![]() |
ঋত্বিক ত্রিপাঠি, সম্পাদক, 'জ্বলদর্চি' |
পকেট থেকে পত্রিকা করা ভালো কথা কিন্তু আয়ু কমে আসে। পত্রিকার বন্ধু সমন্বয়, যৌথ চিন্তাভাবনা না থাকলে সম্পাদকের সাথে পত্রিকার মৃত্যু ঘটে বা অনিয়মিত হয়ে পড়ে।
(১) লেখক-সম্পাদকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক লেখা নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলে?
জ্বলদর্চি: ভালো লেখা ছাপতেই হয়, তা সে পরিচিত হোক বা না হোক। আমি শুধু পত্রিকা করতে ছেয়েছিলাম। অনেকের পরামর্শে ভালো লেখকদের লেখা পাওয়ার জন্য আমার লেখা শুরু। আমি লেখক নই। তরুণের অনেক বানানে ভুল লেখা শুধরে ছেপেছি- এদিক থেকে আমি উদার। কিন্তু অনেক প্রবীণ প্রতিষ্ঠিত লেখকের বাম হাতের লেখা এখনও ফাইল বন্দি হয়ে পড়ে আছে- এদিক থেকে আমি নির্মম। এমন একজন লেখকের লেখা আমি ছাপিনি পরবর্তীতে যিনি সাহিত্য একাডেমী পেয়েছেন।
(২) লেখা নির্বাচনের সময় বানান ভুল না ব্যাকরণ কোনটি বেশি বিরক্ত করে?
জ্বলদর্চি: দুটোই বিরক্তিকর। পনের লাইনের লেখার মধ্যে চারটে বানান ভুল, কুরিয়ার খরচ, কাগজ খরচ, নিজের এবং সম্পাদকের দুজনেরই সময় নষ্ট। লেখার প্রতি যত্ন না নিয়ে প্রকাশের প্রতি মনোযোগ সাহিত্য ও পত্রিকা দুটোর ক্ষেত্রে ক্ষতিকর। অনেকেই জানেন না পূর্ণচ্ছেদের আগে না পরে স্পেস দিতে হয়। 'কি' 'কী' কোথায় বসে জেনে নিয়ে লেখাটাই ভালো। প্রথম প্রথম হয়তো জানবেন না, যত তাড়াতাড়ি শেখা যায় সাহিত্য ও সম্পাদক দুজনের জন্যই ভালো।
(৩) কেউ কেউ অভিযোগ করেন, যে পত্রিকায় যত বেশি সংখ্যক লেখকের লেখা ছাপানো যায় সেই পত্রিকার প্রচার ও আর্থিক স্বচ্ছলতা তত বেশি। আপনি একজন সম্পাদক হিসেবে কি বলবেন?
জ্বলদর্চি: এগুলো ফাঁকা ফাঁকা কথা। এগুলো যারা বলেন তারা পত্রিকার ব্যাকরণ জানেন না। প্রচুর লেখা ছাপলে খরচ বেশি পাতা বাড়ছে, খরচ বাড়ছে। আর্থিক লাভ কোথায়? কুড়ি পাতার চেয়ে দুশো পাতার পত্রিকার খরচ নিশ্চয় বেশি। বিচার করতে হবে যে আর্থিক লাভ করতে গিয়ে খারাপ লেখা ছাপছে কিনা। ত্রিশ পত্রিকার পাতায় যদি বারোটা লেখা খারাপ হয়, অন্যদিকে দুশো পাতার পত্রিকার নব্বই ভাগ লেখা ভালো হয় আমি তাকে বলব স্বাগত।
(৪) আজকাল পত্র পত্রিকায় লেখা আহ্বানের সময় স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয় ধর্মীয় বা রাজনৈতিক লেখা পাঠাবেন না। সাহিত্যের এই দুটি ধারার সঙ্গে দূরত্বের কারণ কি?
জ্বলদর্চি: লেখকের ধর্ম নেই। লেখক স্বত্বার চেয়ে ব্যক্তিগত গোঁড়ামি স্বত্বা বড় হতে পারে না। লেখক হিন্দু মুসলিম হতে পারেন না। লেখক নিরপেক্ষ।
রাজনীতি না থাকলে সমাজ সচেতন হওয়া যায় না। লেখক বামপন্থী বা ডানপন্থী হতেই পারেন তবে স্বচ্ছ নিরপেক্ষ হবেন। খারাপটা খারাপ, সে ডান বা বাম দলের হোক। এরকম বলেন এটা হয়তো সম্পাদকের অসহায়তা।
(৫) পত্র পত্রিকার ক্ষেত্রে সৌজন্য সংখ্যা কি একটি ঐচ্ছিক বিষয়?
