গল্প 


অ নি মে ষ  গু প্ত 

শ্বেতকরবীর দোসর  


শেষ অবধি রাখতে পারলাম না। নিজে গিয়ে বসিয়ে এসেছি ট্রেনে। বিদায় জানিয়েছি দূরগামী ট্রেনের নির্দিষ্ট জানলার উদ্দেশে হাত নেড়ে। দিগন্তে মিশে যাওয়া উদাস রেললাইন, সারিবদ্ধ রেল কোয়ার্টার, কোনকিছু গোপন না রাখতে পারা মফস্বলী মানুষজন, এসব আর সহ্য করতে পারছিলনা সে। তার ওপর এই পাগলকরা হাওয়া, আগলহীন আকাশ, সোজা আর উঁচু গাছপালা… সবই বড় উন্মুক্ত। ব্যক্তিগত অবকাশ বা স্পেস বলতে কিছু যেন নেই। এসবের সঙ্গে সে মানাতে পারেনি কখনো। থাকতে পারছিল না, ফিরে যেতে চাইত বারবার।  কিন্তু আমি কী তার অসহায়তা, কষ্ট বুঝতাম ? হয়ত বুঝতাম, হয়ত নয়। তবু জোর খাটান যেত। বলতে পারতাম, ‘তাহলে আনন্দধাম! তাহলে আমি!’  সে জোর জুটিয়ে উঠতে পারিনি। মনে করিয়ে দিতে পারিনি রংচটা কোয়ার্টারের দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে লিখে রাখা সেই নাম— ‘আনন্দধাম’। আটকাতে পারিনি তাকে, বলতে পারিনি— যেওনা। কাউকেই কী আলহীন, আলোহীন করে ধরে রাখা যায়!

প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখছিলাম… হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া হুইশেলের আওয়াজ ষ্টেশন চত্বরের কৃষ্ণচূড়ার পাতা ছুঁয়ে যাচ্ছে। দুধ সাদা সকাল হলদেটে হয়ে উঠছিল ক্রমশ। কাছেই কোথাও কুকুর ডেকে উঠল। এক অল্পবয়স্ক বাউলানী ময়লা ঝুলি হাতড়াচ্ছিল, পাশে তার বিমর্ষ একতারা। ঝুলে পড়া চটের বস্তা পিঠে নিয়ে এক কিশোর দৌড়চ্ছিল হাওয়ায় উড়ে চলা ছেঁড়া কাগজের পেছনে আর বছর চোদ্দর এক ফুটিফুটি বালিকা দুহাতে চায়ের ভাঁড় নিয়ে ধীর পায়ে এগোচ্ছিল কাদের উদ্দেশে কে জানে! জৌলুষহীন সাদা ফিতেয় বাঁধা তার এক-বিনুনি বেদনার মতো দুলছিল বুকের সদ্যোত্থিত জাগরণের ওপর। খাঁ খাঁ শূন্যতায় ভরে আছে স্টেশন। কোন অকাল থেকে ভেসে এল স্টেশন মাষ্টারের ডাক। অলস, কর্মহীন রবিবারের সকালে শুরু হল এক উদ্দেশ্যহীন ছোট্ট টাউনের গল্প।  

ফিরতি পথে রেল কোয়ার্টারের মরচে ধরা লোহার গেট। ধুসর হয়ে আসা পুরনো বাড়ীগুলোর চারপাশে বাঁশবেড়ার অস্থায়ী বাগান। সাদা হাওয়ায় দুলছে ফুলকপির পাতা। একপাশে গভীর আলস্যে চেয়ে আছে স্থলপদ্ম গাছ। সবুজ, হলুদ পাতার ওপর জমাট বাঁধা স্মৃতির মতো ধুলো। বেড়ার বাইরে, কিছুটা দূরে শুকনো ডালে ঝিমিয়ে আছে বিমর্ষ গন্ধরাজ। পাশেই রেলপুকুর। অজস্র কচুরিপানার মধ্যে একদৃষ্টিতে জগতসংসার দেখছে মুখতোলা জলঢোঁড়া। এরা কেউ জানেনা তার চলে যাওয়ার খবর।


হাট-খোলা দরজা-জানলা। খাঁ খাঁ করা ঘর। আলসে রোদ্দুর এসে বসেছিল পাঁচ বাই ছয়ের তক্তপোষের ওপরে। বাসি চাদর উড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল আধপাগল হাওয়া। সে বলেছিল, ‘এত আলো সহ্য হয়না। উলঙ্গ মনে হয় নিজেকে।‘ বলেছিল, ‘এরমধ্যে একদিন ঠিক মরে যাব আমি।‘

