।। গল্প ।। 

অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল


টলটলে অন্ধকারে

অ নি মে ষ  গু প্ত


(১)

লোকে বলে সুকন্ঠ’র সঙ্গে মণিমালার সম্পর্কটা জায়েশ নয়, অবৈধ। সুকন্ঠ তা ভাবে না। অনেক কিছুই আর ভাবে না সে। সংসারের চাকায় বিজবিজ করছে অনটনের মরচে। বৌটা মরে বেঁচেছে। আত্মীয়দের মধ্যে কেউ এসে নিয়ে গেছে তার একমাত্র মেয়েকে।   


প্রাইভেট ফার্মের কেরানী,  ভালো কবিতা লেখে বলে বসের নজরে পড়েছিল। সুকন্ঠকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছিল পত্র পত্রিকায়। ডাক পড়ছিল সভা সমিতিতে। কবিতার সঙ্গে সহবাস হচ্ছিল তার। শেষে কাজ কামাই করাটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়াল। প্রথম প্রথম ছুটি  কেটে নেওয়া, পরে ধমকধামক, শো কজ নোটিস। শেষে একদিন পিঙ্ক স্লিপ এলো সুকন্ঠর ঠিকানায়। ততদিনে কবি সুকন্ঠকে চিনেছে অনেকে। চাকরিটা যাওয়ার পরে যা ছিল তা শুধু কবিতা, অভাব আর ক্ষিদে। টনক নাড়িয়ে দেওয়ার মতো ক্ষিদে।  


এরপরেও আরো অনেককিছু যেতে থাকল সুকন্ঠর জীবন থেকে। ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই থেকে লোক এসে কেটে দিয়েছে লাইন। সন্ধের অন্ধকারে নড়বড়ে টেবিলটার  ওপর মুড়ির বাটি,  কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ নিয়ে রোজ বসে সুকন্ঠ। কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে থাকে ফ্যাকাশে রঙের মিয়োনো মুড়ি।  কিন্তু এসব ছাড়াও সুকন্ঠকে যা একেবারে নিঃস্ব করে গেল তা হল কবিতা। কতদিন হল কবিতা আর কাছে ঘেঁষে না তার।


(২)  

যখন দিন ছিল, বৌ-মরা, অগোছালো সুকন্ঠর মায়ায় তার সংসারে গতর লাগাত মণিমালা। কবি সুকন্ঠকে কেমন অচেনা মনে হত। মণিমালা শুনেছিল কবিতা মানে দোলা,  লাইনে লাইনে দোলা। রোজগার না হলেও এক অদ্ভুত টানে রোজ সন্ধের পরে এলে সুকন্ঠ কবিতা শোনাত তাকে। মণিমালার শরীরে দোলা, মনে দোলা, শুনতে শুনতে ঘুম পেত আর অজান্তেই সেঁধিয়ে যেত সুকন্ঠর বাসি বিছানায়।


সেসব অনেকদিনের কথা। এখন দিনকাল আরো খারাপ। মাঝবয়সী শরীরটা রাখার জন্য অন্য কাজ খুঁজে নিতে হয়েছে মণিমালাকে। এখন সে কালেভদ্রে আসে, যখন মন টনটন করে। এমনই এক ঘোরলাগা সন্ধের লালচে  আলোয় সুকন্ঠ আবার আবিস্কার করল মণিমালাকে। স্থুল শরীর-- মাংসল। মেদ উপচে পড়ছে কোমর ছাড়িয়ে দুদিকে। ঠোঁটের কষে শুকনো পানের দাগে ফেলে আসা দিনের কথা লেখা।  


দোষটা সেই আসন্ন সন্ধের হতে পারে কিংবা অন্য কিছুর, তবে মণিমালা স্বামী খেদানো মেয়েমানুষ, দুর্বল কবিকে দেখে ভেজা পলিমাটির মতো নরম হল তার মন আর এক বেদনাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো সে জড়িয়ে ধরল সুকন্ঠকে। সুকন্ঠর মাথার মধ্যে তখন পরপর বিস্ফোরণ। একটা গোটা আকাশ ঢুকে যাচ্ছিল হু হু করে। সব ভাবনা চিন্তা গুলিয়ে ফেলে  শরীর জুড়ে এক অন্তর্গত নদীর বয়ে যাওয়া শুনতে পাচ্ছিল সে আর তার সঙ্গে, পেটের মধ্যে গুড়গুড়। সুকান্ত বুঝতে পারছিলনা কার দখলে তার শরীর? কাম না খিদে, নাকি দুটোই ! মা’র কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এক অদ্ভুত আবেশে সুকন্ঠ দেখল অনেকদিন পরে সে জড়িয়ে শুয়ে আছে তার বালক দিনের মাকে। অস্থির হল সুকন্ঠ। কামে অবশ মণিমালার শরীরটাড় দিকে তাকিয়ে জড়ানো গলায় বলে উঠল...


মণিমা,  মণিমাগো...  বড্ড খিদে... !   





ছায়া যাত্রা 

ঋ ভু  চ ট্টো পা ধ্যা য়


 

-তোকে সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছি,আস্তে চালা, আস্তে চালা।দেখলি ট্রাকটা কেমন সামনে চলে এসেছিল।একটু হলেই এক্কেবারে পিশে দিয়ে চলে যেত।পলিও সমানে চেল্লাচ্ছে।


-ড্রাইভারকে একটু শান্তি দিতে হয়, এটা খুব চাপের কাজ।


-সেটা জানি বলেই তো তোমাকে এতক্ষণ ধরে আস্তে চালাতে বলছিলাম, শুনলে তো।গাড়িটাতে চেপে তুমি এটাকে রেসিংকার ভাবো।


-পলি, আমি জানি এটা রেসিংকার নয়।তবে এটা আমাদের মত ছোট ফ্যামিলির কাছে এক্কেবারে ড্রিমকার।


-ড্রিমকার বলেই কি এত জোরে চালাতে হবে?কোথাও লেখা আছে?


-কোথায় জোরে চালাচ্ছিলাম, আশি থেকে একশ, হাই রোডে এর থেকে কম স্পিডে চালালে পিছন থেকে কেউ এসে ঠুকে দিয়ে চলে যাবে।


-হুঁ ঠুকে দিয়ে চলে যাবে!ঠোকার জন্য সবাই বসে আছে তো।


-বিশ্বাস কর আর নাই কর, ইট ইস আ ফ্যাক্ট।                                       


-ঠুকলেই বা কি, তুই যেভাবে এঁটে সেঁটে বেঁধে রেখেছিস, একটুও সরতে পারিনা।


-সিটবেল্ট খুব কাজের মা, এই দ্যাখো একটু আগেই যেটা হল, ব্রেকটা জোরে দিয়েছিলাম তো জার্ক হল না, হবেও না।


-পলি, তাপ্তিকে তোল এবার, ঐ তো সব থেকে বেশি লাফালাফি করছিল।‘গাড়ি চাপব, ঘুরতে যাবো।’আর দ্যাখ গাড়িতে উঠেই কেমন ঘুমিয়ে পড়ল।


-গাড়িতে উঠে নয় গো মা, ব্রিজটা পেরিয়ে।তুমি শুনলে না বলল,‘বাবা গাড়িতে ডানা লাগানো যায়?’


-হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই তো বললাম,‘তোর বর লাগাবে, সাইকেলেও ডানা লাগানো থাকবে।’এই বাবু তুই কিন্তু গাড়ি চালানোর সময় এতবার ঘাড় ঘোরাবি না।তোর মেয়ে বউ সবাই ঠিক আছে।


-হ্যাঁ!মেয়ে বউ?শুধু মেয়ে বউ কেন, আমি তো তোমাকেও দেখতে পারি।


-আমাকে দেখবি না বাবা, এখন আর ছেলেরা মা’কে দেখে না।আমার ভাগ্যটা কি কুক্ষণে একটু ভালো হয়েছে, কে’ জানে?তবে তোর বাবা সামনের সিটে বসে থাকলে ঠিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখত।


-মা, যা বল না, হাসি পেয়ে যায়।


-হ্যাঁরে পলি, আগে যখন এরা ছোট ছিল ওদের বাবা প্রায়ই বিভিন্ন ছুঁতো করে রান্না ঘরে চলে আসত, জিজ্ঞেস করলে বলত,‘তোমাকে দেখতে এলাম।’


‘আমাকে না হাতি, এলে তো কাজুর সন্ধানে।না হলে চা নিতে।’


-তুই হাসছিস পলি?তোর শ্বশুর এমনিই ছিলরে।রান্নাঘরে এসে প্রায়ই কাজু নিয়ে খেত।খুব ভালোবাসত কাজু খেতে।


 -না’গো মা বয়স বাড়লে টানটা এমনিই হয়ে যায়।টান বাড়ে লোভও বাড়ে।আমার বাপের বাড়ির সামনে একটা বাড়ি আছে।এই শীতকালে একটা বুড়োবুড়ি থাকে।


-শীতকালে মানে ?


-বাবু সামনে তাকাবি।পলি বাড়ি গিয়ে বলবি তো।


-না না কথা বল, তবে গলাটা একটু আস্তে কর।


-জানো  মা সেই সময়ে ভোর বেলা পড়তে বসে বুড়ো বুড়ির গল্প শুনতে পেতাম।একদিন আবার ভোর তিনটের সময় দেখছি ওরা চা তৈরী করে খাচ্ছে।


-ভোর তিনটের সময়?বলিস কি’রে?


-তোমাদের ওদিকে সব ঐ রকম লোকজন থাকে।সব ছিটিয়াল, সব কুকুরের মাংস খায়, আর পাগলামি করে।


-দেখছ মা কেমন বাজে কথা বলছে।কে তোমাকে কুকুরের মাংস দিয়েছে গো?


-আরে আমিই তো বিয়ের আগে যে কয়েকবার তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম স্টেশন বা ওভারব্রিজে দু’টো বড় বড় কুকুর বসে থাকতে দেখতাম।বিয়ের পর আর দেখতে পাই না।


-খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু, বিয়ের সময় সবাইকে কুকুর খাইয়ে ছিল নাকি আমার বাবা?


-তুইও যেমন, ও বকছে বকুক না।ওর কথাতে কান করতে নেই।ওটা এই রকমই।


-না গো মা জানো ঐ দাদু-দিদাকে দেখে খুব কষ্ট লাগত।দুই ছেলে দু’জন দুদিকে থাকে, মাঝে মাঝে দেখা হয়।আর দেখা হলে সারাটা রাত দাদু-দিদা বসে গল্প করে।


-ওর বাবাও এমনই ছিল।যখন দ্বিতীয়বার হাসপাতালে ভর্তি হল সেপ্টিসেমিয়াতে শরীরে জল জমে গেছিল এক্কেবারে আনকনসাস, একটা হাসপাতাল থেকে জবাব দিয়ে দিল, আরেকটা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে,  অজ্ঞান, কিন্তু গাড়ি ছাড়ার সময় চোখ দুটো হাল্কা খুলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত হাসি।


-ও মা, তুমি আবার কাঁদছ কেন?


-কাঁদিনি রে, মাঝে মাঝে বুকটা হা হা করে।একটা মানুষ কেমন চলে গেল।বেঁচে থাকলে এই গাড়ি চেপে ঘোরাঘুরিটাতে সব থেকে ও খুশি হত।বেঁচে থাকতে প্রায় বলত,‘একটা গাড়ি কিনব, সবাই মিলে ঘুরব।’আজ দ্যাখ্ গাড়ি হল কিন্তু মানুষটাই থাকল না।


-তোমরা কি গো, বাইরে ঘুরতে বেরিয়েছি, তাও সবসময় ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ।যে গেছে, কাঁদলে কি আর ফেরত আসবে?


-ফেরত আসেনা সবাই জানে, তাও কি মন মানে, কষ্ট হয়।এই পলি তাপ্তিকে তুলে কিছু খাওয়া, কখন খেয়েছে বলতো।


-হ্যাঁ মা একটু পরে তুলব।


-মা একভাবে বসে থাকবে না।পা’দুটো ফুলে উঠবে।


-জানিরে বাবু।পা’দুটো ফুলে উঠলে সব থেকে অসুবিধা তো হয় আমার নিজের,ওষুধ, ডাক্তার, সে এক বিরক্তিকর অবস্থা হয়।বাবু, সেই সুদীপের দাদার গাড়িটাতে তোর বাবাকে কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেছিলাম।আমরা সিটে পা তুলে বসে ছিলাম বলে নেমে কত কিছু বলল, মনে আছে?


-এখানে তো পা তুলে বসলে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না।


-এই শোন একটু গাড়িটা দাঁড় করাবি তো, এমন এটে সেঁটে বেঁধে বসে আছি, বাতকর্মও হবে না।একটু হাত পা গুলো না ছাড়ালে তো ব্যথা আরম্ভ হয়ে যাবে।


-আর একটু গিয়েই দাঁড়াবো।একটা হোটেল দেখে তো দাঁড় করাতে হবে।মা তখন গাড়ির জন্য কত টাকা নিত বলতো।পার্কিং এ কুড়ি টাকা, নিয়ে নিত পঞ্চাশ টাকা।জিজ্ঞেস করলে আবার রেগে যেত।


-সেই সময়টা সত্যিই খুব কষ্টে গেছে।তোর চাকরি নেই, বাবার ঐ’কটা এম.মাই.এসের জমানো টাকার ওপর সংসার, একস্ট্রা বলতে শুধু তোর টিউসন।


-সব সমস্যাই তো কাটিয়ে উঠলাম মা।


-তবে আমাদের এই পলি কিন্তু খুব পয়া।ও আসার পরেই তো তোর প্রমোশন হল।


-আর তাপ্তির জন্মাবার পরে গাড়ি।


-মা, ঠিক জন্মাবার পরে তো নয়, দু’বছর বয়স হয়ে গেল।


-নারে ও পেটে থাকতেই সেই ডাক্তার বাবুর কাছে থেকে পুরানো গাড়িটা কেনা হল,মনে আছে?


