উপন্যাস 

অন্ধকারের মুখোমুখি

প্র তা প  বো স


ইইই্...আস্তে আস্তে। সামলে সামলে”। রিসেপশনে ঢুকতে গিয়ে এই ভাবে হোঁচট খেয়ে আমি যতটা না অপ্রস্তুত হলাম তার চেয়ে ঢের বেশি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম রিসেপশনের চার দেওয়াল জুড়ে তৈরী করা মুর্যালটার দিকে। এক তীরন্দাজ চোখবন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে তীর ছুড়ে ছেদ্রুতধাবমান একটা পূর্ণবয়স্ক হরিণের দিকে। চারিদিকে সবুজ জঙ্গল। উপরে নীলাকাশ। পুরো জঙ্গলটা যেন জীবন্ত হয়ে আমাদের চারিদিকে। হরিণটা প্রাণ পনে ছুটছে জঙ্গল থেকে জঙ্গলে, দেওয়াল থেকে দেওয়ালে। তীরটাও গতি বাড়াচ্ছে ক্রমশ। হরিণ আর তীরের দূরত্ব কমছে ক্রমশ দেওয়াল থেকে দেওয়ালে। সবুজঘাস গুলোর ক্রম বিন্যাসে তুলির দ্রুত চালনা বুঝিয়ে দিচ্ছে একটা অসম যুদ্ধের টানটান উত্তেজনা, উৎকন্ঠা ঘাসগুলোকেও স্পর্শ করে গেছে। কিন্তু ঝাঁকা নিলা গলো চতুর্থ মানে ঘরের শেষ দেওয়ালটাই গিয়ে। হরিণ ভূপাতিত। তীর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে তার নরম শরীর। চারিদিকে জঙ্গল আকাশের গায়ে হাহাকারের তীব্রমূর্ছনা। সবুজ ঘাসগুলো শুয়ে আছে হরিণের পাশে। সন্তান হারামা এর মতো। কিন্তু তাতে তীরের উল্লাস কিছু মাত্র কমেনি। সে সমান বেগে ধাবমান।  চার দেওয়াল ছেড়ে সে কোথায় যাচ্ছে? এই দেওয়ালে তীরন্দাজ মাথা ঝুঁকিয়ে বাঁ হাত দিয়ে তার ডান হাত চেপে ধরে আছে। সারা শরীরে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। চোখ খোলা। চোখে মুখে একটা অবিশ্বাসের কাতরতা।

শান্তিনিকেতনে এসে এই বন বিতান রিসর্টের রিসেপশনে পারে খেই এমন ঘোরের মধ্যে পড়ে যাবো এটা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। ঘোর ভাঙল ঘন্টাদার ফিসফিসানিতে। আমার মতো ঘন্টাদাও অবাক হয়ে দেখছিল মুর্যালটা। 

“শেষ দেওয়ালটাই তীরটাকে খেয়াল কর।“ ফিসফিস করে বলল ঘন্টাদা।

ভালো করে দেখলাম। তাই তো তীরের ডগায় হরিণের লাল রক্ত লেগে থাকলে কি হবে তার গোড়ায় আগুনে রঙ বেশ স্পষ্ট। মানে তীরের বিরাম হীনতায় শুধু নয় রঙের পার্থক্যও একটা কিছু সংকেত দিচ্ছে। 

কি মনে হচ্ছে তোমার। জিজ্ঞেস করলাম ঘন্টাদাকে।


“অতৃপ্তি। আরও কিছু চায়” ঘন্টাদা ভাবলেশহীন মুখে সিগারেট ধরাল। তারপর সিগারেটের এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল “এই মুরালে কিন্তু আরও একটা রহস্য জনক চরিত্র রয়েছে”। 

আমি অনেক খুঁজেও যখন পেলাম না তখন এটাই পাজল গেম হয়ে গেল আমার আর ঘন্টাদার ছেলেমেয়েদের কাছে। ফাইন্ড দ্য অবজেক্ট খেলতে ওরা বেশ ভালোই বাসে।

ফাইন্ড দ্য অবজেক্ট খেলতে খেলতেই এক রবিবারের অলস বিকেলে ছেলেরা বায়না ধরেছিল এবারের গরমের ছুটিতে কাছে পিঠে কোথাও যাওয়ার জন্য। সেই বায়নার হাওয়াকে ঝড়ে পরিণত করতে কালক্ষেপ করেনি আমার সহধর্মিনি। কয়েক দিনের ছুটিতে শান্তিনিকেতন যাওয়ার সিলেকশনটা ওরই। শোনা মাত্রই আমি রাজি। কারণ এই জায়গাটার আকর্ষণ অনেক দিনের। কিন্তু কিছুতেই যাওয়া হয়ে উঠছিল না। গোল বাঁধাল ছেলেরা। তাদের কথায় It’s too cool। শেষমেশ ঘন্টাদাও তার ফ্যামিলি নিয়ে আমাদের সাথে যাবে শুনে আমার ছেলেরাও রাজি। একটুও সময় নষ্ট না করে অনলাইনে চটপট বুক করলাম বন বিতান রিসর্টের ছবির মতো কুটিরগুলো। বলা তো যায়না। আজকের জেনারেশন। হয়তো বলেই বসল – দাড়ি বুড়ো ইজ টু ওল্ড ফর আস।

কিন্তু দাড়ি বুড়োর ম্যাজিক যে কাল জয়ী সেটা বুঝলাম খোয়ায় যাওয়ার পথে এই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে। সবুজ জঙ্গলের বুক চিরেলাল মাটির রাস্তা যত ভিতরে ঢুকছে তত প্রকৃতি অকৃপণ হতে শুরু করেছে। আর তার সাথে বাড়ছে প্রকৃতির চোখ জুড়ানো ফেসবুকে জুনিয়রদের লাইক ওওয়াও এর প্রতিক্রিয়া। সেটা আরও বেড়ে গেল রিসর্টটার কাছে এসে৷ জঙ্গলের মধ্যে রিসর্টটা বানিয়েছে ভারী যত্ন করে। চিত্র কলা, ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি চারিদিকে। কারুকাজ করা পেল্লায় গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকতেই চোখ জুড়ানো সবুজঘাস এসে যেন পা জড়িয়ে ধরল শিশুর সারল্যে। দৌড় দৌড় দৌড়। ছেলেমেয়েদের আর আটকে রাখা গেল না। এত খুশি তারা এমন একটা সবুজ অবাধ চারণ ভূমি পেয়ে। আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে চললাম সবুজ মাঠের মতোই ছবির মতো সুন্দর করে সাজানো রিসেপশনের দিকে। বাহারী সবুজ গাছগুলো ঝুঁকে পড়ে যেন আমাদেরকে অভিবাদন করছিল। মেহুলি গাছের পাতাগুলোকে গালের সাথে লাগিয়ে আদর করতে করতে চলেছে। কে বলবে ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী। ঘন্টাদার আদরের মেয়ে। খুশীতে শিশুর মতো আবদার করলোও- “আমি এখানেই থেকে যেতে চায়”। এই কথায় সবার প্রাণ খোলা হাসি বলে দিল এটা সবারই মনের কথা। আমার ছোটছেলে ঋভু যদিও ক্লাস টেনে পড়ে, তবু ছোট বাচ্চাদের মতো প্রজাপতির মতো করে দুহাত ছড়িয়ে এক পাক দৌড়ে নিল সারা মাঠটা। আর তাতেই সশব্দে উড়ে গেল এক ঝাঁক সবুজ টিয়া। ঝকঝকে নীল আকাশের গায়ে যেন মুহূর্তে কেউ সবুজের তুলি বুলিয়ে দিল। আরও অনেক পাখি এখানে রয়েছে। দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে কিচিরমিচির শব্দটা। আকাশের চোখ আকাশের দিকে নয়। গাছ গুলোর দিকে। ও পাখি খুঁজে যাচ্ছে। ঘন্টাদার ছেলের ছোটবেলা থেকেই এই এক শখ। পাখিদের পেলে আর কিছু চাই না।

পায়ে পায়ে বিমুগ্ধের মতো কখন পৌছে গেছি রিসপশনে সেটা বুঝতে পারি নি। আর তাতেই হোঁচট। আর তার পরেই রিসেপশনের অমন চার দেওয়াল জোড়া চিত্রকলা দেখে ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছিলাম। ঘন্টাদার কথায় রহস্যের গন্ধ পেয়ে কলকাতা থেকে এখানে আসার চার ঘন্টার গাড়ি জার্নির ক্লান্তিও দেখলাম মুহূর্তে উবে গেল ২৪ঘন্টা বৌদিও আমার স্ত্রীর মধ্যে। 

“ছবিটার গতিময়তা তারিফ করার মতো। “বলল ২৪ঘন্টা বৌদি। তাতে সায় দিয়ে আমার স্ত্রী মৈত্রেয়ী বলল- “একবার প্রথম দেওয়ালটা দেখলেই অনিবার্য ভাবে বোঁকরে তোমার মাথা ৩৬০ডিগ্রী ঘুরে চারদেওয়াল দেখে তবে থামবে। আর তাতেই মাথাটা ঘুরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যেমন এখন আমার ঘুরছে। “এ কথা শুনেই আমার বড় ছেলে, ঋক তাড়াতাড়ি মাকে ধরে দাঁড়াল। ক্লাস টুয়েলভে পরে। একটু একটু দা্যিত্বশীল হয়েছে। তার পরে নীচু হয়ে সোফায় মাকে বসাতে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল – “ইউরেকা! পেয়েগেছি ঘন্টাকাকু। রহস্য জনক চরিত্র”।

সবাই কৌতুহলী চোখে তাকাল ঋকের দিকে। ঋক ধীর পায়ে এগিয়ে গেল প্রথম দেওয়ালের ছবিটার দিকে। তারপর আঙুল তুলে দেখাল ছবিটার শুরুতেই যে গাছ পাতা জঙ্গলের ছায়া পড়েছে ঘাসের উপর সেই ছায়ার সাথেই একটা বৃদ্ধের হালকা অস্পষ্ট অর্ধেক ছায়ামূর্তি। আমরা সবাই অবাক। কারণ একটু আগেও তো ওটা চোখে পড়েনি! সবাই ঋকের পর্যবেক্ষণ শক্তির তারিফ করতে যাচ্ছি এমন সময় আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে সেই ছায়ামূর্তি যেন একটু নড়ে উঠল। তারপর ভোজবাজির মতন উধাও হয়ে গেল সেই চিত্রপট থেকে।

যে ২৪ঘন্টা বৌদি তার অনর্গল কথা বলার জন্য বিখ্যাত তিনি পর্যন্ত বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে চিত্র কলার এমন জীবন্ত ম্যাজিকে। 

“এটা কেমন করে হলো ঘন্টাকাকু?” ঋভুর প্রশ্নে রহস্য বাড়িয়ে ঘন্টাদা কি একটা যেন ভাবতে ভাবতে বলল “হুমম্। কেউ একজন নজর রাখছে আমাদের উপর। তার ছায়া পড়েছিল দেওয়ালে। কিন্তু কেন? “।

ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাচ্ছি এমন সময় হই হই করে আরও কয়েকটি পরিবার ঢুকে পড়ল রিসেপশনের বিরাট ঘরটার মধ্যে। মুহূর্তে খানখান হয়ে গেল থ্রিলিং পরিবেশটা। দেওয়ালের মুর‍্যালটা দেখে কেমন অসভ্যের মতো হ্যাহ্যা করে হাসতে লাগলো ওদের মধ্যে অনেকে। তাদের মধ্যে একজন, যার নাম বিশুবাবু ওরফে বিশম্ভর ঘাঁটা, রিসেপশনিস্ট এর দিকে তাকিয়ে বলে বসলেন “কি বোকাবোকা সব ছবি আঁকিয়ে রেখেছেন দেওয়াল জুড়ে। কোথায় শিকারি হরিণটা শিকার করার পর আগুনে পুড়িয়ে রোস্ট খাবেন তা না সে নিজেই নিজের হাত চেপে ধরে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে! “

“ বলছি এই হরিণের মাংস তো আর পাওয়া যাবে না। কোয়েল বা নিদেন পক্ষে ডাকের মাংস কি পাওয়া যাবে দাদা। সাথে ব্ল্যাকডগ আছে। তাহলে সন্ধ্যাটা জমিয়ে.. “ বিশুদা বলেই চলেছেন। “ সাথে এই রকম একটা চিত্রশিল্পী যদি ধরে নিয়ে আসতে পারেন তাহলে সন্ধ্যাবেলায় ক্যাম্প ফায়ার, কোয়েলের মাংস, ব্ল্যাকডগের গ্লাস হাতে একটা আমার পোর্ট্রেট বানাতাম “ খ্যাকখ্যাক করে বিশুদার হাসিতে যোগদিল ওদের দলেরই সান্টুবাবু “ জিও বিশু!  একঘর হবে। সন্ধ্যাটা একদম জমে ক্ষীর হয়ে যাবে কাকা।“ এটা শুনে পুরো দলটা খ্যাকখ্যাক করে হাসতে লাগলো। আর তাদের বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি এতটাই উচ্চকিত হয়ে উঠল যে আমরা তাড়া লাগালাম রিসেপশনিস্টকে আমাদের ঘর বুঝিয়ে দিতে।

টু বেড রুমের দুটো করে ঘর এক একটা কটেজে। দুটো কটেজ নিয়েছি আমাদের ও ঘন্টাদার ফ্যামিলির জন্য। দিগন্ত আর সাঁজবাতি। প্রত্যেক টা কটেজের একটা করে নাম্বারও আছে। চাবি নিয়ে বেরোতে যাচ্ছি এমন সময় রিসেপশনের পাশের বাঁদিকের ঘর থেকে এঘরে এসে ঢুকলেন সৌমকান্তি এক বৃদ্ধলোক। চুল দাড়ি সব সাদা। ৬ ফুটের উপর লম্বা। বলিষ্ঠ গঠন আর স্কিনের রোশনাই বলে দিচ্ছে বেশ একটা অভিজাত ব্যাপার আছে ওনার চেহারায়। ঘরে ঢুকেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন বিশুবাবুদের দিকে। সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যে বিশুবাবুরা তড়িঘড়ি তাদের কটেজের চাবি নিয়ে চলে গেলেন। 

“স্বাগতম ঘন্টাবাবু। আপনাদের আসার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। “ ভদ্রলোক বেশ বিনয়ের সাথে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। “ কি জানেন তো শান্তিনিকেতনে এখন শান্তশিষ্ট রুচিশী ললোকেদের পরিবর্তে ফুর্তি করতে বেশি লোক আসে। দেখলেন তো চোখের সামনে কেমন রুচিহীন লোকেরা এসেছে। এদের সমস্ত মন ভুঁড়িতে পড়ে আছে।  আর চোখ হাঁটুর মাথায়! তবে আপনাদের যে দেখার চোখ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। “এই বলে ভদ্রলোক আমাদেরকে হাতের ইসারায় বসতে বলে রিসেপশনিস্টের দিকে ঘুরলেন। “ রমেন। আমার ল্যাপটপটা একটু দেখে দাও তো। কাল রাতের পর থেকে এক্সেল ফাইল খুললেই ভ্যালুর বদলে শুধু ফর্মুলা দেখাচ্ছে। আর ওনাদের জন্য একটু ভালো ঠাণ্ডা সরবত খাওয়াও। মাঝ রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওনারা বেশ হয়রান হয়েছেন।  “ এই বলে মুচকি হেসে আমাদের দিকে তাকালেন। 

শেষ কথাটাই বেশ চমকে উঠলাম। কি করে জানলেন ভদ্রলোক যে আমাদের গাড়ি মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়েছিল।  বিস্ময়ে প্রশ্ন করতে যাচ্ছি “ আপনি জানলেন কি করে....” এমন মুহূর্তে ঘন্টাদা হো হো করে হেসে বলল-

“ মহেন্দ্রবাবু আপনার দেখার চোখ বেশ প্রখর। প্রতিমের পকেটে জেগে ওঠা গাড়ির সার্ভিসসেন্টার বিকেঅটো,বর্ধমানের বিলটা ঠিক দেখতে পেয়েছেন।  তবে প্রশংসা করি আপনার শিল্পী সত্তাকে। এত সুন্দর একটা দেওয়াল চিত্র উপহার দেওয়ার জন্য যেখানে সৌন্দর্য,  রহস্য, গল্প সব হাতে হাত ধরে হাঁটছে।“

বেশ বিস্মিত হলাম ঘন্টাদার কথায়। ভদ্রলোক দেখি মৃদুমৃদু হাসছেন। জিজ্ঞেস করলাম “ কি করে জানলে ওনার নাম। আর উনি ইযে এই দেওয়াল চিত্রের চিত্রকর সেটাই বা কি করে বোঝা গেল? “

