![]() |
স্ব প্ন রা ক্ষ স
বুমা ব্যানার্জী দাস (কানাডা)
বিড়লা সভাঘর। তিন দিনের সেমিনার শেষে ক্লান্ত ডক্টর পূর্বা মিত্র অডিটোরিয়ামের বাইরে অতিথিদের জন্য পেতে রাখা সোফাতে এলিয়ে পড়ে। এই সেমিনারের সব ভার তার উপরই ছিল। সেমিনারের বিষয় ছিল Sleep disorder অর্থাৎ কি কি কারণে মানুষ ঘুমিয়ে পড়তে পারেনা বা কি কি কারণে মানুষের ঘুমের বিঘ্ন ঘটে।প্রত্যেকদিন সেমিনারের শেষে কিছু আমন্ত্রিত অতিথিদের নিজস্ব অনিদ্রার বা অনিদ্রাজনিত নানা ঘটনার অভিজ্ঞতা সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগও ছিল। এই তিন দিন সময় বের করার জন্য পূর্বাকে খাটতে হয়েছে বিস্তর। পেশায় সে ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট।প্রায় পাঁচ বছর হলো সে কলকাতা পুলিশের ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। যে সমস্ত অপরাধের কোনো মোটিভ পাওয়া যায়না বা অপরাধী ধরা পড়লেও নিশ্চিতভাবে বলা যায়না সে সত্যি অপরাধী কিনা অথবা সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার কারণে অপরাধ হয়ে থাকলে সেই সমস্ত ক্ষেত্রে ডাক আসে তার। ব্রিলিয়ান্ট অ্যাকাডেমিক রেকর্ডের পাশাপাশি সহজাত মেধা ও বিচক্ষণতা তাকে তিরিশের আগেই এই জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।সাহসও সাংঘাতিক। এক ডাকে চেনে লালবাজারের সবাই। মজা করে বলে ডক্টর মিত্র যদি নিজে খুন করেন কারুর ধরার সাধ্য থাকবেনা। অবিশ্যি দুই একটা মশা মাছি ছাড়া আর কিছু মারার সাধ্য পূর্বার নেই।এই সেমিনারে তার নিজস্ব বক্তব্যের বিষয় ছিল মানুষের অপরাধপ্রবণতার উপর অনিদ্রার প্রভাব।
ক্লান্ত পূর্বা নিজের মনেই ভাবছিল অপরাধীদের সে যতটা বোঝে সাধারণ মানুষকে ততটা বোঝে কিনা। হঠাৎ খেয়াল হলো সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুখ তুলে দেখে বছর উনিশ কুড়ির ফ্যাকাশে একটি মেয়ে। সেমিনারের অতিথিদের কেউ নাকি। ঠিক মনে করতে পারল না পূর্বা।
-কিছু বলবে?- সদ্য কৈশোর পেরোনো মেয়েটিকে আপনি বলার ইচ্ছা হলোনা পূর্বার।
খুব আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বললো মেয়েটি - আমিও ঘুমাতে পারিনা।
বসো- সোফাটা দেখিয়ে বলল পূর্বা। -তুমি আলোচনা শুনলে আমাদের? তোমার নাম আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে আছে নিশ্চয়ই।- অতিথিদের তালিকার প্রিন্টআউট চোখের সামনে তুলে ধরে পূর্বা।
মেয়েটি আগের মতোই প্রায় ফিসফিস করে বলে - আমি যে কারণে ঘুমাতে পারিনা সেটা আপনারা আলোচনা করেননি।- পূর্বার হঠাৎ হাসি পায়। এইটুকু একটা মেয়ে, কি এমন কারণ থাকতে পারে তার অনিদ্রা রোগের। হেসে বলেন - আচ্ছা তুমিই বলো কি কারণ।- মেয়েটি অনেকক্ষন চুপ করে থাকে। মনে মনে সামান্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে পূর্বা। হঠাৎ তীব্রস্বরে ফ্যাসফ্যাসে গলায় মেয়েটি বলে ওঠে - আমি স্বপ্ন দেখছি না জেগে আছি বুঝতে পারিনা- ছুটে বেরিয়ে যায় মেয়েটি। পূর্বা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বসে থাকে। মানুষের মনের অন্ধকার গলিতে ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ। এ কাজ সে ভালোবাসে। কী বলতে চাইল মেয়েটি? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে? সে তো ভাবুক প্রকৃতির মানুষরা দেখেই থাকে। কিন্তু এ নিশ্চয়ই তা বলতে চাইল না। যে সামান্য সময়ের জন্য চোখ তুলে তাকিয়েছিল তাতে আতঙ্ক চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি পূর্বার। ইশ মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানা হলনা। বেশ অস্বস্তি নিয়ে অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে এল ডক্টর পূর্বা মিত্র।
