স্মরণিকা 

‘মানুষের মুখ’: কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ন ন্দি নী  ঘো ষ



৪ নং ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডের বাড়ি থেকে বের হলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক, গন্তব্য কলকাতা বইমেলা।  ভদ্রলোক নিজের লেখা বই নিজেই বিক্রি করেন। মালকোঁচা মেরে ধুতি, পরনে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে পাওয়ার চশমা। কাঁধে একটা ঝোলা আর ঝোলার ভিতর মৃত্যু উত্তীর্ণ জীবনের দীর্ঘশ্বাস। উনি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (২রা সেপ্টেম্বর, ১৯২০ - ১১ জুলাই, ১৯৮৫)। যাকে প্রতিনিয়ত লড়তে হয়েছে অভাবের সঙ্গে, যিনি দেখেছেন পুঁজিপতি, ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিরন্ন, নিপীড়িত মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত- তিনি তো জানবেনই বেঁচে থাকা মানে সংগ্রাম, ক্ষুধার মানে ভাত।


“আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে

কারা যেন আজো ভাত রাঁধে

ভাত বাড়ে, ভাত খায়”


তিনি ভালবাসতেন চা, মুড়ি আর জিলিপি। বিড়ি, সিগারেটও চলত। ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরে জন্ম। কথা বলতেন ঢাকাই টানে। ছাতা, চটি, কলম, চশমা প্রায় হারিয়ে ফেলতেন। মাথায় কোন কবিতার লাইন এলে হাতের সামনে যা পেতেন তাতেই লিখে রাখতেন। যেমন ধরুন সিগারেটের প্যাকেট, বাসের টিকিট ইত্যাদি ইত্যাদি। কবি জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, “ভাল বাড়ি দেখে দিতে পারেন”।


প্রথম জীবনে কবিতা লেখার উৎসাহ পেয়েছিলেন বিমলচন্দ্র ঘোষ, অরুণ মিত্রের কাছ থেকে। রিপন কলেজে তাঁর অধ্যাপক ছিলেন বিখ্যাত দুই কবি বুদ্ধদেব বসু এবং বিষ্ণু দে। এঁদের দুজনের প্রভাব তাঁর কবিতা লেখার পথকে  প্রশস্ত করেছিল। বাইশ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়- ‘গ্রহচ্যুত’ (১৯৪২)। কবির প্রথমদিকের রচনাগুলিতে কবি বিষ্ণু দে-র প্রভাব স্পষ্ট। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও একাধিক প্রসঙ্গে বিষ্ণু দে-র ঋণ স্বীকার করেছেন। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত ‘লখিন্দর’ কাব্য থেকে স্বাতন্ত্র্য কবি প্রতিভা পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ছন্দের তিন রীতির ছন্দেই তিনি কবিতা লিখেছেন। কাব্যের কায়াশরীর নিয়ে তিনি যে সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ শব্দ চয়নে, প্রতীক ব্যবহারে এবং চিত্রকল্প ও মিথের নির্মাণে।


“ রাত্রি ভোর হয়

পদ্মের পাতায় জলে।

মন্ত্রগুলি

অবাক ভোরের পাখি

আর

আগুনের রঙে রাঙা মানুষের শোক জন্মভূমি

তোর পায়ে মাথা রাখতে সাধ হয়”।


কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা বিপুল, কিন্তু বেশির ভাগই ক্ষীণকায়। কবিতার কেন্দ্রবিন্দু মেহনতি ও শোষিত মানুষ ও সেই মানুষের স্বদেশ এবং পৃথিবী। তাঁর কবিতায় ভাষিত হয়েছে প্রতারিত মানুষের বেদনা, মানবতা বিরোধী ঘটনার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। অন্যদিকে রোমান্টিকের মতো সমাজ জীবনের সুন্দর স্বপ্নকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন। ‘মানুষ’ শব্দটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।


“যে মানুষ গান গাইতে জানে না

যখন প্রলয় আসে সে বোবা ও অন্ধ হয়ে যায়” 


কবিতাকে প্রতিবাদের আয়ুধ হিসেবে ব্যবহার করেছেন তিনি। ভিয়েতনাম হয়ে উঠেছে কলকাতা। তিনি রাজনৈতিক কবি, কিন্তু রাজনৈতিক হরফের ছাঁচে তৈরি কবি ছিলেন না। তাঁর কবিতা সংকেতময়, সংক্ষিপ্ত, তার অনুসঙ্গে মন্ত্রের গাঢ়তা ও গীতিকার নিবিড় উচ্চারণ।


“মাটি তো আগুনের মতো হবেই

যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো

যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও

তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি”  


কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে উদযাপন মানে লিটিল ম্যগাজিন নিয়ে উদযাপন। তিনি ছিলেন লিটিল ম্যগাজিনের মুখ, লিটিল ম্যগাজিনের কবি। বড় প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়েও তিনি অভাবনীয় জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তথাকথিত বড় পত্রিকায় খুব কমই লিখেছেন। বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অনুরোধে ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন। ১৯৪২ সালের কাছাকাছি সময় থেকে ‘অরণি’ তারপর ‘বসুমতী’, ‘কবিতা’, ‘পরিচয়’, ‘পূর্বাশা’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৬১-৬২ দেশ গোষ্ঠী যখন স্বাধীন সাহিত্যের সমর্থনে অনেক কথা বলতে শুরু করে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার বিরুদ্ধে ‘দর্পণ’, ‘বসুমতি’-তে সোচ্চার হন। 


তরুণ কবিদের প্রতি তাঁর ছিল গভীর মমত্ববোধ। কবিতা নিয়ে নিজেই পাঠিয়ে দিতেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকায়। কলকাতার পোশাকি সভাসমিতির আড়ম্বর উপেক্ষা করে পছন্দ করতেন গ্রামগঞ্জের তরুণ লেকক কবিদের ছোটো সভা। তিনি মনে করতেন, প্যাশন, ভিশন, মিশন- এই তিনটির কোন একটি কবিতায় প্রবল ভাবে থাকলে সে কবিতা পাঠককে টানবেই।


জগবন্ধু ইন্সটিটিউশনে ক্লাস সেভেন পড়ার সময় অনুশীলন দলে যোগ দেন- দেশকে স্বাধীন করার জন্য। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি কথা প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীদের প্রতি ঘৃণামিশ্রিত কটূক্তি করেন, ব্যথিত হয়ে দল ছেড়ে দেন। তাঁর জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করেছে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মনন। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির (CPI)  সদস্যপদ লাভ করেন। রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন, কারাবাস করেছেন। তবে ব্যক্তিগত সমর্থন থাকলে তবেই সভা, সমিতি, মিছিলে যেতেন। দলীয় সংকীর্ণতা, ক্ষমতা লোভের চেষ্টার ঊর্ধে ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে পার্টির আক্রমণাত্মক মনোভাবকে স্বীকার করেত পারেন নি। পারেন নি ৪২-এর আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে সমর্থন করতে। জার্মানির রাশিয়া আক্রমণে তিনি প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। তাঁর মতে রাজনীতি সরল ও স্পষ্ট হওয়া উচিত। 


“তোমার কাজ

আগুনকে ভালোবেসে উন্মাদ হয়ে যাওয়া নয়

আগুনকে ব্যবহার করতে শেখা”


লোকায়ত বাংলার চিত্রকল্প তাঁর কবিতা। তাঁর “রাজা আসে যায়” বাংলার এক প্রবাদ বাক্য রূপে স্থান করে নিয়েছে। তাঁর লেখা বহু কবিতায় সুর সংযোজন করে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, অজিত পাণ্ডে, অসীম ভট্টাচার্য, অমিত রায় প্রমুখ বিশিষ্ট গণসঙ্গীত শিল্পীরা পরিবেশন করেছেন।   


সময়, স্বদেশ, মনুষ্যত্বকে একসূত্রে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গাঁথতে চেয়েছিলেন। দেশভাগে আক্ষেপ করে বলেছেন, “আমার জন্মভূমিকে এখন আমি স্বদেশ বলতে পারি না”


কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আজও ‘মানুষের মুখ’। কবিবন্ধু জগন্নাথ বিশ্বাসের সঙ্গে ‘বক্সা পাহাড়ের জন্য’ (১৯৭৮) নামে একটি যৌথ সংকলন প্রকাশ করেন। বই বিক্রির টাকা বক্সার পীড়িত পাহাড়ি মানুষদের উন্নয়নের জন্য দান করেন। তিনি বলতেন, “ছত্রিশ হাজার কবিতা না লিখে যদি আমি মাটিকে জানতাম"। কবির স্পষ্ট স্বীকারোক্তি-


“আমাকে একটা রক্তগোলাপ দিও

কিন্তু দোহাই তোমার

তার আগে আমকে একটুকরো রুটি দাও

পোড়া বাসি, ভেজালমেশানো, জাই হোক

এখন সবার আগে আমার রুটি চাই”।


RSP দলের রাজনৈতিক যোগ থাকায় বাঘা যতীন স্কুলে যোগ্যতা থাকা সত্বেও চাকরি হয় নি। পুরস্কার সম্মাননা হাতে গোনা। ১৯৮২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’-এ সম্মানিত করে। নিজের বোধ কারোর কাছে বন্ধক দেননি কখনও- চির উন্নত শির। শিরদাঁড়া টানটান করে কালোকে আজীবন কালোই বলে গেছেন। 


“আমার প্রতিবাদ শুধু সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে। আমার সমর্থন শুধু নতুন সমাজ ব্যবস্থার চিন্তার প্রতি”



★ তথ্যঋণ :

১। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, ১ম খণ্ড

২। সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী সাহিত্য সংসদ

৩। বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

৪। ‘সোঁতা’ বইমেলা সংখ্যা, ২০০১

৫। আনন্দবাজার পত্রিকা, অনলাইন সংস্করণ

৬। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ দেবেশ কুমার আচার্য

৭। উইকিপিডিয়া

৮। ইন্টারনেট