রম্যরচনা 

একটি নাগরিক রূপকথা

অ মি ত  চ ক্র ব র্তী


ছেলেটির নদী ছিলনা কোনো। তার সমুদ্র ছিলনা, পাহাড় ছিলনা, অরণ্য ছিলনা, এমন কি পুরো আকাশটুকুও না। সে বাঁশি বাজাতে পারত না, গান গাইতে পারত না, রঙ্গীন তুলির আঁচড় টানতে পারত না। অসাধারাণ বলতে কিছুই ছিলনা তার। শুধু ছিল দুটো বড় বড় চোখ, চুপচুপ, মোহময় দিগভ্রান্ত দু’টো চোখ ---আর তাকিয়ে থাকার মত একটি হলুদ বাড়ি। শহরের ঘিঞ্জি গলিতে পুরো আকাশটুকুর অংশীদারী জুটত না তার ---কিন্তু হলুদ বাড়িটি তাকে সব ভুলিয়েছিল। তার অতিস্বাভাবিক জীবনে ছিল কলেজে যাওয়া ও ফেরা কিন্তু ফেরায় আগ্রহ ছিলনা তার; তার জন্যে কেউ অপেক্ষা করত না। ঘরের বাইরে থাকতেও ভাল লাগত না তার, কথা বলার লোক পেতনা সে। ভাষা তার চিন্তার সঙ্গে কোনোদিনই সহযোগিতা করেনি। বিষাক্ত শহরটা তার সব নিংড়ে নিয়েছিল, নিতে পারেনি শুধু দেখবার আকাঙ্ক্ষা আর হলুদ বাড়ির অজানা রহস্য।

সেই হলুদ বাড়িতে থাকত এক মেয়ে। ছেলেটি তাকে দেখত। সন্ধ্যায় সে ঘরে ফিরলে হলুদ বাড়িতেও জ্বলত আলোঃ জানলার কাচে পড়ত মেয়েটির দীর্ঘ স্রোতস্বিনী ছায়া। ছেলেটি দেখত। সে শুনতে পেত মেয়েটির মৃদুহাসির কলতান। আর মেয়েটি যখন জানলায় বসে চুল বাঁধত, চুলের ঝর্ণায় সে পা ডোবাত। গভীর রাতে হলুদ বাড়ির আলো নিভে গেলে ছেলেটি বেহালা নিয়ে বসত। খুবই অপটু হাত ছিলো তার --- দুঃখের কণাটুকুও বাজনায় ফোটাতে পারত না। ভাষা তাকে বঞ্চনা করত, সুর তাকে ধরা দিত না। তবে এক একদিন যেদিন চাঁদ উঠত, একচিলতে জ্যোৎস্না এসে তার ঘরে উঁকিঝুঁকি দিত, সেদিন কালির আঁচড়ে সে কুমারী কাগজে দিত প্রাণ, লিখতঃ

ভাষার ভিতর দিলাম কণ্ঠস্বর

ভাষার ভিতর দিলাম চোখের চাওয়া

সুরের ভিতর দিলাম অশ্রুজল

গানের ভিতর তোমায় কাছে পাওয়া।


সে জানত তার ভাষা নেই, তার সুর নেই, তার গান নেই, এমনকি এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি সে কোনোদিন। তবু সে প্রায় রাতেই সেই একই কথা লিখত। আর চূড়ান্ত দুঃখের দিনে চুপিচুপি মেয়েটিকে বলত, “বল, একবার বল ভালবাসি”। 


দিন যায়। চৈত্রের দিন, শ্রাবণের দিন, পৌষের দিন। তারপর একদিন সেই ঘটনাটা ঘটল। কলেজ যাওয়ার পথে একটি মেয়ে এসে তাকে বলল, একবার এদিকে আসবেন? সুধা আপনাকে একটু ডাকছে। সুধা কে, সুধা কে, সুধা কে, সুধা কোন মেয়েটি ! ছেলেটির বুকের মধ্যে টিনশেডে বৃষ্টিপতন, ছেলেটির বুকের মধ্যে ঝমঝমাঝম ক্ষুরের আওয়াজঃ সংযুক্তা কি পৃথ্বীরাজে সাজালো চন্দনে ! একটু দূরে গাছের তলায় মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল। ছেলেটি তাকাল। দিনের অকৃপণ আলোয়, সূর্যের অনাবিল দাক্ষিণ্যে ছেলেটি তাকাল।  কূজন ভেসে আসে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার হতেঃ

তুমি আমাদের বাড়ির দিকে অমন ক’রে তাকাও কেন রোজ?

ও বাড়ির তুমি আছে বলে । 

কী আশ্চর্য ! এই প্রথম ভাষা তার সঙ্গে শত্রুতা করলো না – এই প্রথম তার কণ্ঠস্বরে বসন্তের ছোঁয়া ধরলো, এই প্রথম তার সুরে আনন্দ ঢেউ খেলে গেল। মেয়েটিও বলতে পারতঃ

জয়সিংহ, তুমি বুঝি একা !

                      তাই দেখিয়াছি কাঙাল যে জন

তাহারও কাঙাল তুমি ।

যে তোমার সব নিতে পারে

তারে তুমি খুঁজিতেছ যেন !

কিন্তু মেয়েটি শুধু বললো, ও। কত নিঃসংশয়, কত নিঃসংকোচ এই একটি শব্দ। এতদিন ধরে যে প্রশ্নের উত্তর সুধা খুঁজে এসেছে, আজ তাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে তার যেন আর কোনো দ্বিধা নেই, দ্বন্দ্ব নেই, কুণ্ঠার লেশমাত্র নেই।


এইটূকূই। আর কিছুই নয়। তারপর তারা দু’জনে দুদিকে চলে গেল। ছেলেটি যথারীতি কলেজের পথে, মেয়েটি নিজস্ব সময়ের খেয়ায়। কিন্তু আজ অন্যদিন। আজ অন্যরকম দিন। আজ সূর্য একটু বেশি আলো দিল ছেলেটিকে, বাতাস ভাসিয়ে আনলো দূরাগত পাখির শিস, পৃথিবী দিল অজানা স্নেহের বন্ধন। ছেলেটির চীৎকার ক’রে বলতে ইচ্ছে করলো, দ্যাখো, আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, আমি কত সুখী। আমি সুখী, আমি আজ সুখী। কিন্ত কাউকে বলতে পারল না সে। বলা তার অভ্যাসে ছিলনা, ব্যতিক্রম একবারই শুধু ঘটেছে। 


দিন যায় ফের, গড়িয়ে গড়িয়ে। বেলা, অবেলা, কালবেলার দিন। ছেলেটি এখন হাসতে শিখেছে। প্রৌঢ়া পৃথিবীটাকে এখন ভাল লাগে তার। বিষাক্ত শহরটাও এখন তাকে দেয় প্রেরণা। পুরোনো কলেজ আর অধ্যাপকের নির্বোধ ভাষ্য সে নীরবে ক্ষমা ক’রে দেয়। জ্যোৎস্না এসে যখন খেলা করে তার ঘরে, সে তাকিয়ে দেখে আর আপনমনে হাসে। তারপর রাত গভীর হয়, সৃষ্টির প্রথম রাতের নির্জনতা নেমে আসে। অনাঘ্রাত কাগজ খুলে সে একবার সাদা পাতার দিকে তাকায়; তারপর গোটাগোটা অক্ষরে তার প্রথম অশ্রুর জন্ম দেয়ঃ


সুধা, মনুয়া পাখী আমার, ভুলে যাওনি তো ?




'এবং খোঁজ', 

শারদ সংখ্যা (আশ্বিন)

অঙ্কনশিল্পী: তমোজিৎ ভট্টাচার্য্য, শুভদীপ মন্ডল