-মনে থাকবে না।ডাক্তারবাবুর গাড়িতে ওনার ওয়াইফের একটা ছবি ছিল, সরাতে বারণ করে ছিলেন।


-দেখছ মা ডাক্তার বাবু কিন্তু ওনার মিসেসকে খুব ভালো বাসতেন।


-আমি প্রথম দিন ভেবেছিলাম আমাদের বাড়ির কেউ, পরে তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে ও সব কিছু বলল।আমার তো খুব ভয় লাগত, মনে হত যেন সিটের পিছনে বসে শ্বাস নিচ্ছে।


-ডাক্তারবাবু প্রথমে কিছু বলেননি, এক্কেবারে শেষের দিন বলেন।তার সঙ্গে কত কিছু কথা মেয়ে নাকি গাড়িটা বিক্রি করে দিতে বলেছে।আমি তবে শো’রুমে কিছু বলিনি যা ইচ্ছে করুক গে।তবে এই সব গাড়ি টারির সাথে অনেক আবেগ জড়িয়ে থাকে।তার সঙ্গে আবার ভালোবাসা প্রেম।আমরাও তো বাবার ছবি রেখেছি।


-কেন রে আমার ছেলেটা কি তোকে ভালোবাসে না?তোরা কি ভাবিস বুড়ো হয়ে গেছি বলে তোদের আকার ইঙ্গিত কিছু বুঝিনা?


-তুমি না কেমন যেন।


-ভালোবাসার কথা বললেই কেমন যেন।


-না গো মা এই স্বামী-স্ত্রী’র প্রেমটাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলা হয়।আরো কি সব আছে কান্তা প্রেম, দাস্য প্রেম, সখ্য প্রেম এইসব।কলেজের বৈষব পদাবলী পড়াবার সময় স্যার এই সব আলোচনা করতেন।


-অত বাবা প্রেম জেনে লাভ নেই বুড়ো বয়সে মুখের সামনে একটু খাবার ওষুধ এনে দিও, ব্যাস।


-দেখছ মা কেমন ভাবে বলছে, যেন আমিই কিছু দি না।


-না’রে বাবু পলি আমাদের খুব ভালো মেয়ে কোনো তো অভাব অভিযোগ রাখেনা।মুখের সামনে সব কিছু এনে তুলে দেয়।আমাকেও কিচ্ছু করতে দেয় না।


-ওমা!তুমি দেখো ওর ঘাড়ের কাছে ওটা কি? ঘাম!কোনো কিছুর ছায়া?দেখ তো।


-একি রে এতো রক্ত!কি করে এত রক্ত এল?তাহলে কি ঐ ট্রাকটাতে লেগে গেল।তাতে মাথার পিছনে এত রক্ত বেরোবে কেন?


-ওমা, তোমারও নাক দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।


-কই দেখি!হ্যাঁরে তাহলে কি লাগল?ঐ জার্কটাতে?ইন্টারন্যাল কিছু?


-ওমা আমারও মাথার পিছনে এটা কি দেখো তো।


-একিরে তোরও তো মাথার পিছনে রক্ত, এক্কেবারে গলগল করে বেরোচ্ছে।কোথায় লাগল বলতো ?


-বাবু!তোর কিছু কষ্ট হচ্ছে?


-মা ঐ দেখ সামনে কত লোক!ওরা তো আমাদের গাড়ির দিকে আসছে।


-বাবু গাড়ি পিছনে কর, গাড়ি পিছনে কর।পলি তাপ্তিকে ওঠা, তাড়াতাড়ি।বাবু নিশ্চয় কাউকে ধাক্কা মেরেছে, এখানকার লোক সব তাড়া করেছে।


-ওমা আমি মোনাকে ধরতে পারছি না।দেখ মোনা কেমন যেন ভারি হয়ে গেছে,তুমি চেষ্টা করে দেখতো ওঠাতে পারো কিনা?


-তাইতো আমিও তো ওঠাতে পারছি না।কি হল বলতে?বাবু গাড়ি দাঁড় করাস না, আরো জোরে চালা, পালাতে হবে, এরা না হলে মেরে ফেলবে।


-ওমা দেখ গাড়িটার চারদিকে লোক ঘিরছে, এই গাড়িটা ভাঙছ কেন?


-বাবুরে দেখ, দেখ কি হচ্ছে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।ওদের বারণ কর , বল কিছু।


-ওমা ওরা মোনাকে কেড়ে নিয়ে চলে গেল, কেন নিয়ে গেল, আমি গাড়িটা খুলতে পারলাম না কেন?মোনাকে ধরতে পারলাম না কেন ?


-বাবু তুই কিছু কথা বলছিস না কেন ?


-মা ঐ দ্যাখো ওপাশে কয়েকজন লোক একজনকে অন্য আরেকটা গাড়িতে তুলল।মুখটা দেখতে পেলাম না, কিন্তু জামার রঙটা তো ওর জামার মত, ওমা তোমার মত একজন!একই শাড়ি।একি মা ওটা তো আমি!মা তুমি কথা বললে না যে, দেখো।মোনা কই?ওমা মোনা কই, মোনা মোনা ?


-বাবু!পলি!মোনা!


-মা!পলি!মোনা!


-মা!মোনা!তুমি কই গো!




অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল

খুলি গুহার ভিতরে ও বাইরে 

প্র তা প  বো স 



রণ্যদেব! অরণ্যদেব!” শুধু এই শব্দ দুটো বিড়বিড় করেছেন অম্লান বাবু। আর তাতেই আশার আলো পেয়েছে উডল্যান্ড নার্সিংহোমের মেডিকেল টিম। এখনও চোখ বোজা। সারা গায়ে মাকড়সার জালের মতো  ছড়িয়ে আছে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম। বিভিন্ন মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্টের ওঠা নামা করা আলোর রাশি জানান দিচ্ছে এখনও চলছে প্রাণ বায়ু।  আই সি ইউ এর ছোট্ট লুকিং গ্লাস থেকে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ কে মনে হচ্ছে যেন ময়দানের এক কোনে ফেলে রাখা হেলাফেলার ট্রাম লাইন। কিন্তু সায়ন জানে ওটাই তার লাইফ লাইন। যেভাবেই হোক বাবাকে বাঁচিয়ে তুলতেই হবে। কিন্তু বাবা জ্ঞান আসার পর এটা কি বললেন! “অরণ্যদেব”! অন্য কিছু মনে পড়ল না। শুধু ছোটবেলায় পড়া কমিক সিরিজের অন্যতম জনপ্রিয় চরিত্র ফ্যান্টম তার মনে উদয় হলো! আশ্চর্য!  তাহলে এমন স্নায়ু বিপর্যয়ে কি বাবার মানসিক বয়সের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল! সেটা হলেও তো তার সমূহ বিপদ। না আর ভাবতে পারছে না সায়ন। আই সি ইউ এর লুকিং গ্লাস থেকে সরে এসে আর এম ও র টেবিলের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে পড়ল সে। আর এম ও ডাঃ চ্যাটার্জী ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে সায়ন কে এক পলক দেখে নিয়ে এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বললেন, 

“ডোন্ট ওরি মিঃ সেন। হি ইজ আউট অব ডেনজার নাও।“

“বাট হি ইজ ইয়ট টু ওপেন হিজ আইস।“

“ডোন্ট ওরি। সেন্ট্রাল নার্ভ সিস্টেম যখন কাজ করা শুরু করেছে তখন সব কিছুই আস্তে আস্তে চালু হয়ে যাবে।  ইটস ম্যাটার অব টাইম এন্ড পেশেন্স নাও।“


