ভ্রমণ 

কেনিয়ায় কয়েক দিন

সৈ ক ত  রু দ্র   


নাইরোবি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সাজানো-গোছানো এক আধুনিক শহরের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সখেদে ভাবছিলাম, এতদিন কী ভুল ছবি রচনা করে রেখেছিলাম মানসপটে! স্থানীয় সময় বেলা সাড়ে আটটা। দেশে এখন বেলা এগারোটা। শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা উহুরু হাইওয়ে যেন সকালের ব্যস্ত কলকাতা। সোয়াহিলি ভাষায় “উহুরু” মানে স্বাধীনতা। 

  নাইরোবির আসল নাম এনকারে নাইরোবি অর্থাৎ শীতল জল। উচ্চতা ৬০০০ ফুটের কাছাকাছি।  ‘রৌদ্রস্নাত সবুজ শহর’ নাইরোবির আবহাওয়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পার্বত্যাঞ্চলের মতো। মোম্বাসা থেকে উগান্ডা পর্যন্ত রেলপথ তৈরির সময় ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশরা একটা রেল ডিপো তৈরি করেছিল এখানে। ক্রমশ এটাই হয়ে উঠেছিল রেলের সদর দপ্তর। ১৯০৭এ সেই নাইরোবিই পরিণত হয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট আফ্রিকার রাজধানীতে।  

  ছবি তুলে যাচ্ছি মনের আনন্দে। আমাদের গাইড তথা ড্রাইভার মোজেস মাইকেল মোয়াঙ্গি বলল, ‘ক্যামেরা জানলার বাইরে রাখবেন না। ছিনতাই হয়ে যেতে পারে।’ প্রমাদ গণলাম। এতক্ষণ যে সুন্দর শহর দেখে মন ভরে উঠছিল তাতে সহসা শংকার দংশন। নাইরোবি নাকি কিছুদিন আগেও ‘নাইরবারি’ বলে আখ্যাত ছিল। কয়েক দিন আগেই আবার ঘটে গেছে ওয়েস্টগেট মল শুট-আউট। অবশ্য গাড়ির জানলার বাইরে কিন্তু এক স্থিত জীবনের ছবি। অতএব ক্যামেরা সামলে উদ্বেগ সরিয়ে দিলাম মন থেকে। 

   এক চমৎকার দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল মোজেস। রাস্তার পাশে গাছে গাছে মগডালে বসে আছে বিশাল আকারের প্রচুর পাখি। নাম মারাবু স্টর্ক। হঠাত দেখলে শকুন মনে হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Leptoptilos Crumeniferus (এরা অবশ্য জানলে নির্ঘাত খেপে যেত)। শকুনের মতোই এদের ‘ঝাড়ুদার পাখি’ বলা যায়। পচা জীবজন্তুর লাশ এদের প্রিয় খাদ্য, তবে গেলা যায় এমন ছোটখাট প্রাণী - পায়রা, ঘুঘু, বাচ্চা পেলিক্যান বা ফ্লেমিঙ্গো, এমনকি কুমিরছানাও বাদ যায় না। শকুনের মতো বাঁকা ধারালো ঠোঁট নেই বলে এরা অনেক সময় শকুনের খাবারও চুরি করে। মানুষের নানা বর্জ্য এদের কাছে লোভনীয় বলে মানুষের বসতিতেও এদের বাস। 


মারাবু স্টর্ক 
     

বেলা বাড়ছে। দিন ব্যস্ত হয়ে উঠছে এখন। রাস্তায় ঘন ট্র্যাফিক, মানুষের ভিড়। রাস্তার পাশে জ্যাকারান্ডা, রাধাচূড়া রঙিন সাজে সেজেছে। 

   হিলটন হোটেল আজকের আশ্রয়। পুল-সাইড মুক্তাঙ্গন রেস্তরাঁতে প্রাতরাশ সেরে বন্ধুর স্থানীয় অফিস ঘুরে ডলারের বিনিময়ে কেনিয়ান শিলিং জোগাড় করে চললাম জিরাফ সেন্টারে। 

   বিপন্ন রথসচাইল্ড জিরাফকে সংরক্ষণের জন্য নাইরোবি থেকে প্রায় পাঁচ কিমি দূরে লাঙ্গাটাতে  আফ্রিকান ফান্ড ফর এনডেঞ্জারড ওয়াইল্ডলাইফ (কেনিয়া) লিমিটেড ১৯৮৩ সালে গড়ে তুলেছিল  জিরাফ সেন্টার। এখানে জিরাফ প্রজনন করা হয়। উহুরু হাইওয়ে ধরে উহরু পার্ক পেরিয়ে ব্যস্ত শহরের ভেতর দিয়ে পৌঁছলাম জিরাফ সেন্টারে। উন্নত ও দীর্ঘশির জিরাফরা আপন মনে চরে বেড়াচ্ছে। দোতলা-সমান উঁচু অবজারভেশন প্ল্যাটফর্ম করা আছে। সেখানে উঠে জিরাফদের মুখোমুখি হওয়া যায়। তারা এসে প্রার্থীর দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে। দর্শকরা মুখে তুলে দিচ্ছে খাবার, আদর করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মুখে, মাথায়। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আবার গুটিগুটি হাজির ওয়ার্টহগরাও। ডেজার্ট ওয়ার্টহগ নামে পরিচিত এই মজাদার চেহারার প্রাণীটি স্বভাবে কিন্তু বড়োই নিরীহ।

