।। প্রবাসী কলম ।। 


অলংকরণ : শুভদীপ মন্ডল


গৌড় সারং

বু মা  ব্যা না র্জি  দা স

(কানাডা)


গোলবাড়ি থেকে কষা মাংস আর পরোটা খেয়ে তিন বন্ধু যখন বেরোলাম তখন প্রায় বিকেল। মার্চ মাস। সন্ধ্যের দিকে সুন্দর হাওয়া দেয়। সত্যজিৎ, সমরেশ আর আমি কল্যাণ সিংহ রায়। বাগবাজারের নাম করা সিংহ রায় বাড়ির একমাত্র ওয়ারিশ আমি। বাড়ির গাড়িতেই আসা। সত্যজিৎ বললো - চ‘ গঙ্গার ধারে গিয়ে বসা যাক খানিক। তাড়া নেই তো কারুর? সমরেশ বহুদিন পর কলকাতা ফিরেছে গত সপ্তাহে। হাতে এখন অনেক সময়। আর আমার আবার তাড়া। বাড়ি না ফিরলেও কেউ খেয়াল করার মত নেই। অবিশ্যি তাতে আমার কোনও আক্ষেপও নেই। এরকমটাই পছন্দ আমার। চল্লিশ বছরের পুরনো ড্রাইভার গণপতিদাকে গঙ্গার ধারে নিয়ে যেতে বলে গাড়িতে উঠে পড়লাম তিনজন। 



এসব এলাকায় বছর ত্রিশ আগেও একডাকে চিনতো সিংহ রায়দের। আমাদের বিশাল বাড়িটার বেশিরভাগই ভেঙ্গে পড়েছে এখন। বাবা নেই আজ প্রায় কুড়ি বছর। মা তারও আগে থেকে নেই। আমার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। বিয়ে করিনি আর করার কোনো ইচ্ছাও কোনোদিন হয়নি। আমরা যাকে বলে সুরের বংশ। ঠাকুরদার ছিল বাদ্যযন্ত্রের বিশাল ব্যবসা। নিজে হাতে যন্ত্র বানাতে জানতেন। চাকরি করে খেতে হয়নি এ বাড়ির কোনও পুরুষকে।মাকে মনে হলেই মনে পড়ে চোখ বুজে ঠাকুর ঘরে ভজন গাইছেন। বাঁশির মত গলা ছিল। লোকের সামনে কোনদিন গাইতেন না অবশ্য। অত বড়ো পরিবারের বউ, লোকের সামনে গাইলে নিন্দা হবে। খালি মনে পড়ে চোখ বন্ধ করে মা গাইছেন, নাকে হীরের নাকচাবি জ্বলজ্বল করছে। দু চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে।বাবা গাইতেন বিশুদ্ধ ধ্রুপদী। কতদিন ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেত আলবেলা সজন আয়ো রি শুনতে শুনতে। বাবার সবচেয়ে প্রিয় ছিল গৌড় সারং।ওরকম নাকি খুব কম লোক গাইতে পারতো।এভাবেই সুরের মধ্যেই জন্ম, বড়ো হয়ে ওঠা। শুধু মা বাবার মত সুরকে ভালোবাসতে পারলাম না কখনো। ছোট থেকেই শুনতাম সন্ধ্যের রাগের নামে আমার নাম। হাতেখড়ি হওয়ার আগেই বাবার কাছে গান শেখা শুরু হয়ে গেছিল। রক্তে সুর ছিল সন্দেহ নেই। খুব ছোট থেকেই রাগ পেহচান অর্থাৎ সুর শুনে কি রাগ সেটা বুঝে নেওয়া আমার কাছে জলভাত ছিল। কিন্তু সুরের আনন্দটা কোনোদিন পেতাম না। মা হয় রেওয়াজ করছেন বা পুজোর ঘরে বসে গান গাইছেন। ওই ঠাকুর ঘরই সব। একটু অদ্ভুত ছিল সেই ঠাকুরঘর। বেদীর উপর কোনও মূর্তি কোনোদিন দেখিনি। একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি বসানো থাকত। সে যে কিসের ছবি কোনোদিন ভালোভাবে বুঝতে পারিনি। কালো ঝাপসা কিছু একটা। কোনো দেবতা হলে চোখ মুখ তো থাকবে। মা হয়তো বলেছিলেন কখনো কিসের ছবি, কিন্তু আজ আর সে মনে পড়েনা। 



