ধা রা বা হি ক
উপন্যাস ।। ৪র্থ কিস্তি
![]() |
অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল |
এগারো
বেনিয়াপুকুর লেনের ১৪ নম্বর বাড়ির তিনতলায় একটি ছোট্ট ঘরে হিয়া তার বাবা'কে নিয়ে থাকে। বাবার নাম জয়ন্ত হালদার। হিয়া'র মা তাকে জন্ম দেওয়ার পরেই মারা যায়। আর সেই থেকেই জয়ন্ত'বাবু কোলেপিঠে মেয়েকে মানুষ করেছেন। বাপ মেয়ের খুব মিল।
প্রথম জীবনে জয়ন্ত'বাবু একটি প্রেসে কেরানির কাজ করতেন। তবে গত ছয় বছর তিনি একেবারেই বাড়িতে বসা। তার কঠিন হাঁপানি রোগের সমস্যা। দু'পা হাঁটলেই বুকে টান ওঠে। এই ছ'বছর হিয়া'ই সংসার টানছে।
হাঁপানি ছাড়াও জয়ন্ত'বাবুর আরও একটি রোগ আছে। যে রোগ ক্যান্সার বা টিবি'র থেকেও সাংঘাতিক। রোগটি হলো বই পড়ার রোগ। দু'বেলা পেট ভরে ভাত না পেলেও চলবে , কিন্তু জয়ন্ত'বাবুর প্রতি মাসে একটি করে নতুন উপন্যাসের বই দরকার। হিয়া হাসি মুখে সেই বই কিনে দেয়। বই পড়া শেষ হলে জয়ন্ত'বাবু সেটি পাড়ার একটি লাইব্রেরিতে দান করে আসেন।
আজকে হিয়া স্নান সেরে আয়নার সামনে চুল আচড়াচ্ছে। এই ঘরে আসবাবপত্র একেবারেই কম। একটি আলমারি, একটি খাট , দুটি এলুমিনিয়ামের ট্যাংকি আর কিছু বাসনপত্র। জয়ন্ত'বাবু এখন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী'র একটি উপন্যাস পড়ছেন। বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, জানিস মা , কাল লাইব্রেরি'তে গেছিলাম। ফেরার সময় কি মনে হলো একবার টেবিলের উপরে রাখা একটি পত্রিকায় চোখ পড়লো। সেটি খুলে দেখলাম বেশ কিছু কবিতা লেখা। এক একটা যেন মাস্টারপিস। পরের মাসে ভাবছি ওই পত্রিকাটি নেবো। দাম বেশি না। ওই পঞ্চাশ টাকা মতন।
চুলে একটা খোঁপা বেঁধে হিয়া জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো।
তুমি আবার কবে থেকে কবিতার লোক হলে বাবা ! এই তো বলতে কবিতা হলো বড়লোকের শখের জিনিস। সুকান্তের পর আর কেউ কবিতাই লিখতে পারেনি।
তা বলতাম। তবে কালকে আমার সেই ভুল ভেঙে গেল। আহা ! কি লিখেছে একটি ছেলে। কি যেন নাম বেশ , মনেই পড়ছে না।
থাক , আর মনে করতে হবে না।আমি পরের মাসে তোমায় টাকা দিয়ে দেব। কিনে নিও। বাবা , আজ আমার ফিরতে অনেক রাত হবে । ভাবছি আজকেও মাসির বাড়িতে থেকে যাবো।
বই বন্ধ করে জয়ন্ত'বাবু একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, একি কথা মা। রোজ রোজ ওই বাড়িতে থাকাটা উচিত হচ্ছে না। কে কি বলে বসবে …..
কেউ কিছু বলবে না বাবা। আর আমি যে কোম্পানি'তে কাজ করি সেখানে মেয়েরা নাইট ডিউটি'ও করে। সেদিক থেকে আমি বেঁচে গেছি। যাইহোক, একটু চা বসাই। তুমি খাবে তো ?
হ্যাঁ । একটু আদা দিয়ে কর। গলাটা কাল থেকে খুস খুস করছে। এবারে বিশ্বাস ডাক্তার যে ওষুধটা দিয়েছে খুব কড়া।
কড়া হলেও খেতে হবে বাবা। আর আমি যখন থাকি না বেশি সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করবে না।
জয়ন্ত'বাবু চুপ করে গেলেন। হিয়া'র মুখের উপর তিনি কথা বলেন না। অথর্ব মানুষ। তার উপর বয়স হয়েছে। অহেতুক তর্ক এই সময় এড়িয়ে চলাই ভালো।
উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার পর হিয়া'র আর পড়াশুনা এগোয়নি। জয়ন্ত'বাবু তখন চরম অসুস্থ। বাড়িতেই পরে আছেন। ধীরে ধীরে যখন জমানো পয়সাও শেষ হলে এলো তখন একটি চিঠি লিখে মেয়েকে পাঠালেন মিস্টার দত্ত'র কাছে।
মিস্টার দত্ত ছিলেন তাদের ছাপাখানার মালিক। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স বা তার বেশিও হতে পারে। যাদবপুরে থাকতেন। হিয়া চিঠি নিয়ে তার কাছে পৌছালো। চিঠি'তে কি লেখা আছে হিয়া জানত। মিস্টার দত্ত চিঠিটি খুলে দেখলেন তাতে লেখা,
"ডিয়ার স্যার,
আশাকরি ভালো আছেন। এদিকে আমার অবস্থা খুবই খারাপ। মেয়ের হাতে হাজার খানেক টাকা পাঠিয়ে দেবেন। ফেরত দিতে পারবো না। দান হিসেবেই দিতে হবে।
ধন্যবাদান্তে,
জয়ন্ত হালদার"
চিঠি পড়া শেষ হলে মিস্টার দত্ত বললেন, তোমার নাম কি ?হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে তো ?
