ফি চা র
র ন্তি দে ব স র কা র
'তুমি কি কেবলই ছবি'
২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি। কনকনে শীতের কলকাতা। স্থান - ত্রিগুণা সেন মেমোরিয়াল হল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। দর্শকাসন প্রায় ভর্তি। সামনের সারির চেয়ার তখন চাঁদের হাট। চিরায়ত ধুতি-পাঞ্জাবি আর শাল-শোভিত নিপাট শুভ্রতায় মোড়া শঙ্খ ঘোষ, কন্ট্রাস্ট পাজামা-পাঞ্জাবি-জহরকোটের ঔজ্বল্যে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, সহজ জাঁকজমকহীন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ইঙ্গ-সংমিশ্রনে পবিত্র সরকার, ট্রাউজার-শার্টে জহর সরকার ইত্যাদি ইত্যাদি এবং আরো অনেক গুণীজনের উপস্থিতিতে হলঘর সরগরম। মঞ্চে আসীন নবনীতা দেবসেন, অনিতা অগ্নিহোত্রী ও আরো অনেক বিশিষ্টজন। যার জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্যে এই সমাগম সেই নবনীতা দেবসেন স্বয়ং মাইক্রোফোনে তাঁর ঊনআশিতম জন্মদিন উপলক্ষে অধ্যাপক স্যার শঙ্খ ঘোষ কে কিছু বলার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। ধীর পায়ে উঠে স্ট্যান্ড-মাইকে এলেন বর্ষীয়ান কবি এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ। শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত নিচু গলায়, প্রায় অষ্ফুট স্বরে বললেন কেটে কেটে- ‘নবনীতা আমাকে বলে ‘বোবা কবি’। বলেই একটু থামলেন। তারপরেই ঠোঁটে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে বলে ঊঠলেন –‘তাহলে আমাকে কিছু বলতে ডাকা কেন ?’ হলভর্তি হাসির রোল উঠল। এমনই সূক্ষ হাস্যরসবোধ ছিল তাঁর। প্রকাশ হয়ত কম ছিল কিন্তু আদতে ছিলেন রসিকজন। আমি এখানে হয়ত একটি ঘটনার কথা বললাম কিন্তু ঘরে-বাইরে সবখানেতেই, তাঁর রসবোধের পরিচয় পাওয়া যেত। কিন্তু স্বরযন্ত্রে কিছু সমস্যা এসে যাওয়াতে কথা বলতে খুবই কষ্ট হতো। শেষের দিকে তো প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শুনতে হতো। তাই ইদানীং কোনো অনুষ্ঠানেই তিনি কোনো ভাষণ দিতেন না। এ ব্যাপারে সবাই অবহিত থাকায় কেউই তাঁকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করা থেকে বিরত থাকতেন। তবুও একটি অনুষ্ঠানে কিছু বলতে বললে শঙ্খদা বলেছিলেন- ‘আমার হয়ে অলোকরঞ্জন বলে দেবেন।’ তা শুনে অলোকদার চোখমুখের প্রতিক্রিয়া দেখার মত হয়েছিল। এ ছাড়া শঙ্খদার আরেকটি প্রতিবন্ধকতা তাঁকে খুব বিচলিত করত এবং তা হলো তাঁর লিখতে পারার অক্ষমতা। একজন কবি যখন স্নায়ু দৌর্বল্যতার কারণে তাঁর লেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন তখন তাঁর মানসিক অবস্থা যে কি হয়, তা ভুক্তভোগী তারাই সে অব্যক্ত বেদনা অনুভব করতে পারেন। ২০১৮ সালে উল্টোডাঙ্গার হাডকো হাউসিং-এর ফ্ল্যাটে আমি একবার গেছিলাম অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর সাথে। কারণ কবিদেরও আধার কার্ড লাগে। অলোকদা জার্মানিতে বাস করার দরুণ এসব করা হয়ে ওঠেনি আর করার মতো লোকবল তাঁর নেই। যাদবপুর বিশবিদ্যালয়ের পেনসন বন্ধ হবার উপক্রম। শোনা গেলো বন্ধু শঙ্খ ঘোষের কে একজন নিকট আত্মীয় আছেন যিনি অলোকদার আধার কার্ড নিমেষে বের করে দিতে পারবেন। তাই অগত্যা মরীয়া হয়ে অলোকদার এই তৎপরতা। সেই প্রথমবার শঙ্খদার বাসভবনে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল আমার। তাছাড়াও আমার এক ক্ষুদ্র স্বার্থ ছিল। সেইদিন আমি তাঁর কাছে