প্রবাসী কলম
![]() |
অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল |
বু মা ব্যা না র্জী দা স
( কানাডা )
গল্পের খোঁজে
বিশাল অডিটরিয়াম মুখর হয়ে উঠলো তুমুল করতালিতে। নীহারিকা সান্যালের সাহিত্যিক জীবনের আজ কুড়ি বছর পূর্ণ হল। এত অল্প বয়সে শিশু কিশোর সাহিত্যে এত খ্যাতি অর্জন করতে খুব কম সাহিত্যিকই পেরেছেন। মাস ছয়েক আগেই কিশোর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে মধ্য চল্লিশের নীহারিকা। আজ ভারী মনোজ্ঞ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে উদ্যোক্তারা তাদের প্রিয় সাহিত্যিকের কুড়ি বছরের সাহিত্যিক জীবন পূর্ণ হওয়া স্মরণীয় করে রাখল। তার খুব পছন্দের একরাশ রজনীগন্ধা তার হাতে তুলে দিয়ে আর এক খ্যাতনামা প্রবীণ সাহিত্যিক বললেন - কিশোরমনকে নীহারিকা যতটা চেনে, বোঝে, সেভাবে বোধহয় আর কেউ বোঝেনা। কল্পবিজ্ঞান, রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার সব রাস্তাতেই তার স্বচ্ছন্দ গতি। আজ এত বছর ধরে কিশোর কিশোরীদের মুগ্ধ করে রেখেছে নীহারিকা।
সাদা জমির উপর সোনালী পাড় আর সোনালী বুটিদার দক্ষিণী শাড়ি পরা স্নিগ্ধ নীহারিকা মঞ্চে উঠে এলে করতালিতে সত্যি ফেটে পড়েছিল হলঘর। শুধু ছোটরাই নয়, বড়রা পর্যন্ত তার লেখা পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। এমনও হয়েছে নতুন লেখা বেরোনোর সাত দিনের মধ্যে দ্বিতীয় এডিশন ছাপতে হয়েছে।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষের পথে। কী যে হয়েছে কিছুদিন ধরে নীহারিকার, বড়ো ক্লান্ত লাগে মাঝে মাঝে। ছোটরা তার চিরকালের বন্ধু, এমনকি বড়দের তুলনায় তাদের সঙ্গে কথা বলতে, মিশে যেতে সহজ লাগে নীহারিকার। কিন্তু আজ যেন আর ভালো লাগছেনা কিছু। কোনরকমে নিজের বক্তব্যটুকু রেখে নেমেই যাচ্ছিল সে, ঘোষক ছেলেটি বিনীতভাবে আটকায় তাকে।
- ম্যাডাম প্রত্যেকবার যে বক্তৃতার পর বাচ্চাদের সাথে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব রাখেন ?
- ওহ্ তাই তো। - মনে মনে জিভ কাটে নীহারিকা। মস্ত ভুল হয়ে যাচ্ছিল। বাচ্ছারা যে অপেক্ষা করে এটার জন্য। আর কত বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে তারা। শুনে অবাক লাগে তার। কত কিছু শেখাও যায় তাদের কাছ থেকে।
প্রায় রাত ন'টা বাজলো সব মিটতে। মানপত্র, ফুল আরো নানা উপহার হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে নীহারিকা। অদ্ভুত ক্লান্তিতে ছেয়ে আছে মনটা তার। কেন যে এরকম হচ্ছে কিছুদিন ধরে। কেন সমানে মনে হচ্ছে সত্যি কী সে সার্থক সাহিত্যিক? সত্যি কি বাচ্চাদের মন বোঝার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে তার? তাহলে নিজের ভিতরে এত ফাঁকা লাগে কেন - কেন মনে হয় যে গল্পটা বলার ছিল, যেভাবে বলার ছিল - এখনো বলে উঠতে পারেনি সে। বা, বলার ক্ষমতাই হয়ত তার নেই। এসব কথা দেবপ্রিয়কে বললে নির্ঘাত হাসবে। বলবে লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে গেছো, কদিন বিশ্রাম নাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সে অডিটরিয়ামের বাইরে আসতেই বড়ো ছোট মিলে আর এক দল ছুটে আসে। অটোগ্রাফ নেবে। নীহারিকা অবিশ্যি কাউকে ফেরায় না। সবাই চলে গেলে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে আসে বিনয়, তার অনেক পুরনো ড্রাইভার।
- দাও দিদি, ফুল আর জিনিসগুলো গাড়িতে রেখে দিই।
- বিনয়দা তুমি বাড়ি চলে যাও। বেশিদূর তো নয়, আমি একটু হেঁটে বাড়ি ফিরব।
বিনয় জানে তার দিদির মাঝে মাঝে এরকম উদ্ভট ইচ্ছা জাগে। কমদিন তো গাড়ি চালাচ্ছে না তার। কিন্তু কিছুদিন ধরে যেন বড্ড বেশি অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তার দিদিকে। হয়তো নতুন কোনো গল্প ভাবছে।
- রাত হয়েছে দিদি।
- ঠিক আছে। তুমি যাও, আমি এখুনি আসছি। - আশ্বস্ত করে ধীরপায়ে এগিয়ে যায় নীহারিকা।