হিয়া সেই প্রথম একটি নকল নাম বলেছিল। কেন বলেছিল তা সে আজও জানে না। এরপর আবার একসপ্তাহ বাদে তাকে চিঠি নিয়ে যেতে হলো। এবারের দাবি পাঁচশো টাকা। সেদিন মিস্টার দত্ত নিজে এসে হিয়া'কে বাসে তুলে দিলেন আর বললেন, কলকাতার রাস্তা ভালো না, একটু সাবধানে যেও।
এর একমাস পর যেদিন হিয়া'কে আবার আসতে হলো মিস্টার দত্ত'র বাড়িতে সেদিন সেই বাড়িতে কেউ ছিল না। দানস্বরূপ পাঁচশো টাকা হিয়া'র বুকে গুজে দিয়েছিল দত্ত'সাহেব নিজের কৃতকর্ম সাধনের পর। আর বলেছিল, যখন খুশি এসো , টাকার জন্য ভাববে না।
তলপেটে অসহ্য ব্যাথা নিয়ে হিয়া সেদিন রাতে জয়ন্ত'বাবুর জন্য তেলাপিয়া'র ঝোল আর মিনিকেট চালের ভাত বানিয়ে দিয়েছিল।
তবে এরপর আর হিয়া'কে চিঠি নিয়ে যেতে হয়নি মিস্টার দত্ত'র কাছে। সে নিজেই পৌঁছেছিল তার অফিসে। এ'হাত ও'হাত হতে হতে সে পৌঁছায় মুখার্জি ম্যানেজারের খপ্পরে। আর সেই থেকেই তাদের হয়ে কাজ করে চলেছে হিয়া।
বারো
বেল বাজা মাত্রই রিনা'র মা দরজা খুললো। অসিত'কে সামনে দেখে বলল, কি ব্যাপার অসিত ! এত সকাল সকাল। সব ঠিক আছে তো ?
অসিত বলল, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম বলে যাই, আজ রাতে আমি পড়াতে আসবো , রিনা'কে একটু জানিয়ে দেবেন প্লিজ।
রিনা'কে ! সেকি! তুমি জানোনা ? রিনা তো এখানে নেই।
অসিত শঙ্কিত গলায় বলল, নেই ! সেকি ! কোথায় গেছে?
তুমি ভিতরে এসো । বলছি। চা খাবে ?
না কাকিমা , আজকে আর চা খাবো না। রিনা কোথায় গেছে?
বর্ধমান । তুমি ঘরের ছেলে তোমার কাছে আর কি লোকাবো।আসলে ওর একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। ছেলে বিদেশে থাকে। বর্ধমানে পৈতৃক বাড়ি। রিনা'র ফটো দেখে ওকে খুব পছন্দ করেছে। তাই ওর পিসি ওকে নিয়ে গেছে। আমরাও তো আজ বিকেলেই রওনা হবো । যাইহোক, তুমি তোমার মাইনেটা নিয়ে যেও দুএকদিন পর এসে।
রিনা'র বাড়ি থেকে বেরিয়ে অঞ্জন একটা বাসে উঠলো। মনে মনে ভাবলো, এই বাস'টা এক্সিডেন্ট করলে ভালো হয়। দেবেন্দ্রর মতন সেও যেন মারা যায়। এই জীবন রাখার কোনো মানে হয় না। রিনা'র বাড়িতে সে মাইনে নিতে যাবে না। কখনও যাবে না।
প্রকৃতির কোলে মানসিক কেন্দ্র বেশ পয়-পরিষ্কার। পাগলা গারদ এত সুন্দর হয় জানাই ছিল না অসিতের।দোতলা একটা গোল টাইপের বাড়ি। সবে রঙ করেছে হয়ত। নীল সাদা। ভিতরে একটা প্রকান্ড মাঠ। পাগলরা কি ভাবে খেলে কে জানে ! হয়ত এক পাগল ফুটবল খেলছে। সে মনে মনে ভাবছে এটা একটা পৃথিবীর মতন গ্রহ। গ্রহটির উপর অনেক ময়লা জমেছে। গ্রহের মানুষ দিনরাত পুজো করেছে এক ভগবানের জন্য। যে এসে এই গ্রহটিকে বাঁচাবে। সেই পাগল ভাবে আমিই সেই ভগবান। লাথি মেরে এই গ্রহের সব ময়লা দূর করে দিচ্ছি।