মাকে কোনোদিনই সেভাবে কাছে পাইনি। মনে হতো সুর আর ঠাকুরঘর মাকে কেড়ে নিয়েছে। আমার দেখভাল করতো আমাদের অনেকদিনের পুরানো কাজের মাসী। সেই খেতে টেতে দিত, যত্ন আত্তি করতো যথাসাধ্য। উৎসব লেগেই থাকত বাড়িতে। আর তার সাথে গান। বাবাও অবিশ্যি কোথাও গান গাইতে যেতেন না, তবে বাড়িতে মাঝে মাঝেই মজলিশ জমে উঠতো। খুব ছোটতে আমাকেও সেই মজলিশে গান গাইতে হতো। এখনো মনে পড়ে বাবার পাশে বসে তাল মিলিয়ে বন্দিশ গাইছি ইমন কল্যাণে। গান শেষ করে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমার মনে হয়েছিল এমনি এমনিই যদি কখনো এরকম জড়িয়ে ধরে আদর করতেন। একটু বড়ো হতে গুরুজীর কাছে তালিম নিতে যেতে হতো। কিন্তু আমার ততদিনে গানের উপর, সুরের উপর চরম বিদ্বেষ জন্মে গেছে।আর অত রেওয়াজ করার নিষ্ঠাও আমার কোনোদিন ছিল না। গুরুজীর কাছে যাওয়া বন্ধ করলাম। জিদ চেপে গেছিল কিছুতেই আর সুরের ধারে কাছে যাবোনা। অবশেষে বাবা জানতে পারলেন সব। মাও। ওই ঠাকুরঘরেই বসে থাকতেন চুপচাপ ঘন্টার পর ঘন্টা। একদিন চুপচাপ চলেও গেলেন। বাবা একেবারেই ভেঙে পড়েছিলেন তারপর। নাহ কোনও অনুশোচনা হয়নি আমার। সিংহরায় পরিবারের গান থেমে গেছিল সেই থেকে। মাঝে মাঝে দেখতাম বাবা পুজোর ঘরের সামনের বারান্দাটাতে বসে আছেন। এতটাই দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিল যে কাছে গিয়ে কেমন আছেন টুকু জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠতো না। ব্যবসা নিজে আর দেখতেন না, তবে আমার আস্তে আস্তে ব্যবসাতে উৎসাহ বাড়ছিল। বাবা চলে যাওয়ার পর আমিই তখন কর্তা। সবার আগে বাড়ির তিন পুরুষের পুরোহিতমশাইকে আর আসতে বারণ করে দিলাম। ঠাকুরঘরের দরজায় এখন মস্ত একটা তালা ঝোলে। বৃদ্ধ পুরোহিতমশাই কেঁদে ফেলেছিলেন। বাবা চলে যাওয়ার পর এমনিতেই আত্মীয়স্বজনরা আমাকেই দোষারোপ করতেন, এই ঘটনার পর সবাই আসা বন্ধ করে দিল। আমি ব্যবসা নিয়ে থাকি, কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, বেশ চলে যায়। কোনও বদখেয়াল আমার নেই, আমি মোটের উপর চরিত্রবান। মাঝে মাঝে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে সময় কাটাই। আমি যে কোন সময় গান গাইতে পারতাম সমরেশ, সত্যজিৎ এরা জানেই না।



কিরে, নাম- কি ভাবছিস?- সমরেশ ধাক্কা দিয়ে বলে। নামি তিনজনে। গঙ্গার ঘাট একেবারে ফাঁকা। এদিকটায় কেউ আসেনা চট করে, দোকান টোকানও নেই। সমরেশ বলল চল ঠান্ডা কিছু কিনে আনি। আমার আর যেতে ইচ্ছে করল না। তোরা যা, আমি বসি - বলে ঘাটের ধাপের দিকে এগিয়ে গেলাম। চুপচাপ বসে আছি, এত এলোমেলো ভাবনা কেন মনে আসছে সেই চিন্তাই করছি। আমার এরকম সচরাচর হয়না। আমি সোজাসাপ্টা মানুষ, চিন্তা ভাবনা পোষায় না। তবে এখানে এলে আমি ঘাটের ধারে বসে থাকা কুকুরগুলোকে বিস্কুট খাওয়াই। আজ সাথে নেই কিছু। ঘাড় ঘুরিয়ে গণপতিদাকে খুঁজলাম, যদি এনে দেয়। সেও দেখি নেই। হঠাৎ একটা হালকা গুনগুন কানে এলো। চমকে উঠে সামনে তাকিয়ে দেখি কে যেন ঘাটের শেষ ধাপে বসে আছে। ওখান থেকেই আসছে নাকি গুনগুনটা? কিছু ভাবার আগেই প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় মনে হলো শুদ্ধ কল্যাণ। এবং একেবারে নিখুঁত। কথাগুলো বুঝতে পারছি না, শুধু সুরটা কানে ধরা দিচ্ছে। কখন এসে বসলো এ? নাকি আগেই ছিল, খেয়াল করিনি। ভালো করে তাকালাম এবার, ও বাবা এ তো বাচ্চা মেয়ে একটা - কত হবে, দশ এগারো। মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে পোশাক দেখে বাঙালি মনে হচ্ছেনা। মাথায় আবার চুড়া করে বাঁধা চুল। পরনে হাঁটু আর গোড়ালির মাঝ বরাবর পর্যন্ত ঘাগরা। পায়ে নাগরা। মাথার উপর থেকে কাঁধের উপর দিয়ে নেমে এসেছে নীল রঙের দুপাট্টা। হাত দেখা যাচ্ছে না, কোলে জড়ো করা। কাঁধে আবার একটা ঝোলা। এ বানজারাদের মেয়ে নাকি? জলের দিকে তাকিয়ে এইভাবে গেয়ে চলেছে - বানজারাদের মেয়ে এমন তালিম কোথায় পেলো। একবার ভাবলাম উঠে যাই, আবার সেই গানের পাল্লায় পড়ার কোনও ইচ্ছা নেই। কিন্তু কেন জানিনা বড়ো কৌতুহল হলো। আর সুরটা যেন বহুদিন পর আচ্ছন্ন করে দিতে লাগলো ধীরে ধীরে। 



