প্রন্ধ 

অঙ্কন: শুভদীপ মন্ডল

কবিতার রূপকল্প 
সৌ ম্য  ঘো ষ             




সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কবিতা সবচেয়ে প্রাচীন ।এটা সব দেশেই ।ছন্দোবদ্ধ কবিতা উচ্চারণ সবচেয়ে আগে আবির্ভূত হল কেন, তা বলা মুশকিল। জগৎ সৃষ্টির মধ্যে যে অন্তর্লীন ছন্দ রয়েছে ,তারই প্রেরণা কি কবিতার ছন্দবদ্ধ আত্মপ্রকাশ? ছন্দহীন জীবন ছন্নছাড়া । বিশ্বচরাচরের, মানব অস্তিত্বের এক অন্তর্লীন ছন্দের অনিবার্যতায় হয়তো কবিতার জন্ম । রবীন্দ্রনাথ উদ্ধৃত করেছেন,  " শিল্পানি শংসন্তি দেবশিল্পানি " । মানুষের সব শিল্প ই দেবশিল্পের স্তবগান করেছে। হয়তো আবেগের তীব্রতা থেকে কবিতা জন্মায়, আর সেই আবেগ তীব্রতা কল্পনায় প্রকাশ পায় ।       
         
যা ছন্দময় তাই সব সময় কবিতা হয়না। আদিপর্বের সব রচনায় ছন্দময়তা  ছিল । কিন্তু সব রচনায় কবিতা ছিল না। নিয়মিত ছন্দে বিন্যস্ত ছিল বলে সেই সব রচনাকে পদ্য বলা যায়।  পদ্য রূপকল্পের ব্যাপার , আর কবিতা মূল্যবোধের ব্যাপার। তবে কবিতার ইতিহাস পদ্য থেকে কবিতার দিকে যাত্রার ইতিহাস। চর্যাপদের সব রচনা ছন্দবদ্ধ সে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই । কিন্তু চর্যাপদের সব রচনা কবিতা হিসেবে গণ্য নয় । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ছন্দবদ্ধ দীর্ঘ কাব্যে  নাটক আছে বটে কিন্তু কবিতা তত সুলভ নয় । রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ, চৈতন্যজীবনী ,মঙ্গলকাব্য প্রধানত পদ্য রচনা । এই কালপর্বে গদ্যের উন্মেষ হয়নি বলে পদ্যকে গদ্যের সব কাজ করে যেতে হয়েছে । আর সেইসব পদ্যকে আমরা কবিতা ভেবে ভুল করেছি। বিশুদ্ধ কবিতার দুর্লভ প্রকাশ মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলীতে পাওয়া যায়। কবিতার বিশুদ্ধতার সন্ধান আমাদের নিয়ে যেতে চায় কলাকৈবল্যবাদের  দিকে । গীতিকবিতাই একমাত্র কবিতা নয় ।কবিতা হতে পারে হরেক রকম -মহাকাব্য ,আখ্যানকাব্য, নাট্যকাব্য ,রূপককাব্য, লোককাব্য ইত্যাদি ইত্যাদি । দার্শনিক উপলব্ধি, সামাজিক প্রসঙ্গ ,জীবন যাপনের গদ্যময়তা -এসব কবিতার অঙ্গনের উপাদান । কবিতার উপাদান উঠে আসতে পারে জীবনের কর্কশ, মধুর, গভীর যে কোন উৎস থেকে। যেকোন পারিপার্শ্ব থেকে । কিন্তু সকল উপাদানের মৌলিক রূপান্তর হতে হবে কবিতায় । যেমন, পদার্থের চেতনায় । কাব্যগুণ না থাকলে তা কবিতা হতে পারে না।         
          
কবিতায় যে সত্য বিধৃত হয় তা মনস্তাত্ত্বিক সত্য । কবি বহিরিন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় দিয়ে জগতকে দেখেন। তাই কবিদ্রষ্টার অনুভূতি ও কল্পনা দ্বারা বস্তুবিশ্বের যে রূপান্তর ঘটে সেই রূপান্তরিত সত্যকে কবিতায় রূপান্তরিত করে। কবির উক্তি বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত নয়, কবির উক্তি "pseudo- statement" ; কবিতা পাঠের সময় পাঠকের মনে অবিশ্বাসের সন্দেহ অপনোদন হয় কিন্তু কবির কথাই সত্য । তাই নিরীশ্বরবাদী কাছেও " গীতাঞ্জলি" সত্য হয়ে উঠতে পারে ।     
               