জ্বলদর্চি: না। ঐচ্ছিক বিষয় হতে পারে না। সম্পাদক লেখকের লেখা ছেপেছেন তিনি দায়বদ্ধ লেখকের কাছে একটি সৌজন্য সংখ্যা পাঠাবেন। এর বিকল্প কোন ব্যখ্যা নেই। আর্থিক সংকট থাকবেই জেনেই তো তুমি নেমেছো। বারো পাতার জায়গায় দশ পাতার পত্রিকা করে দেড়শ টাকা বাঁচিয়ে সেই টাকায় লেখককে সৌজন্য সংখ্যা পাঠাবেন।
(৬) গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ইত্যাদির অনুপাতে কবির সংখ্যা বেশি কেন?
জ্বলদর্চি: জটিল প্রশ্ন। এক জায়গায় অনেক লেখককে জড়ো করা যায়। কবিতা লেখার সুযোগ হয়তো বেশি। পৃথিবীর অধিকাংশ লেখক কম বয়সে কবিতাই লিখেছেন, পরে অন্য শাখায় গেছেন। সাহিত্যে প্রথম কবিতার জন্ম, পরে গদ্য এসেছে।
(৭) ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সাহিত্য চর্চার ভবিষ্যৎ কি ‘আত্মতুষ্টি’?
জ্বলদর্চি: না না। এটাই তো ভালো প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুকে নিজের ছবি, বাড়ির রেলিঙের ছবি দেওয়ার চেয়ে কিছু লেখা নিঃসন্দেহে ভালো। নিজের, সাহিত্যের, সমাজের ভালো দিক। লেখা না ছাপার আক্ষেপ থাকে না। শ্রীজাত কিছুদিন অন্তর নিজের লেখা কবিতা ফেসবুকে দেন। প্রকাশক, সম্পাদকের দুশো টাকার চেকের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন না। লেখার দম থাকলে ফেসবুক বিনিপয়সার ভালো প্ল্যাটফর্ম।
(৮) বইয়ের বিকল্প নেই মেনে নিলাম। আচ্ছা লকডাউন উঠে গেলে ইবুক বা ওয়েব ম্যাগাজিনের গুরুত্ব কি আর থাকবে না?
জ্বলদর্চি: এই স্পর্শযোগ্য রোগ, ইবুকই থাকবে। এটাই ভবিষ্যৎ। মুদ্রণ ব্যবস্থা আমার মনে হয় ল্যান্ডফোনের মতো ফুরিয়ে যাবে। সময়ের সঙ্গে মানুষ নিজেকে বদলে নিয়েছে। গোরুর গাড়ি কেন তুলে দেওয়া হল এই নিয়ে আন্দোলন করা অন্যায়। আগামী দিনে উঠে আসবে মহাকাশ, গুগল, ই-বুক। গোঁয়ার্তুমি করে এটাকে না মেনে নেওয়া আগের রীতি বা এখনকার রীতি কে মান্যতা দেওয়া হয় না। মধ্যপন্থা স্বেচ্ছা মৃত্যু। নতুনকে মেনে নিতেই হবে। বিকল্প নেই।
(৯) অশ্লীল শব্দ, প্রতিষ্ঠান বিরোধী, বাজারি লেখক এবং বাজারি পত্রিকা- আপনার অভিধানে এই চারটি শব্দের অর্থ।
জ্বলদর্চি: কোনো শব্দই অশ্লীল হয় না। শব্দ প্রয়োগগত ও পরিস্থিতি নির্ভর। এটি একটি পুরনো ধ্যানধারণা। প্রাসঙ্গিক নয় চটক দেওয়ার জন্য প্রয়োগ করলে শব্দ অশ্লীল হয়।
আমরা সবাই এক একটা প্রতিষ্ঠান। সবাই সবার মতো করে লড়াই করছে।
অধ্যাপক বা সমালোচকরা সুবিধার জন্য এই সব শব্দ ব্যবহার করেন। লেখক বাজারি হতে পারেন না, লেখা বাজারি হতে পারে।
(১০) ট্যাঁকের কড়ি খরচ করলেই আজকাল সঙ্কলন, বই বা পত্রিকার পাতায় নিজের লেখা ছাপানো যায়। সাহিত্যের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না মন্দ, আপনি কি মনে করেন?
জ্বলদর্চি: শিক্ষা এবং শিল্প সমাজে অবহেলিত। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে বই পড়ে না। বাজারের ব্যাগে 'সঞ্চয়িতা' থাকে না। খিদে পেলে কেউ কবিতা পড়ে না। এখন প্রচুর বই বেরোচ্ছে- এটা একটা অসুখ। একশটা কবিতা লিখে প্রকাশ করা উচিত নয়, পাঠক আহত হন। ভিড়ে সত্যিকারের লেখক এবং লেখা হারিয়ে যাচ্ছে।
(১১) সাহিত্য বলতে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, রম্যরচনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সাহিত্যের এই শ্রেণিবিন্যাস কতটা তাৎপর্যপূর্ণ?
জ্বলদর্চি: শ্রেণিবিন্যাস করতেই হবে। লিটিল ম্যাগাজিন আজকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। মুক্তগদ্য, পাঠ প্রতিক্রিয়া, রম্যরচনা, গদ্য কবিতা, অণুগল্প ইত্যাদি আসছে। আরও বেশি করে আসা উচিত। অনন্তকাল মানুষ গল্প কবিতা পড়বে এটা হতে পারে না, পাঠক বিরক্ত হবেন।
(১২) সাহিত্যের বাণিজ্যিকরণ বলতে আপনি কি বোঝেন?
