।। ভ্রমণ ।। 



জলে ঢাকা জলঢাকার কাছে
শৌ ভি ক  রা য়



চোখের সামনেই কালো আপেলটি। কিন্তু নাগালের বাইরে। এমনটা নয় যে, ধরা বা স্পর্শ করা যাবে না। কিন্তু তার জন্য খরস্রোতা ঝর্ণাটির বুকে জেগে থাকা নানা আকারের পাথরের গায়ে পা দিয়ে ওপারে যেতে হবে। তার চাইতে এধারে বসে জলের কলতান শুনতে শুনতে অপলক তাকিয়ে থাকাই ভাল। 

খাবার আসবার আগে করছিও সেটা। আর মনে মনে ভাবছি যে, কী অদ্ভুত সৃষ্টি! বিরাট ওই কালো পাথরটি আপেলের আকৃতি নিয়েছে। রসিক কোনও প্রকৃতি-প্রেমিক কবে যেন তার নাম দিয়েছে আপেল স্টোন। আর তখন থেকেই বিন্দু যাওয়ার পথে এই পাথরটি হয়ে উঠেছে এই অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্য। সোনায় সোহাগার মতো পাথর আর ঝর্ণার পাশে পাওয়া গেছে একটি ছোট্ট ছিমছাম হোটেল। তাতেই দুপুরের খাবার অর্ডার করে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি ঝর্ণা আর পাথরের দিকে।





খুনিয়া মোড় থেকে চাপড়ামারি হয়ে সোজা এসেছি জঙ্গল আর পাহাড়কে সঙ্গী করে। চাপড়ামারির উল্টোদিকেই লাটাগুড়ির গভীর অরণ্য। আসলে সবটাই এক। অরণ্যের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথ সেই অরণ্যকেই ভাগ করেছে দুভাগে। তবে লাটাগুড়ির দিকে গন্ডার পাওয়া গেলেও, চাপড়ামারিতে তাদের দেখা পাওয়া যায় না বললেই চলে। কিন্তু উত্তরের অরণ্যের বাকি সব প্রাণীরা অর্থাৎ হাতি, বাইসন,চিতা ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমানে মজুদ। তবে অরণ্যে প্রবেশ মানেই তাদের দেখা পাওয়া যাবে সেটা ভাবা বাতুলতা। কেননা বনচরেদের মেজাজ-মর্জির হিসেব বোঝে সাধ্যি কার!


গৈরিবাস থেকে পথ দু`ভাগ হয়েছে। বাঁ হাতে গেলে পাহাড়ি হ্যামলেট দলগাঁ। খান কয়েক বাড়ি, বাড়ি লাগোয়া চার-পাঁচটি দোকান, ঢিলেঢালা দোকানি, অজস্র মরশুমি ফুল, শীতল হাওয়া আর নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎ ডেকে ওঠা কোনো পাখি। এখান থেকে রঙ্গো খুব কাছেই। চলে যাওয়া যায় সেখানেও। আছে ভিউ পয়েন্ট,  বসে থাকা যায় অনন্তকাল। কালিম্পং জেলার এই জায়গাটিতেও কুইনাইন চাষ হয়ে থাকে। রয়েছে সিঙ্কোনা নিয়ে গবেষণা করবার সুযোগও। তবে সম্পূর্ন জনপদেই দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। আজকাল পর্যটনের কল্যাণে কিছু হোম স্টে হয়েছে, তাতে নানা জায়গা থেকে মানুষজন আসছেন। কিছুটা হলেও তাতে সমৃদ্ধির মুখ দেখছেন পাহাড়ি এই মানুষেরা। 







