ধা রা বা হি ক 

উপন্যাস ।। ৫ম কিস্তি 


অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল


নরকের অন্তরে

কৌ শি ক  দে 


পুরুষ সঙ্গের মুখগুলো হিয়া মনে রাখে না। এতে রাতের ঘুম নষ্ট হয়। তবে তার মতে এই পৃথিবীর সব পুরুষ সমান নয়। কিছু ভালো মানুষ'ও আছে। যারা শুধু শরীর চায় না , মন নিয়েও কথা বলে। বা হয়ত সেই সব পুরুষগুলো কিছুটা অনর্থক ভাবেই ঘুরে বেড়ায় এই সংসারে। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রৌদ্র যেমন শরীরে আবেশ নিয়ে আসে হয়তো সেই পুরুষগুলোর সান্নিধ্য আজীবন একটা ওম রেখে যায় শরীরে। 


তবে ভালো পুরুষের সংখ্যা খুব কম। আর তাদের খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর। এযাবৎ হিয়া'র নজরে ভালো মানুষ বলতে মুখার্জি ম্যানেজার। লোকটার কোনো লোভ নেই। এত দিন সে অফিসে এসেছে , এত কথা বলেছে তাও লোকটা আজও হিয়া'র বুকের দিকে তাকায় নি। উল্টে সাহায্য করেছে বহুবার। এইতো সেদিনের ঘটনা। বৈশাখ মাস। রাত প্রায় দশটা। হিয়া বাড়ি ফিরে দেখে জয়ন্ত'বাবুর হাঁপানির টান উঠেছে। একেবারে যায় - যায় অবস্থা। সাত - পাঁচ না ভেবে হিয়া ফোন লাগলো মুখার্জি ম্যানেজার'কে। মানুষটা সেই রাতে এম্বুলেন্স নিয়ে এসে একা হাতে সব সামলালো। প্রতুত্তরে সে হিয়া'র কাছ থেকে এতটুকু উষ্ণ ছোঁয়াও চায় নি। হিয়া ভাবে এও তো পুরুষ ! এরও তো শরীরের ক্ষিদে আছে। অথচ কত আলাদা। সেই থেকেই মুখার্জি ম্যানেজার'কে সম্ভ্রমের নজরে দেখে সে।


হিয়া এখন বসে আছে মুখার্জি ম্যানেজারের চেম্বারে। সামনে তিনি পেয়ালা'তে চা ঢেলে এক অদ্ভুদ শব্দ করে খাচ্ছেন। হিয়া অনেকক্ষন হা করে সেই দৃশ্য দেখার পর বলল, মুখার্জি'দা , আপনি কি এভাবেই চা খান সবসময় ?


পেয়ালা নামিয়ে রেখে মুখার্জি ম্যানেজার হেসে বললেন, হে হে , নেশা জিনিষটা আমি একটু রসিয়ে রসিয়ে করতে ভালোবাসি হিয়া। মদ গাজা তো খাইনা , সিগারেট'ও ছেড়ে দিতে হলো শরীরের কারণে। এখন এই চা'ই ভরসা। সেটাকে একটু উপভোগ করা। স্যাটিসফাই ওন দা টি। 


হো হো করে হেসে উঠে হিয়া বলল, আর আপনার ইংরেজি'টা? সেটাও তো ইউনিক ।

বেশ চিন্তিত হয়ে উঠলো মুখার্জি'দা। কপালের বলিরেখায় ভাঁজ ফেলে বললেন, এই জন্যই সমস্যা। এই ইংরেজী নিয়েই সমস্যায় পড়েছি হিয়া।

