ব্যক্তিগত  গদ্য 

অলংকরণ : চন্দন কুন্ডু



সৌ মী  আ চা র্য্য

এমন করে ছিঁড়লো ক্যানে একতারাটার তার



নিত্যানন্দকে আমি ছোট থেকে চিনতাম। ওর মাথার সমস্যাটা ঠিক সহজেই ধরা পড়ত না। কথাটা বুদ্বুদের মতো বেরিয়ে এল ঠিকই অথচ ওর মাথায় আদৌ সমস্যা আছে কি না সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি আমাদের কারো ছিল না।প্রায়ই মাথায় ওর মার শাড়ি জড়িয়ে ঘুরতো বলতো,'ঠাণ্ডা লাগে শরীল'।স্কুলে পড়তে গিয়ে কেঁদেকেটে একসা,ভয় ভয় বলে চেঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে সেই যে পিঠটান দিলো আর ফেরৎ গেল না।ওর মা ভারি নরম মানুষ ছিলেন।আমরা কুল কুড়াতে গেলে দেখতাম, হেলেঞ্চা শাক দিয়ে ভাত মেখে নিত্যানন্দ খাইয়ে দিচ্ছেন।ওদের ওল গাছগুলো ছিল নিত্যানন্দের প্রাণ সবার আলাদা নাম দিয়েছিল। একেকদিন মুখ কালো করে বলতো,'লকখির শরীল ভালো না।'তো আবার কোনদিন বলতো,'আজ সরমা পোয়াতি হল।'আমরা মুখ টিপে হাসতাম।ওর বাবা আসতো কালে ভদ্রে।বাবার কথায় নাকের পোঁটা প্যান্টে মুছে বেশ গম্ভীর হয়ে বলতো 'বাবা রাজনীতি করে বুঝলি।'  সময়টাতে নকশালের বাড়বাড়ন্ত।পাড়াগাঁর আমরা জোট বেঁধে দিন যাপন করি। সকালে হরিনাম ধ্বনি অস্পষ্ট হয়ে বুকের ভেতর গোঙাতে থাকলে ঘুম থেকে উঠি আর সন্ধেয় ঘরে ঘরে শাঁখের আওয়াজ আশ্চর্য মঙ্গল বার্তা বয়ে আনলে আমরা দুলে দুলে পড়তে শুরু করি। নিত্যানন্দ পড়তো না গেঞ্জির কাপড় কাটতো। 

ওর বাবাকে কারা যেন পুকুরে বাঁশের উপর গোছর দিয়ে রেখে গিয়েছিল একদিন খুন করার পর। ভোর থাকতে উঠে পুকুর পাড়,খড়ের গাদা থেকে হাঁসের ডিম চুরি করতে গিয়ে ঐ প্রথম দেখে। একগাল হেসে বলেছিল,'বাবা কেমন বাঁশের উপর দাঁড়িয়ে আছে সেনাপতির মতো। কাউরে ভয় খায় না এমন হাবভাব।দেখবি চল।' আমরা ভয়ের চোটে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলাম। নিত্যানন্দ ভয় পায়নি। এমন হাড়হাভাতের মতো জীবন ভালোবাসতে আমি কাউকে দেখি নি। শীতলা পুজোর দিন চাঁদিফাটা রোদে খালিপায়ে পিচ রাস্তা বেয়ে দশবার যাতায়াত করতো।"এবার কার বাড়ি পোসাদ দেওয়া লাগবে দিয়ে দাও,দিয়ে আসি" যদি বলতাম 'ঐ একটু গুড় জল খেয়ে যা লু লাগবে তো' হেসে খলবলিয়ে বলতো,' আমি লুর জুতো পায়ে দিয়ে হিমালয়ে যাবো রে।গুড় জল রেখে দে সামনের বোশেখে তোর বরকে দিস।' বোঝো কাণ্ড!আমি তখন সবে বারো। বটের ঝুড়ির মতো ডালপালা বাড়িয়ে সেই নিত্যানন্দ তড়তড়িয়ে বড় হতে লাগলো। কালিডাঙার ঝিলপাড়ে দিনের বেলা কেউ যেত না,এমন মন খারাপের আঁশটে গন্ধ আর দুঃখের শ্যাওলার রাজত্ব ছিল সেখানে। কানাঘুষো শুনতাম সব খারাপ কাজের রাম রাজত্ব সেখানেই। একবার বাবার হাত ধরে ঐ ভয়ংকর রাস্তা পেরিয়ে ছিলাম। সেই ঝিলপাড় পাহাড়া দেবার কাজ পেল নিত্যানন্দ। ঝিলে সাহাবাড়ির মাছ চাষ হয়। শুনেছি দিনে পনেরো টাকা পেত।মাস খানেক পর স্টেশনের কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে দেখি বসে আছে।বুকের কাছে হাঁটু টেনে গোঁজ হয়ে।কথা বলতে গেলে আউল বাউল চোখে তাকিয়ে ডান হাতটা ঝাড়া দিয়ে হুশ্ হুশ্ আওয়াজ করতে লাগলো।অপমানিত হয়ে রোদের তাতে লাল হয়েছিলাম।পিছন ঘুরতেই গঙ্গাজল ছিটিয়ে ছিল শব্দে,'তোরে না,তোর পেছনে যে ছ‍্যামাটা দাঁড়িয়ে ছিল তাকে তাড়াই।আজ একমাস ধরে আমার পিছু নিয়েছে।যত ঝাপটাই আঠার মতো লেগে থাকে।শুধু এই দুঃখ সেই দুঃখের কথার বলে বিধান চায়।আমি কি নগেন ওঝা বিধান দেব?ক দেখি? শোন কাকন তোরেও ছ‍্যামায় ধরবে দেখিস।তোর গায়ে আমি কপূর্রের গন্ধ পাই।' মাথাটা পুরোই গেছে না হলে মানুষের গায়ে কর্পূরের গন্ধ পায়?