চারিদিক একবার তাকিয়ে বুঝলাম এটা সবারই প্রশ্ন। ঘন্টাদা উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রলোক বললেন –“ ঢোকার মুখে বনবিতান নেমপ্লেটটাই খুব ছোট করে আমার নামটা লেখা আছে। মহেন্দ্র ইন্দু ট্যান্ডন। আমি বাঙালী নই। কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পকলা ভালোবেসে এখানেই থেকে গেছি। আমরা হচ্ছি ক্ষেত্রী। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রী। মানে আপনারা যাকে বলেন ক্ষত্রিয়। আমাদের শারীরিক গঠন তো আপনাদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তাই ঘন্টাবাবু একে একে দুই করে নিয়েছেন। কি ঘন্টাবাবু তাই তো? “ 

ঘন্টাদা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

“কিন্তু উনি যে চিত্রকর এবং এই দেওয়াল চিত্রটা যে ওনারই আঁকা সেটা কিভাবে বোঝা গেল?” আমি প্রশ্ন করার আগেই ২৪ঘন্টা বৌদি দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে প্রশ্ন বানের।

“ উনি যে পেন্টিং করেন সেটা ওনার পাঞ্জাবীর কোনায় যে রঙ লেগে রয়েছে সেটা দেখলে বোঝা যায়।“ আকাশের পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখছি তার বাবা ঘন্টাদার মতোই হয়েছে। “ কিন্ত দ্বিতীয় প্রশ্নটা কি ভাবে সমাধান করলে বাবা। “ মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলো আকাশ। 

“ এটা বুঝতে গেলে আরও কিছু বুঝে নাও আকাশ।  “ ঘন্টাদা এতক্ষণে মুখ খুলল। “ উনি শুধু আর্টিস্ট নন। একজন টেকনোলজিস্টও ।MiT থেকে পাস আউট।“ 

বিস্ময়ের পর বিস্ময়। আমরা সবাই অবাক চোখে দেখছি ঘন্টাদাকে। ২৪ঘন্টা বৌদি তো রীতিমতো সন্দিগ্ধ চোখে একবার মেপে নিলো ঘন্টাদাকে –“ তুমি কি করে জানলে এতসব। ওনার ব্যাপারে। তোমরা কি পূর্ব পরিচিত? “

“প্রবেশ পথের বাঁ দিকে যে নেমপ্লটটা আছে তাতে ওনার নাম ছোট্ট করে লেখা থাকলে কি হবে তার মধ্যে অনেক সংকেত দেওয়া আছে। ওনার পুরোনাম Mahendra indu Tandon। শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর গুলো নিলে হয় MiT “ ঘন্টাদা ব্যাখ্যা করলো।

“ কিন্তু সে তো অনেক নামের ক্ষেত্রেই হতে পারে। যেমন যাদব উপাধ্যায় নাম দেখে কি তুমি JU পাস আউট বলবে! “ ঝটকা দিল ২৪ঘন্টা বৌদি। 


“ না শুধু সে টুকু দেখলে হবে না। মাঝের i অক্ষরটা খেয়াল করো। সব শব্দের প্রথম অক্ষর গুলো বড়। ইন্দু শব্দে i শব্দটাই ছোট হয়ে গেল। শুধু তাই নয়। i শব্দটার রঙটাও ভিন্ন। লাল রঙের। মানে একদম  MiT এর লোগোতে যেমন থাকে। এটা দেখে প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল। ভাবলাম অনেকে এমন করেই থাকেন। হালকা চালে নিজেকে এমআইটিয়ান দেখানোর জন্য। কিন্তু এই দেওয়াল চিত্রটা দেখে সন্দেহ সব উবে গেল। এত অসাধারণ একটা মুর‍্যাল। তার কোনাতেওi লাল রঙে আঁকা আছে। এমন চিত্রকলা যিনি সৃষ্টি করতে পারেন তিনি জাত শিল্পী। তিনিতো MiT  লোগো নকল করে নিজের নামের মধ্যে ঢোকাবেন না। এমনকি নিজের পেন্টিং এ লাল রঙের i কে অত যত্ন করে আঁকবেন না যদি না তার সাথে ওনার সত্যি কারের অ্যাটাচমেন্ট থাকে।“

আবার ও মৃদু হাসলেন ভদ্রলোক এবং সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন ঘন্টাদার দিকে –“ একদম ঠিকঠাক ধরেছেন। আমরা হিন্দুক্ষেত্রী। পশ্চিম পাঞ্জাবের বহু প্রাচীন অধিবাসী। ট্যান্ডনদের জমিদারীর চিহ্ন এখনো ওখানে আছে।  স্বাধীনতার পর ঠাকুর্দা পরিবার শুদ্ধু পূর্ব পাঞ্জাবে চলে আসেন। আমার ঠাকুরমা ছিলেন বাঙালী। কলকাতার ঠাকুর পরিবারের সাথে একটা দূর সম্পর্কের যোগাযোগ ছিল। ঠাকুরমার খুব আদরের নাতি ছিলাম আমি। আমার সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা সব ঠাকুরমার প্রভাবে। তাই বাবা আমার নাম মহেন্দ্র রাখলেও ঠাকুরমার দেওয়া ইন্দর ওরফে ইন্দু নামটা আমি কখনও ভুলতে পারিনি। তাই ওটাও আমার নামের মধ্যে নিয়ে নিয়েছি।“ 

মৈত্রেয়ী উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো “ যা বুঝতে পারছি তাতে আপনার শিল্পী সত্তার পিছনে আপনার ঠাকুরমা মানে ঠাকুর পরিবারের প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু এর মধ্যে MiT কিভাবে আসল?”

“আমার জীবন কাহিনী শুনতে বসলে একটা গোটা দিন লেগে যাবে ম্যাডাম। সেটা সুযোগ সুবিধা মতো নিশ্চয় বলবো। এখন আপাতত আপনারা চেকইন করে নিন।“ এই বলে মহেন্দ্রবাবুর মেনকে তাড়া লাগাল আমাদের কটেজগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। 

রমেন চাবিগুলো বের করতে করতে বলল “ সে তো দিচ্ছি। কিন্তু স্যার আপনার এক্সেল ফাইলটা তো ঠিক হচ্ছে না। সব ফর্মুলা শো করছে।“

“ কন্ট্রোল স্মার্ট অ্যাপোস্ট্রপি প্রেস করো ঠিক হয়ে যাবে।“ ঘন্টাদার মেন বাবুর উদ্দেশ্যে বলল। তারপর মহেন্দ্রবাবুর দিকে ঘুরে দাড়াল- 

“ বাঃ। আপনি এতবড় একটা প্রপার্টি সামলেও কালরাতে অনলাইনে নিজের ইনকামট্যাক্স ফাইল নিজেই জমা করেছেন।“

মহেন্দ্রবাবু এবার একটু চমকালেন মনে হলো। কিন্তু মুহূর্তে চমকটা মৃদু হাসিতে মুড়ে বললেন “ বাঃ। এটাও বুঝে ফেললেন ঘন্টাদা! “ ঘন্টাবাবুকে মন অবলীলায় ঘন্টাদা হয়ে গেল মহেন্দ্রবাবুর কথায় সেটা খেয়াল করলাম।

“ এর ক্লু মনে হয় ওই এক্সেল ফাইলেই আছে। তাই না?” 

“ হ্যাঁ।“ হেসে বলল ঘন্টাদা। “ আপনি ইনকামট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের ওয়েব সাইটটাই ডাইরেক্ট অনলাইন ফর্মটা ফিলআপ করলে এই ভ্যালুর সমস্যাটা হতো না। আপনি আলাদা করে এক্সেল ফাইল ডাউনলোড করেছেন। তারপর ফিল আপ করে এক্সেমেল ফাইলে কনভার্ট করে আপলোড করেছেন। তাতে এক্সেল ফাইলের সেটিং অনেক সময় চেঞ্জ হয়ে যায় ইনকামট্যাক্সের ম্যাক্রোগুলো চলে বলে। আপনার ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। এটা জুলাই মাস। সবাই ইনকামট্যাক্স রিটার্ন অনলাইনে জমা করছে। তাই আবার একে একে দুই মেলালাম আর কি।“ ঘন্টাদা এক নাগাড়ে বলে একটু দম ছাড়লো। 

“ ওদাদা। আপনি তো ধন্বন্তরি! “ রমেন স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত হয়ে বলল। বুঝলাম ঘন্টাদার ওষুধে কাজ হয়েছে। 

“অনেক হয়েছে মগজাস্ত্রের কেরামতি। আর নয়। খিদেই পেটের ভিতর ডাইনোসর ডন মারছে।“ এই বলে ২৪ঘন্টা বৌদি সবাইকে তাড়া লাগাল। আমরা সবাই মিলে চললাম কটেজের দিকে।



“ ঋভু তাড়াতাড়ি খাও। আবার তো বেরতে হবে। আজই আমরা বিশ্বভারতী ঘুরে দেখে নেব। অনেক কিছু দেখার আছে। অনেক সময় লাগবে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে তো আর দেখতে পারবো না।“ মৈত্রেয়ী ছোট ছেলের পিছনে পড়ে আছে। কিন্তু সে আকাশ, ঋক আর মেহুলীর সাথে গভীর আলোচনায় মত্ত। 

আমরা সবাই সেন্ট্রাল ডাইনিং হলে খেতে বসেছি। দারুণ সুন্দর এই ডাইনিং হলটা। রিসেপশনের থেকে একটু দূরে একটা দোতলা বিল্ডিং। গোল করে সবুজ ঘাসের লন। তার মাঝখান দিয়ে লাল সুরকি দিয়ে বাঁধানো রাস্তা একে বেকে একেবারে ডাইনিং হলের দরজা পর্যন্ত চলে গেছে। ছোট ছোট করে ছাঁটা সবুজ গাছগুলো রাস্তার দুধার দিয়ে লাগানো হয়েছে। অনেক গুলো রাস্তা বানানো হয়েছে গোলক ধাঁধার মতো। কিন্তু মাত্র একটা রাস্তা দিয়েই যাওয়া যায়। আর একটা রাস্তা দিয়ে ফেরা। সমস্ত কটেজের লোককেই এই ডাইনিং হলে আসতে হয় দুপুরেরও রাতের খাবারের জন্য।  নামটাও অদ্ভুত। “আস্কারা”। আপনার জিভকে বেহিসাবী করে দিতে এরা সমস্ত রকম লোভনীয় বাঙালী খাবার নিয়ে হাজির। আর সেটা শহুরে মাপের জীবনের জন্য রীতিমতো আস্কারায় বটে। ভিতরটা ছোট বড় নানান গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরী হরেকরকমের টেবিল দিয়ে সাজানো। আমরা আট জন এক সাথে বসতে পারি এমন একটা পেল্লায় গাছের গুড়ি দিয়ে তৈরী টেবিলে বসেছি। গুড়িটার নীচের শুঁড়ের মতন মূলগুলো যত্ন করে এমন ভাবে কাটা যাতে ওগুলোই পা হয়ে গেছে টেবিলটার।

“ আমাদের কটেজের দেওয়াল গুলো সব নানা ছবি তে সাজানো। সব ওয়াল পেন্টিং।“ ঋভু খাওয়া থামিয়ে কথা বলে চলেছে।

“ আমাদের গুলো ও তাই। “ আকাশ মাংসের টুকরোই কামড় দিতে দিতে বলল।

“ আমাদের বেডরুমটায় দরজার ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে বেশ কিছু টুকরো টুকরো ছবি। একটা কুয়ো। একটা বাচ্চা ফুটফুটে মেয়ে হাত নেড়ে ডাকছে। তারপরই এক টানা ম্বার ১৭১৫। পরপর ছবিগুলো যেন একটা গল্প বলছে। “ ঋক বলল চাটনি খেতে খেতে।

“ আমাদেরটাতেও বিভিন্ন রকমের পেন্টিং রয়েছে। “ মেলিল চোখ বন্ধ করে ইলিশ মাছের আস্বাদ নিচ্ছে। ও মাংস পছন্দ করে না। “ ঘরে ঢুকেই যে দেওয়ালটা চোখে পড়ে তাতেও টুকরো টুকরো ছবি। বাঁ দিকের ছবিটাই বিহু উৎসবের নজরকাড়া গ্রুপডান্স। তার পরের ছবিটাই একজন মহিলা পান তুলে দিচ্ছেন আর একজনের হাতে। তার পরের ছবিতে একটা জল ভরা বৃষ্টির মেঘ ঝুলে আছে সবুজ আদিগন্তমাঠের উপর। তার পরের ছবিতেই দারুণ নীল আকাশ।“ মেহুলি বর্ণনা দিতে দিতে ইলিশের ভাপা শেষ করলো।

“এগুলোর মানে কি বলতো আকাশদা” ঋভু জিজ্ঞেস করলো।

“সেটাই ভাবছি।“ অন্য মনস্ক হয়ে উত্তর দিল আকাশ। 

“ কিছু একটা বলতে চাইছে ছবিগুলো। কিছু একটা রিলেশন আছে ছবিগুলোর মধ্যে।  তাই না বল মেহুলি।“ ঋক খাওয়া শেষ করে বলল।

“ বাবা। তুমি কি বুঝতে পারছ? কিছু ক্লু দাও না।” এবার ঋভু আমাকে ধরেছে। 

আমি হেসে বললাম “ এই ছবিগুলো তোমাদের জন্য। তোমাদের উদ্দেশ্যে বলা। এবার বুঝে নাও। “

“পেরেছি। কিছুটা বুঝতে পেরেছি দাদা” উত্তেজিত হয়ে বলল ঋভু।

সবাই কৌতুহলী চোখে তাকাল ঋভুর দিকে।

“ ওই কুয়োটা ইংরাজিতে উচ্চারণ করতে হবে। মানে ওয়েল। আর ছোট্ট মেয়েটা যে হাত নেড়ে ডাকছে সেটাও ইংরাজিতে হবে কাম। মানে দুটো মিলে ওয়েল কাম! “ ঋভুর ব্যাখ্যা শুনে আমি হেসে ওর মাথার চুলটা একটু নেড়ে দিলাম।

“ ঠিক বলেছিস ভাই। “ ঋক বলল। আকাশ, মেহুলি ও হেসে সায় দিল।

“কিন্তু ওই ১৭১৫ নাম্বারটা কি?” ঋভু আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল।

“ বুঝেছি। ওটা আমার আর তোর বয়স। ১৭ ও ১৫। তার মানে হলো ওয়েল কাম ঋক ও ঋভু!” হেসে বলল ঋক।

“ বাঃ। চমৎকার বিশ্লেষণ।“ মেহুলি সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল ঋকের দিকে। তাড়াতাড়ি চোখ সরাল ঋক। এই ভাবে তাকালে বুকটার মধ্যে যেন কি হয়। কতবার বলেছে মেহুলিকে। এইভাবে তাকাবি না বাবা মায়ের সামনে। তবু ও ওই ভাবেই তাকাবে। বুঝতে পারে ঋক যে ওই ভাবে তাকালে ওর ভালোই লাগে। কিন্তু বড়দের সামনে এখনো স্বাভাবিক হতে পারে না। অথচ ও আসবে বলেই এবার এখানে আসা। ভাবল ঋক।

“ হুমম্। এবার বুঝতে পারছি। আমাদের ঘরের ওয়াল পেন্টিংগুলো এমনই কিছু বলতে চাইছে।“ আকাশ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। “ ওই নীল আকাশটা তো আমি।“ 

“ঠিক। “ যোগ দিল মেহুলি। “ আর আমার নামের মানে তো বর্ষার জলভরা মেঘ। সেটাই তৃতীয় ছবিটা।“

“ঠিক বলেছিস দিদিভাই। “ আঙুলে লাইক দেখাল আকাশ। “ বিহু উৎসব তো আসাম রাজ্যের। আর ওখানেই অতিথিকে পান দিয়ে অভ্যর্থনা করা হয়। আমার বইতে আছে।“

“ তার মানে প্রথম আর দ্বিতীয় ছবিটা মিলে এগেন ওয়েল কাম। সব মিলিয়ে ওয়েল কাম মেহুলি এন্ড আকাশ! “ বিস্মিত মেহুলি বলল।

“ বাঃ। সুন্দর বিশ্লেষণ করেছ সবাই। “ খাওয়া শেষ হয়েগেছিল সবার। আমি টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে ছোটদের প্রশংসায় ভরিয়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু ঘন্টাদাকে এত গম্ভীর লাগছে কেন। কি যেন ভাবছে ঘন্টাদা। সিগারেটের একটা লম্বা টান দিয়ে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছে এমন ভাব করে বলল –“ ভাবো। ভাবো। আরও ভাবতে হবে সবাইকে। অনেক গুলো খটকা। টেলরমেড! কেন? “




