিল। তারপর থেকেই দিদির নার্ভের একটা সমস্যা দেখা দিল। আমি ইতিমধ্যে চাকরি পেয়ে দিল্লী চলে এলাম দিদিকে নিয়ে। অনেক রকম চিকিৎসা করিয়েছি। শেষের দিকে দিদি একদম ছেলেমানুষের মত হয়ে গেছিল।  দিদি চলে যাবার পর আমি বুঝতে পারলাম, ততদিনে আমি অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি -- আর সংসার করার কোন মানেই হয় না।

সুপ্রতিম বলল,

-- এবার মা কে এগিয়ে দিয়ে আসি কাকু, না হলে দেরি হয়ে যাবে।

প্রিয়তোষের ইচ্ছা হচ্ছিল মালবিকা আরো কিছুক্ষণ থাকুক,  কিন্তু এখন ত' ওকে যেতেই হবে। প্রিয়তোষ বলল,

-- তোমার কাছে দুটো জিনিস চাইব মালবিকা?

-- হ্যাঁ, বলনা!

-- তোমার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা। মাঝে মাঝে ত' কোলকাতায় যাই, দেখা ত' করতেই পারি।

মালবিকা হ্যান্ডব্যাগটা খুলে একটা ছোট প্যাড বার করে একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে সুপ্রতিমের হাতে দিয়ে বলল,

-- আমার ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা ও কে লিখে দাও।

মালবিকাকে ভিতরে এগিয়ে দিয়ে সুপ্রতিম প্রিয়তোষের সামনে এল -- বলল,

-- কাকু, আপনাকে ত' বসতে হবে আরো কিছুক্ষণ, আমি কি থাকব আপনার সাথে ?

প্রিয়তোষ সুপ্রতিমের পিঠে হাত রেখে বলল,

-- তোমার এত বিব্রত হবার কোন কারণ নেই, আমার সাথে খবরের কাগজ আছে -- পড়াই হয় নি। কোন অসুবিধা হবে না।

সুপ্রতিম চলে যাবার পর কাগজ না খুলে মালবিকার কথাই ভাবতে লাগল। ও কে বেশ ভালো লাগত প্রিয়তোষের। সেই ভালোলাগার কথা দু'একবার বলতে গিয়েও বলতে পারে নি ও। শেষে ঋজুই ওকে সাহস দিল, বলল,

-- কথা না বলতে পারলে একটা চিঠি দে।

পরদিন কোচিং ক্লাসে মালবিকাকে প্রিয়তোষ ইতঃস্তত করে বলল,

-- একটা জিনিস দেব, নিতে হবে কিন্তু !

এই বলে একটা চিঠি ওর দিকে এগিয়ে দিল। মালবিকা নির্লিপ্ত ভাবে চিঠিটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

-- এবার যেতে পারি ত'?

এরপর দু'দিন পার করে মালবিকা সবার সামনেই একটা খাম এগিয়ে বলল,

-- এই নাও ধর, আমার আজ তাড়া আছে -- দিদিরা এসেছে।

মালবিকা দ্রুত চলে যায়। এরপর প্রিয়তোষ ওখানে দাঁড়ায় না।

কোচিং ক্লাস থেকে বাড়ি ফিরে প্রিয়তোষ খাম খুলে দেখে ওর চিঠিটাই ফেরৎ পাঠিয়েছে মালবিকা, তবে লাল কালিতে অনেক কিছু লেখা, কিছু জায়গায় লাইনের নিচে দাগ দেওয়া। লিখিত বিষয় ছিল,

' তোমার ' র ' এবং ' ড় ' এর ব্যবহার সঠিক নয়। সামনেই ফাইনাল, বানানে নজর দিতে হবে।  তিনটে বানান ভুলে এক নম্বর কাটা যায় -- জান না ? ভুল গুলো দেখিয়ে দিলাম, শুধরে নিও।

দিল্লীর কাজ সেরে ঋজু চলে যাবার দিন সি অফ করতে এসেছিল প্রিয়তোষ। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফিরে এসে ঠিক করল মালবিকাকে চিঠি লিখে জানতে চাইবে একটা কথা৷ -- কারণ ফোনে সে ' কথা জিজ্ঞাসা করা যায় না। ওকে জানতেই হবে মালবিকার মনে ওকে নিয়ে কোন ভাবনা ছিল কি না!

প্রিয়তোষ এবার সরাসরি চিঠিতে জানাল -- যদিও এখন আর  নতুন কোন ইচ্ছা প্রকাশের সময় আর নেই তবুও একটা উত্তর পেতে ইচ্ছে করছে ওর।

চিঠিটা বেশ দীর্ঘই হ'ল।

দিন দশেক পরে একটা খাম এল প্রিয়তোষের নামে, প্রেরক মালবিকা। খামটা খুলে প্রিয়তোষ দেখল, আগের মতই ওর চিঠিটাই ফিরে এসেছে,  লাল কালিতে দাগ কাটা বিভিন্ন জায়গায় এবং সবশেষে লেখা --

' হায়ার সেকেন্ডারীতে বোর্ডে ইংরাজীতে রেকর্ড মার্কস পেয়েছিলে জানি আর বাংলায় আমার চিন্তা সঠিক প্রমাণ করে বাজে নম্বর পেয়েছিলে। এখনও তোমার বানানের কিছুমাত্র উন্নতি হয় নি, একই রকম ভুল। যদিও এখন বানান ভুল হলে তোমার কিছু এসে যায় না,  আমার কিন্তু এখনো। ভুল বানান মোটেও সহ্য হয় না।  আবার শুধরে দিলাম। '

প্রিয়তোষের বুকের ভিতর একটা মিষ্টি হাওয়া পাক দিয়ে গেল।