আর আমি শিখছিলাম। এই উদাসীন প্রকৃতি, আলো, হাওয়া, রোদ-বৃষ্টি… শিখিয়ে দিচ্ছিল বারবার বন্ধ মুঠো খুলে দেওয়া, বারবার ছেড়ে দিতে দিতে ভাঙ্গনের গোপন আওয়াজ শোনা... এসবের অন্য নাম জীবন।

এখন এই অফুরান অথচ সন্তর্পণ হাওয়ার মধ্যে আলগোছে পড়ে আছে গতরাতে ভেঙ্গে নেওয়া শ্বেতকরবীর ডাল। তিনপায়া গোল টেবিলের ধুসর-কালোর ওপর এক নীল-সাদা রক্তাল্প আলো। 





সৌ মী  আ চা র্য্য

আশ্চর্য



 কঙ্কাল


কি রে কঙ্কাল আজ হলুদ শাড়ি পরেছিস?চরম রাগ হলো ভালোবাসার ঢং মেশানো এই কথায়।মনে হলি বলি,না রে আমার শাড়ির রঙটা লাল তোর চোখে সারাদিন হাগা ঘোরে তাই হলুদ দেখছিস।কিন্তু যথারীতি মুখে কিছুই বলতে পারলাম না।হে হে হাসি দিয়ে সুরুৎ করে অফিসে ঢুকে গেলাম।আশ্চর্য এই এরাই করিনা কাপুরের জিরো ফিগার নিয়ে কত উচ্ছ্বসিত আর আমার বেলা এদের যত সমস্যা।

-এ্যাই মন্দিরা!আজ সন্ধ্যায় সিনেমায় যাবি?

-নারে আজ একটু কাজ আছে।

-কি কাজ রে?পাত্রপক্ষ?

আবারো হে হে হাসি দিই।তবে জানতাম এতেও রক্ষে নেই।এবার শুরু হবে জল্পনা।ছেলে কি করে?কোথায় থাকে?এটা কত নম্বর?রোগা না মোটা?উফ্ আশ্চর্য মানুষ এরা।আমাকে ছাড়া আর কোনো আলোচনা নেই এদের?

-এ্যাই কঙ্কাল থুড়ি মন্দিরা। রাগ করেছিস?

-না কেন রাগ করবো অফিসের সবার সামনে কঙ্কাল বলে ডাকলে আমি সাধারণত খুশি হই।

আমার কথায় একটু চুপসে গেল কঙ্কনা।একেকবার ভাবি বলে দেবো,দয়া করে তোর ঢ্যবা চোখ আমার দিক থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও ঘোরা কিন্তু রুচিতে বাধে।মনে মনে গজরাতে গজরাতে বাড়ি ফিরি।বাসে এক উঠতি প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বেশ রাগ করে বলে,না সোনা তুমি সবকিছুতেই খাবোনা খাবোনা করো না তো।শেষে ঐরকম ঝাঁটার কাঠি হয়ে যাবে।ঘাড় না ঘুরিয়েও বুঝি আঙুল আমার দিকে।উফ্ এত বিশেষণের পর কাঁহাতক ভালো লাগে অপরিচিতের সামনে বসতে।মায়ের একটা কথারো উত্তর দিইনা,অকারণে হাত পা নেড়ে অনর্গল কথা বলে চলেছে।এমনকি ওনার সিলেক্ট করে রাখা শাড়িও পরিনা,বাবার শেষ দেওয়া গোলাপি ঢাকাইটা পরে তৈরী হই। দরজায় টিংটং। যাই বোধহয় এসে গেল।




