ভ্রমণ 

গা জ ল ডো বা
মধুমিতা রায় চৌধুরী মিত্র

মি বাঙালি। কথায় আছে বাঙালিরা নাকি  ভ্রমণ পিপাসু। আমি এতে সহমত। কারণ আমি নিজেও তাই। আজ অবধি দেশ হোক বা বিদেশ, যত জায়গা ঘুরেছি, সব জায়গাতেই সবের মধ্যে কোনো বাঙালি পরিবার ঠিক চোখে পড়েছে। 
যাইহোক কোলকাতাতে শীতের হওয়া দিলেই আমার মনে কেমন একটা খুশিখুশি ভাব জাগে। মনে হয় কোথাও একটা দিই ছুট। 
গত বছর নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে খবর পেলাম গাজলডোবা নাকি পাখিদের কোলাহলে মুখর হয়ে গেছে। গাজলডোবা হলো জলপাইগুড়ি ওদোলবাড়ি অঞ্চলের ছোট্ট একটি গ্রাম। 
গাজলডোবা ঘুরতে মাত্র একটি বেলা লাগে। কিন্তু কেউ যদি নিরিবিলিতে প্রকৃতির কোলে সময় উপভোগ করতে চান তাহলে যতদিন খুশি থাকতে পারেন।
খবর পেয়েই মনটা ব্যস্ত হয়ে উঠল। 
এদিকে উত্তরবঙ্গে নভেম্বর মাসে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা।
 তাও আমার স্বামীর কাছে আবদার করতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের উদ্দেশ্য শুধু পাখি আর তিস্তা তাই মাত্র একদিন কি দুদিন ছুটি নিলেই যথেষ্ট। 
উনি যদিও, ৩ দিনের ছুটির জন্য দরখাস্ত করে দিলেন। ছুটি মঞ্জুরও হয়ে যায়। 
গাজলডোবা! তাও আবার ৩'দিন "আমাদের কাছে বেশি হয়েও অনেক বেশি '--- এটা বলাতে উনি বলেন কারণটা ওখানে গেলেই জানা যাবে। একে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ তার ওপর আবার সারপ্রাইজ। মনটা একেবারে নেচে উঠলো।
কিন্তু অক্টোবরের শেষ থেকে গাজলডোবা বা ডুয়ার্স অঞ্চলে পর্যটকদের ভিড় থাকে। যাওয়া আসার টিকিট আর থাকার মতন ভালো হোটেল পাওয়া দুষ্কর। 
ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে না এটা আগের থেকেই জানা। তাই আমারা বাস বা ফ্লাইটের টিকিট খুঁজতে থাকি। 
২৩'এ নভেম্বর শনিবার বাসের টিকিট কাটা হল। আর ২৬'এ নভেম্বর মঙ্গলবার ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া গেলো। কিন্তু হোটেল??? 

আমাদের এক পারিবারিক বন্ধু চমৎকার ব্যবস্থা করে দিলেন 'ভোরের আলোতে'- (পশ্চিমবঙ্গ পর্যটক বিভাগের)। এটাকে লটারি পাওয়াই বলে। কারণ ভোরের আলো রিসোর্টে বুকিং অনেক আগের থেকেই হয়ে যায়।
যাই হোক এবার যাত্রা শুরু করি--------
২৩'সে নভেম্বর শনিবার বিকেল ৫.৩০মিনিটে এসপ্লেনেড থেকে রয়্যাল ক্রুসারের (ভলভো) বাসে করে যাত্রা শুরু করি। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি বাসে বা গাড়িতে ১৫ঘন্টার (নিজস্ব অবিজ্ঞতা) মতন লাগে। কারণ উত্তর দিনাজপুরের ন্যাশনাল হাইওয়ে বেশ সংকীর্ণ এবং একদমই মসৃন নয়। তাই সময় এতটা বেশি লাগে। 
পরের দিন-------
২৪'সে নভেম্বর সকাল ৮'টা নাগাদ শিলিগুড়ি বাস টার্মিনালে পৌঁছে বুঝলাম যে পর্যটকদের কেমন ভিড়।
 সেখানে আমাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা আগের থেকেই করে রেখেছিলাম। দেখলাম আমাদের চেনা এক নেপালি ড্রাইভার একটি লাল লিভা গাড়ি নিয়ে দাড়িঁয়ে হাসছেন। নাম গুঞ্জা। খুব হাসি, খুশি, মিশুকে একটি অল্প বয়েশি ছেলে। পাহাড়ে এলে ওর গাড়িতেই ঘুরি। ও আমাদের ড্রাইভার কাম গাইড কাম হেলপার। যত বুকিংই থাক গুঞ্জাকে একবার ফোন করে দিলে ও ঠিক একটা ব্যবস্থা করে রাখে।
এখন তিস্তা নদীর ওপর 'তিস্তা ব্যারেজ' হওয়াতে শিলিগুড়ি থেকে এইসব অঞ্চল বা ডুয়ার্স যাওয়ার পথ বেশ সুগম হয়েছে।

শিলিগুড়ির বাস টার্মিনাল থেকে গাজলডোবা মাত্র ৩৫ কিমি। যেতে লাগে এক ঘন্টা। আমরা অবশ্য এক ঘন্টার খানিক আগেই পৌঁছলাম আমাদের 'ভোরের আলোতে'। বেশ মনোরম একটি রিসোর্ট। সব রকম অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আছে। রিসোর্টের কর্মচারীদের আতিথেয়তা হৃদয় কাড়ে।
আমরা আগেই স্নান করে একটু ভারী প্রাতঃরাশ করেনিলাম। গুঞ্জাও রেডি।
১১ টার মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। যাদের টানে এতদূর এলাম তাঁদেরকে আগে দর্শন করা উচিত। এবং তাঁরা হলেন পরিযায়ী পাখির দল। যদিও তিস্তা ব্যারেজ থেকেই তাঁদের ওড়া উড়ি চোখে পড়েছিল।
 বলে রাখি এখানে তিস্তা একদম শান্ত শিষ্ট নিরীহ এবং প্রশস্ত। চার পাশে জঙ্গল এ ঘেরা। শান্ত, সবুজ, বিস্তৃত এই প্রকৃতির মাঝে শীতের শুরুতেই মধ্য এশিয়া, ইউরোপ ও পৃথিবীর অন্যান্য জায়গা থেকে দল বেঁধে চলে আসে পরিযায়ী পাখির দল। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে জলে, ডাঙায়, আকাশে সব জায়গায় পাখি। মানে শুধুই পাখি। আর এটাই গজলডোবার আকর্ষণ। 

আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নদীর বুকে ভাসতে ভাসতে পাখি দেখা। যাঁরা তিস্তায় মাছ ধরেন, তাঁরাই নৌকা করে নিয়ে যান নদীতে। এখানে মাঝিরাই হল 'মাঝি কাম গাইড'। প্রায় সব পাখির নাম আর তাদের ডাক মাঝি-ভাইদের একেবারে মুখস্ত। এমনকি কোন পাখির ঝাঁকের হদিস কোথায় হতে পারে, সে আন্দাজও তাঁদের জানা। তবে এখানকার নৌকাগুলি বেশ সরু। মাঝি ছাড়া দু’জনের বেশি জায়গা হয় না একটায়।
তাই গুঞ্জা গাড়ি নিয়ে পাড়েই থাকলো আর আমরা একটি নৌকা ভাড়া নিলাম। দাঁড় টেনে কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ল একঝাঁক রাডি শেলডাক। তাদের কমলা ডানা দেখে চোখ সার্থক করতে না করতেই চোখ চলে গেল দূরে ভেসে যাওয়া আর একদল নর্দার্ন পিনটেলের দিকে। তাদের থেকে চোখ সরাতেই উড়ন্ত মালাড। উফফ!!!  মানে কাকে ছেড়ে যে কাকে দেখবো তাই বুঝে উঠতে পারছি না।
 কিছু দূর যাওয়ার পরে দেখি, তিস্তার নীল জল আর সবুজ পাহাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা! এমন চমৎকার ভূদৃশ্য বাকরুদ্ধ করিয়ে দিল কিছুক্ষণের জন্য। আমি প্রায় ওই রূপ দেখে অসাড় হয়ে গেলাম। ছোটবেলায় যেমন ছবি আঁকতাম। একটি নদী, তারপর জঙ্গল আর সবার শেষে বিশাল পাহাড় ঠিক তেমনি। তাহলে বোঝাই যায় ছোটোদের কল্পনা-শক্তি কতটা সুন্দর।  
দার্জিলিং-গ্যাংটক, আমার অগুনতি বার যাওয়া। কাঞ্চনজঙ্ঘা আমার বহুবার বহুরকম ভাবে এবং বহুদিক থেকে দেখা। কিন্তু এই তিস্তার মাঝে তাঁর এই রূপ দেখে যে কেউ স্থির হয়ে যাবেনই।
এক সময়ে নৌকা এসে থামল একটি চরে। 
সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে রেড নেপড আইবিস, রিভার ল্যাপউইং, লিটল রিংড প্লোভার, নর্দার্ন ল্যাপউইং... আরও কত কী!
 অবাক হয়ে শুনছিলাম মাঝি-ভাইটির মুখে এমন উচ্চারণ। সে যখন আমাদের সঙ্গে কথা বলে তখন একেবাই উত্তোরবঙ্গীয় বাঙালিদের মতো উচ্চারণ করে, কিন্তু বিদেশি পাখিগুলোর নাম নিখুঁত ইংরেজিতে বলে। 
সত্যি মানুষ হৃদয় দিয়ে অভ্যাস করলে কি না পারে। এর মাঝে আমি ,মাঝি-ভাইয়ের থেকে যাচাই করে নিলাম একটি খবরের কাগজে পড়া তথ্য। 
সেটি হলো এই যে দূরে জঙ্গলটির নাম 'বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল',, উক্তিটি হলো এই যে 'ওই জঙ্গলে রুক্মিণীকে নিয়ে  শ্রীকৃষ্ণ পালিয়ে এসে লুকিয়েছিলেন'। মাঝি-ভাই একগাল লজ্জা মাখানো হাসি হেসে জানায় ওরাও এসব শুনেছে লোকমুখে। সত্যি হলেও আশচর্য হবো না কারণ এমন প্রকৃতির মাঝে আমারই তো ইচ্ছে হচ্ছিল হারিয়ে যেতে। 
মাঝিটির নাম বাবলা।  সে কলকাতা দেখেনি। যখন জানতে পারে আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, তাঁর প্রথম প্রশ্ন ছিল ভিক্টোরিয়ার মেমোরিয়াল হলকে নিয়ে, এবং আরো বেশ কিছু টুকটাক। বুঝলাম তাঁরও কলকাতা ভ্রমণের বেশ শখ।
 গল্প করতে করতে দেখা মিলল গুজ়্যান্ডার, লিটল ইগ্রেট, কমন শেলডাক, লেসার হুইসলিং ডাক, টাফটেড ডাক, গ্রে হেডেড ল্যাপউইং, লিটল গ্রেব, কমন টিল, পার্পল হেরন-সহ আরও অনেক পাখির।
এই সময়টায় স্থানীর পাখিদেরও সংখ্যা বেশি। বাবলা-মাঝি যে এত নাম কি করে মনে রাখে জানিনা। আমি একটু লেখা-লেখি করি তাই সব কটা নাম মোবাইলের নোটপ্যাডে নোট করছিলাম।
দিনের আলো কমে আসছে তাই এবার পাড়ের দিকে চললাম।
ফিরতে ফিরতে তিস্তাকে কথা দিয়ে এলাম আবার এসে ভাসবো তোমার বুকে। আবার দেখবো চখাচখিদের নয়ন ভরে।
ফিরে এলাম 'ভোরের আলোতে'। ফিরতেই কেমন একটা খাইখাই ভাব।  তাই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে, একদম ডিনার করে নিলাম।
পরের দিন ২৫'এ নভেম্বর সোমবার। সকাল হলো আমাদের ৯.৩০'এ। উঠেই সারপ্রাইজটি জানতে পারি, যে আমরা বাগডোগড়া যাব। গুঞ্জাকে আগের থেকে নাকি সব বলা।
ভাবছেন এত জানা কথা, প্লেনে ফিরবো তো জানি। তাহলে সারপ্রাইজ কিসের।
তাহলে বলি আমার জেঠিমার বাড়ি বাগডোগড়া। সেখানে আজ থাকবো। জেঠিমাকে দেখিনি প্রায় এক যুগ। এর থেকে বড় সারপ্রাইজ আর কি হতে পারে।
তাই সেদিন একেবারে লাঞ্চ করেই বেরোলাম। 
সুস্বাদু বরোলি মাছের ঝাল সহযোগে ভাত। উত্তরবঙ্গের খুব নামকরা মাছ।
ছোটবেলায় জেঠিমার বাড়ি এলে এই মাছ রোজ খেতাম। 
আমরা দুপুর ১২.৩০ মধ্যেই চেক আউট করলাম হোটেল থেকে। এবার  ৪৫কিমি পথ। 
যেতে যেতে তিস্তা ব্যারেজ থেকে উড়ন্ত পাখিগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। 
বাগডোগড়াতে আমার জেঠির বাড়ি এসে পৌছোলাম প্রায় দুপুর ২'টোয়। উনি অবশ্য আগেই জানতেন। আমায় পেয়ে জড়িয়ে ধরলেন।
আমরা গুঞ্জাকে বিদায় জানালাম। 
সেদিন বাগডোগড়াতে কাটালাম বেশ অনেকদিন পর। 
পরেরদিন ২৬'এ নভেম্বর মঙ্গলবার। 
আমাদের ফেরার পালা। দুপুর ৩'টেতে কলকাতা আসার ফ্লাইট। তাই ১২'টার মধ্যেই খেয়ে বেরিয়ে পরলাম। 
কলকাতার মাটিতে পা রাখলাম বিকেল ৪'টেতে।
কিন্তু সারাক্ষণ যেন সেই পাখিদের নানান ধরনের শব্দ যেন কানে কানে বলে চলেছে---"পরের বছর আবার আসবি। দেখা হবে।" 

© ছবি: লেখিকা