গল্প
সাপ্লিমেন্ট
ঋ ভু চ ট্টো পা ধ্যা য়
-গুড ইভিনিং স্যার।আমি অভিষেক রাওয়াত, আপনাকে গত কাল ফোন করেছিলাম।
কথাগুলো শুনে জবাব দেওয়ার আগে তন্ময় ঘড়িটার দিকে একবার তাকিয়ে উত্তর দিল,‘এখন আর ইভিনিং আছে?’
-স্যার আপনি যতক্ষণ না শুতে যাচ্ছেন ততক্ষণ রাত্রি নয়।এইসময় জেগে আছেন মানেই সন্ধ্যা।
-বেশ ভালো বললেন তো।
-থ্যাঁঙ্ক ইউ স্যার।
-আপনি কাল বিকেলের দিকে ফোন করেছিলেন তো?
-ইয়েস স্যার, সাড়ে পাঁচটার সময়।
-বলুন কি বলছিলেন?
-স্যার আমি কি ভিতরে আসতে পারি?
-ও সিয়(র), প্লিস ডু কাম।
শেষের কথাগুলো বলবার পরেই অভিষেক জুতোজোড়াটা দরজার বাইরে রেখে ভিতরে এসে সোফাতে বসল।তন্ময় দরজাটা বন্ধ করে বসল উল্টোদিকের চেয়ারে।ছেলেটা ঘরের চারদিকটা দেখে তন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বলল,‘স্যার, আর ইউ রেডি টু হিয়ার?’
-নিশ্চয় নিশ্চয়, বলুন আপনি।
-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।আমি স্যার এস.এস.এ. কম্পানি থেকে এসেছি।সুপার সাপ্লিমেন্ট ফর অল।কথার মাঝে অভিষেকের ফোনটা বেজে উঠতেই ‘ও এক্সকিউস মি।’ বলে সোফা ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল।অভিষেক ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেলে তন্ময় চেয়ারে বসে মোবাইল বের করে মেল চেক করতে আরম্ভ করল।তন্ময় সেন একটা বিদেশি কম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার।এই সিনিয়ারিটি তার বয়সে নয়, এখন সাঁইত্রিশ প্লাস।তবে দেখলে আটচল্লিশ মনে হয়।সামনের দিকে কোল বালিশের মত পেট আর পিছনটা বাইকের একটা সিট।অফিসের কর্মচারিরা বিশেষ করে মহিলা কর্মচারিরা আড়ালে মটু, ভদকা, কুমড়ো বলে ডাকে।পার্সোনাল আসিসটেন্ট তনয়া, সিলিন্ডার বলে।কয়েকদিন আগেই বাসে তন্ময়ের কাছ থেকে ডবল ভাড়া চাওয়ার জন্য রীতিমত যুদ্ধ বেঁধে যায়।মাথার সামনের দিকের কয়েকটা চুল একদিকে যেমন নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে, তেমনি পিছনের দিকটাতে দিব্যি আলো প্রতিবিম্বিত হয়।তবে এই সব নিয়ে তন্ময় বিন্দুমাত্র চিন্তিত নয়।ঘরে একটা ট্রেডমিল ইতিমধ্যে কিনে ফেলেছে।ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারলেই কেল্লাফতে।আরম্ভ করে দেবে।তন্ময়ের সমস্যা হল ঘুম এবং তার থেকে ওঠা।শনিবার ছাড়া এমনি দিনে শুতে শুতেই রাত্রি একটা, তারপর আবার পাঁচটাতে ওঠা,বাপরে বাপ্ হরিবেল।মাঝে মাঝে আবার রাতে ফোন চলে আসে।অফিসের কড়া হুকুম,‘ফোন কিন্তু চব্বিশ ঘন্টাই চালু রাখতে হবে। ফোনের কিছু হলে নতুন ফোন দেওয়া হবে, কিন্তু ফোন বন্ধ রাখলে তার জন্য কম্পানির কোন ক্ষতি হলে তার দায় পুরোটাই আপনার।’
কয়েকটা দিন অবশ্য রত্না জোর করে ছটার সময় ঘুম থেকে তুলে হাঁটতে পাঠিয়ে ছিল, সেখানেও এক সমস্যা।পার্কের বেঞ্চেই দুদিন ঘুমিয়ে গেছিল।রত্না নিজে গিয়ে ডেকে নিয়ে আসে।তারপরের দিন চোখ কান মুলে বলে,‘এই আজকেই শেষ আর কোনদিন ডাকব না,তাতে তোমার যা হয় হোক।আমার পর্যন্ত লজ্জাতে নাক কেটে গেল।’তন্ময় সব শোনে, বোঝেও কিন্তু করবার কিছু নেই।রাত্রি একটাতে শুয়ে কেউ সকাল ছটাতে উঠতে পারেনা।ফ্যামিলি ডাক্তার সব কথা শুনে একটা নিদান দেন, ‘রাতে ভালো ভাবে না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে হাঁটতে গেলে কাজের কাজ কিছুই হবে না, বরং সুগার বেড়ে যাবে।তার থেকে অফিসের জিমে কিছু সময় কাটাও,না হলে লিফ্ট ছেড়ে সিঁডি ব্যবহার কর।’
-ন’তলা প্রতিদিন সিঁড়ি ভেঙে উঠব!ফুসফুস বাইরে বেরিয়ে চলে আসবে।
-তাহলে উপায়?রত্না জিজ্ঞেস করে।
- নেই, যেমন চলছে, তেমনি চলবে।
তন্ময়েরও সব কিছু যেমন চলছিল তেমনি চলতও, কিন্তু বাধ সাধল রত্নার মা। এক রবিবারের সন্ধ্যে বেলায় সটান হাজির।চায়ে চুমুক দিয়েই রত্না ও শ্বশুরের সামনেই জামাইকে বলে বসলেন,‘তুমি এত ওয়ার্ক লোড নিওনা,তাছাড়া খুব ওবেস হয়ে যাচ্ছ, টেক কেয়ার,শরীর নষ্ট হয়ে যাবে, সেক্স কমে যাবে।’
শাশুড়ি বলে কি!এমনিতেই বিয়ের চারবছর পরেও ঘরে তৃতীয় জনের আগমন না হওয়াতে মনের মধ্যে মেঘ বেশ ভালোই জমে উঠেছিল।অবশ্য তন্ময় অফিসের ছুটি নিয়ে রত্নাকে ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে।কিছু টেস্টও হয়েছে, মোটামুটি নর্মাল, তাহলে!
শেষবার ডাক্তার দেখানোর সময় উনি বলেও দিলেন, ‘মিস্টার সেন ইউর ওয়াইফ ইস কোয়াইট নর্মাল, সি ডাসনট হ্যাভ এনি প্রবলেম।নাও ইউ হ্যাভ টু গো থ্রু সাম মেডিক্যাল টেস্টস।’
-মেডিক্যাল টেস্টস!
-ইয়েস স্যার।ভেরি নর্মাল।সুগার, থাইরয়েড, মোস্ট ইম্পমর্টেন্ট সিমেন টেস্ট।
-ও সিট।
বাড়ি ফিরে সেদিন একটা হৈচৈ হল।তন্ময় রত্নার উপর রেগে কয়েকটা দিন কথা বলাও বন্ধ করে দিল।কয়েকদিন পরে রত্না কথা বলা আরম্ভ করলে তন্ময় বলে ওঠে ‘তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও।’
-আবার একথা হচ্ছে কেন?
-না সঙ্গে সঙ্গে রেজাল্ট পাবে।
-বাজে বোকো না।আমি তো কোন কিছুতে পিছিয়ে আসিনি।ইউ.এস.জি. গুচ্ছের ব্লাড টেস্ট।
-তোমার ব্যাপারটা আলাদা।
-কেন?
-তুমি বুঝবে না।
-তুমি বলেই দেখ না।
-জানো, আগেকার দিনে যে’সব ছেলের পেচ্ছাপে ফেনা হত না, বা বীর্জে শুক্রানু থাকত না তাদের পুরুষ বলা হত না।
-তো.............!
-ধর আমারও যদি স্পার্ম না থাকে?