আঁতেল


-হ্, বুবান, দাঁড়িয়ে আছিস কেন কলিংবেলটা বাজা।

আশ্চর্য দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেজদা হুকুমটা আমায় করলো অথচ আমি সেজপিসি আর ফুলকাকির পিছনে দাঁড়িয়ে।বাড়ি থেকে পঁইপঁই করে বলে এনেছে আগ বাড়িয়ে কোনো কিছু আমি যেন না করি অথচ এখন হম্বিতম্বি করছে যেন কলিংবেলটা আমারই বাজানোর কথা ছিল।কলিংবেল বাজাতেই একটা সরু মেয়ে ভাসাভাসা চোখে বললো,আসুন।বাড়ির সকলের মুখ দেখে বুঝলাম পারলে তখনি ইউটার্ন মারে কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে ভেতরে যাচ্ছে হাসি মুখে।সুন্দর সাজানো ছোট একফালি বসার জায়গা।আমরা আটজন বসার পর আর কারো বসার জায়গা রইলো না।মেয়েটি দরজার কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো।ওর মা ঘরের মাঝে বিচিত্র নৃত্যের  ভঙ্গিমায় অনেক কিছু বলে চলেছে।আর আমার বাড়ির লোকেরাও কিম্ভুত মুখে কথা বলছে। ভদ্রমহিলা বিধবা না সধবা বুঝলাম না যদিও তাতে কিছু যায় আসেনা তবে শুনেছিলাম মেয়েটির বাবা নেই।

-বাবা, তুমি কিছু বলছো না যে।

-সুযোগ পাচ্ছি কোথায়?

ফস করে বলে ফেললাম।ভদ্রমহিলা একটু থতমত খেয়ে বললেন,এ্যাঁ হে হে, সত্যি আমি বড্ড বকছি।তুমি বলো বাবা।

-কি বলবো?

-তোমার কথা।

-আমার কথা কি শুনবেন,আমার কথা কেউ শোনেনা।এই যে আপনার মেয়ে এত রোগা এটা দেখার পর এরা হাসছে, প্যাটিস, পেস্ট্রি সব খাচ্ছে কিন্তু মনে মনে কি ভাবছে সেটা আমি ভালোই জানি অথচ আপনার মেয়ের ব্যাথাভরা চোখদুটো আমায় বড় টানছে।সেটা আমি বলতেই পারবোনা এদের তাহলেই শুনবো আঁতলামি করছি।আর কি বলবো বলুন?চাকরি করি,সামনে পেছনে সবাই আঁতেল,গাম্বাট এসব বলে।তবে আমি জানি আমি সৎ ও স্বাভাবিক। যা বুঝি তাই বলি।যা মাইনে পাই হেসেখেলে জীবন কাটাতে পারি।এবার বলুন আর কি বলবো?

আমার কথা শেষ হওয়া মাত্র মেয়েটি এগিয়ে এল,অপলক চেয়ে বললো,আমার আপনাকে গাম্বাট মনে হয়নি।যদি এই সম্পর্ক না তৈরী হয় তাতেও কোন দুঃখ নেই।তবে ভালো লাগলো আপনাকে।নমস্কার।

বাড়ির ফেরার পথে সবাই পাথর হয়ে বসে থাকলেও আমার মন জুড়ে বিসমিল্লাহ খান।আহা,এমন ছাপোষা আমার আমিকে কারো ভালো লাগতে পারে?আহা কি যে আনন্দের কথা।যদিও জানি এত রোগা মেয়ে বিয়ে করলে চরম ভোগান্তি আছে।বিশ্ব সুদ্ধ সব বলবে বেশী আঁতেলদের এমনটাই হয়।নাহ্ মেয়েটার চোখদুটো কেবলই...ধুর আর ভাববোই না।কিন্তু আমার ভাগ‍্য,আশ্চর্য সব ঘটনা লিখে রাখে আমার জন‍্য। অফিসের স্ফটওয়‍্যার ডিজাইন করতে আসলো সেই মেয়ে ঠিক চারদিনের মাথায়।নামটা কি তাই মনে পড়লো না আমার।চুপচাপ কেটে উঠলাম।

-বাপরে পাটকাঠির দাপট দেখলি উজান?

শুভ্রর কথায় রা কাড়লাম না।ভালো লাগেনা এসব একঘেয়ে কথা।

-কি হল,কিছু বলছিস না যে?

-কি বলবো বলতো,সঙ্গীত স্যার কুমড়ো পটাশ,এই মেয়েটি পাটকাঠি কেনরে তুই কি নিজেকে পারফেক্ট ভাবিস নাকি?আয়নায় নিজেকে এই চোখটা নিয়ে দেখিস ছাব্বিশ রকম ফল্ট খুঁজে পাবি।