মধ্য কলকাতার একটি গলি শেষরাতের অন্ধকারে ঝিমঝিম করছে।দোতলা একটি সাজানো বাড়ি নিঝুম দাঁড়িয়ে। দোতলার খোলা জানালা দিয়ে শেষ ফাল্গুনের হাওয়া সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। বিছানায় ঘুমন্ত মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী। পাশের ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তাঁদের কনিষ্ঠ সন্তান, ঐশিক। হঠাৎ কোনও এক অস্বস্তিতে ঘুম ভেঙে যায় ভদ্রলোকের। বিছানায় উঠে বসে দরজার দিকে তাকান তিনি। হাওয়ায় জানলার পর্দার সাথে দরজার পর্দাও উথাল পাথাল হচ্ছে। খুব বেশি হাওয়া যেন। ঘরের নীলচে নাইটল্যাম্পের আলোয় মনে হয় পর্দার ওপারে আবছা একটা ছায়া।
- কে?
উত্তর আসে না কোনও। পর্দার ওপারের ছায়া পর্দা সরিয়ে ঘরে সামান্য ঢুকে আসে। সাদা রাতপোশাক পরা আবছা এক মূর্তি।
- ওহ তুই? আজও ঘুম আসেনি? আয় এসে বস।- বিছানার একপাশে সরে গিয়ে মেয়ে ঈশিতার জন্য জায়গা করে দেন ভদ্রলোক।
ছায়ামূর্তি আরো এগিয়ে আসে। ভঙ্গিটা সামান্য অদ্ভুত। যেন ঘুমের মধ্যে হাঁটছে সে। হাতদুটো সামনে বাড়িয়ে ধরা।
পাশের ঘর থেকে চাপা গোঙানি শুনে ঘুম ভেঙে যায় ঐশিকের। মায়ের গলা না? কয়দিন ধরে দিদিকে নিয়ে একটু সমস্যা চলছে। কোনও ভালো মনস্তত্ত্ববিদকে দেখানোর কথা হচ্ছে। কিন্তু মায়ের আবার কী হল। দ্রুত পায়ে পাশের ঘরে যায় ঐশিক।
তিনদিন ধরে সেমিনারে ব্যস্ত থাকাতে একরাশ কাজ জমে গেছিল পূর্বার। সকাল থেকে তাই নিয়ে লড়ে চলেছে। লাঞ্চটাও কফি দিয়েই সারবে ভাবছে এমন সময় ফোনটা এলো। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সোমনাথ রায় জানালো মধ্য কলকাতার এক সম্পন্ন পরিবারের যুবতী তার বাবা মা ও ভাইকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। হত্যাকারী সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই বটে কিন্তু হত্যাকারীর আচরণ ও মোটিভের অভাব তাদের বাধ্য করেছে ডক্টর মিত্রের শরণাপন্ন হতে।ইনস্যানিটি বা অন্য কোন মানসিক সমস্যা থাকলে তার বিচারপদ্ধতি একেবারেই আলাদা।যুবতীর নাম ঈশিতা সেন। লালবাজারে পুলিশের হেফাজতেই আছে সে আপাতত।
একবার দেখেই চিনতে কোনো ভুল হলো না পূর্বার। সেই মেয়ে। অদ্ভুত একটা অপরাধবোধে ছেয়ে গেল তার মন। মেয়েটি এসেছিল তার কাছে। কেন সাহায্য করলনা তখন পূর্বা, কেন আরো তলিয়ে দেখলনা। হয়তো আটকানো যেত।
কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের কাঁচে ঘেরা ছোট্ট একটি ঘর। ঘরে দুজন মানুষ। ডক্টর মিত্র ও অভিযুক্ত ঈশিতা সেন। Open and shut কেস হওয়া সত্বেও কেস ক্লোজ করা যায়নি এখনো। এরকম অদ্ভুত মোটিভবিহীন খুন কখনো দেখেনি পূর্বা।
- তুমি ঘুমাতে পারোনা কেন ঈশিতা?- নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে পূর্বা।
জড়ানো গলায় ঈশিতা আবার বলে - আমি স্বপ্ন ভেঙে বেরিয়ে কেন আসছিনা?
