অনুবাদ 

খুশির দস্তাবেজ

মূল ওড়িআ গল্প : অরবিন্দ দাস

অনুবাদ : প্রদীপ কুমার রায়




-ম্যাডাম্ ওটিপি প্লিজ্ !

সামনের মিরারে পেছনে সিটে বসা দেখে চমকে উঠে মোহিত। মোবাইল থেকে ওটিপি নম্বারটা দিয়ে  মাথা এবং মুখের বৃষ্টি র জল মুছে ট্যাকসির বাইরে চেয়ে রইলেন সেই মহিলা।

গাড়ি ষ্টার্ট করে, ও্বাইপর অন্ করে মোহিত। আবার নজর রাখে মিরারের ওপর।

ভ্যানিটি থেকে ছোট্ট আয়না বের করে, লিপষ্টিক লাগিয়ে, টিসু দিয়ে ঠিক করতে করতে সামনে দেখতে গিয়ে তার চোখ মোহিতের চোখের সঙ্গে মিশে যায়।

-দেবকী নগর।

-হ্যাঁ ! সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন।

অচেনা অজানা মতো চোখ ঘুরিয়ে ইয়ার ফোন লাগিয়ে গান শোনার চেষ্টা করেন ভদ্রমহিলা।

কিছু মনে করার চেষ্টা করে মোহিত। অবশ্যই ভদ্রমহিলা কে কোথায় দেখেছে। এক্কেবারে চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কোথায়!

বড় বড় টানা টানা চোখ, ঠোঁটে র ওপরে কালো তিল। অবশ্যই জানে সে।

মোহিত মিরারটা আবার ঠিক্ করে। তার মনে হয় ভদ্রমহিলা তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য জেনেশুনে অপরচিতের মতো ব্যবহার করছেন। মাথায় ওড়ণা টেনে রাস্তার দিকে চেয়ে রয়েছেন।

নামটা মনে করার চেষ্টা করে মোহিত। সুমিত্রা, সুজাতা, সুমনা.....!

সহজে কি নামটা মনে পড়ছে! দরকার যখন এমন হয়, কিছু মনে পড়েনা।

নিজের আগেকার কল্ বয় পেশায় মোহিত অনেক মেয়েদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। তবে সেই সব পেশাদার জীবনের সম্পর্ক। মাত্র কিছু ঘণ্টার সম্পর্ক। ব্যাবসায়িক সম্পর্ক। অন্যের মন বুঝে সন্তুষ্টি দেওয়ার চেষ্টা। টাকার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্ক। দুনিয়া যাকে বলে অনৈতিক। এই ধরণের অনেক গল্প তার বুকের ভেতরে বন্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেই সব অনৈতিক সম্পর্কের ভেতরে কিছু সম্পর্ক আছে যা সে এখনও ভোলেনি।

-আমি আপনার কাছে টাকা নেবো না।

কল্ বয় জীবনে একবার মোহিত এক মহিলা কে বলেছিলো । আঃ... ইনি সেই ..!

সত্যি কি মোহিত কে এখন চিনতে পারছেন না?

মোবাইলে ওটিপি আসা নম্বার ট্রেস করে চুপচাপ নামটা সার্চ করে।

ইয়েস্ ... সুনয়না... মিসেস সুনয়না রাউত।

হ্যাঁ.. প্রায়  দশ এগারো বছর আগে তাদের দেখা, সম্পর্ক।

চাকরির খোঁজে এসে শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা পরীক্ষার জন্য মোহিতের প্রস্তুতি, টিউশনি করে জীবন যাপনের সংঘর্ষ কালের কথা। তার ভাড়া বাসার কাছে ছিলো বিজন দাদার জিম্। ধীরে ধীরে বিজন দাদার সঙ্গে বন্ধুত্ব। তার সুন্দর চেহারা দেখে বিজন দাদা তাকে টাকা উপার্জনের নতুন উপায় বাতিয়েছিলো। কল্ বয় প্রফেসন্।

-আরে, আজকাল এসব খুবই সাধারণ। টাকা খরচ করে আজকাল পুরুষদের মতো মেয়েরা ও চায় খুসি, তৃপ্তি। আমাদের জন্য খুসি আর টাকা। কিছু ভালো ক্লায়েণ্টদের যদি খুসি দিতে পারিস, তোর আর টাকার অভাব থাকবেনা। তবে এই লাইনে সবচেয়ে মা গুরুত্বপূর্ণ তার হচ্ছে বিশ্বাস আর গোপনীয়তা।

মোহিত অবশ্য খবরের কাগজে পড়েছে, বড় বড় শহরে এই সব হয়, তবুও আশ্চর্য হয়েছিলো।

মোহিত পা ' রেখেছিল এই নতুন জগতে।

অনেক সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিলো। নিজের স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে মোহিত জানতে পারে, যৌন সুখ থেকে বঞ্চিত অধিকাংশ মহিলা নিজের বৈবাহিক জীবনের হতাশা, অবসাদ দূর করার জন্য এই পথে পা' রাখেন।

তার এক ধনী ক্লায়েণ্ট মিসেস্ আগ্রও্বাল  সুনয়নার সাথে তার পরিচয় করিয়েছিলেন।

হ্যাঁ .. ইনি সেই সুনয়না। তার দাড়ি আর টুপি র জন্য হয়তো চিনতে পারছেন না। বিয়ের পর সেই ধান্দা ছেড়ে দিয়েছে মোহিত। এখন ট্যাক্সি চালায়।

হঠাৎ মোহিত প্রশ্ন করে- মাম্, আপনি আমাকে....