ভাবতে ভাবতেই রাতে কখন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছিলাম বুঝতেই পারিনি। ঘুম ভাঙল এক তীব্র আর্তনাদে। নিশ্চুপ তারা ভরা রাত যেন ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। সেই আর্তনাদের হাহাকার ছড়িয়ে গেল কটেজ থেকে কটেজে। গাছ থেকে গাছে। নেতিয়ে পড়া ঘাসগুলো অনেকের পদশব্দে তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল ত্রস্ত পায়ে। চাঁদের ঝিম ধরা একটানা জ্যোৎস্নার ঢেউয়ে ভয় পেয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে গেল একটা বুড়ো পেঁচা।

এমন তীব্র সে আর্তনাদ যে সব কটা কটেজের লোকেরাই মনে হয় জেগে গেছে। রাত দুটো আড়াইটে হবে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে এলাম বিছানা থেকে। বাইরে বেরিয়ে দেখি কটেজগুলোতে একেএকে আলো জ্বলে উঠছে। সবাই প্রায় বেরিয়ে এসেছে।  মুহূর্তে জায়গাটা ভরে গেল কি হয়েছে, কার কি হয়েছে,  কোথায় কি হলো ইত্যাদি সব প্রশ্ন বানে। সবাই দিগভ্রান্ত হয়ে এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। তবে আর্তনাদের পরেও একটানা গোঁঙানির আওয়াজটা মনে হয় দক্ষিণ দিকের কটেজগুলো থেকেই আসছে। আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম সরু বাঁধানো রাস্তা ধরে। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বড় ছোট গাছগুলো রাস্তার দু পাশ জুড়ে একে অন্যের সাথে জড়া জড়ি করে দাঁড়িয়ে। কিছু দূর অন্তর অন্তর কটেজ গুলো। রাস্তার একপাশে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। অনেক কটেজে কোন আলো জ্বলেনি। এমন আর্তনাদের পরেও। তার মানে ও গুলোতে বোর্ডার নেই। প্রায় ৫০ – ৬০ টার মতো কটেজ হবে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জঙ্গলের মধ্যে জিগজাগ প্যাটার্ণে সাজানো আছে। তবে রাস্তাগুলো এঁকেবেঁকে গেলেও মোটের উপর একটা সার্কেল তৈরী করছে। বেশ কয়েকটা সার্কেল। তারা আবার নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে জুড়ে আছে। অনেকটা হাবস ও স্পোকস এর মতো। তবে জ্যামিতিক প্যাটার্ণটা অত সহজ নয়। গোলক ধাঁধার মতো। সেন্টার পয়েন্টে বেশ বড় একটা দীঘি। ছোটখাট লেকই বলা যেতে পারে। গোলক ধাঁধায় পড়ে দিঘির দিকে চলে এসেছি। আওয়াজটা বেশ ক্ষীণ শোনাচ্ছে।  তার মানে ভুল করে সেন্টার পয়েন্টে চলে এসেছি। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার একটানা শব্দ। অন্য দিন হলে গাছের ফাঁক দিয়ে গলে পড়া সুন্দরী চাঁদের রূপ দিঘির জলে মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। আজ কিন্তু তিরতির করে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় জলের মধ্যে যে কাঁপন ধরেছে জোৎস্নার ভুতুড়ে আলোয় তার মধ্যে দিয়ে সরসর্করে কালো সাদা লম্বা যে সরীসৃপ টা চলে গেল তা দেখে ভয়ের একটা হালকা শিহরণ খেলে গেল।

কিভাবে গেলে আওয়াজের উৎস স্থলে আবার যাওয়া যায় সেটা বোঝার চেষ্টা করছি দেখি একটা আগুনের ফুলকি জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে সোজা আমার দিকে আসছে।


আতঙ্কে প্রায় আঁতকে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় পরিচিত স্বরটা গমগম করে উঠল – “ দূর থেকে দেখে ঠিকই চিনেছি। এরকম একটা সময়ে রাস্তা ভুল শুধু একজনই করতে পারে! “

“ না। মানে..আমি.... এই অন্ধকারে ঠিক... “ আমার অজুহাত মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে ঘন্টাদা বলল –“ নিন। আর অদৃশ্য হাত না বাড়িয়ে এবার পা চালান।“ 

ঘন্টাদার সাথে পা বাড়ালাম। দিনের বেলার এত সুন্দর রমণীয় জায়গাটাকে মন ভুতুড়ে লাগছে। একটু এগাতেই গাছগুলো আরও ঘনও হয়ে আসল। খিক্খি ক্করে হাসতে হাসতে বুড়ি চাঁদ গাছের গা বেয়ে নেমে দিঘির জলে ডুব দিল। আকাশেও কি মেঘ ঘনাচ্ছে? গাছের ফাঁক দিয়ে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না। তবে লোক জনদের আওয়াজ আস্তে আস্তে বাড়ছে। বুঝতে পারছি গন্তব্য সামনেই। 





“ এটা। এটা কি করে সম্ভব? “ আমি হত বিহ্বল হয়ে ঘন্টাদাকে জিজ্ঞেস করে বসলাম। তবে প্রশ্নটা শুধু আমার ছিল না। ওখানে উপস্থিত সব লোকদেরই ছিল। কটেজ নাম্বার ৫৫ এর বাইরে ভিড় দেখে ওখানে ঢুকতেই প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসল। প্রায় দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের এই কটেজ। কটেজটা অন্য সব কটেজের মতো হলেও একটা বিশেষত্ব হলো এই যে এই কটেজের সামনে সবুজ মখমলের মতো বেশ বড় একটা লন রয়েছে। সেই লনে অনেক গুলো গার্ডেন চেয়ার ও টেবিল। একটু বেখাপ্পা ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটা টেবিলে একটা ব্ল্যাকডগের বোতল স্বমহিমায় শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে না পেরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাশের গ্লাসটার অবস্থা তথৈবচ। আধ খাওয়া একটা হাঁসের মাংসের পাঁজর করুণ ভাবে তাকিয়ে আছে গ্লাসটার দিকে। চিপস্, বাদাম, কাবাব, মাংসের হাড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এমন ভাবে রয়েছে যে বোঝা যাচ্ছে খাওয়ার উল্লাস বেশ কয়েকটা টেবিল জুড়ে ছিল। এর মাঝে বেখাপ্পা ভাবে একটা ক্যানভাস একটা স্ট্যান্ডে লাগানো। আর তাতে যার পোর্ট্রেট আঁকা রয়েছে তাকে চিনতে কষ্ট হলো না। সেই বিশুবাবু। সত্যি ভদ্রলোক দুপুর বেলায় চেকইন করার সময় যা বলেছিলেন তাই করে দেখালেন। নিজের পোর্ট্রেট কোনো শিল্পীকে দিয়ে ঠিক আঁকিয়েছেন। তাহলে এখানে বিশুদাদের আসর বসেছিল। এই কটেজে বিশুদারাই উঠেছেন। তাহলে আর্তনাদ টাকার? এটা ভাবতে ভাবতে কটেজে ঢুকে দেখি মেঝেয় রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বিশুদা ডান হাত চেপে ধরে অসম্ভব যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। আর বিছানায় যেটা দেখলাম তাতেই চমকে প্রশ্নটা করে ফেললাম ঘন্টাদাকে – “ এটা। এটা কি করে সম্ভব?”

রক্ত মাখা লাল টুকটুকে একটা বুড়ো আঙুল পড়ে আছে বিছানায়। নৃশংস ভাবে একপোচে কেটে ফেলা হয়েছে আঙুলটাকে। কিন্তু কেন? কে কাটল? কেনই বা কাটল? বিশুদার স্ত্রীও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বুঝতে পারছেন না কি করবেন। আমার মাথায় প্রশ্নরা ভিড় করে আসছে। আর আসছে অন্য কটেজের লোকেরা। সবার চোখে মুখে প্রশ্নরা বিঁধে আছে এমন একটা অস্বস্তি নিয়ে যেটা সচরাচর দাঁতের ফাঁকে কাঁটা ফুটে থাকলে যেমন হয়। ঘন্টাদা প্রথমেই ইন্টার কমেরিসেপশনিস্টকে ঘটনাটা জানিয়ে তাড়াতাড়ি মহেন্দ্রবাবু ও একজন ডাক্তারকে নিয়ে আসতে বলল।

“ডাক্তারকে ডেকেছি। এখনই চলে আসবে। আপনি চিন্তা করবেন না। “ রঞ্জনা, মানে বিশুদার স্ত্রীকে আাশস্ত করলো ঘন্টাদা।

“ এখন বেশ কিছুটা তুলো দিয়ে কাঁটা আঙুলটা ওনার হাতের কাঁটা জায়গাটাই বসিয়ে বেশ জোরে চেপে রাখুন ডাক্তার না আসা অবধি। কপাল ভালো থাকলে আঙুলটা আবার জুড়ে যেতে পারে। “ঘন্টাদার পরামর্শে রঞ্জনা বৌদি চটপট ব্যাগ থেকে ছোট্ট ফাস্টএইড কিটটা বের করে তুলো খুঁজে আনলেন। বিশুদা তখনও যন্ত্রণায় গোঁঙাচ্ছে।  দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন।

“এবার খুলে বলুন তো কি হয়েছে ঘটনাটা”। দেরি না করে প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছে ঘন্টাদা।

“ আ আ আমিতো কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি হলো এটা। ওর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা এমন ভাবে কে কাটল? কেনই বা কাটল?” বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি রঞ্জনা বৌদির। লাঞ্চ করার সময় আমাদের সাথে আলাপ হয়েছিল ওদের গ্রুপের। বিশুদা,  রঞ্জনাবৌদি,  ওনাদের এক ছেলে, ওনার বন্ধু সান্টুদা, সান্টুদার ছেলে, মেয়ে, মেয়ের বান্ধবী,  ওনার শ্যালিকা, শ্যালিকার হাসবেন্ড ইত্যাদি। চোদ্দ জনের বেশ বড় গ্রুপ। হাওড়া থেকে এসেছেন। বিশুদা ও সান্টুদার প্রমোটারি ব্যবসা। যৌথ উদ্যোগ। ব্যবসার কাটতি পুরটাই কাটমানির উপর চলছে। নেতা খুশ তো ব্যবসায়ী জনতা খুশ। মিলে মিশে করি কাজ/ ঘুষ দিতে বা নিতে নাহি লাজ। এই হচ্ছে ওনাদের খুব সিম্পল ব্যবসায় সাফল্যের মূল মন্ত্র। ওনাদের কথায় একটু নিরিবিলিতে ফুর্তি করতে শান্তিনিকেতন এসেছেন। দু একদিন থেকে এখান থেকে তারাপীঠ গিয়ে মা এর পূজা দিয়ে তবে বাড়ি ফিরবেন।

“ আমরা তো সবাই মিলে সন্ধ্যার থেকে খুব মজা করলাম। হই হুল্লোড় করলাম। খাওয়া দাওয়া, গান, নাচ, পানীয় সব চলল। কোন রকম কোন ঝামেলা তো হয়নি। বিশুদা আর বৌদি খুব হাসিহাসি মুখেই তো সবাইকে গুডনাইট করে শুতে গেল। “ সান্টুদা এগিয়ে এসে বৌদিকে সান্তনা দিলেন।

“ কিন্তু পানীয়টা একটু বেশি হয়ে ছিল নিশ্চয়। না হলে সাধ করে বাইরে থেকে শিল্পী নিয়ে এসে এত সুন্দর করে সুরা পাত্র হাতে যে সেল্ফ পোর্ট্রেটটা করলেন সেটা বাইরে রেখেই চলে এলেন!  “ একটু হেসে বলল ঘন্টাদা। তারপর জিজ্ঞেস করলো-“ ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঘরের দরজাটা নিশ্চয় লক করতে ভোলেন নি?“

“ সেটা তো আমি নিজের হাতে দিয়েছি। “ রঞ্জনাবৌদি একটু ধাতস্থ হয়েছেন মনে হলো। 

“ যখন বিশুবাবুর আর্তনাদ শুনে জেগে উঠলেন তখন কি দরজাটা লকড ছিল?” রঞ্জনাবৌদির দিকে ঘুরে প্রশ্ন করলো ঘন্টাদা। 

“ প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনে আমি ধড়মড় করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করি কি হলো। বিশু প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে শুধু বলতে পারে যে ওর বুড়ো আঙুল কেউ কেটে নিয়ে গেছে। সেটা শুনে আমি প্রথমেই লাইটা জ্বালি। লাইট জ্বালতেই দেখি বিশু প্রচণ্ড আর্তনাদ করছে আর বাঁহাত দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল চেপে ধরে আছে। চারদিকে লাল রক্ত ছড়িয়ে আছে।  আমি ওর পাশে শুয়ে ছিলাম তাই আমার গায়ে ওরক্ত ছিটকে এসে লেগেছে। “ বৌদির গলায় এখনও আতঙ্ক। “দরজা, জানলা সবই তো ভিতর থেকে লক করা। এমনকি অ্যাটাচ্ড বাথরুমের দরজাটাও বন্ধ। কি করে তাহলে এটা ঘটল? আ আ আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। ওর ওর আঙুলটা আবার জোড়া লাগবে তো? ডাক্তার এখনো আসছেনা কেন। আপনারা কিছু করুন না প্লীজ। “বৌদির মিনতি শুনে ঘন্টাদা আবার রিসেপশনে ফোন করতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ম হেন্দ্রবাবু, রমেন,  একজন ডাক্তার সবাই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন।

“ আশ্চর্য ব্যাপার! হটাৎ করে বন্ধ ঘরের মধ্যে আপনার আঙুল কেউ কেটে দিল? “ সবাই যখন বিশুবাবুর পরিচর্যায় ব্যস্ত তখন কোথা থেকে যেন উদয় হলেন এক পুলিশ ইন্সপেক্টরেরও।

“আসুন।  আসুন। ইন্সপেক্টর গাঙ্গুলি। আপনি একদম ঠিক সময়ে এসে পড়েছেন। “মহেন্দ্রবাবু অভ্যর্থনা করে ইন্সপেক্টরকে বিশুবাবুর সামনে নিয়ে আসলেন। ততক্ষণে ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে দিয়েছেন বিশুবাবুর। বুড়ো আঙুলটা জায়গায় বসিয়ে শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন। তার সাথে গোটা কয়েক ইনজেকশন। ব্যাথা কমানোরই হবে বোধ হয়। তার সাথে অ্যান্টি সেপটিক কিছু হয়তো। নিজের মনে ভাবলাম। ভাবনাটা ছিন্ন হয়ে গেল মহেন্দ্রবাবুর কথায় – “ আপনাকে ফোন করার পর এত তাড়াতাড়ি আপনি চলে আসবেন ভাবতে পারিনি। অসংখ্য ধন্যবাদ। দেখুন তো কি সমস্যায় পড়া গেল। আমার রিসর্টে এমন কান্ড!  আগে কখনো তো ঘটেনি। এই রহস্যের উন্মোচন খুব শীঘ্রই হওয়া দরকার। আপনি একটু দেখুন প্লীজ। না হলে রিসর্টের বদনাম হয়ে যাবে।“

মহেন্দ্রবাবুকে আশ্বস্ত করে ইন্সপেক্টর আবার জেরা শুরু করলেন– “ দেখুন ঘরের মধ্যে যখন আর কেউ ঢোকে নি তখন এটা নিতান্তই স্বামী স্ত্রীর গণ্ডগোল মনে হচ্ছে।“

“না না। আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া হয়নি” বৌদি উত্তেজিত হয়ে জবাব দিলেন।“

“ হুমম্। কাল তো ভালো পার্টি হয়েছে দেখছি। ব্ল্যাকডগ। ডাকের মাংস। আরও কত কি! বাই দ্য ওয়ে মহেন্দ্রবাবু। আপনার এখানে তো ডাক নিষিদ্ধ। তাহলে এরা কোথা থেকে পেল? তারপর আবার নিজের পোর্ট্রেটও আঁকিয়েছেন! শিল্পী শেষ পর্যন্ত আপনি! “ইন্সপেক্টর গুছিয়ে প্রশ্ন শুরু করেছেন। 

“ এগুলো সব আমিও এখন দেখলাম। কাল সন্ধাবেলায় মনে হয় লুকিয়ে এগুলো নিয়ে এসেছে। গেটে সিকিউরিটি গার্ড আছে। কিন্তু ওরা তো আর এয়ারপোর্টের মতো চেকিং করেনা। কি করে ধরবে বলুন। এদের নিয়ে এটাই তো সমস্যা।  ফুর্তি করার জন্য অন্য অনেক হোটেল আছে। কিন্তু এরা সব কিছু কিনে নিতে চায়। ক্লাস থেকে গ্লাস! “

“ আর পোর্ট্রেটটা?”