   সন্ধের পরে মোজেস আমাদের নিয়ে গেল এক ভারতীয় রেস্তরাঁয়। সন্ধের শহরের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মনে হল এই শহর আমার চেনা। একটা বড়ো কারণ হয়তো মানুষের চেহারা। আমাদের পাঁচমিশেলি দেশে এমন কালো আমরা অনেকেই। আবার চেহারায় আমাদের অনেকের মতোই ভাল-না-থাকার ছাপ। আছে আমাদের মতোই ঝাঁ-চকচকে হর্ম্যের পাশাপাশি মলিনতা। আরো একটা ব্যাপার হল চেনা প্রকৃতি, গাছপালা যেটা শহরের বাইরে আরো ভাল বোঝা যায়। আমাদের সাভানা না থাকলেও আছে রুক্ষ লাল মাটি, টাঁড়, ব্রহ্মডাঙ্গা যা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমে পাওয়া যায়। অনেক জায়গাকে অনায়াসে পুরুলিয়া বা বাঁকুড়ার কোনও জায়গা বলে চালানো যায়। মিল আরও আছে। ব্রিটিশ প্রভাবে এখানে রাস্তায় গাড়ি চলে আমাদের মতোই বাঁ দিক দিয়ে।  আবার আমাদের মতোই পথের পাশে নিষ্কর্মা মানুষের আড্ডা চোখে পড়ে। এটা বেকারত্বের দুর্লক্ষণ বলে আমার মনে হয়। দু-এক জায়গাতে রাস্তায় দেখলাম গোরু চরে বেড়াচ্ছে আপন খেয়ালে। প্রাইভেট বাসের চেহারাও আমাদের বাসের মতো গরিব-গরিব চেহারা, ছাদে চাপানো আছে মালপত্র। বেশ স্বস্তি পাওয়া গেল। শহরের আপাত-ঔজ্জ্বল্য ছাড়ার পর ছোট ছোট গঞ্জ, শহরও আমাদের মতোই। ঘিঞ্জি, মলিন। 

   পরদিন হোটেল ছাড়লাম চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে। যেতে যেতে চোখে পড়ছে পেঁপে গাছ, কলা গাছ, আম গাছ, কল্কে ফুল, সিলভার ওক, জ্যাকারান্ডা। বারবার ভুলে যাচ্ছি আছি দেশ থেকে অনেক দূরে। নানিয়ুকিতে নিরক্ষরেখার ওপরে থামা হল। পৃথিবী বেষ্টন করে আছে যে কল্পিত রেখা তারই ওপরে দাঁড়িয়ে আছি ভেবেই রোমাঞ্চ হল। স্থানীয় এক ব্যক্তি দেখালেন নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর আবর্তনের প্রভাব। মাঝখানে ফুটো করা জলভরা একটা পাত্র থেকে পড়ছে জলের ধারা। রেখার উত্তরে অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের এলাকায় জলের ধারা পড়ছে ঘড়ির কাঁটার চলনের মতো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে ঘুরে ঘুরে। আবার পাত্রটিকে দক্ষিণে নিয়ে গেলে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার উলটো দিকে ঘুরে ঘুরে পড়ছে। আর ঠিক রেখার ওপরে পাত্র রাখলে জলধারা না ঘুরে পড়ছে সোজা। একে বলা হয় কোরিওলিস এফেক্ট। 

   আমাদের গন্তব্য অ্যাবারডেয়ার ন্যাশনাল পার্কে পৌঁছতে প্রায় বেলা বারোটা। থাকার ব্যবস্থা সুইটওয়াটার্স টেন্টেড ক্যাম্পে, যাকে বলা হয় মাচান টেন্ট। খুঁটির ওপর  মাচা করে ঘর। ক্যাম্প এলাকাও বেশ পরিচ্ছন্ন, সাজানোগোছানো। এই পার্ক মধ্য কেনিয়ার অ্যাবারডেয়ার মাউণ্টেন রেঞ্জের উচ্চতর অংশে ৭৬৬ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ছটিয়ে আছে। 

   আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইয়েলো-বিল্ড স্টর্ক, সেক্রেড আইবিস, গ্রে-ক্রাউন্ড ক্রেন। সুপার্ব স্টারলিং, রুপেল'স গ্লসি স্টারলিং, হোয়াইট-ব্রাউড স্প্যারো উইভার, রেড-বিল্ড কোয়েলা, পিন-টেইল্ড হোয়াইডা ওড়াউড়ি করছে গাছে গাছে। আইবিসরা ‘আমরা তো এপাড়াতেই থাকি’ এমন ভাব করে ধীরেসুস্থে ডাইনিং হলের একেবারে দরজায়, ভয়ডর নেই একেবারে। কেউ খাবার ছুঁড়ে দিলে তারাও লম্বা কাস্তের মতো ঠোঁটে ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে যাচ্ছে। দূরে পাহাড়শ্রেণী। ক্যাম্পের সীমানার ওপারে ওয়াটারহোল। সেখানে চরছে গ্রান্ট'স গ্যাজেল, ওয়ার্টহগ, জেব্রা।

        


খাওয়াদাওয়ার পরে গেলাম শিম্পাঞ্জি ভিজিটর সেন্টারে। প্রবেশপথের মুখে সতর্কবাণী - আপনি এই সেন্টারে বেড়াতে এসেছেন নিজের দায়িত্বে। গাইড ছাড়া হাঁটবেন না। ওল পেজেতা কনজারভেন্সি বিপজ্জনক বন্যপ্রাণী অধ্যুষিত। কনজারভেন্সিতে থাকাকালীন কোনও পর্যটক আহত বা নিহত হলে তার দায় কনজারভেন্সির নয়। বাঃ, বেশ ! 

   প্রবেশপথ থেকে সঙ্গী হলেন গাইড। এই সুইটওয়াটার্স শিম্পাঞ্জি স্যাংচুয়ারি খোলা হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। এর পেছনে ছিল ওল পেজেতা কনজারভেন্সি, কেনিয়া ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস এবং জেন গুডল ইন্সটিট্যুটের মধ্যে এক চুক্তি। লক্ষ ছিল, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকা থেকে অনাথ ও বিপন্ন শিম্পাঞ্জি শিশুদের নিয়ে এসে আশ্রয় দেওয়া। সেই বছরেই বুরুন্ডির বুজুম্বুরা থেকে তিনটি অনাথ শিম্পাঞ্জি শিশুকে নিয়ে আসা হয় বুরুন্ডিতে গৃহযুদ্ধ বাধার ফলে। ক্রমশ এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। 

   তারের বেড়ার ওপারে শিম্পাঞ্জিরা। মুখে যেন কেমন এক বিষাদ মাখা। একজনের নাম কোকো। একজনের নাম এডওয়ার্ড। অন্যদের নাম জানি না। এপারে আমরা দর্শক, ওপারে ওরা। কোনও প্রত্যাশা নিয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। কেউ আপনমনে খেয়ে চলেছে আখ। 

          


