ধা রা বা হি ক
।। উপন্যাস ।। ৩য় কিস্তি ।।
![]() |
(আট)
আজ রবিবার।
অসিত বসে আছে গ্রান্ড হোটেলের বলরুমে। রাত প্রায় দশটা বাজে। আজ বিকেলে সে একটি ফোন পায়। কচি গলা নিয়ে একটি মেয়ে বলে, নমস্কার , আপনার নম্বরটা ম্যানেজার বাবু দিয়েছেন। আজকে আমার একটা কন্ট্রাক্ট আছে গ্রান্ডে। আপনি আমায় আটটা নাগাদ এসে নিয়ে যেতে পারবেন ? ঠিকানাটা লিখে নিন একটু।
ট্যাক্সি করে আসার সময় মেয়েটি একটিও কথা বলেনি। গ্রান্ডের রুম নম্বর ২১২ -তে ঢোকার আগে শুধু বলেছিল , আপনি নিচে অপেক্ষা করুন। আপনাকে ফোন করা হবে।
প্রায় দু ঘন্টা অসিত কোনো কথাই বলেনি। হোটেলের বলরুম যথেষ্ট বড়। মনে হয় যেন কোনো এক রাজবাড়ি'তে বসে আছি। বিশাল আকারের ঝাড় । মানুষগুলোও কি সুন্দর। আস্তে আস্তে কথা বলছে। মেপে মেপে হাসছে। এদের পুরো জীবনটাই মাপামাপিতে চলে যায়। মরার আগেও হয়ত ভাবে , ইস , সুইজারল্যান্ডের লেকে পূর্ণিমার রাত কাটানোটা বাকি রয়ে গেল !
অসিতের ফোন বেজে উঠলো। ওপার থেকে গম্ভীর হয়ে একজন বলল, উপরে চলে আসুন , অসিতবাবু।
রুম নম্বর ২১২'র দরজায় বেল বাজাতেই সেই মেয়েটি দরজা খুলে দিল। অসিত ভিতরে ঢুকে দেখল একটি লোক সোফায় বসে আছেন। এই হলো মেহবুব হাসান। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স হবে। বেঁটে খাটো চেহারা। সাদা রং হয়ত এর খুব প্রিয়। তাই সাদা চুল , সাদা জামা , সাদা প্যান্ট এমনকি পকেটের পেনটাও সাদা।
লোকটি বলল, অসিতবাবু আসুন , বসুন। কথা আছে।
মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন এসো।
অসিত বলল, সেকি , আমার তো ওনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
লোকটি বলল, আরে না না , ও একাই যেতে পারবে। কি পারবে না ?
মেয়েটি ঘাড় নাড়িয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো, যার অর্থ , হ্যাঁ পারবো রে হারামজাদা।
মেয়েটি চলে গেল। লোকটি বলল, এই কাজে নতুন বুঝি ?
অসিত বলল, আজ্ঞে ,হ্যাঁ ।
কিন্তু আপনি যে দুম করে আমার ঘরে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলেন ধরুন আমি যদি পুলিশের লোক হই ! ধরুন ইচ্ছে করেই রিসেপসনে মেহবুব হাসান নাম লিখে এখানে বসে আছি আপনাকে ধরার জন্য। যদি পুরো ব্যাপারটাই একটা সেট আপ হয় ?
তাহলে আপনি এত কথা বলতেন না। অনেক আগেই আমায় শ্রীঘরে চালান করে দিতেন।
তা ঠিক। একটা কথা মাথায় রাখবেন , আপনাকে উপদেশ দিয়ে রাখছি। আপনি হলেন মিডিল ম্যান মানে লে ম্যান ভাষায় দালাল। আপনাদের কোনো বিপদ কোনো দিনই হয় না। যুগের পর যুগ দালালরাই বেঁচে থাকে। জানেন কি , হরপ্পা সভ্যতাতেও দালাল ছিল , আর আজও আছে। আর এরা আছে বলেই সংসারে শান্তি আছে , রাষ্ট্রনেতারা সুখে আছে। বুঝলেন কিছু ?