মানসিক কেন্দ্র'র সুপারের ঘরটা বেশ বড়। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে। অসিত ভেবেছিলো ভিতরে কোনো গুন্ডা টাইপের হোমড়াচমরা লোক বসে থাকবে। কিন্তু ভিতরে ঢুকে সে একটু হকচকিয়ে গেল। প্রকান্ড একটা টেবিলের ওপারে একটি বাচ্চা টাইপের মেয়ে বসে আছে। বাচ্চা টাইপের বলতে হলো কারণ মেয়েটিকে দেখে সত্যিই তার বয়স বোঝা যাচ্ছে না। রোগা গড়ন। এতটাই ফর্সা সে মাথার চুল সোনালী হয়ে আছে। একটা নীল সাদা তাঁতের শাড়ি পরে বসে কি একটা লিখে চলেছে প্রকান্ড একখানা খাতায়। সে মাথা না তুলেই বলল, ভিতরে আসার আগে দরজায় নক করা উচিত ছিল আপনার।
মেয়েটির কণ্ঠ যেন কোকিলের মতন । কেউ যেন এই মাত্র গান গাইল।
অসিত বলল, ওহ , সরি , আমি তাহলে বাইরে দিয়ে দাঁড়াই।
না , না বাইরে যাবেন কেন , বসুন । আপনার নামই তো অসিত ?
কাঠের চেয়ার টেনে বসতে বসতে অসিত বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার মামা'কে মানে ফটিক চন্দ্রকে কাল এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।
লেখা এতক্ষনে থামলো মেয়েটার । মাথা তুলে বলল, হোলি গড ! ওই পেশেন্ট আপনার ?
কেন ম্যাডাম ? কি হয়েছে ?
না কিছু হয়নি। তবে ওনার অবস্থা খুব খারাপ। আমরা অবজারবেসনে রেখেছি। এই নিয়ে তিন খানা ঘুমের ওষুধ দিতে হলো ওনাকে। হি ইজ ফিউরিয়াস।
একবার দেখা করতে পারবো ?
পারবেন তবে কথা বলতে পারবেন না। উনি কথা বললেও আপনি কথা বলবেন না।
সেকি কেন ?
সে সব আপনাকে জানতে হবে না। চলুন।
চলমান দেবী টাইপের সেই মহিলা অসিত'কে নিয়ে এগিয়ে গেল একটা জেলের মতন গরাদের দিকে। সেখানে ছোট ছোট একেকটা ঘর। প্রতিটিতেই লোহার গরাদ দেওয়া। তারা এসে থামলো সেল নম্বর ১২১-এর সামনে।
অসিত খুব কষ্ট করে ভিতরে দেখার চেষ্টা করলো। কিছুই দেখতে পেলো না এতটাই অন্ধকার। সে বলল, এত অন্ধকার করে রেখেছেন কেন ম্যাডাম ? কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।
দেখতে পাচ্ছেন না ? সেকি ! ওই তো আপনার মামা শুয়ে আছেন।
গরাদের একদম কাছে গিয়ে অসিত দেখলো ভিতরে একটা সিমেন্টের বেদির উপর তার মামা শুয়ে আছেন। শরীর দেখলে মনে হয় ভিতরে প্রাণ নেই। শুধু বুকটা উপর নিচ করছে।
তারা ফিরে এলো সুপারের ঘরে। সুপার বললেন, কালকে যা কান্ড হয়েছে আমরা কাগজ পত্রের কাজ কিছুই করতে পারিনি। যাইহোক আপনাকে একটা সই করতে হবে।
অসিত বলল, ম্যাডাম একটা কথা ছিল, আমায় যদি মেরেও ফেলেন তাহলেও একটাকা পাবেন না। টাকার ব্যাপার ছাড়া আপনি সেখানে সই করতে বলবেন করে দেবো।
সুপার মহিলা খিল খিল করে হেসে উঠলো। সেই প্রকান্ড ঘরে যেন হঠাৎ মনে হলো ঝর্নার জল পড়ছে। এই মহিলাকে দেখলে বোঝা যায় জীবন কতটা সুন্দর। হাসতে হাসতেই সে বলল, টাকা চাইছি না। এটা একটা বন্ড। আমাদের চিকিৎসার কারণে যদি আপনার মামা মারা যান তাহলে আমরা দায়ী থাকবো না। এটাই এখানে লেখা আছে ইংরেজিতে। আপনি ইংরেজি পড়তে পারেন নিশ্চই ?
এই কথাটা অসিতের পছন্দ হলো না। তাকে দেখে কি মনে হয় না সে ইংরেজির ছাত্র! কে জানে ! সে বলল, দিন সই করে দিচ্ছি। তবে আমারও একটা অনুরোধ আছে।
কি অনুরোধ ?