ব্যাপারটা বুঝলাম না।

হুমমম। বলছি । আসলে , জাপান থেকে তিনটে পার্টি আসছে। এখানে তিন মাস থাকার ভিসাও পেয়েছে। আমাদের মাল কেনার জন্য যে রেট দিয়েছিলাম তাতে রাজিও হয়েছে।কিছু সমস্যা হলো ওরা তো আর বাংলা জানে না। যা কথা হবে ইংরেজি'তেই। আর আমার যা ইংরেজি কবর থেকে মরা উঠে আসার মতন। এবার ভাবো , এত বড় পার্টি যদি এসে দেখে এই কোম্পানিতে এমন কেউ নেই যে ওই ভাষায় কথা বলতে পারে তাহলে কিরকম ইমপ্যাক্ট ফেলবে ওদের মনে। এদিকে মালিক বলে রেখেছে এই পার্টি যেন কোনো ভাবেই হাত ছাড়া না হয়।


হিয়া নিজের চা শেষ করে বলল, তাহলে এখন উপায় !


উপায় হলো ওই অসিত ছেলেটি। শুনেছি ভালো ইংরেজি জানে। দেখতে শুনতেও ভালো। কেন যে হঠাৎ আসা বন্ধ করে দিলো বুঝতে পারছিনা। এদিকে মিতু ওর বায়োডাটা হারিয়ে ফেলেছে। ফোন নম্বরটাও জানা নেই। মালিক এসবের কিছুই জানে না। জানতে পারলে আমায় চিবিয়ে খেয়ে নেবে। কি যে করি এখন !


হিয়া ভাবলো অসিতের ব্যাপারটা খুলে বলবে , তবে পারলো না। সে বলল, আমার মনে হয় ছেলেটি ফিরে আসবে মুখার্জি'দা। হয়ত কোনো প্রবলেমে আছে।


হুমম, আসলেই ভালো। ওকে আমি নিজের হাতে কাজ শেখাবো ভেবেছিলাম। আসলে কি জানো এ হলো দালালির কাজ। কটা মানুষ করতে পারে বলো! তবে যে টিকে থাকে স্কাই লিমিটে পৌঁছে যায়।


হিয়া বলল, আমার জন্য কিছু কাজ আছে মুখার্জি'দা ?


আরে এখন তো কাজই কাজ। আমি তোমায় জানিয়ে দেবো। চিন্তা কোরো না। তবে একবার যদি জাপান পার্টিকে বোগলের তলায় আনতে পারি তখন আমরা ডলারে খেলবো। বুঝলে কিছু ?


বুঝলাম, বলেই উঠে দাঁড়ালো হিয়া। বলল, এবার আসি । কাজ থাকলে একটু আগেভাগে জানাবেন। না হলে সেই পিয়ারলেসের মতন পার্টি বেরিয়ে যাবে।


সে কি যাচ্ছো কোথায় ? আর এক কাপ চা খেয়ে যাও।

আজ না মুখার্জি'দা। এখন চলি। একটা জায়গায় যাবো। আজ বিকেলে আবার নাকি ঝড়-ফর আসছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।



রাস্তায় নামার সাথে সাথে আকাশ কালো করে এলো। পাশেই কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। ঠান্ডা হিমেল বাতাস দেহ ছুঁয়ে যাচ্ছে। মুহূর্তে সব ক্লান্তি , সব গ্লানি কোথায় উধাও হয়ে গেল। হিয়া ভাবলো হেঁটেই যাবে। আজ হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে এরকম হয়। সেবার সূর্যসেন স্ট্রিট থেকে একনাগাড়ে হেঁটে পৌছালো বেনিয়াপুকুর। মেলা রাস্তা। তাও হাঁটতে ভালোলাগছিলো। হাঁটলে মনে হয় মনের দুঃখ কমে। শরীর হালকা হয়। মাঝে মাঝে শরীরে মেদে'র থেকে দুঃখের ওজন বেশি থাকে।


হিয়া'র গন্তব্য বৌবাজারের 'আকাশ প্রোডাকশন' । এর আগেও এখানে গেছিলো সে। এই নিয়ে নবম যাত্রা। আগের আটবারের অডিশন থেকে কোনো ফোন আসেনি। এবারেও হয়ত আসবে না। তাও যদি আসে ! স্বপ্ন থাকা ভালো। আশা থাকা ভালো। এটা একপ্রকার আকাশে ঢিল ছোড়ার মতন। মাঝে মাঝে সেই ঢিল আর মাটিতে পরে না। আকাশেই থেকে যায়। স্বপ্নের মতন। 