- তুমি তো জেগে আছ দেখ। কেন মনে হচ্ছে তুমি স্বপ্ন দেখছ?
ঈশিতা চুপ। পূর্বা আবার বলে - স্বপ্নে কী দেখেছিলে কিছু মনে আছে ? -চোখ তুলে তাকায় ঈশিতা। বিভ্রান্ত দুই চোখ, আতঙ্কিত। বিড়বিড় করে মনে হলো বলছে - সে আসবে,সে আসবে।
পূর্বা ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সোমনাথ রায় কে জানায় সে ইনস্যানিটি বা স্প্লিট পার্সোনালিটি মানে বহুব্যক্তিত্ব দুটোর কোনোটারই কোনও লক্ষণ পাচ্ছে না ঈশিতার মধ্যে। খুনের ঘটনা খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে ওর, কিন্তু কেন সে এই কাজ করল তার কোনো উত্তর পূর্বা বের করতে পারেনি ওর কাছ থেকে। ঈশিতার ধারণা ও যা করেছে স্বপ্নের মধ্যে করেছে, তারপর নাকি জেগে ওঠার কথা। এইটুকু ছাড়া মানসিক কোনও বিকার কোনোভাবেই তার নেই।
- কিন্তু রায়, ওর ভয়টা খুব স্পষ্ট ও সত্যি। একেবারেই কাল্পনিক নয়। কিসের এত ভয় পাচ্ছে ও। পূর্বা হতাশ ভাবে বলে। বেশ কিছু খুনীর ইভ্যালুয়েশন করেছে সে। সিরিয়াল কিলারও যে দেখেনি তা নয়। কিন্তু ঈশিতা যে খুনগুলো করেছে তার সব প্রমান থাকা সত্ত্বেও মেয়েটা যে খুনি সেটা মেনে নিতে অসুবিধা কেন হচ্ছে তার। আগে সাহায্য করলে হয়তো খুনগুলো আটকানো যেত এই অপরাধবোধ থেকে, না অন্য কিছু? নিজের কাছেই পরিষ্কার হয়না সেটা।
পরিবারের বাকিদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করার অভিযোগে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়া হলো ঈশিতাকে। ঈশিতা সেন, বয়স উনিশ।পূর্বার মনে হতে লাগলো কিছু একটা মিস করছে সে।কিছু একটা তার অবচেতনে সে যেন বুঝতে পেরেছে, কিন্তু সচেতন মনের অগোচরেই সেটা থেকে যাচ্ছে। রায়ের ফোনটা এলো আবার দুপুরবেলা। পুলিশ কাস্টডিতে, পরিবারের বাকিদের মতোই শ্বাসরোধ করে কেউ হত্যা করেছে ঈশিতাকে। না, কেউ আসেনি তার সাথে দেখা করতে, সে একাই ছিল পুরো সময়টা।
- রায় একাজ আমার দ্বারা আর হবেনা।
- কী বলছ পূর্বা। তোমার মত এবল্ খুব কম মানুষই আছে। ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়।
- যে ভুলে প্রাণ পর্যন্ত যেতে পারে? আমি এখনো সম্পূর্ণ ভাবে যোগ্য হতে পারিনি।
সোমনাথ রায় জানে পূর্বা মিত্র ঝোঁকের মাথায় কিছু করেনা। আর একবার কিছু করবে স্থির করলে সেটা আটকানোও যায়না।
নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিল পূর্বা।এতটা ভুল সে কিভাবে করতে পারলো। তার কাছে এসেছিল ঈশিতা নিজের থেকে। হয়ত সোজাসুজি সাহায্য সে চায়নি, কিন্তু তাকে কিছু বলতে চেয়েছিল সে।এত বছরের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারেনি পূর্বা। তাকে তার মনের অন্ধকারে একা ছেড়ে দিয়েছিল। এরপরই সব কিছু থেকে সরে যায় পূর্বা। পুলিশ ঈশিতার মৃত্যুর তদন্ত শুরু করেছিল বটে তবে বেশি দূর এগোতে পারেনি। কোনরকম সূত্র তারা পায়নি।কিছুদিন পর কোল্ড কেস ফাইলে যোগ হয়ে গিয়েছিল ঈশিতা হত্যা তদন্তের ফাইল। পরিবারের বাকি মানুষগুলোর হত্যা যে ঈশিতাই করেছিল তাতে যদিও কোনও সন্দেহর অবকাশ ছিলনা, তবুও কোনও সন্তোষজনক কিনারা করা যায়নি।একদিন সবাই ভুলেও গেল এই অদ্ভুত অমীমাংসিত হত্যা রহস্য।
তিন বছর যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো। তিন বছরের আগের জীবনটা পূর্বার কাছে স্বপ্নের মতো লাগে। সে আর আগের মতো একেবারেই নেই।নিজের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে প্রথমেই ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট-এর পদ সে ত্যাগ করেছিল। তার দক্ষতায় আর কারুর সন্দেহ না থাক, নিজেকে সে আর বিশ্বাস করতে পারতো না। সোমনাথ রায়ের সাথে পেশাগত সম্পর্কের পাশে যে আরো কোনো গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিতে শুরু করেছিল সেটা থেকেও স্বেচ্ছায় দূরে সরে গেল। তীক্ষ্ণ রসবোধ থাকলেও স্বভাবে খুব বেশি চপলতা তার কোনোদিনই ছিল না, ধীরে ধীরে গাম্ভীর্যই তার পরিচয় ও স্বভাব হতে শুরু করল।
তিন বছর ধরে সে আর ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট নয়, কেবল সাইকোলজিস্ট।
সাইকোলজিস্ট ডক্টর পূর্বা মিত্রের চেম্বার। ঠিক সাড়ে সাতটায় চেম্বার বন্ধ করে সাধারণত বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় পূর্বা। গত তিন বছর সে নিজেকে অনেক গুটিয়ে নিয়েছে। খুব বেছে পেশেন্ট নেয়। ঠিক সাতটায় তার প্রাইভেট নম্বরে কল এলো। একটু অবাক হলো পূর্বা। এই নম্বর জানে হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র। সাধারনত চেম্বারে কেউ থাকলে এই প্রাইভেট নম্বরে কল সে নেয় না। আজ সোমবার হলেও চেম্বার আশর্যজনক ভাবে ফাঁকা। বেরিয়ে যাবেই ভাবছিল, বড়ো ক্লান্ত লাগছে।গত দুই রাত একেবারেই ঘুমাতে পারেনি সে,আজ ঘুমের জন্য কোনো ওষুধ নেবে কিনা সেটাই ভাবছিল।
ডাক্তার নিজেকে সুস্থ করো আগে - নিজের মনেই মৃদু হেসে কল রিসিভ করলো পূর্বা।
-হ্যালো, ডক্টর মিত্র স্পিকিং-
ওপাশ থেকে গম্ভীর, ভীষন পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে - কেমন আছো পূর্বা?