ঠিকই বলেছেন  ডাঃ চ্যাটার্জী। পেশেন্স। পেশেন্সটাই কি ওয়ার্ড। আরও পেশেন্স রাখা উচিত ছিল তার। মনে মনে ভাবল সায়ন। ওই ভাবে  বাবার সাথে তর্কে জড়িয়ে না পরলেও হত। ধীরেসুস্থে ব্যাপারটা ম্যানেজ করা যেত। কিন্তু বাবা এমন কাজ করেছেন যে জানতে পেরেই তড়িঘড়ি শর্মিলি কে নিয়ে মুম্বাই থেকে কলকাতায় চলে এসেছে সায়ন উইক এন্ডের আগেই।  আর তারপরই বাড়ি পৌঁছেই সরাসরি বাবার মুখোমুখি।  এই তো দিন চারেক আগের ঘটনা। এখনও ভাবলে  নিজের উপর রাগ বাড়ছে বই কমছে না।


“দিজ ইজ নট অ্যাট অল একস্পেটবল, ড্যাড।  ইউ কান্ট ডু লাইক দিজ।“

“সায়ন, আমি আবারও বলছি এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আমি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে তার থেকে পিছু হটার লোক আমি না সেটা তুমি তোমার ৪০ বছরের জীবনে নিশ্চয়ই অনেকবার দেখছ।“

“আই নিউ  ইন মাই বোনস্ দ্যাট ইউ আ গোয়িং টু ডিপ্রাইভ মি।“

“এটাকে তুমি বঞ্চনা বলছ! আরে বঞ্চিত যদি কেউ হয়ে থাকে সেটা আমি হয়েছি।“

“হোয়াট আ ইউ সেয়িং! হ্যাভ আই এভার ডিপ্রাইভড ইউ? আই ওয়াজ আ সুপা কিড সো ফা পেরেন্টাল ড্রিম ফ্লাইজ। হোয়াট হ্যাভন্ট আই ডান টু কিপ ইউর হেড হাই, প্রফেসর অম্লান সেন? আই ওয়াজ আ ইউনিভার্সিটি ব্লু উইথ গোল্ড মেডেলিস্ট ইন ইলেকট্রিকাল ইন্জিনিয়ারিং  ফ্রম আইআইটি মুম্বাই।“

“তাতে কি হলো? তুমি তোমার পেশার নেশায় আমাদেরকে সব ভুলে গেছ। গোল্ডম্যান স্যাকস্ এর টাকা বানানোর যন্ত্র হয়ে গেছ তুমি।“

“হাউ ক্যান ইউ সে দ্যাট ড্যাড। উই আর অলওয়েজ উইথ ইউ...মি এন শর্মিলি... পিপল ইউসড টু এনভি মি ফর পারফেক্টলি ব্যালেন্সিং মাই ওয়ার্ক লাইফ প্ল্যাঙ্ক!”

“হ্যাঁ, তা বটে। প্রতি সপ্তাহের শেষে তোমরা দুজনেই মুম্বাই থেকে কলকাতায় আস। কিন্তু ওই পর্যন্তই। যোগ আছে সংযোগ নেই। “

“হাউ কাম?”

“কারণ তোমার ভাষা। তোমার নিজের ভাষার প্রতি কোন মমত্ব নেই, ভালোবাসা নেই, সেই ভাষাকে সমৃদ্ধ করার বা নিদেন পক্ষে বাঁচিয়ে রাখার কোন চেষ্টা নেই।“

“ওহ্ ড্যাড! প্লিজ ডোন্ট টেল মি অল দিজ স্টোন এজ সেন্টিমেন্টস।“

“প্রস্তরযুগকে হেলাফেলা কোরো না। তোমার মধ্যের সমস্ত জিন ঐ প্রস্তরযুগের অবদান।  শিকড়কে অস্বীকার করে তুমি কোথাও পৌঁছাতে পারবে না। মাতৃভাষাকে অস্বীকার করা মানে মাতৃদুগ্ধ কে অস্বীকার করা।“

“বাট ড্যাড, মাই মাদার টাং কান্ট টেক মি টু নিউ হাইটস। মাই ওয়ার্ক ইজ মাই প্যাশন এন্ড ইংলিশ ইজ মাই ল্যাঙ্গুয়েজ অব প্যাশন।“

“কিন্তু তোমার মাতৃভাষার প্রতিও তোমার একটা কর্তব্য আছে। তাকে লালন করা, তাকে যাপন করা।  এগুলো তোমার কর্তব্য।“

“আই লাইক টু রাইট মাই সাকসেস স্টোরি ইন মাই ওন ওয়ে এন্ড মাই মাদার টাং হ্যাজ নো রোল টু প্লে দেয়ার। হাউ ক্যান আই লিভ উইথ দ্যাট।“

“সফলতা! তুমি কি জানো মানুষের বা প্রকৃতির মহত্তম সফলতা কী?”

“ওয়েল লেট মি নো ফ্রম ইউ।“

“মানুষের বা প্রকৃতির মহত্তম সফলতা হল যে সে নিজেকে পরবর্তী প্রজন্মে এমনভাবে ছড়িয়ে দিতে পারছে কি না যাতে  প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার পূর্বকাল থেকে পেয়ে আসা জিন বেঁচে থাকে। আর তুমি যেটা করছ সেটা শুধু তোমার একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিগত সাফল্যের পিছনে ছোটা, যার পিছনে তোমার গোষ্ঠী সচেতনতা নেই। তোমার জিনের ঐতিহ্য কে স্বীকার করে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়বদ্ধতা নেই।“

“আই অ্যাম এগজ্যাক্টলি ডুয়িং দ্যাট ড্যাড। মাই সান এন্ড ডটার, বোথ আর লিভিং উইথ ইউ, ইন ইউর ওন ওয়ে।“

“সেটা কতটা বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতির দায়বদ্ধতা থেকে আর কতটা তোমার পেশাগত সুবিধার থেকে সেটা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।“

“ওহ্, দ্যাট অফকোর্স হেল্পস মি ইন পারসুয়িং মাই ক্যারিয়র, বাট দ্যাটস দ্য সাইড এফেক্ট অব দ্য হোল প্রসেস। বাই দ্য ওয়ে, হোয়াটস পিনিং ইউ ইন দ্য প্রসেস?”

“দেখ অর্ক আর টিউলিপ দুজনেই আমাদের কাছে থাকছে, এখানেই পড়াশোনা করছে, বড় হচ্ছে। টিউলিপ কে নিয়ে আমাদের চিন্তা নেই। সে পরিপূর্ণ ভাবে ফুটে উঠছে। কিন্তু অর্ক...”

“হোয়াই, হোয়াটস রং উইথ হিম?”

“কেন? তোমার কিছু মনে হয় না?”

“এভরিথিং ইজ গোয়িং ওয়েল উইথ হিম। হি নেভার কামস সেকন্ড ইন হিজ ক্লাস এন্ড দ্যাট টু ইন আ স্কুল অব ইন্টারন্যাশনল রেপিউট। হি ইজ আ মিউজিক লাভার এন্ড হি উইল বি রিপ্রেজেন্টিং ইন্ডিয়া ইন টোয়েন্টিএইটথ ওয়ার্ল্ড মিউজিক কম্পিটিশন আন্ডার ফোরটিন স্ট্রিং ক্যাটেগরি। হি ইজ ওয়েল বিহেভড, হ্যাভিং হিউম্যান ভ্যালুজ। হোয়াট এলস ক্যান ইউ ডিমান্ড ফ্রম আ ইলেভেন ইয়ারস ওল্ড বয়!”