আপনাদের এখানে দেখলাম অনেকেই কাজ করে , আমায় এখানে একটা কাজের ব্যাবস্থা করে দেবেন? আপনি তো সুপার , আপনার অনেক ক্ষমতা।
মহিলা আবার হেসে উঠলো। বলল, আপনি বেশ কথা বলেন তো। পড়াশুনা কত দূর করেছেন ?
আজ্ঞে , আমি গ্রাজুয়েট।
সর্বনাশ , এখানে যারা কাজ করে তাদের কেউ ক্লাস এইট পাশ করেনি। এত বড় ডিগ্রি নিয়ে আপনি এখানে কেন কাজ করবেন ?
অসিত বুঝতে পারলো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। সে সই করে ঘর থেকে বেরোনোর সময় বলল, ম্যাডাম , আপনার নামটা ?
মহিলাটি কোনো উত্তর দিলো না। যেন চেনেই না অসিত'কে। মাথা নিচু করে আবার কি সব লিখতে লাগলো। অসিত বুঝতে পারলো তাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ শুধু বন্ডে সই করানো। সেই কাজ হাসিল হয়ে গেছে তাই সে এখন এদের কাছে ব্রাত্য।
পার্ক সার্কাস মোড়ে এসে অসিত ঠিক করলো যে তার জীবনে এখুনি কিছু নীতি নির্ধারণ করতে হবে। এভাবে চলতে পারে না। ঠান্ডা মাথায় সব কিছুর একটা ম্যাপ বানিয়ে ফেলতে হবে। জীবনে চলার ক্ষেত্রে এই ম্যাপ'টা হঠাৎ তার কাছে খুব প্রয়োজন হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব করা যায় না। পাশেই একটি চা'য়ের দোকান দেখা গেল।
প্রথম যে নামটা তার মাথায় এলো সেটা রিনা'র। তার বিয়ে হবেই সেই বর্ধমানের ছেলের সাথে এমন কোনো কথা নেই। ফটো'য় দেখা আর সামনাসামনি দেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। যদিও রিনা খুবই সুন্দরী। এমন একটি মেয়েকে সেই ছেলে ছাড়বে বলে মনে হয় না। তাই রিনা'কে আপাতত ভুলে যাওয়াই ভালো। ভাগ্যে থাকলে ফিরে আসবে। আর না আসলে তার প্রকৃতপক্ষে কিছুই করার নেই।
দ্বিতীয় হলো ফটিকবাবু। যদিও তার আজ যা অবস্থা দেখা গেল তাতে খুব বেশিদিন জগতের অক্সিজেন টানবে বলে মনে হয় না। তাই মামি'কে এই ব্যাপারে আগে থেকে বুঝিয়ে বলে রাখতে হবে। মামা'র পর মামি'র সব দায়িত্ব অসিতের।
তৃতীয়টি ঠিক ম্যাপ নয়। রিনা'র বাড়ি থেকে বেরোবার পর থেকেই মনে হচ্ছে বুকে যেন কেউ পিন ফোঁটাচ্ছে। এর নামই হয়ত কষ্ট। তবে যদি তাই হয় তাহলে কষ্ট জিনিষটা সত্যিই খুবই কষ্টের। আজ যে ভাবে হোক অঞ্জনকে খুঁজে বের করে আকণ্ঠ মদ খেতে হবে। ভুত-ভবিষৎ সব ভুলে যাওয়ার মতন খেতে হবে।
চতুর্থ হলো মেহবুব হাসান। দালালির কাজটা একেবারেই করার ইচ্ছে নেই। তাই মেহবুব সাহেবের সেই প্রিন্টিং ফার্ম এখন শেষ ভরসা। সেখানেও কিছু না হলে আপাতত জাহাজ কোম্পানি'ই ভরসা। যদিও কাজটা যদি এখনো টিকে থাকে তাহলেই।
পঞ্চম , টিউশনি ছেড়ে দিতে হবে। মানুষকে এই বৃত্তি অলস করে তোলে। কবিতা আসলে ভালো , না আসলে সেটা নিয়ে এখন মাথাব্যাথা করে লাভ নেই।
যাদবপুর স্টেশনের অনতিদূরে বিবেকানন্দ পার্ক। সেই পার্কে'র গা লাগানো রাস্তার নাম হরিশ চন্দ্র লেন। যার ১৮ নম্বর বাড়ির সামনে অসিত দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর কলকাতায় এত সহজে একটা বাড়ি খুঁজে পেয়ে সে নিজেও একটু অবাক হয়ে গেছে।
বাড়িটা তিন তলা এবং বেশ বড়। বাইরে সবুজ রং করা। ভিতরের রং এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে না। বেল বাজাতে এক হাই পাওয়ার চশমা পড়া ভদ্রলোক দরজা খুলল। অসিত বলল, আজ্ঞে , মেহবুব হাসান কি এখানে থাকেন ?
