অনুবাদ গল্প
![]() |
অঙ্কন: শুভদীপ মন্ডল |
পাথর চাপা কান্না
নিজের ঠোটের ওপরে আঙুল চেপে ধরে সতর্ক হয়ে চারপাশে তাকিয়ে খুবই ধীরে সে বলে -- তুই ত জানিস কি কষ্ট করে আমরা ওই নরকের থেকে মুক্তি পেয়েছি । এই অজানা মহামারী যদি না আসত , না বন্ধ হতো কাজ না আমরা বেরোতে পারতাম । কি হিসাব সে করে দেখ , আমরা দুজন রাতদিন খেটে ও পনেরো হাজার টাকার বায়না আর শোধ হতে চাইছিলনা । হিসেব চাওয়া আর কি সম্ভব । দেখেছিস ত হিসেবে চাইল বলে গোকুল কে কিভাবে মালিকের গুণ্ডা পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল । ওর কাছে খালি টাকা নয় গুণ্ডাও আছে । গোকুল কাজ ছেড়ে চলে যাবে বলে কতো চেষ্টা করেও কোথায় আর যেতে পেরেছে । কি নির্দয় মানুষ জানিস না । কবেই বা বুঝতে চাইছে এক পোয়াতি মেয়েমানুষের দুঃখ , কি বলল , ভারী কাজ যদি না পারে তবে মাটি চটকাতে ত পারবে । আর তার যাতনার ভয়ে তুই মাটি চটকাতে লাগলি । ভয়ে ভয়ে আমি কিছু বলতে পারিনি । তুই মাটি চটকাছিস আর আমার ভেতরটাও চটকিয়ে যাচ্ছিল ।
করোনা র ভয়ে তখন চারপাশের কাজ বন্ধ তবুও আমাদের কে খাটিয়ে চলেছিল । পুলিশ এসে যদি কাজ বন্ধ না করে দিতো , তবে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারতাম ! কাজ বন্ধ হওয়া মাত্রই সবাই ছুটে পালিয়েছিল দড়ি খোলা গরুদের মতো । তবে তোর এই অবস্থায় আমি তোকে নিয়ে কোথায় পালাতে পারতাম । হাতে টাকাকড়ি কিছু নেই , ঠাকুর কে ড়েকে দিন গুনতে গুনতে , ঠাকুরই ওই আশা দিদি কে পাঠালেন । হাসপাতালে নিয়ে তোকে সুস্থ করে তুললেন । সেখানে ই আমাদের গ্রামে ফেরার জন্য নাম লেখিয়ে দিয়েছিলেন । ভাবতে পারিনি যে এত শিগগিরই আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে সু্যোগ পাবো । ভেবেছিলাম গতকাল তোর ড়েলিভেরি হয়েছে , তুই হয়তো যেতে পারবিনা । কিন্তু তুই বললি , এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি ।কাজ নেই , এখানে কে আছে আমাদের ! মরে গেলে এখানে দেখতে কেউই নেই । এখানে কি বা আর ভালো আছি । তোর কথা আর ভগবানের ওপরে ভরসা করে বেরিয়ে পড়েছি । কে জানতো
যে ট্রেনে এরকম ভিড় হবে । কাউকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, সবাই ত ঘরমুখো ।
তোর কোলে কচি বাচ্চা দেখে সেই মানুষটি তার সিট ছেড়ে দিয়েছে কি না । নাহলে তো আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম । আমি যখন তাকে ধন্যবাদ জানাই কি বলল শুনেছিস কি না । বেচারা হেঁটে হেঁটে গ্রামের দিকে চলেছিল । মাইলের পর মাইল চলছে , তখন টি ভি তে তাদের ছবি তুলে দেখাবার পর পুলিশ তাদের আটকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল । কষ্ট করে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছিলাম যখন এখন ট্রেনের ভিতরে একটু দাড়িয়ে যেতে কি বা কষ্ট ! কচি বাচ্চা কোলে নিয়ে কেমন করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, বসে পড়ো । আমি এপাশে ওপাশে ঘোরাঘুরি করে বেশ চলে যাব ।
তখনই বাচ্চা টা কান্না আরম্ভ করে । তুই জানালার দিকে মুখ করে ওকে দুধ খাওয়ালি । মুখটা খোলা রেখে বাচ্চা কে কাপড়ে এভাবে ঢেকে ধরেছিলি , কেউই যাতে দেখতে না পায় তোর বাচ্চা কে । কেউ না জানতে পারে আঁতুড় ঘর থেকে তুলে তুই ট্রেনে উঠেছিস ।