  এরপর গেম ড্রাইভ। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি আফ্রিকার সাভানার কথা। এখন সেই সাভানার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। সাভানা হল বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো গাছ কোথাও ঘন নয়। যার ফলে গাছের চাঁদোয়া তৈরি হয়নি কোথাও। অবাধে সূর্যের আলো পড়ে মাটিতে। তৈরি হয় ঘাস, নানা তৃণ, গুল্ম, ছোট উদ্ভিদ। দিগন্ত জুড়ে যেন অসীম শূন্যতা। সাভানাকে বলা হয় অরণ্য আর মরুভূমির মধ্য পর্যায়। ধু-ধু প্রান্তরে কোথাও কোথাও যেন নিজের মাথায় ছাতা ধরে একা দাঁড়িয়ে আছে আমব্রেলা অ্যাকেশিয়া, কেনিয়ার জাতীয় বৃক্ষ। উদ্ভিদভোজী প্রাণীর পক্ষে আদর্শ জায়গা। অবাধ খোলা প্রান্তর ভেদ করে চলেছে পথ চলে গেছে দিগন্তের দিকে। ঘাসের বুকে গাড়ির চাকার সমান্তরাল দাগ। একেই বোধহয় বলে দূর-শূন্যপথ। 

       

আফ্রিকান এলিফ্যান্ট
                              

এখানে-ওখানে বিচরণ করছে সাভানার অধিবাসীরা। ঘন ঘাসের মধ্যে বসে আছে ভীষণদর্শন কেপ বাফেলো বা আফ্রিকান বাফেলো। সামনাসামনি এদের মোকাবিলা করার সাহস হয় না সিংহ বা চিতা বা লেপার্ডেরও। বড়সড় আকারের বেবুনরা ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের খোঁজে। মা-বেবুনের পরম নিরাপদ কোলে আরামে বসে আমাদের দিকে জুলজুল করে তাকাচ্ছে শিশু বেবুন। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’ কথাটার উভয়ত সত্যরূপ আমার চোখের সামনে। কোথাও আপন মনে চরছে গ্রান্ট'স গ্যাজেল। উদ্ধত ভঙ্গিতে হাঁটছে সেক্রেটারি বার্ড। গাছের মাথায় তাদের গোলাকৃতি বাসা। হেলমেটেড গিনি ফাউলরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের খোঁজে। এক জায়গাতে দেখা গেল ইম্পালার পাল। মাঝারি আকারের এই অ্যান্টিলোপ কেনিয়া ছাড়াও দেখা যায় বটসোয়ানা, অ্যাঙ্গোলা, মালাউই, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, রোয়ান্ডা, সোয়াজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, তানজানিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ি - অর্থাৎ প্রায় গোটা আফ্রিকাতেই। আবার কোথাও চরছে ওয়াটারবাকের দল। এরাও এক ধরণের অ্যান্টিলোপ। দোতলা-সমান মাথা উঁচু করে গাছের মাথা থেকে পাতা খাচ্ছে জিরাফ। এদের মাথা বোধহয় পায়ের খবর রাখে না। শান্ত, নিরীহ, সুস্থির প্রাণী। জীবনে কোথাও যেন কোনো তাড়া নেই, ব্যস্ততা নেই। এরা হল মাসাই জিরাফ। প্রায় ১৯ ফুটের মতো লম্বা। দেখা হল জেব্রা আর হাতিদের সঙ্গে। 

                                       

বারাকা  
                                 

  এবার মোরানি ইনফরমেশন সেন্টার। এখানে আছে কালো গণ্ডার বারাকা। সোয়াহিলিতে ‘বারাকা’ মানে ‘আশীর্বাদ। জন্ম ১৯৯৪এর ২০ নভেম্বার। ব্ল্যাক রাইনো স্বভাবে গুণ্ডা ধরণের। নিজেদের মধ্যে মারামারিতে বেশ উৎসাহ। বারাকাও একটা চোখ হারিয়েছিল মারামারি করতে গিয়ে। পরে অন্য চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পুরো অন্ধ হয়ে গেছে সে। পাছে আরও কোনো বিপদে পড়ে এই ভয়ে ২০০৯ সালে তাকে নিয়ে আসা হয় মোরানিতে।

  রক্ষীর ডাক পেতেই কোথা থেকে বেরিয়ে এল বারাকা। ভারি শরীর নিয়ে হেলেদুলে এল আমাদের কাছে কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে। শুকনো ঘাসপাতা তার মুখের কাছে তুলে ধরতেই আমাদের হাত থেকে খেল বারাকা। 

  বেলা গড়াতে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। অন্ধকার নেমেছে ওল পেজেতা কনজারভেন্সিতে। ক্যাম্প এলাকা বেশ ছড়ানো। তবে আলোর আয়োজন কম। ঘরে থাকতে ইচ্ছে করল না। বারান্দাতে পাতা চেয়ারে বসে রইলাম অনেকক্ষণ অন্ধকারে চোখ ডুবিয়ে। অন্ধকার গাছপালার ভেতর থেকে অদ্ভুত জোরালো আওয়াজ। মনে হল আমার কাছেই, কিংবা ঘরের ভেতরে, অথবা ঘরের নিচে। গা-ছমছম করা আওয়াজ। পরে বুঝলাম ডাকটা আইবিসের। গলার জোর আছে সন্দেহ নেই, তার ওপর নিস্তব্ধতা সেই শব্দকে বাড়িয়ে তুলেছিল বহুগুণ। সারা রাত চলেছিল সেই ডাক। 

  রাতে খাওয়ার পরে আবার বেরোলাম। শুনেছি ক্যাম্প-সীমানায় বিপদআপদ নেই। নিশ্চিন্তে ভিডিও ক্যামেরা সঙ্গে নিলাম। একটু এগোতে দেখি এক ইম্পালা আলোআঁধারিতে নিশ্চিন্তভাবে ঘাস খাচ্ছে। সীমানার ওপারে ওয়াটারহোলের কাছে আরো কয়েকটা। জলের কিনারায় ঘুমন্ত বা ঝিমন্ত আইবিসের ঝাঁক। চরতে চরতে কয়েকটা ইম্পালা সীমানার অগভীর শুকনো সরু খাত পেরিয়ে চলে এল এ পারে। ঘরে ফিরে আইবিসের গা-ছমছম-করা ডাক শুনতে শুনতে ঘুমোনর চেষ্টা করলাম। 