পূর্বা মিত্রের মনে হয় কেউ যেন হঠাৎ রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে সবকিছু মিউট করে দিয়েছে। আর কোনো শব্দ কানে যাচ্ছে না তার। তিন বছর - ঠিক তিন বছর দুই মাস পর এই গলা শুনছে পূর্বা মিত্র। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সোমনাথ রায়। তীক্ষ্মবুদ্ধি, স্বভাবগম্ভীর রায়ের সুদর্শন চেহারাটা মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল এক তীব্র যন্ত্রণার সাথে। ডক্টর পূর্বা মিত্রের তেত্রিশ বছরের জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল মিশে আছে সেই স্মৃতির সাথে।
-পূর্বা - আর ইউ দেয়র? রেখে দিও না প্লিজ।-
-নাঃ, বলো - ডক্টর মিত্র নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে।
-আই নিড টু টক টু ইউ পূর্বা- পূর্বা চুপ এখনো। ঈশিতার প্রায় ভুলে যাওয়া মুখটা হঠাৎ ভেসে ওঠে চোখের সামনে। হু হু করে মনে পড়ে যেতে থাকে সব।
-আমি জানি তুমি শুনছো পূর্বা - রায়ের গলা পূর্বাকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে।
-তুমি কি ঠিক আছো? কাল অত রাতে তুমি আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসেছিলে, অথচ কারুর সাথেই দেখা করলেনা, কাউকে না জানিয়ে চলেও গেলে। কী ব্যাপার বলবেনা?- ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টরের গলার উদ্বেগ লুকানো থাকেনা। চমকে ওঠে পূর্বা। কি বলছে রায়? সে ডিপার্টমেন্টের ত্রিসীমানায় যায়নি আজ তিন বছর। মজা করছে নাকি। নিশ্চয় নয়। এমন উদ্ভট রসিকতা করার স্বভাব তো রায়ের নয়। সেই কথাই বলে সে।সোমনাথ বলে-কি বলছ পূর্বা? আমি নিজের চোখে দেখেছি তোমাকে,একটু দূর থেকে হলেও চিনতে এত ভুল তো হবেনা। তার উপর দেখে মনে হচ্ছিল যেন তুমি স্লীপওয়াকিং করছ।-
এই একটা শব্দ - স্লীপওয়াকিং - যেন মাথার মধ্যে তুবড়ী ফাটিয়ে দিল পূর্বার। কেন তার মনে পড়েনি আগে। তিন বছরের চাপা দিয়ে রাখা সমস্ত আবেগ, উদ্বেগ যেন ফেটে বেরিয়ে আসে। তীব্র গলায় চিৎকার করে উঠল- ডেকার্ট, সোমনাথ - ডেকার্ট।খেয়াল করল না এতদিনের পোশাকী রায় সম্বোধন ভুলে সোমনাথ বলে ডেকে উঠেছে সে। ডিটেকটিভ সোমনাথ রায় ডেকার্ট কে বা কি অথবা কেন কিছুই বুঝতে পারলো না।
রাত আটটা।ঝড়ের মতো ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ঢোকে ডক্টর পূর্বা মিত্র। সেই আগের মত। কাঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল এলোমেলো, কিছু প্রায় খাড়া। কপালের ঘন খয়েরী টিপ মাঝখান বরাবর বসেনি, সামান্য বাঁ দিক ঘেঁষে বেঁকে আছে। কাঁধে লাল সবুজ গোলাপী পিপলির কাজ করা ঝোলা। ঢুকেই সামনে সোমনাথকে দেখতে পেয়ে বলতে থাকে- সপ্তদশ শতকের ফরাসি দার্শনিক রেনে ডেকার্ট ।আমি তিন বছর আগে স্লীপ ডিসঅর্ডার নিয়ে সেমিনার করেছিলাম মনে আছে? যেখানে আমার সাথে প্রথম ঈশিতার দেখা হয়? সেই সময় ডেকার্টের তত্ত্ব নিয়ে বেশ খানিকটা পড়াশোনা করেছিলাম। তিনি এক ইভিল ডিমন বা অশুভ শক্তির কথা বলছেন যে আমাদের বাস্তব পৃথিবী আর স্বপ্নের দুনিয়ার মধ্যে তফাৎ বোঝার ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারে। -প্রায় হাঁফাতে থাকে পূর্বা। বাদামী ফ্রেমের পেছনে জ্বলজ্বল করছে টানা টানা চোখদুটো।
- আস্তে, একটু বুঝিয়ে বল পূর্বা- সোমনাথের চোখ কিঞ্চিৎ গোল হয়ে ওঠে।
-আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে জগৎ আমরা চিনি তো? - ফের রেলগাড়ি ছোটায় পূর্বা।-কিন্তু ধরো চোখ দিয়ে আমরা যা দেখছি, কান দিয়ে যা শুনছি সেই ইনপুটগুলো যদি কেউ ইচ্ছামত পাল্টে দেয়? আর সে যদি কোন অশুভ শক্তি হয়? ধর তোমার মনে হচ্ছে যে তুমি সমুদ্রের ধারে বসে আছো, কিন্তু তুমি সেটা স্বপ্নে বসে আছো না বাস্তবে সেটা তুমি জানোনা। সমুদ্রের ধারে বসে থাকার অনুভূতিটা স্বপ্নেও তো পাওয়া সম্ভব? তাহলে যে অনুভূতিগুলো সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত নই যে স্বপ্নে হচ্ছে না বাস্তবে হচ্ছে, সেটাই এই ডিমনের টার্গেট।ঘুমিয়ে আছি না জেগে আছি সেই বোধটাই সে গুলিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবে যা দেখছি বা বুঝছি তার সত্যাসত্য বিচার করার ক্ষমতাও হারিয়ে যাবে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সোমনাথ রায়। কি বলছে পূর্বা এগুলো। এগুলো তো কতগুলো মিথ, কতগুলো তত্ত্ব, যার কোনো প্রমাণ নেই। অবিশ্বাসটা বোধহয় চোখে ফুটে উঠেছিল। পূর্বা তীব্রভাবে আবার বলে উঠলো - আমার ধারণা আমি কাল রাতে কোথাও বেরোইনি রায়। অথচ তুমি আমাকে দেখেছ। ঈশিতা ঘুমাতে পারতো না, অথচ সে ভাবত স্বপ্ন দেখছে। আসলে বাস্তবটাকেই সে স্বপ্ন বলে মনে করত। তার বাড়ির লোককে সে কী রূপে দেখত সেটা জানার উপায় আর নেই। হয়ত সেই স্বপ্ন ভেঙে বেরোতে চেয়েই খুনগুলো সে করে।এছাড়া স্বপ্ন ভেঙে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় সে আর খুঁজে পায় নি। কিন্তু আসলে যে ঘোর বাস্তবেই সে খুনগুলো করছে সেটা সে একবারও বুঝতে পারেনি। আমার ধারণা আমি কাল ঘুমাতে পারিনি রায়। বাড়িতেই বসে ছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে এখানে দেখেছ। কার বাস্তব বোধ গুলিয়েছে মনে হয়? তোমার না আমার?
বিশ্বাস অবিশ্বাস এর মাঝে মাথা গুলিয়ে যায় সোমনাথের। তারি মাঝে পূর্বা বলে ওঠে - আমাদের দুজনেরই এবার প্রাণ সংশয় সেটা বুঝতে পারছ কি? একইভাবে শ্বাসরোধ করে খুন হয় আমি তোমাকে করবো, নয় তুমি আমাকে।
- কিন্তু পূর্বা আমাদের সচেতন মনে কী কোনও প্রভাবই পড়বে না তার? ঈশিতা তার জীবনে অদ্ভুত কিছু হচ্ছে সেটা অন্তত বুঝেছিল।
- হয়ত আর কিছুদিন গেলেই পড়বে সে প্রভাব। ঈশিতার মা বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো বলতে পারতেন তার আগে থেকেই কোনও মানসিক অসুস্থতা ছিল কিনা। কোনও মেডিক্যাল রেকর্ড তো আমরা পাইনি। হয়তো ঈশিতা নিজেই সেগুলো নষ্ট করেছে। দুর্বলতা ছিল বলেই হয়তো তার অবচেতনকে আচ্ছন্ন করা বেশি সহজ হয়েছিল।
- ঈশিতা কে দিয়ে খুন করিয়ে কী লাভ সেই ডিমনের?
- শুধু ঈশিতা কেন, ওই একটা ঘটনাই হয়তো আমাদের সামনে এসেছে। তুমি, আমি যে কোন মানুষের অস্তিত্বের সংকট আনাই এই ডিমনের লক্ষ্য।
হঠাৎ চোখ ছলছল করে আসে পূর্বার।- আগে বুঝলে হয়তো ঈশিতাকে আটকাতে পারতাম রায়।
- কিন্তু ঈশিতাকে কে মারলো পূর্বা? সে তো নিজেকে নিজে শ্বাসরোধ করতে পারেনা।
- ডিল্যুশন রায় ডিল্যুশন। আমি যদি খুব ভুল না হই, ঈশিতা হয়ত শ্বাসরুদ্ধ হয়ে নয়, কার্ডিয়াক ফেলিওর হয়ে মারা গেছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা কী খুঁজে পাওয়া সম্ভব ?