আজ্ঞে , বুঝতে পারছি।
আপনি নতুন তাই একটু শিখিয়ে দিলাম। এবার আপনাকে আমি কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা বলবো , মন দিয়ে শুনুন। বলেই একটা ক্লাসিক সিগারেট ধরলো মেহবুব সাহেব। অসিতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কাউকে সিগারেট বা মদ অফার করি না। কিছু মনে করবেন না।
অসিত বলল, এটাই কি সেই ইম্পরট্যান্ট কথা ?
ঘর ফাটানো আওয়াজে হেসে উঠলেন মেহবুব সাহেব। বললেন, তুমি তো বেশ মজার কথা বলো। যাইহোক , ইম্পরট্যান্ট কথাটা বলি।
অসিত লক্ষ্য করলো সামনের মানুষটা আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। এর অর্থ তাকে এই লোকটার ভালো লেগেছে। মেহবুব সাহেব বললেন , অসিত , তুমি এই ঘোষাল বা ম্যানেজার'কে কত দিন চেন ?
বেশি দিন না। এই সপ্তাহখানেক মতন।
হুমমম, তুমি একজন ভালো ছেলে। আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না। আর বলতে দ্বিধা নেই যে তোমাকে আমার বেশ ভালোই লেগেছে। তাই কথা গুলি বলছি। এই ঘোষাল হলো একটা পাক্কা ক্রিমিনাল। জাহাজ হাতাবার জন্য যে কত লোককে খুন করিয়েছে তার ঠিক নেই। তার উপর এই স্কট কারবার। আমি যতদূর শুনেছি ওর একটা গ্রুপ আছে। মেয়ে পাচার করার গ্রুপ। লোকটা সুবিধার না অসিত। আমার এডভাইস তুমি এই কাজটা ছেড়ে দাও।
ছেড়ে দেবো ! ছেড়ে দিয়ে কি করবো স্যার ? এই কাজ পেতেই এক বছর লেগে গেল। এখন আমার বাড়ির যা অবস্থা আমাকে যা হোক একটা করে বাড়িতে টাকা নিয়ে যেতে হবে।
হুমম, পড়াশুনা কতদূর করেছ ?
বি.এ করার পর আর পড়তে পারিনি। ইংরেজি'তে অনার্স ছিল।
বাহ্ , এত ভালো ছাত্র হয়ে এই দালালের কাজে এলে কেন ! যাইহোক , এক কাজ করো , আমি কাল দিল্লি চলে যাচ্ছি , আমার একটা প্রিন্টিং ফার্ম আছে যাদবপুরে। তুমি চাইলে সেটার দায়িত্ব নিতে পারো। আসলে ওটা আমি তেমন দেখার সময় পাই না। এখানে যা মাইনে বলেছে ওখানেও না হয় তাই দেবো। কি বলো ?
আমার কোনো অসুবিধা নেই। তবে একটাই শর্ত আছে স্যার , কলকাতার বাইরে যেতে পারবো না। আর গেলেও এক দুদিনের জন্য ঠিক আছে। মাসের পর মাস থাকতে পারবো না।
মেহবুব সাহেব কি উত্তর দিলো সেটা অবান্তর। তবে হোটেল থেকে বেরিয়ে অসিত ফোন করলো অঞ্জনকে। সব তাকে খুলে বলল। অঞ্জন সব শুনে বলল, হুমম, তুই এতক্ষন হোটেলের ভিতরে ছিলি বলে হয়ত টাওয়ার পাওয়া যাচ্ছিল না। খবরটা তোকে দেওয়া হয় নি। দেবেন্দ্রর এক্সিডেন্ট হয়েছে। যায় যায় অবস্থা। পিজিতে আনা হয়েছে। চট করে চলে আয়। সিচুয়েশন ভালো না।
(নয়)
হাসপাতালে এই নিয়ে দুবার এলো অসিত।
প্রথমবার যখন এসেছিল তখন সাত বছর বয়েস। সামনে নিথর বাবা-মা শুয়ে আছে। ডাক্তার অনেক চেষ্টা করেও পাম্প করে বিষ বের করতে পারেনি। পুলিশ এসে অসিতকে বলেছিল, খোকা , রাতে কিছু খেয়েছ? তোমার বাবা মা কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল ?
