বই পর্যালোচনা 

‘বড়দের আরও’

লেখক: ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় 

প্রকাশক: পত্রভারতী 

মূল্য: ১৪৯/- 

আলোচক: দীপাঞ্জন দাস 


র্বমোট দশটি গল্প নিয়ে এই বইটি লেখা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় মহাকাব্যে বর্ণিত বিভিন্ন চরিত্র ও কাহিনিগুলিকে লেখক সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার প্রচেষ্টা করেছেন এবং তার সাথেই জায়গা দিয়েছেন কিছু ভিন্ন স্বাদের গল্পকে। 

প্রথম গল্প "সেদিন যা ঘটেছিল"। মহাভারতে ভীমের সাথে হিড়িম্বার প্রনয়ের কাহিনি আমরা অনেকেই জানি। লেখক সেই কাহিনিটিকেই অন্য আঙ্গিকে প্রকাশ করেছেন। তাই যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়েই বলিয়েছেন- 

"প্রেম আর যুদ্ধে সবই সঙ্গত পিতামহ। বিধাতার বিধিলিপি কি কোনদিন পরিবর্তন করা যায় পিতামহ?"

স্বয়ং দেবদ্বৈপায়ন ব্যাস ঘটনা ও কাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বে পড়েছেন। আর্য ও অনার্যদের দ্বন্দ্বে নিজের লেখনির পরিবর্তন করতে চাইলে কুন্তী পরামর্শ দিয়েছেন- 

"এ ভুল করতে যাবেন না তাতশ্রী। সে করলে আর কূল পাবেন না। তখন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহাভারত আপনাকে নতুন করে লিখতে হবে।"

দ্বিতীয় গল্প "ফেরত চাই, ফেরত দাও"। আড়তের বর্তমান মালিক কৃপানাথের দিবানিদ্রা ভঙ্গ করেছে এক যুবক আর তা থেকেই কাহিনির সূত্রপাত। সরলাবালার ভাইপো হয়ে এসে সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়েছে কৃপানাথ, যার প্রতিদিনের গন্তব্য সাধু দ্বৈপায়নের কুটির। সেই আধুনিক জীবনে কিভাবে এসে পড়লেন অশ্বথামা। মনির খোঁজ তাকে আবারও উদ্যত করল যুদ্ধে, তার এক কাল্পনিক ছবি এঁকেছেন লেখক। এসেছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা যা বহুকাল আগে শেষ হলেও রেশ রয়ে গিয়েছে আজও। 

তৃতীয় গল্প "এ আমার কর্মফল"। মহারাজা শল্যের ভগিনী কুন্তী এখানে রাজরানী থেকে হয়েছেন অসহায় এক মহিলা। সমাজের হাজারো সমস্যার মধ্যে যে বড় করে তুলেছে তার ও মহারাজ পান্ডুর পুত্রদের। পাঞ্চালীকে জয় করার বাসনায় শল্যের মুখোমুখি হতে হয় তার ভাগ্নেদের। মহাভারতের কাহিনির ভাবনাকে এভাবেই নিজের লেখনীর সুতোয় অন্যভাবে বাঁধতে চেয়েছেন লেখক। 

চতুর্থ গল্প "গোপন ব্যথা"। এই গল্পটি একটু ভিন্ন আঙ্গিকের। ভালোবাসার সম্পর্ক সর্বদা নিয়মমাফিক চলে না। সমাজের নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে চাই স্পর্ধা, যা প্রতিদান রূপে বিসর্জন দিতেও পিছপা হন না প্রকৃত প্রেমিক। সেই দৃশ্যকে দৃশ্যায়িত করার চেষ্টা করেছেন লেখক। 

পঞ্চম গল্পে সম্পর্কের বিন্দুমাত্র টানাপোড়েন নয়, স্থান পেয়েছে কঠোর বাস্তব। যৌবনের উদ্দীপনা ভবিষ্যতকে ঠেলে দিয়েছে নির্মম কুঠুরিতে। মহাভারতের কাহিনির পুনরাবৃত্তি হয়েছে, এ এক বিচিত্রবীর্যের কাহিনি। সত্যই "সব যে হয়ে গেল কালো।"

ষষ্ঠ গল্প "অভিনয়"। অভিনয়জগতে চাকচিক্যের পেছনে থাকে অনেকখানি অন্ধকার, অনেকের অসহায়তা, অনেকের হাহাকার। লেখক এই গল্পে সেই কদর্য দিকটি তুলে ধরার প্ৰচেষ্টা করেছেন। কোলাহল স্তব্ধ করে, উৎসবকে ছিন্নভিন্ন করে তাই এখানে গল্পের নায়িকা বেরিয়ে আসার সাহস দেখায়- 

"ব্যাঙ্কয়েট হলে পটপট করে সবকটা আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু একটাও শব্দ নেই।"

সপ্তম গল্প "কমলেশ উত্তর জানে না"। প্রেমের মত সম্পর্কের মধ্যেও অনেক সময়ে কোনো কারণ ছাড়াই আসে দূরত্ব। নতুন কিছুর হাতছানি, নতুন আবেদন জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে। সোনালি, কমলেশকে অকারণে ত্যাগ করেও মুখোমুখি হয় অদ্ভুতভাবে এবং সম্পুর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে। কিন্তু, সুযোগ কি বারবার দেওয়া যায়? উত্তর খুঁজেছে কমলেশ। 

অষ্টম গল্প "গভভের মেয়ে"। এটিও এক অন্ধকার এর কাহিনি। দেহ ব্যবসায়ী মহিলাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া বাচ্চাদের এক টুকরো জীবনকে তুলে ধরেছেন লেখক। তার সাথে মিশেছেন আসা। বাস্তবেও যদি এভাবে পালিয়ে বাঁচা যেত... 

নবম গল্প "ফেসবুক-কেস!" গল্পের শুরু জেঠিমনিকে ফেসবুকে আন্টি বলা নিয়ে ঝগড়া দিয়ে। উঠে এসেছেন অধুনা ফেসবুকের বাহ্যিক চাকচিক্যের মিথ্যে জীবনের কথা। ফেক প্রোফাইলের আড়ালে যা যা রহস্য থাকতে পারে, তার একটি মজার উদাহরণ দিয়েছেন লেখক। আসলে মাধুর্য কখনো অধরা থাকাও ভালো। 

দশম তথা অন্তিম গল্প "মায়াশহরের সেই রাত"। এখানে লেখক নিজের ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। লাস ভেগাসে আয়োজিত আমেরিকা সম্মেলনের টুকরো ছবিতে ধরা পড়েছে এক টুকরো প্রবাস। অবধারিত ভাবেই এখানেও জায়গা পেয়েছে সংগঠন রাজনীতির কথা। তবে দৃষ্টি থেকে দৃষ্টিভ্রম যে লক্ষণ রেখা টেনে দিতে পারে-লেখক তা বুঝিয়েছেন গল্পের শেষে। এই গল্পের মূল বিষয় হয়তো সেটিই। 

ভিন্ন স্বাদের সমাহার এই "বড়দের আরও" বইটি পাঠকদের পছন্দ হবে বলেই আমার মনে হয়েছে।