  ভোর পাঁচটার আগেই উঠে এলাম ভোরের দৃশ্য দেখতে। তখনও বাইরে অন্ধকার। ক্যাম্পাসে আলো জ্বলছে। দূরে মাউন্ট কেনিয়ার মাথায় পুবের আকাশে অতি মৃদু আলোর আভাস। ওয়াটারহোলের পাশে আবছা দেখা যাচ্ছে পবিত্র আইবিসদের, ঘাড় গুঁজে ঝিমোচ্ছে, মৃদু নড়াচড়া করছে। বাতাস এখন বেশ ঠাণ্ডা। অল্প হাওয়াও দিচ্ছে। শিশিরে ভিজেছে ঘাস। পুবের আকাশ গোলাপি হয়ে উঠছে। আকাশের বুকে মাউন্ট কেনিয়ার শীর্ষরেখা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আইবিসদের নড়াচড়া বেড়েছে। কেউ কেউ শ্লথ পায়ে হাঁটছে হয়তো খাবারের খোঁজে। গাছগাছালিতে পাখিদের

চঞ্চল ওড়াউড়ি, কলরব, ব্যস্ততা। দিন শুরু, খাবার দরকার। বেঞ্চে বসে রইলাম, ছবি তুললাম। দূর আফ্রিকার কেনিয়াতে এই ভোরের সাক্ষী আমি, বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন।   

                             

লেপার্ড
                                      

প্রাতরাশের পরে গাড়ি ছাড়ল। আজ চলেছি লেক এলিমেন্টাইটার দিকে। যেতে যেতে দেখা হল মেল এবং ফিমেল মাসাই অস্ট্রিচের সঙ্গে। বাংলায় এদের বলে উটপাখি। উটের সঙ্গে বেশ মিল। ছেলেদের দেখতে সত্যিই সুন্দর।  বিশাল আকারের পাখি। লম্বা পাইপের মতো প্রায় নির্লোম গোলাপি রঙের গলা বেরিয়ে এসেছে। গলাটা পাইপের মতোই ইচ্ছেমতো ঘোরাতে, বাঁকাতে, পাকাতে পারে। মূল দেহ থেকে বেরিয়েছে গোলাপি রঙের লম্বা ঠ্যাং। ভারি কালো রঙের পালকে ঢাকা দেহ। নিচের দিকে সাদা ঝাঁকড়া পালক। বেশ শক্তিশালী চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। উড়তে না পারলেও ভালই ছুটতে পারে। 

  রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এতদিন যাদের দেখেছি চিড়িয়াখানার বদ্ধ কৃত্রিম পরিবেশে আজ তাদের দেখছি প্রকৃতির মুক্ত অঙ্গনে, নিজেদের জগতে। লম্বা গলা উঁচিয়ে উঁচু গাছের মগডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে  সোমালি জিরাফ। দলবেঁধে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করছে জেব্রারা। দলছুট আফ্রিকান 

   

                  

বাফেলো একমনে খেয়ে চলেছে ঘাসপাতা। টমসন'স গ্যাজেলরা চরে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে কয়েকটা ওয়ার্টহগ ল্যাজ খাড়া অ্যান্টেনার মতো তুলে পাঁইপাঁই ছুটছে। সিলভার-ব্যাক্ট জ্যাকাল ঘুরে বেড়াচ্ছে শিকারের সন্ধানে। মুখ ফিরিয়ে একবার দেখে নিলো আমাদের। 

  তেপান্তরের মাঠের মাঝখান দিয়ে চলেছে কাঁকুরে পথ। দূরে ঘোলাটে নীল পাহাড়। প্রাইভেট কনজারভেশনের ঘেরা এলাকাতে অলস ভঙ্গিতে বসে কয়েকটি নর্দার্ন হোয়াইট রাইনো। হোয়াইট রাইনো ঠিক সাদা নয়। ডাচ শব্দ ‘wijd’ নাকি ভুল অনুবাদে ইংরেজিতে হয়েছে ‘হোয়াইট। কথাটার আসল মানে ‘ওয়াইড বা চওড়া। মতান্তরও আছে। তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এটা ঠিক যে, হোয়াইট রাইনোর গাত্রবর্ণ একটু সাদার দিকে। তাদের আশেপাশে ঘুরছে জেব্রা, ইম্পালারা। 


টোপি
                                  

  চলেছি পশ্চিম দিকে। অ্যাবারডেয়ার থেকে নাকুরুর এলিমেন্টাইটা লেক প্রায় ১১১ কিলোমিটার। সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ। পথে পড়ল গ্রাম, ধু-ধু মাঠ, জনপদ, ফসলের খেত, হাট-বাজার, আমাদের মতোই পথের পাশে দোকানে বসে অলস আড্ডা। পাকা সড়ক এখানে বেশ ঝকঝকে। রাস্তা দখল    অবশ্য চোখে পড়ল না। দোকান-পাট, বাজার যা আছে তা সবই রাস্তা অনেক ছেড়ে। কোথাও গাছের ডাল দিয়ে মাচা করে সওদা রাখা আছে। আলু, পেঁয়াজ, বাঁধাকপি, নানা সবজি। ইউনিফরম-পরা কচিকাঁচারা চলেছে স্কুলে। চলতে চলতে, থামতে থামতে অবশেষে যখন এলিমেন্টাইটা পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় তিনটে। 

  লেক এলিমেন্টাইটা বিখ্যাত গ্রেট রিফট ভ্যালির অন্তর্গত। ৬০০০ কিমি দীর্ঘ এক ভৌগোলিক    অবতল ভূমি যা উত্তর-পশ্চিম এশিয়ার সিরিয়া থেকে আফ্রিকার ভেতর দিয়ে মোজাম্বিক পর্যন্ত 

বিস্তৃত। ‘গ্রেট রিফট ভ্যালি’ এই নামকরণ করেছিলেন উনিশ শতকের অভিযাত্রী জন ওয়াল্টার 

   