“ হুমম্। কাল এখানকার এক লোকাল আর্টিস্ট সন্ধ্যাবেলাই এসেছিল বটে। কিন্তু তখন এদের পরিচিত, দেখা করতে এসেছে বলে ঢুকে পড়ে। তারপর রাত দশটা নাগাদ বেরিয়েও যায়। এখন বুঝতে পারছি সেই এই পোর্ট্রেটটা এঁকেছে।“

“ তাহলে পার্টিতে কোন ঝামেলা হয়েছিল নিজেদের মধ্যে? “ বিশুদার পাশে থাকা সান্টুদার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লেন ইন্সপেক্টর। 

“ একদমই না। খুব মজা করেছি আমরা সবাই মিলে। “ সান্টুদার কথায় ওদের গ্রুপের সবাই সায় দিল।

“ তাহলে তো বোঝা যাচ্ছে সব রহস্য রুমের মধ্যে। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়ার এক ভয়ংকর পরিণতি। তাহলে কে কাটল আঙ্গুল?  স্ত্রী রেগে গিয়ে মাথা গরম করে এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছেন নাকি স্বামী স্ত্রীর মান অভিমানে স্বামী নিজের আঙুল কেটে ফেললে ন!? “এই ছুটকো কেস ইন্সপেক্টর তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন বোঝা যাচ্ছে। 

“আ আ আমি বলছি” গোঁঙাতে গোঁঙাতে এতক্ষণ বাদে মুখ খুললেন বিশুদা। ওষুধে হয় তো কাজ হয়েছে একটু। “ পার্টি শেষ হওয়ার পর রাত বারোটা নাগাদ খুশিমনে আমরা দুজনেই শুয়ে পড়ি সমস্ত দরজা,  জানলা লক করে। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হটাৎ একটা ঘরঘর আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। চমকে চোখ খুলতেই যা দেখলাম সেরকম মনে হয় কোন দিন দুঃস্বপ্নেও দেখি নি।“

রহস্যের গন্ধ পেয়ে সবাই আবার ঝুঁকে পড়েছে বিশুদার দিকে। ডাক্তার তাড়াতাড়ি সবাইকে পিছনে সরে যেতে বললেন। না হলে রুগীর শ্বাসকষ্ট হতে পারে। আর এতক্ষণ ফেলে রাখাও ঠিক হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে অপারেশনটা এখনই করা দরকার। যদি আঙুলটা বাঁচানো যায়। কিন্তু উনিও উৎসুক হয়ে তাকালেন বিশুদার দিকে।

“ দেখলাম! “ বলতে গিয়েও ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠল বিশুদা।

“ বলুন। বলুন। একটু কষ্ট করে হলেও বলুন। এরপরই আপনাকে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হবে। অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। “ ইন্সপেক্টর আশ্বাস দিলেন বিশুদাকে।

“ দেখলাম! আমার মাথার উপর যেন পুরো ছাদটা নেমে এসেছে। তারপর একটা হালকা নীলচে আলোর ঝলকানি। সাথে তীব্র গতিতে কোন মোটর ঘুরলে যেমন তীক্ষ্ণ বাঁশীর মতো আওয়াজ হয় তেমন হলো। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার বুড়ো আঙুলের উপর দিয়ে যেন করাত চলে গেল। আর আর....” ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিশুদা অজ্ঞান হয়ে গেলেন আবার। বৌদি আর্তনাদ করে উঠল।

“ নানা আর নয়। এবার একে নার্সিংহোমে নিয়ে যেতেই হবে। ইন্সপেক্টর আপনি পরে নার্সিংহোমে এসে বয়ান নিয়ে যাবেন। পেশেন্ট এখন ট্রমায় চলে গেছে। কে আছেন। একে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তুলুন। “ডাক্তার আর ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

ঘটনার অদ্ভুত বিবরণে সবাই কেমন চমকে গেছে। সবাই হতভম্ব। এমনও হয়! ইন্সপেক্টর বিশুদাকে ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত ভাবে ঘরের ছাদের দিকে তাকালেন। আমরা সবাই এবার ঘরটাকে খেয়াল করার চেষ্টা করলাম। চোদ্দ বাই বারোর বেশ বড় বড় ঘর এই কটেজ গুলোতে। অন্য সব ঘরের মতো এঘরেও অনেক ওয়াল পেন্টিং,  বেশীর ভাগই সিন্ধু সভ্যতার গুহাচিত্র,  সিন্ধু লিপি এই সব। ঘরের এক কোনায় নাইট ল্যাম্পের বাহারি স্ট্যান্ড। তার পাশেই ব্রোঞ্জের এক নারী মূর্তি উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ছাদের টপটাই কোন ফলসসিলিং আছে বলে মনে হলো না। সলিড কংক্রীট। তবে তাতেও শিল্পকলা। সেটা উন্মুক্ত এক দাবা ক্ষেত্র যেন। ঘুঁটি গুলো বিভিন্ন পজিশনে। কেউ খেলতে খেলতে উঠে গেছেন মনে হচ্ছে। কিন্তু এই ছাদ নেমে এসেছে। এটা কি বললেন বিশুদা। এরকম হয় নাকি। কংক্রীটের ছাদ নেমে আসবে নীচে! কি পাগলের মতো বলছেন বিশুদা।

ইন্সপেক্টর একটা ল্যাডার নিয়ে এসে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন ছাদটা। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন–“ হঠাৎ কোনো ইমপ্যাক্টে বিশুবাবুর মাথা মনে হয় গেছে। একটা সলিড কংক্রীট ছাদ। সেটা কি করে নেমে আসবে? নাহ্। নিজেদের গণ্ডগোল ঢাকা দিতে ভালোই একটা আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে বিশুবাবু। যান ওনাকে নিয়ে যান তাড়াতাড়ি নার্সিংহোমে। পরে সুস্থ হলে ওনাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করছি। একটু থার্ড ডিগ্রী দরকার আছে মনে হচ্ছে।”

এতক্ষণ ঘন্টাদা কে কোন কথা বলতে শুনিনি। মন দিয়ে সবার কথা শুনছিল। তারপর সবাই বিশুদাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই ঘন্টাদা ইন্সপেক্টর গাঙ্গুলির মুখোমুখি হলো।

“ কি চেনা যাচ্ছে? “

“ আরে ঘন্টাদা যে!  কি ব্যাপার আপনি এখানে? “ ইন্সপেক্টর এক রাশ বিস্ময় নিয়ে করমর্দন করলো ঘন্টাদার সাথে। 

“ দু তিন দিনের ছুটি নিয়ে এখানে ঘুরতে চলে এলাম। কিন্তু এখানে এসে যে আপনার সাথে এরকম একটা ঘটনায় আবার দেখা হয়ে যাবে সেটা ভাবতে পারিনি।“ 

“কি যে বলে ন! আপনার সাথে দেখা হলো মানে আমার সৌভাগ্য। “

“ নিউটাউন থানা থেকে কবে ট্রান্সফার হয়ে এই শান্তিনিকেতন থানায় এলেন?” ঘন্টাদা কথা বলতে বলতেই ন্সপেক্টর গাঙ্গুলিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। দূর থেকে দেখলাম ইন্সপেক্টর খুব মন দিয়ে ঘন্টাদার কথা শুনছেন আর মাথা নাড়াচ্ছেন। খুব উত্তেজিতও দেখাচ্ছে। আমি এগিয়ে গেলাম। আর তখনই ইন্সপেক্টর“ আমি সব ইনফরমেশন বার করছি। আপনি ভাববেন না। বিদায়।“ এই বলে বিদায় নিলেন।

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ঘন্টাদা বলল –“ চল। আমাদের কটেজে ফিরি। ভোর হতে চলল। কিছুক্ষণ গড়িয়ে নিতে না পারলে কাল শান্তিনিকেতন ঘোরাটা পণ্ড হয়ে যাবে।“

“কিন্তু ঘন্টাদা। এগুলো কি হচ্ছে। কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তুমি কিছু বুঝলে?”

“ অনেক মিসিং লিঙ্করে। জুড়ে আনছি। আবার ভেঙে যাচ্ছে। এখনও অনেক অন্ধকার। হাতড়াচ্ছি অনেক কিছু। কিন্তু সবটা পাচ্ছি না।“

“ কিছু তো সূত্র দাও। “

“ বিশুদা কি বলল খেয়াল করলি?”

“ হ্যাঁ। ওই ছাদের নেমে আসাটা। কি সব আজগুবি কথা বলল।“

“ ওখানেই তো জট পাকাচ্ছে। দেখা যাক। এখন চল।কাল কথা হবে।“

আর কথা না বলে আমাদের কটেজের দিকে পা বাড়ালাম। পূর্ব আকাশে একটু কি হালকা রঙ ধরেছে? একটা শিরশিরে ভোর ডানা মেলতে চাইছে দিগন্ত রেখায়। অন্ধকারের সব রহস্য কি আলোর ভিতরে লুকিয়ে থাকে? না মনে হয়। অন্ধকার মানে আলোর বিপরীত নয়। অন্ধকারের নিজস্ব জগত আছে।





“তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে নাও সবাই। আজ আমাদের বিশ্বভারতী ঘুরে দেখার কথা। কাল দুপুরের খাওয়া গল্পে এত দেরি করলে যে কাল এই প্রোগ্রামটা বাতিল করতে হয়েছিল। আজ কিন্তু কোন ভাবে এটা মিস করতে চাই না। “মৈত্রেয়ীর ভ্রমণের ব্যাপারে একটা ক্যাচলাইন আছে“ কোন কিছু যেন বাদ না যায়” সেটাই আর এক বার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিল।

আমরা সবাই ব্রেক ফাস্ট টেবিলে। কালকের ঘটনা নিয়ে সব টেবিলে টেবিলে আলোচনা চলছে। একটা চোরা আতঙ্ক সবার মনের মধ্যে রয়েছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। অনেক বোর্ডার দেখছিস কাল সকাল চেকআউট করে নিলেন। মুখে না বললেও তারা যে কোন রিস্ক নিতে চাইছেন না সেটা পরিস্কার। আজ রাতে যদি আবার কারো ঘরে ছাদ নেমে এসে বুড়ো আঙুল কেটে দিয়ে যায়! এমন ভৌতিক ব্যাপার কেউ কোনদিন আগে শোনেনি।

ঘন্টাদা অন্যমনস্ক হয়ে আছে। একটা কিছু প্রসেসিং যে চলছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। এই রহস্যের সমাধান না করে যে স্বস্তি পাবে না সেটা বলাই বাহুল্য। কাল রাতে কটেজে ফেরার সময়ই ছেলেমেয়েরা সবাই জেগে গেছিল। কাল রাতেই সংক্ষেপে সব বলেছি। আজ আবার বিস্তারিত বলতে হলো। শুনতে শুনতে সবাই বেশ গম্ভীর হয়ে গেছে। খাবারটা কারই তেমন নামছে না। শুধু কাল রাতে আমি যে বোকার মতন গোলদিঘির দিকে চলে গেছিলাম আর রীতিমতো ভয় পেয়েছিলাম সেটা শুনে সবার মুখে হাসি খেলে গেল। কিন্তু সেটা ওই এক বারই। সবারই মুখ ঝুলে গেছে। শুধু ঋভু একবার বলল “ বাবা ওই দাবার ছকের মতো ছাদটা কি একটু দেখতে পারি? “মৈত্রেয়ী সাথে সাথে না বলে দিয়েছে। ওই ভৌতিক কটেজে ছোট ছেলেকে সে কিছুতেই একা যেতে দেবে না। ঘন্টাদা চকিতে একবার ঋভুর দিকে তাকাল। তারপর সিগারেটের লম্বা টান দিয়ে আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বুঝলাম ঘন্টাদার মাথায়ও ঐ ছাদটা ঘুরছে।

গম্ভীর পরিবেশটা ভাঙতে আমি গতকালের খোয়াই নদী, খোয়াই এর পারে বসা হাট, বাউলদের গান এই সব নিয়ে গল্প শুরু করলাম। মেহুলি বলল তার বিশ্বভারতীর থেকে ও বেশি টানছে খোয়াই এর পারে বসে বাউলদের গান। কাল বাউলদের গানের সাথে ২৪ঘন্টা বৌদি,  মৈত্রেয়ী, মেহুলি সবাই গলা ও পা দুটোই মিলিয়েছে। আকাশ আর ঋক দুজনে খোয়াই এর দুপারের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে বসেছিল। আকাশ কোথা থেকে একটা বাঁশি যোগাড় করেছে এরই মধ্যে।  বসে বসে ও বাউল গান তুলছিল বাঁশিতে–

“ বলে কয়ে মানুষকে কি সাধক করা যায়! 

ও ভোলা রি মন আমার

ও খ্যাপা রি মন আমার

বলে কয়ে মানুষকে কি সাধক করা যায়! “

মগ্ন হয়ে ওগানটা তুলছিল বাঁশিতে আর সেই বাঁশির আওয়াজ খোয়াই নদীর তিরতির করে বয়ে যাওয়া জলে পড়ন্ত বিকেলের উদাসী হাওয়ায় অস্তগামী সূর্যকে পর্যন্ত গেরুয়া ধারী সন্ন্যাসী বানিয়ে দিয়েছিল। ঋক ক্যামেরায় সেই দৃশ্যবন্দি করতে করতে গেয়ে উঠেছিল আর একটা বাউল গান –

“তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো

যেতে দেব না। “

ছেলে বড় হয়েছে। কথা গান সব ইঙ্গিতবাহী হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। 

গল্প করতে করতে হেঁড়ে গলায় আমিও দু কলি গেয়ে উঠলাম –

“ সুজন মাঝিরে

কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও

আমার সুজন মাঝিরে

কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও

আমি পারের আশায়

বইসা আছি

আমায় লইয়া জাও

কোন ঘাটে

লাগাইবা তোমার নাও

সুজন মাঝিরে

কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও

এই পারেতে

দরদি নাই

ওই পারেতে চলো যাই

হয় না আমার পারে যাওয়া

হয় না আমার তোমায় দেখা

জল চলিয়া বইয়া যায়

কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও

আমার সুজন মাঝিরে

কোন ঘাটে লাগাইবা তোমার নাও।“

বাঃ চমৎকার হয়েছে। এবার তো ওঠো। তাড়া দিল মৈত্রেয়ী।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল ঘন্টাদা। “যে লাইনটা গানের মধ্যে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে সেটা আর একবার গা”। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলো ঘন্টাদা। 

“ওইতো। কোন ঘাটে লাগাই বা তোমার নাও। “আমি আর একবার গেয়ে দিলাম।

“নাও। মানে নৌকা। থ্যাঙ্কু প্রতিম। একটা জট ছাড়লো মনে হচ্ছে। শীঘ্রই চল। এখুনি অকুস্থলে যেতে হবে।“ ঘন্টাদা ছিটকে বেরল ডাইনিং হল থেকে। খাওয়া হয়েগেছিল বেশ কিছুক্ষণ আগে। তাই হাত মুখ ধুয়ে চটপট বেরিয়ে এলাম সবাই। এত তাড়াতাড়ি হাঁটছে ঘন্টাদা যে আমরা সবাই পিছুপিছু রীতি মতো ছুটছি।

“ কোথায় যাচ্ছি বলবে তো?” শিডিউল ঘোরা ছেড়ে কেথায় চলল ঘন্টাদা এটা রীতিমতো বিরক্তি তৈরি করেছে ২৪ঘন্টা বৌদির মধ্যে। মৈত্রেয়ীও খুশী নয় এভাবে হনহন করে হাঁটতে। আমার দিকে ভ্রুকুঞ্চিত করে তাকাচ্ছে। আমি রহস্যের গন্ধ পেয়ে রীতিমতো উত্তেজিত। ছেলেমেয়েরাও উত্তেজনায় ফুটছে।

ঘন্টাদা শুধু বলল “ ফলোমি”।

বেশ কিছুটা যাবার পর যে জায়গাটাই পৌঁছালাম সেটা সেই ৫৫ নম্বর কটেজ। বিশুদাদের কটেজ। কাল রাতের বেলায় ঠিক করে ঠাহর করিনি। আজ দিনের বেলায় দেখলাম কটেজের নাম সত্যজিৎ রায়ের গানের কথায় “ ভূতের রাজা দিল বর”।