হঠাৎ হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে সোমনাথের। কবে থেকে এই ডিমন তার পিছু নিয়েছে? কবে থেকে সে যা দেখছে বুঝছে সেগুলো ঠিক নয় আর?কবে থেকে অপেক্ষা করছে অস্তিত্ব নষ্ট করে দেওয়ার জন্য। কবে থেকে তার অবচেতনকে গ্রাস করছে কেউ?পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট খুঁজে পাওয়া অবশ্যই যাবে, কিন্তু কেমন যেন ইচ্ছা করেনা সোমনাথের। দুই হাতে মাথা নামিয়ে আনে সে। পূর্বা এখনো এত শান্ত থাকে কী করে।
রাত নেমে আসে।সোমনাথ রায়ের মাথা আর কাজ করছে না। তার এত বছরের চাকরি জীবনে এমন ঘটনার সম্মুখীন সে কখনো হয়নি। পূর্বার কথা যদি একটুও সত্যি হয়, আজ রাতে খুন হতে চলেছে সে বা পূর্বা। কিন্তু কে কার হাতে? কী অসাধারণ। সে ডিটেকটিভ না ভূতের ওঝা।দুজনে ডিপার্টমেন্টের সেই কাঁচ ঘেরা ঘরটাতে বসে আছে। আজ সারা রাত জেগে থাকতে হবে। একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিল- এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি পূর্বা? উত্তরে পূর্বা বলে - এমন কিছু যা একই সাথে প্রস্তাব, সত্য এবং উপসংহার, অর্থাৎ প্রপজিশন ট্রুথ আর কনক্লিউশন। শুনে আরো মাথা গুলিয়ে যায় রায়ের, আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস তার হয়নি। ঘরের বাইরে তিনজন বন্দুকধারী বসিয়ে শান্তি পায়নি সোমনাথ। কারণ পূর্বা একবার তাকিয়ে বলেছে - লাভ হবে না। সত্যি বলতে কী নিজের খুন হওয়ার আশঙ্কাটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি তার। আর সেও পূর্বাকে খুন করবে এটা ভাবার বাইরে। ঈশিতার ব্যাপারে পূর্বার ভীষন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে এখনো সেটা সোমনাথ ভালো ভাবেই বোঝে। এটা তারই বহিঃপ্রকাশ কিনা কে জানে। তবে পূর্বা যে সেই আগের মত উৎসাহ নিয়ে ফিরে এসেছে, এটাতেই সোমনাথ খুশি।
বসে বসে চোখ জড়িয়ে গেছিল সোমনাথের। হঠাৎ হালকা খসখস আওয়াজে সজাগ হয়ে ওঠেন। সামনে পূর্বা কখন উঠে এসেছে। -কিছু বলবে?- জিজ্ঞেস করে রায়। পূর্বার মাথায় ওদুটো কি? বাচ্চাদের মতো শিংওয়ালা চুলের ব্যান্ড পরেছে নাকি পূর্বা? পূর্বার হাত দুটো সামনে এগিয়ে আসে। রায়ের কাঁধের উপর। সেখান থেকে গলা। অবাক হওয়ার আগেই গলায় চাপ অনুভব করে সোমনাথ। কি করছে পূর্বা?!!
- ছাড় পূর্বা আমি….আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।-তীক্ষ্ম নখ বিঁধে যাচ্ছে গলায়…..এত লম্বা নখ তো পূর্বার নেই। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এটাও কী ডিল্যুশন। পাল্টা আক্রমণ করবে পূর্বাকে? তাও কী সম্ভব। কিন্তু গলায় কী অসম্ভব চাপ।জ্ঞান হারাতে থাকে সোমনাথ। বাইরে বসে থাকা বন্দুকধারী দুজন কী কিছু দেখতে পাচ্ছেনা!
ঠিক চেতনা হারানোর আগে এক পরিচিত দৃঢ় কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে - I think, therefore I exist….