গ্রান্ট’স গ্যাজেল 
                                                              

গ্রেগরি। বিজ্ঞানীদের মতে এই উপত্যকার সৃষ্টি ২ কোটি বছর আগে। পৃথিবীর উপরিভাগ দুর্বল হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এক দীর্ঘ ফাটল। পৃথিবীর সেই ঘন ঘন মাথা নাড়ার দিনে উপত্যকার দুপাশে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে তৈরি হয়েছিল বিশাল আগ্নেয়গিরি আর উপত্যকা ক্রমশ বসে গিয়ে তৈরি হয়েছিল সমভূমি। গ্রেট রিফট ভ্যালি কেনিয়াকে ভাগ করেছে দৈর্ঘ্য বরাবর। এর প্রস্থ সবচেয়ে বেশি ১০০ কিমি এবং সবচেয়ে কম নাইরোবির উত্তরে ৪৫ কিমি। আর উপত্যকার তল সবচেয়ে নিচু লেক টুরকানার  কাছে। রিফট ভ্যালি সক্রিয় আজও। এর দৈর্ঘ্য বরাবর এখনও ছড়িয়ে আছে জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, উষ্ণ প্রস্রবণ, ক্ষারীয় হ্রদ। 

 লেক এলিমেন্টাইটা সেরেনা ক্যাম্পের লাক্সারি টেন্টে থাকার ব্যবস্থা। রীতিমতো বড়ো। যেন স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা বাড়ি। সামনে চওড়া বারান্দা। প্রশস্ত ঘর, সুন্দর বাথরুম, পেছনেও বারান্দা। মন-খুশি-করা ব্যবস্থা। ক্যাম্প থেকেই লেক দেখা যায়। জিনিসপত্র রেখে ডাইনিং হলে দুপুরের খাওয়া সেরে লেকের দিকে চললাম ফ্লেমিঙ্গো দেখতে। ঝিরঝির বৃষ্টি নামল। তার মধ্যেই  চলল গাড়ি। বেলা পড়ে আসছে। চলতে চলতেই বৃষ্টি থামল। ভিজে বাতাস। লেকের কাছে চরছে জেব্রা, আফ্রিকান বাফেলো। ফ্লেমিঙ্গোদের সাদা পালকে লালের গাঢ় ছোপ, যেন হোলি খেলেছে। লাল টুকটুকে পা জলে ডুবিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে খাবারের খোঁজে। অনেকে ভেসে বেড়াচ্ছে জলে। ফ্লেমিঙ্গোর সঙ্গে ঘুরে     

                 

সন্তানসহ অলিভ বেবুন
                                                               

বেড়াচ্ছে পেলিক্যানের দল। সামনে বিস্তৃত লেক। ওপারে নীলাভ পাহাড়। আকাশ মেঘে ঢাকা। যে-কোন মুহূর্তে আবার বৃষ্টি নামতে পারে। বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরলাম ক্যাম্পে। সন্ধে নামল। 

  ডাইনিং রুমে একজন গায়ক একপাশে বসে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে। বেশ ভাল গলা আর গাওয়ার ভঙ্গি। টেন্টে ফিরে পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। স্তব্ধ আঁধার রাত। রাতচরা পাখিদের ডাক। একটানা ডেকে চলেছে ঝিঁঝিপোকা। অদ্ভুত ভাল-লাগায় ভরে গেল মন।  

                         

মাসাই জিরাফ 

       
                                        ভোরে উঠে পড়লাম। আমাদের চেনা হনুমান গাছের ডালে বসে প্রাতরাশ সারছে। আজ গন্তব্য মাসাই মারা, প্রায় পাঁচ ঘণ্টার পথ। 

  দুপাশে ছড়ানো প্রান্তর। সুন্দর, মসৃণ রাস্তা। কাছে-দূরে ধূসর পাহাড়। মাঝে মাঝে যতিচিহ্নের মতো গ্রাম, জনপদ, হাটবাজার। পাকা রাস্তা ছেড়ে গাড়ি গড়ালো মাসাই মারার মেঠো কাঁকুরে রাস্তায়। এই রাস্তা পাকা নয় কেন মোজেসকে প্রশ্ন করায় যা জবাব পেলাম সেটা গ্লোবাল বলে মনে হল। রাস্তা পাকা না হওয়ার কারণ নাকি রাজনীতি। বেশ !!!

  দূরে দূরে একা একা দাঁড়িয়ে আছে আমব্রেলা অ্যাকেশিয়া। তৃণভূমি দিগন্তে উধাও। আমাদের ল্যান্ড ক্রুজার ছুটে চলেছে দূর-শূন্যপথে। হঠাৎ চোখে পড়ল কয়েকটা উইল্ডেবিস্ট চরে বেড়াচ্ছে। এরাই হল গ্রেট মাইগ্রেশনের প্রধান অভিযাত্রী। কিছু দূরে চরছে এল্যান্ড আর জেব্রা। গজেন্দ্রগতিতে ঘুরে বেড়াছে আফ্রিকান হস্তিযূথ। রাজকীয় আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি। 

                               

টমসন’স গ্যাজেল 

                               

  বেলা সওয়া দুটো। গাড়ি থামল তেপান্তরের মাঠের মাঝে। যতদূর চোখ যায় শুধুই সাভানার শূন্যতা। একটু বিরতির পর গাড়ি ছাড়ল আবার। হঠাৎ মোজেসের ফিসফিস। ঝোপের ছায়ায় অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে চিতা। পূর্ণবয়স্ক। ঝিমোচ্ছে। মনে হয় পেট ভরা আছে। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে, তবে উদাসীন। মাঝে মাঝে মুখ তুলে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছে, আবার চোখ বুজে শুয়ে পড়ছে। ক্লিক ক্লিক ছবি উঠছে। আমাদের চাপা গলায় উল্লাস। কিন্তু কিছুতেই তার হেলদোল নেই। 

   গাড়ি চলছে। বেশ কিছুটা চলার পর  শূন্য প্রান্তরে দেখা গেল স্ত্রী মাসাই অস্ট্রিচ। পুরুষের সৌন্দর্য নেই, তবে আকারে একইরকম বৃহৎ। দীর্ঘগ্রীব। সারা শরীরে ধূসর কালচে পালক। গ্রীবামূল থেকে ঊরুমূল পর্যন্ত। একটু দূরে চরছে পুরুষটি। 

                     

সেক্রেড আইবিস 
                                         

  বেলা পাঁচটা। একটা খোলা জায়গাতে একটা ছোট নিরাড়ম্বর স্তম্ভ। তেকোনা পীঠের ওপর বসানো মাথাকাটা তেকোনা ওবেলিস্কের মতো। তার ওপরে কাঁচা হাতে লেখা দুটি ইংরেজি অক্ষর - T K । তানজানিয়া-কেনিয়া। দুই দেশের সীমান্তচিহ্ন। নেহাতই হেলাফেলায় তৈরি। পাঁচিল নেই, কাঁটাতার নেই, সীমান্তরক্ষী নেই, পাহারাদার নেই কোনও। হায়, সব সীমান্ত যদি এমনই হত! 