ভদ্রলোকটি মনে হয় এই প্রশ্নটা পছন্দ করলেন না। কর্কশ গলায় বললেন, থাকেন মানে ? এটাই তো ওনার বাড়ি।
ওহ, মাফ করবেন। আসলে উনি আমায় আসতে বলেছিলেন। একটা কাজের ব্যাপারে ।
ভদ্রলোকটি অসিত'কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার মেপে নিয়ে বলল, কাজ ? কি কাজ ?
তা তো আমি জানি না। উনি আমায় দিল্লি যাওয়ার আগে আসতে বলেছিলেন। আমি আসতে পারিনি ।
ভদ্রলোকটি মনে হয় এবার একটু প্রসন্ন হলেন। কেন হলেন কে জানে! তিনি বললেন, এই বাড়ির বাঁ দিক ধরে তিন'টে বাড়ির পর যে বাড়িটা আছে সেখানে উনি আছেন। ওটাই ওনার অফিস। এটা ওনার বাড়ি। বলেই মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো লোকটা। অসিত'কে মনে হয় তার একেবারেই পছন্দ হয়নি।
প্রিন্টিং অফিস'টা বেশ বড় সড়। তিনটে মেশিন লাগানো । সব কটাই বিদেশি। অসিত বসে আছে পাশের একটি ঘরে। মাঝে মাঝে তাকে মেশিনের ঘর থেকে লোকজন এসে দেখে যাচ্ছে। সে যেন এক দেখার বস্তু।
মেহবুব সাহেব কিছু পরে এলেন হন্তদন্ত হয়ে। অসিত'কে দেখে বললেন, হ্যাঁ বলুন কি চাই !
স্যার , আমি অসিত। চিনতে পারছেন ? সেই যে ….
ও , হ্যাঁ , হ্যাঁ । কেমন আছো ? হঠাৎ এখানে ! ঠিকানা পেলে কিভাবে ?
অসিত বলল, স্যার আপনিই তো দিয়েছিলেন।
দিয়েছিলাম নাকি ? মনে পড়ছে না । যাইহোক , বলো কি ব্যাপার ?
স্যার , আপনার হয়ত মনে নেই , আপনি আমায় কাজের জন্য বলেছিলেন। সেই জন্যই আসা আপনার কাছে।
মেহবুব সাহেব যেন আকাশ থেকে পড়লেন , বললেন, আমি তোমায় কাজের জন্য বলেছিলাম ?অদ্ভুদ , আমার তো মনেই নেই কিছু। যাইহোক, আমার কাছে তো কোনো কাজ নেই এখন। তুমি বরং তোমার ফোন নম্বর দিয়ে যাও আমি দেখবো যদি কিছু করা যায়।
অসিত মেহবুব সাহেব'কে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এলো। আর মনে মনে যে কটা খিস্তি জানে সব কটাই বলতে লাগলো।
রাস্তার কুকুরগুলো তাকিয়ে থাকলো তার দিকে।
তেরো
অঞ্জনের কথাগুলো অসিতের কানে আসছে কিন্তু তার অর্থ কি তা সে বুঝতে পারছে না। এর কারণ শরীরে অতিরিক্ত এলকোহল। তার মস্তৃষ্ক , শব্দের মানে নির্ধারণ করতে সাময়িকভাবে অক্ষম হয়ে গেছে।
অসিত দেখলো অঞ্জন হাত নাড়িয়ে কি সব বলে হেলতে দুলতে মেনকা বার থেকে বেরিয়ে গেল। অসিতের সামনে সব দুলছে। খুব কষ্টে সে এটা বুঝতে পারলো যে অঞ্জন বিল মিটিয়ে গেছে। কারণ টেবিলের উপর বিলটা রাখা আছে।
মেনকা বার থেকে বাস স্ট্যান্ড দশ মিনিটের হাঁটা পথ। অসিত কোথায় পা ফেলেছে নিজেই জানে না। তবে তাকে বাড়ি ফিরতেই হবে। চোখের সামনে সব কিছু কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে সেটাই মাটিতে পরে গেল। ট্যাক্সি ডাকার মতন টাকাও নেই। পকেটে মাত্র তিরিশ টাকা। এই নিয়ে কাল বাজার করতে হবে।
হঠাৎ হোঁচট খেলো সে। মুখ থুবড়ে পড়লো একেবারে রাস্তার উপর। অসিত এখন একটা ঘোরের মধ্যে। মনে মনে ভাবলো, মুখটা কি ফেটে গেছে ! জিভ দিয়ে ঠোঁটের কাছে বোলাতে লাগলো। তেমন কিছুই টের পেলো না। এদিকে রাস্তার কেউ এগিয়ে আসছে না। কলকাতা শহর হঠাৎ অমানবিক হয়ে উঠেছে।
অসিত কোনো মতে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। তার শরীরে এখন সেই শক্তিও নেই। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখ লেগে আসছে। এখানেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
হঠাৎ কে যেন বলল, একি ! একি অবস্থা আপনার !