তারপর এই দ্বিতীয়বার আসা। খবর পাওয়া গেল , একটা ট্রলার ব্রেক ফেল করে দেবেন্দ্রর উপর দিয়ে চলে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। অঞ্জন অপারেশন থিয়েটারের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে। চারিপাশে বেশ কিছু লোকজন। তার মাঝে এক বয়ষ্ক লোক চুপ করে বসে আছে। এটাই হয়ত দেবেন্দ্রর বাবা।
অঞ্জন বলল, চল বাইরে যাই। অপারেশন কখন শেষ হবে জানা নেই। একটা সিগারেট খেয়ে আসি।
পিজির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে খুব জোরে জোরে সিগারেট টানতে লাগলো দুজন। অঞ্জন বলল, সাহিত্যের দিব্বি কেটে বলছি দেবু যদি বেঁচে যায় ওকে আজীবন আমি ফ্রিতে মদ খাওয়াবো।
অসিত ভেবে পেল না এই কথার কি জবাব দেবে। অঞ্জন বলল, শালা জলজ্যান্ত একটা ছেলে এভাবে মরে যাবে ! ইয়ার্কি নাকি !
অসিত বলল, কোথাও টানছিলি নাকি ? এখনো গন্ধ বেরোচ্ছে।
আর বলিস না , সবে মেনকা'তে বসে দু পেগ মেরেছি তখনই ফোন। দেখি অবিনাশ। আমি তো অবাক। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এক্ষুনি চলে আয় , দেবুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি শালা তাড়াহুড়োর মাথায় বিলটাও দিয়ে আসতে ভুলে গেছি।
'অবিনাশ মানে আমাদের সেই অস্ট্রেলিয়ার অবিনাশ। বছর খানেক হলো গেছে ? ও কি ফিরে এসেছে নাকি ?'
'ওর মতন তেলাপোকা'কে কোন দেশ পুষবে ? ভিসা শেষ হয়ে গেছে আর দিয়েছে এক লাথি। মালটা এখন ফিরে এসে বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের মাসির বাড়িতে থাকে। '
'তা ও কোথায় ? দেখতে পেলাম না তো ?'
' আছে এখানেই কোথাও। দেখ গিয়ে কোনো নার্সের পিছন পিছন ঘুরছে । '
'চল ভিতরে যাই'
'একটু পরে যাবো। তা তুই কি ঠিক করলি কাজটা ছেড়ে দিবি ?'
'বুঝতে পারছি না। আমি কনফিউজড।'
'এতেই কনফিউজড হলে হবে কিভাবে ব্রাদার। আমায় দেখ , বারো বছর বয়সে এসে জানতে পারি যাকে মা বলে ডাকি সে আমার মা নয়। আমার মা আমার জন্মের দু মাসের মধ্যেই মারা গেছিলেন। যাকে নিজের বোন ভাবতাম সেও আমার সৎ মায়ের মেয়ে। বাড়িতে আমায় সবাই খাবার খেয়ে হাড় ফেলার মতন ফেলে রেখেছে। ভাইফোঁটার দিনেও বোনটা এসে পাশে বসে না। সবার একটা এমন ভাব যেন আমি মরলে বাঁচে। বাবা আমায় দশহাজারের একটা বান্ডিল দিয়েই দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে। এটা একটা লাইফ !'
অসিত চুপ করে রইল। আজ তার সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে আছে সে তার পরিচিত অঞ্জন বসু নয়। এ এক অন্য মানুষ। যে তার মতোই শহরের রাস্তায় ধাক্কা খাওয়া এক ভিখারি।
অসিত অঞ্জনের কাঁধে হাত রাখলো। অঞ্জন বলল, সাহস নেই বলে , না হলে শালা কবেই পাখায় ঝুলে পড়তাম। আমাদের তো আবার পাখাও নেই , সব এসি। তোর বাড়িতে পাখা আছে তো ?