  ছোট পুল পেরিয়ে তানজানিয়ার ভেতরে ঢুকে থামলাম। এখানে ছোট এক গুমটি ঘরে রক্ষীদের অফিস। মোজেস একটা পারমিট করিয়ে নিলো। নেহাতই মামুলি ব্যাপার। কিছু এগিয়ে চোখে পড়ল ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অথরিটির একটা বড়সড় সাইনবোর্ড। এটা লেক ভিক্টোরিয়া সাউথ ক্যাচমেন্ট এরিয়া। জায়গার নাম কিসুমু। সামনে মারা নদি। নদির দৈর্ঘ্য ২৭০ কিমি। কেনিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদি। এখানে অগভীর। মারাবু স্টর্কের ঝাঁক মৃত প্রাণীর শব ঘিরে। একটু ঘুরে ফিরে আবার কেনিয়াতে ঢুকলাম। 

  প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল মাটির ঢিবি। মোজেস জানালো ওগুলো পিঁপড়ের ঢিবি। বেলা পড়ে আসছে। পথের পাশে বয়ে চলেছে নয়নজুলির মতো জলধারা। এখানে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে সবুজ। জলের পাশে চরছে টোপির দল। এরা অ্যান্টিলোপ গোত্রের প্রাণী। চেহারা বড়। লম্বাটে মাথা,  ছুঁচলো মুখে যেন কালচে আবরণ। গাঢ় বাদামি গায়ের রঙ। বাঁকানো শিং। গর্দানমূলে স্ফীতি। পায়ের ওপরের দিকে কালো ছোপ। আফ্রিকার অন্যতম দ্রুতগতিসম্পন্ন অ্যান্টিলোপ এরা। দরকারে ঘণ্টায় আশি কিমি গতিতেও ছুটতে পারে। তবে বেশ নিরীহ আর সামাজিক স্বভাবের প্রাণী। 

   আমাদের আজকের আশ্রয় মারা সেরিনা সাফারি লজ। প্রায় পৌনে সাতটা বাজলেও আলো যথেষ্ট। গাড়ি চলছে। লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে চরছে জিরাফ। আর তারপর চোখ ছানাবড়া। ঘাসের বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন সিংহ মহারাজ। একটু দূরেই সিংহগিন্নি। দুজনেই নিদ্রামগ্ন। মাঝে মাঝে ল্যাজ নাড়িয়ে ডাঁশ, পোকামাকড় তাড়াচ্ছেন। আমাদের উচ্চগ্রামে কথাবার্তা, ক্যামেরার শব্দ, রসিকবচন কিছুতেই তাঁদের অলস নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটল না। 

  প্রায় পৌনে আটটা। সাফারি লজে পৌঁছলাম। ধু-ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে সাফারি লজ। ঘরের পেছনের দিকে দেওয়াল জোড়া কাচের দরজা। তার বাইরে নিশ্ছিদ্র নীরবতায় আচ্ছন্ন সাভানার মুক্ত প্রকৃতিতে চাঁদের আলো এক অদ্ভুত মায়ালোক রচনা করেছে। সাভানা থেকে উঠে আসছে শীতল বাতাস। নিজেদের ঘরে জিনিসপত্র রেখে বাইরে এলাম। লজটা একটা টিলার ওপরে। ছড়ানো ব্যালকনিতে বসার জায়গা। নানা দেশের পর্যটক আছে এখানে এবং আমরাই  একমাত্র বাঙালি নই। 

  পরদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আলো-আঁধারিতে গাড়িতে উঠলাম। তেপান্তরের মাঠে থামলো গাড়ি। পুবের আকাশে রঙ ধরেছে। নেতিয়ে পড়া রঙিন কাপড়ের মতো পড়ে আছে বেলুন। হলুদ রঙের ওপরে দৈর্ঘ্য বরাবর গাঢ় লাল, গাঢ় সবুজ আর নীল রঙের ডোরা। পাশে কাত হয়ে আছে বেতে বোনা দোলনার মতো দেখতে বিশাল এক বাস্কেট। এটাতেই সওয়ার হবো আমরা। বেলুনের কম্যান্ডার এক শ্বেতাঙ্গিনী। স্বাস্থ্যবতী, স্মার্ট, ব্যক্তিত্বময়ী, বয়স হয়তো চল্লিশের আশেপাশে। এদের দেখে খুব ভালো লাগে আমার। এক মহিলা কী আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন একটা কাজে নিযুক্ত! হ্যাভলক আইল্যান্ডে স্কিউবা ক্লাবও চালাতে দেখেছিলাম এক ফরাসি মহিলাকে। 

  সহসা প্রবল শব্দে অগ্নি নিঃসরণ করতে লাগলো একটি যন্ত্র। আগুনের মুখ বেলুনের বৃত্তাকার  

খোলা মুখের দিকে। দেখতে দেখতে ফুলতে লাগলো বেলুন, ফুলে ধারণ করল বিশাল আকার। বেলুন-কর্ত্রী সবাইকে নির্দেশ দিলেন কাত হওয়া বাস্কেটে উঠতে। উঠতে হবে চিত হয়ে পিঠে ভর দিয়ে। গাড়ির নিচে চিত হয়ে মেকানিকরা যেভাবে কাজ করে সেইভাবে। 

  নড়তে শুরু করল বেলুন, সোজা হয়ে গেল বাস্কেট। আস্তে আস্তে দুলতে দুলতে মাটি ছাড়ল বেলুন। ক্রমশ উঠতে লাগলো ওপরে, আরো ওপরে। মাসাইমারার বিশাল সাভানা ছড়িয়ে আছে নিচে। যেন এক বিরলকেশ মাথা। মাঝে মাঝে থোকা থোকা গাছ, কোথাও নিঃসঙ্গ অ্যাকেশিয়া। ক্ষীণদেহী মারা নদি। নদিতে ভাসছে হিপোর মসৃণ পিঠ। চরছে কেপ বাফেলো, টমসন'স গ্যাজেল, টোপি, এল্যান্ড। নাঃ, কেপ বাফেলো ছাড়া বাকি বিগ ফোরের দেখা নেই। (আফ্রিকার বিগ ফাইভ বলে খ্যাত কেপ বাফেলো, সিংহ, লেপার্ড, আফ্রিকান এলিফ্যান্ট আর রাইনো এই পঞ্চক)। ঘণ্টাখানেক আকাশভ্রমণের পরে বেলুন নেমে এল নিচে। নিচে আয়োজন করা হয়েছে শ্যাম্পেন ব্রেকফাস্টের।  