বিনয় অবিশ্যি যায়না। একটু বাদে ঠিক খুঁজে নিয়ে গাড়িতে তুলে নেবে ওকে। গাড়িটা পার্ক করে একটু দূর থেকে পিছু নেয় তার। বড্ড আনমনা দিদি আজ।
বেশ রাত হয়েছে সত্যি। রাস্তায় বিশেষ কেউ নেই। কেন যে এইভাবে চলে এলো নিজেও বুঝতে পারছেনা। কী যেন খুঁজে পেতে চাইছে নীহারিকা, কিন্তু কী যে খুঁজছে তার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয় সেটা।
সামনের পানের দোকান থেকে একটা শোরগোল মত কানে আসে।
- আশ্চর্য, আমি তো পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম, তুমি আমাকে মাত্র পাঁচ টাকা ফেরত দিচ্ছ যে?- একটা বাজখাঁই গলা।
- না তো, আপনি তো দশ টাকা দিলেন, পঞ্চাশ টাকা দিলে আমি নিতামই না। আমার অত খুচরো নেই।- একটা মিনমিনে গলা।
- তবে রে, আমার টাকা মেরে দিবি ভাবছিস - বাজখাঁই গলা এবার মারমুখী। তুমি ছেড়ে তুইতে নেমে আসে।
দুই কান চেপে দ্রুত জায়গাটা পেরিয়ে আসে নীহারিকা। কোনও গল্প নেই এখানে। এসব বলবে নাকি তার পাঠকদের। ছি।
দুই পা এগোতেই, সামনে দুজন সুবেশা সুন্দরী ভদ্রমহিলা। গল্প করছেন।
- তুই বলেই বলছি, কাউকে বলিসনা। সুমির তো এই বিয়েটাও টিকলো না বোধহয়। যা মেয়ে বাবা- ঈষৎ ফিসফিসে স্বর।
- সেকিরে আবার? এবারে কী হল? - কৌতুহলে ফেটে পড়া অন্য একটি স্বর।
ওরে বাবা ভয়ানক। প্রায় পালায় নীহারিকা। এত লম্বা একটা রাস্তা, কোথাও গল্প নেই ! তার হারিয়ে যাওয়া না বলা গল্পটা?
হাঁটতে হাঁটতে একটা বাগানে ঘেরা ভারী চমৎকার দেখতে বাড়ির সামনে এসে পড়ে সে। বাহ্ কত ফুল। এমন প্রাইভেট বাড়ি দেখাই যায়না আজকাল। ভিতরে মৃদু স্বরে কারা কথা বলছে। একটা গলা হঠাৎ তীব্র হয়ে ওঠে।
- এই সামান্য অঙ্কটাও ভুল করলি তুই। দু দুটো টিউটর রেখেও? - সঙ্গে ঠাস করে একটা শব্দ।
আর একবারও বাড়িটার দিকে তাকায় না নীহারিকা। এ গল্পও তার জানা।এ শহরে আর কোথাও কোন গল্প নেই মনে হয়।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত নরম গলা কানে আসে। রাস্তার ওপারে, খানিক দূরে ওই ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক, চট এসব দিয়ে একটা ঝোপড়া মত বানানো। সেখান থেকে নাকি? একটা হতশ্রী বুড়ি বসে আছে মনে হচ্ছে আলো অন্ধকারে। গালে, কপালে অজস্র ভাঁজ। তার সামনে নীহারিকার দিকে পিঠ করে দুটো বাচ্ছা বসে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছেনা। তবে ভয়ানক রুক্ষ চুল, শতছিন্ন জামা, খড়ি ওঠা হাত, সবই বেশ স্পষ্ট। একটা ছেলে আর আর একটা যে মেয়ে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। নাহ্ এটাও খুব চেনা গল্প। পা চালিয়ে চলেই যাচ্ছিল নীহারিকা, কানে আসে একটা কচি স্বর।
- তারপর কী হল বলনা ঠাম্মা, তুই বল, আমরা শুধু শুধু রুটিই আজ খেয়ে নেব। আর কিচ্ছু লাগবে না। -
হতশ্রী বুড়ি একটা ভাঙ্গা থালা থেকে বোধহয় রুটিই হবে, ছিঁড়ে একবার মেয়েটার, আর একবার ছেলেটার মুখে দেয়, তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলে-
- গল্পটা কতদূর বলেছিলাম রে কাল?
থেমে যায় নীহারিকা এবার। এটা কোন গল্প? এটা কেমন গল্প দুটো বাচ্চাকে তাদের সীমাহীন দারিদ্র্য, খিদে, গায়ের শতচ্ছিন্ন জামা সব ভুলিয়ে দিতে পারে? এমন গল্প তো সে কখনো বলতে পারেনি। সারাজীবন বাচ্চাদের জন্য লিখেও এইভাবে বাচ্চাদের টেনে রাখার ক্ষমতা তো তার নেই। এই গল্পটাই তো সে খুঁজছিল। নীহারিকা বুঝতে পারে তার ভিতরের ফাঁকা ভাবটা যেন আস্তে আস্তে, খুব ধীরে ভরে যাচ্ছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সে।
বিনয় একটু দূর থেকে লক্ষ্য রাখছিল নীহারিকার উপর। হঠাৎ দেখে তার দিদি একটা রাস্তার ধারের ঝোপড়ার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর অত দামী শাড়িটা পরে ঝুপ করে বসে পড়লো। চাঁদের আলো নীহারিকার মুখের উপর এসে পড়েছে। কী নরম দেখাচ্ছে মুখটা।
অনেক দিন ধরে অনেক গল্প শুনিয়েছে নীহারিকা। আজ বহুদিন পর, তার নিজের গল্প শোনার পালা।