আবেদন রেখেছিলাম একটি কবিতার জন্য- আমার সম্পাদিত নতুন একটি সাহিত্য পত্রিকা ‘অন্তরীপ’ এর উদ্বোধনী সংখ্যাতে ছাপানো হবে বলে। একটা নতুন সাহিত্য পত্রিকায় যদি শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং পবিত্র সরকারের লেখা নিয়ে বেরোয় সে পত্রিকা যে বেশ ওজনদার হবে, বলাই বাহুল্য। অলোকদা আবার যেখানে প্রধান পরামর্শদাতা, সম্পাদক হিসেবে আমি যে অনেকটা এগিয়েই শুরু করব, তাতে কোনো সন্দেহ ছিলনা। তখনই তিনি বলেন তাঁর লেখার অসুবিধের কথা। ভালোমতো কলম ধরে লিখতে জোর পেতেন না। ভীষণ কাঁপুনি হতো। মনে মনে এক দারুণ অবসাদ শুরু হয়েছিল। তাও বলেছিলেন তিনি চেষ্টা করবেন। আমারও খুব তাড়া ছিলনা। ২/৩ মাস পর একদিন ফোন করে আসার জন্য বলেছিলেন। সেবার তাঁর বাড়িতে গেছিলাম বটে, কিন্তু শঙ্খদা তাঁর লেখার অক্ষমতার কথা বিনীতভাবে জানিয়েছিলেন এবং আমাকে খালি হাতেই ফিরে আসতে হয়েছিল। আমি শঙ্খদাকে সমাধান সূত্র দিয়েছিলাম- সরাসরি ল্যাপটপ-এ লেখার কথা। শঙ্খদা বলেছিলেন একবার চেষ্টা করে দেখবেন। কিন্তু আমি জানতাম এই বয়সের মানুষেরা চট্ করে এমন অভ্যেস ধাতস্থ করতে পারবেন না। অলোকদারও তাই। আর কবিতা যারা চর্চা করেন তাঁরা সম্যকভাবেই জানেন, অনুলিখন দিয়ে আর যাই হোক, কবিতা লেখা যায় না।
মা অমলাবালা ও পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষের পুত্র শঙ্খ ঘোষের জন্ম ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ ওপার বাংলায়, চাঁদপুর গ্রামে। ১৯৫১ সালে বাংলা ভাষার স্নাতক কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে। তাঁর পোষাকি নাম ছিল ‘চিত্তপ্রিয় ঘোষ’। তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, জঙ্গীপুর কলেজ, বহরমপুর গার্লস কলেজে বিভিন্ন সময়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৯২ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এছাড়া আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ-এ অংশগ্রহণ করেন। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিমলার ইন্সটিটিউট অফ এডভান্সড স্টাডিজ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপনা করেন। ২০১৬ সালে জীবনের সেরা ভারতীয় স্বীকৃতি ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরষ্কারে ভূষিত হন। তিনি ‘কুন্তক’ ছদ্মনামেও অনেক কাব্য রচনা করেছেন। তাঁর রচিত কাব্য সংকলন ২৮ টির মতো এবং গদ্যগ্রন্থের সংখ্যা ৪৫টির উপর এবং ২৩টির মত গ্রন্থ শিশু-কিশোর দের জন্য।‘বাবরের প্রার্থনা’ (১৯৭৬), পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’- তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যসংকলন।
শঙ্খদা এত বড় মাপের একজন কবি হয়েও তিনি তাঁর কাছে যাওয়া প্রতিটি মানুষকে সমান গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতেন। আর যেই তাঁর কাছে আসুন না কেন অভ্যাগতদের জন্য দুরকম মিষ্টির একটি প্লেট বরাদ্দ থাকত। এই ব্যাপারে পবিত্র সরকারও একই লৌকিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আর অলোকদার বাড়িতে ব্ল্যাক কফি। কিন্তু শঙ্খদা একটা ব্যাপারে আমি খুব উপভোগ করতাম যে যখনই যাই, দিনের যে সময়ই যাই না কেন, শঙ্খদা সেই চিরপরিচিত পাটভাঙ্গা ধুতিপাঞ্জাবিতে সদা সর্বদা সজ্জিত থাকতেন। ঘরের পোষাক আর বাইরের পরিধান সব সময় একই থাকত। এই অভ্যাস উনি বজায় রেখেছিলেন শেষদিন