   মোজেস গাড়ি নিয়ে হাজির ছিল। পথের পাশে স্পটেড হায়েনা শ্রান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে ঝোপের পাশে। লম্বা ঠ্যাং ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রে ক্রাউন্ড ক্রেন। ভারি সুন্দর দেখতে এই পাখি। দুপুর হয়ে গেল। সেরেনা ক্যাম্পে ফিরে লাঞ্চ সেরে গেম ড্রাইভ। 

  দেখা হল কেপ বাফেলো, টোপি, জিব্রাদের সঙ্গে। গাছের ছায়ায় অলসভাবে শুয়ে আছে সিংহ। আমাদের দেখে বিশ্রামের ব্যাঘাত হল বোধহয়। একটু সরে গিয়ে ঝোপের পেছনে মুখ লুকোল। একটু এগিয়ে দেখি সস্ত্রীক সিংহ। সিংহী প্রায় চিত হয়ে নির্লজ্জ ভঙ্গিতে শুয়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। কর্তা বোধহয় পাহারা দিচ্ছে পাশে বসে। 

  মারা নদির ঘোলা জলে ভেসে বেড়াচ্ছে হিপোপটেমাসের দল। যেমন চেহারা তেমনই নাম। অনেকে পাড়ে বসে ঘুমোচ্ছে বা বিশ্রাম করছে। বাচ্চাকাচ্চা সমেত যেন এক যৌথ পরিবার। মাঝে মাঝে গুটিগুটি পায়ে এসে জলে নামছে। জীবনযাপনে ভারি একটা নিশ্চিন্ত ভঙ্গি। এদিকে ওদিকে বিপুলদেহী  কুমির পাড়ে শুয়ে ঝিমোচ্ছে। অবশ্য নিশ্চিতভাবে বলা যায় না ঝিমোচ্ছে কিনা। ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে এরা প্রায়ই। ধৈর্যও অতুলনীয়। শিকারকে ঠিকমতো বাগে পাওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় একইভাবে পড়ে থাকে। জলে থাকলে শুধু চোখদুটো ভাসিয়ে রাখে। 

  নদি ছেড়ে কিছুটা এগোতে দেখা গেল দলবদ্ধ 'টমি' বা টমসন'স গ্যাজেল। গ্রান্ট'স গ্যাজেলের সঙ্গে চেহারায় খুব মিল এদের। একটু দূরে চোখে পড়ল এক হিপো মাঠে চরছে। সন্ধের দিকে এরা জল ছেড়ে ডাঙ্গায় উঠে ঘাস খায়। মূলত উভচর হিপোর ওজনও মন্দ নয়। পুরুষের গড় ওজন ১৫০০ কেজি, স্ত্রী হিপোর ১৩০০ কেজি। এদের খাওয়ার সময় প্রধানত রাতে। চার-পাঁচ ঘণ্টায় প্রায় ৬৮ কেজি খাদ্য । 

                                    

হিপোপটেমাস
                            

  দুপুরে সেরেনা ক্যাম্পে ফিরে লাঞ্চ সেরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ল ধু-ধু প্রান্তরে একা এক ঐরাবত ধীর পায়ে চলে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। কোথায় কে জানে। হয়তো দলচ্যুত।    

  আবার গেম ড্রাইভ। দলবদ্ধ হস্তযূথ, টোপি। সেক্রেটারি বার্ড ঘুরে বেড়াচ্ছে। বেলা ঢলছে। সহসা কিছু দূরে দেখা গেল চিতা। উঁচু ঢিবির ওপরে বসে চারিদিকে ঘোরাচ্ছে সন্ধানী দৃষ্টি। সঙ্গী বসে আছে ঢিবির নিচে। বেশ ক্ষত্রিয়সুলভ চেহারা। গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে দেখলাম, ছবি তুললাম। 

  চলতে চলতে দেখা হল জিরাফ, হাতির দলের সাথে। ঘাসের মধ্যে বসে মাথা তুলে তাকিয়ে আছে সিংহ। দিন ফুরোল। ফিরলাম হোটেলে। 

  ব্যালকনিতে বসে সাভানার অন্ধকারে চোখ ডুবিয়ে কাটল সন্ধেরাত। কাল ফিরব নাইরোবিতে। 

  ব্রেকফাস্ট সেরে সাড়ে আটটা নাগাদ গাড়িতে উঠলাম। ঠিক হয়েছে লাঞ্চপ্যাক সঙ্গে নেওয়া হবে আর যেতে যেতে যতটা পারা যায় চিরুনি তল্লাশি করা হবে সাভানাতে। 

  টোপিরা দল বেঁধে চরছে। একটা বড়সড় টোপি ঢিবির ওপর চড়ে দাঁড়িয়ে কী অবলোকন করছে কে জানে। তবে টোপির এমন ছবি বেশ দেখা যায়। মারা নদির তিরে পৌঁছলাম। এটাও লেক ভিক্টোরিয়া সাউথ ক্যাচমেন্ট এরিয়া। এদিকটা লোয়ার মারা। জায়গাটা যেন শ্মশানঘাট। নদি অগভীর। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে মৃত জীবজন্তুর অজস্র লাশ আর হাড়গোড়। আর সেখানে জমেছে মারাবু স্টর্কের মহোৎসব। এত প্রাণী এখানে এসে গণ-আত্মহত্যা করেছে এমন ভাবার কারণ নেই। আসলে মৃত পশুপাখিদের এখানে এনে ফেলে দেওয়া হয়। মরচুয়ারি অব আনক্লেমড বডিজ। বীভৎস দৃশ্য। 

  ছবিটবি তুলে এগোলাম। ধূর্ত চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখছে স্পটেড হায়েনা। ছানাপোনা নিয়ে ঘুরছে হাতির পাল। জেব্রার বিশাল বাহিনী মনে হল বিশ্রামরত। একেবারে রাস্তার ওপর সদ্যপ্রসূত জেব্রাছানাকে ঘিরে আছে সপরিবার মা জেব্রা। 