বক্তা'কে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার আগেই অসিত অজ্ঞান হয়ে গেল।
জ্ঞান ফেরার পর সে দেখলো এক বেসরকারি হাসপাতলের জেনারেল ওয়ার্ডে শুয়ে আছে। তার দিকে এগিয়ে আসছে একটি নার্স। নার্স'টি এসে তাকে একটি সিল করা চিঠি দিলো। আর মুখ টিপে হাসতে লাগলো। অসিত এসবের মানে বুঝতে পারলো না । চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলো,
অসিতবাবু,
প্রথমেই একটা উপদেশ , বেশি মদ আপনার সহ্য না হলে খাবেন না। কারণ রোজ রোজ আপনাকে রাস্তা থেকে আমি তুলে আনতে পারবো না। যাইহোক, আমি নিশ্চিত আপনি এখনো কোনো কাজ পাননি। আপনাকে জানিয়ে রাখা ভালো যে মুখার্জি ম্যানেজার আপনাকে খুব পছন্দ করেন। আপনি কবে ফিরবেন সেই আশায় আছেন। আমার সাথে এই নিয়ে কথাও হয়েছে। তাই এদিক ওদিক না ঘুরে কাজে জয়েন করুন। এতে আপনার'ই লাভ হবে। না হলে সত্যিই এরপর এই কাজটাও যাবে।
যে নার্স আপনাকে এই চিঠিটি দিলেন তিনি আমার নিজের মাসি হন। ওনাকে আমি হাজার টাকা দিয়ে এসেছি আপনাকে দেওয়ার জন্য। টাকাটা নিয়ে আপনি প্রথমে একটা জুতো কিনবেন কারণ আপনার বর্তমান জুতোর তাপ্তি মারা সেলাই'টা বড্ড চোখে লাগে। বাকি টাকায় একটা ভালো জামা আর প্যান্ট কিনবেন। তারপর কাল সকালে অফিসে চলে আসবেন।
আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যেদিন আবার দেখা হবে আমি আমার আসল নাম'টা জানাবো। তাই জানাচ্ছি। আমার নাম হিয়া।
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
ইতি,
হিয়া
চিঠি পড়া শেষ হতেই সেই নার্স দুটো পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিলো তার দিকে। তারপর আবার মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, আপনার ছুটি হয়ে গেছে। আপনি এখন যেতে পারেন। বড় ডাক্তার বলে দিয়েছে। আর হ্যাঁ , আপনার মাথায় চোট লেগেছে। তাই মাঝে মাঝে এসে বড় ডাক্তারকে দেখিয়ে যাবেন। বলেই আবার হাসতে লাগলো। কিছু মানুষকে হাসলে বেশ ভালো লাগে , এই মহিলা তাদের মধ্যে একজন।
চোদ্দ
অঞ্জন যে ঘরে বসে আছে সেটায় একটা আভিজাত্যের ছাপ আছে। সেগুন কাঠের চেয়ার , দেওয়ালে নামকরা শিল্পীর তৈলচিত্র। চারিদিকে একটা পরিপাটি ভাব।
অঞ্জন অবশ্য একা আসেনি। তাকে নিয়ে এসেছে অবিনাশ। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফেরার পর সে এখন পরিচালক হওয়ার চেষ্টায় ঘুরছে। মাঝে দু একটি সর্ট ফ্লিম করে বেশ নাম করেছে। এবার তার পরিকল্পনা একটা ফুল মুভি , একেবারে বড় পর্দার জন্য।
এই বাড়িতেই থাকেন অঙ্কন সেন। তাকে ফাইন্যান্স করার জন্য অবিনাশ রাজি করিয়েছে। গল্প নেওয়া হয়েছে অঞ্জনে'র চিত্রকূট বলে এক উপন্যাস থেকে। লেখাটি ইদানিং বেশ সাড়া ফেলেছে। এদিকে অঞ্জনের এসব একেবারেই ভালো লাগছে না। এখানে আসার আগে সে অবিনাশ'কে বলেছিল, মর্কট'টার কাছে যাচ্ছি ঠিক আছে তবে সাহিত্য নিয়ে যদি বেশি কপচায় আমি কিন্তু তখনই উঠে চলে আসবো।
প্রায় আধঘন্টা পর অবিনাশ এলো। পিছনে একজন বেশ সুন্দর দেখতে মানুষ। এই মনে হয় অঙ্কন সেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। জরি দেওয়া ক্রিম কালারের পাঞ্জাবি আর একটা জিন্স পড়া। মানুষ বাড়িতেও এত সাজগোজ করে থাকতে পারে সেটা জানা ছিল না। যদিও বড়লোকেরা অনেককিছুই পারে।
দুজনেই হাসতে হাসতে বসলো । অঙ্কন'বাবু বললেন, আপনার সাথে দেখা করে ভালো লাগলো অঞ্জন'বাবু। লেখাটা সত্যিই দারুন হয়েছে। এমন একটা লেখা মুভি বানানোর জন্য অপরিহার্য।
অবিনাশ বলল, তা যা বলেছেন। হে হে, এই অঞ্জন তুই কিছু বল!