জ্বলদর্চি: বাণিজ্যিকতা খারাপ নয়। না হলে সাহিত্য অনন্তকাল ধরে চলবে কি করে? তাহলে তো আমাদের শিল্পের দরকার নেই, পড়াশোনা, চাকরি বাকরির দরকার নেই- সব বাণিজ্য। ক্রেতা-বিক্রেতা না থাকলে জগৎটাই নষ্ট হবে। সাহিত্য ফুলগাছ লাগানোর মতো নয়, ইচ্ছে হল লাগালাম তা নয়। বই করলাম, কেউ কিনলে কিনবে। আমাদের সময় ‘দফা তিনশ দুই’ নামে যৌনতার একটা পত্রিকা ছিল, এখন আর নেই। পাঠক কিন্তু বোঝে। পাঁজির চেয়ে ‘বর্ণপরিচয়’ বেশি বিক্রি হয়, সমানে বিক্রি হয়।
(১৩) সাহিত্যে ব্যক্তিগত গুণের কদর কম, সব জানাশোনা- এটা কি সত্যি?
জ্বলদর্চি: পরিচিত বৃত্ত কিছুটা তো কাজ করবেই। আমার বাড়ির বিয়ে বাড়িতে আমি একদম অপরিচিত গুণী মানুষকে নাও তো ডাকতে পারি, তবে এটা শেষ কথা নয়। সম্পাদক যদি তার বৃত্তের লেখা ছাপে- পত্রিকার মান কমে, আয়ু কমে আসে।
(১৪) সাহিত্যে পুরস্কার কি সন্দেহজনক?
জ্বলদর্চি: সব পুরস্কারই সন্দেহজনক। আমাদের দেশে জাতীয় শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়- এটা লজ্জার কথা। শিক্ষক মার খেলে সংবাদপত্রের চারের পাতায় বেরোয়। কিন্তু একজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা মাথা ফাটালে প্রথম পাতায় ছাপে। যোগ্য মানুষরা অনেক সময় আবেদন করেন না, করবেন না। যোগ্য মানুষ যোগ্য জায়গায় যোগ্য সম্মানটুকু পান না।
(১৫) শিক্ষাক্ষেত্রে মাতৃভাষা ঐচ্ছিক হলে সাহিত্যচর্চায় কিরকম প্রভাব পড়তে পারে?
জ্বলদর্চি: মাতৃভাষা যদি দ্বিতীয় ভাষা হয় সাহিত্য থাকবে না, দরকারও নেই। এখন মানুষের tendency প্রথম ভাষা হোক। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে যাবে এবং সে সাহিত্যরস পাবে সম্ভব নয়। সেটা নকল সাহিত্য।
(১৬) যুব সম্প্রদায়ের অনেকেই আজকাল নিয়মিত পত্র পত্রিকা সম্পাদনা করছেন, কেউ আবার পাবলিকেশন হাউস চালাচ্ছেন। সংখ্যাটা আপনাদের সময়ের থেকে কম না বেশি?
জ্বলদর্চি: প্রচুর বেশি। আমাদের সময় অবিভক্ত মেদিনীপুরে ছয় থেকে সাতটি পত্রিকা ছিল। এখন সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি মৃত্যুর হারও বেড়েছে। এই জগতের আলো দেখে অনেকেই আবেগে আসছে কিন্তু অন্ধকার দিক যে আছে সে জানত না। মোহভঙ্গ হলেই সে পালাচ্ছে।
(১৭) জীবিকা হিসেবে সাহিত্যচর্চা কতটা সম্ভাবনাময়?
জ্বলদর্চি: প্রচণ্ড রিস্ক আছে। এই বাজারে লিখে, বই বিক্রি করে সংসার চালানো, এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া খুব কঠিন। আলু, পটল কিনতেই হবে। এই সময়ের প্রায় প্রত্যেক লেখক কোন না কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত। জয় গোস্বামী কে আনন্দবাজার বা প্রতিদিনের সাংবাদিকতা করতে হচ্ছে। সমাজ যদি সেরকম পরিস্থিতি তৈরি করে দিত, পড়াশোনার কালচার থাকত, পাঠক থাকত তবে লেখাটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যেত। ব্যতিক্রম নেই বলছি না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ মজুমদাররা পেরেছেন সেটা তাঁদের কলমের দক্ষতা। এখন সে সম্ভবনা নেই বললেই চলে।
আপনার এই অন্তরঙ্গ আন্তরিক যাপনে ‘এবং খোঁজ’ সমৃদ্ধ হল অনেক। আশাকরি ভবিষ্যতে আবার আপনাকে পাব এমনি এক নিবিড় আলাপচারিতায়। ‘জ্বলদর্চি’ পাঠকের হৃদয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাক। ঈশ্বরের কাছে আপনার নীরোগ দীর্ঘায়ু কামনা করি, ধন্যবাদ।