কিছুক্ষন চুপ থেকে দুজনেই হেসে উঠলো একসাথে। তাদের অগোচরে আকাশের একটা তারা খসে পড়লো। দূর থেকে দেখা গেল অবিনাশ ছুটে আসছে । চোখে মুখে কান্না ভাব। দূর থেকেই চেঁচিয়ে বলে উঠল, দেবু গন । দেবু গন ।
(দশ)
এখন বিকেল পাঁচটা বাজে। অসিত দাঁড়িয়ে আছে বৌবাজার ক্লাবের ঠিক পিছনের হরিমোহন স্ট্রিটে। তার সামনে রাস্তায় ওপারে 'রুপা আর্ট এসোসিয়েশন'। একটা বড় ব্যানার যার নিচে একটা বোর্ড লাগানো। তাতে হাজার একটা ফটো। কেউ নাচছে , কেউ গাইছে। এর মধ্যে রুপা কোনটা কে জানে ! বা হয়ত সে এখানে নেই। অসিত ভাবলো , এই রুপা ছোটবেলা থেকে কোমড় বেঁকিয়ে কত মানুষকে ঘায়েল করেছে। তারপর একদিন একটা মালদার পার্টি দেখে রুপা বিয়ে করবে। এক বছর যেতে না যেতেই রুপার সন্তান হবে। ধীরে ধীরে রুপা বুড়ি হয়ে যাবে। তারপর একদিন সন্ধ্যে বেলায় রুপা বসে বসে ভাববে তার বাগানের প্রথম ফুলটা যে ছেড়েছিল সে এখন কেমন আছে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটা। রিনা কই ?
এই নিয়ে তিনটে সিগারেট শেষ করলো অসিত। মুখটা টক টক লাগছে। মাঝে মাঝে সিগারেট শরীর নিতে পারে না কিন্তু মস্তিস্ক আদেশ দেয় - আমার এখন ধুমপানের প্রয়োজন , শরীরের রক্তে নিকোটিন কমে গেছে, ব্রেনে যে রক্ত আসছে তাতে শুদ্ধতার পরিমান বেশি। হার্ট পাম্প বাড়িয়ে দাও। একটু ঘাম আসুক , শরীরটা ছটফট করুক।
একটু চা খেতে হবে। কিন্তু এখানে চাএর দোকান নেই। অসিত বারেবারে কপালের ঘাম মুছছে। রিনা কি তাহলে ভুলে গেছে আজকের ব্যাপারটা! নাকি ইচ্ছে করেই এলো না ! ওকে তো ফোন করাও যাবে না কারণ ওর তো ফোনই নেই। এদিকে এই স্পট ছেড়ে অসিত কোথাও যেতেও পারবে না। রিনা যদি এসে দেখে সে নেই !
সন্ধ্যে ছটা। অসিতের ফোন বেজে উঠল। নম্বরটা তার পরিচিত। ফোনটা তুলতেই ওপার থেকে একটি মহিলা কন্ঠ বলে উঠলো, হ্যালো, আশাকরি চিনতে পারছেন। আমি ওই আগের দিন গ্রান্ডে গেছিলাম। আজকে এই মাত্র ম্যানেজারবাবু জানালেন আমায় পিয়ারলেসে যেতে হবে। এখুনি। পার্টি না হলে চলে যাবে। আপনি একটা ট্যাক্সি নিয়ে গড়িয়াহাট মোড়ে চলে আসুন।
অসিত কি বলবে ভেবে পেল না। আজ সে অফিসেই যায় নি। কেউ তাকে অফিস থেকে ফোনও করেনি। সে সত্যিই ভেবে পাচ্ছে না কি করবে এখন। সিগারেটটা ফেলে দিয়ে হাঁক দিলো , ট্যাক্সি ।
মেয়েটি আজকেও চুপ চাপ বসে আছে। অসিত তার সাথে ট্যাক্সির পিছনের সিটে বসে আছে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকা অসহ্যময়। অসিত দেখলো মেয়েটি আগের দিনের মতোই হালকা বেগুনি একটা শাড়ি পড়েছে। মাথার চুলে এক গাদা ক্লিপ আটকানো। তেমন ভারী মেকআপ নেই। কিন্তু চোখের তলায় আইলানার দিয়েছে। দারুন লাগছে । মেয়েটির মধ্যে একটা গাম্ভীর্যবোধ আছে। এই লাইনের মেয়েরা সাধারনত বাচাল হয়। গায়ে ঢোলে পরে। এ তেমন না।
তাদের ট্যাক্সি সিগনালে দাঁড়িয়ে আছে। অসিত ঘড়ি দেখল। রাত আটটা। সে বলল, ইয়ে মানে একটা সিগারেট ধরাতে পারি ?