-তোর সাথে শালা কথা বলাই যায়না।সব সময় আঁতলামি।                        




উজানে


জ একটা নতুন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলাম।উজানবাবু আমাদের বাড়ি থেকে যাবার পর কোন যোগাযোগ রাখেননি আমি কিছু ভাবিওনি কেননা রিজেক্ট হওয়া আমার সয়ে গেছে।যে অফিসে সফ্টওয়্যার ডিজাইন করতে গেছি সেটাতেই যে উনি কাজ করেন জানতাম না।আশ্চর্য দেখামাত্র এমন আকাশ থেকে পড়া মুখ করে সরে পড়লেন অবাক হয়ে গেলাম।রোগাসোগা মেয়ে দেখে কয়েকজন বক্তৃতা দিতে জুটে গিয়েছিলো ঠাণ্ডা গলায় যেই বললাম,আরে আপনারা নিজেরাই তো করতে পারতেন আমাকে এতটাকা দিয়ে হায়ার করলেন কেন?এককাজ করুন আপনারা কাজটা করুন আমি বরং টুক করে হাওয়া খেয়ে আসি।অনেকক্ষণ আপনাদের গায়ের ডিও,ঘাম,পাইরিয়া,সিগারেট এসবের গন্ধ পাচ্ছি কিনা।যাইহোক এক নাগাড়ে কথাগুলো বলার পর লোকগুলো হতচকিত হয়ে সরে পড়লো।আমি নিশ্চিন্তে কাজ সেরে অফিসের বাইরে পা বাড়ালাম।লিফ্টে উঠতে যাবো পেছন থেকে কাচুমাচু স্বর ভেসে এল।

-শুনছেন একটু দাঁড়াবেন।

পিছন ফিরতেই দেখি উজান দাঁড়িয়ে আছেন।মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে চায়।

-বলুন।

-নামটা ভুলে গেছি বলবেন।

-কেন?

-কেন মানে?একটু কথা বলতে চাই।নাম না জানলে সম্ভব কি সেটা।

-কথা বলবেনই বা কেন?

-আশ্চর্য আচরণ তো আপনার।আপনি রোগা বলে কে কি বললো তার দায় কি আমার?আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন?

খুব ভালো লাগলো লোকটার এই রাখঢাক না রেখে কথা বলা।কিন্তু কেন জানিনা গম্ভীর হয়ে  বললাম,আমার নাম মন্দিরা,বলুন কি বলবেন।

-আশ্চর্য মানুষ আপনি সব সময় এত রেগে থাকেন কেন?কত কি বলবো ভেবে এলাম।এমন মুখ করে আছেন।

খুব হাসি পেল,বললাম,আমার মুখটাই এমন কি করবো বলুন!

-মোটেই না আপনি নিজেও জানেন না আপনার মুখটা মানে চোখটা আসলে...

কথা হারিয়ে ফেলেন উজান।তোতলাতে তোতলাতে বলেই ফেলেন,আমার সাথে চা খাবেন এক কাপ গঙ্গার পাড়ে?আমি লাজুক হেসে বলি,উজানে যাবেন না ভাঁটিতে।ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন,আপাতত উজান চাইছে আপনাকে।গঙ্গার পাড় এত সুন্দর!প্রিন্সেপ ঘাটে কতবার এসেছি এত ভালো লাগেনি।সূর্য অস্ত যাচ্ছে যখন আচমকা হাতের উপর আরেকটি হাত এসে পড়ে,বড় আপন লাগে হাতটিকে।হাতের মালিক বলেন,আমার সাথে পথ চলা যায় মন্দিরা?

-আমি যে কঙ্কাল,পাটকাঠি।

ভুরু কুঁচকে উজান বলে,ছিঃবলবে না এমন।তুমি রোগা এটা সত‍্যি তুমি সুন্দর এটাও সত‍্যি।

এরপরের ঘটনাগুলো কতটা কঠিন হবে জানিনা তবে আপাতত আশ্চর্য লাগছে এই দেখে যে আমার সব ভালো লাগছে সব।মার বকবক,উল্টোপাল্টা সিরিয়াল,বাড়ি ফেরৎ বাস কন্ডাক্টরের উক্তি,আরে আস্তে ধাক্কা দিন,সামনের রোগা মহিলাতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে।সব ভালো লাগছে।উজানে বয়ে যেতে বড় সুখ।মেসেজ আসে,নীলচে আলো জানান দেয়।

আমার মুখে লাগাম নেই তাই বলে লোকে,তাই নির্ভয়ে বলছি আজ বিছানাটা ফাঁকা লাগছে।এবার সঙ্গী চাই,গল্প করার,রাত জাগার আর একটা নতুন গল্প লেখার।


অলংকরণ : চন্দন কুণ্ডু