অনুবাদ গল্প 

অঙ্কন: শুভদীপ মন্ডল


পাথর চাপা কান্না

মূল ওড়িআ গল্প : রাজ্যবর্ধন ধল মহাপাত্র
বাংলা অনুবাদ : প্রদীপ কুমার রায়


নিজের ঠোটের ওপরে আঙুল চেপে ধরে  সতর্ক হয়ে  চারপাশে তাকিয়ে খুবই ধীরে সে বলে -- তুই ত জানিস  কি কষ্ট করে আমরা ওই নরকের থেকে মুক্তি পেয়েছি । এই অজানা মহামারী যদি না আসত , না বন্ধ হতো কাজ না আমরা বেরোতে পারতাম । কি হিসাব সে করে দেখ , আমরা দুজন রাতদিন খেটে ও পনেরো হাজার টাকার বায়না আর শোধ হতে চাইছিলনা । হিসেব চাওয়া আর কি সম্ভব । দেখেছিস ত  হিসেবে চাইল বলে  গোকুল কে কিভাবে মালিকের গুণ্ডা পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল । ওর কাছে খালি টাকা নয় গুণ্ডাও আছে । গোকুল  কাজ ছেড়ে চলে যাবে বলে কতো চেষ্টা করেও কোথায় আর যেতে পেরেছে । কি নির্দয় মানুষ জানিস না । কবেই বা বুঝতে চাইছে এক পোয়াতি মেয়েমানুষের দুঃখ , কি বলল , ভারী কাজ যদি না পারে তবে মাটি চটকাতে ত পারবে । আর তার যাতনার ভয়ে তুই মাটি চটকাতে লাগলি ।  ভয়ে ভয়ে আমি কিছু বলতে পারিনি । তুই মাটি চটকাছিস আর আমার ভেতরটাও চটকিয়ে যাচ্ছিল ।


করোনা র ভয়ে তখন চারপাশের কাজ বন্ধ তবুও আমাদের কে খাটিয়ে  চলেছিল । পুলিশ এসে যদি কাজ বন্ধ না করে দিতো , তবে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারতাম ! কাজ বন্ধ হওয়া মাত্রই সবাই ছুটে পালিয়েছিল  দড়ি খোলা গরুদের মতো । তবে তোর এই অবস্থায় আমি তোকে নিয়ে কোথায় পালাতে পারতাম । হাতে টাকাকড়ি কিছু নেই , ঠাকুর কে ড়েকে দিন গুনতে গুনতে , ঠাকুরই ওই আশা দিদি কে পাঠালেন ।  হাসপাতালে নিয়ে তোকে সুস্থ করে তুললেন । সেখানে ই আমাদের গ্রামে ফেরার জন্য নাম লেখিয়ে দিয়েছিলেন । ভাবতে পারিনি যে এত শিগগিরই আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে সু্যোগ পাবো । ভেবেছিলাম গতকাল তোর ড়েলিভেরি হয়েছে , তুই  হয়তো যেতে পারবিনা  । কিন্তু তুই বললি , এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি ।কাজ নেই , এখানে কে আছে আমাদের ! মরে গেলে এখানে দেখতে কেউই নেই । এখানে কি বা আর ভালো আছি । তোর কথা আর ভগবানের ওপরে ভরসা করে বেরিয়ে পড়েছি । কে জানতো

যে ট্রেনে এরকম ভিড় হবে । কাউকে  দোষ দিয়ে লাভ নেই, সবাই ত ঘরমুখো ।


তোর কোলে কচি বাচ্চা দেখে সেই মানুষটি তার সিট ছেড়ে দিয়েছে কি না । নাহলে তো আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম । আমি যখন তাকে ধন্যবাদ জানাই কি বলল শুনেছিস কি না ।  বেচারা হেঁটে হেঁটে গ্রামের দিকে চলেছিল ।  মাইলের পর মাইল চলছে , তখন টি ভি তে তাদের ছবি তুলে দেখাবার পর পুলিশ তাদের আটকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিল । কষ্ট করে মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছিলাম যখন এখন ট্রেনের ভিতরে একটু দাড়িয়ে যেতে  কি বা কষ্ট ! কচি বাচ্চা কোলে নিয়ে কেমন করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, বসে পড়ো । আমি এপাশে ওপাশে ঘোরাঘুরি করে বেশ চলে যাব ।


তখনই বাচ্চা টা কান্না আরম্ভ করে ।  তুই জানালার দিকে মুখ করে ওকে দুধ খাওয়ালি । মুখটা খোলা রেখে  বাচ্চা কে কাপড়ে  এভাবে ঢেকে ধরেছিলি , কেউই যাতে দেখতে না পায় তোর বাচ্চা কে । কেউ না জানতে পারে আঁতুড় ঘর থেকে তুলে তুই ট্রেনে উঠেছিস ।


রাত তখন কতো হবে কেজানে । কোন এক স্টেসনে গাড়ি থামিয়ে মাইকে ঘোষণা করা হয়, এখানে সবাইকে খাওয়ার প্যাকেট আর  জলের বোতল দেওয়া হবে । সবাই নিচে নেমে গেছে । কি আর করবে , পেটে ত আগুন জ্বলছে । আমি যাবো কি  জিঞ্জেস করতে তুই বললি ,  আগে বাচ্চা কে একটু ধরো , আমি কাপড় পাল্টে আসি , ভিষণ ব্যস্ত লাগছে ।