মেয়েটি একটু হেসে জবাব দিলো, এভাবে বলছেন কেন ? নিশ্চই পারেন।
অসিত সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি ঠিক কোথায় থাকেন বুঝতে পারলাম না। আগের দিন ময়দান আজকে গড়িয়াহাট থেকে ট্যাক্সিতে উঠলেন।
আমার ঠিকানা জানা কি সত্যিই কোনো প্রয়োজনিয়তা রাখে ?
তা রাখে না তবে জেনে রাখা ভালো। কার কখন কি বিপদ হয় তা তো আমাদের জানা নেই তাই বললাম।
আপনি মনে হয় নতুন জয়েন করেছেন তাই না ?
হ্যাঁ , কেন ?
ম্যানেজার বাবু আপনার কথা বলছিলেন। আপনি নাকি ইংলিশে অনার্স ?
সেকি এসবও বলেছেন নাকি আপনাকে !
তা , এত শিক্ষিত হয়ে এই কাজ করছেন কেন ! খারাপ লাগে না লোকে যখন দালাল বলে ?
কথাটা মনে হল বারুদের মতন পুড়িয়ে দিলো অসিতের শরীর। নিজেকে সংযত রেখে অসিত বলল, সব কাজই সমান। আর আপনি কি জানেন হরপ্পা আমলেও দালাল ছিল !
এরকম একটা উত্তরের প্রত্যাশা করেনি বোধহয় মেয়েটি। সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মুখটা জানলার দিকে ঘুরিয়ে নিলো।
পিয়ারলেস হোটেলে পৌঁছে জানা গেল পার্টি চলে গেছে। ফ্লাইট মিস হয়ে যাবার ভয়ে বেরিয়ে গেছে। মেয়েটি রিসেপসনে এগিয়ে গেল। তাকে একটি খাপ দেওয়া হলো। সেটি ভ্যানিটি বাগে ঢুকিয়ে সে ফিরে এলো অসিতের কাছে। অসিত বলল, আমরা মনে হয় দেরি করে ফেলেছি।
মেয়েটি জবাব না দিয়ে হাঁটতে লাগলো । হোটেলের বাইরে এসে বলল, একটা ট্যাক্সি ডেকে দিন তো । বলবেন বৌবাজার যাবে কি না !
অসিত বলল, আপনি বৌবাজার থাকেন ?
মেয়েটি জবাব দিলো না। অসিত বলল, এখান থেকে গাড়ি পাওয়া যাবে না। চৌরঙ্গী পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। রাত আটটার পর এই রাস্তা ওয়ান ওয়ে হয়ে যায়।
মেয়েটি বলল, তাই চলুন।
অসিতের এদিকে বেজায় খিদে পেয়েছে। সেই দুপুরে ভাত খেয়েছে তারপর একটা দানাও কাটেনি। রাস্তায় কিছু খাওয়াও যাবে না। পকেটে একশো টাকা আছে। এই নিয়ে কালকে বাজার করতে হবে। কাল রাতে একটা টিউশনির মাইনে পাওয়ার আছে। টিউশনির কথা মাথায় আসতেই রিনার কথা মনে পরে গেল। অসিতের কেমন যেন গা'টা গুলিয়ে উঠল। পেটে মনে হয় পিত্ত পরে গেছে।
পাশের একটা চাএর দোকানে এক জগ জলের অর্ধেকটাই শেষ করে দিলো অসিত। তারপর মেয়েটির কাছে এসে বলল, চলুন , হাঁটা যাক।
আপনার কি খিদে পেয়েছে ?
পেয়েছিল , এখন ঠিক আছে।
মেয়েটি ব্যাগ থেকে একটা পাঁচশো টাকা বের করে বলল, এটা নিন।
একি ! এসব কি ! আপনি আমায় টাকা দিচ্ছেন কেন ?
