বদ্রি আর মানা গ্রামে
শৌ ভি ক রা য়
ওই নিচে অলকানন্দা। আক্ষরিক অর্থেই আঙুলের মতো দেখাচ্ছে। ঠিক কতটা উচ্চতায় আছি বুঝতে পারছি না। তবে বেশ ভয় ভয় লাগছে। আমার একটু অ্যাক্রোফোবিয়া আছে। মানে উচ্চতার ভয়। কিন্তু চারদিকের এই পাগল করা প্রকৃতিতে সেসব উধাও। কেদারনাথ দর্শন শেষে গৌরীকুন্ড থেকে রওনা দিয়েছি সেই সকালে। উখিমঠে সকালের জলখাবার খেয়ে চোপতা পৌঁছেই চোখ ট্যারা হয়ে গেছিল! এরকমটাও হয় নাকি? চারদিকে দেওদার, পাইন আর দূরে শ্বেতশুভ্র উত্তুঙ্গ পাহাড়চূড়ো নিয়ে সে এক অসম্ভব কান্ড! কিছুতেই ওখান থেকে আসতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল জীবনের তাঁবু যদি এখানে পাততে পারতাম, তবে বেশ হত!
কিন্তু সে কি আর হয়? হিমালয়ের পথে চমক তো পদে পদে। এ বলে 'আমায় দ্যাখ', ও বলে 'আমায় দ্যাখ'! এই দেখতে দেখতেই চলে এলাম চামোলি হয়ে যোশীমঠে। এখানকার মন্দির দর্শন করতেই হবে। কেননা বদ্রিনাথ শীতকালে এখানেই অবস্থান করেন। গারোয়াল হিমালয়ের এই মন্দিরগুলির চেহারা আমাদের জানাশোনা মন্দির থেকে একেবারেই আলাদা। শঙ্করাচার্যের মঠ, নরসিংহ মন্দির ইত্যাদি ঝটপট দেখে আবার যাত্রা শুরু। তবে পঞ্চবদ্রির কথা এই প্রসঙ্গে একটু বলতেই হয়। আমাদের গন্তব্য বদ্রিবিশাল ছাড়াও গারোয়াল হিমালয়ে আদি বদ্রি, বৃদ্ধ বদ্রি, ধ্যান বদ্রি, আধ বদ্রি ও যোগ বদ্রি। প্রতিটি স্থানেরই নিজস্ব মাহাত্ম্যের পাশাপাশি নৈসর্গিক দৃশ্য অসামান্য।

যোশীমঠ থেকেই আভাস পাচ্ছিলাম যে, এবার দেখতে পাব ভয়ঙ্কর সুন্দরকে। অনুমান সত্যি হল। হিমালয়ের রুক্ষতা ধরা পড়ল এবার। কোথাও কোথাও রাস্তার ওপর পাহাড় যেন ছাদের মতো হয়ে রয়েছে। অদ্ভুত সব বাঁক। এক একটা বাঁক পার করছি, উঠে যাচ্ছি কয়েক শ' মিটার। কালো পাহাড়ের গায়ে কখনও দেখা যাচ্ছে মরশুমি ফুলের ঝাঁক। ওপাশের পাহাড় তীব্র মাদকতাময়। আর মাঝে বয়ে যাচ্ছে অলকানন্দা। আক্ষরিক অর্থেই হাতের আঙুলর মতো। একবার ভাবলাম যে কোনও কারণে একচুল এদিক ওদিক হলে কোথায় যে গিয়ে থামব কে জানে! কিন্তু সে ভাবনাও কেটে গেল নিমেষে হিমালয়ের অনিন্দ্য শোভায়।
একসময় পৌঁছে গেলাম ৩১৫৫ মিটার উচ্চতার বদ্রিনাথে। এতটা উঁচুতে তবু মনে হচ্ছে না যেন! বরং অনেকটাই সমতল মনে হচ্ছিল চারদিকের পাহাড় দেখে দেখে। তবে ভালভাবে বুঝবার আগেই ঝপ করে অন্ধকার নেমে এল। কিন্তু সেই অন্ধকার কেটে গেল আকাশে পূর্ণ শশীর আগমনে। দুম করে মনে হল আজ তো লক্ষী পূর্ণিমা! মনে পড়া মাত্রই দৌড় বদ্রিনাথের মন্দিরে। এই সুযোগ কি কেউ হাতছাড়া করে? গতকাল মাথা ঠেকিয়েছি কেদারনাথে, আজ বদ্রিনাথ। কজনের ভাগ্যে এরকমটি হয়? তার ওপর কোজাগরী। কপাল খুব ভাল। মন্দিরের ভেতর বসবার জায়গা পেলাম আমার পুজোর থালির জন্য। এখানে বলে রাখি যে, খুব কিছু ধার্মিক বা ভক্ত নই। কিন্তু তাই বলে এক মহাশক্তিকে অস্বীকার করব সেরকমও নই। সেই শক্তির টানেই তো চলছে দুনিয়া। সেই শক্তিই তো ধরে রেখেছে এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড! সেই শক্তির জন্যই কাল ছিলাম কেদারনাথে, আজ এই কোজাগরী সন্ধ্যেয় বদ্রিনাথের কাছে। পুজো দেখি তাই। আর ভাবি যে, অবশেষে সম্পূর্ণ হল আমার পরিক্রমা! কিন্তু উল্টোপথে। তবে হোক সে তা! কজন পারেন! আমি প্রবল ভাগ্যবান। তাই সম্ভব হয়েছে!
বদ্রিনাথ মন্দিরের দুপাশে নর ও নারায়ন নামের দুই উত্তুঙ্গ পর্বত। ৮ শতকে শঙ্করাচার্য এখানে এসে নারদ কুন্ড থেকে প্রাচীন দেবমূর্তি উদ্ধার করে তপ্তকুন্ডের কাছে গড়ুর গুম্ফায় প্রতিষ্ঠিত করেন। মন্দির তৈরি হয় আরও পরে। ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই মন্দিরের চূড়ো বাঁধিয়ে দেন সোনায়। চতুর্ভুজ দেবতার মাথায় রয়েছে মণি আর মাথার ওপর সোনার ছাতা। সামনে গড়ুর মূর্তি রূপো দিয়ে তৈরি। রয়েছেন নর নারায়ন ও কুবেরও। লক্ষ্মীদেবীর জন্য আলাদা মন্দির রয়েছে একই প্রাঙ্গণে। মনে করা হয় যে, অতীতের কেশবপ্রয়াগ আজকের বদ্রিবিশাল। দেবী লক্ষ্মী কুল গাছ অর্থাৎ বদ্রি হয়ে ছায়া দেন এখানে নারায়নকে।
ভারতে বিষ্ণুক্ষেত্র চারটি। বলা হয় যে, বিষ্ণুর জাগরণ বদ্রিতে, স্নান দ্বারকাতে, ভোজন পুরীতে আর শয়ান রামেশ্বরমে। বদ্রির মন্দিরে বসে আমার মনে হল, সর্বপ্রথম গিয়েছিলাম রামেশ্বরমে। তারপর দেখেছি পুরী। দ্বারকা শেষে আজ বসে আছি বদ্রিতে। আমার যাত্রা শেষ থেকে শুরু হয়ে শুরুতেই শেষ হল। এ এক পরম পাওনা। মাথা নত হয়ে এল আমার এক অশেষ শ্রদ্ধায়, রোমাঞ্চে। অনুভব করলাম স্বয়ং বিষ্ণু যেন তাকিয়ে আমার দিকে, হাসছেন মিটিমিটি। বোঝাতে চাইছেন, শেষ বলে কিছু হয় না, সব শেষেই থাকে শুরুর চিহ্ন। অথবা সব শুরুতেই থাকে শেষের কথা। কবি এলিয়টের ভাষায় 'In my beginning is my end'...
রাত কাটল তুমুল। জ্যোৎস্না প্লাবনে ভেসে গেল চারদিক। একের পর এক পাহাড়। বরফে ঢাকা শৃঙ্গে চাঁদের আলো সৃষ্টি করল এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। এই রূপ যে দেখে নি, সে বুঝবে না কোনোদিনই। তবে একই সঙ্গে প্রবল ঠান্ডায় জবুথবু দশাও হল। চোখের সামনে বালতির জল জমে গেল যেমন, তেমনি পাহাড় থেকে নামতে থাকা ঝর্না হয়ে গেল সাদা বরফের থমকে থামা ধারা! রাতের এই পাগল করা বাহার মনে আর গায়ে মেখে বিছানায় শুতে না শুতেই প্রবল ঘুম।
সকালে উঠে হৈ হৈ। চটজলদি রেডি সব। আগে মন্দির। ইতস্তত দোকানপাটের ভেতর দিয়ে মন্দিরের দিকে এগোতে না এগোতে কাল থেকে পাওয়া শব্দের রহস্যভেদ হল। ও আসলে জলশব্দ। বয়ে চলেছে অলকানন্দা। মন্দিরের সামনে দিয়ে। ব্রিজ রয়েছে নদীর ওপর। তার ঠিক নিচে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়া। বুঝলাম উষ্ণ প্রস্রবণ ওটি। ওখানে স্নান সেরে মন্দিরে পুজো দেয় পুণ্যার্থীরা। অলকানন্দার নিজস্ব জলগান, ভিড় করা মানুষদের সম্মিলিত কথা, দোকানপাট, মন্দির...সব মিলে দিনের আলোয় এক অন্য ঝলমলে বদ্রিনাথ। আজও ঢুকলাম মন্দিরে। তবে আজ আর পুজো নয়। শুধু দর্শন। আর তাতেই মিলল প্রশান্তি।

বদ্রি থেকে আট কিমি দূরের ধর্মশিলায় রয়েছে বসুধারা জলপ্রপাত। অসামান্য সেই জলপ্রপাত না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। সূর্যের কিরণে জলপ্রপাত থেকে বিচ্ছুরিত সাত রং আর গ্লেসিয়ার দেখা নিঃসন্দেহে অন্য অভিজ্ঞতা। বিষ্ণু গঙ্গার জন্মও এখানে। ফিরতি পথে বদ্রি থেকে ৩ কিমি দূরে ৩২০০ মিটার উচ্চতার মানা গ্রাম দর্শন। পাশে পাশে অলকানন্দা। মানা ভারতের শেষ গ্রাম। মানা থেকে পাহাড় টপকে ওপাশে চলে যাওয়া যায় তিব্বতে। এখান থেকে নীলকন্ঠ পাহাড়ের শোভা নজরকাড়া। গারোয়াল হিমালয়ের ছবির মতো সুন্দর মানা গ্রামেই দেখা মেলে সরস্বতী নদীর। ভীম বেগে সে এখানেই প্রবেশ করেছে মাটির তলায়। অন্তসলিলা সরস্বতীর দেখা মেলে আবার এলাহাবাদে ত্রিবেণী সঙ্গমে গঙ্গা ও যমুনার পাশে। খানিক দূরে অলকানন্দা। আর তার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথই নাকি মহাপ্রস্থানের পথ। শিহরন জাগে মনে সেই পথ দেখে! রয়েছে ব্যাস চৌকি আর গণেশ চৌকি। বিরাট সেই পাথরদ্বয়ে বসেই নাকি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মুখে মুখে বলেছিলেন মহাভারতের কথা, আর মহাজ্ঞানী গণেশ লিখেছিলেন তা। অলকানন্দা ও সরস্বতীর সঙ্গম স্থল কেশবপ্রয়াগে মহাপ্রস্থনের পথে ভীমের তৈরি ভীম পুল দেখাও সৌভাগ্যের। অলকানন্দা পেরোনোর জন্য দ্রৌপদীকে এই পুল তৈরি করে দিয়েছিলেন মধ্যম পান্ডব। চারদিকের অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য আর তার সঙ্গে মিশে থাকা ইতিহাস মুহূর্তেই মানার প্রেমিক বানিয়ে দিল আমাকে। ভারতের শেষ চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আসব আবারও, তা সে বৃদ্ধ হলেও!
এরপর সব শুরুর সেই শেষ শুরু হল। ফিরে এলাম বদ্রিকে পেছনে রেখে। এত দিনের ইচ্ছে পূরণ হল ঠিকই, কিন্তু সেই পূরণ জাগিয়ে তুলল আর এক ইচ্ছে! তার কথা অবশ্য আজ নয় আর....