'আকাশ প্রোডাকশন' বাড়িটি দোতলা। নিচে দুটি এবং ওপরে দুটি ঘর। এর মালিক সঞ্জীব'দা। এককালে নাটক থিয়েটার করতেন। এখন উঠতি অভিনেতাদের চান্স করিয়ে দেন। 


সঞ্জীব'দার অফিসটা নিচের ঘরে। বেশ সুন্দর করে সাজানো। দেওয়ালে প্লাস্টিক পেইন্ট করা । সারা ঘরে উত্তম-সুচিত্রার ফটো। হিয়া নিচের ঘরে ঢোকা মাত্র সঞ্জীব'দা বলে উঠলেন, আরে , এসো এসো। বসো। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। তুমি না আসলে বেজায় বেইজ্জত হয়ে যেতাম আজ।


কাঠের চেয়ারে বসতে বসতে হিয়া বলল, সেকি সঞ্জীব'দা ! এরকম বলছ কেন ?


আর বলো না। আসার কথা ছিল তিনজনের। শেষ মুহূর্তে ফোন করে বলে কিনা একটা অ্যাড ফ্লিম পেয়ে গেছি সঞ্জীব'দা, আজ আর আসছি না। এরা তো আর বুঝবে না , ফেস হলো একটা প্রোডাক্ট। যেখানে সেখানে দেখিয়ে দিলে বড় পর্দায় কি আর মানুষ নেবে ? 


হিয়া বলল, তারা কি এসে গেছেন ?


এসে গেছেন মানে ! উপরের ঘরে বসে আছে। শোনো হিয়া , প্রযোজক পরিচালক দুজনেই এসেছে। এই চান্স বার বার আসে না। একটাই ডায়লগ দেবে ওরা তোমায়। তিনটে সিনের তিন রকম সিকুয়েন্স নিয়ে নামাতে হবে। তাই মোট তিনটে চান্স পাবে। যদি লেগে যায় একেবারে মূল চরিত্রে নায়িকার রোল। আর পয়সাটা'ও খারাপ দেবে না। দু লাখ। তবে আমার টেন পার্সেন্ট কেটে তুমি হাতে পাবে।


সাদা বুটিকের শাড়ির আঁচলে কপালের ঘাম মুছে হিয়া বলল, এই রে এটাও মনে হয় তাহলে গেল। আমি তো সাইড রোল ভেবে এসেছিলাম। দেখতেই পাচ্ছো মেকআপ নেই, শাড়ি পরে আছি। নায়িকার চরিত্রে এসব মানাবে !


উফফ, তুমি ওসব ভেবো না। আমায় দেখো , কত থিয়েটারে আমি শুধুমাত্র একটা লাইন বলে নেমে এসেছি। অতটুকুই চরিত্র পেয়েছিলাম আর সেটাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। আসল হলো অভিনয়। তুমি শুধু ওদের সামনে গিয়ে শট তিনটে ভালো ভাবে দাও। বাকি উপরওয়ালা।


সঞ্জীব'দার উপরওয়ালা বেছে বেছে  কিছু মানুষের উপর সদয় হন। হিয়া'র মতন মানুষের জন্য তার হাতে সময় কম। হিয়া সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে কাঠের দরজায় টোকা মেরে বলল, আসতে পারি ?


ভিতর থেকে একজন বলল, আসুন। হিয়া দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখে দুটো লোক বসে আছে। বেশ এলোমেলো একজনের পোশাক আর বেজায় রোগা। অন্যজন বেশ ফিটফাট আর চটপটে মনে হচ্ছে। সেই মানুষটাই বলল, বসুন , বসুন , আপনার নাম কি ?


আজ্ঞে , হিয়া।

আশাকরি সঞ্জীব আপনাকে সবই বলেছে তাও আমাদের কিছু জানার আছে আপনার কাছে।

বলুন।

আপনি এর আগে কোথাও কাজ করেছেন ? মানে অভিনয় ?