তার কথা না শোনার মতো ভান করেন ভদ্রমহিলা।

ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি থামার পর  কিছু কথা মোহিতের মনে পড়ে।

প্রথম সাক্ষাতেই মোহিতের মনে হয়েছিল সুনয়না অন্যদের চেয়ে খুবই ভিন্ন। বিয়ের আঠ বছর পরে ও সন্তান নেই। টাকার বিনিময়ে তাকে কখনো রোবর্টৈর মতো ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন নি। ক্রমাগতভাবে তারা দুবার মিলিত হয়েছিল কোনো প্রতিষেধক ব্যবহার না করে। বয়স ত বেশি নয়, মনোপোজ হওয়ার ও সম্ভাবনা নেই। তবে অনেক খুশি এবং উপভোগের অনুভূতি পেয়েছিলো মোহিত। তাই বলেছিলো -ম্যাম ... আমি আপনার কাছে টাকা নেবো না।

-কেনো,  তুমি তো টাকার জন্য এইসব করো!

-টাকার জন্য মানুষ সবকিছু করেনা।

সেইদিন হেসেছিল সুনয়না, বলেছিল- এই সব ছেড়ে বিয়ে কর। ছেলেমেয়ের সংসার ই আসল আনন্দ দেবে।

আর কবেও সুনয়না তাকে ড়াকায়নি। ফোনে এড়িয়ে চলে। একদিন হঠাৎ মোহিত পৌঁছে যায় সুনয়নার বাসায়। সুনয়না কে দেখে চমকে উঠে। সুনয়না প্রেগন্যান্ট। ফিরে আসে মোহিত।

আজ আবার এতো বছর পর !

ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ হওয়ার পর গাড়ি এগিয়ে চলে।

-আপনি সুনয়না ম্যাডাম ত! আমি মোহিত, চিনতে পারছেন!

-চুপচাপ গাড়ি চালাও। নাহয় আমি সেক্সুয়ালী হ্যারাসমেণ্ট কম্লেন করতে পারি। পুরানো অভ্যাসটা ছাড়োনি বোধহয়।

-ম্যাম, প্লিজ্, আমি ওসব ছেড়ে দিয়েছি। এখন ট্যাক্সি চালাই। আপনাকে অনেক খুঁজেছি।

-কল বয় থেকে ট্যাক্সি! কেনো খুঁজছিলে? ব্লাকমেইল করবে?

মোহিত গাড়ি থামায়।

-ম্যাম, প্লিজ, আমি আমাদের বাচ্চা কে একবার দেখতে চাই।

-আমাদের বাচ্চা! তুমি কি পাগল! পুলিশ কে ফোন করবো?

-হ্যাঁ ম্যাম, আমি পাগল। বিয়ের পর প্রথম সন্তান জন্মের আগেই মারা যায়। পরের দুটোই সন্তান মানসিক বিকলাংগ। জীবনের সব সুখ হারিয়ে গেছে। আমি জানি, কেনো আপনি আমার থেকে দূরে থাকতে চাইছেন। আমি কন্তু মাত্র একবার আমাদের সন্তান কে দেখতে চাই। একবার...!

-বাবা মায়ের জন্য সন্তানের সঞ্জা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তোমাদের মতো মানুষ সুখের সংজ্ঞা ও জানেনা।

গাড়ি আবার চলতে আরম্ভ করে।

সুনয়নার ঘরের সামনে গাড়ি থামে। ভাড়া দিয়ে সুনয়না মোহিত কে ভেতরে ড়াকে।

দরজা খোলে কাজের মেয়ে। তার পেছনে দশ বছরের এক মেয়ে।

-এই আমার মেয়ে। আমাকে মা র গৌরব দিয়েছে। তাই আমি খুবই খুশি এবং গর্বিত। একে দেখতে চেয়েছিলে না। এই হচ্ছে আমার খুশির দস্তাবেজ।

মোহিতের মনে হয় সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে।  কোনো মতে গাড়িতে বসে স্টার্ট করে। তুমুল বৃষ্টি আরম্ভ হয়।

মোহিতের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হুইলচেয়ারে বসা এক স্পাষ্টিক মেয়ের মুখ।




অরবিন্দ দাস: জন্ম ১৯৬৮। সমকালীন ওড়িআ সাহিত্যের এক পরিচিত নাম। প্রকাশিত গল্প সংকলন :  'লিপষ্টিক', 'প্রজাপতির নূআঁ ঠিকণা', 'পেদাপুরম্ র পদ্মা', 'বিধর্মী'।




'এবং খোঁজ', 

শারদ সংখ্যা (আশ্বিন)

অঙ্কনশিল্পী: তমোজিৎ ভট্টাচার্য্য, শুভদীপ মন্ডল