“সে দিক দিয়ে সে সত্যি সেন বংশের আদর্শ বংশধর হয়ে উঠছে। তবু একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। সে আমার সাথে বাংলায় কথাই বলে না।“

“ওহ্, রিয়েলি!  এন্ড হি নেভার এভার টক ইন ইংলিশ উইথ মি অর উইথ হিজ মম। এন্ড আই টোল্ড হিম, দিজ কান্ট টেক হিম টু পিক।“

“তাহলে বুঝতে পারছ, তোমার ছেলে তোমাকে কি বোঝাতে চাইছে। প্রাণের ভাষায় কথা বলো। কাজের ভাষায় না।“

“দেন হাউ কাম হি টকস উইথ ইউ ইন ইংলিশ!”

“সেটাও একটা ধাঁধা হয়ে আছে আমার কাছে। তার মনের কোন অব্যক্ত কষ্ট সে বোঝাতে চায়। বুঝতে  হবে, আমাকে বুঝতেই হবে।“

“এনি ওয়ে, উই আর ড্রিফটিং ফ্রম দ্য পয়েন্ট। ইউ হ্যাভ টু চেঞ্জ ইউর উইল।“

“এটা আমার উইল। আমি কি করব সেটা আমার স্বাধীনতা।“

“বাট ড্যাড, দিস ফিফটিন থাউজ্যান্ড স্কোয়ার ফিট টু স্টোরিড ম্যামেথ বাংলো ইন আলিপুর ইজ আওয়ার অ্যানসেস্ট্রল প্রপার্টি। ইউ জাস্ট ওন ইট নাও অ্যাস ন্যাচারল সাকসেসর, নাথিং মোর দ্যান দ্যাট। দেন হোয়াই নট মি?”

“ঠিক, আমি উত্তরসূরী হিসেবেই এই সম্পত্তি পেয়েছি। কিন্তু এই বংশের ঐতিহ্যও আমি সমানভাবে রক্ষা করেছি। আমার প্রপিতামহের বাংলা ভাষায় পাণ্ডিত্য, গবেষণা,  সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হয়ে এ জমি দিয়েছিলেন তদানীন্তন কৃষ্ণনগরের মহারাজা। তারপর সেই জমিতেই আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে এই বাড়ি। তাই এই বাড়িতে বাংলার অবমাননা আমি কিছুতেই মেনে নেব না।“

“ওয়াজ দেয়ার এনি কন্ডিশন হোয়েন গ্রান্ডপা হ্যান্ডেডওভার দ্য প্রপার্টি টু ইউ? নো, নট অ্যাট অল। দেন হাউ কাম ইউ আর ইমপোজিং কন্ডিশন অন মি!”

“আমার বাবা আমার উপর ভরসা রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু আমি তোমার উপর রাখতে পারছি না।“

“এন্ড ফর দ্যাট ম্যাটার ইউ আর ডিপ্রাইভিং মি। ইন ইউর অ্যাবসেন্স মম উইল বি দ্য সাকসেসর এন্ড আপ টু দ্যাট পয়েন্ট ইট  গোজ ওয়েল উইথ মি। বাট ড্যাড হাউ কাম ইউ পাস অন দ্য সাকসেসন টু পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আফটার মমস পাসিং অ্যাওয়ে। দিজ ইজ নট অ্যাট অল একস্পেটবল ড্যাড।“

“হ্যাঁ, এটাই হবে। আমি এ বাড়িতে বাংলা ভাষার অমর্যাদা হতে দেব না।“


তারপর সেই যুক্তি তর্ক কে একটা ঝড় এসে ঝগড়ায় নিয়ে চলে গেল। আর ঝগড়া তখনই চরমে ওঠে যখন স্বরে জোরের তাপমাত্রা একশ ডিগ্রী অতিক্রম করে যায়। আর সেই চরম মুহূর্তে হঠাৎ সেরিব্রাল অ্যাটাকে ধরাশায়ী হয়ে গেলেন অম্লান বাবু। 



যদি বাবা না বাঁচতেন, যদি বাবার স্মৃতি শক্তি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে? তাহলে তো উইলটায় আর চেঞ্জ হত না বা হবে না। উফফ! কি বোকার মতো কাজ করেছে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই দুদিকে মাথা নাড়াল সায়ন। একটা অস্থির দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এল তাড়াহুড়ো করে। ডাঃ চ্যাটার্জী আবার আশ্বস্ত করলেন সায়নকে,

“মিঃ সেন, আই ফিল ইউ নিড আ ব্রেক নাও। ইন দিজ ফোর ডেইজ ইউ পিপল হ্যাভ ট্রাভেলড মিলিয়ন মাইলস ইন ইউর মেন্টাল রোড। ইউর ড্যাড ইজ আউট অব ডেঞ্জার নাও। আউর নিউরো টিম ইজ সুপারভাইজিং হিজ এভরি ইম্পালস টোয়েন্টি ফোর বার সেভেন। প্লিজ গো এণ্ড টেক রেস্ট এট হোম। উই উইল কিপ ইউ ইনফর্মড এনি ইমপ্রুভমেন্ট দ্যাট উই রেজিস্ট্রার।“


এক রাশ চিন্তা নিয়ে বেরিয়ে আসে সায়ন। বাবা জানেন না সেন বংশে সেনসেক্স কি ঝড় তুলেছে। তার মার্কেট ক্রেডিবিলিটির একমাত্র ভরসা এখন এই সম্পত্তি। কিন্তু “অরণ্যদেব”! কেন ডাকছেন অরণ্যদেবকে বাবা। কি হবে যদি বাবা মনের জঙ্গলে হারিয়ে যান। সমস্ত দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সায়ন। একবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক বাবা। বাবার সব কথা মেনে নেবে সে।


এরপর মাস খানেক কেটে গেছে। অম্লান বাবু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তারও একমাস পরে অম্লান বাবু সবাই কে তাঁর ঘরে ডাকলেন। এসবের মধ্যে থাকতে চান না মধুমালা দেবী। কিন্তু আজ থাকতে হবে। না হলে আবার বাবা ছেলে যদি কোন তর্কে জড়িয়ে পড়ে। সায়ন ও শর্মিলি অনেক আগেই বাবার কাছে বসে আছে। ধৈর্য আর কৌতুহল পরস্পরের পরীক্ষা নিচ্ছে।  টিউলিপ এসে দাদুর গা ঘেঁষে বসল। সবার শেষে এল অর্ক।


“ওয়েল দেন, লেটস্ স্টার্ট  ড্যাড।“  আর অপেক্ষা করতে রাজি নয় সায়ন।

“ইয়েস ড্যাড, উই অল আর ইগারলি লুকিং ফ ইউর সারপ্রাইজ।“ শর্মিলিও কড়া নাড়া শুরু করল সায়নের সাথে।

“কি চমক মাতঃ? আমরা কি অরণ্য ভোজনে যাব? গ্রান্ডপা, ইউ প্রমিসড টু টেল মি দ্য স্টোরি- ওল্ড ম্যান এণ্ড দ্য সি।” অর্কর ভাষা নিয়ে দুষ্টুমিতে সবাই হেসে ওঠে। 