“ বাঃ ভদ্রলোকের শিল্প সংস্কৃতির ছোঁয়া সর্বত্র “নামটা দেখে বলল মৈত্রেয়ী।

কটেজের কলিং বেল বাজাতে কেউ সাড়া শব্দ দিল না।

“ কেউ নেই মনে হয় ঘরে। “ ২৪ঘন্টা বৌদি বলল।

“ না থাকারই কথা। সবাই তো বিশুবাবুকে নিয়ে নার্সিংহোমে ব্যস্ত।“ ঘন্টাদা একটু ঠেলে দেখল দরজাটা। যদি তাড়াহুড়োই লক না করে যায়। কিন্তু সেগুড়ে বালি। বন্ধ।

“ একটাই উপায়। যদি ওদের গ্রুপের কেউ থাকে আশ পাশের কটেজে আর তাদের কাছে যদি চাবিটা রেখে যায়। “ ঘন্টাদা আইডিয়া দিয়ে নিজেই নেমে পড়ল খুঁজতে। আমরা সবাই আবার ঘন্টাদাকে ফলো করছি।

কিছুটা দূরে দূরে কটেজগুলো। পাশেরটার নাম “ কভি আলবিদা না কহেনা।“ সেখানেই সান্টুদার স্ত্রীকে পাওয়া গেল। ওনার শরীরটা খারাপ লাগছে বলে উনি আর বেরান নি। কটেজেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে চিনতে পারলেন। ঘন্টাদা রহস্যের উন্মোচন করবেন বলায় আগ্রহী হয়ে বিশুদার কটেজটা খুলে দিলেন।

ঘরে ঢুকেই আমরা সবাই ছাদের দিকে তাকিয়ে। বোঝার চেষ্টা করছি কি বিশেষত্ব আছে এই ছাদে। আগের রাতের চেয়ে বিশেষ নতুন কিছু চোখে পড়ল না। শুধু দাবার কোর্টটা আরও পরিস্কার করে দেখলাম। যেন মনে হচ্ছে দাবার একটা খেলার মাঝামাঝি কোন দৃশ্য। সাদা ও কালো ঘুঁটিগুলো বিভিন্ন পজিশনে দাঁড়িয়ে আছে।  আরও একটু ভালো করে দেখলাম। কালো ঘুঁটিগুলোকে অনেক আগ্রাসী দেখাচ্ছে। সাদা ঘুঁটিগুলো অনেক ডিফেন্সিভ পজিশনে।

“ দেখ দেখ ঘন্টাকাকু। এই বোর্ডে সাদা রাজা তো চেক মেট হয়ে আছে।“ ঋভু ছাদের বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল।

“ অ্যাবসোলিউটলি ঋভু! “ ঘন্টাদা কালকের ল্যাডারটা ঘরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল। 

এই কথায় আমরা সবাই আবার ভালো করে বোর্ডটা দেখলাম। এবার বুঝলাম। ঋভু ঠিকই বলেছে। সাদা রাজা নিজের পজিশন থেকে দু ঘর এগিয়ে এসেছে। আর সেখানেই মাত সে।

“ আরও খেয়াল করো ঋভু। কারা রাজাকে মাত করায় মুখ্য ভূমিকায় নিয়েছে।“ ঘন্টাদা জিজ্ঞেস করলো ঋভুকে।

“ দুটো নৌকা দু দিক থেকে চেপে ধরেছে রাজাকে।আর তাতেই মাত রাজা।“ চটপট উত্তর দিল ঋভু। গেমসের ব্যাপারে ঋভুর মাথাটা সবসময় ভালো খোলে। কম্পিউটার গেমস নিয়ে সব সময় তার মার সাথে তার ঝামেলা লেগেই আছে। 

“ ঠিক। কিন্তু তাতে কি বাবা?” আকাশ জিজ্ঞেস করলো এবার।

“এর সাথে আঙুল রহস্যের কি সম্পর্ক?” মেহুলিও যোগ দিল।

এতক্ষণ ঘরের অন্যান্য ইন্টেরিয়র ডিজাইন দেখছিল ২৪ঘন্টা বৌদি ও মৈত্রেয়ী। রহস্যের কথা শুনে আবার এদিকে ফিরে তাকাল।

“ ভালো করে দেখ ছাদটা। পুরো কংক্রীটের। নেমে আসার কোন সুযোগ নেই। “ ব্যাখ্যা শুরু করলো ঘন্টাদা। 

“ তাহলে ঘটনা ঘটছে কি করে? সাদা রাজার পজিশন টাদেখেছ। একদম বিছানার উপরে। ঠিক যেখানে বিশুদা মাথা রেখে শুয়েছিল। এটা আমি কালকেই খেয়াল করেছিলাম। যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে রাজা মাত। কিন্তু তাতে ছাদের নেমে আসাটা কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। আলোর রেখা মিলল আজ প্রতিমের গান শুনে – কোন ঘাটে লাগাই বা তোমার নাও”। কথা বলতে বলতে সিগারেটের ছাইটা অ্যাস্ট্রেতে ঝাড়ল ঘন্টাদা।

“ সেই নাও মানে নৌকাই এখানে আসল প্লেয়ার।“

“কি রকম?” জিজ্ঞেস করলো ঋক।

“ দেখ পুরো ছাদটা কখনো নেমে আসতে পারে না। তাহলে সেটা বেডে পৌছানোর আগেই অন্য জিনিসগুলোর সাথে ফাউল করবে। যেমন ওয়াল এসি, ওয়ার্ডরোব, ব্রোঞ্জের ভাস্কর্যটা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই পুরো ছাদটা দেখতে গিয়ে আমরা ধোঁকা খাচ্ছি।“

“ তার চেয়ে আমার যা ধারণা“ বলতে বলতে ঘন্টাদা ল্যাডারটা টেনে ঘরের একে বারে কোনায় নিয়ে গেল যার উপরে ঠিক কালো নৌকা বসে আছে।

“ এই নৌকার খোপটা খোলা যায়। দাঁড়া দেখি।“ ঘন্টাদা বেশ কিছুক্ষণ ওই খোপটাই হাত দিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলো তার পর একটু হতাশ হয়ে বলল “ অনুমান ঠিক। একটা সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা এই খোপ আর ছাদের বাকি অংশের মধ্যে রয়েছে। মানে এই খোপটা অন্য অংশের চেয়ে আলাদা। মানে খোলা যায়। কিন্তু এ পাশ থেকে খোলার কোন উপায় নেই।“

“তারমানে ওই অংশটাই খুলে কেউ এই ঘরে ঢুকেছিল বাইরে থেকে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।

“ তা না মনে হয়। কারণ বাইরে থেকে কেউ ঢুকলে কাজ করে এত তাড়াতাড়ি কেউ বেরোতে পারতো না। রঞ্জনাদি ঠিক দেখে ফেলতো। “

“তাহলে?”

“ আরও বড়ো কোন টেকনোলজি মনে হয় কাজ করছে এর পিছনে। রিমোট কন্ট্রোলড।“

“কিন্তু করছে কে? কে আছে এর পিছনে?  কি উদ্দেশ্য তার? ”সবাই এক সাথে প্রশ্ন করলাম ঘন্টাদাকে।

“ সেটাই সবচেয়ে দামি প্রশ্ন। আমার যেন মনে হচ্ছে কেউ পরীক্ষা নিচ্ছে আমাদের। বুদ্ধির পরীক্ষা।“

“ কিন্তু কেন? কি লাভ তার আমাদের বুদ্ধির পরীক্ষা নিয়ে? “ অধৈর্য হয়ে উঠছে ২৪ঘন্টা বৌদি।

“ বুদ্ধির পরীক্ষা অনেক হবে। এখন চলুন তো আমাদের বিশ্বভারতী ভ্রমণটা সেরেনি।“ আর অপেক্ষা করতে রাজি নয় মৈত্রেয়ী।

আমরা সবাই পা বাড়ালাম ঘরের বাইরে। ঘন্টাদাও নিমরাজী হয়ে চলল আমাদের সাথে। একবার ঘার ঘুরিয়ে দেখল কটেজটাকে। আহত বাঘের মতো লাগছে ঘন্টাদাকে।  চোখগুলো ওর জ্বলছে। বুঝতে পারছি এ যুদ্ধ আরও তীব্র হতে চলেছে। 

জীবনটা হলো এক  দাবা খেলার বোর্ড। সেই বোর্ডের একপাশে মানুষ আর একপাশে অমোঘ নিয়তি। আমরা আমাদের পছন্দের মতো চালদি। আর নিয়তি অলক্ষ্যে হাসে। তারপর নিয়তির চাল ফলাফল হয়ে ফিরে আসে। নিয়তির সাথে এই খেলা অনন্তকাল ধরে চলছে। শুধু মাঝে মাঝে মানুষটা বদলে যায়। যখন মানুষ চাল দেয় আর সেই চালে বেশীর ভাগ মানুষ মাত হয়ে যায় তখন সে নিজেকে ভাবে ঈশ্বর। তারপর যখন ঈশ্বরের চালটা ফিরে আসে তখন মানুষ বোঝে তার অস্তিত্বের অসারতা। এত সব জেনেও কিন্তু মানুষ দাবা খেলাটা চালিয়ে যায়। কারণ নতুন নতুন চাল নতুন নতুন সম্ভাবনার পৃথিবী খুলে দেয়। এই ভাবেই সময় এগিয়ে যায়। দাবা খেলাও চলতে থাকে। ঘন্টাদার আপাত হারে আমি কি দার্শনিক হয়ে পড়লাম। বেশি ভাবার সময় দিতে রাজি নয় গিন্নি। অগত্যা পা চালালাম। 



একটা বড় গাড়ি নিতে হয়েছে এক সাথে সবাই মিলে যাবো বলে। বিশ্বভারতীর আগেই ঘন্টাদা নেমে গেল। থানায় যাবে বলে। ইন্সপেক্টর গাঙ্গুলি ফোন করেছিলেন। বলেছেন অনেক খবর আছে। তাড়াতাড়ি আসুন। ঘন্টাদা কিছুক্ষণ পরে আমাদের সাথে জয়েন করবে বলে চলে গেল।

ভিতরে গাড়ি নিয়ে ঢোকা গেলনা। দুটো টোটো ভাড়া করতে হয়েছে। বিশ্বভারতীর ভিতরে ঢুকেই মনটা ভালো হয়ে গেল। চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি। তার মধ্যে বিভিন্ন ভবন। শিল্প, সাহিত্য,  সঙ্গীত সব একাকার। বাঙালীর যাকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই সেই রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া এখানে সর্বত্র। জাতি হিসাবে বাঙালীকে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছিলেন গুরুদেব। কিন্তু যতটা এগিয়ে নিয়ে গেছিলেন ততটাই আবার পিছিয়ে দিয়েছে তার মন্ত্রমুগ্ধ করা প্রতিভা। এতটাই মুগ্ধতা তাকে ঘিরে আপামর বাঙালীর যে নিজেকে আর ভেঙে চুরে নতুন করে এগিয়ে নিয়ে গেল না সে। এমনটাই বলে ঘন্টাদা। পাশে না থেকে ও ঘন্টাদা চিন্তার মধ্যে ঠিক রয়ে যায়।


কি কি সূত্র পেল ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে জানার জন্য উৎসুক হয়ে আছি। কিন্তু ঘন্টাদার দেখা নেই। আমাদের রবীন্দ্র মিউজিয়াম ইতিমধ্যে দেখা হয়েগেছে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে দেখলাম। রবীন্দ্র ব্যবহৃত সমস্ত জিনিসের মধ্যেই একটা রুচির ছাপ স্পষ্ট। দেখতে দেখতে নোবেল রাখার জায়গাটাই এসে নোবেলটা না দেখতে পেয়ে মনের ভিতরটা হুহু করে উঠল। কারা যে চুরি করে। কি পায় এমন একটা গর্বের জিনিস চুরি করে কে জানে। ঘন্টাদা অবশ্য মজা করে বলে কোন বিখ্যাত সাহিত্যিকই এটা কায়দা করে সরিয়েছে যাতে বাঙালীর কাছে সাহিত্যে আর একটা নোবেল প্রাইজের তীব্র ইচ্ছা তৈরি হয়। মজা করে বললেও ঘন্টাদার কথা সব সময় চিন্তার পুষ্টি জোগায়। 

রবীন্দ্র মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে একে একে ছাতিমতলা, আম্রকুঞ্জ, শিল্পভবন, সঙ্গীতভবন, পাঠ ভবন, শিক্ষা ভবন, চীনা ভবন ইত্যাদি দেখে শেষে এলাম কলাভবনে। এই ভবনের আলাদা একটা আকর্ষণ আছে সবার কাছে। রামকিঙ্করের জীবন্ত ভাস্কর্য গুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।

“নোয়াখালী অভিযান” দিয়ে আমাদের অভিযান শুরু করলেও চোখ আটকে গেল রামকিঙ্করের বিখ্যাত ভাস্কর্য Mill call এর সামনে এসে। মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি আমরা সবাই। দুজন সাঁওতাল মহিলা ধান কলে কাজ করতে যাচ্ছে সঙ্গে তাদের শিশুপুত্র। মিলের বাঁশি শুনে এরা কাজে ছুটছে।একটা ছোট্ট ফ্রেমে কি অসাধারণ গতিময়তা আর কাহিনী বিন্যাস। মার কাছে ছেলের আবদার, ছুঁতে চাওয়া, মার স্নেহভরা ছদ্ম  উদাসীনতাএসব ছুঁয়ে গেল।


“ কিন্তু পাশের নারী চরিত্রটা কে এবং কেন বলতো?“ এর মধ্যে কখন যে ঘন্টাদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি। ঘন্টাদার মুডটা বেশ ফুরফুরে মনে হলো। তার মানে ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে যেটা চেয়েছিল সেটা পেয়েছে। পরে জেনে নেওয়া যাবে কি হলো। ঘন্টাদার কথায় ভাস্কর্যটা দেখার অ্যাঙ্গেলটায় চেঞ্জ হয়ে গেল। চটপট ফেসবুকে ভাস্কর্যটা পোস্ট করে মতামত চাইলাম। দেখি কে কি বলে।

“.....আচ্ছা এমন ভাবে যদি ভাবি.....তিনি সাঁওতালি পরিবার , তাদের  জীবন যাত্রা , তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন যুদ্ধের মধ্যে মিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আর এক চিরকালীন মমতার টানাপড়েন....দেবকী আর যশোদা র কাহিনী......আমার কল্পনায় আমি এই ভাবেই দেখি না কেনো.....” চমৎকার কমেন্ট করেছে প্রদীপ কাকু। আকাশ চেচিঁয়ে জানাল। ও পোস্টটা ফলো করা শুরু করে দিয়েছে। 

“ শিশু পুত্রের পরিপ্রেক্ষিতে প্রদীপের ব্যাখ্যাটা বেশ যুত সই। কিন্তু আকাশ, দুই নারীর যে সখ্যতা এখানে দেখিয়েছে তাতে অন্যর কম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। “ আমি আরও প্রিসাইস হতে চাইলাম।

ঘন্টাদা আমার কথায় সায় দিয়ে বলল-

“একটা জিনিস খেয়াল করে দেখো দুই নারীর পায়ের পজিশন টা। একি জায়গায় একজনের ডান পা আর একজনের বাঁ পা। তারমানে এই হাঁটার ছন্দে একজন আরেকজনকে কমপ্লিমেন্ট করছে। কিন্তু সৈন্যদলের হাঁটার যান্ত্রিকতা এটার মধ্যে নেই।

দুই নারী হাত ধরে হাঁটছে। স্টেপ্ একসাথে।  একটা আত্মিক সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত রয়েছে।হাতটা যেভাবে ধরা আছে তার মধ্যেও মনে হয় একটা ইঙ্গিত আছে।“


“একই নারীর দুটিস্বত্তা কি?” মেহুলিবলল।

পাশের মহিলার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোটা  দেখে কি মনে হচ্ছে?নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম।

“আমি একেবারেই অর্বাচীন। তবু মনে হল প্রতিটি কর্মরতামা তার মনের অর্ধেক অংশকে বাড়িতে তার শিশুসন্তানের কাছে ফেলে কাজে দৌড়ন। কর্মস্থলে ব্যস্ত থাকলেও তার মন পড়ে থাকে বাড়িতে। যে নারী সংসার প্রতিপালনের জন্য সটান হাঁটছেন তার মন কাঁদছে দুধের বাচ্চাকে একা রেখে যাচ্ছেন বলে। তাই পিছন ফিরে চাওয়া”। নীলাঞ্জনা আন্টিকমেন্ট করেছে ফেসবুক পোস্টটা ফলো করতে করতে আবার জানাল আকাশ। 