এমনি দিচ্ছি না। ধার হিসেবে নিন। মাইনে পেয়ে দিয়ে দেবেন।
অসিত হেসে উত্তর দিলো, মাইনে তো আমি পাবো না ম্যাডাম।আমি এই কাজ ছেড়ে দিচ্ছি। আজ এলাম জাস্ট আপনি ফোন করেছিলেন বলে। কেন এলাম তা জানি না। তবে আসতে ভালো লাগলো তাই এলাম। টাকাটা আমি নিতে পারবোনা ম্যাডাম।
মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অসিতের দিকে। মানুষ মাঝে মাঝে এমন কিছু শুনে ফেলে যেগুলো তারা ঠিক হজম করতে পারে না। এই মেয়েটির ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। সে বলল, চাকরি ছেড়ে দেবেন ! বলেন কি ! নাকি আমি আপনাকে দালাল বললাম বলে ছেড়ে দেবেন !
তেমন হলে আমি তখনই ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতাম।
ঠিক আছে টাকা নিতে হবে না। এই সামনের মোড়ে দিলশান রেস্টুরেন্ট আছে। খাসা কাবাব বানায়। চলুন ওখানে যাওয়া যাক। আমারও খিদে পেয়েছে।
যেতে পারি , তবে আমার কাছে মাত্র একশ টাকা আছে আর সেটাও আমি খরচ করতে পারবো না।
আপনাকে টাকা দিতে হবে না। আমি দেবো। চলুন।
দিলশান রেস্টুরেন্টের ভিতরে অনেকগুলো ছোট ছোট গুমটি করা। ভিতরে কে বসে আছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না। ক্যাপেলদের জন্য একদম ঠিক ঠাক। তারা একটি গুমটির ভিতর চলে গেল। মেয়েটি বলল, কি নেবেন কোক না পেপসি? এখানে কিন্তু ড্রিঙ্কইসও পাওয়া যায়।
খালি পেটে ওসব খাবো না। একটা কোক বলুন।
কোক পরে বলছি। আগে খাবার আসুক।
মেয়েটি মেনুকার্ডের দিকে না তাকিয়েই তিন চার রকমের কাবাবের অর্ডার দিয়ে দিল। অসিত দেখল মেয়েটিকে হঠাৎ দেখলে বেশ গম্ভির মনে হয় আসলে তা নয়। মেয়েটা কথা বলতে ভালোবাসে। হয়ত ভয় পায় সবার সাথে কথা বলতে।
পরপর দু'প্লেট কাবাব উড়িয়ে দিলো মেয়েটি। মুখে কোনো কথা নেই। হয়ত খাবার সময় কথা বলতে ভালোবাসেনা। অসিত এক প্লেট'ই শেষ করতে পারলো না এখনো। কোকের দিকে হাত বাড়িয়ে মেয়েটি বলল, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।
অসিত শেষ কাবাবটা মুখে ঢুকিয়ে বলল, কি ?
আপনি আমার নাম জিজ্ঞেস করেননি ।
এই দেখো , তাই তো ? তা আপনার নাম কি ?
আসল না নকল ?
নামের আবার আসল নকল হয় নাকি ?
হয়না বলছেন ?
না ।
তাহলে আমার নাম মিতালি । আর এটা নকল নাম।
মিতালি নামটা সুন্দর , নকল হলেও সুন্দর।
আপনাকে আমি আমার আসল নামটা বলবো যদি কোনোদিন আবার হঠাৎ করে দেখা হয়। আপনাকে তো আমি আর ফোন করবো না। কারণ আপনি কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।
তা ঠিক।
কি ঠিক ?