- না থাকবে।কিন্তু তার আগে তো তোমাকে টেস্ট করাতে হবে।
তিন চার দিন পরেই অফিস থেকে ফিরে হাসি হাসি মুখ করে তন্ময় বলে, ‘ডাক্তারের সাথে কথা বলে এলাম।ওয়েট কমালেই সব কিছু নর্মাল হয়ে যাবে।’
-তুমি ওয়েটটা কমাবে কি করে, এটা কি মুদিখানার মাল, যে ওজন বেশি হলেই কমিয়ে দেবে।হাত, পা, মাথা ছাড়া ওজন করবে।
-না, না তা কেন, ওজন কমানোর জন্যে যা যা করতে হয় করব।হাঁটা, চলা ব্যায়াম, ডায়েট কন্ট্রোল সব।
-তবেই হয়েছে আর কি।তাছাড়া তুমি তো টেস্ট করাতেই গেলে না।
-ঠাট্টা করছ, পারব না বলছ?
-নিশ্চয় পারবে।এই চার বছর যে’ভাবে পেরেছ, সে ভাবেই পারবে।
শেষের কথাগুলো তন্ময়ের মনে চড়াম চড়াম করে লাগল।তারপরের দিন খুব ভোরে উঠেই হাঁটতে চলে গেছিল।তবে মাত্র চারদিন।পাঁচদিনের দিন রত্নাকে বলে,‘আমাকে সাড়ে পাঁচটার সময় ঘুম থেকে ডেকে দেবে তো।’রত্না প্রথন কয়েকদিন ডেকে দিলেও তৃতীয় দিন থেকে সেই একই সমস্যা।ডান দিকে ডাকলে তন্ময় বাঁ দিক ফিরে শুয়ে পড়ে আর বাঁদিকে ডাকলে ডানদিক ফেরে।শেষে রত্না ডাকা বন্ধ করে দেয়।তবে প্রতিরাতে শোওয়ার সময় তন্ময় ভোরে হাঁটবার কথা বলে, ব্যায়ামের কথা বলে। এটা অবশ্য রাতে ভোর বেলা ঘুম দুটো চোখ ছাড়তে চায় না।তন্ময়ের তাতে কি দোষ?
-সরি স্যার, আপনাকে অপেক্ষা করতে হল।
-না, না, ঠিক আছে।আপনার ফোন এলে আপনি আর কি করবেন।
-তাহলে স্যার যা বলছিলাম।আমি এসেছিলাম এস.এস.এ কম্পানি মিনস্ সুপার সাপ্লিমেন্ট ফর অল।আজকের এই হেসেল ফুল লাইফে আমরা না পাই গুড ফুড, না গুড কনডিসন ফর লিভিং।ইভেন আপনি যখন ভালো ফুড,হেলদি ফুড নিতে যাবেন, দেখবেন হয় সেটাতে ভেজাল বা কেমিক্যাল।এই জায়গা থেকেই আমাদের কম্পানি একটা অদ্ভুত রকমের ফুড-সাপ্লিমেন্ট নিয়ে এসেছে।ইট ইস ভেরি গুড ফর ইয়র ফ্যামিলি।আপনি যদি বলেন আমি এলাবরেটলি ডেসক্রাইব করব।
-নিশ্চয় নিশ্চয়।
-তার আগে স্যার আপনার লাইফস্টাইলটা যদি বলেন, মানে কখন ঘুম থেকে ওঠেন, ব্রেকফাস্ট, এই সব।সেই অনুযাযী আমরা আপনার জন্য সাপ্লিমেন্টের ডোস ঠিক করব।
-ঘুম থেকে ওঠার টাইমটা ঠিক ফিকস্ড নয়।সেটা নির্ভর করে আগের রাতে কখন শুতে যাচ্ছি এবং পরেরদিন ঠিক কি কি কাজ থাকছে তার ওপর।
-তারমানে আপনি কতক্ষণ ঘুমাবেন সেটা ঠিক করবে আপনার কম্পানি, তাই তো?
-হ্যাঁ.....।আপনি বলতে পারেন।
-ওকে ফাইন।
-তারপর..?
-তারপর মানে টার্গেট কিছু না থাকলে সকালে চা, ব্রেকফাস্ট খেয়ে অফিস।
-কটার সময়?
-বিফোর নাইন, বায়োমেট্রিক তো।
-লাঞ্চ?
-ঠিক নেই, তাও একটা থেকে চারটের মধ্যে।মাঝে কফি স্ন্যাকস্ বা টুকটাক চলে।
- ইভিনিং এ?
-একই, কিছু আনিয়ে নেওয়া হয়।
-ডিনার?
-আফটার টুয়েলভ।
-সরি টু আক্স, ডু ইউ স্মোক?
-ইয়া বাট নট ইন দ্য হোম।অফিসে কাজের খুব প্রেসার থাকলে একটু বাড়ে।
-ড্রিকন্স?
-ওয়ান্স ইন আ উইক।মোস্টলি অন স্যাটারডে।
-স্যার আপনার ফ্যামিলি মেম্বারস?
-মি এবং মাই ওয়াইফ।আমাদের এখনো কোন ইস্যু হয়নি।শেষের কথাগুলো বলে মাথাটা নিচু করে দিল।
-সরি স্যার।কিন্তু আপনি যা বললেন তা এখন নাইনটি ফাইভ পার্সেন্ট মানুষের ডেলি রুটিন।ফুল ওয়ার্ক, নো টাইম ফর রেস্ট অর রেসপাইট।আমাদের কম্পানি আপনাদের জন্যেই এই প্রোডাক্টটা এনেছে, অনলি পর ইউ।আমাদের একই প্রোডাক্ট মাল্টিডাইমেনসনাল।সকালে খালি পেটে গরম দুধের সাথে মাত্র দু’চা চামচ গুলে খেয়ে নিলেন, তারপর মুখ ধুলেন।ফাইভ মিনিটসের মধ্যে আপনার সিস্টেম ক্লিয়ার হয়ে যাবে।তারপর চা বিস্কুট খেলেন, আবার গরম দুধে চার চা চামচ দিয়ে খেয়ে নিলেন, আপনাকে আর ব্রেকফাস্ট করতে হবে না।লাঞ্চের সময় আপনি চা বা কফিতে গুলে ছয় চামচ, সন্ধে বেলা আবার দুই, রাতে চার চা চামচ।ঠিক নিডেড ক্যালোরি পেয়ে যাবেন।
তন্ময়ের চোখমুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল।কথাগুলো শুনতে শুনতে একটা ঘোর এসে গেছিল।কথা বন্ধ হলেও ঘোরটা আরো কিছু সময়ের জন্যে থাকল।তারপরে বলে উঠল,‘তারমানে আমাকে কিছু খাবার খেতে হবে না।’
-এইখানেই একটা ম্যাজিক আছে।ধরুন আপনি এই সাপ্লিমেন্টটি খাওয়ার আধ ঘন্টার ,মধ্যে কিছু খেয়ে নিলেন, মানে কোন সলিড ফুড।এই সাপ্লিমেন্টটা তখন হেল্থ ড্রিঙ্কসের মত কাজ করবে, যেমন কমপ্ল্যান হরলিক্স এইসব।এনার্জি বুস্টার। আধঘন্টার মধ্যে কিছু না খেলে এটাই তখন সলিড ফুডের মত কাজ করবে।সব থেকে বড় কথা হল এটা ফ্যাট রিডিউসার।
-বাঃ, বিরাট ব্যাপার তো।
-আরো আছে।
অভিষেক তন্ময়ের দিকে ঘাডটা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলে উঠল,‘এটা সেক্স স্টিমুলেটার।এমনকি লো’স্পার্ম বা নো’স্পার্মের কোন সমস্যা থাকলে এটা দারুন হেল্প-ফুল।আমি রেফারেন্স নম্বর পর্যন্ত দিয়ে দেব।’
তন্ময় কিছুসময় কোন কথা বলতে পারল না।কিছুসময় পরে অভিষেকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘আপনার কাছে স্যাম্পেল আছে?’
-নিশ্চয়, দিচ্ছি।
একটা প্রশ্ন আছে।
-করুন, একটা কেন হাজারটা করুন।
-এটার কোনো সাইড এফেক্ট নেই তো?
-আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন স্যার।আমরা সেই সব অর্গানাইজেসনের মত বলব না একশ শতাংশ ভারতীয়, পদ্ম পাতার কন্ডোমের মত।
-মানে?
-এটা স্যার এক্সপ্লেন করতে বলবেন না।বিজনেস এথিক্স ক্ল্যাস করবে।তবে আমাদের প্রোডাক্ট ইন্ডিয়ান ও ওয়েস্টার্ন গাছগাছড়া থেকেই তৈরী।কোন কেমিক্যাল নেই আমি নিজে ব্যবহার করেছি।
তন্ময়ের শরীর তখন ছুটছে।‘তাহলে আর কোন সমস্যা থাকবে না।অফিসে আর কোন টিটকারি হজম করতে হবে না, নো তনয়া কেশ নো তানপুরা।রত্নার সাথেও সমস্যা মিটে যাবে।রত্না মা হবে, আমি বাবা?বাঃ বেশ বেশ।’
কিছুসময় চুপ থেকে অভিষেকের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘তাহলে আমি দুধ গরম করতে বলি, স্যাম্পল তো খেতে হবে, কি বলেন?’
-নিশ্চয়।এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসুন।আমি দু’চামচ গুলে দিচ্ছি, খেয়ে এফেক্টটা বুঝুন।
কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তন্ময় জোরে জোরে‘রত্না রত্না’ বলে ডাকতে আরম্ভ করল।কিছুসময়ের মধ্যেই রত্না খুব রেগে এসে জিজ্ঞেস করল,‘কি হল এত চেল্লাচ্ছ কেন?’
-এক’কাপ গরম দুধ দাও তো।এখন গরম দুধ নিয়ে কি করবে?
-আরে ঐ যে ছেলেটা এসেছে না, অভিষেক,ওর থেকে একটা স্যাম্পেল খাবো।
-কিসের স্যাম্পেল, কে দেবে?মাথাটা গেছে নাকি বয়সের সাথে ভিমরতি হচ্ছে?
-একথা বলছ কেন?আমি তো শুধু গরম দুধ দিতে বলেছি।
-ওঠো, সাড়ে নটা বাজছে, ডাক্তারের কাছে দশটার সময় নাম লেখানো রয়েছে।
-কিসের নাম?
-ডাক্তারের।
-কেন?
-কেন তুমি জানো না?
-আমি তো সাপ্লিমেন্ট কিনছি, এই তো অভিষেক, জিজ্ঞেস কর ওকে।এই তো ছেলেটা।তন্ময় ডান বাঁ দিক দেখে অভিষেককে খোঁজার চেষ্টা করল।কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে উঠল,‘ছেলেটা কই?এই তো সোফাতে বসে ছিল।’
-কোন ছেলে?কেউ তো আসে নি, তুমি তো এতক্ষণ নাক ডেকে ঘুমালে।
-ঘুমালাম!তাহলে অভিষেক, সাপ্লিমেন্ট?
রং মিলান্তি
সৌ মী আ চা র্য্য
(রং-১)
-আবার!আবার তুমি কুমড়ো লাগিয়েছো ইয়ার্ডে।আর ইউ ক্রেজি ইমন?এটা আমেরিকা।তোমার বাগুইহাটি নয়।আশ্চর্য।আজ পাঁচ বছরে এতটুকু বদলালেনা,সত্যি!
গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলো সৌগত।ব্যথাচোখে ওর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো ইমন।দুকামরার ছোট দুটো ঘর,রান্নাঘর,এটাচ টয়লেট আর ড্রইং কাম ডাইনিং রুমের অ্যাপার্টমেন্টটার একটাই প্লাস পয়েন্ট ঐ এক টুকরো জমি।ফুল আর সব্জি নিজের হাতে ফলিয়েই সুখ।সন্তান না হওয়ার দুঃখটাও যেন কমে আসে।সৌগতর উপেক্ষা আজকাল আর গায়ে মাখেনা ইমন।স্নান সেরে কুমড়ো গাছটার ছবি ফেসবুকে 'বন্ধু সুজন' গ্রুপটাতে পোষ্ট করে।দেখতে দেখতে লাইক,কমেন্টে ভরে ওঠে দেওয়াল।ভীষণ ভালো লাগায় ভরে ওঠে ইমন।এটুকু তার নিজস্ব জগৎ।এখানে শুধুই প্রশংসা।একটা কমেন্টে চোখ আটকায়।
-আমেরিকায় কুমড়ো গাছ?আপনার সাথে পরিচিত হতে ইচ্ছে করছে।
নাম আবহমান মজুমদার।বাপরে কত বড়ো নাম।ভাবতে ভাবতেই টুং করে ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ এলো।
-কখনো আমেরিকা স্বচক্ষে দেখিনি মানে স্বচক্ষে এখনো দেখছি না মানে...
-বুঝেছি বলুন।
-ম্যাডাম আমেরিকায় কুমড়ো গাছ?একটু জায়গাটার ছবিও দিন।
-আমেরিকায় কুমড়ো হয় এবং যথেষ্ট হয়।আপনি জানেনা?
-না,মানে ওদেশে গিয়ে কজন আর বাগানে কুমড়ো লাগায় বলুন?তাই জায়গাটার ছবি যদি...
-আপনি কি আমায় অবিশ্বাস করছেন?
-এমা ছি ছি না না।সরি।
ব্যাস্ মেসেজ বন্ধ।আশ্চর্য গায়ে পড়া লোক তো।মনটা সবে ভালো হচ্ছিলো।রাগে গা জ্বলতে লাগলো ইমনের।খাওয়া সেরে ঘরের কাজ গুছিয়ে চুপচাপ বসেছিলো।সৌগত রোজ দায়সারা একটা ফোন করে অফিস পৌঁছে,তারপর সব স্থির।ঠাণ্ডা বাড়ছে।গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো ইমন।ওদের এলাকাটা নিউ জার্সির মরিস প্লেনের সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গা।চিনারের পথে একা রোজ অনেকটা হেঁটে আসে।আজ ফাঁকা ঝাঁ চকচকে রাস্তায় স্লেট পাথরের দোতলা বাংলোটার সামনে ইচ্ছে করে একটা সেল্ফি তুললো।তারপর তখনি ফেসবুকে আপলোড করে লিখলো,
-ঠিক এখন,এই যে আমি।
এরপর মোবাইলে নেট কানেকশান বন্ধ করে ফেরার পথ ধরলো।এখানে সূর্য ডোবে অনেক পরে।এখন এখানে বিকেল ছটা তার মানে ভারতে বুধবার ভোর প্রায় সাড়ে তিনটে।সুতরাং রাতে শোবার আগে একবার পোষ্টটা চেক করে নিলেই চলবে।বাড়ি ফিরে ইয়ার্ডে চোখ যায় মন জুড়িয়ে ওঠে।ফিসফিস করে বলে 'ভালোবাসি'ওর বাবা শিখিয়েছিলেন গাছের সাথে কথা বলতে হয়,গান শোনাতে হয়।মনে প্রাণে বিশ্বাস গুলো রয়ে গেছে ভীষণ ভাবে।সৌগতর ব্যঙ্গ বিদ্রুপ অতোটা জোরালো আজো হয়নি।
(রং ২)
আজকাল ঘুম কমে এসেছে ভীষণ।টপ টু বটম টিপটিপ স্লিম ফ্যাশানেবল বছর চল্লিশের মৌটুসী এখন ঘোঁতঘোঁত করে নাক ডাকছে।ফিক করে হেসে ফেলে আবহমান।আস্তে করে পা নামায়।ঘড়ি বলছে পৌনে পাঁচটা।বাথরুম থেকে ফিরে মোবাইলটা দেখতে ইচ্ছা করে।আর মোবাইল নিতেই কুমড়ো গাছের মালকিনকে মনে পড়ে যায়।কি যেন নামটা?খানিক মাথা চুলকে গ্রুপে ঢুকে নামটা দেখে- ইমন বসু।টুক ওয়ালে ঢুঁ দেয়।লক করার ধ্যাষ্টামো নেই দেখে খুশি হয়।সদ্য দেওয়া ছবিটা দেখে চুপ করে যায়।ঠোঁটে একটা হাসির রেখাও ফুটে ওঠে।এ ছবি যে তারজন্য বুঝতে অসুবিধা হয় না।যদিও কুমড়ো গাছটা কোন পরিবেশে সেটা দেখার ইচ্ছেই ছিলো।তবে মালকিনকে দেখা অতোটাও আশাহত হবার মতো বিষয় নয় যদিও।ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেয়।মনে মনে ভাবে দারুণ জায়গায় থাকে তো।আমেরিকা মানেই বড়ো বড়ো ব্লিডিংএর জঞ্জাল মনে উঁকি দেয় কিন্তু এতো দারুণ সুন্দর।লিকার চা বানিয়ে নিয়ে পাশের ঘরে আলি আকবর খানের সরোদ চালিয়ে নিমগ্ন হয়ে যায় আবহমান।
-ভূঁড়িটা খেয়াল করেছো নন্তু?সকালে উঠে একটু হাত পা নাড়তে পারো না?ডিসগাস্টিং।
কোনো উত্তর দেয় না নন্তু মানে আবহমান।
-কি হলো আজকাল উত্তর দেওয়াটাও জরুরী মনে করো না।
-কি বলবো বলো?ওসব হুইহাই আমার ভালো লাগেনা।এই বয়সে সকালটা একটু আয়েশ করবো না?