“দাদুভাই, আজ যেটা বলছি সেটাও একটা বৃদ্ধ লোকেরই গল্প। অরণ্য ভোজনের গল্প নয়, এ হল অরণ্যের ঈশ্বরের গল্প।  তিনি  ১৯৩৬ এ আত্ম প্রকাশ করলেও আজও তাঁর বংশধরেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে খুলি হাতে নিয়ে শপথ নেয় এই বলে যে তাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করছে সমস্ত রকমের অন্যায়, অত্যাচার, লোভ, নিষ্ঠুরতা কে ধ্বংস করতে এবং তাঁর সন্তান ও তাঁর সন্তানের সন্তানরা একই পথ অনুসরণ করবে। অরণ্য তার ভিত্তি ভূমি। কিন্তু অরণ্যের সাথে নগরকেও তিনি রক্ষা করে চলেছেন।“

“ওহ্ ফ্যানটম!” টিউলিপ ও অর্ক একসাথে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। 

“ফ্যানটম! বাট ড্যাড উই থট সাম সিরিয়াস বিজনেস আউট হেয়ার।“

সায়ন কে এক হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে অম্লান বাবু বলে চলেন, 

“ধন্যবাদ দাদু ভাই,  তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ।“ পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন অর্কর, তারপর সায়নদের দিকে ফিরে বললেন,

“এই যে অর্ক সবসময় তার বাবা মার সাথে বাংলায় কথা বলে আর আমার সাথে ইংরেজিতে এটাই আমি অনেকদিন  ভাবছিলাম। কেন বলে ও এরকম। ভাবতে ভাবতেই মনে হল যে ও, না ওর বাবা মায়ের যোগাযোগের ভাষা পছন্দ করে, না ও আমার যোগাযোগের ভাষা পছন্দ করে। তাই ও ঠিক আমাদের পছন্দের উল্টো ভাষায় কথা বলে। এটা পরিস্কার যে এটা ওর একটা রূপক প্রতিবাদ। কিন্তু কেন?”


সায়ন আর শর্মিলি পরস্পরের দিকে বিস্ময় চিহ্ন ছুড়ে দেয়। অর্ক আর টিউলিপ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। অম্লান বাবু বলে চলেন,

“কারণ ওর মনে হয় আমরা দুই প্রজন্মই ভাষার ব্যাপারে উগ্রপন্থী। তোমরা তোমাদের কাজের ভাষায় স্বপ্ন দেখ আর আমি আমার মাতৃভাষায় ইংরেজি বই পড়ি। দুটোই দরকারী, কিন্তু দু জায়গায় আলাদা আলাদা করে। তাই আমি নিজেকে আজ থেকে পরিবর্তন করেছি, আর চাই আমার পরবর্তী প্রজন্মও সেটাই অনুসরণ করুক।“

“হেয়াট কাইন্ড অব চেঞ্জ ?” সায়ন ও শর্মিলি একসাথে জিজ্ঞেস করে ওঠে।

“অরণ্যদেবের মত আমরাও শপথ নেব। এই বাড়িই আমাদের খুলি গুহা। আজ থেকে আমরা বর্ণপরিচয় হাতে নিয়ে এই প্রতিজ্ঞা করব যে  বাইরে যে ভাষায় কথা বলি না কেন আমরা আমাদের বাড়িতে সবসময় আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলব আর আমাদের সন্তান ও তাদের সন্তানরা সেটাই অনুসরণ করবে। এর জন্য আমরা আমাদের জীবন উৎসর্গ করলাম। এই শপথ বাক্যই হবে এই সম্পত্তির মালিকানা পাওয়ার অন্যতম শর্ত।“

সায়ন হেসে এক লহমায় এই শর্তে রাজি হয়ে যায়। 


“কিন্তু দাদু, অরণ্যদেব তো আউটারের উপর ইনার পরে সেটার কি হবে! অরণ্যদেবের মত আমিও কি এখন থেকে আউটারের উপর ইনার পড়ব?” চোখে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করে অর্ক।

সবাই সজোরে হেসে ওঠে। 

“দাদুভাই ওটা রূপক। ব্যতিক্রমী চিন্তার প্রকাশ। মানে ইংরেজিতে যাকে বলে আউট অব বক্স থিঙ্কিং। এক কাজ কোরো। তুমি মাঝে মাঝে ইংরেজি কথাবার্তা বাংলা ব্যাকরণ অনুযায়ী বলতে পার। তাতে তোমার মস্তিস্কের কম ব্যবহৃত ডান দিকটা আরও সক্রিয় হবে।“

“কি রকম দাদু?”

“যেমন ইংরেজির “আই ডোন্ট লাইক লায়ারস” কে তুমি বলতে পার “আই লায়ারস লাইক ডোন্ট।“

“ওহ্, এটা তো আমার আর বোনের খুব প্রিয় একটা খেলা। কিন্তু আসল ইনার অন আউটার এর রহস্যটা শুনবে?”

সবাই সাগ্রহে অর্কের দিকে তাকায়।

“এই যে এক একজনের সাথে এক এক রকম ভাষা-ব্যবহারের প্রতিবাদের মুখ হিসেবে তোমরা আমাকে ভাবো, আসলে কিন্তু পরিকল্পনাটা টিউ এর। আমি শুধু রূপায়ণ করেছি।




সেতু

শু ভ দী প  ব সু




বরের  চ্যানেলটা বন্ধ করে দিল বসুধা।একই খবর চলছে  তো চলছেই।এত নাশকতা,এত যুদ্ধ  আর ভাল লাগে না দেখতে আজকাল। খুন,খারাপি,রাহাজানি,এই তো শুধু খবর।কতক্ষ্ ণ আর দেখা যায়। মাঝেমধ্য বিরক্ত লাগে বসুধার। 

সিরিয়াল দেখতে কোনদিনই ভালো লাগে না  ওর।সেখানেও সেই ধৈয্যর পরীক্ষা। চলছে, চলবে করে গল্পের গরু যখন গাছের মগডালের মাথায় গিয়ে বসে পড়ে তখন এটা কি দেখছি ভেবে নিজের  প্রতি আর শ্রদ্ধাশীল থাকা যায় না। তার চেয়ে বরং সিরিয়াল দেখে সময় নষ্ট করে না বসুধা, সন্ধ্যার একঘেয়েমি কাটানোর এখন তাই একটাই উপায় – অপেক্ষা। 

 মেয়েটা বাড়ি ফিরলেই হুলুস্থুল অবস্থা। কোনমতে ব্যাগটা রেখেই প্রথমেই খাবার টেবিলে গিয়ে দেখে নেবে রাতের মেনুতে কি আছে। পছন্দসই হলে খুশী,না হলেই মুখটা ভার।সবসময় মুখে কিছু না বললেও বসুধা বোঝে, মায়ের মন তো!