নিত্যানন্দ  ছ‍্যামাটাকে তাড়িয়েছিল কি করে জানিনা।তবে অষ্টপ্রহরের মালসা মাথায় বৃন্দাবনে যাবার রাস্তা ঠিক দেখিয়ে দিত।দই,খই,মিষ্টির সাথে ওর ভক্তি কি এক অনির্বচনীয় গন্ধ বয়ে আনতো তা বোঝানো যায় না। ঘোর লাগতো। পায়ের কাছে আছড়ে পড়তো মালসা সমেত সবাই হুড়োহুড়ি করতো প্রসাদের মাটির টুকরো নিতে আর আমি দেখতাম ওর ছ‍্যামাটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। নিত্যানন্দ মাথায় আলু গজিয়ে বিকেলের জলে ঝাঁপিয়ে পড়তো।ঝরঝরে শরীরের স্নিগ্ধতা শেষ সূর্যের আলোয় মেখে নিত।আমরা উঠতি কিশোরীর দল নোট বুকে ব্রিলিয়ান্ট ছেলেদের নাম আঁকতাম।আর নিত্যানন্দ আমাদের সাধের কৃষ্ণচূড়া,বকুল জড়ো করে দিত।আমাদের বাড়ি কাজ করতে আসতো যে মেয়েটা তার গোলাপি ফিতেতে গলায় ফাঁস লাগলো এই পাগলার।হলদে পরা দাঁতে নখ খুঁটে লজ্জা পেয়ে গন্ধরাজ ভেঙে আমার হাতে ধরিয়ে দিল,'ওরে দিস' যত বলি, 'তুই দে'।ততই জটিল অঙ্ক কষে।আমার ভেতর নাকি ভালোবাসার আলো আছে ঐ আলোয় ডুব খাইয়ে ফুলটা দিতে হবে। স্টিলের গ্লাসে পাতা সমেত গন্ধরাজ রেখেছিলাম। পরীক্ষা করছিলাম ভালোবাসার আলোর ক্ষমতা। কোন বিরহী যক্ষ আসে কি না দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল কত গুলো বছর। কেউ এলো না সেই ভালোবাসার আলো দেখতে বরং এই বিশ্বাস যার ছিল সেই নিত্যানন্দ মরে গেল। পাড়ার জগন্নাথ বুড়ো বিধান দিয়েছিল দানোয় খেয়েছে ওকে।রাত বিরেতে পুকুর ক্ষেত চষে বেড়ায়।সূর্য মাস্টার গম্ভীর গলায় বলেছিল,'বাবার মতো ছেলেও খুন হল। নিশ্চই কোন অপরাধ হতে দেখে নিয়েছিল।'


"যাও বলে যাও নিঠুর পাখি কোথায় যাও চলি

যাবার আগে মনের কথা যাওগো আমায় বলি

রাধাচূড়া কিষ্ণচূড়া আর পুখুরের জল

রাখবি কি আর মনে আমায় সত্যি করে বল"


ভারী উদাস হয়ে টান দিতো। উত্তরাদির ঠাকমা বলতো,'ছ‍্যামড়ার মন অন্য জগতের মরবো অকালে' আচ্ছা কি করে বুঝতো ওরা ও অকালে মরবে?ভরা যৌবনে এমন কালো অক্ষর হয়ে যাবে?আমি তো নিত‍্যানন্দের মধ্যে একটা উদার আকাশ দেখতে পেতাম,নৌকার ছইয়ের ভিতর থেকে তারা ভরা রাতের মতো আলো ছায়া এক সরল যুবক। কারা যেন ওর বুকে দুঃখ বুনে দিত, কারা যেন ডাকত আর ওর বাবা সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো বাঁশের মাথায় গোঁজ হয়ে। মাঝেমাঝে রাতে ঘুম ভাঙলে ফিসফিস করে বলি,নিত‍্যানন্দ আমার চারপাশে ছ‍্যামা দেখতে পাস?' বাতাসের ভেতর সড়সড় আওয়াজ ভাসে,গায়ে কাঁটা দেয়।গন্ধরাজের গন্ধ আর অষ্টপ্রহরের সংকীর্তন শুনলে আমার শরীর থেকে কি যেন ছুটে পালিয়ে যেতে নেয়।আমিও কি নিত্যানন্দের  মতো পাগল?ধূলো হাতে নিয়ে চিৎকার করে ওর মতো বলবো কোনদিন,'মাটি রে মাটি,এর চেয়ে আপন কিছু নাই। মা রে মা এরচেয়ে দামী কিছু নাই।'