-মাত্র বিয়াল্লিশ, এই বয়েস মানে?পুজোতে এসে মেয়ে বলে গেছে,মা তুমি আর বাবা একসাথে বেরোবে না সবাই জিজ্ঞাসা করে উনি কি তোর মার জ্যেঠু?
-মেয়ে তোমায় আসলে সত্যিটা বলেনি,আমি শুনেছি পাশ থেকে।ওর বন্ধুরা বলেছে তাথৈ তোর মা তোর থেকে বেশী সেক্সী।
-সকাল সকাল শুরু করলে তাই না।
-আরে সত্যি বলছি।তবে আমাকে তোমার জ্যেঠুই লাগে।
-প্লিজ একটু নিজেকে নিয়ে ভাবো।কি বিচ্ছিরি ফিগার হয়েছে তোমার।তাছাড়া সুস্থ থাকতে তো হবে।
সরোদ শোনার সুন্দর কানটা একবার নষ্ট হয়ে গেলে আর তৈরী করা কঠিন।আবহমান আরেক প্রস্থ চায়ের জন্য ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ হয়ে ছাদে চললো।কামকট গাছে এখনো ষাট সত্তরটা ফল রয়েছে।ছবি তুলে ম্যাসেঞ্জারে ছবিটা মিস্ কুমড়োকে পাঠিয়েদিলো সুপ্রভাত লিখে।মৌটুসী নীচ থেকে জবর ডাকাডাকি শুরু করেছে।একটু বিরক্ত হয় আবহমান।এরপর তো দৌড়াতেই হবে। ট্রেন,অফিস,গুঁতোগুঁতি।সকালটা একটু শান্তি চায় মন।
-বলো?
-মেয়ে ফোন করেছে জিজ্ঞাসা করছে মে অথবা জুনে আমরা দেরাদুন যচ্ছি নাকি?
-মৌ যেতে তো পারিই কিন্তু চারদিনের বেশী না।গতবার জলের অভাবে মৌসুম্বী গাছটা মরে গেছে।
-আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি নন্তু তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?গাছের জন্য মেয়ের কাছে থাকার দিন কমাবে?
-তুমি থেকে যেও।তাছাড়া আমার অফিসে ছুটি পাওয়া হাজার সমস্যা।তোমরা কেন্দ্রের লোক ছুটি নিয়ে তো সমস্যা নেই।
-যতদিন যাচ্ছে তুমি খোঁচা দিতে ওস্তাদ হয়ে উঠছো।ঘরকুনো ব্যাঙের মতো নিজের চিন্তাতেই মগ্ন থাকো।বাকি সব ভেসে যাক।
নটা পনেরোর মধ্যে বেরিয়ে নিজেকে সোদপুর স্টেশন থেকে ট্রেনের ভীড়ের মধ্যে অনায়াসে গুঁজে দেয় আবহমান।নিত্যযাত্রী বন্ধুদের হাসাহাসি এরমধ্যেই চলে দক্ষতার সঙ্গে।তারপর শিয়ালদহ হয়ে এন্টালি। দারুণ কায়দায় বাদুর মানুষ রূপে ঝুলে শেষে ঝড়ো কাক হয়ে অফিসে নিজেকে এস্টাবলিশ করে আবহমান।আজ টেবিলে বসেই আগে ফেসবুকে নজর দেয়।প্রায় এগারোটা।মানে ওখানে রাত দেড়টার আশেপাশে।ভদ্রমহিলা অনলাইন।সুপ্রভাতের উত্তর এসেছে।
-আপনার সুপ্রভাতকে অভিনন্দন।আমি এখনো ঘোর অন্ধকারে।তবে কামকটের ছবি মন ভালো করে দেবার মতো।আপনার বাড়ির তাইনা?
ওদিকে ফ্রেণ্ড রিকোয়েস্ট এ্যাকস্পেটেড।ফুরফুরে লাগে আবহমানের।
(রং-৩)
ভোরের দিকেই আজকাল ঘুমটা আসে।ইমন গতকাল সৌগতর পকেটের রুমালে অন্য পারফিউমের চড়া গন্ধ পেয়েছে।তাতে মন খারাপ হয়নি কেন সেটা সঠিক ভাবে জানেনা।গত দেড়মাসে কুমড়ো গাছটা লকলকিয়ে উঠেছে বেশ।সবুজ পাতাগুলোতে হাত বুলিয়ে ভীষণ সুখ।আজ বিকেলে নীল জামদানীটা পরবে।তেমনটাই কথা।ঠিক যে যে কাজগুলো ভারতে তার বাড়িতে মল্লিকা করতো।এখানে ঠিক সেই সেই কাজগুলো খুব যত্ন করে ইমন করে।প্রথম প্রথম সৌগতর গোল করে গোটানো জাঙিয়া কাচতে খুব ঘেন্না পেতো এখন সব অভ্যাস হয়ে গেছে।একেক সময় একেক পারফিউমের গন্ধগুলোও।শুধু নিজের প্রিয় কিছু কাজ ইমন হাজার বাধা সত্ত্বেও ছাড়েনি।সৌগতর সাথে বাঁধন গত দুবছরে অনেক আলগা হয়ে গেছে।তবে ভদ্রতার সীমা রক্ষা করতে সৌগত খুব ভালো জানে।পাঁচটা নাগাদ নীল জামদানীর সাথে মুক্তোর সেটটা পরে আয়নায় নিজেকে দেখে খুশিই হয় ইমন।অক্টোবরে ছত্রিশ হবে তবু ছাপ পড়েনি।দরজা বন্ধ করে ওভারকোট গায়ে ফেলে হাঁটতে থাকে।পরিচিত দু একজনের চোখে আজ মুগ্ধতা ইমনের গালে লালিত্য ছড়ায়।পছন্দ মতো রাস্তায় জঙ্গল ঘেঁষে সেলফি তোলে।হঠাৎ দেখে দুটি ছেলে পিঠে রুকস্যাক নিয়ে ঐ পথেই।ওদের অনুরোধ করে দু একটা ছবি তুলিয়ে নেয়।পথের ধারে রাখা বেঞ্চটায় বসে পোষ্ট করে।
-শুধু তোমারি জন্য।
পোষ্টটা করে মনে মনে লজ্জা পায় ভীষণ।গালে হাত দিয়ে জঙ্গলের দিকটায় চেয়ে থাকে।মেসেজ আসে।অবাক হয়ে ম্যাসেঞ্জারে চোখ রাখে ইমন।
-এক খণ্ড আকাশ আমার দুচোখে এখন।তবে শুধু আমার জন্য যদি তাহলে ফেসবুকে কেন?ম্যাসেঞ্জারে কেন নয়?
-সে কি এতো রাতে জেগে?
-অপেক্ষায় ছিলাম।
-এসব বাড়াবাড়ি।ঘুমাও।স্ট্রেস নিও না এতো।অসুস্থ হয়ে পড়বে কিন্তু।
-ধুস,এটুকু তো বেঁচে থাকি।শোনো,আমার বাগানের সেই ঘাসগুলো দিয়ে পাঁচটা টব করেছিলাম,মনে আছে ?