“বাঃ। ভালো বলেছেন উনি। কর্মরতা নারীর সংসার ও কর্মক্ষেত্রের যে টানাপড়েন তা যদি শিল্পীর চোখ দিয়ে দেখতে হয় তাহলে এর চেয়ে সহজ সরল মরমী চিত্রকল্প আছে বলে আমার জানা নেই। তবে রামকিঙ্কর যদি এটা ভেবে করতেন তাহলে নিশ্চয় শিশুটাকে কোনভাবে দুই নারীকেই ছুঁয়ে রাখতেন। “সিগারেট ধরাতে গিয়েও ধরালো না ঘন্টাদা কারণ ততক্ষণে টোটোর ড্রাইভার একগাল হেসে তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে শুরু করেছে–“ আরে ও হলো মাসি। শোনেন নি মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। “

“বাঃ মন্দ বলেন নিতো।“ আমার মনে ধরল ব্যাখাটা। কিন্তু ঘন্টাদা দেখলাম হঠাৎ তড়িৎ গতিতে টোটো ড্রাইভারের হাত ধরে টানতে টানতে টোটোর দিকে ছুটছে। “শীঘ্রই চলো সবাই। আমাদের এখনই বনবিতানে ফিরতে হবে।“ ঘন্টাদার আপাত ঠাণ্ডা কন্ঠস্বরের মধ্যেও ঠিক বুঝতে পারলাম আবার উত্তেজনার ঘোড়দৌড় শুরু হলো।

২৪ঘন্টা বৌদিও আমার গিন্নি যারা পরানাই এই ঘোড়দৌড়ে ভাগ নিতে রাজি নয়। কারণ কালকে কলকাতায় ফিরে যাওয়া। আজ সব কিছু দেখে মার্কেটিং ও কমপ্লিট করতে হবে। তাই ওরা থেকে গেল। ছেলেমেয়েরা সবাই ঘন্টাদার পিছন পিছন দৌড়াল। ওরা আবার অ্যাডভেন্চারের গন্ধ পেয়েছে। আমি পড়লামম হাফাঁপরে। কুল রাখি না শ্যাম রাখি। শেষ পর্যন্ত আমার ক্রেডিট কার্ড তার হাতে দিয়ে কুল রাখলাম। তারপর এক দৌড়ে টোটোতে। কারণ শ্যামকে তো আমি ছাড়তে পারবো না।




ঘন্টাদাকে এমন আক্ষেপ কখনো করতে দেখিনি। টোটো থেকে নেমে গাড়ি। তারপর সোজা বনবিতান রিসর্ট। এর মধ্যে টোটোর ড্রাইভারকে প্রচুর প্রশংসা করলো তার কমন সেন্সের জন্য। ভাড়া দিলো ডবল। টোকেন অব অ্যাপ্রিশিয়েশন। বনবিতানের গেট দিয়ে ঢুকলো রুদ্ধশ্বাসে। তারপর সোজা সেই ৫৫ নং কটেজ।

গাড়িতেই আমরা আর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছি –“ কি হলো ঘন্টাদা?  হঠাৎ ক্ষেপে উঠলে কেন? কিছু কি আলোর রেখা পেলে? “

“ বুঝতে পারছি না এটা আমার মিস হলো কি ভাবে! “ আক্ষেsপ ঝরে পড়ছে ঘন্টাদার কথায়।

আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি অবাক হয়ে। ঘন্টাদা আবার বলতে শুরু করলো –

“ ওই যে বলল না বাংলা প্রবাদ। মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি। ওটাই আমি মিস করে গেছি।“

“মানে কি বাবা। খুলে বলো না।“ মেহুলি বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বলল।

“ এখানে মা কে ? মাসিই বা কে? “ সচারচর প্রশ্ন করে না ঋক। সাইলেন্ট লার্নার। কিন্তু এবার করলো।

“ ওই বিশুদার কটেজের ছাদে যে দাবার ছক রয়েছে তাতে রাজা কে মাত করছে দুটো নৌকা। মা হচ্ছে প্রথম নৌকাটা। যেটা একদম কর্ণারে রয়েছে। যেটা পরখ করে দেখলাম। বুঝতে পারলাম ওখানে একটা সারফেস ডিফারেন্স আছে। কিন্তু খুলতে পারলাম না ও ইস্ল্যাবটা।আমি নিশ্চিত ওই স্ল্যাবটা রিমোট কন্ট্রোলড। পুলিশ ডেকে ভেঙে দেখতে পারতাম। কিন্তু কিছু পাওয়া যেত না। কারণ ওটা খালি খোলা যায় বাকি সব অ্যারেঞ্জমেন্ট বাইরে থেকে এসেছে। সকালে বাইরে বেরিয়ে আমি ওটাই দেখলাম। তাই পুলিশ ডেকে কোন লাভ নেই। ভেবে দেখ একটা আঙুল কাটা হয়েছে। খুন কিন্তু করা হয়নি। আবার সেটা করা হয়েছে খুব কায়দা করে। কিভাবে করা হয়েছে তার ইঙ্গিতও রাখা হয়েছে। তার মানে শাস্তি দেওয়া হলো। তার সাথে একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো। বুদ্ধির পরীক্ষা। “

“ কিন্তু“মাসি”এখানেকে?” অধৈর্যহয়েউঠেছেমেহুলি।

“ দ্বিতীয় নৌকাটা। ওটা ঘরের গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন জায়গায় রয়েছে। তাই ওটাকে দেখিনি। কিন্তু আমার ধারণা ওটার মধ্যেই পাওয়া যাবে আসল ক্লু। তাই আমাদের প্রথম কাজ ছাদের দ্বিতীয় নৌকার জায়গাটা দেখা। “ঘন্টাদা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল।

“সেটা তো আমরা চার জন মিলে দেখে নিয়েছি বাবা। সকালে যখন তোমরা বিশুকাকুর কটেজ থেকে বেরিয়ে গেলে তখনই আমরা চটপট ল্যাডারটা লাগিয়ে দেখে নিয়েছি।“ এই প্ থম বাবা বলার আগেই কিছু করে দেখিয়েছে বলে গর্ব অনুভব করলো আকাশ।

“ বাঃ গুড। তোকি দেখলি? “

“ তেমন কিছু নয়। যেমন কংক্রীটের ছাদ হয় তেমনই। সারফেসে কোন ডিফারেন্স নেই। তবে...” একটু থামল আকাশ।

“ তবেকিআকাশ? “

“ যে নৌকাটা ওখানে আঁকা আছে সেই নৌকার গায়ে একটা কটেজ ছোট্ট করে আঁকা আছে। হঠাৎ করে দেখে বোঝার উপায় নেই। তবে খুব কাছ থেকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে। এর কি কোন তাৎপর্য আছে বাবা? ”জিজ্ঞেস করলো আকাশ।

“ নৌকার গায়ে কটেজ! “ বিড়বিড় করে উঠল ঘন্টাদা। “ কোন ঘুঁটির গায়ে কিছু নেই। হঠাৎ এর গায়ে কটেজ কেন? যা বলেছিলাম এটাই একটা ক্লু। অন্য কোন একটা কটেজের কথা বলছে।“

“ কোন কটেজ ঘন্টাকাকু” ঋভুর সাথে সবাই উৎসাহিত হয়ে উঠেছে এবার।

“ ওই বিশু বাবুর কটেজের আশে পাশেই কোন একটা হবে। কিন্তু কোনটা?” ঘন্টাদার সাথে আমরাও ভাবতে থাকলাম।

“ নৌকার সাথে রিলেটেড কটেজ। “ আবার বিড়বিড় করছে ঘন্টাদা “ রিলেশন... রিলেশন..নামে? কিন্তু ওখানে তো সব গানের লাইন দিয়ে নাম। সেখানে নৌকা কোথায়? চল গিয়ে দেখি।“

তারপর গাড়িতে একটাও কথা হয়নি। সবাই মনে করার চেষ্টা করলাম কটেজগুলোর নাম। শেষ পর্যন্ত বিশুদার কটেজের একটা কটেজ পরেই পাওয়া গেল সেই কটেজ যার নাম “রুক জানা নহি”। ঘন্টাদাই বলল নৌকা এখানে ইংরাজিতে রুক হয়ে গেছে। 

অদ্ভুত ভাবে এই কটেজে কেউ নেই কিন্তু একটা দরজা খোলা। যেন মনে হচ্ছে কেউ আমাদের আসার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ঘন্টাদার ঠোঁটে মৃদু হাসি বুঝিয়ে দিল আমার অনুমান ঠিক। দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম কোথাও কিছু নেই। একদম খালি ঘর। শুধু সামনের দেওয়ালে প্রথমে তিনটে ছবি পরপর। প্রথমে একটা হারমোনিয়াম যার বাঁদিকের কর্ণারে স্কেল দেখা যাচ্ছে G*। আর বাঁদিক থেকে চতুর্থ ব্লাকস্টিকটা (রিডটা) প্রেস করা অবস্থায় আছে। দ্বিতীয় ছবি একটা গরুর ছবি। আর তৃতীয়টা বিখ্যাত কমিক সিরিজ টম এন্ড জেরির টমের ছবি। ছবিগুলোর নীচে একটা লাইন লেখা-

“ মেঘদূত সান্টার দাদা”

তার নিচে একটা নাম্বার –৫৩২৪১২৩৪২৯৯।

“এগুলো কি কিছু বলছে ঘন্টাকাকু?” ঋক জিজ্ঞেস করলো।

ঘন্টাদা বলার আগেই মেহুলি বলে উঠল “হারমোনিয়ামের ‘সা’ রিডটা প্রেস করা আছে“। আকাশ বলল “তাহলে গোরু মিলিয়ে হলো সা-গো”। “ আর শেষে ‘টম’। মানে সা-গো-টম। মানে স্বাগতম! “ ঋভু চটপট মিলিয়ে দিয়েছে। 

“তাহলে কাকে স্বাগতম জানানো হলো?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“ মেঘদূত সান্টার দাদা এই লাইনটার শব্দগুলোর দ্বিতীয় অক্ষর গুলো নিয়ে দেখ! “ ঘন্টাদা মৃদু হেসে বলল।

“ আরে তাই তো। ঘন্টাদা। মানে ছবি আর লাইনগুলো জুড়ে হলো স্বাগতম ঘন্টাদা। তার মানে কেউ জানে তুমি এই ঘরে আসবে?“ আমি বেশ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“ আমাদেরকে একটা বিশেষ দিকে চালিত করা হচ্ছে। কিন্তু কোন দিকে?  কেনই বা করা হচ্ছে? “ ঘন্টাদাকে একটু চিন্তিত দেখাল।

“ তাহলে ওই নাম্বারটা কি ইঙ্গিত করছে? ৫৩২৪১২৩৪২৯৯।?” আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।

অদ্ভুত নাম্বার।১১ ডিজিটের। তার মানে মোবাইল নাম্বার নয়। তাহলে? নাম্বারটা ভাবাচ্ছে সবাইকে।

“নাহ্। কিছু তো বেরচ্ছে না মাথা থেকে। এখানেই কি থেমে যাবে আমাদের অভিযান? “ আকাশের উৎকন্ঠা আমাদের সবার মধ্যে।

আর একটা সিগারেট ধরাল ঘন্টাদা। এই নিয়ে দু নম্বর। ধোঁয়ার রিং ছোটর থেকে বড় হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। একটা রিঙের পিছনে আর একটা রিং। তার পিছনে আর একটা রিং। একের পর এক রিং তৈরী হচ্ছে। রিং মাস্টারের সিগারেট শেষ হতে চলল কিন্তু নাম্বার টারর হস্যভেদ করা যাচ্ছে না। ওটা যেন আমাদের কে দেখে মিটিমিটি হাসছে। নিঃশব্দে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বাঙালীর মেধাকে। ঘন্টাদা শেষটান দিয়ে সিগারেটের টুকরোটা যেই ফেলে দিল ঠিক সেই সময় চেচিঁয়ে উঠল ঋক।

“ দেখ ঘন্টাকাকু ওই নাম্বারটাই তিন নম্বর, ছয় নম্বর আর নয় নম্বর ঘরের প্রত্যেকটাতেই ২ সংখ্যাটা রয়েছে। “ আবিষ্কারের উত্তেজনায় ফুটছে ঋক।

“ ঠিক ধরেছিস ঋক। ২ ইংরাজিতে To ও বলা যায়। তাহলে বাকি নাম্বার গুলো হলো ৫৩, ৪১, ৩৪ও৯৯।“ ঋকের চুলটা নেড়ে দিয়ে বলল ঘন্টাদা।

“ আর এই কটেজের নাম্বার ৫৩। তার মানে এগুলো কটেজের নাম্বার” আকাশও ডিকোড করা শুরু করে দিয়েছে। 

“ একদম ঠিক। এখুনি চলো। কুইক। ৫৩to ৪১to ৩৪ যাবো। তারপর সেখান থেকে ৯৯।“ ঘন্টাদা বলেই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে পড়ল। আমরা নিঃশব্দে ফলো করলাম। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চ কর হয়ে উঠেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা কি হতে চলেছে সেটা বুঝতে পারছি না। ঘন্টাদা কি বুঝতে পারছে? কে জানে।

ঠিক ঠাকই আমরা এসেছি। ৫৩ থেকে ৪১ হয়ে ৩৪। কিন্তু গোল বাঁধলো ৯৯ নিয়ে। এই নাম্বারে তো কোন কটেজ থাকার কথা নয়। কারণ মোট কটেজ তো ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে। তাহলে? 

আবার উদ্ধার করলো ঘন্টাদা। “ ওই দেখ। রাস্তার নাম্বার টা ৯৯। ওটা ধরেই যেতে হবে।“

৯৯ নাম্বার রাস্তা ধরে সোজা হাঁটছি। চারপাশে জঙ্গল ঘন হতে শুরু করেছে। এদিকটা উত্তর পশ্চিমের শেষ বিন্দু মনে হচ্ছে। দুপুরবেলায়ও সূর্যের আলো বেশি ঢুকতে পারছেনা এখানে। কেমন ছায়া ঘন জায়গাটা। রিসর্টের বাকি জায়গা থেকে একদম আলাদা। এখানে কোন পরিচর্যার ছাপ নেই। প্রচুর শুকনো পাতা চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। বেশ কয়েকটা বটগাছ ঝর্ণার মতো ঝুড়ি নামিয়েছে সারা গা জুড়ে। তাকে জড়িয়ে এমন করে বন্য লতাগুলো উঠেছে যে সেগুলো সাপ না লতাপাতা সেটা নিয়ে মাঝেমাঝে দৃষ্টি ভ্রম হচ্ছে। হটাৎ শুকনো পাতায় খসখস আওয়াজে চমকে উঠে পাশে তাকাতেই এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখ তাকিয়ে আছে দেখলাম।

“ ঘাবড়াবেন না। ওগুলো বন বিড়াল। কিছু করবে না। “ আশ্বস্ত করলো ঘন্টাদা। 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা রাস্তার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে গেছি। ঘন্টাদা হঠাৎ আমাদের সবাইকে থামিয়ে দিল। আঙুলের ইশারায় চুপ করতে বলল। তারপর আঙুল তুলে বাঁদিকের অদ্ভুত গড়নের কটেজটার দিকে দেখাল। দুটো৯ যেন পরস্পর জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। রুক জানা নহি কটেজের দেওয়ালের শেষ দুটো নাম্বার মনে পড়ল ।৯৯। তাহলে ঠিক জায়গায় এসেছি। একটা বিশাল বটগাছ পাশ থেকে উঠে কটেজটার মাথার উপর ছাতার মতো ছড়িয়ে গেছে। চারপাশ জুড়ে বটের ঝুড়ি নেমেছে অজস্র। কটেজটা কে দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছর ধরে কোন মুনি ঋষি ধ্যান করছে। কোন এক অজানা জ্ঞানের সন্ধানে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। সামনে ঘন্টাদা। পিছনে ছেলে মেয়েরা। সবার পিছনে আমি। অখণ্ড নিস্তব্ধতা চারিদিকে। কোন কিছুর জন্য যেন প্রহর গুনছে সবাই। হৃৎপিণ্ডটা হাতুড়ির মতো পিটছে ভিতরটা। দেখতে দেখতে দরজার সামনে পৌঁছলাম আমরা। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কি করা যায় ভাবছি। এমন সময় স্লাইড করে দু পাশে সরে গেল দরজার দুই পাল্লা।





মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মাথার ডানদিকটাই প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চেতনের কোন অতল স্তর থেকে যেন ভাসতে ভাসতে উঠছি। কোথায় আছি আমি। কোথায়?  কোথায়? বারবার প্রশ্নরা ধাক্কা মারছে স্নায়ু তন্ত্রে আর সারা মাথা জুড়ে যেন ডেটা স্ক্যান হচ্ছে। কোন একটা হরিণ প্রাণ ভয়ে ছুটছে মনে হচ্ছে। আরে ওই তো একটা তীরন্দাজ চোখ বন্ধ। আকাশের দিকে মুখ করা। তীর নিশানা করছে হরিণটার দিকে। হরিণটা প্রাণপনে ছুটছে। তীর ছুড়ল তীরন্দাজ। তীর আর হরিণের গতির এক অসম যুদ্ধ। তারপর!  তীব্র আর্তনাদ। গগন ফাটান হাহাকার। দুমড়ে মুচরে উঠল ভিতরটা। খুব দ্রুত ভেসে উঠছি গভীর খাদ থেকে। আর দ্রুত ছায়াছবির মতো দেখতে লাগলাম ঘটে যাওয়া অতীত।

দরজা দিয়ে আমরা ঘরের ভিতরটাই ঢুকতেই মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা। মানে আমরা ট্রাপড। মনে হলো আমার। ঘরটা হালকা নীলচে আলোয় ভরে আছে। খুব মৃদু একটা শিনশিনে শব্দ হচ্ছে চারপাশ থেকে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম দেওয়াল গুলোর দিকে। আর চমকে দেখলাম দেওয়াল জোড়া সেই মুর‍্যাল। সেই হরিণ শিকারের কাহিনী। তার মানে!  ভাবার দরকার পড়ল না। একটা গমগমে আওয়াজে ভরে গেল ঘরটা।

“ওয়েলকাম ঘন্টাদা! ওয়েলকাম বন্ধুরা!আমার অনেক দিনের অপেক্ষা মনে হচ্ছে আজ শেষ হতে চলেছে। “ 

আমরা চমকে তাকিয়ে দেখলাম হাসতে হাসতে নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত দুটো বুকের সামনে জড়ো করে এগিয়ে আসছেন আর কেউ নয়, এই রিসর্টের মালিক মহেন্দ্র ইন্দু ট্যান্ডন। ঘন্টাদার মুখে চমকের বদলে মৃদু হাসি দেখলাম।

“ অনেকটা কষ্ট দিতে হলো আপনাদের। কিন্তু কিছু করার নেই আমার। এটুকু করতেই হতো আপনাদের সাথে। না হলে বুঝব কি করে বলুন আপনারা সত্যিই পান্না কিনা। আর আমার চেতনার রঙে সেই পান্নাগুলো সবুজ হয়ে উঠবে কিনা! কি ঘন্টাদা তাই তো!”