রাত তখন কতো হবে কেজানে । কোন এক স্টেসনে গাড়ি থামিয়ে মাইকে ঘোষণা করা হয়, এখানে সবাইকে খাওয়ার প্যাকেট আর জলের বোতল দেওয়া হবে । সবাই নিচে নেমে গেছে । কি আর করবে , পেটে ত আগুন জ্বলছে । আমি যাবো কি জিঞ্জেস করতে তুই বললি , আগে বাচ্চা কে একটু ধরো , আমি কাপড় পাল্টে আসি , ভিষণ ব্যস্ত লাগছে ।
তুই গেলি বাথরুমে আর আমি ছেলেকে ধরে ওর মুখে, নাকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে হয় ছেলে এক্কেবারে কাঠ হয়ে গেছে । ভাবি চিৎকার করবো । এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখি , সবাই খাবার লাইনে দাঁড়িয়ে । বাবারে.. বাবারে.. বলে নড়াতে থাকি । না , আর একটু ও প্রাণ নেই ওর শরীরে । তুই বাথরুম থেকে আসার পর তোর হাতে তুলে দিয়ে বলি ,এও আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল ।
কি হলো আমার ছেলে বলে সরিতা চিৎকার করে উঠলে , দিলেশ্বর ওর মুখ চেপে ধরে বলে - কান্দিস না । তুই কাঁদলে সবাই জানতে পারবে আমাদের বাচ্চা মারা গেছে । মরা বাচ্চা নিয়ে আমাদের ট্রেনে আর যেতে দেবে না । নামিয়ে দেবে । একবার ভেবে দেখ , এখানে আমাদের নামিয়ে দিলে কি করবো ? কোথায় যাবো ?
কত কত বিপদ এসেছে , আমরা সামলে নিয়েছি । এই বিপদকে ও সামলে নিতে হবে । মানছি , তুই মা ,তোর মন আমার মতো শক্ত নয় । নরম মাটিতে ইট গড়ে তাকে পুড়িয়ে যেমন শক্ত করা হয় মনটাকে ও সেভাবে শক্ত করতে চেষ্টা কর ।
যা হওয়ার হয়েছে । চুপচাপ বসে থাক । কাল দিন বারোটায় আমরা টিটলাগড়ে পৌঁছে যাবো । আজ রাতটা আর কাল দিন বারোটা পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে রাখ । বুকে পাথর চেপে রাখ । গ্রামে পৌঁছে দুজন কাঁদতে হবে ।
সরিতা ছেলেকে কোলে ধরে বসে রয়েছে পাথরের মূর্তির মত । দিলেশ্বর যতটা বাইরে শক্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে কাঁদত থাকে । বারবার সরিতা র দিকে তাকিয়ে দেখে , ওর তেমন কিছু না হয়েযায় ।
রাত বাড়তে থাকে । সবাই এখন ঘুমিয়ে পড়েছে ।ওর স্থির দৃষ্টি বাইরের দিকে ।সরিতা আর দিলেশ্বরের চোখে ঘুম নেই । খিদে নেই , তেষ্টা নেই । পাথর পাল্টে গেছে দুজন ।
টিটলাগড় স্টেসনে গাড়ি থামে । সবাই নেমে গেছে । কাপড়ের পোটলা , হাতের ব্যাগ ধরে দিলেশ্বর , তার পেছনে সরিতা নামে । নামার সাথে সাথে তাদের কপালে যন্ত্র ধরে কি যেনো দেখে সরকারের লোক । লাইনে দাঁড়াতে বলে । এখন তাদের বাসে চেপে ক্বারেণ্টাইন সেণ্টারে যেতে হবে । চৌদ্দ দিন থাকতে হবে সেখানে । সরিতা বাসে উঠতে চাইছে না । দিলেশ্বর তাকে বোঝায়- সরকারের নির্দেশ । চল , বাসে ওঠ , এখন আমাদের গ্রামে যেতে দেবে না ।
হঠাৎ ভেঙে পড়ে সরিতা - একে ওখানে চৌদ্দ দিন ধরে রাখবো কি ভাবে ?
- ওটা কি ?
- মরা বাচ্চা ।
চমকে সবাই তাকিয়ে থাকে ।--- মরা বাচ্চা । কখন মরেছে ?
- দু' দিন আগে । কোলে ধরে বসেছি । এখন মায়ের কোলও ওর আর ভালো লাগছে না । পচে এসেছে । ও এখন মাটি চাইছে । মাটির কোলে যেতে চাইছে ।
নিজের বাচ্চা কে মাটিতে দেওয়ার জন্য তুলে দিয়ে সরিতা বলে -- যা বাবা , যা ! দুঃখ ভোগ করার জন্য লম্বা আয়ু দরকার , দুঃখ দেখার জন্য যতটা আয়ু নিয়ে এসেছিলি , যথেষ্ট । কান্না আমার আর পাথর চাপা দিয়ে রাখতে পারছিনা । আমাকে কাঁদতে দে ....! আমাকে মনে ভরে কাঁদতে দে !