কিছু না। আপনি বসুন আমি একটু হাত ধুয়ে আসি। তারপর বেরোব।
অসিতের হঠাৎ মনে হলো তার ফোনটা সাইলেন্ট করা আছে। বুক পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলো দশটা অজানা মানুষ ফোন করেছিল। কে এরা কে জানে ! মাঝে একবার অঞ্জনও ফোন করেছিল। এখন অঞ্জন'কে ফোন করার কোনো মানেই হয় না। ডেকে বসলে মুশকিল। তখন যেতেই হবে।
বৌবাজার মোড়ে মেয়েটি ট্যাক্সি থেকে নামার সময় বলল, আমি ভাড়া দিয়ে দিলাম। জানিনা আবার দেখা হবে কিনা। ভালো থাকবেন।
বৌবাজার থেকে বাড়ি পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না অসিতের। এদিকে আজ জোৎস্নার আলো ছিটকে পড়ছে কলকাতার বুকে। এই সময় একটা খাতা পেন থাকলে ভালো হতো। অসিত মনে মনে একটা লাইন ভেবে নিলো,
এসো , পুরোনো অতীত , বুকেতে যন্ত্রনা লুকিয়ে
আজ ভরাবো জোৎস্না'মাখা শহরের প্রান্তর হতে।
বাহ্ , লাইনটা বেশ মনের মতন হয়েছে। আজ বহুদিন পর কবিতা এলো। আজ রাতেই পুরো লেখাটা নামাতে হবে।
বাড়ির কাছাকাছি এসে অসিত একটু থমকে গেল। পাড়াটা আজ একটু বেশিই চুপচাপ। দরজা পেরিয়ে সে যখন মামির ঘরে পৌছালো তার চোখ কপালে উঠে গেল।
সারা ঘরে জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পরে আছে। বিছানার চাদর ছেড়া, আয়নার কাচ ভাঙা আর এসবের মাঝে মালতি দেবী বসে আছেন । চুল উসকো , গায়ের কাপড় আলগা । অসিত বলল, মামি এসব কি অবস্থা ! কি হয়েছে ?
মালতি দেবী কোনো সাড়া দিচ্ছেন না। নিথর হয়ে বসে আছেন।অসিত চেঁচিয়ে বলল, কথা বলছো না কেন ! এসব কে করেছে ?
মালতি দেবী মিন মিন করে বললেন , ওরা নিয়ে গেল। তোর মামাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল।
অসিত বলল, কোথায় নিয়ে গেল ? কে নিয়ে গেল ?
এই প্রশ্নের উত্তরে মালতি দেবী যা বললেন তা এই রকম ―
আজ বিকেলে ফটিক বাবু রাস্তায় বেরিয়েছিলেন। পাড়ার মোড়ের যে দোকান থেকে তিনি তার পাঞ্জাবির জন্য টাকা ধার করেছিলেন সেই দোকানদার তার কাছে টাকা ফেরত চায়। ফটিকবাবু উল্টো পাল্টা উত্তর দেয়। শেষে ঝগড়া শুরু করেন। সেই দোকানদার যখন তার পাঞ্জাবিতে হাত দিয়ে ছেঁড়ার চেষ্টা শুরু করে তখন ফটিকবাবু তাকে কামড়ে দেয়। কামড় এতই সাংঘাতিক ছিল যে সেই মানুষটার চামড়া ছিঁড়ে ফটিকবাবুর মুখে চলে আসে। ফটিকবাবু ভয় পেয়ে বাড়িতে পালিয়ে আসেন। এরপর পাড়ার ছেলেরা মিলে অসিতকে অনেক বার ফোন করে। তাকে না পেয়ে এই বাড়িতে এসে ফটিকবাবুকে টানতে টানতে নিয়ে যায়। উন্মত্ত ফটিক চন্দ্র পুরো ঘরের জিনিস পত্র ভাঙচুর করে ছুড়ে মারতে থাকে তাদের দিকে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় না।
অসিত বলল, কোথায় নিয়ে গেছে ? কোন হাসপাতালে ?
মালতি দেবী একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে বলেন , এখানে। ওরা বলল , কাল সকালে তোকে এখানে একবার যেতে।
অসিত চিরকুট খুলে দেখলো তাতে লেখা ,
"তোমার পাগল মামাকে আমরা নিয়ে গেলাম। কাল সকাল দশ'টা নাগাদ নিচের ঠিকানায় এসে দেখা করে যেও।
প্রকৃতির কোলে মানসিক কেন্দ্র। ১৭/১ , ঝিলম রোড,পার্ক সার্কাস ময়দানের বিপরীতে। "
অঙ্কন: শুভদীপ মন্ডল
(চলবে)