আমি কি বলবো! আমি মুভির কিছু বুঝি না। আমার মনে হয় পথের পাঁচালীর পর বাংলায় আর একটাও মুভি কেউ বানাতে পারেনি।
অঞ্জন'বাবু বললেন, না না তা বলছেন কেন । ভালো ছবি তার পরেও হয়েছে। আর সত্যি বলতে মানুষের স্বাদ বদলেছে তাই ছবির ব্যাকরণ'ও বদলে গেছে।
অবিনাশ বলল, তা ঠিক , তা ঠিক। যাইহোক, অঞ্জন একটা গুড নিউজ আছে , অঙ্কন'দা আমাদের প্রজেক্টে ফিনান্স করতে রাজি হয়েছে। একমাস পরেই শুটিং শুরু। আমার তো এখনই লোম খাঁড়া হয়ে যাচ্ছে। সো এক্সাইটিং।
অঙ্কন বাবু বললেন, আচ্ছা আমার একটাই কথা আছে মানে একটা আডভাইস বলতে পারেন, ছবিতে যদি নায়ক আর নায়িকার মিল করিয়ে দেওয়া হয় শেষে গিয়ে ! কি বলেন?
অঞ্জন এবার ভুরুটা কুঁচকে ফেললো, অবিনাশ বেগতিক বুঝে বলল, সে সব পরে দেখা যাবে। আগে শুটিং শুরু হোক। হুবহু তো আর গল্পটা নামানো যায় না। একটু পরিবর্তন লাগেই।
অঞ্জন বেশ জোর দিয়ে বলল, না , নায়কের চরিত্রটা আমি সেই ভাবেই নামিয়েছি। শেষে গিয়ে যেন মিল না হয় দুজনের মধ্যে। এটা একটা গোবর মার্কা সাজেসন।
অবিনাশ ঢোক গিললো। অঙ্কন'বাবু সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে গেলেন। দেওয়াল ঘড়িতে দুপুর একটার ঘন্টা বাজলো। অঞ্জন বলল, আমায় এবার উঠতে হবে।
রাস্তায় নেমে অবিনাশ এই মারে কি সেই মারে অঞ্জনকে।
কি দরকার ছিল তোর ওসব বলার? গেল এই প্রজেক্ট'টা। কত কষ্ট করে অঞ্জন'দাকে কনভিন্স করেছিলাম। গেল সব ভেস্তে। এখন আবার আমায় একটা পার্টি খুঁজতে হবে।
অঞ্জন চুপচাপ। সচরাচর এরকম অবস্থায় সে খিস্তির বন্যা বইয়ে দেয়। কিন্তু এখন সে কিছুই বলছে না। বেশ কিছু সময় পর সামনে একটি চায়ের দোকান দেখে সেখানে বসে পড়ল। অবিনাশ তার পিছন পিছন গজগজ করতে করতে সেখানে বসলো।
অঞ্জন চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, ওই হারামজাদা তোকে কত টাকা দেবে বলেছিল?
মানে? কি বলতে চাইছিস ?
মানে মুভিটা বানাতে কত টাকা লাগবে ?
কেন ?
শুওরেরবাচ্চা যা প্রশ্ন করছি তার জবাব'টা দে।
বিশ লাখ মতন। কেন ? তোর কাউকে জানা আছে নাকি? দেখিস ভাই কেউ থাকলে জানা আমায়। বন্ধুকে ল্যাং মারিস না।
অঞ্জন কিছু বলল না। চুপচাপ উঠলো । চায়ের দাম দিয়ে বলল, চলি। রাতে তোকে ফোন করবো। কথা আছে।
অবিনাশ কিছু বোঝার আগেই বাসে উঠে চলে গেল সে। অবিনাশ মনে মনে বলল, শালা বুর্জোয়া ।
সুখেন আচার্য একেবারে গলদঘর্ম হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ফিরে দেখেন লোডশেডিং । দাঁত মুখ খিচিয়ে হাঁক দিলেন, পর্ণ , পর্ণ। হেলতে দুলতে এক মহিলা বেরিয়ে এলো তাদের শোবার ঘর থেকে। মিষ্টি স্বরে বলল, চেঁচাচ্ছো কেন , কি হয়েছে ?