না।

সেকি! তা অভিনয় জানেন কিভাবে করতে হয় ?

অডিশন দিতে দিতে অভিনয় শিখে নিয়েছি।


সেই চটপটে ছেলেটি হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, বেশ বলেছেন তো। অডিশন দিতে দিতে অভিনয় শিখে ফেলেছি। আপনাকে একটা কথা বলি , দেখুন অভিনয় জিনিষটা একটা বিট'এর ব্যাপার। ওই বিট'টা ধরতে পারলেই গেম ওভার। যেমন ধরুন আপনি যতই ভালো তবলা বাজাতে পারুন না কেন আসল বাজিয়ে তখনই হবেন যখন ওই বিট'টা ধরতে পারবেন।


বুঝলাম। আমায় কি করতে হবে ?


হ্যাঁ , এটা একটা ভালো প্রশ্ন। আপনাকে আগে সিকুয়েন্স বলে দিই। একটি মেয়ের বিয়ে হয়েছে। মাস দুয়েক পর তার স্বামী উধাও হয়ে গেছে। আজ তিন বছর পর সে হঠাৎ তার স্বামীকে দেখতে পেলো। তাই চরিত্র'টি একটা ডায়লগ বলবে। একটাই কথা তিন রকম ভাবে বলবে। 'একি পরিমল , তুমি এখানে?'

এটাই আপনাকে একবার অবাক হয়ে , একবার রেগে গিয়ে আর একবার নরম ভাবে খুব পোলাইট হয়ে বলতে হবে। আপনি ওখান থেকে হেঁটে আসবেন, এইখানে দাঁড়াবেন আর ঠিক এই দিকে তাকিয়ে বলবেন। 


কিছুটা হাফ ছেড়ে হিয়া বলল, ওকে।


হিয়া হেঁটে এসে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে বলল, 'একি পরিমল , তুমি এখানে ?


সঙ্গে সঙ্গে সেই রোগা ছেলেটি বলে উঠলো, উহু , হচ্ছে না। আপনার ঠোঁট কাঁপছে। মনে রাখতে হবে এই মহিলা গ্রামের মেয়ে। সে খুব সাধারণ ভাবে কথাটা বলবে অথচ তার মধ্যে একটা ফিলিংস থাকবে। আবার করুন।


প্রায় দু'ঘন্টা সেই এক সংলাপ বলে গেল হিয়া। মাথায় জেদ চেপে গেছিলো তার। এদিকে পেটে একটাও দানা পড়েনি সেই সকালের পর। 


অনেক সময় পর মনে হলো তাদের মনের মতন হয়েছে। সেই চটপটে ছেলেটি বলল, আপনার নাম আর ঠিকানা সঞ্জীবের কাছে দিয়ে যান। আপনাকে সিলেক্ট করলে ফোন করা হবে।


হিয়া আর থাকতে না পেরে বলল, একটি প্রশ্ন করতে চাই আপনাদের।


বলুন, সেই চটপটে ছেলেটি বলল।

মানে বলছিলাম যে আপনাদের কি ভালো লেগেছে আমার কাজটা? মানে তাহলেই আমি অপেক্ষা করবো। এই নিয়ে আট বার আমায় রিজেক্ট করা হয়েছে। এটা রিজেক্ট হলেও ক্ষতি নেই। তবে আমি অহেতুক আর অপেক্ষায় থাকতে চাইছি না।


হিয়া ভাবলো কথাগুলো মনে হয় একটু কাঠ কাঠ হয়ে গেল। সচরাচর এই সময় মেয়েরা রোল পাওয়ার জন্য মন ভেজানো কথা বলে। সেই রোগা ছেলেটি বলল, আপনি কাজকর্ম কি করেন ?


হিয়া বলল, এই প্রশ্নের উত্তর কি সত্যি'ই এখানে প্রয়োজন ?