প্রশ্ন হচ্ছে ,কবিতার ভাষা কেমন হবে?  কবিতার ভাষা  কি  heightened language হতে হবে? কবিতার ইতিহাসের আবহমানতা পড়ে আমরা জেনেছি , দীর্ঘকালব্যাপী মানুষের মুখের ভাষা এবং কবিতার ভাষা ছিল সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বতন্ত্র। পরবর্তীকালে  মিল্টন বা মধুসূদন দত্তের কবিতার ভাষা মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি চলে আসে । যেমন, ওয়ার্ডসোয়ার্থ বলেছিলেন কবিতার ভাষা হবে ,  

" language really used by men". 

মুখের ভাষাই হবে কবিতার ভাষা। কিন্তু সে ভাষায় থাকবে কল্পনার বর্ণ সুষমা। সমসময়ের ভাষা হবে কবিতার ভাষা।  কিন্তু হুবহু নয় । তাহলে কবি কালের মধ্যে বন্দি হয়ে যাবেন ।কবি সবসময়ই অতিসাময়িক ।তাই তাকে যেতে হয় ভাষাগত অসীমতায় ।          
       
পদ্য,  কবিতা নয় । ছন্দোবদ্ধ রচনা কে পদ্য বলে শনাক্ত করা হয় । কবিতার শব্দেরই বিন্যাস । সেই শব্দের তিনটি গুণ থাকে । যথা, - অর্থগুন, চিত্রগুন ও ধ্বনি গুন । শব্দ যখন কেবল অর্থময় তখন তা সংবাদ পরিবেশন করে মাত্র। যথা,   

 "দেশে খাজনার তরে পালাইয়া যাই ।     
 বিদেশে বেগারী বুঝি ধরিল সিপাই ।।"  

এটি পদ্য,  কবিতা নয় । কবিতায় থাকে দ্ব্যর্থতা।  কবিতার শব্দ শুধু অর্থময় নয় ,তা চিত্রময় ও সঙ্গীতময়। যথা ,     

"রূপের পাথারে আঁখি ডুবি সে রহিল।   
যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল ।।" (জ্ঞানদাস)

" মনে পড়ে কবে একরাত্রির স্বপ্নের ভিতরে        
শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী            
কেমন আশ্চর্য গান গায়   
বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা  বাজায় ......"( জীবনানন্দ দাশ )    

এখানে আমাদের মানসপটে একটি ছবি উদ্ভাসিত হয় । উপমা ,উৎপ্রেক্ষা ,বাকপ্রতিমা বা চিত্রকল্প ছবি ফুটিয়ে তোলে কবিতায়। কবিতা হল ধ্বনিগত ঐশ্বর্য্যের। শব্দ সংগীতের।     
         
কিন্তু শুধু অর্থ নয়, চিত্র নয়, ধ্বনি নয়, আরো এক অনন্য বিস্ময় কবিতাকে শিখরে আরোহণ করায় । এক অতল স্পর্শী নীরবতার গভীর থেকে কবিতার শব্দ গুলি তুলে আনেন কবি। শব্দের অমর বিন্যাসে সৃষ্টি হয় কবিতা । যেমন ,  

" ফুলগুলি  যেন  কথা                  
পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার                
পুঞ্জিত নীরবতা। " 

 নীরবতা থেকে উঠে এসে কবিতার কথা শেষ পর্যন্ত আরো এক নীরবতা দিকে ইঙ্গিত করে। কবিতার শব্দ ধাবিত হয় শেষহীন নীরবতার দিকে । অনুরণনের শেষে স্তব্ধতার দিকে । মহৎ কবিতা আমাদের নিয়ে যায় সৃজনশীল স্বজ্ঞার দিকে, এক পরম দিব্যানুভূতির দিকে।