কি হয়েছে মানে ? দেখতে পাচ্ছো না ? এত ঘেমেছি যে গা চুলকাচ্ছে। স্নানের জল দাও। স্নান করবো।
স্নানের জল তোলা আছে। চুপচাপ স্নান করে খেতে এস। ম্যালা চেঁচামেচি করবে না গরমের মধ্যে।
সুখেন'বাবু কিছু বললেন না। এভাবেই তার তিরিশ বছর কেটে গেল। প্রথমে হাঁক ডাক দেন তারপর বউ কিছু বললেই চুপ করে যেতে হয় তাকে। এছাড়া উপায়ও নেই। প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর মোটা টাকার পণ নিয়ে পর্ণ'কে বিয়ে করেছিলেন। আজ তার ব্যাবসার এই উন্নতি সেই টাকাতেই হয়েছে। মাঝে মাঝে তাও তিনি ভাবেন , মরলে বাঁচি , হারামজাদি। জ্বালিয়ে খেল।
তিনি স্নান সেরে খাবার টেবিলে আসা মাত্রই হকচকিয়ে গেলেন । বিকেল চারটে বাজে। খাবার টেবিলে বসে আছে তার গুণধর ছেলে - অঞ্জন। মাথা নিচু করে বসে চা খাচ্ছে। সুখেন'বাবু বললেন, কি ব্যাপার এই সময় বাড়িতে ! শরীর ঠিক আছে তো ?
চায়ের কাপ একটু দূরে সরিয়ে রেখে অঞ্জন বলল, যাক, তোমার তাও মনে আছে যে আমার শরীর'ও একটা সত্তা , যেটা খারাপও হতে পারে।
বেশি সাহিত্য ফোটাবি না আমার কাছে। কি দরকার সেটা বল।
বলছি , তবে তার আগে একটা কথা বলে রাখছি , আমাদের কথার মাঝে যেন কেউ কথা না বলে।
ইতিমধ্যে পর্ণ এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। তার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে সুখেন'বাবু বললেন, এমন কি কথা ?
অঞ্জন বলল, আমায় বিশ লক্ষ টাকা দিতে হবে।
বিশ লক্ষ ? এত টাকা কি করবি ?
সেটা জানার দরকার নেই তোমার। তবে রেস কোর্সে গিয়ে ওড়াবে না সে দিক থেকে নিশ্চিত থাকো।
করবি'টা কি ?
ব্যাবসা করবো। মাথায় একটা প্ল্যান আছে। আর আমি নিশ্চিত আমি সাকসেস পাবই।
তোর মাথা খারাপ হয়েছে নাকি! এত টাকা আমি পাবো কোথায়? ব্যাবসার খবর তো রাখিস না। সারাদিন ড্যাং ড্যাং করে ঘুরে বেড়াস। আর আমি খেটে মরি।
ব্যবসাতে তুমিই আমায় আনতে চাও না বাবা। আর কারণটা তুমি জানো।
কি কারণটা কি শুনি!
অঞ্জন শান্ত দৃষ্টিতে পর্ণ'র দিকে তাকিয়ে বলল, কারণ আমি পাক্কা ব্যাবসায়ী হয়ে উঠলে এই বাড়ির একজনের কৃতিত্ব আর খাটবে না। তাই আমায় এক প্রকার পঙ্গু করে রাখা।
সুখেন'বাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন , পর্ণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বিশ লক্ষ টাকা নয় আমি তোমায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দেব। তবে আমার একটা শর্ত আছে। তোমায় লিখিতভাবে এই বাড়ি আর এই সম্পত্তি থেকে সরে যেতে হবে। রাজি হলে বলো।
অঞ্জনের ইচ্ছে করছিল চায়ের কাপটা ছুড়ে মারতে। নিজের মাসি হয়ে কিভাবে এত কুৎসিত এই মহিলা! পরিণত বয়সে এসে সে জানতে পারে এই মহিলা তারই মায়ের বোন। এবং তার মায়ের মৃত্যুও কিছুটা অস্বাভাবিক ভাবে হয়েছিল। সেই মৃত্যুর পিছনে এই মহিলার থাকাটাও অস্বাভাবিক না। চোয়াল শক্ত করে সে জবাব দিলো, আমার অত টাকা দরকার নেই। যা চেয়েছি সেটা পেলেই হবে। যেখানে সই করতে বলবে করে দেবো।
খুব দ্রুত এসব ঘটে যাওয়ায় সুখেন'বাবু ঠিক খেই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে তিনি বললেন, আহা , তুই মাথা গরম করছিস কেন ! ব্যাপারটা আমায় বুঝতে দে আগে।
পর্ণ বলল, তোমার বোঝার মতন কিছু নেই এখানে। যা কথা হওয়ার হয়ে গেছে। আমি দুদিনের মধ্যে কাগজ তৈরি করে ফেলব। তুমি কথা না বাড়িয়ে খেতে বসো।
সুখেন'বাবু শূন্য দৃষ্টিতে অঞ্জনের দিকে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করলো। বাইরে হঠাৎ কিছু পায়রা তাদের জানলার সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল। অঞ্জন মাথা নিচু করে তার ঘরে যাওয়ার সময় চোখ পড়ল মায়ের ফটোর দিকে। তার দৃষ্টি আজ কেমন ঝাপসা হয়ে উঠেছে। মায়ের মুখটাও ভালো ভাবে দেখতে পেলো না সে।
(চলবে...)