পর্যন্ত। আরেকটা ব্যাপার খুব ধর্মীয় নিষ্ঠায় মেনে চলতে দেখেছি, অতিথি-অভ্যাগত যারাই তাঁর সঙ্গে দেখা করার পর বিদায় নিতেন, তাদের প্রত্যেককে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেবার সৌজন্য প্রদর্শনে কক্ষনো ভুল হতো না এই জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারে ভূষিত, নিরহঙ্কারী এই সাহিত্যসাধকের। হাঁটা-চলায় হাঁটুর সমস্যা নিয়ে ভুগতেন, তা সত্ত্বেও কিন্তু তিনি কাউকেই ঘুণাক্ষরে বুঝতে দিতেন না। আর ছিল তাঁর নিজস্ব এক ‘প্রতিবাদী’ কণ্ঠ। বাইরের যা কিছু প্রকাশ তা মৃয়মান অবরুদ্ধ থাকলেও, আন্তরিক প্রতিবাদে ছিলেন অমলিন। যা বলতেন, কোনো কিছুর সংগে আপস না করেই।
![]() |
কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে একান্ত কবি শঙ্খ ঘোষ |
একবার বেশ একটা মজার ঘটনার কথা শঙ্খদার ব্যাপারে শুনেছিলাম অলোকদার মুখে। এরা দুজনে খুব ভালো বন্ধু হলেও, এক বছরেরে বড় হওয়ার সুবাদে অলোকদা ‘শঙ্খদা’ আর সম্বোধনে ‘আপনি’ বলতেন। ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এমন ফর্মাল সম্বোধন থাকা আদৌ কাম্য হতে পারে না। এ ব্যাপারে অভিন্ন বন্ধুত্রয় শঙ্খদা, আলোক সরকার এবং অলোকরঞ্জন দা্শগুপ্ত একদিন ধর্মতলা থেকে এসপ্লানেড অঞ্চল ধরে হেঁটে হেঁটে বাস ধরার উদ্দেশে আসতে আসতে এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে করতে আসছিলেন। মূলতঃ কবি আলোক সরকার এবং শঙ্খদা এ ব্যাপারে সহমত হলেও অলোকদার মনে দোলাচল চলছিল। এমন একটা অমীমাংসিত সন্ধিক্ষণে বাস এসে পড়ল ঐ বাস অলোকদার পাড়া যাদবপুরে ৮বি বাস স্ট্যান্ড যাবে। অমনি অলোকদা তড়িঘড়ি করে ত্রস্তপদে বাসের পেছনের দরজা দিয়ে উঠে মুখ বাড়িয়ে হাত নেড়ে অপর দুই বন্ধুর দিকে হাত নেড়ে বলে উঠলেন- ‘এটা আমার পক্ষে মেনে নিয়ে সবাইকে ‘তুমি’ সম্বোধন করা কোনোদিনই সম্ভব নয়’- বলেই বাসের অভ্যন্তরে সেঁধিয়ে গেলেন। শঙ্খদা আর আলোক সরকার হতবাক।
গত কয়েকবছর ধরে তিনি নানান শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিলেন। স্ত্রী প্রতিমা ঘোষ ছিলেন তাঁর যোগ্য সহধর্মিনী এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে শঙ্খদা বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই বেশিরভাগ সময়ই আবদ্ধ ছিলেন। তবুও শত প্রতিকূলতে সত্ত্বেও তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে। এমনকি নিকট ভক্তদের বাড়ির বিয়েবাড়িতেও তাঁর নীরব উজ্জ্বল উপস্থিতি সবার সাথে এক অদৃশ্য সেতু গড়ে তুলতে পারতেন। তাঁর ক্ষীণ বাকশক্তি যোগাযোগের কোনো অন্তরায় ঘটাতো না। এমনই ছিল শঙ্খদার নান্দনিক ব্যক্তিত্ব।
![]() |
যাপন : শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও রন্তিদেব সরকার |
বহু পুরষ্কারে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন তবুও জ্ঞানপীঠ, পদ্মভূষণ এবং সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কারে ভূষিত হয়ে তাঁর কবিজীবনকে যেমন এক আলোর বলয় ঘিরে থাকত। ২১ শে এপ্রিল ২০২১ ছিল সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন যেদিন তিনি আমাদের এই নশ্বর বলয় ছেড়ে চলে গেছেন এক ঐশ্বরিক আবাসে। তিনি তাঁর সাহিত্যকীর্তির মধ্যেই বাংলার সাহিত্য জগতে অমরত্ব লাভ করেছেন। আমরা তাঁর চর্চিত সাহিত্যসম্ভার আগলে রাখব পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
© আলোকচিত্র : রন্তিদেব সরকার