-আছে তো।
-সব কটা বেঁচে গেছে।থ্যাঙ্ক ইউ।ভাগ্যিস নতুন টেকনিকটা শেখালে।
-ধুর থ্যাঙ্ক ইউ আমি বলবো।ভাগ্যিস তুমি বলেছিলে তাই তো কুমড়ো গাছটা বাঁচলো।নইলে পোকায় তো শেষ করে ফেলেছিলো।মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি ফুল আসবে।তুমি অতো দূর থেকেও বাঁচিয়ে দিলে।
-হুম্ তারপর কুমড়ো।
-এবার যাও ঘুমাও।আমি ফোন বন্ধ করছি।
-এ্যাই শোনো,বন্ধ করো না প্লিজ।তোমার কথা আমি বুঝেছি।এই দেড়মাসে যা তুমি বলোনি,তাও বুঝেছি।নিজের জন্য বাঁচবে ইমন।যা করলে তুমি ভালো থাকবে তাই করবে।বাকি সব আপেক্ষিক।
-বুঝলাম।তবু যদি কেউ বাঁচতে ইন্ধন দেয় ভালো লাগে।
-তোমাকে একবার সামনে দেখতে ইচ্ছা করে।আজ খুব সুন্দর লাগছে বলে বলছি না কিন্তু।ভিডিও কল করবো?
-না।যে দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব নয় সেখানে অকারণ হাত পা ছুঁড়তে আমি রাজি নই।তাছাড়া এই ভালো।কোনো জবাব দিহি আর চাহিদা ছাড়া এই ভেসে যাওয়া।ভালো থাকা।
-ভালো আছো তো?তবেই শান্তি।
-ভালো থাকতে গেলে সুস্থ থাকতে হবে।বয়সটা ভালো নয়।তুমি এমন রাত জেগো না।প্লিজ।আমি রাখছি।
ফোনটা বন্ধ করে দেয় ঠিক করে আর খুলবেই না বারোটার আগে।অদ্ভুত ভালো লাগা নিয়ে বাড়িতে ফেরে ইমন।ফুরিয়ে যাওয়া ইমন।জীবনে নতুন করে কিছু পাওয়ার আছে এই বিশ্বাস যখন তলানিতে তখন এক কুমড়ো গাছ বেঁধে দিলো দুটো প্রাণ।সোদপুর আর নিউ জার্সির মরিস প্লেন,কত দূরত্ব এদের মধ্যে?ঠিক ততটা যতটা সৌগত আর ইমনের মধ্যে।ইমন আর আবহমান কতটা কাছে?ঠিক যতটা কাছাকাছি বিছনায় শুয়ে থাকে ইমন আর সৌগত।
রাতে ডিনার টেবিলে সৌগতই বলে,
-আজ শাড়ি পরেছিলে?ফেসবুকে ছবি দেখলাম।
-হুম্।
-বেশ দেখাচ্ছিলো।শুধু তোমারি জন্য ক্যাপশান।কার জন্য ইমন?
-তোমার বান্ধবীদের লিস্ট অনেক বড়ো সৌগত।আমার ততটা নয়।কোন এক বিশেষ জনের জন্যই আমার সাজ।
সৌগত খুশি হয় মনে মনে আজো তবে ইমন তার জন্যই সাজে?লজ্জিত বা কুন্ঠা আসে যেন খানিকটা।বান্ধবীদের কথা কোনদিন উচ্চারিত হয়নি তাদের মাঝে।তাই সংকোচ কাটাতে বলে,
-মাঝেসাজে পারোতো এমন সাজতে।ভালো লাগে আমার।
-হুম্ পারি তো ইচ্ছা করে না।
-এতো রুক্ষ্ম ভাবে কথা বলো কেন?
-আমি রুক্ষ্ম ভাবে কথা বলবো তোমার সঙ্গে?আমার সে সাহস আছে?কি যেন বলেছিলে শনিবার পার্টির শেষে?
-প্লিজ ইমন আমি সরি বলেছি তো!
-হুম্,বলেছো তো সরি।বাগুইহাটির এলেবেলে মেয়ের চোদ্দ পুরুষে কেও কোনদিন আমেরিকা দেখেছে?না ভেবেছে সেখানে থাকা যায়?তাহলে এতো সাহস পায় কোথা থেকে যে ইমন সৌগতবাবুর গেষ্টকে অপমান করে?
-ইমন?
-হ্যাঁ ইমন সেই এলেবেলে ইমনকে তোমরা দেখে এনেছো।সেই ইমন সবার কাছে বাঁজা বলে পরিচিত কিন্তু কে এর জন্য দায়ী ইমন কখনো কাউকে বলেনি।তাই তাকে এদেশে এনে রেখেছো।দোষটা ইমনের হলে এতদিনে সে হয়তো বাগুইহাটিতেই ফিরে যেতো।আর শোনো তোমার কোনো গেস্ট যদি আমার ঐ এক টুকরো বাগান নিয়ে কোনো ইয়ার্কি মারে তার ফল ভালো হবে না।এটা তুমি জেনে রেখো।
সৌগত হতচকিতো হয়ে যায়।কোথা থেকে এতো জোর পেলো ইমন? কোনোদিন যে কথা বলেনি আজ তাই বলে দিলো?গুটিগুটি এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের কাছে।গ্যাস ওভেন মুছছে ইমন।
-আই এ্যাম সরি ইমন।
-ও হ্যাঁ, সৌগত!এই এলেবেলে ইতিহাসে এম এ ইমন কোনদিন বাবার বাড়িতে ঘর মোছেনি,বাসন মাজেনি,কোনদিন দাদার,বাবার জাঙিয়া কাচেনি।এই আমেরিকায় থাকা তার সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য সেটা দয়া করে ইমনকেই ঠিক করতে দাও।যে তার পরিসেবা নেয় সে যেন ঠিক না করে।
টানা কথা বলে কাঁপতে থাকে ইমন।বুকে তীব্র যন্ত্রণা টের পায়।হাঁটু মুড়ে আসে পড়ে যাবার আগে বুঝতে পারে সৌগত ছুটে এসে ধরে ফেলেছে ওকে।
(রং-৪)
সারাদিন অফিসে মেজাজ খিচড়ে থাকে আবহমানের।কিছুতেই ফোন নম্বর দেয়নি,নিতেও চায়নি।এতে নাকি পারিবারিক জীবন নষ্ট হবে।পারিবারিক জীবন মানে তো ভিন্ন রুচীর এক মানুষের সাথে মানিয়ে চলা।আর কি বা আছে?ছটফট করতে থাকে আবহমান।বায়োমেট্রিকক্যাল শুরু না হলে আজ অফিস থেকে বেরিয়ে যেতো।বাড়ি ফেরার পথে এতটাই অন্যমনস্ক ছিলো যে পরিচিত কামরায় ওঠেই নি।সোদপুর কখন পেরিয়ে গেছে খেয়ালো করেনি।খড়দায় ট্রেন ঢুকতেই অবাক হয়ে গেলো আবহমান।কোথায় যাচ্ছে সে,কেন যাচ্ছে কিচ্ছু মনে করতে পারলো না।খড়দা স্টেশনে নেমে একটা চায়ের দোকানের পাশে বেঞ্চে বসে পড়লো।গান ভেসে আসছে।
"তেরে দর পর সনম চলে আয়ে/তু না আয়ে তো হাম চলে আয়ে"
ফোনটা খুলে অফ লাইন দেখতে দেখতে গলা দলা পাকিয়ে আসলো কান গরম হয়ে উঠলো।বারবার এ্যাকাউন্ট খুলে নীল জামদানী পরা ছবিটা দেখতে লাগলো আবহমান।
"ইসসে পহেলে কে হামপে হাসতি রাত/বনকে নাগিন যো হামকো ঢশতি রাত/লেকে আপনা ভরম চলে আয়ে"
এলোমেলো পায়ে ফেরার ট্রেন ধরে এক সময়।ট্রেন চলতে শুরু করলে ঠাণ্ডা হাওয়ায় স্বস্তি পায়।বাড়ি ফিরে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খোলে তাথৈ।
-সারপ্রাইজ বাবাআআআ।কি হয়েছে তোমার?