  ঘণ্টাখানেক পরে আরো বিস্ময়। সিঙ্গিমামা নয়, সিঙ্গিমামিমা। দুর্লভ ছায়ায় বসে আছে। কখনো আমাদের দেখছে, কখনো বা উদাসীনভাবে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যেন ক্লান্ত, জীবনের প্রতি নির্লিপ্ত।     

  হঠাত মোজেসের চোখে বিদ্যুৎ, দৃষ্টি সামনের গাছের দিকে। সদ্য একটা ইম্পালা শিকার করে এনে গাছের ওপরে ডালপালার ভেতরে রেখে তার পাশে বসে হাঁফাচ্ছে লেপার্ড। শিকার একটা গ্যাজেল। আমরা চিতা আর লেপার্ড গুলিয়ে ফেললেও দুটি আলাদা। চেনার সহজ উপায় হল চিতার দুই চোখের ভেতরের কোণ থেকে নাকের পাশ দিয়ে প্রায় মুখ পর্যন্ত নেমে এসেছে কালো দুটি রেখা যাকে ইংরেজিতে বলা হয় টিয়ার লাইন। দ্বিতীয়ত, গায়ে তার কালো পোলকা ডট। কিন্তু লেপার্ডের টিয়ার লাইন নেই এবং গায়ে ডটের বদলে লিপ মার্কের মতো দাগ। লেপার্ডটি মুখ ফিরিয়ে তাকালো আমাদের দিকে। আমাদের যে পছন্দ করছে না সেটা বুঝিয়ে দিল চোখের ভাষায়। 

  গাড়ি ফিরে চলেছে নাইরোবি। প্রায় ২৮০ কিমি পথ মাসাই মারা থেকে। পথে পড়ল মাসাই গ্রাম। মাসাই পুরুষ ছাগল চরাতে চলেছে। পিঠে বোঝা নিয়ে চলেছে মাসাই কন্যা। পথের পাশে কোথাও বাজার। ছোট দোকান। কোথাও অলস আড্ডা। একটা জায়গাতে থামা হল লাঞ্চের জন্য। ভ্রমণকারীর জন্য ঘেরা সুন্দর ব্যবস্থা। জায়গার নাম এনগোসোয়ানি।  

  হোটেলে ফিরলাম। সন্ধেয় মোজেস আমাদের নিয়ে গেল নাইরোবির বিখ্যাত রেস্তরাঁ কার্নিভোর-এ। কার্নিভোর বিশাল জায়গা জুড়ে। খদ্দেরে ভর্তি। মাঝখানে একটা বড় গনগনে চুল্লিতে তৈরি হচ্ছে খাবার। এখানে অন্যান্য খাদ্যের মধ্যে মেলে অস্ট্রিচ, কুমির ইত্যাদির মাংসের কাবাব। বন্ধুদের খুব উৎসাহ। অস্ট্রিচ, কুমির এসব নিধন আইনত নিষিদ্ধ, তবে রেস্তরাঁর জন্য নাইরোবি থেকে প্রায় পঁচিশ কিমি দূরে খামারে এদের আলাদা করে প্রজনন করা হয়।

   টেবিলে কার্নিভোরের খুদে পতাকা গোঁজা। ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়ে গেলে পতাকা খুলে নামিয়ে রাখতে হবে। পরিবেশকরা বুঝবে খদ্দেরের প্রয়োজন মিটেছে। খাবার আসতে লাগলো। লম্বা শিকে গাঁথা চাকা চাকা কুমির আর অস্ট্রিচের মাংসে সেজে উঠল প্লেট। দাবিমতো চাকা নামতে লাগলো প্লেটে। 

  পরদিন প্রাতরাশের পরে হোটেল ত্যাগ করে পৌঁছলাম ডেভিড শেলড্রিক ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্টের এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজে। নাইরোবি ন্যাশনাল পার্কের উত্তর প্রান্তে এই অরফ্যানেজ। অনাথ হস্তিশাবকদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এই অনাথাশ্রম। দাঁতের জন্য বিপুলসংখ্যক হাতি হত্যা করা হয় সারা পৃথিবীর মতো  কেনিয়াতেও। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিশু হাতিদের উদ্ধার করে এখানে সযত্নে প্রতিপালন করা হয়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার মতে, এটা পৃথিবীর সফলতম হস্তিশিশু উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। শিশুরা সক্ষম হয়ে উঠলে একশ মাইল দূরে সাভো ন্যাশনাল পার্কের প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। 

  সত্যি এদের ব্যবস্থার যত্ন দেখে অবাক হতে হয়। দর্শকের জন্য এক ঘণ্টা খুলে দেওয়া হয় কেন্দ্র। গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে হেলেদুলে, শিশুসুলভ দুষ্টুমি করতে করতে সার বেঁধে খোলা জায়গাতে চলে এল শাবকরা। সঙ্গে পালকরা। এসেই হুটোপাটি। বড়বড় বোতল মুখের কাছে ধরতে চোঁ-চোঁ করে টানতে লাগল। শেষ করেই ভাষাহীন আবদার, আরো দাও। শুধু দুধ নয়, গাছের পাতা, ডালপালার জন্য হামলাহামলি। খাওদাওয়ার পরে ছোট্ট ডোবায় উল্লাসে মাডবাথ, কাদায় হুটোপাটি। দেখতে দেখতে মনে হল মানবশিশু আর হস্তিশিশুর তফাত কিছু নেই। এদের আবার দত্তকও নেওয়া যায় কিছু অর্থের বিনিময়ে। শাবক অবশ্য এখানেই থাকবে। 

  দুপুর গড়িয়ে গেছে। শহরের দিকে ফিরে চললাম। পথে দূর থেকে দেখা গেল কেনিয়ার বৃহত্তম বস্তি কিবেরা স্লাম। একটা হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে বিমানবন্দরের দিকে। মোজেস বিদায় 

                  

কার্নিভোর রেস্তরাঁর কিচেন  
                             

নিলো। দশাসই চেহারার আত্মবিশ্বাসী মানুষটিকে ভালো লেগেছে এই কয়েক দিনে। বিস্তীর্ণ সাভানার বাসিন্দাদের জন্য মন খারাপ থাকবে অনেক দিন। মনে মনে বললাম, আবার আসবো, প্রিয় কেনিয়া।

 © ছবি: লেখক