আমরা সবাই হতচকিত। ভদ্রলোক কি বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। শুধু ঘন্টাদা দেখলাম খুব স্বাভাবিক গলায় বলল –

“একটা সিগারেট ধরাতে পারি?”

“ও নিশ্চয়। আজ আপনারা আমার পরম অতিথি। আপনারা আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। আপনাদের যেটা ভালো লাগে সেটা তো আমাকে দেখতেই হবে।“

সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়ার রিংটা হাওয়ায় ছেড়ে দিয়ে ঘন্টাদা বলতে শুরু করলো-

“ রিসেপশনে আপনার ওই চার দেওয়াল জোড়া মুর‍্যাল দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। তীরন্দাজ একজন যুবক। কিন্তু গঠনে আপনার যুবক বয়সের ছাপ আছে। ভালো করে দেখলে চতুর্থ দেওয়ালে যেখানে হরিণ তীর বিদ্ধ সেখানে তীরন্দাজ মাথা ঝুঁকিয়ে হাত চেপে ধরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আছে। তার ঘাড়ের কাছে একটা লম্বা কাটা দাগ। আর দাগটার মাথায় একটা ফুটকি। ইংরাজির‘ i ‘ এর মতো। সেটা আপনার ঘাড়েও দেখেছি। যখন আপনি টার্ন নিয়ে পিছনে ঘুরলেন। কিন্তু খটকা লাগলো ঐ দৃশ্যটাই। তীরন্দাজ হরিণ শিকার করেও হাত চেপে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তীরন্দাজ দারুণ ধনুর্ধর। চোখ বন্ধ করে নিশানা করেছে। এতটাই পারদর্শী সে। তাহলে? তখনই চোখে পড়ল হরিণ যেখানে ভূপতিত ঠিক তার পাশের জলাশয়ে এক দাড়িওলা বৃদ্ধের ছায়া। আকাশে মেঘেদের যে সন্নিবেশ তাতে বৃদ্ধের শেপটা ঠিক আসছিল না। কিন্তু জলাশয়ের কিঞ্চিত তরঙ্গে সেই মেঘের ছায়াগুলো জুড়ে বৃদ্ধমূর্তি স্পষ্ট। দারুণ পেন্টিং। সেই বৃদ্ধমূর্তি যেন দ্রোণাচার্যকে মনে পরিয়ে দিল। আর পুরো ঘটনাটা যেন একলব্যের হাহাকার করা গুরুদক্ষিণা। বুঝলাম একটা গভীর যন্ত্রণার যোগ আছে আপনার সাথে।“ সিগারেটের ছাই ঝাড়ল ঘন্টাদা। 

“ তারপর তীরটার ওই রকম ভাবে অবস্থান। হরিণকে ফুঁড়ে আরও এগিয়ে যাচ্ছে। আগুনরঙ পিছন দিকটাই। যেন একটা অতৃপ্তির আগুন জ্বলছে।“ ঘন্টাদা বলে চলেছে। আর মহেন্দ্রবাবু সম্মতি সূচক মাথা নাড়ছেন। মুখে মৃদুহাসি। আবারও মুখ খুলল ঘন্টাদা। আমরা অবাক হয়ে শুনছি।

“এখানে খোঁজ খবর করে আপনার বিশ্বভারতীতে পড়তে আসা জানতে পারি। আরও জানতে পারি সেখানে অধ্যক্ষের একমাত্র মেয়েও আপনার সাথেই কলাভবনে পড়তেন। সেখান থেকেই আপনাদের পরিচয় আর গভীর প্রেম। সেই মেয়ের নাম ছিল ইন্দ্রাণী। সেই ইন্দ্রাণীই আপনার হৃদয়ের ইন্দু। ঠাকুরমার ইন্দর ডাকের ব্যাপারটা যেটা আপনি শুনিয়েছিলেন সেটা হতেও পারে নাও হতে পারে।“

“ না না ঠাকুরমাও আমাকে ওই নামেই মানে ইন্দু বলেই আদর করে ডাকতো। “ মহেন্দ্রবাবুর গলাটা যেন একটু ধরে এসেছে মনে হলো।“ আমি ঠিক লোকই নির্বাচন করেছি ঘন্টাদা। জানি আপনি এগুলো ঠিকই ধরতে পারবেন। আর তাতে আমার কাজের সুবিধাও হবে।“

“ ঠিক লোক নির্বাচন,  আপনার কাজের সুবিধা এগুলোর মানে কি? “ আমি আর কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম। ভদ্রলোক কে কেমন রহস্যময় মনে হচ্ছে। 

“ জানবেন,  জানবেন। এত তাড়াহুড়ো কিসের। তার আগে জানি ঘন্টাদা আর কি কি জেনেছেন আমার ব্যাপারে। “ চোখ নাচিয়ে মহেন্দ্রবাবু বললেন। ঘন্টাদাকে আর একটু বাজিয়ে দেখে নিচ্ছেন মনে হলো।

“ঐ ইন্দ্রাণীর সাথে সম্পর্কের জন্যই আপনাকে বিশ্বভারতী ছাড়তে হয়েছিল। বিশ্বভারতীর রেজিস্টারে তৃতীয় বছর থেকে আপনার নাম আর নেই। তবে শিল্পকলার উপর আপনার যে বিশেষ টান তা আপনার শিল্প কীর্তি দেখেই বোঝা যায় আর সেই জন্যই বিশুবাবুর উপর এত রাগ আপনার। সেদিন কে রিসেপশনে বিশুবাবু আপনার মুর‍্যালটা দেখে যে ধরনের অশ্লীল মন্তব্য করেছিল সেটা আপনি মেনে নিতে পারেন নি। ওনাকে শাস্তি দিয়ে ছিলেন ওর বুড়ো আঙুল কেটে। তবে তার আগেই আপনার টার্গেট হয়েগেছিলাম আমরা। আমাদের ছেলেমেয়েদের ঘরে পেন্টিং এর মাধ্যমে যে ওয়েলকাম মেসেজগুলো দিচ্ছিলেন তাতে পরিস্কার আপনি ইচ্ছে করেই আমাদের বুদ্ধির পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আর সেটা করছিলেন লেটেস্ট টেকনোলজি প্রয়োগ করে। ওই ওয়াল গুলো সবই ছিল লেটেস্ট কোয়ার্জ টেকনোলজির যার ফিনিস কমন দেওয়ালের মতো। দেখে বোঝার উপায় নেই কিন্তু সবগুলোই এক একটা কোয়ার্জস্ক্রীন। যাতে রিমোটলি আপনি যা ইচ্ছে ডিসপ্লে করতে পারেন। সেটাই করেছেন আপনি প্রত্যেক দেওয়ালে। ছাদে। আর আমাদের বুদ্ধির পরীক্ষা নিয়ে চলে ছেন। কিন্তু কেন সেটাই রহস্যের। আমার ধারণা প্রত্যেকটা কটেজের ছাদই ডিসপ্লেসবল। আর আপনি খুব সম্ভবতঃ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেনস ব্যবহার করেছেন ঐ অপারেশন থাম্বস্ডাউন প্রসেসটায়।“

ঘন্টাদা একনাগাড়ে যা বলে গেল তাতে বুঝতে পারলাম ভয়ঙ্কর এক প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি এবার ঘন্টাদা। যার পদক্ষেপ হয়তো বুঝতে পারছে ঘন্টাদা। কিন্তু মোকাবিলা করবে কি ভাবে। কি যে করতে চলেছেন ভদ্রলোক সেটাই এখনো পরিস্কার নয়। তবে ওনার খপ্পরে যে পড়েছি সেটা পরিস্কার বুঝতে পারছি। 

“ অনেকটাই জেনে ফেলেছেন কিন্তু পুরোটা নয়।“ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন মহেন্দ্রবাবু। এবার বসলেন। আমরাও যে যার মতো চেয়ার টেনে বসলাম। আকাশ, মেহুলি,  ঋক, ঋভু সবাই দেখলাম অধীর আগ্রহে টানটান হয়ে বসে পড়ল। চোখে মুখে উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট। 

“ এটা দেখুন” এই বলে ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা রিমোট বের করে হলুদ একটা বোতামটা টিপলেন আর তাতেই সামনের টেবিলের উপরের একটা অংশ কিছুটা উপরে উঠে পাশের দিকে সরে গেল আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো অদ্ভুত ছোট্ট একটা যন্ত্র যার দুটো ছোটছোট পা। উপরে একটা চক্র ঠিক বিষ্ণুর চক্রের মতো ঘুরছে। সবাই হাঁ হয়ে দেখছি ব্যাপারটা কি। ঠিক তখনই উনি রিমোটের সবুজ বোতামটা টিপলেন আর সেই বিষ্ণুর চক্র প্রচণ্ড জোরে ঘুরতে ঘুরতে নীলচে আলো ছড়িয়ে তীক্ষ্ণ বাঁশীর মতো আওয়াজ করে বোঁকরে আমাদের সবার গলার সামনে দিয়ে ঘুরে টেবিলের ফ্লোটিং ডিস্কটার উপর বসে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় আর ওই চক্রটা একবার স্পর্শ করলে আমাদের কি হতে পারতো সেটা ভেবে গলা শুকিয়ে কাট হয়ে গেল। আমরা স্থানুর মতো ভয় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। বুঝতে পারলাম বিশুদার আঙুল কাটার রহস্য। 

“ আরে অত ভয় পাবেন না। রিল্যাক্স। রিল্যাক্স! “ হোহো করে হেসে উঠলেন মহেন্দ্র বাবু যেটা আমাদের একটুও ভালো লাগলো না।

“ আরে আপনাদের গলা আমি কাটছিনা। এটা কিছুই নয়। টেকনোলজি এখন কোন লেভেলে পৌঁছেছে সেটা একটু পরে আপনারা দেখতে পারবেন। এখন আর এগুলো ব্যবহার হয় না। পুরোটাই শব্দ দিয়ে হয়। অদৃশ্য শক্তি। আলোর কোন ব্যবহার নেই। পুরোটাই অন্ধকার। যাই হোক। এসব ছাড়ুন এখন। আমাকে পুরোটা জানতে গেলে আপনাদেরকে যেতে হবে অনেক অনেক কাল আগে। আমার কৈশোর ,আমার যৌবনে।“ মহেন্দ্রবাবু গুছিয়ে শুরু করলেন আবার।

“ ১৯৪৭ এ আমার জন্ম। বাবাদের তখন এক পা পাকিস্তানে এক পা ভারতে। বাপ ঠাকুর্দার বিশাল পারিবারিক জমিদারি পশ্চিম পাকিস্থানে। সেই ক্ষেত্রী পরিবারের ঠাটবাটই আলাদা। ঠাকুর্দা গান বাজনা চিত্রকলা সব খুব ভালোবাসতেন। একবার ঠাকুর পরিবারের আমন্ত্রণে কলকাতায় এসে আমার ঠাকুরমার সাথে আলাপ এবং আলাপেই প্রেমে পড়ে যান। আর বিয়ে করে একেবারে পশ্চিম পাঞ্জাবে নিয়ে যান। বাবাও জমিদারি চালানোর ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। উনিও MiT থেকে ডক্টরেট। নেহেরুর এক ডাকে পশ্চিম পাঞ্জাবের সমস্ত জমিদারিবেচে দিয়ে চলে আসলেন দিল্লী। মিনিস্ট্রি অব হেভি ইন্জিনিয়রিং এন্ড ইন্ডাস্ট্রীর টেকনিক্যাল ডাইরেক্টর  হয়ে। দেশকে নতুন করে গড়তে হবে। ফলে উনি ভয়ংকর ব্যস্ত থাকতেন কাজ নিয়ে। তার জন্য সারা বিশ্ব, সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন নতুন টেকনোলজি আনতে ও সেগুলো প্রতিষ্ঠা করতে। আর তার সাথে মাকেও ঘুরতে হচ্ছে সব জায়গায়। ফলে আমার শৈশব কাটলপুরোটাই ঠাকুরমার কাছে পাঞ্জাবে। ঠাকুর্দা ততদিনে মারা গেছেন।  তাই আমি হয়ে উঠলাম ঠাকুরমার নয়নের মনি। বাঙলা সংস্কৃতির সমস্ত কিছু উজাড় করে ঢেলে দিলেন তিনি আমার মধ্যে। আমি যে আমার গ্রাজুয়েশন বিশ্বভারতী থেকেই করবো সে স্বপ্ন ততদিনে আমার মধ্যে দৃঢ়ভাবে গেঁথেগেছে। বাঁধ সাধলেন বাবা। তার ইচ্ছে ছেলে তারই মতো MiT থেকে ডক্টরেট করবে এবং তারপর ভারতবর্ষকে টেকনিক্যাল ফিল্ডে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমার জেদ আর ঠাকুরমার প্রশ্রয় আমাকে বিশ্বভারতীতে নিয়ে এসেই ফেলল। “ মহেন্দ্রবাবু বলে চলেছেন আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি।

“ জানেন এসে এত ভালো লাগলো আপনাদের এই জায়গা,  এই চির সবুজ মাঠ, আপনাদের গান, চিত্রকলা, আপনাদের সংস্কৃতি, আপনাদের সাহিত্য যে মনে হলো আমি আমার স্বপ্নের দেশে এসেছি। ঠাকুরমার কাছ থেকে আগেই শিখেছিলাম রবীন্দ্রসঙ্গীত। কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে আমি যে গানটা গেয়েছিলাম সেটা আজও মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই সন্ধ্যা। গাছ তলায় খোলা মঞ্চে আমার গাওয়া গান শুনে শ্রোতারা বিমুগ্ধ হয়ে গেছিল-

‘এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল

দ্বার?

আজি প্রাতে সূর্য -ওঠা সফল হল কার?

কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে

আলোক ভরে-

ঊষা কাহার আশিসবহি হল আঁধার পার?।‘


বাউল রাগে, দাদরা তালের মূর্ছনায় যে সূর্যের অভিষেক হয়েছিল সেই প্রাতে তাকে দুহাত বাড়িয়ে বরণ করে নিল সমস্ত প্রকৃতি আর বাঙলার হৃদয়-


‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।

এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।

এসো অঙ্গে পুলকময়পরশে

এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে

এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়নে।।

এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত

এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত

এসোএসো হে বিচিত্র বিধানে।‘


জানেন সেই মঞ্চেই ঘটে গেল আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর অধ্যায়। আমার গান শেষ হতেই গেয়ে উঠল এক তন্বী শ্যামলবরণ কন্যা -


এসো গো, জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি

বিজন ঘরের কোণে, এসো গো।

নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা, কালো ছায়া ঘনায় বনে বনে।।

আনো বিস্ময় মম নিভৃত প্রতীক্ষায় যূথীমালিকার মৃদু গন্ধে

নীলবসন-অঞ্চল-ছায়া

সুখরজনী-সম মেলুক মনে।।

হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি,

আমি কোন্‌ সুরে ডাকি তোমারে।

পথে চেয়ে-থাকা মোর দৃষ্টিখানি

শুনিতে পাও কি তাহার বাণী–

কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে।।


সেই গানের রেশ ছড়িয়ে পড়লবহু দূর, হৃদয়ের গভীর সমুদ্রের তলদেশে ছড়িয়ে পড়ল তার অনুরণন,  স্নায়ু তন্ত্রে ঝংকার তুলে সে বলে গেল 

‘ মোর বীণা ওঠে কোন্‌ সুরে বাজি 

কোন্‌ নব চঞ্চল ছন্দে।

মম অন্তর কম্পিত আজি নিখিলের হৃদয়স্পন্দে॥

আসে কোন্‌ তরুণ অশান্ত, 

উড়ে বসনাঞ্চলপ্রান্ত,

আলোকের নৃত্যে বনান্ত মুখরিত ...’।  


আমি শিহরিত হলাম। আমার শিহরিত মন গেয়ে উঠল –


‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে

তোমারি সুরটি আমার মুখের 'পরে, বুকের 'পরে ॥

পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে--

নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে।‘


সেই দেখা,  সেই গান নিমেষে দুজন দুজনের হৃদয়কে কাছে টেনে নিলো। শান্তিনিকেতনের সবুজ প্রকৃতি, খোলা মাঠের হাওয়া, কোপাই এর মরমী স্রোত, কলাভবনের থামের আড়াল, গ্রন্থাগারের গভীর গাম্ভীর্য সব সব সেই নিবিড় প্রেমের সাক্ষী হয়ে থাকল। জানেন কি অদ্ভুত। ইন্দ্রাণীও আমার প্রথম পরিচয়ের পরেই আমাকে ইন্দু বলে ডাকতে লাগলো। ঠিক আমার ঠাকুরমার মতো। আবেগে মন ভরে গেল। আরও অদ্ভুত আমিও ওকে আদর করে ইন্দু বলেই ডাকতাম। দুজনেই দুজনকে ইন্দু বলে ডাকি, সে এক ভারী মজার ব্যাপার হতো।“ আবেগে কেমন বৃষ্টির মেঘের মতো লাগলো মহেন্দ্রবাবু কে। সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার সেই নরম স্পর্শ।


“ সে এক স্বর্গীয় সময়। সময় যেন ডানা মেলে দিয়েছে সূর্যোদয়ের রঙ মাখানো হলুদ সর্ষের ক্ষেতের উপর। কিন্তু সে আনন্দের আয়ুষ্কাল মাত্র দু বছর। অচিরেই চাউর হয়ে গেল সেই অনাবিল প্রেমের বাঁধ ভাঙা উচ্ছাসের গল্প, ছড়িয়ে গেল কোনায় কোনায় হিসহিসে বাতাসের মতো। পৌঁছাল ইন্দ্রাণীর বাবার কানে। যিনি তখন বিশ্বভারতীর অধ্যক্ষ ছিলেন। এবং গোঁড়া ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃস্থানীয়ের একজন। কিছুতেই মানতে পারলেন না এই অসম সম্পর্ক। অসম্ভব ক্ষুব্ধ হয়ে ডাকলেন আমাকে ওনার ঘরে। তীব্র তিরস্কারে ভরিয়ে দিলেন আমায়। অপমান করে তক্ষুনি বিশ্বভারতীর ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে বললেন। স্টুডেন্ট রেজিস্টার থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো আমার নাম। শত অনুরোধ, অনুনয় বিনয় এমনকি পা এ ধরে ক্ষমা চাইলেও গলল না সে পাষাণ হৃদয়। গৃহবন্দী করে রাখা হলো ইন্দ্রাণীকে। আমার ইন্দু কে একবার শেষবারের মতো চোখের দেখাও দেখতে পারলাম না। জোর করে কয়েক জন লোক মিলে আমাকে সেদিনের রাতের ট্রেনেই পাঠিয়ে দিল পাঞ্জাব। হৃদয়ের হাহাকার মিশে গেল ট্রেনের ধাতব শব্দে। শুধু মাঝে মাঝে হৃদয় আর্তনাদ করতে লাগলো ট্রেনের তীব্র হুইশেলের শব্দে। “


 বর্ষার জলভরা মেঘ শ্রাবণের ধারার মতো ঝড়ে পরছে মহেন্দ্রবাবুর চোখ থেকে। এতবড় একটা মানুষের এত তীব্র বেদনাবোধ মনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। কখন যেন মেহুলি সব ভুলে ঋকের হাতটা জড়িয়ে ধরেছে। প্রেম যে অবিনশ্বর।  যুগে যুগে তার পদচারণা। 


“ তারপর?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।


“ তারপর আমি পাঞ্জাবে ফিরে গিয়ে মানসিকভাবে ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি। টানা এক বছর কারও সাথে কোন কথা বলিনি। শুধু ঠাকুরমার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে চলতাম। ইন্দ্রাণীর কোন খবর আমি পাইনি। এক বছর পরে বাবা একদিন এসে বললেন – 'অনেক হয়েছে। ক্ষেত্রীরা লড়াকু জাত। তারা কখনো এমন ভাবে ভেঙে পরে না। চলো ওঠো। তোমাকে MiT তে ভর্তি করে দিয়েছি। আজকের রাতের ফ্লাইটেই তুমি রওনা হচ্ছ।' আবার আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোলার চলল। ওখানে থাকতে থাকতেই খবর পেয়েছিলাম ইন্দ্রাণী এই যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। আর তাতে আমি ভিতরে ভিতরে উন্মাদ হয়ে গেলাম। ইয়েশ আমি উন্মাদ। এখনো উন্মাদ আমার ইন্দুর জন্য। MiT তে বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিভিন্ন সাধকের সংস্পর্শে এসে সেই উন্মাদনা আমার আরও বেড়ে যায়। ওখান থেকেই ডক্টরেট করি। ওখানেই বিজ্ঞান সাধনায় ডুবে যায়। কিন্তু সে সাধনা নিরন্তর পুরনো সময় কে ধরার জন্য। কিভাবে কাজ করে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।  কিভাবে ধরে রাখে তার সমস্ত অতীত, সমস্ত তথ্য। কেন এই চরাচরে এত অন্ধকার। অন্ধকারের সমুদ্রে নক্ষত্ররা যেন আলোর বিন্দু। সেই অন্ধকারের গভীরে কি আছে? ডার্ক ম্যাটার? যেমন ব্ল্যাক হোল। সমস্ত কিছু আত্বস্থ করে নিচ্ছে। পদার্থ,  আলো এমনকি সময়কেও। তাই অন্ধকার কে মনে হয় যেন একটা বিরাট স্টোরেজ স্পেস। যেখানে ধরা থাকে সমস্ত পুরনো আলো, অতীতের সমস্ত চাল চিত্র, সমস্ত হারিয়ে যাওয়া ম্যাটার, আর বিরাট একটা ফাঁকা জায়গা যেটা ক্রমশ বাড়ছে নতুন নতুন আলোকে ধরে রাখার জন্য, নতুন নতুন অতীতকে ধরে রাখার জন্য। তাইতো ব্রহ্মান্ড এমন সম্প্রসারণশীল। এমন ভাবে বেড়েই চলেছে। কিন্তু সেই পুরনো আলো কে ধরবো কি করে আমি? সেইখানে পৌঁছানোর টেকনোলজি তো এখনো আবিষ্কার হয়নি। ভাবতে লাগলাম। খুঁজতে লাগলাম বিভিন্ন পথ। তারপর একদিন মনে হলো পরমাণুতে যদি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের খন্ড চিত্র ধরা থাকে, আমাদের হৃৎপিণ্ড যদি একাধারে বিগ ব্যাং আর এক আধারে ব্ল্যাক হোলের মতো কাজ করে তবে আমাদের শরীরেই আছে সেই রহস্যের চাবিকাঠি। মনে পড়ে ঠাকুরমা মারা যাবার আগের দিন  ঘোরের মধ্যে বলেছিল ইন্দু,  আ আ আমি, আমি সব দেখতে পাচ্ছি,  আ আ আমার বাবা মা দাদু দিদা সব ফিরে এসেছে,  আ আ আমার ছোটবেলা থেকে বড়বেলা সব ছবির মতো দেখছি রে...। তারপরের দিনই ঠাকুরমা মার যান। এমন ঘটনা আমি অনেকের মুখে শুনেছি। এযেন সমস্ত কিছু এতদিন কম্পিউটারের RAM এ রাখা ছিল। একবার চালিয়ে শেষবারের মতো দেখে নেওয়া হলো। তারপর কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে পারমানেন্টলি সেভ করে নেওয়া হলো। জিনের মধ্য দিয়ে এই অতীত যুগের পর যুগ ধরে প্রাণ থেকে প্রাণে এভাবেই বয়ে চলেছে। জানেন আমাদের মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা? এখনো পর্যন্ত যা জানা গেছে সেটা হলো ১০০০ টেরাবাইট। ব্রিটেনের জাতীয় আর্কাইভস এ গত ৯০০ বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা আছে। ওই পুরো ইতিহাসটা আপনার মস্তিস্কের শুধু ৭০ টেরাবাইট জায়গা নেবে। ভাবুন তাহলে কত হাজার বছরের ইতিহাস আপনার মাথায় আছে। অথচ কত সামান্য অংশ আমরা ব্যবহার করি। কেন?  কেন আমরা পারি না ঐ অংশ কে ব্যবহার করতে?  কারণ ওখানে সমস্ত অতীতের ডেটা ভর্তি আছে। ওই স্টোরড্ মেমরিকেই খুঁড়ে বের করতে হবে। এই এক্সট্রাকসনটেকনোলজি টাই আমাকে আবিষ্কার করতে হবে। এটা করা গেলে ইতিহাসের সমস্ত রহস্য খুলে যাবে আমাদের কাছে। খুলে যাবে সিন্ধু লিপির রহস্য, দেখতে পাবো কনিষ্ক কে কেমন দেখতে ছিল, কেমন করে বানাতো সেই কেমিক্যাল প্রাচীন মিশরবাসীরা যা দিয়ে অক্ষত রাখা যায় ফ্যারাওদেরমমি হাজার হাজার বছর ধরে। অনেকটাই এগিয়েছে সেই গবেষণা। এক বছর আগের পুঙ্খানুপুঙ্খ স্মৃতি আমি খুঁড়ে আনতে পারি। চলচিত্রের মতো প্রজেক্ট করা যায় সেটা। অন্তত ৫৫ বছর তো করতেই হবে আমার ইন্দুকে দেখার জন্য। তাই দেশে ফিরে সোজা শান্তিনিকেতনে এসে এই রিসর্ট আর তার পিছনে এই গবেষণাগার খুলেছি। আর অপেক্ষায় ছিলাম একটা বুদ্ধিমান মস্তিস্ক যেটা আমার গবেষণায় সাহায্য করবে। “ 

আবেগ আর বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত মিশেল মহেন্দ্র বাবুকে ক্রমশ রহস্যময় করে তুলেছে। গলায় যেন একটা ইস্পাত কাঠিন্য। ক্রমশ সেটা টের পাচ্ছি। ঘন্টাদার চোখটা অস্ভাবিকরকম জ্বলছে। কিছু একটা আন্দাজ করেছে মনে হচ্ছে। ঘাড়টা অস্বাভাবিক ভাবে একদিকে অল্প বেঁকে রয়েছে। এই ঘন্টাদাকে অচেনা লাগছে।একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন মহেন্দ্র বাবুর দিকে।

“ কিন্তু তাতে আমরা কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।


হো হো করে হেসে উঠলেন মহেন্দ্রবাবু। তন্ত্র সাধনায় বসা যোগীর মতে মনে হলো তার হাসি। একটু কি পৈশাচিক মনে হলো? বেঝার সময় না দিয়ে মহেন্দ্র বাবু যে টা বললেন তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

“ আপনাদেরকেই তো চাই। আপনারাই আমার এক্সপেরীমেন্টের গিনিপিগ। আপনাদের মস্তিস্কগুলো এখন আমার জিম্মায় থাকবে। ওই দেখুন আমার ল্যাব।“ মুহূর্তে এক আলোর ঝলকানি এসে লাগলো আমাদের চোখে। সামনের দেওয়াল দু ভাগ হয়ে সরে গেছে। আর তার মধ্যে সবুজ আলোয় পরিপূর্ণ একটা ল্যাব। যার মধ্যে সারি সারি বড় বড় জার। আর তার মধ্যে এক অদ্ভুত দ্রবণের মধ্যে চোবান অসংখ্য বিভিন্ন প্রাণীর মস্তিস্কের গ্রে ম্যাটার। আর তার চারপাশ ঘিরে অসংখ্য সাউন্ড জেনারেটর। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল। এবার অট্টহাসি হেসে মহেন্দ্রবাবু ঝোলার থেকে বিড়াল বার করলেন-

“ এত দিন পর এই প্রথম আমি মানুষের মস্তিস্ক নিয়ে কাজ করবো। প্রথমে সুপারসনিক সাউন্ড দিয়ে শেলটা ক্রাক করে বের করে আনবো গ্রে ম্যাটার। তারপর নিয়ন্ত্রিত আলট্রাসনিক সাউন্ড দিয়ে খুঁড়ে তুলে নিয়ে আসবো সেই অন্ধকার।  হাজার হাজার বছরের অন্ধকার। “

কথাটা শেষ করার আগেই ঘন্টাদা লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল মহেন্দ্র বাবুর উপর। আমরাও ঝাঁপালাম। আর মুহূর্তে একটা তীব্র সাউন্ড ওয়েভ আমাদেরকে যেন তুলে আছাড় মেরে ফেলে দিল শক্ত মেঝেতে। মাথাটা ঠুকে গেল প্রচণ্ড শব্দ করে। আর তারপরেই জ্ঞান হারালাম।




মাথা ঝিম ঝিম করাটা যেন কমেছে মনে হলো। সব মনে পড়ে গেল যা যা হয়েছে এত ক্ষণ। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম রক্ত চুঁয়ে পড়ছে। ভয়ে ভয়ে চোখটা খুলে তাকালাম সামনে। যা দেখলাম সামনে তাতে আবার অজ্ঞান হবার জোগাড়। 


আমার মতো ঘন্টাদার কপালও ফেটে গেছে। ছেলেমেয়েরা এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। বুকের ধুকপুকানি বলে দিচ্ছে ওরা বেঁচে আছে। অদ্ভুত ভাবে ঋক এখনো ধরে আছে মেহুলির হাতটা।  কিন্তু সামনে ওটা কি। ঘন্টাদার মতো অবিকল আর এক ঘন্টাদা। তীব্র যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছেন মহেন্দ্রবাবুকে। পুরোটাই শব্দ যুদ্ধ। শুধু তাদের চোখ গুলো জ্বলছে। আর হাতে ছোট্ট সাউন্ড জেনারেটর মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর কম্পন তৈরী করছে। ঘন্টাদাও দেখলাম অবাক হয়ে দেখছে। দেখতে দেখতে মহেন্দ্রবাবু পিছুহটে ল্যাবের মধ্যে ঢুকে গেলেন। আর দেওয়ালটা সপাটে বন্ধ হয়ে গেল। তারপরেই একটা বিকট আওয়াজ। যেন ভূমিকম্প হলো। সেই আওয়াজে সবাই জেগে উঠেছে। শুধু দ্বিখণ্ডিত ঘন্টাদার সেকেন্ড ভার্সন কখন তার বেসে ফিরে গেছে। মৃদু হাসল ঘন্টাদা। মনে পড়ল “দ্বিখন্ডিত” গল্পের কাহিনী। বারে বারে সে আসে। চরম মুহূর্তে নিজেকে নিজেই বাঁচায় এই প্রকৃতি। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের বিরুদ্ধে তৈরী হওয়া এ আমাদের দ্বিখণ্ডিত সত্তা। আমার আমি ভার্সন ২। 




স মা প্ত




'এবং খোঁজ', 

শারদ সংখ্যা (আশ্বিন)

অঙ্কনশিল্পী: তমোজিৎ ভট্টাচার্য্য, শুভদীপ মন্ডল