প্রয়োজন না হলে করতাম না। 

আমি বেকার। 

আপনার কি মনে হয় আপনি একজন অভিনেত্রী হতে পারবেন ? 

তা জানি না। তবে একটা চান্স নিতে ক্ষতি কি ! যদি হয় ভালো , না হলে সেটা আমার হাতে নেই।


রোগা ছেলেটি এবার একটা সিগারেট ধরালো। পাশে বসে থাকা সেই চটপটে ছেলেটি বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আপনি এবার আসুন।


হিয়া উঠতে যাচ্ছিল তখনই রোগা ছেলেটি বলল, আপনি অসিত'কে চেনেন নিশ্চই !

মাথায় যেন বাজ পড়লো হিয়া'র। কি বলবে বুঝতে না পেরে বলে উঠল, খুব কি অন্যায় ওনাকে চেনা ?

ছেলেটি বলল, আমার নাম অঞ্জন । আমি অসিতের ছোট বেলার বন্ধু। আমি আপনাদের রাস্তায় একদিন দেখেছিলাম। মাঝের দু-তিন দিন হলো অসিতের কোনো খবর নেই। আপনি কি জানেন ও কোথায় আছে ?


হিয়া অবাক হয়ে বলল, সেকি! এটা তো জানা ছিল না। আপনি হয়ত জানেন না ওনার অফিসের লোকজন'ও ওনাকে খুঁজছে। ফোনে পাচ্ছেন না ?


সিগারেট'টা নিভিয়ে অঞ্জন বলল, নাহ। জানি না কোথায় গেল। এদিক ওদিক অনেক দেখলাম। কোথাও নেই । ভাবছি পুলিশে যাবো কিনা ! আসলে ও খুব মানসিক চাপে ছিল।


জানি। কোনো এক বন্ধুর ওকে মদ খাইয়ে ছেড়ে গেছিলো। সেদিন রাস্তায় পরে মুখ ফাটিয়ে একাকার কান্ড। আমি দেখতে পেয়ে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম। তারপর আর কথা হয়নি।



                               ।। ষোলো ।।


অসিত আজকাল কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। একগাল দাড়ি , গা'য়ের পোশাক শেষ কবে ধুয়েছিলো জানা নেই। অসহ্য দুর্গন্ধ আসে। তবু সে এসবের কিছুই বুঝতে পারে না। সে শুধু হেঁটে চলে। চলতে চলতে সে কোথায় এসে পৌঁছেছে নিজেও বুঝতে পারে না। কোনোদিন খাবার পায় , কোনোদিন না খেয়ে'ই শুয়ে পরে রাস্তায়। এরকম যে কতদিন ধরে হচ্ছে তারও কোনো হিসেব নেই তার কাছে। কেউ যখন দয়াপরোবশ হয়ে প্রশ্ন করে , তোমার বাড়ি কোথায়? সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যায় তার কাছে। নিজের নামটাও বলতে পারে না। 


তবুও এসবের মাঝে হঠাৎ রাতের ঘুমের আচ্ছন্নতায় তার মনে পরে দুটি লাইন -


এসো , পুরোনো অতীত , বুকেতে যন্ত্রনা লুকিয়ে

আজ ভরাবো জোৎস্না'মাখা শহরের প্রান্তর হতে।


দূর হতে কে যেন বলে এই লাইন দুটি। তার মুখ দেখবার জন্য অনেক হন্যে হয়ে এগোতে গেলেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। চোখ খুলে সে দেখে নীল আকাশ। তার মনে প্রশ্ন আসে , সে কে ? কি তার পরিচয় ?


আজ সকালে তার ঘুম ভাঙলো লাল সিমেন্টের এক দালানের উপর। চোখ খুলে সে দেখলো প্রকান্ড এক বাড়ি। বড় বড় দরজা জানালা। যার হয়ত মূল ফটকের সামনে সে শুয়ে ছিল। আসে পাশে কেউ নেই। শুধু একটি রাস্তা যা চলে গেছে পাশের এক অরণ্যের নাভির ভিতর। হঠাৎ একটা মাঠের উপর এরকম প্রাসাদ প্রমান বাড়ি কে বানালো সেটাও একটি চিন্তার বিষয়।


ঘুম থেকে উঠে অসিত আবার হাঁটবে বলে পথে থামলো। ঠিক সে সময় মূল ফটক খুলে গেল। একটি গেঞ্জি পরা ভৃত্য বাইরে এসে বলল, আপনে ভিতরে আসেন। বাবাঠাকুর আপনাকে ডাকতেছেন।


অসিত কিছু বুঝলো না। সে সেই বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলো। এঘর ওঘর হয়ে তাকে একটি প্রকান্ড ঘরের মধ্যে নিয়ে আসা হলো। সেই ভৃত্য বলল, আপনে এখানে বসেন। আপনারে ডাকুম । অসিত বসলো একটি কাঠের চেয়ারে। তার গা থেকে অতীব দুর্গন্ধ আসছে। চুল দাঁড়িতে জট পাকিয়ে উঠেছে। কিছু সময় পর সেই ভৃত্য এসে বলল, আসেন , ভিতরে আসেন।


অসিত প্রবেশ করলো আরেকটি ঘরে। তার সামনে একটি পালঙ্ক। চারিদিকে সুন্দর কাঠের আসবাবে মোড়া সেই ঘর। আর পালঙ্কে বসে আছে একজন। ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পড়া। বয়স প্রায় ষাট। বা হয়ত তারও বেশি। তিনি বললেন, তোমার নাম কি অসিত ?


অসিত দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, মনে নেই। 


তিনি বললেন, মনে নেই ! অদ্ভুদ। তা তোমার বাড়ি কি কলকাতায় ?


মনে নেই।


হঠাৎ ঘরের পিছনের পর্দার আড়ালথেকে এক মহিলার কন্ঠস্বর শোনা গেল , ওনার নাম অসিত। উনি আমার মাস্টার মশাই ছিলেন।


লোকটি পিছনে একবার তাকিয়ে অসিত'কে বললেন, তোমার কিছুই মনে নেই ?


না।


আচ্ছা ঠিক আছে। মনে করতে হবে না। বলেই সেই ভৃত্য'কে বললেন, এনাকে স্নান করিয়ে ভালো পোশাক পরাও। আর আহারের ব্যাবস্থা করো। আমি বিকেলের দিকে আবার ওনার সাথে কথা বলবো।


এখন সন্ধ্যে ।

অসিত বসে আছে ছাদে। আকাশে বেশ কিছু বক উড়ে যাচ্ছে। তার পরণে সুন্দর একটি পাঞ্জাবি । চুল দাড়ি কামানো। তবুও সে ভাবছে তার প্রকৃত পরিচয় কি। পিছন থেকে একজন বলল, আপনি কিছু খাবেন ?


অসিত পিছনে না ঘুরেই বলল, না। এটা কোন জায়গা ? আপনারা কারা ?


এ জায়গার নাম বর্ধমান । আর আপনি রায়চৌধুরী বাড়িতে আছেন। অতীতে এই পুরো অঞ্চল এদের'ই ছিল। আজ সকালে ছোট বউ আপনাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসতে বলেছিল।


ছোট বউ ? , অসিত অবাক হয়ে বলল, সে কে ?


সে নাকি আপনাকে চেনে। আপনি তার মাস্টার ছিলেন ।


আমি ! , এবার সে পিছনে ফিরলো। দেখল এক বিধবা সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সেই মুখ দেখতে গিয়ে আবার তার মাথা ঝনঝন করে উঠলো, শুরু হলো গুঞ্জন,


এসো , পুরোনো অতীত , বুকেতে যন্ত্রনা লুকিয়ে

আজ ভরাবো জোৎস্না'মাখা শহরের প্রান্তর হতে।


অসিত মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে পড়লো। ব্যাথা খুব ব্যাথা হয় মাথায় , বলতে বলতে আছন্ন হয়ে গেল।তারপর সব অন্ধকার।


(চলবে...)