ম্লান হেসে আবহমান মেয়েকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে ভেতরে আসে।হাসি মুখে মৌটুসী বলে,
-কেমন সারপ্রাইজ হুম্!
মৌটুসী তাথৈয়ের কথা শুনতে শুনতে ফ্রেশ হয়ে ডিনারে বসে।মেয়ে আসার আনন্দে চিকেন বিরিয়ানী করেছে মৌটুসী।নাড়াচাড়া করতে থাকে আবহমান।
-নন্তু কি হয়েছে তোমার?খাচ্ছো না,কথা বলছো না।
-আমি শুনছি তো।
-কি কথা বলছিলাম বলো তো বাবা?
কোনো উত্তর দিতে পারেনা আবহমান।তীব্র অভিমান আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে ওকে।কি এমন হলো?প্রায় চব্বিশ ঘন্টা হতে চললো কোনো কথা নেই।মেসেজ নেই।এমনকি অনলাইন পর্যন্ত না।
-আসলে আজ শরীরটা ঠিক নেই।সরি,এতো ভালো বিরিয়ানীটা...
-তুমি উঠে যাও আমি প্লেট নিয়ে নেবো।আর ফ্রিজের ওপর বক্সে ইনো আছে একটা খেয়ে নাও।তাথৈ বাবাকে জলের বোতলটা দে তো।বহুবার বলেছি নিজের যত্ন নিতে।
-প্লিজ মা সব সময় পেছনে লেগো না তো।দেখছো তো শরীর খারাপ।
-তুই ওর নিজেকে অবহেলাটা তো রোজ রোজ দেখিস না।তাহলে বুঝতি।
ইনো খেয়ে চুপচাপ পাশের ঘরে এসে গুলজারের শায়রী চালিয়ে রকিং চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো আবহমান।চোখ বুঁজে দিতেই "তুম এঁহি কঁহি হো"নিজের আবেগ কন্ট্রোল করতে পারেনা।আশ্চর্য কিসের টান।যাকে কখনো সামনে থেকে দেখেনি,কোনদিন ছোঁয়নি আজ তার জন্য টিন এজেরবাচ্চাদের মতো ছটফট করছে কেন?অক্টোবরের পর এই মে মাসের প্রায় শেষে সে মেয়েকে দেখছে অথচ কোনো আবেগ নেই।নিজের উপর রাগ হয় খুব।সম মনের মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে মুগ্ধতা এমন পর্যায় কেন গেলো?
-বাবা, তুমি কাঁদছো?
লাফিয়ে বসে চোখ মুছে ফেলে আবহমান।
-না রে পাগল।ঘুম এসেছে তাই চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
-বাবা আমি পাঁচ মিনিট ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি।তুমি ফোঁপাচ্ছিলে।কি হয়েছে বাবা?
-কিচ্ছু না তাথৈ তুমি মার কাছে যাও।আমি একটু একা থাকি।
তাথৈ এগিয়ে এসে আবহমানের পাশের ছোট্ট টুলটায় বসে।গায়ে হাত রাখে।
-বাবা,আমি কুড়ি এখন।তোমার বন্ধু হবার মতো বড়ো কিন্তু হয়েছি।তুমি অত্যন্ত মজার মানুষ।তোমার ভালোবাসা গাছের মতোই খাঁটি।আমি তোমায় বিশ্বাস করি,শ্রদ্ধা করি।কি হয়েছে বলো বাবা।
আবহমান কাউকে একটা বলতে চাইছিলো বোধহয়।তাছাড়া তাথৈ ছোটো থেকেই যথেষ্ট বুঝদার।গত দুবছর ধরে দেরাদুনে পড়ার সূত্রে থাকতে গিয়ে আরো পরিণত হয়েছে।কিছুক্ষণ পর বলে-
-আমার এক বন্ধু হঠাৎ করেই কোনো যোগাযোগ করছে না।
-তো?না মানে তোমার সাথে কি ঝগড়া হয়েছিলো?
-না,বরং সহজ কথাই হয়েছে।
-কতদিন যোগাযোগ করে না?
-একুশঘন্টা।
-হোয়াট?বাবা আর ইউ ক্রেজি?সত্যি করে বলোতো বন্ধু না বান্ধবী?
আবহমান চুপ করে যায় ধরা পড়ে গিয়ে।তাথৈ মুচকি হাসে।
-বাবা,হয়তো তার ফোনটা নষ্ট হয়ে গেছে।
-আমেরিকায় ফোন নষ্ট হলে ঠিক করতে কতক্ষণ লাগে?
-ওয়াও বাবা,বিদেশিনী বান্ধবী?নট ব্যাড।
-আরে বাঙালী।তুই যা এখান থেকে।
-বাবা,ওখানকার ওয়েদার রিপোর্ট দেখো।হয়তো খারাপ অবস্থা খুব।আবার শরীর টরির খারাপ হতেও পারে।
আবহমান সোজা হয়ে বসে।এদিকগুলো সে তো ভাবেনি।প্রতিটাই তো যুক্তিপূর্ণ।
-ফোন নম্বর নেই?কল করো।
-ফোন নম্বর দেয়নি।
-ইন্টিলেজেন্ট ওম্যান।অস্থির হয়োনা বাবা
অপেক্ষা কর।...আর হ্যাঁ আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি।বন্ধুত্বে আপত্তি নেই বাবা।তার বেশী কিছু হলে আমায় মার পাশেই দেখতে পাবে চলি গুড নাইট।
দুষ্টু হেসে চলে যায় তাথৈ।আবহমান লজ্জিত হয় নাকি দৌড়াতে দৌড়াতে দাঁড়িয়ে যায় বোঝে না।
(রং-৫)
খুব ধীরে চোখ খুলতেই ওষুধ গন্ধটা টের পায় ইমন।অস্পষ্ট থেকে দৃষ্টি স্পষ্ট হয় সৌগতর মুখে।ওকে তাকাতে দেখে এগিয়ে আসে সোফা ছেড়ে।
-কেমন লাগছে?
ঘাড় নেড়ে ভালো বলে।সৌগত চুপ করে তাকিয়ে থাকে।ইমন সেই দৃষ্টিতে একটু ভয় দেখতে পায় যেন।ডাক্তার এসে সব কিছু চেক করেন যন্ত্রের মতো।ইমনের মনে পড়ে অস্পষ্ট ভাবে যতবার চোখ খুলেছে সৌগতকে দেখতে পেয়েছে।দেখতে পেয়েছে বড়ো বড়ো মেশিন,আলো।কিছু মনে পড়তেই হাত নেড়ে ইশারা করে, সৌগত কাছে এলে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে,
-আমার কুমড়ো গাছ।
-আজ তিনটে ফুল এসেছে।আমি রোজ জল দিয়েছি।আর হ্যাঁ তোমার ফোন সুইচ অফ।কোথায় যে রেখেছো খুঁজে পাইনি। ইনফ্যাক্ট সময় হয়নি।তোমার কি মনে আছে?তাহলে এনে দেবো।অবশ্য কাল তোমায় ডিসচার্জ করছে।
মাথা নেড়ে না বলতে বলতেই আচ্ছন্ন হয়ে যায় ইমন।সৌগত ফ্যালফ্যাল করে ওর তলিয়ে যাওয়া দেখে।তারপর ফাঁকা বাড়িতে ফেরে একা।ভারতে ফোন করে ধীরে ধীরে সবাই কে জানায়,ইমন ভালো আছে কাল ফিরবে।একটা ব্লকেজ পাওয়া গেছে অগাস্টে অপারেশান।ক্লান্ত সৌগত,বার্গার মাইক্রো অভেনে গরম করে।বাড়ি ফিরলে ঠিক কি বলবে ইমনকে সবটা বারবার বিড়বিড় করে।পরদিন ইয়ার্ডের গাছগুলোতে জল দিয়ে দেখে কুমড়ো ফুল মোট পাঁচটা।খুশির আলো মেখে ইমনকে আনতে যায় সৌগত।
(রং-৬)
এখন আর কোনো কষ্ট নেই আবহমানের হঠাৎ আসা খুশি হঠাৎ ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে তার জীবন থেকে।প্রায় পনেরো দিন ইমনের কোনো খবর পায়নি।রোজ ঢুঁ মেরেছে ওয়ালে।ওদিক থেকে কথা শুরু না হলে কোনো মেসেজ করা সঙ্গত নয় বুঝে কোনো মেসেজ করেনি।তাথৈ চলে গেছে ছদিন।ও চলে গেলে রাতে মৌটুসী ঝাঁপিয়ে পড়েছে বুকে,মৃদু কিল মেরে বলেছে,
-জানোনা,তোমায় না ছুঁলে ঘুম আসে না।
অনেকক্ষণ আদর করেছে দুজনা দুজনকে।সকালে সরোদ শোনার সময় পায়ে পায়ে পাশে এসে বসে মৌটুসী।হাত রাখে বেড়ে ওঠা ভূঁড়িতে কিছু বলে না যদিও।মেয়ে যে কিছু বুঝিয়ে গেছে মাকে ঠের পায় আবহমান।ভালোই লাগে তার,এটুকুই তো চাওয়া।আজ একগাদা বেলিফুল ছাদ থেকে এনে দিয়েছে মৌটুসী কে।জুনের আজ সতেরো।সবকিছু যেন বেশ ঝরঝরে হয়ে গেছে।মৌটুসী কিটি পার্টি সেরে টায়ার্ড হয়ে ঘুমিয়ে গেছে।সৌগত পেঁপের তরকারি দিয়ে দিয়ে রুটি খেয়ে গান শুনছিলো।হঠাৎ নটিফিকেশান টোনে চমকে ওঠে।এতো রাতে নোটিফিকেশন?তবে কি?টানটান হয়ে বসে মোবাইলটা খোলে।স্ক্রিন জুড়ে ছবি।
-আমাদের কুমড়ো গাছ ফুলে ফুলে ভরে গেছে।কাছের বন্ধুদের ছবি পাঠালাম।
ম্যাসেঞ্জার খুলে বসে থাকে আবহমান।একটা মেসেজ শুধু একটা মেসেজ এলেই আবহমান সিন করবে কিন্তু উত্তর দেবে না।একটা,ব্যাস্ একটা মেসেজ।
সেই মা
মো হ না দে ব রা য়
সকাল থেকেই মনটা বড়ো খারাপ। মায়ের জন্য। কতোদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি। খুব মিস করছিলাম।
সেইসঙ্গে অবাকও হচ্ছিলাম। এতদিন কেন মন খারাপ হয়নি? কাজের চাপে কি এতই ব্যস্ত ছিলাম? কবে এত ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমি?
প্রশ্নগুলো ছারপোকার মতো কামড়াচ্ছিল সারাদিন। অবশ্য সেই কামড় গুলো আমি অনুভব করছিলাম ডেস্কটপের সামনে বসে বসেই। লকডাউনের বাজারে বারো ঘন্টা work-from-home করছি, দুঃখবিলাসিতার সময় কোথায়? সত্যিই বড়ো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি।
হঠাৎ মাথার ভিতরে গুনগুনিয়ে উঠল একটা গানের কলি, "জ়রা নজ়রোঁ সে ক্যাহে দো জ্বী, নিশানা চুক না যায়ে... জ়রা নজ়রোঁ সে ক্যাহে দো জ্বী..."
কেন মনে পড়ল হঠাৎ গানটা? কীবোর্ডের ওপর আঙুলগুলোকে কুড়ি সেকেন্ড পজ় করে রাখতেই মনে পড়ল কারণটাও। অনেক ছোটবেলায়, আমাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে যে গানগুলো গেয়ে ঘুম পাড়াতো মা, এটা তার মধ্যে ছিল একটা।
আমার মা কোনদিনই সঙ্গীতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিল না, গান শুনতে ভালোবাসলেও, গাইতে পারত না। কিন্তু তবুও গাইতে হতো আমার জন্যই। মায়ের গলায় সেই সুর-বিচ্যুত গানই হয়ে উঠতো আমার জন্য জৃম্ভ্রকাস্ত্র।
ভীষণ শুনতে ইচ্ছে হলো গানটা। চালিয়ে দিলাম। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ভরাট স্বর প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো আমার একফালি ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে।
খানিকটা শোনার পরেই কিন্তু অনুভব করলাম, এটা একটা নতুন গান... যে গানটা আমি মায়ের মুখে শুনতাম, এটা সেটা না। মায়ের গলায়, ওই যে জায়গাটা... "তুমহারে ইস্ শরারত্ সে না জানে কিসকি মউত আয়ে... জ়রা নজ়রোঁ সে ক্যাহে দো জ্বী..."-- ওখানটায় সবসময় সুর কাটতো। ওইখানটুকু তে লাগতো মার মায়ের নিজস্ব সুর...
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরপ্রয়োগ সেই ত্রুটি থেকে মুক্ত।
কিন্তু আমি যে খুঁজছি সেই ত্রুটিটাই...!
শুনতে পারলাম না, শেষ স্তবকে এসে বন্ধ করে দিলাম গানটা। মা কখনো এতদূর গাইতেও পারতো না। মনেই থাকতো না মায়ের।
উঠে পরলাম। একটু মুক্ত বাতাস দরকার। বাইরে তো বেরোনোর উপায় নেই, ছাদে যাওয়া যাক। কিন্তু ছাদের কথা মনে হতেই আবার মা এসে হাজির হলো মনে।
এইরকম লক ডাউন আগেও হয়েছিল একবার, দুহাজার কুড়ি সাল নাগাদ। তখন আমি দশ। খেলতে যেতে না পেরে, বিকেল বেলা কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করে বেড়াতাম সারা বাড়ি জুড়ে...
মা ব্যাপারটা একদিন দেখলো, দুদিন দেখলো, তিনদিনের দিন থেকে, যতদিন লক ডাউন চলেছিল, রোজ আমায় নিয়ে ছাদে যেত মা, আমরা ক্রিকেট খেলতাম দুজনে। সেই মা...
স্মৃতি যেন হুড়মুড়িয়ে জবরদখল করতে লাগলো আমার চেতন-অবচেতন...
সেই সে বার... যেদিন মা আমায় প্রথম সিগারেট খেতে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল, দেখেছিলাম, সারা দিন চোখ লুকিয়ে বেড়াচ্ছে মা। আমি হাজার বার করে ক্ষমা চাওয়ার পরে বলেছিল, "তুই এখন বড়ো হয়েছিস, কী খাবি না খাবি তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার। একটু সময় দে, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে পারবো ব্যাপারটা। প্রথমবার তো, তাই একটু শক পেয়েছি।"
আমি অবশ্য সেইদিন, ও জিনিস আর জীবনে কখনো না স্পর্শ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু রাখতে পেরেছিলাম কি? ছয় মাসের সেট্ল্ ইন করা নেশা কি এতো সহজে ছেড়ে যেতে পেরেছিল আমায়?
না... আমাকে শুধু আরও ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
মা কি কিছুই বোঝেনি?
বুঝলেও, কখনো বুঝতে দেয়নি যে বুঝেছে। কোনো প্রশ্নও তোলেনি কখনো। সেই মা...
আরও ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে...
কতো অসংখ্য ঘটনা... অসংখ্য স্মৃতি...
ভীষণ স্পর্শকাতর বাচ্চা ছিলাম আমি। যখন নার্সারী স্কুলে পড়তাম, স্কুলের বন্ধুরা পিছনে লাগলে, বা কারোর কাছ থেকে কোনোরকম আঘাত পেলে, বাড়ি এসে সাংঘাতিক গুমরে থাকতাম, কারোর সাথে কোনো কথা বলতাম না।
মা জিজ্ঞেস করলেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতাম। মনে আছে, মা একদিন বলেছিল... আমার বোঝার বয়েস হয় নি, তবু বলেছিল... "শোন, তুই কাঁদলে, মন খারাপ করে থাকলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তেমন কষ্ট আর কোনো কিছুতেই হয় না। এটা তোর থেকে লুকোনোর কিছু নেই, আর উচিতও নয় লুকোনোটা। এবার থেকে তোর যখন যার ওপর রাগ হবে, দুঃখু হবে, আমায় মেরে হাতের সুখ করে নিস, সেও ভালো। কিন্তু মন খারাপ করে থাকিস না। আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না তাহলে।"
অনেক পরে বুঝেছিলাম আমি কতো ভাগ্যবান, আর আমার মা ঠিক কতখানি ব্যতিক্রমী। কারুর উপর রেগে গেলেই, মায়ের ওপর রাগ দেখানোর সেই অভ্যাস বহুদিন ত্যাগ করতে পারিনি আমি। সেই মা...
আরও এমন কতো কথা, কতো উপদেশ... বয়সের স্বভাবে হয়তো বিদ্রোহ করেছি কোনোটার... কোনোটা আবার মেনে নিয়েছি প্রবল অনিচ্ছার সাথে। সব আজ আর মনে নেই। কিন্তু 'মনে' আছে সবই। সেই পথ ধরেই তো হাঁটি আজও, শুধু মা-ই...
ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম বটে, কিন্তু ছাদে যাওয়া আর হলো না। রান্নাঘরের দিকে এগোলাম। ইন্ডাকশন ওভেনের সামনে দাঁড়িয়ে যন্ত্রের মতো খুন্তি নেড়ে চলেছেন এক প্রৌঢ়া। মৃদুস্বরে তাঁকে সম্বোধন করলাম আমি।
আমার দিকে চোখ না ফিরিয়েই ক্লান্ত প্রশ্ন ভেসে এলো তাঁর তরফ থেকে, "কফি?"
"না। এমনি এলাম। কিছু ভালো লাগছে না।"
উত্তর এলো না।
"একটা কথা বলবো?" আমিই সাহস করে বলি।
উত্তর এলো না এবারও"কোনো সাহায্য করতে হবে?" হাস্যকর ঠেকলো কথাটা নিজের কানেই।
"উঁহু।"
"দুমিনিট কথা বলা যাবে?"
"কী কথা?"
"এমনি সাধারণ কথা।"
আবারও উত্তর এলো না।
হতাশ হয়ে রান্নাঘরের দরজা থেকে সরে এলাম আমি। এই মুহূর্তগুলোতেই তাকে মিস করি সবচেয়ে বেশি।
সারাদিন আর কী মন খারাপ হয়েছিল... তার চতুর্গুণ মন খারাপের পাহাড় নিয়ে ফিরে এলাম নিজের ঘরে।
কিন্তু আমিই দায়ী। হ্যাঁ, আমিই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আস্তে আস্তে নিজের ক্যারিয়ার, লেখালেখি, সবকিছু নিয়ে অবর্ণনীয় রকমের আত্মমগ্ন হয়ে গিয়েছি আমি। আর, দিনের পর দিন নিষ্ফল ভাবে আমার সামান্যতম মনোযোগ ভিক্ষা করতে করতে প্রবল আত্মসম্মানী আমার মা ধীরে ধীরে নিজেকে অভিযোজিত করেছে এক অনুভূতিহীন, অভিব্যক্তিশূন্য মানুষে, শুধু যন্ত্রের মতো কাজ করা ছাড়া যারা আর কোনো ব্যবহারিক মূল্য নেই।
বাবার মৃত্যুর পর, সম্পূর্ণ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে মা।
হ্যাঁ, মায়ের সাথে আমি একই ছাদের তলায় থাকি, কিন্তু এক বাড়িতে থাকা ঘুচেছে বহুদিন। এখন আর কোনো কাজই একসঙ্গে হয় না আমাদের। শেষ কবে মায়ের মুখটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেয়েছি, সেটাও মনে পড়ে না।
নাহ্... এ বরফ একদিনে গলার নয়, একমাসে গলার নয়, হয়তো এক বছরেও নয়।
কিন্তু গলাতে হবে। না হলে যে অনুতাপ নিয়ে আমায় মরতে হবে, সেটা অনুতাপ নয়, সেটা পাথর। আগ্নেয় পাথর।
ঘর থেকে স্পিকারটা নিয়ে এসে খাবার টেবিলের ওপর রাখলাম আমি। ফোনের সাথে যোগ করে, ভলিউমটা বাড়িয়ে দিলাম পুরোটা। হলজুড়ে গমগমিয়ে উঠল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর... "জ়ারা নজ়রোঁ সে ক্যাহে দো জ্বী..." আমার মায়ের অন্যতম প্রিয় গান।
আড়চোখে দেখে নিলাম, রান্নাঘর থেকে অবাক দৃষ্টিতে ঘরের দিকে তাকিয়ে আছেন সেই প্রৌঢ়া, সেই দৃষ্টিতে বিস্ময়, অবিশ্বাস, আর... আর একটা ব্যাখ্যাতীত ভরসা-- মিলেমিশে গেছে এক অদ্ভুত অনুপাতে। সেই দৃষ্টির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে... আমার মা।
দিনটা অবশ্য মে মাসের কোনো রবিবার ছিল কিনা, জানি না।
অণুগল্প
শিম্পাঞ্জির বাচ্চা
কি ঞ্জ ল রা য় চৌ ধু রী
চতুর্দিকে হই হই, যেন সাংঘাতিক কিছু ঘটে গেছে। ব্যাপার কি? জানতে পারলাম, একটা শিম্পাঞ্জির বাচ্চাকে সিজারের মাধ্যমে প্রসব করানো হয়েছে।
এটাই ঘটনা। এই নিয়েই বিস্তর ফোনাফুনি-লেখালেখি-চুলোচুলি-মত বিনিময়...
একদল প্রশ্ন তুলল 'এই যে শিম্পাঞ্জির দেহে মানুষের মতন ছুরি কাঁচি চালানো হল, এটা কি মনুষ্য জাতির পক্ষে অপমানকর নয়?' অশিক্ষিতের প্রশ্ন।
শিক্ষিতরা প্রশংসা করল মন খুলে। বলা হল 'মানুষ যে এগোচ্ছে, এটাই তার প্রমাণ।'
যারা বুঝল, হাততালি দিল। বেশির ভাগই অবাক। 'সত্যি? এমনও হয়!' চায়ের আড্ডায় বন্ধুরা বলল 'গুজব।' রাশভারি সিনিয়র লোকরা মন্তব্য করলেন 'যতসব মিডিয়ার কারসাজি'।
টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট চলছিল। গরাদ ঘেরা একটা বদ্ধ লনের মধ্যিখানে ছানা কোলে মা শিম্পাঞ্জি। ওদের ঘিরে মেডিক্যাল টিমের বিশেষজ্ঞ আর ক্যামেরা-বুম হাতে সাংবাদিকদের গম্ভীর আলোচনা। বাচ্চাটা তখন মায়ের রোমশ বুকে হাত চালিয়ে স্তন খুঁজছে। আর মা শিম্পাঞ্জি বাচ্চার কচি লোম খুঁটে খুঁটে উকুন মারছে পটাপট্। চারপাশে কি হচ্ছে যেন বয়েই গেল!
আমাকে কাঁচা ঘুম থেকে টেনে তুলে এনে দৃশ্যটা দেখিয়েছিল আমার স্ত্রী।
--"দ্যাখো দ্যাখো, শিম্পাঞ্জির হাসিটা কি সুইট্ না! একটা ছবি তুলে নাওনা প্লিজ্!"
ফোনক্যামেরা তাক করলাম৷ চোখ একদৃষ্টে স্থির। হাসছে? সত্যিই শিম্পাঞ্জিটা হাসছে কি? বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে একেবারে মুখ বাড়িয়ে ঝুঁকে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল মা শিম্পাঞ্জিটাও আমাকেই দেখছে! ওর গোল গোল গুলিচোখগুলো কটমট করছে। বুকে ধরা বাচ্চাসমেত পাশ ফিরে যেন আড়াল করতে চাইছিল কিছু! আমার আঙুল ক্যামেরা জুম করছে। একটা লোহার গরাদ ক্রমশ এগিয়ে আসছে একটু একটু করে…ঠিক বুঝতে পারছিনা … চিড়িয়াখানার বাইরে না ভেতরে আছি!
'এবং খোঁজ',
শারদ সংখ্যা (আশ্বিন)
অঙ্কনশিল্পী: তমোজিৎ ভট্টাচার্য্য, শুভদীপ মন্ডল