তুই গেলি বাথরুমে আর আমি ছেলেকে ধরে ওর মুখে, নাকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে হয় ছেলে এক্কেবারে কাঠ হয়ে গেছে ।  ভাবি চিৎকার করবো । এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখি , সবাই খাবার লাইনে দাঁড়িয়ে । বাবারে.. বাবারে.. বলে নড়াতে থাকি । না , আর একটু ও প্রাণ নেই ওর শরীরে । তুই  বাথরুম থেকে আসার পর তোর হাতে তুলে দিয়ে বলি ,এও আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেল ।


কি হলো আমার ছেলে বলে সরিতা  চিৎকার করে উঠলে  , দিলেশ্বর  ওর মুখ চেপে ধরে  বলে - কান্দিস না । তুই কাঁদলে  সবাই  জানতে পারবে আমাদের বাচ্চা মারা গেছে । মরা বাচ্চা নিয়ে আমাদের ট্রেনে আর যেতে দেবে না । নামিয়ে দেবে । একবার ভেবে দেখ , এখানে আমাদের নামিয়ে দিলে  কি করবো ? কোথায় যাবো ? 


কত কত বিপদ এসেছে , আমরা সামলে নিয়েছি । এই বিপদকে ও  সামলে  নিতে হবে । মানছি , তুই মা ,তোর মন আমার মতো শক্ত নয় । নরম মাটিতে ইট গড়ে তাকে পুড়িয়ে যেমন শক্ত করা হয় মনটাকে ও সেভাবে শক্ত করতে চেষ্টা কর ।


যা হওয়ার হয়েছে । চুপচাপ বসে থাক । কাল দিন বারোটায় আমরা টিটলাগড়ে পৌঁছে যাবো । আজ রাতটা আর কাল দিন বারোটা পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে রাখ । বুকে পাথর চেপে রাখ । গ্রামে পৌঁছে দুজন কাঁদতে হবে ।


সরিতা ছেলেকে কোলে ধরে বসে রয়েছে পাথরের মূর্তির মত । দিলেশ্বর যতটা বাইরে শক্ত মনে হলেও ভেতরে ভেতরে কাঁদত থাকে ।  বারবার সরিতা র দিকে তাকিয়ে দেখে , ওর তেমন কিছু না হয়েযায় ।


রাত বাড়তে থাকে । সবাই এখন ঘুমিয়ে পড়েছে ।ওর স্থির দৃষ্টি  বাইরের দিকে ।সরিতা আর দিলেশ্বরের চোখে ঘুম নেই । খিদে নেই , তেষ্টা নেই । পাথর পাল্টে গেছে দুজন ।


টিটলাগড় স্টেসনে গাড়ি থামে । সবাই নেমে গেছে । কাপড়ের পোটলা , হাতের  ব্যাগ ধরে দিলেশ্বর , তার পেছনে সরিতা নামে । নামার সাথে সাথে তাদের কপালে যন্ত্র ধরে কি যেনো দেখে সরকারের লোক । লাইনে দাঁড়াতে বলে । এখন তাদের বাসে চেপে ক্বারেণ্টাইন সেণ্টারে যেতে হবে । চৌদ্দ দিন থাকতে হবে সেখানে । সরিতা বাসে উঠতে চাইছে না । দিলেশ্বর তাকে বোঝায়- সরকারের নির্দেশ । চল , বাসে ওঠ , এখন আমাদের গ্রামে যেতে দেবে না ।


হঠাৎ ভেঙে পড়ে সরিতা - একে ওখানে চৌদ্দ দিন ধরে রাখবো কি ভাবে ?

- ওটা কি ?

- মরা বাচ্চা ।

চমকে সবাই তাকিয়ে থাকে ।--- মরা বাচ্চা । কখন মরেছে ?

- দু' দিন আগে । কোলে ধরে বসেছি । এখন মায়ের কোলও ওর আর ভালো লাগছে না । পচে এসেছে । ও এখন মাটি চাইছে । মাটির কোলে যেতে চাইছে ।


নিজের বাচ্চা কে মাটিতে দেওয়ার জন্য তুলে দিয়ে সরিতা বলে --  যা বাবা , যা ! দুঃখ ভোগ করার জন্য লম্বা আয়ু দরকার , দুঃখ দেখার জন্য যতটা আয়ু নিয়ে এসেছিলি , যথেষ্ট । কান্না আমার আর পাথর চাপা দিয়ে রাখতে পারছিনা । আমাকে কাঁদতে দে ....! আমাকে মনে ভরে কাঁদতে দে !

    



রাজ্যবর্ধন ধল মহাপাত্র: জন্ম ১৭ই অক্টোবর, ১৯৬০। 
প্রকাশিত গল্প সংকলন- 'সবুমায়া', 'অশ্বগন্ধা', 'ইচ্ছাপত্র', 'মায়াচিত্র', 'মাটি দ্রোণ', 'বামন বৃক্ষ', 'অথল আশ্রয়', 'তথাস্তু', 'দূর নক্ষত্র', 'দৌড় প্রতিযোগিতা', 'সবুজ পত্ররে সূর্যাস্থর রঙ', 'সবুজ মায়া'। প্রকাশিত উপন্যাস- 'দৃদয়র সীমারেখা', 'পুণ্য পতিতা', 'বেল ভল নাহি'।