ঘড়ির দিকে তাকালো বসুধা, রাত ন'টা বেজে দশ মিনিট, এখনো এল না মেয়েটা।আজ আবার হয়তো রাত হবে।ওদের আবার অফিসে অমানুষিক কাজের চাপ।তবে হ্যাঁ মেয়েটা কিন্তু সত্যি মন দিয়ে খেটে যায়, ক্লান্তি নেই। শুধু কাজ করে গেলেই হল,একটু তো নিজের কথাও ভাবতে হবে মাঝে মধ্যে। বসুধা কতবার বলেছে এবার একটু জীবনে থিতু হ', কে শোনে কার কথা! বসুধাকে ছেড়ে সে নাকি কোথাও যাবেই না,শোনো মেয়ের কথা। এই বুড়িটা আজ আছে, কাল নেই, তারপর? ভাবলেই ভয় হয়, কিন্তু কি করবে সে। মেয়েটা বড় একরোখা।

ওর অফিসের ওই যে ছেলেটা, কি যেন নাম, হ্যাঁ সোম, কম তো দময়ন্তীর পেছনে ঘুরপাক খায়নি,কিন্তু কি হল তাতে! বসুধা কিন্তু সব বুঝতে পেরেছিল, দমুকে বুঝিয়ে ছিল,ছেলেটা বেশ ভালো, শিক্ষিত, বড়ো মাপের চাকরি করে, নিজের বাড়ি,গাড়ি সব আছে,কিন্তু সে পাত্তা দিলে তো।তবে হ্যাঁ, মেয়েটাও অনেক চেষ্টা প্রচুর পরিশ্রম করে আজ কাজের ক্ষেত্রে নিজের একটা জায়গা করে নিয়েছে। খুব উঁচু পদে কাজ করে সে,নিজেও।

এই সাতপাঁচ ভাবাটাই এখন বসুধার কাজ। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। খাবারগুলো কি গরম করতে শুরু করে দেবে, না একটু বাদে? ঠিক বুঝতে পারছে না।প্রথমত বারবার খাবার গরম করাটা একদম পছন্দ নয় বসুধার।কেউ কখনো বলেছিল তাতে নাকি খাদ্যগুণ নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা হ'ল বাড়ির মানুষ বাড়ি না ফেরা অবধি খাবার সাজিয়ে পাত পেড়ে বসে থাকতে ভালোবাসে না বসুধা। 

আজ রাতের জন্য খুব বেশি কিছু একটা রান্না করেনি।একটু ডালের বড়া দিয়ে পেঁপে আর হঁাসের ডিমের ডালনা।ব্যস,এই তাই একা হাতে করতে বেশ অনেক সময় লেগেছে।ডাল নিজের হাতে বেটে  বড়া বানিয়ে একে একে তেলে ভেজে খুব যত্ন করে রেঁধেছে সে। দমুর খুব পছন্দ বড়া। সব বড়া খুঁটে খুঁটে খেয়ে নেবে,পড়ে থাকবে পেঁপে,তা খাবার লোক তো আছেই- বসুধা।

এখন রাত প্রায় সাড়ে ন'টা।কি করবে? একটা ফোন করে দেখবে কি? না,যদি গাড়ি চালায়।ভীষণ ভয় লাগে তঁার।গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন ধরাটা এক্কেবারে পছন্দ ন'য় বসুধার।সে নিজে বারবার ওকে মনে করে দেয় “ দমু,গাড়ি চালাবার সময় ফোনে কিন্তু কথা বলবি না।“আর এখন সে নিজেই যদি ফোন করে, না একদম ঠিক হবে না। দমুর আবার ঠান্ডা খাবার মুখে রোচে না। তবে,শুধু দমু একা নয়,বসুধাও পারে না একদম। অনেকে কি সুন্দর ঠান্ডা খাবার খেয়ে নেয়।

এখন দশটা ।বসুধা অগত্যা উঠলো খাবার গরম করতে।সত্যি,বসুধার অনেক ঝামেলা।মাইক্রো ওভেনের গরম আবার ঠিক মনের মতো নয়। অথচ,দ্যাখো সব্বাই তাই খাচ্ছে।আগুনের আঁচে গরম না হলে ঠিক যেন স্বাদ আসেনা। 

“না, এবার সত্যি আস্তে-ধীরে রান্নাঘরে যাই,মেয়েটা একবার এসে গেলে আর দাঁড়াবে না,তখন হয় আমার মুশকিল “ মনে মনে ভেবে আপন মনেই বিড়বিড় করল।

একবার যদি এসে পড়ে তখন তার তাল মেলাতে রীতিমতো হিমসিম খেতে হতে হবে। 

এখনো গরম করোনি? 

যা না হাত মুখটা ধুয়ে আয়

ধুর,খিদে পেয়ে গেছে

মেয়েটা এখনো যেন বড় হয়নি। অবশ্য বড়াবড়ি ও এরকম,হাজার বল্লেও শুনবে না। কতবার ওকে বলেছে হাত মুখটা ধুয়ে বাইরের জামা কাপড়টা ছেড়ে খা,না,কে কার কথা শোনে।বাড়ি এসেই খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে সোফায় বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে খাওয়াটাই ওর অভ্যাস। এটা নতুন নয়,বরাবর।

খাবারগুলো গরম করে সবেমাত্র টেবিলের দিকে যাচ্ছে,কলিং বেল টা বেজে উঠল।ঘড়ির দিকে তাকালো বসুধা। দশটা কুড়ি।হাতটা আঁচলে মুছতে মুছতে দরজাটা খুলে দিল। 

কি রে,আজ আবার এত দেরি?

সোয়া দশটা তো

একটা ফোন করবি তো

ওহ,আর করা হয়নি,কি আছে গো রাতে?

প্রায় এক নি০শবাসে বলল দময়ন্তী। কোনোমতে ল্যাপটপের ব্যাগটা সোফায় ছুঁড়ে ফেলল,তারপর হাতটা ধুয়েই খাবার টেবিল।বসুধা ঠিক যা ভেবেছিল হুবুহু তাই।আঙুল দিয়ে বড়াগুলো তুলে খেতে শুরু করল।বসুধা এবার একটু ধমকের সুরে বলল,”ভালো করে বসে খা,এভাবে একটা খাওয়া হয়?”



(২)

বসুধার ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।বালিশের তলা থেকে মোবাইল টা বার করে টাইমটা দেখল।রাত একটা।প্রতিদিন এই এক সময় ঘুমটা ভেঙে যায়,আর আসে না। বয়সের সাথে ঘুমের একটা নিবিড় যোগাযোগ আছে।

বন্ধ দরজার নীচ দিয়ে পাশের ঘরের আলোটা খুব জোড়ালো হয়ে বসুধার ঘরে ঢুকছে।এখনো দমু ঘুমোয়নি! এত রাত্রে মেয়েটা করছেটা কি? মনে হয় আলোটা না নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আস্তে আস্তে খাটের উপড় উঠে বসল,ধীর পায়ে অন্ধকারেই এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলল,খুব আস্তে।পাছে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটার না ব্যাঘাত হয়।

বসুধা দেখল, দময়ন্তী খাটের উপর চুপ করে একা শুয়ে আছে,পাশে বিছানার উপর খোলা রাখা আছে ল্যাপটপটা।কি যেন ভাবছে একমনে,একদৃষ্টিতে। বসুধা কাছে এসে দাঁড়াতেই ওর ঘোরটা যেন কাটলো।

কি গো, তুমি ঘুমোওনি?

বসুধা কোনো উত্তর না দিয়ে ওর পাশে এসে বসল।দমুর মাথায় হাত রেখে বলল,” তুইও তো ঘুমোসনি।“

মৃদু একটা ম্লান হাসি হাসল দময়ন্তী।

আমার ঘুম এ'রমই,তুই ঘুমো,সারাদিন এত দৌড়ঝাঁপ 

ঘুম আসছে না, যাও তুমি গিয়ে শুয়ে পড়

তুই শো,আমি না হয় তোর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দি? চোখটা বন্ধ কর,দেখবি ঘুমটা এসে যাবে।

দময়ন্তী গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বসুধার দিকে পাশ করে শুলো,বসুধা ওর কপালে,মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

খুব কাজের চাপ না রে? 