গৈরিবাস থেকে ডানহাতের রাস্তায় সোজা ঝালং। খুনিয়া মোড় থেকে আসবার পথে, অরণ্য শেষে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় অজস্র পাহাড়ি ঝোরার সঙ্গে সাক্ষাৎ সেরে, গৈরিবাস থেকেই পৌঁছে যাওয়া যায় অনেকটা নিচুতে ঝালঙে। জলঢাকা এখানে পাহাড়ের ভাঁজে সমতলের দিকে বয়ে চলেছে। অদ্ভুত লাগে দেখতে জলঢাকার সেই রূপ। ছোট্ট গ্রাম ঝালং অবশ্য এখন অত্যন্ত পরিচিত নাম। বৌদ্ধ মন্দির, বেশ দোকানপাট, জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অফিস, স্টাফ কোয়ার্টার মিলে বেশ জমজমাট। পাহাড়ের বিভিন্ন দিক থেকে আরও কিছু নদী ও ঝোরা এখানে মিশেছে জলঢাকার সঙ্গে। ফলে, পাহাড়, অরণ্য, নদী, ঝর্না সব মিলে এরকম সুন্দর প্যানোরামা খুব কম মেলে। ঝালং থেকে তারপর চলা প্যারেন ছুঁয়ে বিন্দুতে। এখানেই গড়ে উঠেছে জলঢাকা হাইডেল প্রোজেক্ট। বাধা পেয়েছে নদী। দিচ্ছে বিদ্যুৎ। বাজছে জলতরঙ্গ। 





এখানে বলতেই হয় যে, গত শতকের ষাটের দশকে জলঢাকা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তৈরি করা  'হেড রেস্ টানেল'টি  হিমালয়ের প্রাচীনতম টানেলগুলির একটি। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকারের সেচ ও বিদ্যুৎ দপ্তরের উপদেষ্টা কমিটির ছাড়পত্র পাবার পর ১৯৬৭ সালে যুগোস্লাভিয়ার লিটস্ট্রোজ, প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দুটি ৯ মেগাওয়াটের ইউনিট তৈরি করে। ১৯৭২ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিট দুটি তৈরি করে জাপানের ফুজি।১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ের  ৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি ইউনিট তৈরি করতে  অস্ট্রিয়ার ভেস্ট আলপাইনের সাহায্য নেওয়া হয়। প্রাচীন এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থেমে থাকে নি, বরং প্রকল্প ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটন। এমনিতেই উত্তরের এই অঞ্চলটি প্রকৃতির আশীর্বাদধন্য। এত সুন্দর রমণীয় পরিবেশ উত্তরের কম জায়গাতেই মেলে। তার সঙ্গে বিজ্ঞানের মেলবন্ধন সত্যিই অদ্বিতীয় করে তুলেছে ভুটান পাহাড়ের ঠিক পাশে থাকা বিন্দুকে।





বিন্দু থেকে একটু পিছিয়ে, চড়াই পথে প্যারেন হয়ে চলে যাওয়া যায় তোদে। তোদে থেকে কপাল ভাল হলে দেখা মেলে নাথুলা শৃঙ্গের। তা ছাড়াও কালিম্পং পাহাড়ের ভিউ অসামান্য। তোদে-তে পর্যটকের ভিড় কম বলে, উপভোগ করা যায় পাহাড়ের নিস্তব্ধতা। তবে অনেক সময় অজানা পাখির ডাকে সে নির্জনতা ভেঙে সৃষ্টি হয় এক অনবদ্য মুহূর্ত। যারা সেই মুহূর্তের সুর শুনেছেন, তাদের কাছে তোদে চিরদিন অসামান্য অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে। বিন্দু থেকে সামান্য দূরত্বে চিসাং আর একটি সুন্দর জায়গা। দেওদার, রডোড্রেনডন, চিকরাশি, মরশুমী ফুলে ছাওয়া চিসাঙের সৌন্দর্য্য মনকাড়া। হাতে সময় থাকলে ঝালঙের কাছের কুমাই, রকি আইল্যান্ড, সুন্তালিখোলা, সামসিং, লালিগুরাস ইত্যাদিও বেড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। প্রকৃতি সব জায়গাতেই ঢেলে দিয়েছে তার সব ঐশ্বর্য!





আসলে উত্তরে এত কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে, সেসব দেখতে একটু সময় লাগে বৈকি!এখানে প্রধান দ্রষ্টব্য হলেও প্রকৃতি হলেও, সেই প্রকৃতির মাঝে থাকা এক একটি বৃক্ষ, ফুল, পাহাড়, ঝর্না, মানুষ, মনুষ্য-সৃষ্ট নানা জিনিস দেখতে দেখতে কখন যে দিন ঢলে রাত নামে টের পাওয়া যায় না কিছুতেই....