একসময় শেষ হলো। আমি মুগ্ধ হয়ে বসে আছি। কোল থেকে হাত দুটো নামিয়ে ধাপের উপর রাখলো সে। দেখি আঙ্গুলের ডগাগুলো আলতা দিয়েই হবে, লাল রং করা। হাতে দুটো করে বালার মাঝে একগাদা করে কাঁচের চুড়ি। বালাগুলো সোনালী রঙের। সোনার নিশ্চই নয়। হঠাৎ গা ছমছম করে উঠলো। সর্বনাশ, গান্ধর্বী বা ভুত টুত নয়ত। এই প্রায় সন্ধ্যে হয়ে আসা গঙ্গার ধার, হতে বাধা কি। আস্তে করে ডাকলাম - সুন রহি হো? মুখটা ঘোরালো সে। আর আমি কোথায় আছি কেন এসেছি সব ভুলে গেলাম। এমন চোখ হয় মানুষের? টানা টানা আলো জ্বলা দুই আয়ত চোখ, পৃথিবীর কোন কিছু দেখছে বলে মনে হয়না। ভোরের আকাশের মত কপাল, ঠিক মাঝখানে একটা টিকলি। এত সাজ কেন এই বাচ্চা মেয়ের? তার উপর একা। কোনমতে জিজ্ঞেস করি - নাম কেয়া হ্যায় তুমহারা? উজ্জ্বল হাসিতে চোখ দুটি ভরে ওঠে - বীনার মত আওয়াজ আসে - দিওয়ানী। বাবা এ আবার কি নাম? আবার জিজ্ঞেস করি - তুম আকেলে হো? আবার বীনার ঝঙ্কার। এবার হাসি। - মেরা পতি মেরে সাথ হ্যায়। এইটুকু মেয়ের পতি কি রে বাবা। হবে হয়তো। আমি কিছু না ভেবেই বলে বসলাম এবার - আভি গৌড় সারং সুনাওগি? আমি গান শুনতে চাইছি? আমি বললাম না অন্য কেউ বললো আমার ভিতর থেকে বুঝে উঠতে পারলাম না। সে কানের লতি ধরে বলল - আওকাদ নেহি হ্যায় মেরি, ফিরভি সুনাতি হুঁ।


আকাশ বাতাস জল মন্থন করে সুর উঠলো - এ গান আমি চিনি,এ গান আমি শুনেছি আগে মায়ের গলায়, তবে অন্য রাগে। এই গান গৌড় সারং এ এই প্রথম শুনছি।মনে হচ্ছে চিরিদিক দুলে উঠছে, আমার দুই চোখ ঝাপসা, গা টলমল করে উঠছে। গঙ্গা, তার ধাপ সব যেন চোখের সামনে মিলিয়ে যাচ্ছে, আবার স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ও মানুষ না অন্য কিছু। কাঁধের ঝোলার মুখটা খুলে গেছে। ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে কুচকুচে কালো পুতুল নাকি ওটা। চোখমুখ তো থাকবে তাহলে। হঠাৎ এতদিনের বিস্মৃতির আড়াল থেকে মনে পড়ে গেল মা বলেছিল রাজস্থান বেড়াতে গিয়ে ওই ছবি নিয়ে এসেছে।


 গৌড় সারং এর অপার্থিব সুর তখন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। গঙ্গার ঘাট, গাছপালা, দূরে ভেসে থাকা নৌকো, গঙ্গার জল সবাই যেন গলা মিলিয়ে তখন গাইছে - মেরে উনকে প্রীতি পুরানী উন বিন পল না রহুঁ, ম্যায় গিরধর কে ঘর যাউঁ। জ্ঞান হারাবার আগে দূর থেকে আর একটি ভারী গলা শুনতে পেলাম - এ মীরা বেটি, এ দিওয়ানী, কিধর গয়ী তু ?


নাহ্, আমূল বদলে গেছি তা নয়। তবে গুরুজীর কাছে ফিরে গেছি আবার। তিনি সব শুনে মুচকি হেসেছেন শুধু। পুরোহিতমশাইকেও পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে এনেছি। মীরার কুচকুচে কালো গিরি ধারীর ছবিতে আবার মালা চন্দন পড়ে। কী কালো বাবা, মুখচোখ বোঝা যায়না। গঙ্গার ধারে আর যাইনি। সেদিন সমরেশ আর সত্যজিৎ অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিল আমাকে। তাছাড়া আর কেউ কোথাও ছিলনা। ওদের কিছু বলিনি। তবে মীরাবাই এর ভজন কখনো গাইনা। সাহস নেই। মনে মনে বলি - অওকাদ নেহি হ্যায় মেরা।