হুম,তা তো একটু আছেই

ছেড়ে দে তো,অতো আর খাটাখাটনি করে লাভ নেই

কথাটি বলেই বসুধা বুঝল,এটা বলা মানেই নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছে।ঠিক তাই,দমু যে বেশ বিরক্ত হয়েছে বোঝা গেল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ভুরুটা কুঁচকে গেল।

কাজ করি,আমার ভাল লাগে তাই

তা তো জানি,কিন্তু কত রাত হয়, বল?

তো কি করব? সারাদিন বাড়িতে বসে থাকব?

চোখ বুজেই বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠলো দময়ন্তী।

আচ্ছা,আচ্ছা এবার ঘুমো

দমুর চোখের উপর হাতটা দিয়ে রাখল বসুধা।

বসুধা, কিন্তু জানে আজ দমুর ঘুম না আসার অনেক কারণ আছে।যতই দমু কিছু না বোঝাক,যতই ও ভাবুক বসুধার কিছু মনে নেই, যতই ও ভাবুক বসুধাকে ও ফাঁকি দেবে ও কিন্তু পারবে না। কালকে যে ১৬ই ফেব্রুয়ারি। 



(৩)

১৬ই ফেব্রুয়ারি, আজ থেকে পনেরো বছর আগের কথা,কিন্তু মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা। দময়ন্তীর সাথে শুভ্রর প্রথম দেখা হওয়ার দিন ছিল এই ১৬ ই ফেব্রুয়ারি। শুভ্রর সহপাঠি অলোকের অফিসের কলিগ ছিল দময়ন্তী গুহ। সুন্দরী,বুদ্ধিমতি  দময়ন্তীর সাথে প্রথম পরিচয় অলোকের বাড়ির একটি অনুষ্ঠানে। সাদা লাল ঢাকাই জামদানিটি যেন ওর তনুকায় শরীরে ভীষণ ভাবে খেলে যাচ্ছিল, কানের রূপোর ঝুমকো,খোঁপার জুঁই যেন কোন এক অচেনা হাতছানি দিয়ে ইশারা করছিল শুভ্রকে।লাজুক শুভ্র যেন আরো লজ্জা পাচ্ছিল। নিজে থেকে দময়ন্তীই কথা বলেছিল প্রথমে। ঘন কালো কাজল পড়া চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিল শুভ্র যে আর যাই হোক আর কারুর দৃষ্টি এতো গভীর হতে পারে না,কারুর চোখের ভাষায় এত টান সে এর আগে আর কখনো অনুভব করেনি।

এরপর সবই ঘটল এমন ভাবে যেন এমনটাই দাবি করেছিল জীবন। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা, তারপর পরিণয়।

জীবন চলতে থাকে,কিন্তু এই ১৬ই ফেব্রুয়ারি ওদের জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলে।প্রতিবছর এই দিনটি শুধু ওদের।সারাদিন একসঙ্গে এই দিনটি উদযাপন করার এক অলিখিত আবদার ছিল পপরস্পরের কাছে দু’জনেরই ।হাজার ব্যস্ততার মাঝেও কোনোদিন এমন হয়নি যে তারা একসঙ্গে থাকেনি। একবার তো শুভ্র মুম্বাইতে একটা কাজে গিয়ে আটকে গেছিল,দময়ন্তী কি করবে ভেবে না পেরে প্রচুর টাকা দিয়ে টিকিট কেটে নিজে পৌঁছে যায়। শুভ্র তো প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেনি। সেবার সারারাত মেরিন ড্রাইভে ঘুরেছিল দুজনে।সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় দুজনে বসে বসে কষেছিল ভবিষ্যতের অনেক অঙ্ক,দুজনে মিলে মিলিয়ে নিতে চেয়েছিল আগামী দিনের অনেক হিসেব।

কিন্তু হঠাৎ করেই সব কেমন যেন হিসেবের বাইরে চলে গেল। এটাই হয়ত হওয়ার ছিল।কিন্তু কেন এমন হল জানে না বসুধা। নিজেকে কতবার সে প্রশ্ন করেছে, কিন্তু উত্তর পায়নি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিল, জীবনের হিসেব কেউ কোনোদিন মেলাতে পারবে না। ভেবেছিল ভগবানকে একদিন প্রশ্নটা করবে,কিন্তু আর করেনি কারণ বিশ্বাসটাই যে আর নিজের মধ্যে বেঁচে  নেই। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করেই সব যেন কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল।

খবরটা হঠাৎ করেই আসে। দুপুরের খাবার পর যখন টিভিটা খোলে বসুধা। বুকটা কেঁপে উঠল। প্রতিটি চ্যানেলে তখন ওই এক খবর- কলকাতার বুকে ভেঙে পড়েছে একটি ব্রীজ। প্রচুর অফিসযাত্রী, অটোচালক,পথচারী আটকে পড়েছে তার নিচে।জনবহুল রাস্তায় আচমকাই ঘটে এই ভয়াবহ ঘটনাটি।বসুধা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়ি থাকে টিভির রঙিন স্ক্রিনে। টিভির পরদায় তখন নিঁখোজ নামের তালিকা। এত নিষ্ঠুর হতে পারে না ঈশ্বর, হা হা কার করে ওঠে বুকের ভিতরটা। নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ঘরময় তখন শুধু সংবাদ ঘোষিকার কন্ঠস্বর। 



(৪)

বসুধা দেখল মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে।আস্তে আস্তে নিজের হাতটা তুলে নিল দমুর চোখের উপর থেকে। ঘুমন্ত,শ্রান্ত মুখটার দিকে কিছুক্ষ্ণণ তাকায়ি থাকল বসুধা।

আজও সেই চিৎকারটা যেন কানে ভেসে আসে বসুধার।একা একা রাত্রে যখন ঘুম আসেনা, কিম্বা দুপুরে সারা পাড়া যখন থাকে নিস্তব্ধ, তখন বারবার বারবার ওই কথাগুলি যেন মননের একদম ভিতর থেকে স্ফূলিঙ্গর মত আগুনের হল্কার মতো ঊগ্রে বেড়িয়ে আসে- মা,আমার কি হবে, মা? ও যে চলে গেল,মা!”

বসুধার বুকটা যেন আজও দপ করে ওঠে।চুরমার হয়ে ভেঙে যাওয়া বুকটা আজও অনেক ক্ষত লুকিয়ে রাখার ভার বয়ে চলেছে। সেদিনও নিজের সন্তান হারানোর ব্যাথাটা বুকের গভীরে চেপে রেখে বুকের মাঝে টেনে নিয়েছিল নিজের ছেলের সবথেকে ভালোবাসার মানুষটিকে।

সামাজিক অনেক ব্যাখ্যা, অনেক প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে বসুধাকে,কিন্তু সে জানে সামাজিক কোনো সম্পর্কই যে প্রাণের সম্পর্কর থেকে বড়ো হতে পারে না। হয়তো জানে দমুও। সম্পর্কর সেতু তো এভাবেই বাঁধা হয়।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় বসুধা।ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বড়িয়ে আসে ঘর থেকে। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন” মেয়েটা ঘুমিয়েছে তো?”