মন্ত্রের মতো সে নিজেও বলতে থাকে - I think, therefore I exist ...cogito ergo sum… এই তো প্রস্তাব, সত্য, উপসংহার সব একসাথে। ধীরে ধীরে কমে আসে গলার উপর আঙ্গুলের চাপ। জ্ঞান হারায় সোমনাথ।
শেষরাত। সোমনাথের ঘোর কাটেনি এখনও। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার অনুভূতিটা এখনও যেন কিছুটা রয়ে গেছে। তবে ওটুকু না থাকলে পুরোটা স্বপ্ন বলেই মনে হতো। টেবিলের উপর দুই কাপ ধোঁয়া ওঠা কফি। টেবিলের দুই দিকে দুজন মানুষ। ডক্টর পূর্বা মিত্র, আর সে, ডিটেকটিভ সোমনাথ রায়। সোমনাথের মনে হয়, এই যে দুধ চিনি দেওয়া পূর্বার কফি, তারটা ব্ল্যাক চিনি ছাড়া- পূর্বার ভাষায় হাহাকার কফি- এইসব ছোট ছোট বাস্তবের চেনা ছবি কত অমূল্য, কত আপন। এসবের সত্যতা যাচাই করে যদি নিতে হয় প্রতি মুহূর্তে, যদি কোন অশুভ ডিমন হোক বা অন্য কিছু এসে এই চেনা ছবি পাল্টে দিয়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দেহ জাগাতে থাকে, তাহলে ঈশিতার মত হয়ে যেতে তারই বা কতদিন সময় লাগবে।
- বুঝিয়ে বল পূর্বা এবার।cogito ergo sum মানে কি?
মাথার উপর কাকের বাসাটা আঙুল চালিয়ে ঠিক করতে করতে পূর্বা বলে- ডেকার্টের ডিমন চায় অস্তিত্বের সংকট ঘটাতে। চারপাশে যা তুমি দেখছ তা যদি মিথ্যে হয়, তাহলে তুমি আসলে কোথায় কিভাবে আছ সেই ধারণাটা তুমি কখনোই সঠিক ভাবে করে উঠতে পারবেনা। তাছাড়া তুমি যখন ভাবছো যে জেগে আছো তখন হয়তো তুমি আসলে ঘুমিয়ে আছো, জেগে আছে তোমার স্বপ্নময় অথবা দুঃস্বপ্নময় অস্তিত্ব। কিন্তু তোমার অস্তিত্বকে যদি নির্ভুলভাবে প্রমাণ করতে পারো সেই ডিমনের কাছে, তাহলে তার অস্তিত্বটাই তখন সংকটে পড়ে যায়। সোমনাথের হঠাৎ ইচ্ছা করে নিজের গায়ে চিমটি কেটে দেখতে সে আছে না নেই। পূর্বার চোখে মুখে গলার স্বরে রাতজাগার ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই। কফিতে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে বলতে থাকে- সেই অস্তিত্বের সংকটটাই আনে cogito ergo sum বা আই থিঙ্ক, দেয়রফোর আই এক্সিস্ট।
- কিভাবে?
- দেখো ডিমন যদি তোমাকে ভাবায় যে তুমি নেই যখন তুমি আসলে আছো, তখন সেটা ভাবানোর জন্যই তো তোমার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিতেই হবে তাকে, নাহলে ভাবাবে কাকে? সেই যুক্তিটাই ডিমনকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করেছিলাম।
- বাবাগো। যুক্তিবাদী ডিমন! আর কত দেখবো। কিন্তু তাকে দেখতে কেমন আসলে? আর তারপর কী হল? - সোমনাথ তার হাহাকার কফিতে চুমুক দিয়ে যেন সত্যিকার হাহাকার করে ওঠে।
- অজ্ঞান হয়ে গেলে সব জানা যায়না ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সোমনাথ রায়। - পূর্বার চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে বদমাশী। - তাকে দেখতে কেমন তা কী জানা সম্ভব বলো? আর তারপর? তারপর সে মিলিয়ে গেল। ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট পূর্বা ফিরে এলো। নটে গাছটি মুড়িয়ে গেল।
ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। পূর্বা আর সোমনাথ বেরিয়ে আসে। সোমনাথ ডাকে - পূর্বা, ধরে নাও শুধু সাইকোলজিস্ট স্বপ্নে হয়েছিলে, বাস্তবে তুমি ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট।আর আমাকে সোমনাথ বলে ডাকতে কি খুব অসুবিধা হবে? রায় ডাকটা যেন কেমন।- হেসে ওঠে পূর্বা। ক্রিমিনাল সাইকোলজিস্ট ওরফে প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর ডক্টর পূর্বা মিত্র।
অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল