দেবীদুর্গা ও তার চালচিত্র
সায়ন দাস মুখোপাধ্যায়
আগের বছরেরই কথা। অষ্টমীর দিন সকালে আবুল জেলে আমায় ঠাকুর দেখতে বেরোতেই হয়েছিল। আগের দিন সপ্তমীর রাতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম, তারপর আর পরের দিন সকালে বেরোনোর কোনো ইচ্ছেই ছিলো না আমার। কিন্তু বরাবরই ওর জূদের কাছে আমি হার মেনে যাই। মহাষ্টমীর সকালে মা দূর্গার কাছে অঞ্জলী দিয়ে বেলা বারোটা নাগাদ কলকাতায় ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলাম। তবে সেদিন আবু নীল রঙের একটা শাড়ী পড়েছিল, কি অপূর্ব লাগছিলো। ওর থেকে চোখ সরাতেই পারছিলাম না। ওর সেদিনের রূপে আমি খুবই প্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তাই আর নাও করতে পারিনি। ওর সাথে ঠাকুর দেখতে বেরোনাটা সেদিন অন্যরকম শান্তি দিয়েছিল। কিন্তু সেই শান্তি বেশিক্ষন টিকলো না। দক্ষিন কলকাতার একটি বারোয়ারী পুজোর মন্ডপে আমরা দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ ঢুকেছিলাম। বেশ কিছু সেলফিও তুলেছিলাম তবে মায়ের মূর্তি দেখে আমার একদম ভালো লাগলো না। আমরা সাধারনত তেমন সাধারনত মা কে দেখে আসছি, এই মন্ডপের মা কে তেমন দেখতে নয়। প্রতিমাটির কোনো চালচুলো নেই। সকালের পরিষ্কার আকাশে তেমন মেঘ ছিন্নভিন্ন থাকে ঠিক তেমনি মা দূর্গার ও তার ছেলেমেয়েদের একই অবস্থা। মন্ডপের চার কোনে মায়ের ছেলেমেয়েরা। সবার মাঝে মা দূর্গা। এই সমাজ আধুনিকতার সাথে সাথে মায়েরও রূপ বদলাচ্ছে। এখন তো বারোয়ারী পুজোগুলোয় আর মায়ের চালচিত্র দেখাই যায় না, প্রায় বললেই চলে। অথচ মায়ের চালচিত্রর অবদান সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
দেবী দূর্গার মাহাত্ম্যের অবদান তাঁহার চালচিত্রে। কিন্তু এখন আর কোথায় সেই চালচিত্র? তবে অবশ্য এখনো বনেদি বাড়ির মা দূর্গার প্রতিমায় চালচিত্র রয়েছে। তবে বর্তমানে যেইসব বাড়িতে পুজো শুরু করেছে, সেইসব বাড়িগুলোর মধ্যে কিছু সংখ্যক বাড়িতে চালচিত্র দেখা যায় না। তবে এমন সংখ্যক বাড়ির প্রতিমায় চালচিত্র হীন অতি নগন্য। আমি মনে করি বারোয়ারী পুজোগুলো বিধিসম্মত পুরোপুরি মেনে হয়না।
দেবীদুর্গার রূপের বিবরণ পাওয়া যায় দেবীর ধ্যানমন্ত্রেই। মন্ত্রসহ দেবীর সেই রূপই বিস্তারিত করলাম-
“জটাজুট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।
লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্।।২।।
অতসীপুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।
নবযৌবন সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্।।৪।।
সূচারু দশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত পয়োধরাম্।
ত্রিভঙ্গস্থান সংস্থানাং মহিসাসুরমর্দীনিম্।।৬।।
মৃণালায়াত সংস্পর্শ দশবাহু সমন্বিতাম্।
ত্রিশুলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খর্গং-চক্রং ক্রমাদধঃ।।৮।।
তীক্ষ্ণবাণং তথা শক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ।
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ।।১০।।
ঘণ্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।
অধস্থান মহিষং তদ্বৎবিশিরক্ষং প্রদর্শয়েৎ।।১২।।
শিরোচ্ছেদোদ্ভবং তদ্বৎ দানবং খর্গ পাণিনম্।
হৃদি শুলেন নির্ভিন্নং নির্যদন্ত্র বিভূষিতম্।।১৪।।
রক্তারক্তী কৃতাঙ্গঞ্চ রক্তবিস্ফুরিতেক্ষণম্।
বেষ্টিতং নাগপাশেন ভ্রূকুটি ভীষণাননাম্।।১৬।।
সপাশ বামহস্তেন ধৃতকেশঞ্চ দুর্গয়া।
বমদ্রুধির বক্ত্রঞ্চ দেব্যা সিংহং প্রদর্শয়েৎ।।১৮।।
দেব্যাস্তু দক্ষিণাং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।
কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বং তথা বামঅঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি।।২০।।
স্তুয়মানঞ্চ তদ্রূপ মমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকাম ফলপ্রদাং।।২২।।
উগ্রচন্ডা প্রচন্ডা চ চন্ডোগ্রা চন্ডনায়িকা।
চন্ডা চন্ডবতী চৈব চন্ডরূপাতিচন্ডিকা।।২৪।।
অষ্টাভি শক্তিভিরষ্টাভিঃ সততং পরিবেষ্টিতাম্।
চিন্তয়েৎ জগতাং ধাত্রিং ধর্মকামার্থ মোক্ষদাম্।।২৬।।”
দেবীর এই শ্লোকের ব্যাখ্যাটি উদ্ধৃত করলাম।
দেবীর মাথায় জটা, সাথে অর্ধচন্দ্রের মত কপাল। পূর্ণিমার চাঁদের মত মুখ তাঁর ও গায়ের রঙ অতসীফুলের মতো। তিনি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এবং তাঁর সর্বাঙ্গ বিভিন্ন অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত। ।২-৪।
তাঁর দাঁত সুন্দর এবং ধারালো, স্তন সম্পূর্ণ। তিন ভাঁজে দাঁড়িয়ে তিনি দৈত্য নিধন করছেন। দশহাতভর্তি অস্ত্র তাঁর যা দেখতে শাখা-প্রশাখা সমন্বিত পদ্ম গাছের মতো। ডানদিকের উপরের হাতে অবস্থান করে ত্রিশুল, তারপর ক্রমান্বয়ে খর্গ এবং চক্র। ।৬-৮।
দেবীর দক্ষিণের সর্বনিম্ন দুই হাতের অস্ত্র ধারালো তীর এবং বর্শা। দেবীর ধ্যানে বর্ণিত হয় তাঁর বাঁ হস্ত। সেদিকে সবচেয়ে নিচের হাতে থাকে চামড়ার ঢাল ও তার উপরের হাতে ধনুক। সেগুলির উপরের হাতে থাকে সর্প, অঙ্কুশ এবং কুঠার (ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে)। দেবীর পায়ের কাছে দৈত্যরাজের মাথার স্থান। ।১০-১২।
মহিষের কাটা মাথা থেকে মহিসাসুরের দেহ অর্ধেক উত্থাপিত, হাতে তাঁর খর্গ এবং হৃদয়ে দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ। তাঁর পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি নির্গত হয়েছে। শরীর রক্তলিপ্ত। দেবীর হাতে ধরা সাপ দ্বারা অসুরের দেহ বেষ্টিত। তবে উত্থিত ভ্রূ তে দৈত্যের রূপও ভয়ঙ্কর। ।১৪-১৬।
দেবী তাঁর বাম হাত দিয়ে দৈত্যরাজের চুল টেনে রেখেছেন। দেবীর ডান পা বাহন সিংহের উপরে এবং বাঁ পা কিঞ্চিৎ উর্ধে মহিষের উপরে অবস্থান করে। প্রবল যুদ্ধরত অবস্থাতেও দেবী তাঁর শান্তিপূর্ণ মুখাবয়ব ও আশীর্বাদী রূপ বজায় রেখেছেন এবং সমস্ত দেবতা দেবীর এই রূপের স্তুতি করেন। ।১৮-২২।
দেবীর উপরোক্ত রূপ দেবতাদের আট শক্তি উগ্রচন্ডা, প্রচন্ডা, চন্ডোগ্রা, চন্ডনায়িকা, চন্ডা, চন্ডবতী, চন্ডরূপ ও অতিচন্ডিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। গৃহকর্তার মানব জীবনের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেন এই দেবী। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের জন্য জগন্মাতৃকা দেবী দুর্গার ধ্যানই মানবজাতির হওয়া উচিত। ।২৪-২৬।
অর্থাৎ দেবীর ধ্যানমন্ত্রের তৃতীয় ছত্রে দেবীর গায়ের রং অতসীপুষ্পের মতো বলে বর্ণিত হয়েছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যায়। ‘তপ্ত কাঞ্চন বর্ণাভাং’ অর্থাৎ তপ্ত বা গরম গলিত সোনার সঙ্গেও দেবীর গায়ের রঙের তুলনা করা হয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রে। তবে এই দুটিই বহুল প্রচলিত এবং দেবীপ্রতিমাতেও দু’রকম রঙেরই ব্যবহার দেখা যায়, ফলে যে কোনোটিই সঠিক বলে বিবেচিত। শাস্ত্র মতে দূর্গার এই ধ্যানমন্ত্রে দূর্গার রূপটি কল্পনা করা হয়েছে। এই রূপি বিধিসম্মত সর্বজনগৃহীত মূর্তি। এই রীতি অনুযায়ী সর্বপ্রথম জমিদার কংস নারায়ণ রায় পুজার প্রচলন শুরু করেন। যেহেতু জমিদার কংস নারায়ন রায় এই রীতির পুজার প্রচলন শুরু করেন,তাই এই রীতি কে কংস নারায়ণ রীতি বলা হয়। এই রীতি অনুযায়ী লক্ষ্মী থাকেন বাঁদিকের উপরে আর নীচে থাকে গনেশ আর মায়ের ডানদিকের ওপরে থাকেন সরস্বতী আর নীচে থাকেন কার্তিক। আর এই রীতিই প্রায় সর্বজনীন গ্ৰাহ্য। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী র প্রতিমাও এই রীতি অনুযায়ী নির্মিত। নবদ্বীপ শাক্তরাসের ৩০০-৪০০ বছরের প্রাচীন প্রতিমাগুলিতে এই শৈলীর চালচিত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব রাসের সাথে সাথে যখন শাক্ত রাসের প্রচলন হয় তখন সুবিশাল দেবীচালা বা চালচিত্রের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও বর্তমানে অনেক ঠাকুরেই চালচিত্রের ঐতিহ্য ফিরেছে। নবদ্বীপের চালচিত্র শিল্পী তপন ভট্টাচার্য বলেছেন- “প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি চিত্রকলা ফের ফিরে আসছে দেখে ভাল লাগছে।”
এছাড়া আরেক ধরনের রীতির দূর্গা প্রতিমা রয়েছে, তাহা বিষ্ণুপুরী রীতি। এই রীতি অনুযায়ী দেবী দূর্গার ডানদিকের উপরে গনেশ, নীচে লক্ষ্মী আর বাদিকের উপরে কার্তিক আর নীচে সরস্বতী বিরাজ করছে। এই রীতির প্রবক্তা বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা জগৎমল্ল। বর্তমানে গোটা বাংলায় এই দুই ধ্রুপদী রীতির প্রতিমা শিল্পের প্রচলন রয়েছে। রাজা জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই বিষ্ণুপুরী রীতি অনুযায়ী মৃন্ময়ী মাতার প্রতিমা ও মন্দির নির্মাণ করেন। আবার রাঢ় বাংলার বহুস্থানে দূর্গামূর্তির বদলে শুধুমাত্র মা দূর্গার মুখ রেখে পুজিত হয়ে আসছে।
“চালচিত্র” শব্দের ‘চাল’ শব্দের অর্থ ‘আচ্ছাদন’। প্রতিমার এই আচ্ছাদনের উপর চিত্র আঁকা হয় বলে, একে চালচিত্র বলা হয়। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র কে “পটলেখ” বলা হয়। স্থানীয় অনুসারে একে দেবীচাল বা দূর্গাচালাও বলা হয়। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গায় চালচিত্রের ব্যবহারে অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে কলকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের বৈষ্ণবদাস মল্লিক ও হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরের বসু পরিবারে পট লেখার ঐতিহ্য এখনও বজায় রেখেছে। উত্তর কলকাতার চোরাবাগানের রামচাঁদ শীল পরিবারের বিমানবিহারী শীল চালচিত্র প্রসঙ্গে বলেছেন- “আগে চালিতে পট লেখা হলেও ভাল চালচিত্র শিল্পী সংখ্যায় কমে যাওয়ায় এখন দেবীর চালচিত্রে ব্যবহার করা হয় হাতে আঁকা চালচিত্র ”। এছাড়া কৃষ্ণনগরের চালচিত্র শিল্পী বিশ্বনাথ পাল কলকাতার বিভিন্ন বনেদি পরিবারে পট লেখেন। তিনি বলেছেন- “বনেদি পরিবার আজও হাতে আঁকা পট পছন্দ করে। পুজোর আগে এখনও খিদিরপুর ও উত্তর কলকাতার বেশ কিছু বাড়িতে পট লিখতে যেতে হয়।”
বাংলায় বিভিন্নতার উপর চালচিত্র কে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। তেমন; বাংলা চালি, খোপচালি, টানাচৌড়ি চালি, মঠচৌড়ি চালি ও মার্কিনচালি। চালচিত্রের মধ্যে শিবদূর্গা, নন্দী-ফিরিঙ্গী, কৈলাসী, দশাবতারী, বৃন্দাবনী, রামচন্দ্রী কৃষ্ণলীলা, শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ, মহিষাসুরের যুদ্ধ, অষ্টনায়িকা, সপ্তমাতৃকা, দশমহাবিদ্যা, বৃন্দাবন, লঙ্কা, ইন্দ্রালয়, নরনারীকুঞ্জর, বস্ত্রহরণ ইত্যাদি প্রকৃত সৌন্দর্যরূপ দেখা যায়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সাধারনত বনেদি বাড়িগুলোয় কৈলাসী ও দশাবতারী চালচিত্রর অধিক প্রচলন দেখা যায়।
এছাড়া বীরভূম জেলার হাটসেরান্দি র সূত্রধর সমাজে চালচিত্র র বদলে বিশেষ ধরনের পটচিত্র দেখা যায়। এখানে দূর্গা প্রতিমা পুজো করা হয়না, তার বদলে পটচিত্রে দূর্গা প্রতিমা এঁকে পুজিত হয়ে আসছে। এই পুজার্চনায় দূর্গা পটের উপরে রাম, সীতা, শিব, নন্দী-ফিরিঙ্গী, ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু অঙ্কিত থাকে।
বিভিন্ন প্রকারের রে চালচিত্রর উদাহরণ উল্লেখ করেছি, তারই কিছু বর্ণনা উদ্ধৃত করলাম। এই প্রসঙ্গে গবেষক রাজা ঢাকির তথ্য উদ্ধৃত করলাম। রে চালচিত্রে দুটা থামের উপর অর্ধচন্দ্রাকৃতি চাল যুক্ত থাকে তাকে মার্কিনি চাল বলা হয়। এই চালচিত্র বাগবাজার সর্বজনীন ক্লাবের দূর্গা প্রতিমায় দেখা যায়। আর বাংলাচালি চালচিত্রে দুটি দাম থাকে না। বাংলাচালি গোলাকৃতি হয়ে থাকে। বাংলাচালি পুরো কাঠামো ছাড়িয়ে প্রায় নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এমন চালচিত্র শোভাবাজার রাজবাড়ির দূর্গা প্রতিমার চালচিত্রে দেখা যায়। এছাড়া বর্তমানে এরূপ বাংলাচালি প্রায় দেখা যায় না বললেই চলে। সারা বাংলায় মার্কিনিচালি চালচিত্র সর্বজনীন গৃহিত।
এছাড়া মঠচৌড়ি চালি চালচিত্রের মাথায় প্রায় অর্ধচন্দ্রাকার দেখা যায়। এই চালে তিনটি শিখর থাকে। এই চালি অনেকটাই থাপত্য ঘেঁষা। এই শিখর বিশিষ্ট চালচিত্র দ্রাবিড় জাতির স্থাপত্যের অনুরূপ। এই তিনটি শিখর শাস্ত্র মতে সত্য-রজ-তম খুনের প্রতীক। শ্রী শ্রী চন্ডিতে দেবীকে " ত্রিগুণাতিকা " বলা হয়েছে। এই শৈলীর চালচিত্র কলকাতার হাটখোলা দত্তবাড়িতে দেখা যায়। রে সকল দূর্গাপ্রতিমায় এই চালি ব্যাবহার করা হয়, সেইসব প্রতিমা প্রাচীন বাংলা রীতিতে নির্মিত। দেবীর মুখ "বাংলামুখ" আদরের। প্রতিমার পরনে মাটির শাড়ি থাকে। পটুয়ার তুলিতে এই শাড়িতে শ্রীশ্রী চন্ডীকাহিনী অঙ্কন করা হয়।
আর টানাচৌরি চালচিত্র রে তিনটি শিখর একটানা একটা সরলরেখায় যুক্ত থাকে। এই চালিত অপর নাম “চৌধুরী চালি” এই চালচিত্র বাংলার চৌধুরী পদবীধারী বনেদী পরিবার গুলোয় একমাত্র এই শেলী দেখা যায়। উদাহরন স্বরূপ কলকাতার বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের আটটি পরিবারে এরূপ চালচিত্র দেখা যায়। এছাড়া হাওয়ার আন্দুল রাজবাড়ির চৌধুরী পরিবারের দূর্গা প্রতিমার চালচিত্রেও এমন শৈলীর চালচিত্র দেখা যায়।
এইসব শৈলীর চালচিত্র ছাড়াও আরোও দুই ধরনের চালচিত্র দেখা যায়। তেমন; গির্জা শৈলী আর সর্বসুন্দরী শৈলী। গির্জা চাল হল, ঠাকুরের পিছনে তেমন চাল থাকে আর তেমনি সামনেও একটা চাল থাকে। এই চালদুটির খোপের ভিতরে মা বিরাজ করেন। আরেক ধরনের চালচিত্রের কাঠামোর চারকোণে তিনটি করে মোট বারোটি দাম থাকে। এই থামগুলির মাথায় ছাদ আকৃতির চাল থাকে। তবে এই রীতির চাল সম্পূর্নভাবে বিলুপ্ত।
এবার চালচিত্র কিভাবে নির্মান হয়, তা আলোচনা করবো। প্রতিমার চালির উপরিভাগে অর্ধগোলাকৃতি বাঁশের খাঁচা করে তার উপর কাদালেপা এক প্রস্থ মোটা কাপড় টানটান করে লাগিয়ে কাপড়ের বারতি অংশ বাঁশের খাঁচার পিছন দিকে মুড়ে দেওয়া হয়। কাদালেপা কাপড়টি শুকিয়ে গেলে তার উপর খড়ি গোলার কয়েকটি আস্তরণ দেওয়া হয়। এর উপর পরিকল্পিত কাহিনিমূলক চিত্র আঁকা হয়।
এই চালচিত্রে রঙ করার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহৃত হয়, যা বাংলার পটচিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চালচিত্রে সাধারণত নীল, হলুদ, সবুজ, লাল, খয়েরি, কালো ও সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে চালচিত্রের অঙ্কনরীতি বাংলার পটচিত্রের অনুকরণ করেছে। চালচিত্রে সাদা রঙের জন্য খড়িমাটি, হলুদ রঙের জন্য পিউরি, নীলের জন্য খেতের নীল, কালো রঙের জন্য ভুষোকালি ও লাল রঙের জন্য মেটে সিন্দুর ব্যবহার করা হয়।
অন্যান্য হস্তশিল্পের মতো দিনে দিনে কমে আসছে চালচিত্র-শিল্পীও। আর যাঁরা টিকে রয়েছেন তাঁরা কোনোরকমে পেটের দায়ে ধরে রেখেছেন তার এই প্রাচীন শিল্পকে। পটশিল্পীদের মতে, সময়ের সঙ্গে সে ভাবে বাড়েনি পটের দাম। আর ক্রেতারাও চালচিত্রের জন্য বেশি খরচ করতে নারাজ। কৃষ্ণনগরের ঘুর্ণি এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে দেখা যায় এই পেশার কিছু শিল্পীকে। পুজোর আগে তাঁদের ব্যস্ততা এখন তুঙ্গে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাঁরা বায়নার কাজ শেষ করতে ব্যস্ত। এখনও এখান থেকেই চালচিত্রের পট যায় কলকাতায়, গোটা রাজ্যে, এমনকী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়। শিল্পীদের ভাষায়, এই পট আঁকা আসলে ‘পট লেখা’। পট লেখার এই কাজ চলে সারা বছর ধরেই। তবু অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন শিল্পীরা। সে কারণেই পট লিখতে লিখতে প্রবীণ চালচিত্রশিল্পী মতে, “একটা পট লিখে নাম মাত্র দাম মেলে। তার জন্য বেশি সময় দেওয়া যায় না। ভাল কাজ করলে ক্রেতারা তার দাম দিতে চান না। আর এই কারণেই জৌলুস হারিয়েছে চালচিত্র। এখনও বছরে প্রায় দু’হাজারের মতো পট লিখতে হয়। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এবং মফসসলে এর চাহিদা আছে।”
তবে বাংলার সাবেক চালচিত্র কেমন দেখতে ছিল তা দেখতে হলে আজ ভরসা দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রহালয়। ভারতীয় সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামলকান্তি চক্রবর্তীর কথায়: “চালচিত্র হত নানা রকম। যেমন মঠচৌড়ি চালির চালচিত্রে দেব দেবীর অবয়বগুলি থাকে উপর থেকে নীচে, একটির নীচে আর একটি। আবার সাবেক বাংলা চালে সেগুলি থাক থাক করে আলাদা আলাদা প্যানেলে থাকে। অন্য দিকে, মার্কিনি চালের পটে সেগুলি থাকে পাশাপাশি। গুরুসদয় সংগ্রহালয়ে এবং হাওড়া কেন্দ্রীয় সংগ্ৰহশালায় রাখা দুর্গার চালচিত্র দেখে একটা ধারণা তৈরি হতে পারে, কতটা সূক্ষ্ম কাজ করতেন তখনকার শিল্পীরা।
❑ তথ্যসূত্র :
(১) পশ্চিমবঙ্গের লোকশিল্প ও লোকসমাজ; তারাপদ সাঁতরা
(২) "অবক্ষয় আর অবলুপ্তির মাঝে বাংলার চালচিত্র"; বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা
(৩) "পটচিত্রের চাহিদা বাড়ছে নবদ্বীপের রাসে"; দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
(৪) চালচিত্রের চিত্রলেখা; সুধীর চক্রবর্তী
© ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত