রম্যরচনা 


ভ-এ ভবাদা
স্ব প ন  না গ

বাদা হন্তদন্ত হয়ে বলল, 'শোন্, এই কেসটা একটু হাতে নে তো !'
         আমি বললাম, 'কেস ! কিসের কেস ?'
         চলতি ভিড় থেকে আমাকে টেনে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল ভবাদা, 'দিন দশেক হল রূপার সঙ্গে বিল্টুর কথাবার্তা নেই। বিষয়টা সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করে একটা মিটমাটের ব্যবস্থা কর। এটা তুই-ই পারবি।'
         -- 'যাব্বাবা ! আমি কী করব ? এটা তো ওদের এক্কেবারেই ব্যক্তিগত ম্যাটার !'
         -- 'বললুম তো। তুই-ই পারবি। শো-কেস দেখে আমি গোডাউনের ক্ষমতা টের পাই বাবা !'
        আমার ওপরে ভবাদার এই অগাধ আস্থায় আমি তো হতবাক।
        শ্যামা কোথায় ছিল কে জানে ! হঠাৎ ভুঁইফোড়ের মত উদয় হয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী কেস গুরু ?'
        ভবাদার কথাগুলোই শ্যামাকে ট্রান্সফার করতেই ওর চটজলদি জবাব, 'আমাকে কেস দিও না ওস্তাদ। যেচে কেস খেতে আমি রাজি নই।'

     ভবাদা, মানে ভবতোষ রক্ষিত একবার আমার দিকে, একবার শ্যামার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল শুধু। কিছু বলল না। ভবাদা এরকমই। মজার মানুষ, পরোপকারীও।

     ভবাদাকে আমরা খুব ভালোবাসি। দরকারে একটু আধটু ভয়ও করি। ভক্তি, তাও যে কখনো সখনো করি না, তাও নয়। অ-এ অজগরের মত আমরা যে ভ-এ ভবাদা বলি, ভবাদা খুব ভালো ভাবেই জানে। পুলক তো বলে, ভবাদা আমাদের ভগবান !
    
       সেই ভবাদার শব্দকোষে অদ্ভূত অদ্ভুত সব শব্দ আর ততোধিক অদ্ভুত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ তাদের প্রয়োগ।
       একটু থেমেই নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, দাঁড়া, বিল্টুটার খুব তেল বেড়েছে। রূপার সঙ্গে মিটমাট করার জন্য এত তেল মারছি আর কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না শালা। আরে বাবা, এতই যখন দেমাক, প্রেম করতে গেছিলি কেন ? শালা প্রেমপত্রে আবার সুনীল গাঙ্গুলী কোটি করছে 'যদি নির্বাসন দাও ওষ্ঠে অঙ্গুরীয় ছোঁয়াব। আমি বিষ পান করে মরে যাব।' আর এখন দর বাড়াচ্ছে !
       এবার আমাদের দিকে ঘুরে, 'যা-ই বলিস, বিল্টু কিন্তু একটা বিষ মাল ।'
       সমর্থন বা প্রতিবাদ, আমাদের তরফে কিছুই না পেয়ে ভবাদা বোধহয় কিছুটা বিরক্ত। রোগা-পাতলা চেহারার ভবাদাকে দেখে বোঝা মুশকিল ঠিক রাগ করেছে কিনা !
       একটানা কথাগুলো বলার পর ভবাদাই বলল, 'মেজাজটা তোরা পাতলা করে দিলি। এখন তোরা পাতলা হ' দিকি। ব্যাপারটা দেখছি আমাকেই মেটাতে হবে।দাঁড়া, বিল্টুটার বিষ ঝাড়ছি।'

     ব্যাপারটা শেষমেশ মিটেছিল কিনা জানি না। সপ্তাখানেক পরে বাদামতলা বাজারে দেখা ভবাদার সঙ্গে। দূর থেকেই হাঁক পাড়ি, 'ভবাদা --'
     ভবাদা ঘুরে তাকাতেই হাত তুলে বলি, 'জয় শ্রীরাম।'
     'জয় শ্রীরাম' বললে ভবাদা রেগে যায়, জানি।আজ কিন্তু রাগ করল না। বলল, 'শালা ভূতের মুখে রাম নাম !'
     -- 'এখন বাজারে কিন্তু রাম খুব হিট ভবাদা।'
     -- 'শুধু বাজারে কেন রে শালা, শ্মশানেও তো বহু যুগ ধরে হিট। শুনিসনি, মড়া কাঁধে নিয়ে দল বেঁধে রাম নাম সত্য হ্যায় বলতে বলতে যায় !'
     বিষয়টা স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে দেখে কথা ঘোরালাম। বললাম, 'বিল্টুর খবর কী ?'
     ভবাদা এবার স্ব-রূপে ফিরল, 'শালা ও একটা রাম পাঁঠা।রাম দা দিয়ে কোপালে গায়ের রাগ মেটে।'
     উসকানোর জন্য বলি, 'রাম রাম, এসব কী বলছ ?'
     -- 'যা বলছি, ঠিক বলছি। রূপার সঙ্গে যা করছে, তাতে বলতে পারি, বিল্টু একটা রাস্কেল।'
     হঠাৎই জিভ কেটে বলল, 'এ রাম, লেবু নিতে বলেছিল রে। একেবারে ভুলে মেরেছি। '
     বলেই বাজারের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।


     ভবাদা কথায় কথায় রাগে যেমন , ঠান্ডাও হয়ে যায় চটপট। রাগ পুষে রাখা ভবাদার ধাতে নেই। সে বার দলবেঁধে আমরা মধুপুর গেলাম। আমি, ভবাদা আর সঙ্গে পুলক, গোবিন্দ আর শঙ্কর। হাওড়া স্টেশনে রিজার্ভেশন ছাড়াই যোগ দিয়েছিল শ্যামাও। একেবারে টেনিদা অ্যান্ড আদার্স। আমাদের মধ্যে ভবাদাই একটু সিনিয়র। রাতের জার্ণি। ভোরে মধুপুর। ক্যাঁচাল বাঁধল আপার বার্থে শোওয়া নিয়ে। ধুরন্ধর পুলক শুরু করল, 'আমাদের মধ্যে আপার বার্থে চড়বার ফিটনেস একমাত্র ভবাদারই আছে।'         খুব বেশি বলতে হয়নি। ভবাদা তরতর করে আপার বার্থে চড়ে বসল। ব্যাপারটা এত সহজে মিটে যাবে আমরা কেউই ভাবিনি। আপার বার্থে চড়ে , বেশ গুছিয়ে বসে ভবাদা তারপর মোক্ষম বাণীটি দিলে -- 'শোনো বাচ্চুরা, একটা কথা মনে রেখো, গ্যাস খায় যে লোক, আর গ্যাস দেয় যে লোক, তারা আর যাই হোক, একসাথে বেড়াবার সঙ্গী হতে পারে না।' কটাক্ষের হুলের তীক্ষ্ণতায় আমরা সবাই তখন বিদ্ধ। গোবিন্দ শুধু ভবাদার বাণীর মর্মোদ্ধার করতে না পেরে অসহায়ের মত তাকিয়ে ছিল। ভবাদাই রহস্য ভাঙার ঢঙে বলল, 'ও শালা চিরকালই টিউবলাইট। দেখ্ দেখ্ এখনও দপদপাচ্ছে।'
     মুহূর্তে পরিবেশটি স্বাভাবিক হয়ে গেল। এরপর ঘুমটুম শিকেয় তুলে শুরু হল এ ওর পেছনে লাগা।বলা বাহুল্য, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হল ভবাদাই। আপার বার্থে আধশোয়া হয়ে ভবাদা আবৃত্তি করতে শুরু করল, 'আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি...' ব্যাস্ ! তারপরই শুরু হল শঙ্করের কাঠি করা। গোবিন্দ সাধারণত চুপচাপ থাকে। আমাদের সব্বার এ ধারণায় ভবাদা একেবারেই সহমত নয়। তার মতে চুপচাপ বসে থেকে কলকাঠি নাড়ে আসলে গোবিন্দই। ভবাদার দেওয়া এই অপবাদের আমরা যৌথভাবে প্রতিবাদ করি। আমাদের পাড়ার ফুটবল টিমের গোলকিপার গোবিন্দ। মাঠের তিনকাঠি আগলানো বাদে অন্য কোনো ব্যাপারে গোবিন্দর যে বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই, কথায় কথায় আমরা তা প্রতিষ্ঠিত করতেও দল বাঁধি। কিন্তু ভবাদা মানতে নারাজ। বোঝাতে গেলে বলে, 'ও তোরও এককাঠি ওপরে।'
     রাত অনেক হল। ট্রেন ছুটছে। বাইরে জ্যোৎস্না। ভবাদা ঝুঁকে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে খানিক উদাসীন। আড়ালে আমরা সবাই এ নিয়ে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছি। ভবাদাকে আজ কবিতায় পেয়েছে। সুকান্ত ছেড়ে এবার ছোটবেলার সুখলতা রাওয়ে -- 'ফুটফুটে আঙিনায় ধবধবে জোছনায় একখানি মাদুর বিছায়ে...।' শঙ্কর একটু তোতলা। সেও ফুট কাটতে শুরু করল। 'লোহে সে লোহা কাটতা হ্যায় ঠাকুর' শোলের ডায়ালগের পরেই উল্টোদিকে মুখ করে সে আবৃত্তি করতে শুরু করল 'ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।'
     ভবাদা বুঝতে পারল শঙ্কর তাকেই টার্গেট করেছে। রেগে আধশোয়া থেকে তড়াক করে উঠে বসে লোয়ার বার্থে বসা শঙ্করের দিকে আঙুল তুলে হুমকি দিল, 'শোন্ শঙ্কর, বেশি লাগলে এই মাঝপথেই কিন্তু তোকে ফুটিয়ে দোবো, বলে দিলুম। শালা, মুখে এখনও ঠিকমত কথা ফোটেনি, আবৃত্তি মারাচ্ছে !'
     কপট রাগ দেখিয়ে আমি দু'জনকেই থামাই। পরামর্শ দিই, 'ভাইসব, জার্ণিতে এমন কিছু ক'রো না যাতে কেউ কারোর দিকে আঙুল তুলে কিছু বলতে পারে।' ভবাদা তাতেও রেগে গেল। বলল, 'এই যে সাধু যুধিষ্ঠির, আঙুলবাজি বন্ধ করো। আমি সব বুঝি। কোন্ রোগের কোন্ ওষুধ আমি ভালোই জানি। ঘি সোজা আঙুলে না উঠলে বাঁকাতে হয় সেটা ভুলিনি।'
      ভবাদার হাড়হিম শাসানিতে আমি একেবারে চুপ হয়ে যাই।
       ঘুমোই না কেউই। ভোরেই মধুপুর স্টেশন। হৈ হৈ করে নেমে বুককরা হোটেলে পৌঁছে যাই। খাওয়া ঘোরা আর দেদার আড্ডায় নিমেষে কেটে গেল দুটো দিন।


     ফেরার জার্ণি দিনের বেলায়। আমরা সজাগ ছিলাম, ফিরতি পথে কোনো রকম মনোমালিন্য যাতে না হয়, সে ব্যাপারে। দুটো লোয়ার বার্থই আমাদের। পাশাপাশি আর মুখোমুখি ছ'জন মিলে এবার ফেরার পালা। ঠিক হল, কবিতা নয়, ফিরবার জার্ণিতে হবে শুধু গান। আমাদের মধ্যে শ্যামাই একটু আধটু গান জানে। সবাই ধরলাম ওকে। ভবাদা বলল, 'গা।' ভবাদার কথায় শ্যামা কোনো গা করল না। ভবাদা চেঁচিয়ে উঠলো, 'নে গান ধর।' একটু ভেবে নিয়ে শ্যামা গাইতে শুরু করল, ' ধরো কোনো এক শ্বেতপাথরের প্রাসাদে আমার এই গানের পাখি সোনার খাঁচায় বন্দি যদি রয়...।' সঙ্গে সঙ্গে পুলক যন্ত্রানুষঙ্গে অ্যাক্টিভ হয়ে গেল। একটা টিফিন বক্সেই তবলার টোকা। গিটার আর ড্রামের এফেক্ট মুখেই। ভবাদা তখন চোখ বুজে মগ্ন শ্রোতার ভূমিকায় দেশলাই বাক্সেই তাল ঠুকছে। শ্যামা গান থামাতেই উৎসাহিত গোবিন্দও শুরু করল, 'আয় তবে সহচরী হাতে হাতে ধরি ধরি নাচিব ঘিরি ঘিরি গাহিব গান...' জমে উঠেছে গানের আসর। ভবাদা নিজেকে সামলাতে না পেরে গোবিন্দর গানের শেষেই চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে গেয়ে ওঠে, ' চরণ ধরিতে দিও গো আমারে নিও না সরায়ে...'
     ট্রেন ছুটছে। গাছপালা ঘরবাড়ি ছোট ছোট স্টেশন পিছন দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমাদের দলটির মাতামাতিতে সহযাত্রীরাও সমর্থনসূচক উঁকিঝুঁকি মেরে যাচ্ছে। শঙ্করকে বললাম, 'এবার হিন্দি গান গা।' এমন প্রস্তাবের অপেক্ষাতেই ছিল যেন ও। সঙ্গে সঙ্গে গেয়ে উঠল, 'ও হাওয়া হাওয়া মুঝকো উড়া লে আ জা আ জা ও মেরে দিল কো চুরা লে...' যন্ত্রানুষঙ্গে এবার সবাই।
     লাইভ প্রোগ্রামের মধ্যে টিকিট চেকার এসে রসভঙ্গ করে দিল। ভবাদার কাছে রাখা ছিল আমাদের টিকিট । ছ'টা টিকিটের হিসেব মাথা গুনে বুঝে নেবার সময় খেয়াল হল, গোবিন্দ নেই।
     পুলক বলল, 'গোবিন্দটা কোথায় যে হাওয়া হয়ে যায় !'
     বলতে বলতেই গোবিন্দ একটা কাগজের প্যাকেট হাতে নিয়ে সহাস্যে গানের আসরে জয়েন করল। তারপর প্যাকেট থেকে কিসের যেন একটা একটা করে সবার হাতে তুলে দিল।
     কৌতূহলী সব্বার জিজ্ঞাসা, 'কী রে ?'
     সারপ্রাইজ দেবার ঢঙে প্যাকেট খুলে বলল, 'হাওয়াই মিঠাই।'
     'ভালোই হল -- হাওয়া গানের সঙ্গে হাওয়াই মিঠাই' , নিজের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে শঙ্করের দার্শনিক মন্তব্য।
     আমি যোগ করি, 'হাওয়াই মিঠাই-ই শুধু নয়, লক্ষ্য করেছিস গোবিন্দর পায়ে ওটা কী ? হাওয়াই চটি।'
     'সততার প্রতীক', ফুট কাটল ভবাদা।

   খানিক পরেই ট্রেন হাওড়া স্টেশনে। আড্ডায় গানে গল্পে এত চমৎকার ও দ্রুত সময় কাটল, যেন ট্রেন নয়, হাওয়াই জাহাজে যাত্রা করেছি আমরা !